ঠিক অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন হারাল লকেটটা। প্রথমে গুনগুন খেয়াল করেনি। স্কুল থেকে ফিরে জামাকাপড় ছেড়ে খেয়েদেয়ে সবে পড়তে বসেছে এমন সময় পেনসিল বক্সটা খুলে খেয়াল হল যে লকেটটা নেই! অবশ্য লকেটটা তো আর হারে করে গলায় পরা নেই। ওদের স্কুলে ঐ সব হার আংটি ইত্যাদি পরা বারণ কিন্তু গুনগুন ওটা স্কুলে নিয়ে যাবেই, ওটা নাকি ওর ‘লাকি চার্ম’। তাই মা ওটাকে একটা কাগজে মুড়ে পেনসিল বক্সে রেখে দিয়েছেন। দিব্যি চলছিল সেই ভাবেই এতদিন আর অঙ্কের পরীক্ষার আগের দিনই কিনা…
গত বছর পুজোর পর ওরা সবাই দিঘা বেড়াতে গিয়েছিল। সবাই মানে মা, বাবা, গুনগুন আর ওর দিদি মুনমুন। সেখানে সমুদ্র সৈকতে বালির মধ্যে ওটাকে খুঁজে পেয়েছিল গুনগুন। খুঁজছিল ঝিনুক আর পেয়ে গেল লকেট। পাথরের তৈরি একটা লকেট, তাতে বেড়ালের মুখ দেওয়া একটা মেয়ের প্রতিকৃতি খোদাই করা। জিনিসটা দেখতে বেশ সুন্দর। গুনগুনের দিদি লকেটটাকে হাতে নিয়ে এক ঝলক দেখে ওকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “ওটা কে জানিস?”
গুনগুন ভয়ে ভয়ে বলল, “না, জানি না। কে বেড়াল মাতা?”
“ধুস! তুই একটা হাঁদারাম! ওটা বাস্তেত! বেড়াল দেবতা থুড়ি দেবী, ‘ক্যাট গডেস’। ইজপ্টের লোকেরা ওকে পুজো করে। আমরা স্কুলে পড়েছি।”
“বাস্তেতের লকেট! আমি তাহলে এটা পরব!” গুনগুন ঘোষণা করল।
মা তো তাই শুনে হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “কী জানি কার জিনিস বাপু!”
তবে বাবা দেখে বললেন, “দামি নয়। পাথরের তৈরি তবে দামি পাথর নয়।”
গুনগুন তো কিছুতেই ছাড়বে না তাই হোটেলে গিয়ে জিনিসটাকে ভাল ধুয়ে টুয়ে ওকে দেওয়া হল। দিঘাতে সময়টা ভালই কাটল ওদের সবার। গুনগুন শেষ দিন বালি থেকে একটা বেশ বড়সড় শাঁখ পেয়ে গেল। তখন থেকেই পাথরের ওই লকেটটা লকেট থেকে ‘লাকি চার্ম’ হয়ে গেল।
দিঘা থেকে ওরা যখন ফিরল তখন ওদের দুদিন স্কুল কামাই হয়ে গেছে। স্কুলে গিয়ে গুনগুন দেখল সেদিন অঙ্কের ক্লাস টেস্ট। ভীষণ ভয় পেয়ে গেল সে। কিন্তু অবাক কান্ড, টেস্টে পঁচিশে পঁচিশ পেয়ে গেল সে! আগে কোনদিন প্রচুর পড়াশোনা করেও যা পায়নি! কোন কিছুই বদলায়নি শুধু ওর পেনসিল বক্সে রাখা কাগজে মোড়া ওই বাস্তেতের লকেটটা ছাড়া। ব্যস সেই থেকে গুনগুনের মনে বদ্ধমূল ধারনা ঢুকে গেল যে ওই লকেটটাই ওর ভাগ্য পালটে দিয়েছে। সে বলে লকেটটা পাওয়ার পর থেকেই নাকি প্রতিটা পরীক্ষায় ওর ভাল ফল হয়েছে। ওর দিদি মুনমুন অবশ্য বলে সেটা সরকার স্যারের ক্রেডিট কারণ দিঘা যাওয়ার তিন মাস আগে থেকে উনি পড়াচ্ছেন ওদের দুজনকে। গুনগুন কিন্তু সেই কথাটা মানতে রাজি নয়। ওরা তো দুজনেই সরকার স্যারের কাছে পড়ছে তাহলে কেন গুনগুনই শুধু ফার্স্ট হচ্ছে ক্লাসে? মুনমুন কেন হতে পারছে না? কারণ একটাই গুনগুনের কাছে রয়েছে বাস্তেতের লকেট!
মুনমুন ওর যুক্তি শুনে চোখ পাকিয়ে বলল, “আজ্ঞে না! উঁচু ক্লাসে কম্পিটিশান অনেক বেশি! তুই এইট নাইনে উঠে ফার্স্ট হয়ে দেখাস, তবে বুঝব তোর লকেটের কত ক্ষমতা! ক্লাস টু থ্রিতে সবাই ফার্স্ট হতে পারে।”
মুনমুনের ওই রকম কথা শুনলে অবশ্য মা খুব রেগে যান, ওকে বকে বলেন, “নিজের পড়াশোনায় মন নেই আবার বোনেরও মাথাটা খাওয়া হচ্ছে!”
যাই হোক, গুনগুনের সেই অলৌকিক লকেট কিনা অঙ্কের ফাইনাল পরীক্ষার আগের দিনই হারিয়ে গেল। গুনগুন পড়া শোনা ভুলে হাঁউমাউ করে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। মা প্রথমে সাধাসাধি করলেন, তাতে যখন কাজ
হল না তখন বকাবকি করা শুরু করলেন। বকুনি খেয়ে গুনগুন কান্না থামিয়ে গুম হয়ে বসে রইল। ভাবতে চেষ্টা করতে লাগল কোথায় পড়ে গিয়ে থাকতে পারে লকেটটা। বাড়িতে তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও পেল না। ব্যাগে খুঁজল, সেখানেও নেই। তার মানে স্কুলেই কোথাও পড়েছে মনে হয়।
মুনমুন মাঝে মাঝেই এসে ফোড়ন কেটে যাচ্ছে, “এমা, কালকে অঙ্ক পরীক্ষা আর তুই আজ দিব্যি হাত পা ছড়িয়ে বসে রয়েছিস! পড়াশোনা করতে হবে না?”
বাবা অফিস থেকে ফিরতেই গুনগুন বাবার কাছে গিয়ে কেঁদে পড়ল, “বাবা, আমাকে এখুনি স্কুলে নিয়ে চলো! আমার বাস্তেতের লকেটটা হারিয়ে গেছে আর কালকে অঙ্ক পরীক্ষা!”
“সেকী কথা গুনগুন, এখন তো স্কুল বন্ধ। গেটে তো তালা দেওয়া থাকবে এখন। আমরা তো ঢুকতেই পারব না। আর কালকে অঙ্ক পরীক্ষা যখন তখন আজকে স্কুলে গিয়ে সময় নষ্ট করার তো মানে হয় না। এখন
পড়াশোনা করে নাও, কাল সকালে স্কুলে গিয়ে খুঁজে নিও। দেখবে হয়তো ক্লাসে তুমি যেখানে বসো সেখানেই পড়ে আছে। আমি না হয় মুনমুনকে বলছি ও তোমার সঙ্গে গিয়ে খুঁজবে।”
মুনমুনের এদিকে লকেট খোঁজার কোন ইচ্ছেই নেই। সে উলটে বাবাকে নালিশ জানাল, “জানো বাবা পাজি মেয়েটা স্কুল থেকে আসার পর থেকে একবারও পড়তে বসেনি! কালকে স্বয়ং বাস্তেত এসে ওর পাশে বসলেও ও ডাহা ফেল করবে! ভাবখানা এমন যেন কী না কী! ওই তো একটা পাথরের লকেট, কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস একটা!”
গুনগুন বই নিয়ে বসতে বসতে বলল, “ওটা কী জিনিস তুই বুঝবি না!”
পরদিন স্কুলে যাওয়ার পথে রাস্তার জ্যামে আটকে গেল ওদের পুল কার। ওরা যখন স্কুলে পৌঁছল তখন স্কুলের ঘন্টা পড়ে গেছে। মুনমুন নিজের ক্লাসে চলে গেল। গুনগুনও ছুটতে ছুটতে গিয়ে যখন ক্লাসে পৌঁছল তখন পরীক্ষার খাতা দেওয়া হচ্ছে। কিছু খোঁজার সময় নেই দেখে ওর মনটা একটু খারাপ হল বটে কিন্তু উপায় নেই তাই প্রশ্নপত্রে মন দিল। পরীক্ষার পর অনেক খুঁজল সে। একে ওকে জিজ্ঞেস করল কিন্তু কেউ কিছুই বলতে পারল না। আবার মন মরা হয়ে বাড়ি ফিরল গুনগুন।
এমনি করে ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল কিন্তু দেবী বাস্তেতকে আর পাওয়া গেল না।
দুরুদুরু বুকে রেজাল্টের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল গুনগুন। এদিকে নিজের জন্মদিনের পার্টিতে দেবাঙ্গনা জানাল, “এবার আমার সব পরীক্ষা দারুণ ভাল হয়েছে, আর অঙ্কে তো একশোয় একশো!”
ওর কথা শুনে আরো ভয় পেয়ে গেল গুনগুন, বাস্তেতের লকেটটা পাওয়ার আগে দেবাঙ্গনাই বরাবর ক্লাসে ফার্স্ট হত।
রেজাল্টের দিন গুনগুনের গা বমি বমি, পেটে ব্যথা, মাথা ধরা সবই হল কিন্তু স্কুলে যাওয়াটা আটকানো গেল না।
সবাইকে এবং নিজেকেও আশ্চর্য করে দিয়ে গুনগুনই ওদের ক্লাসে ফার্স্ট হল। অঙ্কে একশোয় একশো। দেবাঙ্গনাই বরং আটানব্বই পেয়ে গেছে কী একটা ছোট ভুল করে।
বাড়ি ফিরতে মুনমুন বলল, “ওই দ্যাখ! বলেছিলাম না, ওইসব পাথরের লকেট টকেট দিয়ে কিছু হয় না! সরকার স্যার তোকে অঙ্কগুলো এমন গুলে খাইয়েছেন যে তুই পরীক্ষার আগের দিন রাতে না পড়েও একশো পেয়ে গেলি!”
সন্ধ্যা হওয়ার আগে ঠাম্মা পুজোর ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখলেন মুনমুন সেখানে কী খুটখাট করছে। ঠাম্মা দু মাসের জন্যে ছোটকাকুর বাড়ি জামশেদপুরে গিয়েছিলেন তাই দেবী বাস্তেতের হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা জানেন না। ঠাকুর ঘরে ঠাম্মার টুকিটাকির বাক্স থেকে কী একটা বার করেই আবার ঢুকিয়ে দিল মুনমুন।
“এটা এখানেই রইল কেমন? প্রথমে ভেবেছিলাম ফেলেই দেবো তারপর মনে হল থাক। কোন একদিন না হয় দেখাবো বার করে,” মুনমুন ঠাম্মাকে বলল।
ঠাম্মা কিছু বলার আগেই সে আবার শুরু করল, “জানো, মেয়েটা না এটার ওপর বড্ড নির্ভর হয়ে পড়ছিল। নিজের ওপর বিশ্বাসের ওই রকম অভাব হলে চলে, তুমিই বলো? বলে কিনা বাস্তেতের জন্যে ক্লাসে ফার্স্ট হচ্ছে! বোকা আর কাকে বলে। ওর ভুলটা ভাঙানোর দরকার ছিল। যারা বোঝে না ‘ভগবান তাদেরই সাহায্য করেন যারা নিজের সাহায্য নিজে করে’ সেই সব বুদ্ধুদের এই ভাবেই শেখাতে হয়!” বলে মুচকি হেসে ঝপ করে বাক্সের ঢাকনাটা বন্ধ করে দিয়ে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে গেল মুনমুন।
ছবিঃ শিমূল