বিপিন অবাক হয়ে চেয়ে আছে বিস্তীর্ণ জলাশয়ের দিকে। ভরা ভাদরের স্বর্গীয় দৃশ্য দেখে দেখেও তার মন ভরে না কিছুতেই। জলাশয়ে হাজার হাজার সাদা ও রঙিন পদ্ম এবং শাপলার মেলা বসে গেছে। স্নিগ্ধ ও শীতল জলাশয়কে ঘিরে তার চেয়েও বেশি সংখ্যক ফড়িং শাপলাদের গন্ধ গায়ে মেখে উড়ে বেড়াচ্ছে। কলমিলতা মাথা উঁচু করে নিজের জায়গা দখল করে নিয়েছে। পুঁটিমাছের ঝাঁক মনের সুখে সাঁতার কাটছে। গেঁড়ি-গুগলি খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে পাতিহাঁসের দল। কচ্ছপ উঁকিঝুঁকি মারছে এখানে ওখানে। সোনা ব্যাঙের দল শুধু মাথাটুকু বাইরে বের করে এক সুরে গান গেয়ে চলেছে। দূরে জলাশয়ের পাড় ঘিরে রেখেছে সাদা কাশগুচ্ছ।
ছাড়ি-গোয়াইয়ের অনাবিল দৃশ্য বিপিনকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। এই কয়েক বছর আগে পর্যন্ত এই জায়গাটা ছিল ইঁদুরের বড়ো বড়ো গর্তে ভরা এবড়োখেবড়ো রুক্ষ মাঠ। সেই রুক্ষ জমিটাই এখন পদ্মবনে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রকৃতির মতো খামখেয়ালি বোধহয় আর কেউ হতে পারে না। তার খামখেয়ালিপনারই ফসল এই অনাবিল স্বর্গীয় দৃশ্য।
সরকারি কোষাগারে অগ্রিম টাকা জমা রেখে নদী থেকে বালি তোলার ছাড়পত্র পেয়েছে টোডা কোম্পানি। ছাড়পত্র পেয়েছে এনভায়রনমেন্ট ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট জমা দেবার পরই। এছাড়া সরকারি অনেকগুলি বিধিনিষেধ মেনে চলবার অঙ্গীকারও করতে হয়েছে টোডার কর্ণধার মিঃ বর্মণকে।
টোডা প্রথম প্রথম লরি নামিয়ে নদীগর্ভ থেকে সেই বালি তুলে নিচ্ছিল। কিন্তু বর্তমানে গোয়াই নদীর বালির চাহিদা বেড়ে য়াওয়ায় মালিকপক্ষ জেসিবি নামিয়ে বালি তোলার কাজ শুরু করেছে। এতে খুব দ্রুত বালি তোলা সম্ভবপর হচ্ছে। শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে নদী। সেই নদীর বালির যেমন কনকচাঁপার মতো রং ঠিক তেমনই তার দানা। ইঞ্জিনিয়ারদের প্রথম পছন্দ এই গোয়াই নদীর বালি। তাই এর একটা ঘাট লিজ পাওয়া মানে হাতে স্বর্গ পাওয়া।
গোয়াই নদীর একটি শাখা ঢুকে পড়েছে বিপিনদের গ্রাম পটমদা মৌজায়। বছর আট-দশ আগে একবার নদীর পাড় ভেঙে পটমদার বেশ কিছু ফসলের ক্ষেত, কয়েকটি বড়ো পুকুর ও রুক্ষ মাঠের কিছু অংশ জলমগ্ন হয়ে যায়। সেই থেকে পুরো জায়গাটা সুন্দর একটি ছোটোখাটো হ্রদের চেহারা নিয়েছে। গ্রামের লোকজন এই জায়গাটাকে ‘ছাড়ি-গোয়াই’ বলে থাকে।
ছাড়ি-গোয়াই ও মূল নদীর সংযোগ স্থানে প্রায় দুশো একর সরকারের খাস জমি রয়েছে। সেই জমিটি জলাজমি হলেও তার উপরে রয়েছে প্রচুর বালির ঢিবি। টোডা সেই সমস্ত বালির ঢিবিগুলি দখল করতে চায়। কিন্তু তা করতে হলে এই বিস্তীর্ণ জলাজমির দফারফা হয়ে যাবে। অবশ্য মালিকপক্ষের তাতে কোনও ক্ষতি নেই। তারা তো ঐ খাস জমিটিও তাদের স্যান্ড-ব্লক এরিয়াতে সংযুক্ত করে স্কেচ ম্যাপে পাশ করিয়ে নিয়েছে। তাই গ্রামবাসীদের ‘ছাড়ি গোয়াই বাঁচাও কমিটি’র আন্দোলনেও কোনও ফল হয়নি।
বিপিনের নানা কাজে শহরে যাওয়া-আসা আছে। গ্রামের লোকের সাহায্য করার জন্য তার এক পা তোলাই থাকে সবসময়। তার এক বন্ধু শহরে একটি সংবাদ সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক। তার কাছ থেকেই বিপিন জানতে পারে, পরিবেশকে বিপন্ন করে কোনওমতেই নদীগর্ভ বা তৎসংলগ্ন স্থান থেকে বালি তুলে নেওয়া যায় না। তাই বিপিন এখন গ্রামবাসীদের আন্দোলনের একজন সক্রিয় সহযোগী হয়েছে।
একদিন নদীপাড়ের অস্থায়ী ক্যাম্পে মিঃ বর্মণ বিপিনকে একা পেয়ে বললেন, “আপনি, মানে তুমি তো শুনেছি সেরকম কিছুই কাজকর্ম করো না। চাইলে আমাদের একটা ট্রাক্টর নিয়ে পাশের নদীঘাট থেকে বালি চালানোর কাজে নেমে যেতে পার।”
বিপিন বলল, “আপনার সাথে ছাড়ি-গোয়াই ছাড়া আমি আর অন্য কোনও কথা বলতেই রাজী নই। আপনারা খাসজমির বালি তুলে ফেললে আমাদের কী ক্ষতি হবে বুঝতে পারছেন? ঐ অংশের বালি একটা মোটা ও শক্ত আইলের কাজ করছে। ওটা ভেঙে গেলে পুরো জল ফের নদীতে এসে মিশে যাবে। ফলে এত বড়ো একটা ওয়াটার-বডি নষ্ট হয়ে যাবে। ঐ জলা জায়গায় রয়েছে প্রচুর মাছ, কচ্ছপ, সোনা ব্যাঙ, ঢোঁড়া সাপ, হোগলা, কলমিলতা… এসব…”
মিঃ বর্মণ হাসতে হাসতে মাঝপথেই বিপিনকে থামিয়ে দিলেন। “আরে, থামো থামো। রাখো তোমার কচ্ছপ আর ঢোঁড়া সাপ। ওসব নিয়ে আজ আর কেউ ভাবে নাকি? তার চেয়ে তোমাকে আমি আরও দুটো ভালো অফার দিচ্ছি। প্রথমটা হল, তোমাকে এই ঘাটের ম্যানেজার করে দেওয়া হবে। আর দ্বিতীয়টা হল, তোমায় একখানা নতুন ট্রাক্টর কিনে দেওয়া হবে। এক বদলে গ্রামবাসীদের উটকো ঝামেলা বন্ধ করতে হবে।”
একথা শুনে বিপিন একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেল। বলে কী এরা! তাকে হাত করে গ্রামবাসীদের এত বড়ো সর্বনাশ করতে চায়? প্রকৃতির দয়ায় নদী নিজে গ্রামে এসেছে সকলের কল্যাণের জন্য। আর সেই মনোরম জলাশয়টাই এরা কিনে নিতে চায়! বিপিন আর এক মুহূর্তও থাকেনি সেখানে।
তারপর বিপিনের নেতৃত্বে অনেক দরবার হল। তার বন্ধুর সাপ্তাহিক সংবাদপত্রে বিস্তর লেখালেখি হল। টোডা কোম্পানিও অনেক ফন্দিফিকির বের করল জলা জায়গার দখল নেবার। উকিলি নোটিশ দেওয়া হল। কিন্তু বিপিনের সততা ও সংকল্পে একচুল ফাটল ধরানো গেল না।
গ্রামের আর কারও জানতে বাকি থাকল না যে, টোডা কোম্পানি বিপিনকে তাদের কোম্পানির ম্যানেজার করতে চেয়েছিল। এমনকি নতুন ট্রাক্টরও কিনে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বিপিন জানত তার লড়াইয়ের একমাত্র ভিত তার সংকল্প ও সততা। টোডা যতই অসৎ হবার লোভ দেখাক না কেন, বিপিন সেই ফাঁদে পা দেবে না। ফলে একদিন জয় হল বিপিনরই। গ্রামবাসীদের কাছে বিপিন এখন চোখের মণি। আর বিপিনের চোখের মণি এই ছাড়ি-গোয়াইয়ের স্নিগ্ধ জলরাশি।
অলঙ্করণঃ মৌসুমী