গল্প বিহু সুপর্ণা বোস শরৎ ২০১৯

সুপর্ণা বোস

স্কুল থেকে ফিরে কোনওমতে ব্যাগটা রেখেই মশারি তুলে দিম্মার বিছানায় ঢুকে পড়ে বিহু। দিম্মা তখন কম্বলের আসনের ওপর বই রেখে ঈশ্বর প্রসঙ্গ পাঠ করছিলেন। বিহু বলল, “দাও দিম্মা, আমি পড়ে শোনাচ্ছি তোমায়।”

দিম্মা পাঠ বন্ধ করে বিহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, “তুমি তো এক্ষুনি স্কুল থেকে ফিরলে দিদিভাই, হাত-পা ধুয়ে খেয়ে নাও, তারপর না হয় পড়ে শুনিও।”

বিহু পাখির মতো উড়ে বেরিয়ে গেল, আর মশারিটা ঝুলে পড়ল বিছানা থেকে। দিম্মা সেটাকে ঠিকঠাক করে আবার পড়ায় মন দিলেন।

মাঝেমধ্যে দিম্মা এ-বাড়িতে এলে বিহুর ভারি আনন্দ হয়। দিম্মা যেন একটা মস্ত বটগাছ আর বিহু একটা সবুজ টিয়াপাখি। সে উড়ে উড়ে এ-ডাল ও-ডাল করে। সারাক্ষণ দিম্মার গা ঘেঁষে থাকতে চায়। দিম্মাও তাকে আগলে আগলে রাখেন বাবার বকুনি, মায়ের ছোটোখাটো চড়-থাপ্পড় থেকে। দিম্মার কাছে বিহু তার মনের সবকথা খুলে বলতে পারে। বন্ধুদের কথা, মিসের কাছে বকা খাওয়ার কথা। দিম্মা বিহুর সবকথাই মন দিয়ে শোনেন। দিম্মা এলে বিহুর মনে হয়, তাদের বাড়ির মাথায় আর কোনও ছাদ নেই, শুধু আকাশ আর আহ্লাদের রোদেলা আঁকিবুকি।

ঠাম্মাকে বিহু খুব বেশি দেখেনি। বিহুর এগারো বছর বয়সে এসে মাত্র দু’বার সে ঠাম্মাকে দেখেছে। ঠাম্মা ছোটোকাকুর কাছে কানাডায় থাকেন। দেশে এলে দিন পনেরো থেকে আবার ফিরে যান। বিহুর মন ভরে না তাতে। ইচ্ছে করে ঠাম্মাকে সে জোর করে নিজের কাছে রেখে দেয়। কিন্তু কাকুর ছোট্ট ছেলেটা যে ঠাম্মাকে ছেড়ে থাকতেই চায় না! আর ঠাম্মাও ওকে ছেড়ে থাকতে পারেন না, তাই একটা সময়ে ঠাম্মাকে ছেড়ে দিতেই হয়। বিহুর অভিমান হলেও ভাইয়ের কষ্ট হবে ভেবে সে ঠাম্মাকে আটকায় না। এয়ারপোর্টে গিয়ে হাসিমুখে ওদের টা টা করে ফিরে এসে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদে বিহু। ঠিক তক্ষুনি পাশের ঘরে গিয়ে মা চুপি চুপি ফোন করে দিম্মাকে। “কয়েকদিনের জন্যে আমাদের সাথে কাটিয়ে যাও না, মা। আসলে ঠাম্মা চলে গেছে তো, বিহুটার বড্ড মনখারাপ।”

দিম্মা বলেন, “আমার যে এখন বড্ড কাজ রে, মা! এই পূর্ণিমায় বাড়িতে একটু সিন্নি দোব ভাবচি। তারই তোড়জোড় করচি। ঠাকুরমশাইকে ফর্দ দিতে বলেচি, তিনিও আসবেন দু’য়েকদিনের মধ্যে।”

“এ তো খুব ভালো কথা গো, মা। সত্যনারায়ণ দেবে। তা পূর্ণিমাটা কবে?”

এদিকে বিহুর কানে সত্যনারায়ণের সিন্নির কথা যেতেই সে ছুটে এল। “কবে? কবে? আমাকে ফোনটা দাও।” বলে সে রিসিভারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। “ও দিম্মা, বলো না কবে হবে পুজো? আচ্ছা, সামনের শনিবার? খুব ভালো, আমার স্কুল তো ছুটিই থাকবে। সকাল সকাল চলে যাব। আমিই আল্পনা দেব, কেমন? তুমি শুধু চালটা বেটে রেখ। সিন্নিটাও কি আমিই মাখব দিম্মা? আখের গুড়ের সাথে কলা চটকে চটকে। আগের বারে আমি ঠিক মেখেছিলাম, না?”

দিম্মা বললেন “হ্যাঁ দিদিভাই, একদম ঠিক মেখেছিলে। এবারেও তুমিই মাখবে।”

শাসন নিগড়ের বাইরে এই প্রশ্রয় বিহুর আত্মবিশ্বাস দ্বিগুণ করে দেয়।

সাধারণত স্কুল থেকে ফিরে পনেরো মিনিটের খাওয়া বিহু পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে খায় টিভি দেখতে দেখতে। মা শত বকলেও সে কর্ণপাত করে না। আজ সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খাওয়া শেষ করে দিম্মার মশারির ভেতর এসে ঢুকল। দিম্মার কাছে কত্ত গল্প। রাক্ষস-খোক্ষসের গল্প। ক্ষীরের পুতুলের গল্প। শ্রীবৎস-চিন্তামণির গল্প। গল্প শুনতে শুনতে বিহু অন্য জগতে পৌঁছে যায়।

বিহুও দিম্মাকে গল্প শোনায়। নিজের বাংলা রাপিড বই খুলে দিম্মাকে পড়ে শোনায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘গন্ধটা খুব সন্দেহজনক’।

এদিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই সারা ঘরে এক অদ্ভুত সুগন্ধ খেলা করতে শুরু করে হঠাৎই। মা নাক টানতে টানতে বলে, “একটা ভালো গন্ধ পাচ্ছ তোমরা? গন্ধটা খুব চেনা। কোথায় যেন পেয়েছিলাম মনে পড়ছে না এখন।”

দিম্মা বলেন, “একটা ভালো গন্ধ পাচ্ছি বটে।”

শুধু বিহু চুপটি করে শুয়ে থাকে দিম্মার আঁচলের তলে। মা আবার গন্ধের উৎস সন্ধানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই বিহু দিম্মার কানে কানে কিছু বলে। দিম্মা আঁতকে উঠে বলেন, “সে কি রে, তোর মা যে আস্ত রাখবে না!”

পাশের ঘর থেকে মায়ের বাজখাঁই গলা ভেসে আসে, “বিহু, ছোটোপিসির দেওয়া ফরাসি সেন্টের শিশিটা ভেঙেছ? শয়তান মেয়ের হাতে-পায়ে লক্ষ্মী, ভেঙে আবার ড্রেসিং টেবিলের কাবার্ডে লুকিয়ে রেখেছে! বেরিয়ে আয় বিছানা থেকে, আজ তোর একদিন কী আমারই একদিন।”

বিহু চুপটি করে শুয়ে থাকে। সে জানে, যতক্ষণ দিম্মা আছে ততক্ষণ কেউ তার কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না।

অলঙ্করণঃ স্বীকৃতি ব্যানার্জি

জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস

1 thought on “গল্প বিহু সুপর্ণা বোস শরৎ ২০১৯

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s