নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
সন্ধ্যা সাতটা। খালের জল বেয়ে তীব্র কটু গন্ধ ছড়াচ্ছে বাতাস। অবশ্য এই গন্ধ আর নাকে লাগে না বিন্তির। অর্থাৎ, বিন্তিদের। ওদের জন্ম এই খালপাড়ের বিস্তীর্ণ মানুষের আস্তানায়। ছোটো একটা ঘর। মাথায় খাপড়ার টালি। দেওয়াল মুনি-বাঁশ ও তেরপলের। মেঝে মাটির। মাটিতে ইট বিছিয়ে আদ্যিকালের একটা তোষক আর তার উপর একটা চাদর পাতা আছে। বিন্তি যে চাদরটার উপর এখন বসে আছে তার রং আগে যে কী ছিল, এখন তা বলা বেশ মুশকিল। যদি বলা হয় চাদরটা ময়লা, তবে বোধহয় খানিকটা কম বলা হয়। কারণ, ধুলো ও কালি চাদরটার প্রতিটা তন্তুর ভেতর বহুকাল ধরে জমা হতে হতে চাদরটাকে একটা ধোঁয়াটে রং দিয়েছে। বিন্তির গায়েও একটা আধময়লা ফ্রক। পিঠের পিছনের হুক ছিঁড়ে যাওয়ায় জামার গলাটা সামনে সামান্য ঝুঁকে পড়েছে। রাস্তার আলো থেকে জোড়াতালি দেওয়া তার টেনে ঘরের ভেতর একটা কম পাওয়ারের লাল আলোর বালব জ্বলছে। তবে এই চিত্রপটে সবথেকে আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, বিন্তির হাতে একটা বই দেখা যাচ্ছে। বেশ মোটা ধরনের একটা বই। একটা গল্পের বই। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘কিশোর রচনা সমগ্র’। বিন্তি সেখান থেকে পড়ে শোনাচ্ছে ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ এবং তা শুনছে বিন্তির বোন। ওর থেকে বছর চারেকের ছোটো অন্তি।
কলকাতা থেকে হাসনাবাদ-বাসন্তী যে হাইওয়ে তৈরি হয়েছে সায়েন্স সিটির পাশ থেকে, তার গা ঘেঁষে কলকাতা ইস্ট-ওয়েস্ট ক্যানেল। সেই ক্যানেলের ধারে বাসন্তী-গোসাবা থেকে উদ্বাস্তু কিছু মানুষ বাঁশ-ত্রিপল দিয়ে ঘর বেঁধেছে। গড়ে উঠেছে মানুষের আস্তানা। ক্যানেলের ধারে ধারে বাইপাসের কাছে মাথা তুলেছে অনেক হাইরাইজ, তবে বিন্তিদের আস্তানাও থেকে গেছে সেখানে সুন্দর শরীরে ক্ষতের মতো। তাদের আস্তানা আজও দৃশ্য-দূষণ করে সজ্জিত শহরের বুকে। তাদের অনেকের ঘর আগুনে পুড়ে গেছে কতবার, কেউ বা রোগে মারা গেছে। তবুও আবার নতুন করে কীভাবে যেন নতুন লোক এসে পূরণ করেছে সেই শূন্যস্থান।
বিন্তির পুরো নাম বিন্তি রাম। বিন্তির বাবা সুখচাঁদ রাম বাঙালি নয়, বিহারি। বিন্তির মা মালতী অবশ্য বাঙালি। সুখচাঁদ মালিক অঘোর রায়ের ট্যাক্সি চালাত। খালপাড়ের বস্তিতেই দু’জনের আলাপ।
এখানেই বিন্তি আর অন্তির জন্ম। সুখচাঁদ তাদের দু’জনকেই স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। দিনরাত ভাড়া খাটত সে। তাদের সংসারে খাওয়া-পরার অভাব ছিল না তখন।
সুখচাঁদ উচ্চাকাঙ্ক্ষী বরাবর। সবসময় বলত, এভাবে পড়ে থাকলে চলবে না। একদিন সুখচাঁদ তার মালিকের ট্যাক্সি নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। সুখচাঁদের খবরের থেকেও ট্যাক্সির খোঁজে অঘোর রায় থানাপুলিশ করল অনেক বেশি। সুখচাঁদ ট্যাক্সির নাম্বার প্লেট বদলে ফেলেছিল বোধহয়, ট্যাক্সির খোঁজ পাওয়া গেল না কিছুতেই। একসময় পেটের টানে কাছাকাছি আবাসনগুলোতে মালতী ঝিয়ের কাজ শুরু করল। জুনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলের ক্লাশ সেভেনের ছাত্রী বিন্তি ও ওই স্কুলের প্রাইমারি সেকশনের ক্লাশ থ্রিয়ের অন্তির পড়াশুনায় যতিচিহ্ন পড়ে গেল। বিন্তি ছিল স্কুলের বেশ মেধাবী ছাত্রী, পড়া বন্ধ হতে ভীষণ মুষড়ে পড়ল সে। মালতি মেয়ের মনের দুঃখ বুঝতে পারলেও কিছু করতে পারে না। সারাটা দিন বাবুদের বাড়ির কাজে কেটে যায় তার। রাতে রান্নার কাজ ও দিনে ঘরমোছা, বাসনমাজা। সে পড়ানোর খরচের ভয়ে কোনও উদ্যোগই নেয় না।
খালপাড়ের বাসিন্দাদের দিনগুলো সব এরকমের। কলকাতার আবর্জনাবাহী খালের জলের বিষাক্ত গন্ধ বহুদূর বিস্তৃত হলেও দিনের পর দিন থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে ভোঁতা হয়ে গেছে তাদের ঘ্রাণশক্তি। কেমন একধরনের অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে। দূর থেকে বড়ো রাস্তায় গাড়িতে বসে নাকে রুমাল চাপা দেয় আরোহীরা, কিন্তু বিন্তি, অন্তি, বাসনা, জবা, পান্তু, রূপসী, বিনুরা এরই মধ্যে যাপন করে তাদের শৈশব।
বই পড়তে পড়তে বিন্তি বইটা মুড়ে রাখল। ভোলার গলা না! হ্যাঁ তো! ভোলাই কুঁই কুঁই করছে। ভীতুর একশেষ একটা। বিন্তি আর অন্তি তাদের তেরপলের বাইরে এসে দাঁড়ায়। ভোলা বিন্তির পোষা নেড়ি কুকুর। ভোলাকে অন্য কয়েকটা বাইরের কুকুর ঘিরে রেখেছে। সমর্পণের ভঙ্গিতে চিত হয়ে শুয়ে পাগুলোকে উপরে তুলে যেন মাপ চাইছে ভোলা। বিন্তি কুকুরগুলোকে তাড়িয়ে দিতেই ভোলা একছুটে ওর কাছে।
“তোর সাহস হবে কবে রে ভোলা? বেপাড়ার কুকুর দেখে কোথায় ঘেউ ঘেউ করবি, তা না, শুয়ে পড়লি!”
ভোলা বিন্তির সঙ্গে ওর পেছন পেছন ওদের ত্রিপলের একটা কোনায় রাখা চটের উপর গুটিয়ে পাকিয়ে বসল। বকুনি খেয়ে বুঝি মনখারাপ হয়েছে।
আজ বিন্তির মনটাও খুব খারাপ। আজ থেকে সত্যিই সে একা হয়ে গেল। আজ তিথিদিদিরা তাদের আবাসন ছেড়ে চলে গেল। তিথিদিদি অবশ্য কলকাতাতেই থাকবে। তবে ইউনিভার্সিটির গার্লস হোস্টেলে। তিথিদিদি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম.এ. করছে। করুণা আবাসনের একটা ফ্ল্যাটে ওরা দু’বছরের চুক্তিতে ভাড়া থাকত। বিন্তিকে অনেক বই দিত তিথিদিদি। বিন্তির মা ওদের বাড়িতে রান্না করত এতদিন। মালতী রাতের রুটি করতে করতে একদিন বলেছিল, “জানেন বৌদি, আমার মেয়েটা লেখাপড়াতে ভালো ছিল। ওর বাপের দোষে পড়াশুনো হল না।”
কী মনে হতে কাকিমা বলেছিলেন, “আচ্ছা, একদিন তোমার মেয়েকে আমার এখানে এনো।”
সেই সূত্রে বিন্তি মায়ের সঙ্গে এক বিকেলে উপস্থিত হয়েছিল তিথিদিদিদের বাড়িতে। তিথি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “তুমি কি টিভি দেখবে? তোমার মা তো কাজ করছেন, তুমি এতক্ষণ একাবসে বসে কী করবে?”
“আমি টিভি দেখি না। আমার ভালো লাগে না।”
“কেন? ভালো লাগে না কেন?”
“ওরা সবাই সবসময় কেমন সাজগোজ করে থাকে। এমনকি রঙচঙ মেখে খায়, ঘুমায় পর্যন্ত।”
তিথি ওর কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ে। বলে, “তাহলে তোমার কী ভালো লাগে?”
“ভালো লাগে বই পড়তে। স্কুলে বাংলার দিদিমণি আমাকে গল্পের বই দিতেন।”
“আচ্ছা, আমিও তোমাকে বই দেব। তবে পড়তে হবে কিন্তু।”
“পড়ব।”
সেই শুরু। তিথি বুঝতে পারে বিন্তি সত্যিই বইয়ের পোকা। সে অনেকবার পরীক্ষা করে দেখে বুঝেছে বইগুলো সবই পড়ে বিন্তি। তিথি মুগ্ধ হয়ে যায়। একদিন বইমেলা থেকে কয়েকটা রঙিন বই এনে দেয় সে বিন্তিকে। বিন্তি আনন্দে কেঁদে ফেলে। তা দেখে তিথি ঠিক করে ফেলে, সে বিন্তিকে একবার বইমেলায় নিয়ে যাবে।
মেলায় বিন্তি তার সঙ্গে অন্তিকেও নিয়ে এসেছে। তিথি অবাক হয়ে দেখে কত সহজে সে এই শিশুদুটির মন জয় করে ফেলেছে। তিথির মনে হয় সে সত্যি-সত্যি দুটো অচেনা রাজ্য জয় করেছে। দুটি সরল নিষ্পাপ শিশুমনের আধিপত্য।
দেখতে দেখতে বিবর্ণ দিনগুলো কেটে গেল বিন্তির। সেই বইমেলার রঙিন দিনটার পর পৃথিবী নিজের অক্ষের উপর তিনশো পঁয়ষট্টিবার ঘুরে নিয়েছে। এসে গেছে পরের বছরের বইমেলা। এবার বিন্তিকে বইমেলা নিয়ে যাবার কেউ নেই। বইমেলার প্রাঙ্গণ আবার নানা প্রকাশনা সংস্থার স্টলে ভরে উঠেছে। বিন্তি ঠিক করেছে, এবার সে একাই বইমেলায় যাবে। মার কাছ থেকে টাকা চাইতে গেলে মা বারণ করবেন, তাই বিন্তিকে খালি হাতেই যেতে হল বইমেলাতে। বই না কিনলেও সে অন্তত অনেক বই দেখতে তো পাবে!
বিন্তির পরনে সামান্য রঙ-ওঠা একটা ফ্রক, পায়ে টায়ারের জুতো। মেলার ভিড়ে অন্যান্য মানুষদের সঙ্গে সেও স্টলগুলোর ভেতর ঢুকে বই দেখতে লাগল। সে একটা স্টলে ঢুকে বই পড়তে শুরু করে দিল। কিছুক্ষণ পরে একজন বয়স্ক লোক তাকে ধমক দিলেন, “অ্যাই, তোমার সঙ্গে কে আছেন? বই ওখানে রেখে দাও। বই কিনলে ওটা নিয়ে কাউন্টারে যাও, এখানে দাঁড়িয়ে ভিড় করো না।”
বইটা রেখে দিয়ে চলে আসে বিন্তি, কারণ তার কাছে একটা টাকাও নেই। তারপরেই অন্য একটা স্টলে ঢোকে সে। ছোটো ছোটো বইগুলো এক নিঃশ্বাসে পড়ে নিতে থাকে। সে যেন পুরোপুরি বইয়ের জগতে হারিয়ে যেতে থাকে। এখানেও মৃদু ধমক শুনে বিন্তি উদাসভাবে স্টলের বাইরে এসে দাঁড়ায়। তখন চোখে পড়ে একটি পরিবার। ঠিক তারই বয়সী একটি মেয়ে। কী অপূর্ব সুন্দর দেখতে! ওর গায়ের কোথাও একটুও ময়লা নেই। যেন দুধ দিয়ে স্নান করা শরীর, পরনে ঘন নীল রঙের ফ্রক। মা ও বাবার সঙ্গে একটি স্টল থেকে বেরিয়ে এল তারা। হাতে বিশাল বড়ো একটা বইয়ের প্যাকেট। মেয়েটিকে তার মা বললেন, “সোহা, এই প্যাকেটটা ধরো। এটাতে তোমারই ফরমাসের সব বই। রূপা থেকে কেনা ইংরাজি বই। কতবার বলেছি, বাংলা বই একটু পড়বে। কষ্ট করে হলেও পড়তে হবে। তোমার মা, বাবা, দাদু, দিদা সবাই যে ভাষায় কথা বলেন, তাকে জানবে না! কত বৈচিত্র এই সাহিত্যে। সবই তো না হলে তোমার কাছে অজানা থেকে যাবে। আমি কিন্তু তোমার জন্য কিছু বাংলা গল্পের বই কিনেছি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজকাহিনী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সদাশিবের কাণ্ডকারখানা, শিশু ভোলানাথ, আর চাঁদের পাহাড়। এগুলো আমি চাই তুমি নিজে নিজে পড়বে।”
“না, তুমি আমাকে পড়ে শোনাবে প্লিজ। আমার বাংলা বই পড়তে একদম ভালো লাগে না, মামমাম। তবে শুনতে খুব ভালো লাগে। শোনাবে তো?”
“বেশ বেশ, তুমি আগে নিজে পড়ার চেষ্টা করবে, তারপর।”
বিন্তি সতৃষ্ণ নয়নে দেখতে লাগল ওদের। একটু পরে ওরা খাবার খেতে ফুড-কোর্টে চলে গেল।
বিন্তি এবার মেলা থেকে বেরনোর জন্য গেটের দিকে গেল। হঠাৎ সে দেখল ভোলাকে। ভোলাও অন্য কুকুরদের তাড়া খেয়ে ময়লা ফেলার ভ্যাটের কাছ থেকে উদাস হয়ে গেটের দিকেই এগিয়ে আসছে। ভোলাও দেখতে পেল বিন্তিকে। অনেকক্ষণ পর যেন পরিচিত কাউকে দেখল বিন্তি। ভোলাও তাই। দু’জনেই আনন্দে আত্মহারা। বিন্তি ভোলাকে আদর করতে থাকে। “চল ভোলা, এখানে খুব ভিড়। বাড়ি ফিরে যাই। ওখানে গিয়ে তোকে আমি দুটো বিস্কুট খাওয়াব আজকে। এখন আমার কাছে একটা পয়সাও নেই রে!”
ভোলা সমর্থন করে লেজ নাড়ায়। গেটের বাইরে যেতে গিয়ে কাঁধে কার হাতের স্পর্শে চমকে ওঠে বিন্তি। আরে তিথিদিদি! তিথি আনন্দে জড়িয়ে ধরেছে বিন্তিকে। তিথি বন্ধুদের সঙ্গে আজ বইমেলায় এসেছিল।
এরপর বেশ কিছু বই কেনা হল বিন্তিরও। একটা স্টলের সামনে গিয়ে গিল্ডের পক্ষ থেকে এবার যে রচনা লেখার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে তার কথা জানতে পারল তিথি। বিষয় ‘তুমি ও তোমার চারদিক’। শব্দ সংখ্যা অধিকতম দু’হাজার। বয়স বারো থেকে চৌদ্দ বছর। সময় দুই ঘন্টা। প্রথম পুরষ্কার পাঁচ হাজার টাকা, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরস্কারের মূল্য যথাক্রমে তিন হাজার ও দু’হাজার টাকা। আগামীকাল বেলা বারোটা থেকে প্রতিযোগিতা শুরু। আজও নাম দেওয়া যাবে।
তিথি বলল, “বিন্তি, নাম দিবি? গুছিয়ে লিখতে হবে কিন্তু।” তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করে বলল, “চল, ওখানে যাই।”
ফর্ম তুলে জমা দেওয়ার আগে ওখানে নিজের মোবাইল নম্বরটা লিখে দেয় তিথি। বলে, “কাল এখানে এগারোটার মধ্যে চলে আসবি। তারপর তোর যা মনে আসবে বসে বসে বেশ করে সাজিয়ে গুছিয়ে লিখবি, কেমন! লেখার সময় শব্দ সংখ্যা কীভাবে গুনবে তাও বুঝিয়ে দিল সে বিন্তিকে।”
বিন্তি ভাবে, সে যদি প্রথম পুরষ্কার পেত কী ভালোই না হত! সে তাহলে মাকে, অন্তিকে আর তিথিদিদিকে কিছু কিনে দিতে পারত। তিথিদিদিকে কিছু দিতে বিন্তির বড়ো সাধ হয়। তাকে তিথিদিদি কতবার বই উপহার দিয়েছে। সেও বইই উপহার দেবে তিথিদিদিকে। তারপরই বিন্তি ভাবে, ধুর! সে কি এসবের যোগ্য! কত বড়ো ঘরের ছেলেমেয়েরা আসবে! সে কি তাদের মতো অত ভালো লিখতে পারবে?
বিন্তি প্রতিযোগিতার লেখা জমা দিয়ে চলে আসে। তারপর তার দিন কাটতে থাকে একঘেয়ে বিবর্ণতায়। সঙ্গী নতুন কয়েকটা বই, এই যা পার্থক্য।
ক’দিন মায়ের খুব জ্বর। মালতী বিন্তিকে তাই পাঠিয়েছে বাবুদের বাড়িতে বাসন মাজতে। মালতী জ্বরের ঘোরে বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকে। এমন সময়ে বাইরে কাদের গলা পেয়ে অতিকষ্টে মাথা তোলে মালতী। সে দেখে, তিথি তার কয়েকজন বান্ধবীকে নিয়ে তাদের এখানে এসেছে। মালতী অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তিথি বলে, “মালতীমাসি, বিন্তি কোথায়? ও অবাক করেছে আমাকে! বইমেলাতে একটা রচনা প্রতিযোগিতায় ও ফার্স্ট হয়েছে! আমাকে কিছুক্ষণ আগে ফোনে জানিয়েছেন ওঁরা। আমি তাই ওকে নিতে এসেছি। ওর ভালো জামাকাপড় আছে তো? আজ বিকেলে স্বয়ং তথ্যসংস্কৃতি মন্ত্রী বইমেলাতে আসবেন। শুনেছি উনিই ওর হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন। বলেছেন, ওর লেখাটা ওঁরা একজন কন্ঠশিল্পীকে দিয়ে পাঠও করাবেন। আজ আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। তোমাকেও আজ মেলাতে যেতে হবে। আজ তোমাদের সকলের স্বপ্ন পূরণের দিন।”
আলোকোজ্জ্বল এক সন্ধ্যায় মঞ্চে উঠেছে বিন্তি রাম। সে তার লেখায় অদ্ভুত দক্ষতায় তার চারপাশের কথা যেন তুলির টানে এঁকে ফেলেছে। সেখানে তার পাওয়া না পাওয়া সবকথাই আছে। এমনকি আছে ভোলার কথাও। তার লেখা শুনতে শুনতে মন্ত্রীমশাই চোখ মুছতে থাকেন। তারপর বিন্তির হাতে টাকার অঙ্ক তুলে দিতে দিতে বলেন, “তোমাকে আবার লেখাপড়া শুরু করতে হবে। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে সবাইকে কিছু বলো। ভালো লেখিকা তুমি, নিশ্চয়ই ভালো কথাও বলতে পার।”
কথা শেষ করে মাইকটা এগিয়ে দেন তিনি বিন্তির হাতে। না না, বিন্তি ভালো বক্তা নয়। তার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তার খুব কান্না পাচ্ছে। গলার ভেতর দলা দলা কষ্ট। সে জলভরা চোখে শুধু বলে, “স্যার, আমার পড়াশুনা করার খুব ইচ্ছে। তবে আমি তো একা নই…”
অলঙ্করণঃ মৌসুমী
জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস
খুব সুন্দর হয়েছে। উদ্বাস্তু অবহেলিত মানুষের বাস্তব চিত্র এই গল্পের মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে।
LikeLike