মহুয়া মল্লিকের আগের গল্পঃ মায়া রয়ে যায়, আরশিনগরের মেয়ে, তিব্বতী লকেট
বোবা লরা
মহুয়া মল্লিক
১
সায়কের কথা
প্রীতমের মাথায় এই বিদঘুটে খেয়ালটা না এলে এতক্ষণ আমরা শিলং শহরের দামী হোটেলের উষ্ণ কামরায় হাত পা ছড়িয়ে বিশ্রাম করতাম। অথবা কফির কাপে চুমু
ক দিতে দিতে সারাদিনের তোলা ছবিগুলো দেখতাম। আমরা তিনজন মাঝেমাঝেই হুটহাট করে এমন বেরিয়ে পড়ি। তিনজনেই বেশ ভালো রেজাল্ট করে উৎরে যাই বলে বাড়ির লোকজন খুব একটা আপত্তি করেনা। নাহ আমরা কিন্তু শখের ট্যুরিস্ট নই। ঘুরতে প্রচুর ভালবাসি ঠিকই কিন্তু ট্যুরিস্টদের থেকে আমাদের একটা পার্থক্য আছে। এবার আমাদের পরিচয়টা একটু দিয়ে দিই, আমরা তিনজনেই কলেজের গন্ডী পার করিনি এখনও। আমি সায়ক বসু ফিজিক্স্ অনার্স ফাইন্যাল ইয়ার, প্রীতম ব্যানার্জী বটানি নিয়ে আমার ব্যাচেই আর প্রতাপ কাঞ্জিলাল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর থার্ড ইয়ার। আমাদের তিনজনের কমন ইন্টারেস্ট ফটোগ্রাফি। প্রতাপ কাঞ্জিলাল নামটা কেমন চেনা চেনা লাগছে না? ঠিক ধরেছেন। বছর তিন আগে বেস্ট ফটোগ্রাফি এ্যাওয়ার্ড পেতে দিন কয় মিডিয়াতে ওকে নিয়ে বেশ হৈ চৈ হয়েছিল। আমরা তিনজনই পড়াশোনার পাশাপাশি এই শখের ফটোগ্রাফি করেই নিজেদের পকেট মানি যোগাড় করে ফেলি। অবশ্য প্রতাপের ফিনানশিয়াল ব্যাকগ্রাউন্ড মারাত্মক স্ট্রং। ওর এসব টাকার দরকার পড়ে না।
এবার আমরা বর্ষায় শিলং এসেছি বিধ্বংসী কিছু সৌন্দর্য লেন্সবন্দী করব বলে। আমি একটি বিদেশী জার্নালে চুক্তিবদ্ধ “মনসুন ইন ইন্ডিয়া” সিরিজের কিছু ছবি পাঠাব বলে। দু’দিন ঘুরে বেশ কিছু ভালো ছবি আমরা প্রত্যেকেই ক্যাপচার করেছি। আজ মাওলিলং ভিলেজ থেকে রুটব্রিজের দিকে যাবার পথে প্রবল বর্ষণ শুরু হল। ড্রাইভার চিন্তিত মুখে জানাল, এ বৃষ্টি না থামলে গাড়ি চালান মুশকিল। আমরা তবু, “সামহাল কে ভাইয়া” করে ড্রাইভারকে অভয় দিচ্ছিলাম। রুট ব্রিজের কাছে পৌঁছলাম বিকেলের দিকে। জায়গাটা এর মধ্যেই ভয় ধরানো ছায়াছন্ন। ট্যুরিস্ট খুব কম, যারা এসেছিল সবাই ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা তিনজন প্রকৃতির অপার বিস্ময়ের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকালাম, তারপর পিছল পথে পা বাড়ালাম। ড্রাইভার বলল, “আলো কমে আসছে, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো ভাইরা, নাহলে এই রাস্তায় গাড়ি চালাতে খুব অসুবিধা হবে।”
প্রীতম ফস করে বলে বসল, “কাছাকাছি থাকার জায়গা নেই?” ড্রাইভারদাদার মুখের অবস্থা দেখার মত, এই ছেলেগুলোর মতলব কী! মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে ওর। আমি হেসে বললাম, “ভাইয়া, আরামসে গাড়ির অন্দর বৈঠিয়ে, আমরা এই গেলাম আর এলাম।” আমার হিন্দী শুনে ওরা দু’জনেই ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে। খুব রাগ হয়ে গেল, বলেই ফেললাম, “লোকটা ঘাবড়ে গিয়েছিল থাকার কথা শুনে, শেষে গাড়ি নিয়ে পালালে মজা বুঝতিস, আমি বলে ম্যানেজ দেবার চেষ্টা করছি! আর তোর হাসছিস?”
“পালিয়ে গেলে কী আর হত, এখানেই থেকে যেতাম,” প্রতাপের গলাটা কেমন ফ্যাসফ্যাসে লাগল। তবে প্রীতমের ভ্রূক্ষেপ নেই, কে জানে আমারই এরকম মনে হল কিনা!
বড় বড় গাছের শিকড় একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে সেতু তৈরি করেছে। এই প্রাকৃতিক সেতু দেখলে দুচোখ জুড়িয়ে যায়। আমরা যে যার মত ছবি ক্যাপচার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল, পিছল পথ সামলে হাঁটছিলাম। একটু পরেই দেখলাম প্রতাপ ফেরার পথ ধরেছে। পাহাড়ের গা বেয়ে সরু পিচ্ছিল পথ বেয়ে হনহন করে যাচ্ছে, কিছুটা যেন ঘোরের মধ্যে হাঁটছে। গলা তুলে ডাকার চেষ্টা করলাম, ও শুনতে পেল না। একটু পরেই আলো অনেকটা কমে আসতে জায়গাটার সৌন্দর্য বহুগুণ বেড়ে গেল। প্রীতম তাড়া দিচ্ছিল ফেরার জন্য। আমি হাত নেড়ে থামালাম ওকে, লেন্সে চোখ রেখে বলে উঠলাম, “আলো অন্ধকারের এই রহস্য ঘেরা পরিবেশে যা ছবি আসবে না, উফ…”
মনের সুখে ক্লিক করতে লাগলাম।
প্রীতম টেনে না নিয়ে এলে ওই ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য আমাকে আরও কতক্ষণ সম্মোহিত করে রাখত কে জানে! যে দু’চারজন টেবিল পেতে টিকিট দিচ্ছিল, তারাও ফেরার আয়োজন করছে। আমাদের দেরি দেখে বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছিল। বড় বড় গাছের নীচে ছাতা খুলে দাঁড়িয়ে থাকলেও টুপ টাপ করে বৃষ্টি ঝরে তাদের ভিজিয়ে দিচ্ছিল, বিরক্ত হওয়াই তো স্বাভাবিক!
“প্রতাপ চলে এল কেন বলত? গেলই বা কোথায়? গাড়িতেও তো নেই। ঐ দেখ ড্রাইভারদাদাও ইশারায় জিজ্ঞেস করছে, আরেকজন কই?”
“কাছেই আছে কোথাও। আর একটা বাচ্চা ছেলে ওকে হাত নেড়ে ডাকছিল বলে তড়িঘড়ি চলে এল। ছেলেটাকে টফিও দিচ্ছিল।”
আশ্চর্য! প্রীতম এত কিছু দেখে ফেলল, আর সে এতই মগ্ন ছিল যে কিছুই চোখে পড়ল না? ড্রাইভারদাদা কখন ছাতা মাথায় আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, বাচ্চা ছেলে শুনে ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “বাচ্চা ছেলে? এখানে তো টিকিট বাবুরা ছাড়া কেউ ছিল না, অন্যদিন খাবারের দোকান, চা থাকে। আজ বৃষ্টির জন্য তাও নেই। বাচ্চাটা কেমন দেখতে?”
“খুব নোংরা জামাকাপড়, খাবারের জন্য হাত পাতছিল। একটা গাছের গুঁড়িতে লেপটে দাঁড়িয়েছিল। আর ইশারায় কথা বলছিল, ওর ঠোঁট নড়ছিল না।”
“অদ্ভূত, তুই এত দূর থেকে এত কিছু দেখে ফেললি?” আমার কন্ঠে শ্লেষ মিশে ছিল। প্রীতম চমকে তাকাল, তারপর বলল, “আমি জুম করে ছবি তুলছিলাম, তাই দেখেছি, এতে অবাক হবার কী আছে!”
এবার নিজেই লজ্জিত হলাম। ড্রাইভারদাদা বললেন, “ছবিটা দেখাও তো, বাচ্চাটাকে দেখি একবার!”
আমি প্রতাপের নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করলাম। টিকিটবাবুরা কী হয়েছে জানতে চেয়ে চলন্ত বাইক থেকেই বলে গেল, “এটা রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া, এখান থেকে চলে যান।”
ড্রাইভারদাদা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলেন তারপর বলে উঠলেন, বোবা লরা অর্থাৎ অসমীয়া ভাষায় বোবা ছেলে। তাঁর কণ্ঠস্বরে কিছু একটা ছিল, চমকে তাকালাম। প্রীতমও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
“কী হল রে?” আমিও হুমড়ি খেয়ে বাচ্চাটাকে দেখতে গেলাম। কোথায় বাচ্চা? প্রতাপের নানা ভঙ্গির ছবি। কখনো এক মুঠো চকলেট এগিয়ে দিচ্ছে, কখনও নীচু হয়ে কারো সঙ্গে কথা বলছে, আবার কখনও কারো হাতের টানে পাহাড়ি পথে পা বাড়াচ্ছে। প্রীতম বলে উঠল, “বাচ্চাটা কই?” জ্যাকেট ভেদ করে বরফ মেশান ঠান্ডা হাওয়া শরীরের মধ্যে ঢুকে এল, প্রবল শৈত্যে কেঁপে উঠলাম আমি।
২
প্রতাপের কথা
ছেলেটা পিচ্ছিল পথ বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। একটা টফি মোড়ক খুলে মুখে ফেলে, ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে
তাকিয়ে দেখে নিল আমি ঠিক আসছি তো! ছেলেটার পিছু পিছু অনেকটাই চলে এসেছি। বন্ধুদের ছেড়ে কী খেয়ালে যে এলাম! আলো ফুরিয়ে আসছে, আর এগোলে ফিরতে মুশকিল হবে। ছেলেটা যখন হাত নেড়ে ওর সঙ্গে যেতে বলল, ওর মায়াভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে না করতে পারিনি। কিন্তু এখন এই বড় বড় গাছগাছালি ভরা মরা আলোয় হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারলাম ভুল করে ফেলেছি খুব। ছেলেটা অনেকটা এগিয়ে গেছে, আমি দাঁড়িয়ে পড়েছি টের পেয়েই ঘুরে দাঁড়াল, হাত নেড়ে ডাকল। মাথা নেড়ে না বলতেই ছেলেটার মুখ চোখ পালটে গেল, একটা সাত আট বছরের বাচ্চার চোখ এত হিংস্র হতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত নেমে গেল। আমি ফেরার পথ ধরলাম, কিন্তু কয়েক পা হাঁটতে না হাঁটতেই টের পেলাম একটা ছুঁচলো পাথর মাথার পিছন দিকে এসে লাগল, মাথায় হাত দিতেই চটচটে পদার্থটা হাতে লাগতেই যা বোঝার বুঝে গেছি। আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম।
কিছুক্ষণ পরে মনে হল হাওয়ায় ভাসছি যেন। মাথাটা ভারভার। চেষ্টা করেও চোখ খুলতে পারছিনা, কে যেন চোখ দুটো আঠা দিয়ে জুড়ে দিয়েছে। তবে বুঝতে পারলাম অনেক জোড়া চোখ আমাকে লক্ষ করে যাচ্ছে নীরবে।
“এই প্রতাপ চোখ খোল। কী রে শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা?”
সায়কের গলা পেলাম। আমি একা একা জঙ্গলে হারিয়ে যাইনি তাহলে? সায়কের গলা শুনেই মনের মধ্যে ইচ্ছাশক্তি জমাট বাঁধল, আমি চোখ খুলে ফেললাম। আর তারপরেই চমকে গেলাম। এ কোথায় এসেছি আমরা? একটা পাথরের চাতালে আমি আর সায়ক গা ঘেঁষাঘেঁষি করে শুয়ে আছি আর আমাদের ঘিরে আছে নানান বয়সের কিছু লোকজন। দূরে পাহাড়ি ঝরনা সুরেলা ছন্দে বয়ে যাচ্ছে। বড় বড় গাছের ফাঁকে আকাশ দেখা যাচ্ছে না, তবুও জায়গাটা একটা অপার্থিব আলোয় ভরে গেছে।
আমি সায়ককে প্রশ্ন করলাম, “এখানে শুয়ে আছি কেন আমরা? চল পালাই।”
সায়ক আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “আরে সে চেষ্টা করিনি নাকি! নিজের হাত পা নাড়াতেই পারছি না, মনে হচ্ছে কে যেন অদৃশ্য শিকলে বেঁধে রেখেছে।”
সায়কের কথা শুনে আমি নিজের হাত পা নাড়াতে গিয়ে দেখলাম পারছি না, শরীরটা যেন পাথরের সঙ্গে আটকে গেছে। অসহায় ভাবে সায়কের মুখের দিকে তাকালাম। আমাদের দুজনকে দেখে ঘিরে থাকা মানুষগুলো দুলে উঠল। ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম, ওরা সবাই হাসছে, তাই শরীর দুলছে কিন্তু কী অদ্ভূত একটুও শব্দ হচ্ছে না হাসির। বরং সবাই এক ছন্দে দুলছে। এরা সবাই বোবা সেই ছেলেটির মত? ছেলেটির কথা মনে আসতেই ভিড়ের মধ্যে তাকে খুঁজতে লাগলাম। একটু দূরে সেই ছেলেটা বসে আছে। একটা বনমোরগের গলা মুচড়ে পলকে মেরে ফেলল, তারপর মোরগের দেহ থেকে গলাটা ছিন্ন করে রক্ত খেতে লাগল। দৃশ্যটা দেখেই গা গুলিয়ে গেল। ছেলেটা এবার রক্তমাখা মুখ তুলে আমাকে দেখল, মুখে তার পৈশাচিক হাসি।
সায়ক ফিসফিস করে বলল, “বেঁচে ফেরার চান্স কম, এরা কারা তাই তো বুঝতে পারছি না! ট্যুরিস্টদের ভুলিয়ে নিয়ে এসে সব লুঠ করে নেয় নাকি? সেই আগেকার দিনের ডাকাতের মত?”
“তাই যদি হয়, আমরা নড়তে পারছি না কেন সায়ক? কেউ তো বেঁধে রাখেনি আমাদের।”
আমার কথা শুনে চাপা গলায় সায়ক উত্তর দিল, “হিপনোটাইজ করে রেখেছে আমাদের, এসব গ্রাম্য লোকজন কালাজাদু জানে।”
হ্যাঁ সম্মোহনই তো! নাহলে ছেলেটার পিছু পিছু চলে এলাম কেন? আর আমাকে খুঁজতে এসে সায়কও ফেঁসে গেল।
এখন এর থেকে মুক্তি পাব কীভাবে! আমার ভাবনার মাঝেই বাতাস আরও ভারী হল, মাথার উপর জমাট অন্ধকারের চাঁদোয়া কিন্তু রূপালী আলোয় আমরা স্নান করে যাচ্ছি। খুব অদ্ভূত এই পরিবেশ। হঠাৎ সায়ক সামনের দিকে আঙুল তুলে আমার দিকে তাকাল। ও কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। সর্বনাশ, এত বোবা মানুষের মাঝে ও কি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলল? সামনে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের ঘিরে থাকা একটা মানুষও নেই। সব যেন ভোজবাজির মত উবে গেছে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড ওদের থেকে মনোযোগ সরিয়ে ছিলাম, তারমধ্যেই… কীভাবে সম্ভব এটা?
সায়ক ফিসফিস করে বলে উঠল, “ওরা মানুষ না প্রতাপ, আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে যা হোক করে।”
সায়কের কথায় একটা দমচাপা ভয় বুকের উপর চেপে বসল। আর তখনই শুনতে পেলাম বনভূমি বিদীর্ণ করে একটা নারীকন্ঠ তীক্ষ্ণ স্বরে কেঁদে উঠল। আর তারপরেই যা দেখলাম এ জীবনে ভুলব না, এত ঘুরেছি এমন অভিজ্ঞতা হয়নি কোনদিন। এসব শুধু হরর মুভিতেই সম্ভব। আমাদের চোখের সামনে রক্তমাখা পায়ের ছাপ ফুটে উঠল, যেন অনেক বয়সের মানুষের পা অশান্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে, তাদের দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু অনুভব করা যাচ্ছে রক্তমাখা পায়ের ছাপ দেখে। চোখের সামনে যে দুধজ্যোৎস্নার ঝরনাটি ছিল সেটিও রক্তলাল হয়ে উঠছে। আমরা টের পেলাম ঠকঠক করে কাঁপছি। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম এই অশরীরী দুনিয়া থেকে আমাদের আর মুক্তি নেই।
ঝুপ করে লোডশেডিং হলে যেমন জমাট অন্ধকারে আমরা ডুবে যাই, সেই অপার্থিব আলোটা ঝুপ করে নিভে যেতেই আমরা তেমনই অন্ধকারের মধ্যে ডুবে গেলাম। সায়ক আমার হাতটা আঁকড়ে ধরল অন্ধকারে, এই তো সায়কের মুভমেন্ট শুরু হয়েছে। তার মানে আমিও অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো নাড়াতে পারব এবার। কিন্তু সায়কের হাতে এত বড়বড় নখ কবে হল? ধারালো নখ আমার কবজিতে বসে যাচ্ছে, একটা সুন্দর নেশা ঝিম গন্ধ ছেয়ে যাচ্ছে, মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে আসছে।
তার মধ্যেই কোনক্রমে বললাম, “সায়ক ছাড় আমায়, কী করছিস?”
সায়কের মুখ দিয়ে অস্ফুট গোঙানির মত একটা আওয়াজ বেরিয়ে আসে। সামনের গাছটা থেকে একটা পাখি বিশ্রী স্বরে ডাকতে ডাকতে ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। এদিকে কবজিতে বসে যাচ্ছে সায়কের নখ। অনেক চেষ্টা করেও নড়তে পারছি না।
মরিয়া হয়ে আমি হনুমান চল্লিশা পাঠ করতে শুরু করলাম। পাঠ করতে করতেই বুঝতে পারলাম বাতাসের দমচাপা ভাবটা কমে আসছে, সেই গন্ধটাও আস্তে আস্তে দূর হয়ে যাচ্ছে, ঘুটঘুটে অন্ধকার কেটে গিয়ে বড় গাছাপালার মাথার উপর দিয়ে চাঁদের ক্ষীণ আলো ছড়িয়ে পড়ল। সায়ক আমার হাত ছেড়ে দিয়েছে, কেমন ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পরিবেশ এখন অনেকটাই স্বাভাবিক, একসময় ক্লান্ত হয়ে চোখদুটো লেগে গেল।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, ঘুম ভেঙে দেখি সায়ক ধাক্কা দিচ্ছে। পাথরের চাতালে নিজেকে দেখে প্রথমটায় বুঝতে পারছিলাম না কোথায় আছি আমরা! মুহূর্তে সব মনে পড়ে যেতেই উঠে বসলাম। এই তো আমি বা সায়ক দুজনের স্বাভাবিক। হাত পা নাড়াচাড়া করতে পারছি। দুজনেই পাথরের চাতাল থেকে নেমে দাঁড়িয়েছি। রিস্টওয়াচে দেখেও নিয়েছি দুটো দশ বাজে। কিন্তু এখান থেকে বের হব কীভাবে? চারদিকে দুর্গম জঙ্গল। কোনও পথ চোখে পড়ছে না।
সায়ক চোখের ইশারায় কিছু একটা দেখাল। আমাদের অবাক করে দিয়ে লাল টুকটুকে একটা একটা করে পায়ের ছাপ ফুটে উঠছে। বাড়িতে লক্ষ্মী পুজোর সময় আলপনা আঁকা হয় যেমন পায়ের ছাপের অনেকটা সেরকম। যেন মনে হচ্ছে আলতা ডোবান পাত্র থেকে পা তুলে কেউ মাটিতে হাঁটছে। আশ্চর্য এই পায়ের চিহ্ন দেখে একটুও আতঙ্ক হল না, লাল রংটা রক্ত বলেও ভ্রম হল না। নিশ্চিন্তে সেই পদচিহ্ন অনুসরণ করতে লাগলাম।
কতক্ষণ এভাবে হেঁটেছি জানি না, তবে প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে পিছনে কেউ যেন আমাদের লক্ষ করছে, পিছন ফিরলেই সেই বাচ্চা ছেলেটার জ্বলন্ত চোখদুটি দেখতে পাব। ঐ চোখে চোখ পড়লেই আবার সর্বনাশ ঘনিয়ে আসবে। কোনদিকে না তাকিয়ে সায়কের হাত ধরে হাঁটতে লাগলাম আলতা মাখা পায়ের ছাপ অনুসরণ করে।
৩
প্রীতমের কথা
সায়ক আর প্রতাপকে যে সুস্থ অবস্থায় ফিরে পাব ভাবিনি। সারারাত গাড়ির মধ্যে কাটিয়ে ভোরের আলো ফোটা মাত্র ড্রাইভারদাদাকে সঙ্গে নিয়ে আবার ছুটে ছিলাম রুটব্রিজের কাছে। রাস্তা বন্ধ ছিল, একটু ঘুরে সরু পাহাড়ি পথে গা ঘষটাতে ঘষটাতে যখন রুটব্রিজের কাছাকাছি যাই, দেখি দুজনেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। কোনরকমে ওদের তুলে কী কষ্ট করেই যে গাড়ির মধ্যে নিয়ে আসি আমিই জানি। তবে ড্রাইভারদাদা না থাকলে আমি কী করতাম জানি না।
ওদের মাঝখানে বসে দু’হাতে ওদের জড়িয়ে রেখে বাকিটা পথ চুপচাপ কাটিয়ে দিলাম। ওরা কোনও কথা বলছিল না। ড্রাইভারদাদা বলেছিল, “বোবা লরার সঙ্গে আজ পর্যন্ত যতজনের দেখা হয়েছে তারা বেশির ভাগ ফিরে আসেনি, বা এলেও জীবিত ফেরেনি। যে দু’চারজন ফিরে এসেছিল তাদের মধ্যে অধিকাংশরই বাকশক্তি চলে গিয়েছিল। এক আধজন ভাগ্যবান শুধু স্বভাবিক ফিরে এসেছিল দৈব মহিমায়।”
এসব দেবতা, অশরীরী কোনটাই আমি মানতে পারি না। তাই চুপ করে বসে ছিলাম বাকিটা পথ।
হোটেলে ফিরে স্নান করে ওরা দু’জন ঘুমিয়ে পড়ল। দু’জনেই শুধু একটি কথাই বলেছিল, “ভীষণ ক্লান্ত। ঘুমতে চাই।”
যাক বাবা, ওরা ঠিক আছে। বোবা লরার কাহিনীটা কাল রাত্রে জঙ্গলের মধ্যে ঐ ভয়াল পরিবেশে যখন শুনেছিলাম সত্যি বলে মেনে নিতে কষ্ট হলেও মিথ্যা মনে হয়নি। আজ কিন্তু বড্ড অবাস্তব মনে হল। আমার স্বাভাবসুলভ ভঙ্গিতে খিক খিক করে একচোট হেসেও নিলাম।
ওরা ঘুম থেকে উঠল একদম বিকেলে। উঠেই দুজনে জিজ্ঞেস করল কিছু খাবার পাওয়া যাবে কিনা? এই অবেলায় হাল্কা স্ন্যাক্স ছাড়া কিছুই পাওয়া যাবে না বলে আমরা পুলিশ বাজারের দিকে বেরিয়ে পড়লাম। খেতে খেতে ওদের কাল রাতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। দুজনের মধ্যে চোখে চোখে কিছু কথা হল, তারপর সায়ক বলল, “ভূতের হাত থেকে বেঁচে এসেছি ভাই, বেশি কিছু এখন জিজ্ঞেস করিস না।”
সায়কের কথা শুনে হেসে উঠলাম, “তুই এসব বিশ্বাস করিস? আর কারুর কাছে এসব বলিস না ভাই, আমরা তরুণ প্রজন্ম যদি এসব কুসংস্কার ছড়াই, সেট কি ঠিক হবে? তবে ভূতের গল্প গা ছমছমে পরিবেশে আমার হেব্বি লাগে। তোদের গল্পটা শুনব ভাই কোনও গভীর জঙ্গলে ট্রি হাউসে বসে। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়বে, আহ জমে যাবে ভাই।”
কথা ক’টা বলতে বলতে আরাম করে একটা ড্রামস্টিকে কামড় বসালাম। প্রতাপ বিরক্ত চোখে আমাকে এক পলক দেখে নিয়ে সায়ককে ইশারা করল চুপ করে যেতে।
পরের দিন ফেরার ট্রেনে চেপে বসলাম। একটা জিনিস লক্ষ করলাম ওদের সঙ্গে আমার কেমন একটা মানসিক দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। ওরা যে নিজের মধ্যে গল্পগুজব করছে তা না, সেদিনের পর থেকে কথা প্রায় বলছেই না ওরা। কিন্তু চোখে চোখে বা ইশারায় ওদের মধ্যে একটা বন্ডিং কাজ করছে, আমি সেখানে সম্পূর্ণ আউটসাইডার।
ফেরার কিছুদিন পর এক সকালে ঘুম ভেঙে দেখি, আমি কথা বলতে পারছি না। অথচ গলায় কোনও ব্যথা বা ইনফেকশন নেই। বাড়ির লোকও আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল। আমি এখন কলকাতার এক দামি নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে আছি। এই কদিনে অনেকরকম টেস্ট হয়েছে। ডাক্তারবাবু গম্ভীর মুখে রিপোর্ট দেখতে দেখতে জানিয়েছেন, অজানা একটা পোকার কামড়ে আমার ভোকাল কর্ডটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি আর কোনদিন কথা বলতে পারব না। সেইসঙ্গে আমার জীবনীশক্তিও একটু একটু করে কমে আসবে। এই ডাক্তারকে মানুষ সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি মানলেও আমার বাড়ির লোক সন্তুষ্ট হয়নি, কিছুদিনের মধ্যেই ট্রিটমেন্টের জন্য আমাকে চেন্নাই নিয়ে যাওয়া হবে।
আমি এখন ভিজিটিং আওয়ারের অপেক্ষা করছি। আজ আমার প্রিয় দুই বন্ধু সায়ক আর প্রতাপ আসবে। আশা করছি এবার ওদের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে অসুবিধা হবে না। আচ্ছা পোকাটার কী নাম রাখা যায় বলুন তো? বোবা লরা?
(সম্পূর্ণ কাল্পনিক কাহিনী, স্থান কালের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই)
গ্রাফিক্স্: ইন্দ্রশেখর
জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস