হাসান হাবিবের আগের গল্পঃ টারজানের গান
হাসান হাবিব
“ফিল্ড ক্যাম্প থেকে গেস্টহাউসে ফেরার পথে ঘটল ঘটনাটা। সন্ধ্যা নেমেছে সবে। একটু আগেই জোর বৃষ্টি হয়ে গেছে একপশলা। গাড়িটা এবড়ো খেবড়ো কর্দমাক্ত রাস্তায় চলতে চলতে বন্ধ হয়ে গেল,” বলে চুরুটে একটা টান দিল অরণ্যমামা।
“তখন তুমি কোথায় ছিলে মামা?” প্রশ্ন করে রাজা।
“চুপ কর না, মামাকে বলতে দে,” রূপসা গল্পের মাঝে রাজার ঘন ঘন প্রশ্ন করা একদম পছন্দ করে না।
“সে প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। সদ্য চাকরিতে ঢুকেছি। বিহার–নেপাল সীমান্তে ক্যাম্প বসেছিল আমাদের। বাল্মীকিনগর থেকে ভুলভুলাইয়া পেরিয়ে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে। গন্ডক নদীর তীরে সেই জায়গাটা ছিল খুব মনোরম। আমার আমন্ত্রণে সেখানে বেড়াতে গেছিল আমার দুই বন্ধু সমুদ্র আর পলাশ।”
ফের চুরুটে টান দেন মামা।
“সন্ধ্যার পর ওই রাস্তায় কোনও গাড়ি চলে না। তাই গাড়ি খারাপ হওয়া মানে বিরাট বিপদের ব্যাপার। তাও আবার জঙ্গলের ভিতরে। তড়িঘড়ি করে নেমে যা দেখলাম তাতে তো আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। গাড়ির বনেটের ভিতর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। তাড়াতাড়ি ব্যাটারির তার খুলে দিলাম। লাইটও নিভে গেল। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও মেরামত করা গেল না।”
“তারপর…?” সন্ধ্যার জঙ্গলে গাড়ি খারাপ শুনে নড়েচড়ে বসে রাজা।
“তুই চুপ করবি?” রূপসার মত ঝিলমিলেরও এত প্রশ্ন না পসন্দ, “বলতে দে না কাকুকে।”
“ওদিকে জঙ্গলে ছিল হাতির, চিতাবাঘের উপদ্রব। আমি জানতাম জায়গাটা খারাপ। আমার কথা শুনে ওরাও চিন্তিত হয়ে পড়ল। সবাই মিলে স্থির করলাম, হাতি বা চিতার মুখে পড়া যাবে না। তার চেয়ে কোথাও একটা আস্তানা খোঁজা উচিত। রাতটুকুর জন্য। শাল, মহুয়া, দেওদারের ঘন জঙ্গল। আকাশে মেঘ, যে কোনও সময় ফের বৃষ্টি নামতে পারে। চমকে ওঠা বিদ্যুতের আলোয় দেখলাম রাস্তার ধারে একটা বোর্ড লাগানো। কাছে গিয়ে পেন্সিল টর্চের আলো ফেললাম তাতে। দেখলাম হিন্দিতে লেখা আছে – রাজকীয় অতিথি নিবাস, বৃন্দাঝোরা ১ কিমি। যেদিকে তীর চিহ্ন দেওয়া ছিল সেই দিকে হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। আধঘন্টা হাঁটার পর আবার একটা বোর্ড দেখতে পেলাম। যেটাতে পাকা রাস্তা থেকে পাশের একটা টিলার দিকে তিরচিহ্ন দেওয়া।”
“টিলা! কত বড় মামা?”
রাজার দিকে রুষ্টভাবে তাকায় রূপসা আর ঝিলমিল।
“বেশি উঁচু নয়। তবে জঙ্গলে ঢাকা,” চুরুটে টান দিয়ে বলতে থাকলেন মামা, “সরু ফিতের মত একটা রাস্তা চলে গেছিল টিলার দিকে। একটা জিপ কোনমতে যাওয়া যাবে। কিন্তু রাস্তাটার ছাল চামড়া ওঠা অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে বহুদিন মেরামতি হয়নি। গাছের শুকনো পাতা, ডালপালাও পড়ে থাকতে দেখলাম। বুঝলাম তেমন লোক চলাচল নেই। সেই রাস্তায় ২০০ গজ মত হেঁটে গিয়ে পেলাম একটা জং ধরা গ্রিলের দরজা। টর্চের আলোয় দেখলাম একটা সাইনবোর্ড – রাজকীয় অতিথি নিবাস, বৃন্দাঝোরা।
রাজা রূপসার গাঁ ঘেঁসে বসল। তাই দেখে হাসল ঝিলমিল। ওদের মধ্যে রাজাই ছোট। গল্প যত রোমাঞ্চকর জায়গায় গিয়ে পৌঁছয় রাজা তত কারও গাঁ ঘেষে বসতে থাকে। বাঘ যখন হালুম করে বা ভূত যখন দাঁত বের করে এগিয়ে আসে তখন রাজা গিয়ে কারও কোলের উপর উঠে পড়ে।
বালিশে হেলান দিয়ে বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে মামা। তাকে ঘিরে তিন খুদে শ্রোতা। ছাই ঝেড়ে নিয়ে ফের বলতে থাকেন মামা, “সেখান থেকে ধাপে ধাপে উপরের দিকে উঠে গেছে সিঁড়ি। বিদ্যুৎ চমকানোর সময় দেখলাম একটা টিলার মাথায় গাছপালায় ঘেরা গেস্টহাউসখানা। শ’খানেক সিঁড়ি ভেঙে আমরা শেষতক উপরে গিয়ে পৌঁছালাম। চারটে একতলা ঘর নিয়ে গেস্টহাউসটা। ইংরাজি ইউ শেপ-এর মত। মাঝেরটা বড় হলঘর। “কোই হ্যায়?” বলে উঠোনে দাঁড়িয়ে একটা হাঁক পাড়ল সমুদ্র। ডান দিকের ঘরটার ভিতর একটা আলোর রেখা দেখা গেল জানালা দিয়ে। আমরা সে ঘরের দিকে এগোতেই একটা লোক সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তার হাতে একটা কালিঝুলি মাখা হ্যারিকেন। হ্যারিকেনটা উঁচু করে আমাদের দিকে ধরে সে বলল, “আইয়ে সাহাব, আইয়ে। হম জগদীশ, ইঁহা কা কেয়ারটেকার। চমকে উঠলাম আমরা তিনজনেই কোন ভূমিকা ছাড়াই এই অভ্যর্থনা দেখে। এই কেয়ারটেকারের তো জানার কথাই নয়, এই ঝড় বৃষ্টির রাতে আমরা ওইভাবে ওখানে যাচ্ছি! আমাদের ঘাবড়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল জগদীশ। ওর কালো ছোপধরা দাঁতের ভিতর দিয়ে ভয় যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তে লাগল।”
রাজা জানালা দিয়ে বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দেখল একবার। ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে গল্প জমে উঠেছে তখন।
ফের চুরুটে একটা টান দিয়ে বলতে শুরু করে অরণ্যমামা, ““আইয়ে সাব, কোই বাত নেহি। বিচ বিচ মে ইস তরেহ্ মেহমান চলে আতে হ্যাঁয় আধি রাতো মে।” আমরা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই উত্তর দিয়ে দেয় জগদীশ। আমরা থ মেরে যাই! মনের কথা পড়তে পারে নাকি ব্যাটা! বাম হাতে হ্যারিকেন ধরে ডান হাতে হলঘরের দরজা খুলতে ঠেলা দেয় জগদীশ। সেই মুহূর্তে ফের বিদ্যুৎ চমকায়। দেখি লোকটার দু’হাতের চামড়া, মুখমন্ডল আগুনে পোড়া। সাদা সাদা দাগ হয়ে আছে চামড়ার উপর।”
রাজার মতো রূপসা আর ঝিলমিলও তখন সেঁধিয়ে গেছে গল্পের ভিতর। রূপসা শুধু অস্ফুটে বলল, “তারপর কী হল মামা?”
“হঠাৎ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। টিলার আশে পাশেই কোথাও ফের যেন বাজ পড়ল একটা। ধেয়ে এল ঝড়ো বাতাস। টিনের ছাউনিতে তালপাতার ঘষটানি লেগে কড়কড়, কিড়কিড় ভৌতিক আওয়াজ। এই গা-ছমছমে পরিবেশের মধ্যে ঘরের ভিতরে ঢুকতে একটু ইতস্তত করলাম আমি। দরজার কাছে পা বাড়িয়েও সামলে নিলাম। ভাল করে দেখে নেবার উদ্দেশ্যে দরজায় দাঁড়িয়ে জগদীশকে প্রশ্ন করা শুরু করলাম।” মামার বলার ভঙ্গিমায় সেই রাতটা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে তিন শ্রোতার কাছে।
““রাত মে খানে কা কুছ মিলেগা?” আমার প্রশ্ন শুনে মাথা চুলকে উত্তর দিল জগদীশ, “বনানা পড়েগা বাবু। এক ঘন্টা টাইম দিজিয়ে। রোটি, দাল-কদু, ঔর ওমলেট বনা দেঙ্গে হম।” আবার বিদ্যুৎ চমকাল। ঘরে তার আলো এসে পড়ল। তাতে ঘরের ভিতর বেশ কিছুটা দেখতে পেলাম। উলটো দিকের দেওয়ালে বড়বড় কাঁচের জানালা। ভিতরে ডর্মিটরির মত বেশ কিছু লোহার খাটিয়া ফেলা। জগদীশের পিছু পিছু আমরা ঘরে ঢুকি। দু’টো সারিতে বারোটা খাট পাতা আছে ঘরটাতে। পুরানো লোহার সিঙ্গল খাটগুলো জং ধরা। তাতে ম্যাট্রেস পাতা আছে। তবে তার উপর ধুলোর পুরু আস্তরণ। বেশ কিছু জায়গায় ছিঁড়ে ফেটে গিয়ে ভেতরের স্পঞ্জ বেরিয়ে এসেছে। হাতের হ্যারিকেনটা দরজার পাশে রাখা ধুলো মাখা টেবিলের উপর রেখে বেরিয়ে গেল জগদীশ। এমন সময় ফের বিদ্যুৎ চমকাল। বজ্রপাত সেই ঘরের ভিতরে হলেও এতটা আশ্চর্য হতাম না!”
“কী দেখলে মামা?” ডান হাতে দিদির ফ্রকের কোণ খামচে মুঠোর মধ্যে ধরে রাজা।
“বিদ্যুতের আলোয় যা দেখলাম, সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল। কী আশ্চর্য! বারোটা আয়রণ খাটের ন”টাতে তেল চিটচিটে ময়লা ম্যাট্রেস, পুরু ধুলোর আস্তরণ গায়ে। শতেক জায়গায় ছেঁড়া-ফাটা। ভিতরের গদি বেরিয়ে আসছে উঁচু হয়ে। আর বাকি তিনটেতে? সুন্দর করে সাদা বেড-শিট পাতা! বালিশ সহ!”
রাজার মুখের দিকে তাকায় ঝিলমিল। রাজার মুঠো আর একটু শক্ত হয়। সেটা ফ্রকে টান পড়া দেখেই বুঝে যায় রূপসা। মামাও রাজার অবস্থা দেখে মনে মনে হাসে। গল্পের সিচুয়েশন অনুযায়ী রাজার এই অবস্থা পরিবর্তন দেখে বাকিরা যে মজা করে, সেটা রাজা অবশ্য মোটেই জানে না।
“পলাশ আর সমুদ্রও চমকে ওঠে। আমার কনুই খামচে ধরে পলাশ। আমরা ভেবে কূলকিনারা পাই না ওটা কাকতালীয় হতে পারে কিনা। তবে সেরকম বিপদজনক কিছু দেখলে না বলে পালাব বলে ঠিক করি।” অরণ্যমামার ভয়ার্ত কণ্ঠ যেন চোখের সামনে জীবন্ত করে তোলে জগদীশকে, “থোড়া চায়ে পি লিজিয়ে বাবু,” বলতে বলতে চায়ের কেটলি নিয়ে ঢোকে জগদীশ। তিনটে কাপ রেখে তাতে চা ঢালতে থাকে। চা দেবার সময় কাছ থেকে দেখি জগদীশকে। হাতের চামড়া কী রকম যেন খসখসে! কব্জি থেকে ঊর্ধ্ববাহু পর্যন্ত কেমন যেন গোলগোল লাগছে হাত দু’টো। ময়লা ধুতি হাফ করে পরা। রান্নার তেলচিটে, মশলা লেগে থাকা ফতুয়ার উপর একটা ফিনফিনে ময়লা চাদর চাপানো গায়ে। চা ঢেলে ফেরার সময় জগদীশের সঙ্গে একবার চোখাচোখি হয়ে গেল। বুকটা ধক করে উঠল। চোখদুটো কেমন যেন গোলগোল, জ্বলজ্বল করছে!”
রাজা রূপসার কোলের উপর বাম হাত রেখে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ডেপুটি ডিরেক্টর অরণ্যমামাকে পেলেই রাজাদের গল্প শোনার আসর জমে ওঠে।
“আমাদের চা খাবার মাঝে লুঙ্গি-পরা চাপকান গায়ে-দেওয়া একটা অন্ধকার মূর্তি দরজায় এসে দাঁড়াল। “নমস্তে বাবুসাব, হম ভরতলাল। ইঁহা কা নাইটগার্ড,” গম্ভীর কেমন-যেন ধরা গলায় বলল লোকটা। “ভরতলাল কি কথা বলার ছলে আমাদের দেখে গেল?” জিজ্ঞেস করল সমুদ্র। “ওর চোখও তো সেই একই রকম…জ্বলজ্বলে,” বলল পলাশ।”
তিন শ্রোতার মুখের দিকে তাকিয়ে অরণ্যমামা যেন খুঁজে পায় তাদের সেদিনের ভয়কে। “জানালার গরাদ দেখি খেয়ে গেছে উইয়ে। কাচ ফ্রেম থেকে খুলে পড়ছে। আমাদের টেনশন আরও বেড়ে গেল। খেয়েদেয়ে জানালা দরজা বন্ধ করে আর নিশ্চিন্ত ঘুমের উপায় রইল না।”
“তারপর কী হল, মামা?” ফের রাজা।
“খাবার পরই তেল শেষ হয়ে হ্যারিকেন নিভে গেল। আমরা একবুক ভয় নিয়ে তিন বন্ধু শুয়ে পড়লাম। সারাদিন ঘোরাঘুরি আর হাঁটার ধকল নিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, খেয়াল নেই। মাঝরাতে হঠাৎ ঘরের কোণে খুকখুক হাসির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।”
রাজা রূপসার হাতের উপর নিজের হাত রাখল। মামার সঙ্গে চোখোচোখি হল রূপসা, ঝিলমিলের। মামা রাজার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলতে শুরু করল, “কান পেতে বুঝতে করতে চেষ্টা করলাম ঠিক শুনছি কিনা। আবার সেই হাসি! যেন আনন্দের উল্লাস চেপে রাখার চেষ্টা হচ্ছে! আমাদের বুকে হাতুড়ি পিটতে শুরু করল। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে দেখি ঘরের ভিতর দুটো ছায়া মূর্তি…”
রাজা একটা ঢোক গিলল।
“পরস্পরের দিকে মুখ করে এক পা আর দু’ হাত সামনে তুলে কেমন জানি নৃত্যের তাল করছে। আর অস্পষ্ট খোনা গলায় বলছে –
-আঁজ কেঁয়া নসিব থেঁ, ভঁর্তে…
-হিঁ হিঁ হিঁ বঁহোৎ দিঁন বাঁদ মিঁলি এঁইসি মৌঁকে…
-আঁজ ইঁনকো রোঁস্ট বঁনাকে খাঁয়েঙ্গে…
ফের সম্মিলিত খিঁ খিঁ হিঁ হিঁ হাসি…”
“ভূত…!” শুকনো ঠোঁটে জিভ বোলায় রাজা।
“দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। মনে হল তখুনি ছুটে পালাই। কিন্তু উঠতে পারলাম না। সমুদ্র আর পলাশও জেগে ওঠেছে। চুপ করে দেখতে থাকি দুই অশরীরীর নাড়াচাড়া আর খিঁ খিঁ হিঁ হিঁ হাসি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে। ভাবি কী ভয়ানক রাত এল রে বাবা! গন্ডক নদীর তীরে বসে সন্ধ্যে পর্যন্ত পাখিদের ওড়াউড়ি দেখেছি। তখনও বুঝতে পারেনি যে সেটাই জীবনের শেষ দিন।”
“তারপর?” উত্তেজনায় প্রশ্ন করে ঝিলমিল।
“দুই অশরীরী নাচ বন্ধ করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। এগিয়ে আসতে থাকে। লম্বা হলঘরে এক কোণ থেকে অন্য কোণে… আমরা সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে দেখতে পাই।”
ক্লাস ফোরের রাজা ক্লাস সিক্সের রূপসার গায়ে হেলান দিয়ে বসে। আর কিন্তু রূপসা ঝিলমিল ওকে দেখে হাসে না। ওদেরও গা শিউরে ওঠে।
মামা বলতে থাকে, “হঠাৎ বাইরে যেন কাদের গলার আওয়াজ শোনা যায়। সঙ্গে সার্চ লাইটের তীব্র আলো ঝলসে ওঠে ভাঙা জানালায়। আলোর ঝলকানি পড়তেই দুই ছায়ামূর্তি অন্তর্হিত হয়ে যায়। আমরাও বিছানা থেকে এক লাফ দিয়ে উঠে পড়ি। দৌড়ে পড়িমড়ি করে বাইরে চলে আসি। দরজায় ধাক্কা লেগে কঁকিয়ে ওঠে পলাশ। কিন্তু প্রাণ বাঁচাতে তখন জখম পায়ের দিকে তাকানোর সময় কোথায়! গেস্টহাউসে ঢোকার মুখের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তখন সার্চলাইট হাতে এক বিশালদেহী পুরুষ। আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেই চিৎকার করে বলে ওঠে, “আরে সাহাব, তুরন্ত আইয়ে…কাঁহা চলা আয়া আপ…” পিছনে থেকে তার সঙ্গী চার জনের গলাতেও ফুটে ওঠে আতঙ্ক। “জলদি ভাগো সাব, জলদি ভাগো…” হাঁফাতে হাঁফাতে আমরা ছুটে এসে সিঁড়ির মুখের চাতালে পড়ে যাই। দেখি একজন পুলিশ অফিসার আর চার সেপাই দাঁড়িয়ে। “আপকি গাড়ি রোডসাইড মে দেখতে হি হম সমঝ গয়ে ওহি বাত হ্যায়। তো হম তুরন্ত আ গয়ে ইঁহা,” বললেন স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির ওসি।”
“পুলিশে তোমাদের বাঁচিয়ে দিল?”
“শোন না, শুধু বকবক করিস,” রাজাকে বকুনি দেয় রূপসা। মামা বলতে থাকে, “হ্যাঁ সে যাত্রা পুলিশ চলে আসায় বেঁচে গেলাম। তারপর রাস্তায় ফিরতে ফিরতে ফাঁড়ির ওসির মুখেই ঘটনাটা শুনলাম আমরা। ড্যামের জল শুকিয়ে যাবার জন্যে ওখানে পর্যটক আসাও কম হয়ে যায়। তবে একদিন সন্ধ্যার মুখে আটজন লোকের একটা দল গিয়ে পৌঁছয় ওই গেস্টহাউসে। তাদের সঙ্গে কয়েকটা বোঁচকা। গিয়েই ওরা দু’টো হাজার টাকার নোট দিয়ে পোলাও আর মুর্গির ব্যবস্থা করতে বলে।”
“তারা কারা মামা?” ফের প্রশ্ন করে রাজা। ঝিলমিল ওর কাঁধের কাছে চিমটি কাটে।
“বলছি, শোন। রাতে বাথরুম যাবার জন্য বাইরে বেরোয় ভরতলাল। সে দেখে ঘরের ভিতর থেকে জানালা দিয়ে আসা হ্যারিকেনের আলোটা বেশ জোরালো। জানালার কাছাকাছি যেতেই শোনে ফিসফিস করে কথা বলার আওয়াজ। জানালার কাচে চোখ রেখে তো ভরতলালের ভিরমি খাবার যোগাড়! হা ভগওয়ান, এরা কারা এসেছে তার গেস্টহাউসে! লোকগুলো ঘরের ভিতর মেঝের উপর গোল হয়ে বসে। আর তাদের আশেপাশে পাঁচ-ছটা খালি বোঁচকা। সামনে ঢেলে রাখা বান্ডিল বান্ডিল টাকার পাহাড়। সব নতুন আর চকচকে!”
“ওরা কি ডাকাত, মামা?”
“ঠিক ধরেছিস। ভরতলাল বুঝতে পারে ওরা ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে এই টাকা পেয়েছে। সে তখন জগদীশের সঙ্গে যুক্তি করে। যেভাবে হোক ওদের মেরে ওই লক্ষ লক্ষ টাকা হাতাতে হবে। কিন্তু ওই ষন্ডাগন্ডা আটজন লোককে তাদের পক্ষে মেরে ফেলা একেবারে অসম্ভব। আর অন্য কাউকে ডেকে এসব পাঁচকান করতে বা ভাগীদার বাড়াতেও ওদের মন চাইছিল না। তাই ওরা ঠিক করে যে খাবারে বিষ দিয়ে ওদের মেরে ফেলবে। তাহলে কোন ঝামেলার বা মারামারির প্রয়োজনই হবে না। তারপর দু’জন মিলে রাতে কোনও পাহাড়ের কোলে গর্ত করে ওদের দেহ মাটি চাপা দিয়ে দেবে।”
শেষ টান দিয়ে জানালায় চুরুট নামিয়ে রাখে অরণ্যমামা। বালিশে হেলান দিয়ে আধ শোওয়া মামার দিকে তাকিয়ে বসে উৎকন্ঠিত রাজা, রূপসা আর ওদের মামাতো বোন, ক্লাস সেভেনের ঝিলমিল।
“মামা তারপর?” জিজ্ঞেস করে রাজা।
“ওরা পরের দিন সকালের চায়ে বিষ মিশিয়ে দেয়। কিন্তু ডাকাত দলের সর্দার সকলের একসঙ্গে শরীর খারাপ শুরু হতেই ত্বরিতে বুঝে ফেলে খাবারে কিছু মেশানো হয়েছে। সে ভরতলালের দিকে এগোতেই তার ক্রুদ্ধ চোখ দেখে ওরা দু’জন রান্নাঘরের পাশের ঘরটায় ছুটে গিয়ে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ওরা জানত বিষক্রিয়া অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। মিনিট পনের কাটাতে পারলেই কেল্লা ফতে। দু’একজন আগেই ঢলে পড়েছে মাটিতে। দু’একজন ওদের ঘরের দরজা ভাঙাভাঙি করতে গিয়ে সেখানেই ঢলে পড়ে। সর্দার হঠাৎ দরজা বাইরে থেকে আটকে দেয়। পাশের রান্নাঘর থেকে গ্যাসের সিলিন্ডার বের করে আনে। জানালার গ্রিলের মুখে সিলিন্ডার রেখে পাইপ খুলে দেয়। ভিতরে তখন বিপদ বুঝতে পেরে ওরা দু’জন দরজা ধাক্কাধাক্কি শুরু করে। ডাকাতদের বাকিরা সবাই তখন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। সর্দার মরে যেতে যেতে দেশলাই কাঠি ধরিয়ে জানালার ভাঙা কাচের ভিতর দিয়ে ভিতরে ছুঁড়ে দেয়। ব্যস্, সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ!”
“তারপর?” একসঙ্গে প্রশ্ন করে রূপসা ও ঝিলমিল।
“একসঙ্গে দশটা লাশ আর ষাট লক্ষ টাকা পাওয়া যায় পরদিন। অপঘাতে মৃত্যু বলে ওরা কেউই সেই জায়গা ছেড়ে যায়নি। পরে কেয়ারটেকার হিসাবে একজনকে পাঠানো হয়েছিল। কাজে যোগ দেবার পরদিনই তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। তার গায়ে কোনও আঘাতের চিহ্ন ছিল না। শুধু চোখ দু’টো বিস্ফারিত অবস্থায় ছিল। যেন আতঙ্কে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে! তারপর থেকেই গেস্টহাউস তালাবন্ধ হয়ে যায়।”
রাজা এবার মামার কোলের কাছে গিয়ে বসে। রাজার মাথার চুলে হাত বুলোতে বুলোতে বলে চলে মামা, “তারপর থেকে ওই ভুলভুলাইয়ার জঙ্গল আর গেস্টহাউসে শুরু হয় অশরীরি উপদ্রব। মাঝেমধ্যে রাতের রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে যেত। পরদিন সকালে দেখা যেত রাস্তায় কোনও খারাপ গাড়ি। আর গেস্টহাউসে দু’একজনের মৃতদেহ!”
“মাগো, তোমাদেরও মেরে রক্ত খেয়ে নিত, মামা…” অরণ্য মামার গলা জড়িয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে ওঠে রাজা।
ওর আদুরে কথা শুনে হেসে ওঠে ঝিলমিল ও রূপসা।
অলঙ্করণঃ শিমুল
এই ঘরানার গল্প পড়লে টুক করে পড়ে নি। ভাল। কিন্তু সবচেয়ে অসাধারণ শিমুলদির ইলুশট্রেশন। লাজবাব।
LikeLike
দারুণ গা ছমছম একটি গল্প পড়লাম, অসাধারণ।
LikeLike
good
LikeLike