গল্প ভুলু নাহার তৃণা শরৎ ২০১৯

ভুলু

নাহার তৃণা

এক

ছুটির দিনটা পিকলুর ভারি আনন্দে কাটে। পড়াশোনার বালাই নেই, দিনমান খেলা আর খেলা। আগে ছুটির দিনগুলোতে পাড়ার আর সবার সাথেই হল্লা করে কাটত। এখন তেমনটা হয় না। চয়নরা এ-পাড়া থেকে চলে যাবার পর পিকলুর খেলার জায়গাও বদল হয়েছে। চয়নদের নতুন পাড়ার ছেলেমেয়েরা তাদের মতো গা-ভর্তি ধুলোবালিতে গড়াগড়ি করে আনন্দে মাতে না। ওদের খেলাধুলোগুলো ভারি নিশ্চুপ আর আনন্দহীন। তবুও চয়নদের বাড়ির ওদিক না গেলে পিকলুর ছুটির দিনটাই কেমন পানসে ঠেকে। চয়ন পিকলুর জানের বন্ধু। সেই ছোট্টবেলা থেকে ওরা পাশাপাশি বাড়িতে বেড়ে ওঠেছে। এখন দু’বন্ধু দুই পাড়া এমনকি আলাদা স্কুলে পড়লেও বন্ধুত্বটা অটুটই আছে। চয়নদের নতুন বাড়িটা এত বেশি ঝা-চকচকে, মাঝে মাঝে পিকলুর অস্বস্তি হয় গা-ভর্তি ধুলো নিয়ে সেখানে ঢুকতে। অবশ্য একবার বাড়িতে ঢুকে গেলে আর ওসব মনে থাকে না। চয়নের হাসিভরা মুখটা দেখলে এক ঝটকায় পিকলুর সব অস্বস্তি উবে যায়। রাতের অন্ধকারকে যেভাবে দিনের সূর্য শুষে নেয়, তেমনি করেই যেন চয়নের সূর্যভরা হাসি পিকলুর মলিনতাকে ঢেকে দেয়। শুধু চয়নের বড়বোন বিউলির সামনে কোনওভাবেই পড়তে চায়না পিকলু। বিউলিদি কুকুর একদম সহ্য করতে পারে না। আর পিকলু মানেই তো ওর পেছন পেছন ছায়াসঙ্গী ভুলুর অপরিহার্য উপস্থিতি।

চয়নের মতো ভুলুও পিকলুর জীবনের একটা অংশ। যেখানে পিকলু সেখানেই ভুলু। কেবল স্কুল আর ঘুমের সময়টুকু বাদ দিলে প্রায় সারাদিনই ভুলু পিকলুর সাথে সাথে। পিকলু তখন ক্লাস টুয়ে পড়ে। একদিন ঠিক সন্ধ্যার মুখে ছোটকা এই এত্তটুকুন ভুলুকে নিয়ে হাজির। পথের ধারে কুঁই কুঁই করতে দেখে তুলে এনেছেন পিকলুর জন্য। বাড়িতে কুকুর রাখবার ব্যাপারে মা তো কিছুতেই রাজী নয়। মায়ের সাথে দাদিমাও গলা মেলালেন। সে সময় বাবা এসে পড়ায় এ-বাড়িতে ভুলুর থাকাটা নিশ্চিত হয়ে যায়। অবশ্য বাবা তখন মা আর দাদিকে এটাই বুঝিয়ে ছিলেন যে, পথের কুকুর হাতে-পায়ে একটু বড়ো হলে পথে ফিরে যাবে। মা এবং দাদিমা অগাধ জ্ঞানী বাবার কথায় আস্থা রেখে যে মহা ভুল করেছিলেন, তা সময়ে অসময়ে বলতে ছাড়েন না। ভুলু আজও মা কিংবা দাদিমায়ের মন সেভাবে গলাতে পারেনি। অথচ এই ভুলুর কারণে বাড়ির কত কত উপকার হয়, সরবে নীরবে। মানুষ ভীষণ স্বার্থপর আর ভুলে যাওয়া স্বভাবের!

ভুলু নামটা ছোটকারই দেয়া। তাঁর মতে, “গরিব কুকুরের নাম সিজার বা এটিলা দ্য হুন না রেখে ভুলুই রাখ। দু’দিন পর পালিয়ে গেলে ভুলতেও সুবিধা, নাকি বলিস?”

পিকলুর ছোট্ট মাথায় এসব খুব একটা ঢুকেনি যদিও। তবে ওর পক্ষে নামটা সহজসাধ্য হওয়ায় খুশিই হয়েছিল। পরের দিন বিকেলে সবাই ছোট্ট ভুলুকে নিয়ে হুলোহুলির একশেষ। খায়রুল কিছুক্ষণ মন দিয়ে ভুলুকে দেখে বলে বসল, “এহ্, এটা তো নেড়ি কুত্তা! আমি ভেবেছিলাম অ্যালসেশিয়ান।”

জাতপাতের এতসব ওরা তখন কেউই জানত না। শৈশব-কৈশোরের অকপট হয়ে ভালোলাগার আনন্দে ওরা তখন বিভোর। মানুষ যত বড়ো হতে থাকে, আরও বেশি জানতে গিয়ে যেন নিজের ভেতরটাকেই সংকুচিত করে ফেলে এইসব বিভেদ-জাতপাতের আঁচড় টেনে টেনে। খায়রুল পিকলুদের চেয়ে বয়সের তুলনায় বেশিই জেনে গিয়েছিল যেন।

ভুলু যত বড়ো হতে থাকল, খায়রুলের কথাটা ততই সত্যি হতে থাকল। মা এখন মাঝেমধ্যে রেগে গিয়ে বলেন, “তাও যদি অ্যালসেশিয়ান হত!”

পিকলুর তখন ভারি কান্না পায়। মানুষ কত স্ববিরোধী হতে পারে? এই জটিলতার তেমন কোনও সুরাহা করতে না পেরে রাগের মাথায় ভুলুর পেটেই একটা লাথি কষায়। ব্যথার চেয়ে অবাক হয়েই ভুলু তখন ছিটকে দূরে সরে যায়। সে সময় সহজাত ওর কুঁ কুঁ শব্দটাও প্রাণ পায় না জোরালোভাবে।

এ-বছর পিকলুরা ক্লাস এইটে উঠল। নতুন ক্লাস এখনও তেমন জোরেশোরে শুরু হয়নি। কুড়িয়ে পাওয়া পয়সার মতো সময় তাই যথেচ্ছা ব্যবহারের স্বাধীনতায় মত্ত সবাই। এখন ওদের খেলার ধরনও বদলেছে। আগের মতো অহেতুক মাটিতে গড়াগড়া করা, ধুলোবালি না মেখে পাড়ার সবাই এখন ক্রিকেটে ব্যস্ত। যখন চয়ন বাড়িতে থাকে না তখন পিকলু নিজ পাড়ার খেলায় সামিল হয়। পিকলু ব্যাটিং-বোলিং দুটোতেই দারুণ ভালো। যে কারণে সবাই তাকে খেলায় নিতে আগ্রহী। কিন্তু খায়রুল ঠিকই হুল ফোটায়। “কেন, তোর বড়োলোক বন্ধু বুঝি তোকে খেলতে নিল না? তাড়িয়ে দিয়েছে?’’

সমস্বরে সবার হেসে ওঠাকে অগ্রাহ্য করে পিকলু দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাট চালায়। কিন্তু ইদানিং চয়নের বাড়িতে না থাকার মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে যাওয়াতে পিকলুর হয়েছে বিপদ। পাড়ার বন্ধুদের হাসি সবসময় অগ্রাহ্য করা ওর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেদিন তো আরেকটু হলেই খায়রুলের মাথাটা গিয়েছিল ওর ব্যাটের নিচে। আচমকা অবাক বাতাসের মতো চয়নের উপস্থিতির কারণে বেঁচে যায় খায়রুল। নাকি ওদের বন্ধুত্বই বেঁচে যায় অহেতুক অপমান থেকে!

চয়নের প্রতি কৃতজ্ঞতায়, ভালোবাসায় পিকলুর মনটা ভরে যায় সে মুহূর্তে। তবে খুব বেশিক্ষণ থাকেনি সে রেশটা। খেলা ছেড়ে ওরা দু’বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিল লেকের নির্জন দিকটাতে। এখানে প্রায়ই আসে পিকলু। সাথে অবশ্য তখন চয়ন থাকে না, ভুলু থাকে। পাড়ার ছেলেগুলোর সাথে যখন খেলায় যেতে ইচ্ছে করে না তখন পিকলু এখানে এসে চুপচাপ বসে থাকে।

চয়ন ভারি অন্যরকমের ছেলে। আজ পর্যন্ত ও গলা তুলে রূঢ় স্বরে কথা বলেনি। সবসময় ওর ঠোঁটে হাসি লেপটে থাকে। পিকলুর স্বভাবের ঠিক বিপরীত চয়ন। পিকলু অল্পেই রেগে যায়। সামান্যতেই চোখ ছলছলিয়ে ওঠে। পরক্ষণেই হৈ হৈ করে ভুলেও যেতে পারে সব। তবে পড়াশোনাতে দু’জনই তুখোড়।

চয়নের হঠাৎ আসবার কারণটি জানা যায় কিছু সময় পর। খুব রূঢ় কিছু বলে ফেলবার মতো অপরাধ করে ফেলছে, এমন একটা মুখ নিয়ে চয়ন যখন পিকলুকে জানায়, ওর বাড়ির কেউ চায় না যে সে আর ভুলুকে নিয়ে ওদের বাড়িতে যায় তখন পিকলুর বুকের ভেতরে কেমন অচেনা একটা অনুভূতি পাক খেতে খেতে গলার কাছটাতে এসে ভিড় করে। একটু দূরে বসে থাকা ভুলুটার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে পরক্ষণেই চয়নকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে। চয়নের জন্য পিকলু সব পারে। চাইলে স্কুলের ছয়তলা বিল্ডিং থেকে ঝাঁপও দিতে পারে চোখ বুজে। আর এ তো একটা নেড়িকুত্তার সঙ্গ ছাড়তে বলছে! তাও কিছু সময়ের জন্য। বাকি সময়টুকু তো ভুলু পেছন-পেছনই থাকবে। বন্ধুকে আশ্বস্ত করতে পারলেও বুকের ভেতর অচেনা কষ্ট কষ্ট অনুভূতিটা গেল না পিকলুর। সেটা বুকে নিয়েই সন্ধ্যা নামার আগে আগে বাড়ি ফিরে আসে সে। সে রাতে পিকলুর ধুম জ্বর এল। সারারাত মা জেগে রইলেন মাথার কাছে। ঘরের মেঝেতে বিষণ্ণ মুখে একটা প্রাণী বসে রইল নতমুখে।

দুই

টানা সাতদিন পিকলু জ্বরে ভুগে তারপর সেরে উঠল। এর মধ্যে চয়ন দু’দিন এসে তাকে দেখে গেছে। টানা স্কুল কামাই হওয়ায় জ্বর সারতে না সারতে পিকলু স্কুল যাওয়া শুরু করে। স্কুল শেষে একবারের জন্য চোখের দেখা দেখতে চয়নদের বাড়িতে গেল। যেহেতু স্কুলে যাবার সময় ভুলু সাথে থাকে না, তাই এসময়ে বিনা অস্বস্তিতেই সটান ঢুকে যায় পিকলু। চয়নের বাবা এসেছেন গতকাল। ওর বাবা অস্ট্রেলিয়াতে বড়ো চাকুরে। মাঝেমধ্যে ওরা গিয়ে বেড়িয়ে আসে। চয়নের দাদুর একদমই ইচ্ছে নয় চটি-বাটি গুটিয়ে সবাই গিয়ে বিদেশে বসত গড়ে। দাদুর শরীর খারাপ, তাই চয়নের বাবা দু’দিনের জন্যে হঠাৎই এসেছেন।

বাড়ির কেউ অসুস্থ থাকলে সেভাবে আড্ডা বা গল্প জমে না। তাছাড়া সন্ধ্যা পার করে বাড়ি ফেরাটা পিকলুর মাও খুব একটা পছন্দ করেন না। পিকলু তাই কোনওমতে দু-চারটে কথা বলে বাড়ি ফিরে আসে।

এর পর ভুলুকে ফাঁকি দিয়ে চয়নদের বাড়ি গেছে পিকলু। কিন্তু বাড়ি থেকে বেরোনোর মুখে দেখে রাস্তার পাশে ভুলু ওর জন্য অপেক্ষা করছে। ভুলুর এই নাছোড়বান্দার মতো পেছন লেগে থাকাটা মাঝেমধ্যেই পিকলুর ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়। তখন যা হবার তাই হয়। ঝেড়ে লাথি মারে অবলা জীবটাকে। রাতে যখন ভুলু কেমন করুণ সুরে উঁ উঁ করে, তখন নিজের অপকর্মের জন্য অনুশোচনা হয়। কিন্তু দিনের আলো ফোটবার সাথে সাথে সেসব পিকলু ভুলেও যায়।

বাড়িতে ইঁদুরের উপদ্রবে পিকলুর মা ভীষণরকমের বিরক্ত। ছোটকা ইঁদুর মারার নিত্যনতুন সব কল, ওষুধ এনে বাড়ি ভরিয়ে দিচ্ছেন। রোজ রাতে পিকলু দেখে মা খাবারে ইঁদুর মারবার ওষুধ দিয়ে রাখে। কিন্তু ওষুধে ভেজাল থাকায়, সন্তোষজনক ফলাফল না পাওয়ায় মায়ের ভাতমাখা চলতেই থাকে। ভুলুকে দেখা যায় তৎপর হয়ে মায়ের সেকাজে উৎসাহ যোগায়। পিকলু খরচোখে সেসব দেখে।

চয়নের দাদু হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে আসবার দু’দিন পরই মারা গেলেন। শোকের সময়টা পিকলু বন্ধুকে ছায়ার মতো আগলে রাখল। আর পিকলুর অলক্ষ্যে আরও একজন ওকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে গেল। কিন্তু মাঝেমধ্যেই বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে বিপত্তি বিরক্তির দুটোই যখন মাত্রা ছাড়াল তখন পিকলুকে জানানো হল ভুলুর কথা। অস্বস্তিতে পড়ে গিয়ে মাঝে কয়েকদিন পিকলু চয়নদের বাড়িতেই গেল না আর।

গতরাতে অনেক ভেবেছে পিকলু, তারপর একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। বন্ধুর জন্য জান কুরবান। ব্যাপারটা ঘটিয়ে ফেলার পর পাষাণভার নেমে গিয়ে হালকা অনুভব করে পিকলু। গত একটা মাস এটা নিয়ে চিন্তায় চিন্তায় জেরবার হয়েছে সে। এখন তার সব চিন্তার ইতি।

ঘুম ভাঙতে দেরি করায় কোনওরকমে নাকেমুখে গুঁজে স্কুলে চলে আসে পিকলু। আজ অনেকদিন পর সে বন্ধুদের সাথে হাসিঠাট্টায় গলা মেলায়। টিফিন পিরিয়ডে খুনসুটি করে অকাতরে। স্কুল শেষে প্রায় উড়তে উড়তে চয়নদের বাড়িতে চলে যায়। ব্যাপারটা চয়নকে জানাবার জন্য ছটফট করছে সে। চয়নদের বাড়ি গিয়ে দেখে ওর বাবা এসেছেন।

বাড়িতে বেশ হৈহৈ একটা ভাব। জানা গেল, দু’সপ্তাহ পর চয়নরা সবাই চলে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। ওরা চলে গেলে চয়নের বড়মামার পরিবার এ-বাড়িতে থাকবেন। আন্টি মানে চয়নের মা হাসতে হাসতে বললেন, “পিকলু, তুমি কিন্তু আসবে এ-বাড়িতে, যেমন আসতে। আর হ্যাঁ, চয়নের মামারও একটা পোষা কুকুর আছে, যদিও অ্যালসেশিয়ান। তুমি তোমার ঐ কুকুরটা নিয়ে আসতে পারবে। বুবুনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। কেমন?”

কে বুবুন! তার সাথে কেন পরিচয়ের প্রয়োজন? চয়ন চলে যাচ্ছে! সেকথা চয়ন তাকে বলেনি তো! বড়মামা… এতসব কথা পিকলুর মাথায় ঠিক ঢুকছে না। কেমন অসাড় একটা অনুভূতি ওর শরীর জুড়ে। পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যায়। এক ঝটকায় অসাড় শরীরটাতে সর্বশক্তি এনে ছুটে বেরিয়ে আসে চয়নদের বাড়ি থেকে। ঝাপসা চোখে ছুটতে ছুটতে পাগলের মতো বিড়বিড় করতে থাকে, “তোর খাবারে যে বিষ মিশিয়েছি তাতে যেন ভেজাল থাকে। প্লিজ তুই সুস্থ থাকিস, ভুলু!”

অলঙ্করণঃ ইন্দ্রশেখর

জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস

2 thoughts on “গল্প ভুলু নাহার তৃণা শরৎ ২০১৯

  1. জানি লেখিকা যান্ত্রিক আখরে গল্পটা লিখেছেন। লেখার সজল আবেশে ভাবতে ইচ্ছে করছে, উনি ভুলুর বিশ্বস্ত চোখে চোখ রেখে লেখনী দিয়ে বাঁধ-ভাঙা কান্নার জোয়ারকে আটকে রেখেছেন। মানব-মনের এই ভালবাসার এই দ্বন্দ্বের এমন স্বরূপ কমই দেখছি।
    লেখিকাকে লাখ লাখ সেলাম।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s