গল্প -মিমো-সত্যজিৎ দাশগুপ্ত-শরৎ ২০২০

সত্যজিত দাশগুপ্তর আগের গল্প মোতিবিবি, ক্লাইম্যাক্স, বোলতার চাক, বিশ্বনাথের চিত্রনাট্য, ফ্ল্যাট নম্বর ২০১ সেই মেয়েটা

মিমো

সত্যজিৎ দাশগুপ্ত

আজ প্রায় চারদিন হয়ে গেল কিডোরা না পারছে স্কুলে যেতে, না পারছে খেলতে যেতে! বাইরে যাকে বলে একেবারে ধুন্ধুমার বৃষ্টি। মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে একটা আশা জাগাচ্ছে বটে, কিন্তু ওইটুকুই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার হৈ হৈ করে নেমে পড়ছে। এমনটা চলতে থাকলে কলকাতা আর কয়েকদিনের মধ্যেই জলে ভাসবে। অবশ্য আবহাওয়া দপ্তর বলেছে আস্তে আস্তে অবস্থার উন্নতির কথা।

কিন্তু ঘরে বসে যে সময় কাটতে চায় না। তাই কিডোরা এসে হাজির হয়েছে লোকনাথদাদুর ফ্ল্যাটে। এই ফাঁকে একটা গল্প শুনে নিলে বেশ হয়, তাই। এতে অবশ্য লোকনাথদাদুর কোনও আপত্তি নেই। কারণ এই ক্ষুদে ছেলেমেয়েগুলো ছাড়া মানুষটার তিনকুলে আর কেউ নেই। আর আছে একজন চব্বিশ ঘণ্টার কাজের লোক। সারাজীবন হিল্লি-দিল্লি করে বেরিয়ে আজ ওঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার বিশাল। আর সেগুলোই উনি কিডোদের কাছে এক এক করে বলেন গল্পের আকারে। ওঁর এই গল্প বলার ক্ষমতার জন্য অনেকের কাছে উনি তো একালের তারিণীখুড়ো! আবার নানান বিষয়ে জ্ঞান থাকার জন্য কেউ কেউ ওঁকে গুগলদাদু বলেও ডাকেন। তাছাড়া কিডোদের ওঁর কাছে আসা নিয়ে ওদের বাবা-মায়েদেরও কোনও আপত্তি নেই। কারণ ওঁরা জানেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরা লোকনাথদাদুর কাছে এলে আর যাই হোক খারাপ হবে না।

বৃষ্টির আওয়াজ ততক্ষণে কান সওয়া হয়ে গেছে। অবশ্য মাঝে মাঝে বাজের শব্দে বুক কেঁপে যাচ্ছে বটে। বসার ঘরে লোকনাথদাদু তাঁর অতি প্রিয় ইজি চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে বসে। আর তার সামনে মেঝেতে শতরঞ্চি পেতে ওঁকে ঘিরে রয়েছে কিডো, দ্যুতি, রিবাই আর রায়ান।

“আর ভালো লাগছে না।” ঠোঁট উলটে বলল দ্যুতি।

“হ্যাঁ দাদুভাই, আর বৃষ্টি ভালো লাগছে না।” নাকমুখ একসঙ্গে কুঁচকে দ্যুতির কথায় সায় দিল কিডো।

“এভাবে ঘরে বসে থাকতে কার ভালো লাগে দাদুভাইরা! কিন্তু উপায় কী বলো।” মাথা নেড়ে বললেন লোকনাথদাদু।

রিবাই আর রায়ান কিছু না বলে একে অপরের দিকে তাকাল। সবার চোখে এখন একটাই প্রশ্ন। লোকনাথদাদু কখন গল্প শুরু করবে। আর আজকের গল্পের বিষয়টাই বা কী। লোকনাথদাদুও বাচ্চাগুলোর মনের কথা জানেন। যতক্ষণ না উনি গল্প শুরু করেন, ওরা ছটফট করতে থাকবে।

“আজ কী নিয়ে গল্প বলবে দাদুভাই?” জিজ্ঞাসা করল কিডো।

“আজ কি বৃষ্টির গল্প হবে?” এবার প্রশ্ন এল দ্যুতির থেকে।

“না। বৃষ্টি হচ্ছে বলে তোমাদের মনে হতেই পারে যে আমি হয়তো আজ বৃষ্টি নিয়ে গল্প বলব। কিন্তু না, আজ আমি তোমাদের একটা খুব মজার একটা গল্প বলব।”

“হাসির গল্প?” বলে সামনে ঝুঁকে পড়ল রিবাই।

“না, ঠিক হাসির গল্প নয়। মজার গল্প।” বললেন লোকনাথদাদু।

“আচ্ছা, ঠিক আছে। তাই বলো তাহলে।” বলল রায়ান।

ততক্ষণে লোকনাথদাদুর কাজের লোক কিডোদের জন্য জলখাবার দিয়ে গেছে। আর লোকনাথদাদুর জন্য এসেছে পেল্লায় কাপে করে এক কাপ গরম গরম লাল চা। উনি এবার তাতে একটা আয়েশের চুমুক মেরে শুরু করলেন তাঁর নতুন গল্প।

“জায়গাটার নাম ঠিক জানা নেই। বিশাল পাহাড়গুলো যেখানে মাটি ছুঁয়েছে, সেখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে একটা গ্রাম। একটা ঝরনা রয়েছে সেই পাহাড়গুলোর মাঝে। তার থেকে নেমে এসেছে একটা নদী। উত্তর থেকে দক্ষিণ, আঁকাবাঁকা ওই নদীটা পুরো গ্রামটাকেই মিলিয়ে দিয়েছে। সারা গ্রাম জুড়েই ভিড় করে রয়েছে বড়ো বড়ো গাছ। শাল, সেগুন, পাইন—আরও কত কী! কখনও হালকা, কখনও জোরে, হাওয়ার তালে তালে গাছগুলো দুলে চলেছে প্রায় সারাটা দিন। আকাশটা এখানে অনেক বড়ো। গ্রামের একপ্রান্ত থেকে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে আরেক প্রান্তে। পাহাড়ের চূড়ায়। কখনও দেখলে মনে হতে পারে, কেউ যেন জঙ্গল থেকে পাহাড় পর্যন্ত একটা বিশাল নীল সামিয়ানা টাঙিয়ে দিয়েছে। দূষণ বলে কোনও শব্দ মনে আসবে না এই গ্রামে থাকলে। এখানে শহরের মতো চোখ জ্বলে না। গাড়িঘোড়ার শব্দে কান ঝালাপালাও হয়ে যায় না। সেই সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত কানে আসে পাখিদের কিচিরমিচিরের আওয়াজ। যেখান দিয়ে নদীটা গেছে, সেখানে বা তার আশেপাশে গেলে কানে আসবে নদীর জলের কলকল শব্দ। ওরা মনের আনন্দে কোথায় যেন ছুটে চলেছে। সন্ধের পর অবশ্য মাঝে মাঝে জংলি শেয়াল আর হাতির ডাক শুনে একটু ভয় ভয় করে বটে, তবে সেগুলো আজ পর্যন্ত কখনও বিপদ ডেকে আনেনি।

“মিমো বলে খুব ছোট্ট মিষ্টি একটা মেয়ে থাকত ওই গ্রামে। ওর বাবা করত চাষবাস, আর মা ঘরের কাজ। যেহেতু পাহাড়ি গ্রাম, তাই তাতে ঘরের সংখ্যাও ছিল অনেক কম। আর লোকজনও ছিল হাতে গোনা। মিমোর বন্ধুর সংখ্যাও সেই কারণে খুব বেশি ছিল না। সকালবেলা গ্রামের স্কুলে পড়ত মিমো। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরেই শুরু হত খেলা। চলত বিকেল পর্যন্ত। বাবা ক্ষেত থেকে ফিরলে তার কাছ থেকে রোজই কিছু না কিছু পাওনা থাকত। সন্ধে থেকে আর বাবার কাছ ছাড়া হত না ছোট্ট মিমো। সারাদিন কী কী করেছে, কার কার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ রযেছে, মা কেন তাকে বকেছে, সব মন দিয়ে শুনতে হত বাবাকে।

“বাবা-মা ছাড়া মিমোর আপন বলতে ছিল এক দিদা। সে থাকত অন্য আরেকটা গ্রামে। মাঝেমধ্যে আসত মিমোদের বাড়ি। আর তার সঙ্গে নিয়ে আসত মিমোর জন্য অনেক খেলনা। দিদাকে খুব ভালোবাসত মিমো। সে এলে তাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে বসে থাকত। এক মুহূর্তের জন্যও কাছ ছাড়া করত না।

“সেদিন ছিল বুধবার। রোজকার মতোই মিমো স্কুল থেকে ফিরেছে দুপুর প্রায় সাড়ে বারোটায়। আজ মা বলেছিল হাঁসের ডিম রান্না করবে। তাই বাড়ি ফিরতে দেরি করেনি। কিন্তু ঘরে ঢুকতেই চোখ গোল গোল হয়ে গেল ওর। দু’গালে ছড়িয়ে পড়ল হাসি। আনন্দের চোটে বার চারেক লাফ দিয়ে নিল। জোরে জোরে হাততালি দিল অনেকবার। তারপর দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল দিদার কোলে।

“সেবার দিদা মিমোদের বাড়ি ছিল প্রায় এক সপ্তাহ। কতকিছু খাওয়াদাওয়া হল, মজা হল, ঘোরা হল। এবারে কিন্তু দিদা অন্যান্য বারের মতো মিমোর জন্য হাত ভরে খেলনা নিয়ে আসতে পারেনি। আসলে দিদাদের গ্রামে কী যেন হয়েছে। সেই কারণে গত কয়েকদিন যাবত সেখানকার দোকানপাট সব বন্ধ। কিন্তু একমাত্র নাতনিকে দেখতে এল, আর তাও আবার খালি হাতে! দিদার কি মন মানে? তাই ফেরার সময় দিদা মিমোর হাতে একশো টাকার একটা নোট দিয়ে বলল, ‘গ্রামে তো কয়েকদিনের মধ্যেই মেলা আসছে। মাকে নিয়ে যেও দিদিভাই। কিছু কিনো।’

“মিমো মুখে কিছু বলল না। মনে মনে অবশ্য ভীষণ খুশি হল। টাকাটা মিমো খরচ করল না। কিন্তু টাকা তো রাখতে হয় টাকার ব্যাগে। আর ওর কাছে তো তেমন কোনও ব্যাগ নেই। তাই দিদা চলে যেতে ও সেটা মায়ের কাছেই রেখে দিল। বলল যত্ন করে রেখে দিতে। যখন দরকার পড়বে, ও সেটা মায়ের থেকে নিয়ে নেবে। আসলে মনে মনে ও ভেবে রেখেছিল যে এই টাকাটা ও কোনোদিনও খরচ করবে না। দিদার কথা মনে পড়লেই ও টাকাটা বের করে দেখবে। আর তার আগে যাতে টাকাটা একবারেই চিনতে পারে, তাই টাকার গায়ে ও ওর অপরিণত হাতে লিখে রাখল ‘দিদা’।

“পরের দিন খুব মনখারাপ করে কাটল মিমোর। বাবা অনেক কষ্ট করেও বেশি কিছু খাওয়াতে পারল না। রাত কাটল প্রায় না ঘুমিয়ে। খালি দিদার কথা মনে পড়ছিল। পরদিনও মন ভালো ছিল না মিমোর। এমনকি বাবা ফিরতে তার সঙ্গেও বেশি কথা বলল না। রাতে কোনোরকমে দুটো রুটি খেয়ে তাড়াতাড়ি বিছানা নিল।

“রোজ ভোরবেলায় স্কুলে যেতে হয়। তাই আজও প্রতিদিনের মতোই ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে পড়ল মিমো। কাল রাতেও ভালো করে ঘুম হয়নি। থেকে-থেকেই দিদার কথা মনে হয়েছে। খুব কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু মা বলেছে ও বড়ো হয়ে গেছে। আর বড়োরা কাঁদে না। তাই ও কাঁদেনি। কিন্তু মনখারাপ তো তাতে আটকে রাখা যায় না। তাই স্কুল যাবার আগে ও মায়ের কাছে দিদার দেওয়া টাকাটা চাইল। আজ ও ওটা নিয়েই স্কুলে যাবে। ব্যাগে রেখে দেবে। তাতে ওর মনে হবে দিদা ওর সঙ্গেই আছে। এতে মনখারাপও কিছুটা কমবে।

“কিন্তু মা টাকাটা হাতে দিতেই মাথা নেড়ে ও বলল, ‘না মা, এটা নয়। দিদা যেটা দিয়েছিল সেটা দাও।’

“মা তখন হেসে বলল, ‘সেটাই তো দিলাম।’

“না মা, এটা দিদার দেওয়া টাকা নয়।’

“এটাই তো সেই টাকাটা। কালই তো তুই আমাকে দিলি।’ আবার বলল মা।

“এবার বুকটা ধক করে উঠল মিমোর। জোরে জোরে শ্বাস পড়তে শুরু করল। মনটা কেন জানি না কু ডাকতে শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে। বলল, ‘আমি এটাতে পেন্সিল দিয়ে দিদা লিখে রেখেছিলাম মা।’

“ও তাই?’ মা এবার টাকাটা হাতে নিয়ে বলল, ‘কই, কিছু তো লেখা নেই।’

“‘তাই তো বলছি মা, এটা দিদার দেওয়া টাকা নয়।’ বলতে বলতে কান্না পেয়ে গেল মিমোর। বলল, ‘আমাকে ওই টাকাটা দাও মা।’

“মা তখন টাকাটা মিমোকে দিয়ে বলল, ‘ওইরকম কোনও টাকা আমার কাছে নেই। এখন ইস্কুলে যাচ্ছিস, যা।’

“‘দাও না মা।’ গলার কাছটা ততক্ষণে ধরে এসেছে মিমোর।

“মা তখন এক মুহূর্ত কী যেন ভাবল। তারপর মিমোর হাত থেকে টাকাটা নিয়ে বলল, ‘কই, দে দেখি।’ তারপর ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। মিমো নিচের ঠোঁট আর নাক একসঙ্গে ফুলিয়ে ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে রইল। মা ফিরে এল একটু পর। মিমো সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিতে মা ওর হাতে একশো টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিল।

“একটা আশার আলো জেগেছিল। কিন্তু মায়ের হাত থেকে টাকাটা নিয়ে সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আবার হতাশ হয়ে পড়ল মিমো। ‘কোথায় মা? এটাও তো দিদার দেওয়া টাকাটা নয়!’ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল মিমো।

“মা তখন ওর হাত থেকে টাকাটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, ‘কই, এটাই তো টাকাটা। ভালো করে দেখ।’

“‘না মা, এটা ওই টাকাটা নয়। আমি ওটাতে পেন্সিল দিয়ে দিদা লিখে রেখেছিলাম।’

“‘ও, তাই নাকি?’ বলে মা আবার দেখল টাকাটা। তারপর বলল, ‘কই, এতে তো কিছু লেখা নেই!’

“‘তাই তো বলছি। এটা দিদার দেওয়া টাকাটা নয় মা। ওই টাকাটা দাও।’ বলে আবার হাত পাতল মিমো।

“‘দাঁড়া দেখছি।’ বলে মা আবার ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। প্রায় মিনিট খানেক পর যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এল, তখন মায়ের মুখ আর চলার ধীর গতি দেখেই মিমো বুঝতে পারল কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে।

“‘দাও মা দিদার দেওয়া টাকাটা।’

“মেয়ের কথা শুনে মা তখন আমতা আমতা করে বলল, ‘আসলে মিমো, কী হয়েছে বল তো, সকালে আব্দুলচাচা এসেছিল তো। ডিম কিনেছি ওঁর কাছ থেকে। টাকাটা আমি ওঁকেই দিয়ে দিয়েছি।’

“‘কী! তুমি দিদার টাকাটা…’ কথা শেষ করতে পারল না মিমো। ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না যে মা এমন কাজ করতে পারে!

“এদিকে নিজের ভুল বুঝতে পেরে মা গলা নরম করে বলল, ‘দেখ, আমার কাছে মোট তিনটে একশো টাকার নোট ছিল। তার মধ্যে তোর দিদার দেওয়া টাকাটাও ছিল। আমি ঠিক বুঝতে পারিনি রে মা।’

“কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না মিমো। ফ্যালফ্যাল করে ও চেয়ে ছিল মায়ের মুখের দিকে। বুক ফেটে কান্না পাচ্ছিল ওর। মা বুঝতে পারছিল মেয়ের মনে অবস্থা। তাই সান্ত্বনা দেবার জন্য বলল, ‘তুই চিন্তা করিস না মিমো। আমি আবার দিদাকে বলব, পরের বার এলে তোকে আরেকটা একশো টাকার নোট দেবে।’

“শেষ কথাগুলো ভালো করে ঢুকলও না মিমোর কানে। ও ততক্ষণে রাগে দুঃখে ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটতে শুরু করেছে। ছুটতে ছুটতে যখন বাড়ির বাইরে রাস্তায় চলে এসেছে, তখন কানে এল মায়ের গলা। ‘সাবধানে স্কুলে যাস। দুপুরে আজ তোর পছন্দের খাবার করব। এসে খাবি।’

“মায়ের গলাটা দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল। মিমো দৌড়ে চলল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওর স্কুল ডানদিকে। কিন্তু ও যাচ্ছিল বাঁদিকে। এখান থেকে কিছুটা গেলেই আব্দুলচাচার বাড়ি। ও চেনে। চাচা নিশ্চয়ই এখন বাড়িতে। নাকি হাটে বেরিয়ে গেছে? কে জানে। কিন্তু ওকে আজ দেখা পেতেই হবে আব্দুলচাচার।

“প্রায় মিনিট দশেক একটানা দৌড়ে একটা একতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল মিমো। খুব হাঁফাচ্ছিল। একবার ডানে-বাঁয়ে তাকাল। কেউ কোথাও নেই। বাড়ির সামনেটা নিস্তব্ধ। যদিও এখন আর ভোর নেই। আব্দুলচাচা বাড়িতে আছে কি? নাকি ডিম বিক্রি করতে অন্য জায়গায় চলে গেছে? যদি অন্য জায়গায় চলে যায়, তাহলে তাকে কী করে পাবে মিমো? জানবে কী করে সে কোথায় গেছে? আব্দুলচাচার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সাতপাঁচ ভাবছে, এমন সময় কানে এল একটা গলা। ‘কী, মিমো বেটি! তুমি এখানে এই সময় কী করছ?’

“গলাটা ওর চেনা। ঝট করে এবার ঘুরে দাঁড়াল মিমো। আব্দুলচাচা তখন তার পুরনো মোটর সাইকেল থেকে নামছে। মিমো ছুটে গেল তার কাছে। এবার হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমার একশো টাকাটা দাও।’

“‘টাকা? কোন টাকা বেটি?’ অবাক হল আব্দুলচাচা।

“‘আজ তুমি আমাদের বাড়ি গেছিলে। মা তোমার থেকে ডিম কিনেছে। আর তখন তোমাকে যে একশো টাকার নোটটা দিয়েছিল সেই নোটটা। আমাকে ফেরত দাও।’

“‘নোট ফেরত দেব!’ অবাক হয়ে বলল আব্দুলচাচা।

“‘ওটা আমার দিদা আমাকে দিয়েছিল। মা ভুল করে তোমাকে দিয়ে দিয়েছে।’

“‘কিন্তু বিটিয়া, আমি ডিম বিক্রি করে খাই। ওটা তো আমার ইনকাম।’

“‘মা তোমাকে অন্য টাকা দিয়ে দেবে। এখন ওই টাকাটা আমাকে দাও। ওটা আমার দিদা আমাকে দিয়েছিল।’ বলে হাত পাতল মিমো।

“আব্দুলচাচা কী বুঝল কে জানে। কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল। তারপর মাথা চুলকে বলল, ‘কিন্তু বেটি, ও-টাকা তো আর আমার কছে নাই।’

“কথাটা শুনে মুখ ছোটো হয়ে গেল মিমোর। ও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল আব্দুলচাচার দিকে। আব্দুলচাচা ওকে তখন বলল, ‘আমি ওই টাকাটা জুরানের দোকানে দিয়ে দিয়েছি।’

“‘জুরানের দোকানে? টাকাটা হাতে এসেও বেরিয়ে গেল!’ একটা হতাশার ঢোঁক গিলল মিমো।

“‘হ্যাঁ রে বিটিয়া। আসলে আমি হপ্তায় হপ্তায় ওর দোকান থেকে ঘরের মালপত্র কিনে নিয়ে আসি তো। এখন তাই গেছিলাম জিনিস কিনতে। আর তার সঙ্গে টাকাটাও দিয়ে এসেছি। কিন্তু…’

“আব্দুলচাচার কথা শেষ করতে দিল না মিমো। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে এক ছুট লাগাল। জুরানের দোকানে ও আগে গেছে। বাবার সঙ্গে। আজও নিশ্চয়ই পৌঁছে যেতে পারবে আন্দাজ করে করে। কষ্ট হলেও ওকে যেতেই হবে। কিন্তু হাতে সময় নেই। স্কুল ব্যাগটা পিঠে। সেটা সামলাতে সামলাতে ছুটতে লাগল মিমো। পেছন থেকে আব্দুলচাচার গলাটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছিল, ‘আস্তে, আস্তে, বিটিয়া। কোথায় যাচ্ছ? তোমার বাবা-মা চিন্তা করবে…’

“সামনে রাস্তাটা ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে। সরুও হয়ে গেছে অনেকটা। দু’পাশে বড়ো বড়ো গাছগাছালি। তার মাঝে একটা ছোট্ট রাস্তা আচমকা বাঁক খেয়ে ঢুকে গেছে ডানদিকে। এই গলির মুখটাতে একবার দাঁড়াল মিমো। বেশ কিছুক্ষণ ভাবল। ওর মনে পড়ল। হ্যাঁ, এই গলিটা দিয়েই বাবা ওকে জুরানের দোকানে নিয়ে গেছিল। একবার আকাশে দিকে তাকাল। সকাল আরও উজ্জল হয়ে উঠেছে। দোকানে ভিড় বাড়তে পারে, তাই আর না দাঁড়িয়ে সোজা ঢুকে পড়ল সরু মাটির রাস্তাটাতে। জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। তার মধ্য দিয়ে দৌড়ে চলল মিমো। একেবারে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়োচ্ছিল। কয়েক পা এগোতেই না দেখতে পেয়ে ডান পাটা ঠোকা খেল একটা পাথরের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে গিয়ে পড়ল রাস্তার পাশে জঙ্গলে।

“লতায় পাতায় জড়িয়ে পড়েছিল। এবার কোনোরকমে উঠে বসল। তারপর আস্তে আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে গিয়ে এবার ডান পায়ে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল। ঝুঁকে পড়ে দেখল ডান হাঁটুর কাছটা লালচে হয়ে গেছে। আলতো করে সেখানে হাত রেখেই সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিল। খুব ব্যথা। পড়ে গিয়ে পাথরে ঠোকা খেয়েছিল হাঁটুটা। কয়েক মুহূর্ত একভাবে দাঁড়িয়ে দম নিল মিমো। তারপর আবার ছুটতে শুরু করল। ব্যথা ছিল অবশ্যই। কিন্তু সেটা জোর করেই ভুলে গেল। দিদার টাকাটা ওকে ফিরে পেতেই হবে।

“ছোটো রাস্তাটা শেষ হল একটা খোলা জায়গায় গিয়ে। তারপর দু’পা এগিয়ে ডানদিকে ঘুরতেই পেল একটা মুদির দোকান। পিঠে কুঁজ নিয়ে জুরান তখন দোকানের লোকজন সামলাতে ব্যস্ত। বেশ কিছুক্ষণ জুরানের দিকে চেয়ে রইল মিমো। এবার আস্তে আস্তে ওর মুখে হাসি ফুটে উঠল। প্রাণভরে নিশ্বাস নিল। আর ঠিক এই সময় ঘটল সাংঘাতিক একটা ঘটনা।

“মিমো দাঁড়িয়ে ছিল জুরানের দোকানের প্রায় তিরিশ গজের মধ্যে। সেই বাড়ি থেকে আব্দুলচাচার বাড়ি হয়ে জুরানের দোকান পর্যন্ত পৌঁছানো, তাও আবার দৌড়ে, চাট্টিখানি কথা নয়। ভীষণ হাঁফাচ্ছিল বেচারি। কিন্তু আর সময় নষ্ট করা চলবে না। এক বুক নিঃশ্বাস নিয়ে দোকানের দিকে পা বাড়িয়েছে, ঠিক এমন সময় আকাশ কাঁপিয়ে বিকট শব্দ করে মিমোর দিকে লাফিয়ে ধেয়ে এল বিশাল আকারের একটা কালো জংলি কুকুর! আচমকা এই ভয়াল দর্শন কুকুরটাকে দেখে দম প্রায় আটকে গেছিল মিমোর। পা দুটো মাটিতে কে যেন আটকে দিয়েছিল। অবশ হয়ে গেছিল সেগুলো। ভয়ে, ‘মা!’ বলে চিৎকার করে উঠে চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল ও। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ কেটে যেতেও তেমন কিছু ঘটল না। ঠিক এই সময় একটা হাতের ছোঁয়া অনুভব করল মাথায়। ধীরে ধীরে চোখ খুলে সামনে পেল জুরানকে। হাসি মুখে মিমোর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জুরান জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল মা? আর ভয় নেই। ওকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছি।’

“ভয়ে ভয়ে চারপাশটা দেখে নিল মিমো। হাত দুটো তখনও ওর বুকের কাছে মুঠো করা অবস্থায় জড়ো করা। থরথর করে কাঁপছে সেগুলো।

“‘আর ভয় নেই মা। এসো এসো।’ বলে জুরান ওকে নিয়ে গেল দোকানের ভেতরে। সেখানে রাখা চৌকিটাতে বসিয়ে এক গ্লাস জল দিল ওকে। জুরান ওদের অনেকদিন ধরে চেনে। আচমকা মিমো ওর দোকানে এভাবে এসেছে। ব্যাপারটা ভাবাল জুরানকে। ভয় পেল? কিছু কি হয়েছে? তাই এবার গলা নরম করে মিমোকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে মিমো? তুমি একা একা এইভাবে এত দূর এসেছ কেন? কিছু হয়েছে?’

“মিমো কোনও উত্তর না দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল জুরানের দিকে। জুরান আবার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে মা? বলো।’

“‘আমি আব্দুলচাচার বাড়ি গেছিলাম।’ বার দুয়েক ঢোঁক গিলে বলল মিমো।

“‘আব্দুলচাচা? মানে যে ডিম বিক্রি করে?’

“‘হ্যাঁ।’ মাথাটা বার দুয়েক সামনের দিকে ঝোঁকাল মিমো।

“‘কিন্তু তার সঙ্গে তোমার এখানে আসার কী সম্পর্ক?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল জুরান।

“‘আব্দুলচাচা তোমার কাছে এসেছিল জিনিস কিনতে।’ বলল মিমো।

“‘হ্যাঁ, কিন্তু তাতে কী?’ মিমোর কথা শুনে আবার অবাক হল জুরান।

“‘জিনিস কিনে আব্দুলচাচা তোমাকে একটা একশো টাকা দিয়েছিল।’

“‘একশো টাকা!’ মিমোর কথা মাথায় ঢুকছিল না জুরানের।

“‘ওই টাকাটা আমার। ওটা আমাকে দাও।’ বলে কাঁদো কাঁদো মুখে ডান হাতটা পেতে দিল মিমো।

“‘তোমার টাকা! মানে!’ ছোট্ট মেয়েটার এমন আজব আবদার শুনে হাসবে না রাগ করবে বুঝতে পারছিল না জুরান।

“‘আমার দিদা আমাকে ওই টাকাটা দিয়েছিল। তাতে আমি ‘দিদা’ লিখে রেখেছিলাম। আমার মা ওটা আব্দুলচাচাকে দিয়ে দিয়েছিল। ডিম কিনেছিল তো, তাই। চাচা বলল, আজ সকালে সে তোমার দোকানে এসেছিল জিনিস কিনতে। আর তখন চাচা তোমাকে ওই টাকাটা দিয়েছে। ওই টাকাটা আমার দিদা আমাকে দিয়েছিল। আমি পেন্সিল দিয়ে ওটার ওপর ‘দিদা’ লিখে রেখেছিলাম। আমার টাকা আমাকে দাও। আমার মা তোমাকে অন্য টাকা দিয়ে দেবে।’

“প্রায় একদমে কথাগুলো বলে গেল মিমো। একদৃষ্টে নিষ্পাপ মেয়েটার দিকে চেয়ে ছিল জুরান। বাচ্চারাই হয়তো এমন সরল মনের হয়। তাই তারা এমন কথা বলতে পারে। কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল আব্দুলচাচার দেওয়া টাকাটার কথা। এবার ব্যাপারটা মনে পড়তে মুচকি হেসে মিমোর দিকে দিকে এগিয়ে এল। তারপর ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে গলা নামিয়ে বলল, ‘কিন্তু মা, আমার কাছে তো সেটা আর নেই।’

“‘নেই!’ আঁতকে উঠে দাঁড়াল মিমো। তারপর আতঙ্কের গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় ওটা!’

“‘আব্দুলচাচা যখন আমার দোকানে এসেছিল, তখন অর্জুন ছিল আমার দোকানে। আমি ওকে তখন টাকাটা দিয়ে দিয়েছি যে মা!’

“‘অর্জুন কে?’ একটা অচেনা নাম শুনে আরও হতাশ হয়ে পড়ল মিমো।

“‘ওই যে, যে ছেলেটা বাড়ি বাড়ি খেজুরের গুড় বিক্রি করে, সেই।’

“একটা ছেলেকে গ্রামের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে গুড় বিক্রি করতে ও দেখেছে। তাই ও জিজ্ঞাসা করল, ‘লম্বা কালো দেখতে?’ বলে হাতটা যতটা হয় ততটা ওপর দিকে তুলে জিজ্ঞাসা করল মিমো।

“‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছ মা। রোজ আসে আমাদের গ্রামে। আমি ওকেই টাকাটা দিয়ে দিয়েছি যে।’

“‘অর্জুন কোথায়?’ কাঁদো কাঁদো হয়ে জিজ্ঞাসা করল মিমো।

“‘সে তো বাড়ি চলে গেছে।’

“‘কোথায় থাকে অর্জুন?’ মিমোর মাথায় তখন ঘুরছে আবার একটা অজানা পথে ওকে দৌড়োতে হবে।

“‘সে তো অনেকটা। গ্রামের প্রায় শেষপ্রান্তে। ওইদিকে, যেখানে শ্মশান আছে। রোজ সকালে ও গুড় বিক্রি করতে বেরোয়। সকাল প্রায় এগারোটা-সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ও গুড় বিক্রি করে। তারপর ফিরে যায় বাড়িতে।’

“জুরানের কথা শুনে মিমোর খেয়াল হল যে ওর স্কুল ছুটির সময় হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে না ফিরলে মা চিন্তা করবে। কিন্তু তাতে ওর কিছু করার নেই। দিদার দেওয়া টাকাটা ওকে ফেরত পেতেই হবে। আর জুরানের বাড়িতে দাঁড়াল না মিমো। ওকে এখনই যেতে হবে অর্জুনের কাছে।

***

“একটা বিশাল বটগাছ। সেটার ঝুরিগুলো নেমে এসে মাটিতে ঠেকে কে যে কোথায় কোথায় হারিয়ে গেছে তা বোঝা মুশকিল। যার ফলে গাছটার আসল গুঁড়িটা যে কোনটা, সেটাই খুঁজে পাওয়া যায় না। গাছটার বিশাল ডালপালাগুলো এমনভাবে দিনের আলোকে আড়াল করেছে যে, এখন ভরদুপুর, যেটা বুঝতেও কষ্ট হয়। আলো প্রায় পৌঁছচ্ছিলই না গাছের নিচে। মিমোর মনে হচ্ছিল ও যেন সন্ধের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। দূরে দেখা যাচ্ছে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়টা। আকাশটাও প্রায় চলে গেছে গাছের আড়ালে। এই বটগাছটাকে ঘিরে রয়েছে আরও নানান সব জানা অজানা পাহাড়ি গাছপালা। মিমোর প্রায় বুক অবধি ঘাসে ছেয়ে ছিল চারপাশটা। একটু দূরে গাছটার ডালপালা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে মাটিটা ফাঁকা। নিয়মিত ব্যবহার হয় বলে সেখানে ঘাস ওঠেনি। বেশ কিছু পোড়া কাঠ এখনও পড়ে আছে একপাশে। মিমো বুঝল, এটাই শ্মশান। আজকালের মধ্যেই মড়া পোড়ানো হয়েছিল মনে হয়। আর এই ফাঁকা জায়গাটার থেকে হাত দশেক দূরেই একটা একচালার খড়ের চালের মাটির বাড়ি। যার পেছন দিয়ে বয়ে চলেছে এই গ্রামের একমাত্র নদীটা। তাতে জল বয়ে চলার কলকল শব্দ কানে আসছে।

“একে তাকে জিজ্ঞাসা করে অনেক কষ্ট করে মিমো এসে পৌঁছেছে এখানে। একটা লোক যাবার সময় এই বাড়িটা দেখিয়ে গেল। বলল এখানেই নাকি অর্জুন থাকে। ওর বাবা মড়া পোড়ায়। এক পা দু’পা করে ঘাস সরিয়ে ও এবার ফাঁকা জায়গাটাতে এসে দাঁড়াল। কেউ কোথাও নেই। দুরু দুরু বুকে মিমো একবার ঘার ঘুড়িয়ে দেখল চারপাশটা। তারপর মাথা তুলে দেখল। কী বিশাল উঁচু গাছটা। মনে হল ও যেন একটা দৈত্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে ভেসে আসছিল কোকিলের ডাক। এই ডাকটা ওর খুব প্রিয়। ভারি মিষ্টি লাগে। তার সঙ্গে কানে আসছিল আরও কত নানা পাখির কিচিরমিচিরের আওয়াজ। এবার আরও এক পা এগিয়ে গেল ওই ঘরটার দিকে। এমন সময় হঠাৎ কানে এল একটা খসখস আওয়াজ। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে কিছু একটা চলে যাচ্ছে যেন। এই শব্দ মিমো চেনে। একেবারে নড়াচড়া করা চলবে না এখন। না হলেই বিপদ। তবে শব্দটা কোথা থেকে আসছে, ঘাড় ঘুরিয়ে ও সেটা দেখার চেষ্টা করছিল। ততক্ষণে আওয়াজটা মিহি হয়ে এসেছে। এবার যখন ওর দৃষ্টিটা বাঁদিকে কোনাকুনি পড়ল, তখন ও পরিষ্কার দেখতে পেল কালো মোটা লেজটা শুকনো পাতার তলায় আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। ওটা যে মারাত্মক বিষাক্ত, তা দেখেই বোঝা যায়। কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন শ্বাস আটকে গেছিল মিমোর। সাপটা চলে যেতে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এবার ঘোর কাটল একটা শব্দে। কেউ মনে হল ঘরের দরজাটা খুলছে। সঙ্গে সঙ্গে ও নিজেকে লুকিয়ে নিল বটগাছটার গুঁড়ির আড়ালে। আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখল একটা ছেলেকে ঘরটা থেকে বেরিয়ে আসতে। এই ছেলেটাকে ও আগে দেখেছে। বাঁক কাধে ঝুলিয়ে তাতে গুড়ের হাঁড়ি চাপিয়ে গ্রামে ঘুরে ঘুরে ও গুড় বিক্রি করে। আগে নাম জানত না। এখন জুরানের মুখে শোনা নামটার সঙ্গে মিলিয়ে নিল। এই তার মানে অর্জুন।

“ছেলেটা কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে সোজা চলে গেল নদীর দিকে। মিমো ভাবল একবার ডাকে ওকে। কিন্তু ও তো ওকে চেনে না। টাকাটা কি ফেরত পাবে? উলটে যদি অর্জুন ওকে মারে? কথাটা মনে আসতে ও ঝট করে নিজেকে আবার গাছের আড়ালে লুকিয়ে নিল। তারপর ধীরে ধীরে গাছের আড়াল থেকে মাথাটা বের করতে এবার দেখতে পেল একটা বয়স্ক মানুষকে। মিমোর মন বলল, এই হল অর্জুনের বাবা। লোকটা কোথায় যেন যাচ্ছে। এই বেলা যদি ও ঘরে ঢুকে টাকাটা খুঁজে বের করে! কিন্তু ঘরে অর্জুনের মাও তো থাকতে পারে! তাহলে তো ও ধরা পড়ে যাবে! কিন্তু ঠিক এই সময় লোকটা যেতে যেতে অর্জুনের উদ্দেশ্যে হাঁক পেড়ে বলল, ‘ওরে ওই ছেলে, আমি বাজার চললাম মাছ আনতে। তুই জলদি ঘরকে আয়। ফাঁকা আছে ঘর।’

“লোকটা চলে গেল। মিমোর বুক ধুকপুক করতে শুরু করল। এই তো সুযোগ! ঘর ফাঁকা! যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। ঘরের দরজাটাও হাঁ করে খোলা। এবার দৌড়ে গিয়ে ঘরে ঢুকল মিমো। ইস, কী ছোটো ঘর! ওদের ঘরে এর থেকে ঢের বেশি জিনিস রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই বা ও কোথায় খুঁজবে টাকাটা? একবার চিন্তা করল মায়ের কথা। ওর মা হয় বিছানার নিচে আর না হয় চামড়ার ওই চৌকো বড়ো একটা বাক্সর মধ্যে টাকা রাখে। কী যেন বলে ওটাকে। বাবাকে বলতে শুনেছে সুটকেস। কিন্তু এই ঘরটাতে তেমন কোনও সুটকেস দেখতে পেল না। একটা চৌকি ঘরের মাঝে রাখা ছিল। কিন্তু ওদের বাড়ির মতো বিছানা বা চাদর পাতা নেই তাতে। একটা ছেঁড়া মাদুর বেছানো রয়েছে মাত্র। মিমো গুটি গুটি পায়ে সেটার দিকে এগিয়ে গেল। হয়তো ওটার তলাতেই রাখা রয়েছে ওর দিদার দেওয়া একশো টাকার নোটটা! এবার যেই ও মাদুরটা তুলে সেটার নিচটা দেখতে গেছে, এমন সময় কানে এল ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ আর তার সঙ্গে একটা গলা, ‘এই, কে রে তুই? এখানে কী করছিস?’

“আচমকা গলাটা শুনে চমকে গেছিল মিমো। সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে গিয়ে দেওয়ালের সঙ্গে সিঁটিয়ে গিয়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। ততক্ষণে ঘরে ঢুকে এসেছে অর্জুন। কপাল কুঁচকে বেশ কিছুক্ষণ মিমোর দিকে চেয়ে ও আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কে তুই? চুরি করতে ঢুকেছিস?’

“চুরি কথাটা শুনে ভীষণ কান্না পেয়ে গেল মিমোর। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠল। ‘না না, আমি চোর নই।’

“‘তাহলে? এভাবে আমাদের বাড়িতে ঢুকেছিস যে? কী নিতে ঢুকেছিস? কোথা থেকে এসেছিস?’ ধমকে উঠল অর্জুন।

“বকা খেয়ে এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মিমো। হঠাৎ করে কান্না শুনে থতমত খেয়ে গেল অর্জুন। সঙ্গে সঙ্গে স্বর নরম করে বলল, ‘আরে আরে কাঁদিস না। কিন্তু তুই কে? কোথা থেকে এসেছিস? আর কেনই বা এসেছিস এখানে?’

“‘আমি আমার একশো টাকাটা ফেরত নিতে এসেছি।’ চোখ মুছতে মুছতে বলল মিমো।

“‘একশো টাকা!’ মিমোর কথা শুনে অর্জুন অবাক হল।

“‘আমার দিদা আমাকে দিয়েছিল। আজ সকালে মা ওটা ডিম কিনতে গিয়ে আব্দুলচাচাকে দিয়ে দিয়েছে। তারপর আব্দুলচাচা জিনিস কিনতে গিয়ে ওটা জুরানকে দিয়েছে। আর জুরানের থেকে তুমি নিয়ে নিয়েছ।’ বলেই আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মিমো।

“অর্জুন অবাক হয়ে মিমোর কথা শুনছিল। ভাবল, বলে কী মেয়েটা। তারপর বলল, ‘দিদা, একশো টাকা, আব্দুলচাচা, জুরান—তুই কী বলছিস আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না রে। তবে তোকে কিন্তু আমার খারাপ মেয়ে বলে মনে হচ্ছে না। তুই কী চাস বল তো?’

“‘আমার দিদার দেওয়া টাকাটা ফেরত দাও। মা তোমাকে আরেকটা একশো টাকা দিয়ে দেবে।’

“‘আহ্‌, টাকা ফেরত দাও বললেই দেওয়া যায়! আর কোন টাকার কথা বলছিস তুই?’ তারপর কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে বলল, ‘হুঁ, দাঁড়া দাঁড়া, আজ আমি জুরানকে গুড় বিক্রি করেছি বটে। আর তার বদলে ও আমাকে একটা একশো টাকার নোট দিয়েছিল সেটাও ঠিক কথা।’

“‘তাহলে দাও। ওটা আমার দিদা আমাকে দিয়েছে।’ বলে আবার ওর ছোট্ট হাতটা অর্জুনের সামনে পেতে দিল মিমো। অর্জুনের কথা শুনে ততক্ষণে ওর মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সেটা আবার মিলিয়েও গেল। কারণ ওর আবদার শুনে মুখ দিয়ে চুক করে একটা আওয়াজ করে অর্জুন বলল, ‘কিন্তু সে টাকা তো আমার কাছে আর নেই!’

“‘কোথায়!’ অর্জুনের কথাটা শুনে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল মিমো।

“‘ওটা তো লুম্বা নিয়ে গেছে।’

“‘লুম্বা?’ বলে হাঁ করে অর্জুনের দিকে চেয়ে রইল মিমো। ওর গাল বেয়ে তখনও জল গড়িয়ে পড়ছে।

“‘লুম্বা এখানে এসেছিল মাটির হাঁড়ি বিক্রি করতে। আমি তো গুড় বিক্রি করি। হাঁড়িতে করে গুড় নিয়ে যাই লোকের বাড়ি বাড়ি। ঘরে হাঁড়ি শেষ হয়ে গেছিল। তাই আজ হাঁড়ি কিনেছি লুম্বার থেকে। তখন আমি ওকে ওই টাকাটা দিয়ে দিয়েছি। যে টাকাটা জুরান আমাকে দিয়েছিল।’

“‘এবার সব আশা শেষ।’ ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল মিমো।

“অর্জুন তখন ওর দিকে এগিয়ে এল। ‘কী হল?’

“‘আমার দিদার টাকা।’ ধরা গলায় বলল মিমো।

“‘বললাম না, ওটা লুম্বা নিয়ে গেছে।’

“‘লুম্বা কে?’

“‘ওই তো, যে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মাটির হাঁড়ি বিক্রি করে।’

“‘কোথায় থাকে লুম্বা?’

“‘সে তো অনেক দূর। ওই সেই আদিবাসী গ্রামে।’

“‘আদিবাসী গ্রাম!’

“‘হ্যাঁ, নদীর ওপারে। ওই যে একটা আদিবাসী গ্রাম আছে, সেখানে।’ বলে হাত তুলে অর্জুন যেভাবে দেখাল, সেটার মানে হল লুম্বাদের গ্রাম এই গ্রাম থেকে অনেক দূর।

“জায়গাটা পাহাড়ি হলেও নদীটা তেমন এবড়ো-খেবড়ো ধরনের নয়। ওপার থেকে এপার মানুষ নৌকোতে যাতায়াত করে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে শেষে নৌকো পেল মিমো। মাঝি তো ওকে নিতেই চায় না। এতটুকু মেয়ে একা একা কোথায় যাবে? কে আছে ওপারে? কী কাজ তার? আরও কত প্রশ্ন। অনেক করে মাঝিকে রাজি করাল মিমো। লুম্বা ওর বন্ধু শুনে মাঝি অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি অতটুকু মেয়ে, লুম্বা তোমার বন্ধু!’ অবশ্য তারপর বলল যে লুম্বা খুব ভালো ছেলে। মিমো ভাগ্যিস অর্জুনের থেকে জেনে নিয়েছিল যে লুম্বা রোগা, লম্বা কালো আর ওর মাথায় কোঁকড়ানো ছোটো ছোটো চুল আছে। এটা বলেই ও মাঝিকে বিশ্বাস করাতে পারল যে লুম্বা ওর পরিচিত। একটা বাচ্চা মেয়ে এই সময় স্কুলের পোশাক পরে একা একা নদী পার হতে চাইছে, যে কেউ সন্দেহর চোখে তাকাবে।

“ছলাত ছলাত করে জল কেটে ওপারের দিকে এগিয়ে চলেছে নৌকো। থেকে-থেকেই মায়ের কথা মনে পড়ছিল মিমোর। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। মা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। কাঁদছেও হয়তো। মায়ের মুখটা মনে পড়তে কান্না পেয়ে গেল মিমোর। পরক্ষণেই বেজায় রাগ উঠল। কেন মা আব্দুলচাচাকে ওই টাকাটা দিয়ে দিল? এই যে এতসব হচ্ছে, ওকে এত দূর নদী পেরিয়ে যেতে হচ্ছে, এতে ওর কী দোষ? টাকাটা দেবার আগে দেখে দেওয়া উচিত ছিল মায়ের।

“দেখতে দেখতে নৌকো গিয়ে ভিড়ল নদীর ওপারে। দুয়েকজন যাত্রী ছিল তাতে। ওরা সবাই আদিবাসী। একটা বাচ্চা মেয়ে একা একা রাস্তা পার হচ্ছে দেখে তারাও থেকে থেকে কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকাচ্ছিল। নামার সময় মাঝি বলল, ‘চিনে যেতে পারবে তো লুম্বার বাড়ি?’

“লুম্বা যে কে, ও তাই চেনে না, তো তার বাড়ি! শুধু জানে যে লুম্বা মাটির হাঁড়ি বিক্রি করে। এই সময় একটা বুদ্ধি এল ওর মাথায়। বলল, ‘অনেকদিন আগে বাবার সঙ্গে এসেছিলাম।’

“মাঝি তখন হেসে বলল, ‘জানতাম চেনো না।’

“অন্য যাত্রীদের মধ্যে একজন ওদের কথা শুনছিল। সে বলল, ‘তুমি লুম্বার বাড়ি যাবা?’

“‘তুমি চেন নাকি ওস্তাদ?’ এবার ঘুরে গিয়ে মাঝি জিজ্ঞাসা করল লোকটাকে।

“‘লুম্বা থাকে হেই হোতায়।’ বলে দূরে হাত তুলে দেখাল।

“‘পাহাড়ে?’ ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করল মিমো।

“‘না না, পাহাড়ে নয়। ওইদিকে। এখান থেকে প্রায় দুই ক্রোশ হবেক।’ বলে আবার হাত তুলে দেখাল লোকটা।

“‘ওস্তাদ, মেয়েটারে একটু পৌঁছে দেও না।’ বলল মাঝি।

“তাতে জোরে জোরে মাথা নেড়ে সে লোক বলল, ‘অত সময় নাই আমার। হেই রাস্তা ধইরে সোজ্জা চইলে যাও। পেয়ে যাবা।’

“সামনে সোজা ছোটো মাটির রাস্তাটা দেখে একবার ঢোঁক গিলল মিমো। তারপর ঘাড় কাত করে বলল, ‘আচ্ছা।’

“‘যেতে পারবা?’ জিজ্ঞাসা করল মাঝি।

“‘হ্যাঁ।’ বলে আবার ঘাড় কাত করল মিমো।

“‘আচ্ছা যাও তাইলে।’ বলে নৌকো নিয়ে মাঝি এগোল নিজের কাজে।

“গ্রামের পাহাড়ি এবড়ো-খেবড়ো সরু রাস্তা ধরে হেঁটে চলল মিমো। ডানদিকে পাহাড় আর বাঁদিক দিয়ে বয়ে চলেছে নদীটা। কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে, কে লুম্বা, ওর কাছে সেই আদৌ আছে কি না টাকাটা, জানে না মিমো। লোকটা বলেছিল যে এই রাস্তা ধরে সোজা গেলেই পাওয়া যাবে লুম্বার বাড়ি। আর লুম্বার কাছেই আছে ওর দিদার দেওয়া টাকাটা। এগিয়ে চলল মিমো। মনে মনে ভাবল টাকাটা ওকে ফিরে পেতেই হবে।

“আর কিছুটা এগোতে রাস্তাটা আরও ডানদিক নিল। তার সঙ্গে সঙ্গে সাঁই করে নদীটা যেন ওর থেকে অনেক দূরে চলে গেল। এই নদীটাই ওর বাড়ির সামনে দিয়ে গেছে। তাই এতক্ষণ ওর মনে হচ্ছিল ওর বাবা-মা যেন ওর সঙ্গে-সঙ্গেই রয়েছে। কিন্তু এখন কেমন যেন অন্যরকম লাগতে শুরু করল। মনে হচ্ছিল মা-বাবার থেকে ও যেন দূরে সরে যাচ্ছে। এদিকে জঙ্গলের ঘনত্বও বাড়ছে। তবুও মনে জোর রেখে এগিয়ে চলল মিমো। রাস্তায় একটা লোকও নেই। চারদিকে একটা নিঝুম গা ছমছমে পরিবেশ। ভয় ভয় করছিল মিমোর। যদি ও হারিয়ে যায়! যদি ও আর কোনোদিন বাড়ি না ফিরতে পারে!

“ঠিক এমন সময় রাস্তার ধারে দেখতে পেল একটা লোককে। সারা শরীরে সাদা চাদর জড়ানো। হাতের লাঠিটা পাশে রেখে রাস্তার ধারে মাথা নীচু করে উবু হয়ে বসে রয়েছে লোকটা। মনে হল ঝিমোচ্ছে। এবার মিমো ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ধীরে ধীরে মাথা তুলল। আগে বুঝতে পারেনি। কিন্তু এবার ওর মুখটা দেখে আঁতকে উঠে দু’পা পিছিয়ে এল মিমো। এত কালো মানুষ ও কোনোদিন দেখেনি। কালো মুখের মাথার এক ঝাঁক কোঁকড়া সাদা চুল। চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের লাল। মণিগুলোও ঘোলাটে! নাক বলতে কিছুই নেই। দু’গালের মাঝের জায়গাটা সামান্য একটু উঁচু হয়ে রয়েছে। একটা মানুষের নাক এতটা চ্যাপ্টা হতে পারে! তাতে মেয়েদের মতো নথ পরা। তার ওপর আবার দু’কানে বড়ো বড়ো গোল গোল দুটো দুলের জন্য ওর মুখটা ভারি অদ্ভুত দেখাচ্ছে। এই লোকটা নিশ্চয়ই আদিবাসী। ওদের গ্রামে ও এইরকম দুয়েকজনকে দেখেছে। বাবা বলেছিল এরা আদিবাসী। এমনিতে নাকি এরা খুব ভালো। এদিক থেকেই ওরা ওদের গ্রামে মাঝে মাঝে যায় এটা সেটা বিক্রি করতে।

“‘তুই কে?’ খ্যানখ্যানে গলায় মিমোকে জিজ্ঞাসা করল লোকটা।

“প্রথমদিকে এমন একটা ভয়াল দর্শন মানুষকে দেখে কথা হারিয়ে ফেলেছিল মিমো। এবার দুটো ঢোঁক গিলে বলল, ‘মিমো।’

“লোকটা তখন মিমোকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘তুই ইস্কুলে পড়িস?’

“তাতে মাথাটা বার দুয়েক সামনের দিকে ঝোঁকাল মিমো। আস্তে আস্তে ভয় কাটছিল ওর। কারণ, লোকটা ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছিল।

“‘কী চাস তুই?’

“‘লুম্বার বাড়ি যাব।’ ভয়ে ভয়ে বলল মিমো।

“লোকটা আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই লুম্বার বন্ধু?’

“‘তুমি চেনো লুম্বাকে?’ লোকটার কথা শুনে উৎসাহ পেল মিমো।

“‘তুই চিনিস উকে?’ উলটে প্রশ্ন করল লোকটা।

“মিমো কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ওর দিকে। লোকটা তখন বলল, ‘তুই উহার বাড়ি যাবি?’

“মিমো খুব জোরে মাথাটা ওপর নিচ করল বার দুয়েক।

“লোকটা তখন হেসে ডানদিকে দেখিয়ে বলল, ‘উদিকে চলে যা। হেই রাস্তা দিয়া যাবি। তারপর দেখবি একটা ইয়া বড় একটা কালীমায়ের মন্দির। তার পাশ দিয়া চলে যাবি। ওর বাঁদিক দিয়া গেলেই লুম্বার বাড়িটা। সামনে একটা উঠান পাবি বটে।’

“মিমো হাঁ করে লোকটার কথা শুনছিল। লোকটা এবার জিজ্ঞাসা করল, ‘পারবি যেতে?’

“‘হ্যাঁ।’ বলে মাথা নাড়ল মিমো। তারপর সোজা দৌড় লাগাল লুম্বার বাড়ির দিকে। একছুটে রাস্তাটা পার করল। তারপর যেখানে থামল, সেখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে খোলা উঠোন। তার এককোণে একটা ঘর। লোকটার কথার সঙ্গে চোখের সামনে যা দেখতে পাচ্ছিল সেটা মিলিয়ে নিয়ে বুঝতে পারল যে এটাই লুম্বাদের বাড়ি। উঠোন সমেত পুরো অঞ্চলটা জঙ্গলে ঘেরা। বাড়ির পেছনে দিকের জঙ্গলটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকেই উঠে গিয়ে পাহাড়টা আকাশ ছুঁয়েছে।

“লুম্বা বাড়ির উঠোনে বসে ফ্যান ভাত খাচ্ছিল। মিমোকে দেখে দৌড়ে এল। ‘এই মেয়েটা, তুই কে রে?’

“‘তুমি লুম্বা?’ ওকে জিজ্ঞাসা করল মিমো।

“‘হ্যাঁ রে মেয়ে, আমি লুম্বা বটে। কিন্তু তুই কে?’ অচেনা একটা বাচ্চা মেয়ের মুখে ওর নাম শুনে অবাক হল লুম্বা।

“মিমো যে আদিবাসী নয় তা ওর চেহারাই বলে দিচ্ছিল। তাই জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার নামটা জানলি কেমন করে?’

“ঠিক লোককে খুঁজে পেয়েছে বুঝতে পেরে তখন ভীষণ উৎসাহ নিয়ে মিমো বলল, ‘তুমি ওই একশো টাকাটা এখুনি ফেরত দাও আমাকে।’

“‘টাকা ফিরত দিবো! কোন টাকা রে মেয়ে?’

“আমার টাকা। একশো টাকা। আমার দিদা ওটা আমাকে দিয়েছিল। আমাকে ওটা ফেরত দাও। মা তোমাকে আরেকটা একশো টাকা দিয়ে দেবে।’ বলে ছোট্ট হাতটা পেতে দিল মিমো।

“‘আরে মেয়ে, তুই কি পাগল আছিস নাকি রে?’ বলে খিকখিক করে হেসে উঠল লুম্বা।

“তাতে খুব রেগে গিয়ে মিমো বলল, ‘হাসছ কেন? তুমি হাসছ কেন?’

“‘তোর কথা শুনে হাসি পাচ্ছে রে মেয়ে।’ আবার হেসে বলল লুম্বা। তারপর বলল, ‘তার আগে বল তো, তুই কে?’

“‘আমার নাম মিমো। আমার দিদা যে টাকাটা তোমাকে দিয়েছিল, আমি জানি সেটা এখন তোমার কাছে। আমাকে ওটা দাও।’

“‘আবার বলে টাকা! আরে কোন টাকা রে মেয়ে?’ নাক ফুলিয়ে লুম্বা বলল, ‘তোর দিদার টাকা আমি নেব কেন রে?’

“মিমো তখন প্রায় কেঁদেই ফেলে আর কী। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘আমি কতদূর থেকে এসেছি জানো? আমার টাকাটা দাও। আমি বাড়ি যাব।’

“‘কোথা থেকে এসেছিস রে মেয়ে তুই?’

“‘আমি নদীর ওপারে থাকি।’ বলে মাথা নীচু করল মিমো।

“‘সে কী রে!’ চোখ কপালে তুলে লুম্বা বলল, ‘তুই উখান থেইকে এসেছিস আমার থিকে টাকা নিতে? আমার ঘরটা যে এখানে, সেটা তোকে বলল কে? আর আমিই যে তোর টাকা নিয়েছি সেইটাই বা জানলি কী কইরে?’

“মিমো তখন সবকথা খুলে বলল লুম্বাকে। ওর দিদার ওকে টাকা দেওয়া, ওর মায়ের ভুল করে আব্দুলচাচাকে টাকা দিয়ে দেওয়া, তারপর সেই টাকা জুরানের হাত ঘুরে অর্জুনের কাছ থেকে লুম্বার কাছে আসা।

“সব শুনে লুম্বার তো চোখ তখন কপালে। বলল, ‘বলিস কী রে মেয়ে? তুই ওই একশো টাকার জন্য ওই গেরাম থেইকে নৌকা করে নদী ডিঙ্গিয়ে এখানে এসে পড়লি! তুই তো সাংঘাতিক মেয়ে বটে! কিন্তু তোর বাবা-মা তো চিন্তা করবে রে।’

“মায়ের কথা শুনেই এবার ভ্যা করে কেঁদে ফেলল মিমো। তাতে ঘাবড়ে গিয়ে লুম্বা বলল, ‘আরে আরে, হল কী? কান্দিস কেন রে?’

“তাতে ‘মা!’ বলে আরও জোরে কেঁদে উঠল মিমো।

“‘আরে আরে দেখো দেখো, দেখো তো মেয়েটার কাণ্ড!’ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে লুম্বা বলল, ‘তোর বাবাটা, মাটা চিন্তা তো করবেই। কিন্তু তুই এত্ত সাহসি মেয়ে, এত্ত দূরে এক্কা এক্কা চলে এসেছিস, তুই কান্দছিস কেন রে?’

“‘আমি বাড়ি যাব!’ বলে আবার কেঁদে উঠল মিমো।

“‘হ্যাঁ, যাবি তো বটে। তুই চিন্তা করিস না রে মেয়ে। আমি তোকে দিয়া আসব। তোর কোনও ভয় নাই।’

“এতে মিমোর কান্না কিছুটা কমল। তারপর ডান হাতের পিঠ দিয়ে চোখ নাক মুছতে মুছতে আবার টাকাটা চাইল লুম্বার কাছে। তাতে লুম্বা বার দুয়েক খকখক করে কেশে বলল, ‘দেখ মেয়ে, আমি আজ অর্জুনের থেকে টাকা নিয়েছিলাম বটে, কিন্তু উ টাকা তো আর আমার কাছে নাই রে।’

“কথাটা শুনে আচমকা কান্না থেমে গেল মিমোর। হাঁ করে লুম্বার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখের পাতা পড়ছিল না বেচারার। লুম্বা তখন ওর দিকে এগিয়ে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গলা নরম করে বলল, ‘তুই খুব ভালো আছিস রে মেয়ে। কিন্তু কী করবি বল। আমি তো জেনে বুঝে দিই নাই টাকাটা। আসলে অর্জুনকে মাটির হাঁড়ি বিক্রি করে ফেরার সময় রাস্তায় একটা লোকের সঙ্গে দেখা হল। আমার ঘরের জন্য জিনিস কেনার ছিল। তাই আমি ওর থেকে জিনিস কিনে নিলাম। আর ওই টাকাটা আমি ওকেই দিয়ে দিলাম বটে।’

“লুম্বার কথা শেষ হতে না হতেই কড়াৎ করে দূরে পাহাড়ের গায়ে একটা বাজ আছড়ে পড়ল আকাশ থেকে। সঙ্গে সঙ্গে লুম্বা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই রে, মা কালী! এইবার তো জল নামবে রে মেয়ে। তোকে তো যেতে হবে অনেকটা রাস্তা বটে। তোর বাড়ির লোক তো চিন্তা করবে। চল চল এই বেলা। দেরি হলে নৌকাও পাবি না। তখন হবেক আরেক কাণ্ড!’

“মিমো পাথর হয়ে মাটির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। লুম্বা ওকে নিয়ে এবার চলল নদীর দিকে। মনে মনে মা কালীকে ডাকতে লাগল নৌকোটা যাতে পেয়ে যায়।

“নদীর কাছে আসতে আসতে ততক্ষণে বৃষ্টি নেমে গেছে। একটা বিশাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কোনোরকমে নিজেদের বাঁচাচ্ছিল ওরা। বৃষ্টিতে সামনেটা দেখতে অসুবিধে হচ্ছিল বটে, তবে আবছা হলেও দূরে দেখা যাচ্ছিল ঘাটটা। লুম্বা নৌকোর আশায় সজাগ চোখে চেয়ে রয়েছে ঘাটের দিকে। প্রতিটা সময় গুনছে কখন নৌকো আসে। থেকে-থেকেই বৃষ্টির জোর বেড়ে যাচ্ছিল। আর সঙ্গে সঙ্গে লুম্বার হাতটা খামচে ধরছিল মিমো। ছোট্ট মেয়েটাকে দেখে লুম্বার কেন জানি না নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেই কবে ওর মা ওকে ছেড়ে আকাশে চলে গেছে। ও এবার মুচকি হেসে মিমোর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘আমি তো আছি রে মা। তোকে ঠিক বাড়ি পৌঁছে দেব দেখিস!’

“লুম্বার কথা শুনে আবার কেঁদে ফেলল মিমো। ঠিক এই সময় একটা আশার আলো দেখা গেল। বৃষ্টির মধ্যে নদীতে আবছা আবছা কিছু একটা দেখা যাচ্ছিল। এবার সেটা ঘাটের কাছে এগিয়ে আসতে বোঝা গেল সেটা একটা নৌকো। জল কেটে ছলাত ছলাত করে এপারে আসছিল ওটা। লুম্বা যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল এবার। যাক, মেয়েটা আজকে অন্তত বাড়ি ফিরতে পারবে।

“মিমোকে দেখে চিনতে পারল মাঝি। পাশে লুম্বাকে দেখে বলল, ‘আরে লুম্বা, তোর বন্ধু তোরে খুঁজতে খুঁজতে তোর বাড়ি চলে গেছিল।’ তারপর আর কথা না বাড়িয়ে মিমোকে নিয়ে ওপারে রওনা দিল মাঝি। লুম্বাকে আর যেতে দিল না। বলল, ‘তোরে আর যেতে হবে না রে লুম্বা। এই পাগলিটারে আমিই পৌঁছে দেব।’

“মেয়ে এতক্ষণেও বাড়ি না আসাতে মিমোদের বাড়িতে তখন হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড! মিমোর মা তো মেয়ে হারানোর শোকে অজ্ঞানই হয়ে পড়েছিল। শেষে গ্রামের হাকিম এসে তাকে ওষুধ দিয়ে ঠিক করে। সারা গ্রামে তখন খোঁজ পড়ে গেছে। এবার মাঝি যখন মিমোকে নিয়ে ওর বাড়িতে এল, তখন মিমোর বাবা-মায়ের যে কী অবস্থা হল, তা নিশ্চয়ই আন্দাজ করা যায়! আলুথালু বেশে ওই প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে মিমোকে বুকে জাপটে ধরে প্রায় পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে রইল মিমোর মা। ডাল, আলু ভাজা, হাঁসের ডিমের তরকারি, শহর থেকে আনা মিষ্টি, সব পেট পুরে খেতে হল মাঝিকে। মাঝি তখন বুঝিয়ে পারে না যে আসল কাজটা করেছে লুম্বা। ও না থাকলে মিমোকে আজ রাতে বাইরেই কাটাতে হত। ফেরার সময় মিমোর বাবা মাঝির হাত ধরে কেঁদে ফেলল।

“আজ একটা ঝড় গেল মিমোদের পরিবারে। মেয়েকে পেয়ে বাবা-মা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। এদিকে দিদার দেওয়া টাকাটা না পেয়ে মিমো একেবারে কথা হারিয়েছে। ফিরে অবধি একটাও কথা বলেনি বাবা-মায়ের সঙ্গে। বাবা কত চেষ্টা করল মেয়ে সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু মেয়ের মুখ দিয়ে একটাও কথা বেরোল না। মা ভাবল কেউ কি তবে মেয়ের ওপর জাদু-টোনা করেছে? মিমোর বাবা সেকথা শুনে হেসেই উড়িয়ে দিল। বলল, আসলে পথ হারিয়েছিল তো। তাই ভয়ে গুম মেরে গেছে। মিমো বাবার কথাগুলো শুনল। কিন্তু কিছু বলল না।

“মাঝে কতক্ষণ কেটে গেছে মিমো জানে না। ক্লান্ত শরীরে ওর চোখ বুজে এসেছিল। এবার ঘুম ভাঙল অনেক রাতে। কানে এল বাবার গলা। মাকে কিছু বলছে বাবা। এবার কানটাকে আরও খাড়া করতে যে কথাগুলো ওর কানে এল, তাতে ওর সব ক্লান্তি মুহূর্তের মধ্যে ফুড়ুৎ করে উধাও হয়ে গেল।

“‘আজ জানো, সকালে বেলা বেশ ভালো ব্যাবসা হয়েছে। অবশ্য প্রথমদিকে তেমন মাল বিক্রি হচ্ছিল না। কেউ দশ টাকা তো কেউ বিশ টাকা। এর বেশি কেউ মাল কেনে না। কিন্তু শেষে একটা ছেলে এসে আমার অনেক সবজি কিনে নিল। ছেলেটার কাণ্ড দেখে তো আমি অবাক! বললাম, তুমি এত মাল নিয়ে কী করবে? ও বলল, একসঙ্গে সাতদিনের জিনিস কিনে নিলে আগামী এক সপ্তাহ আর ওকে বাজার করতে হবে না। ভারি মজার ছেলে।’

“‘তুমি চেন ওকে?’ জিজ্ঞাসা করল মিমোর মা।

“‘নাম জানি না। মুখ চিনি। বলল নদীর ওপারে থাকে। ছেলেটাকে আগে আমাদের গ্রামে দেখেছি। মাটির হাঁড়ি বিক্রি করে।”

“মাটির হাঁড়ি! কথাটা শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল মিমো। নদীর ওপারে থাকে, মাটির হাঁড়ি বিক্রি করে… কানে বাজতে লাগল কথাগুলো। এবার দুড়দাড় করে বিছানা থেকে নামল। বাবা কোথায় কী রাখে ও জানে। তাই বিছানা থেকে নেমেই ও দরজার কোণটার দিকে তাকাল। দেখতে পেল বাবার জামাটা ওখানে পেরেকের ওপর ঝুলছে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেল সেদিকে। মেয়ের কাণ্ড দেখে বাবা-মা তখন অবাক।

“‘কী হল মিমো-মা?” জিজ্ঞাসা করল বাবা।

“মিমোর কানে তখন কিছুই ঢুকছে না। ও ছুটে গিয়ে পেরেক থেকে বাবার জামাটা নামাল। তারপর সেটার পকেট থেকে যে একশো টাকাটা বের করে আনল, সেটা ঘরের লন্ঠনের আলোর সামনে তুলে ধরে পরিষ্কার দেখতে পেল তাতে লেখা রয়েছে “দিদা”! সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠল মিমো। তারপর ‘বাবা!’ বলে চেঁচিয়ে উঠে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাবার কোলে আর ডান হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল মায়ের গলাটা।”

এতটা বলে থামলেন লোকনাথদাদু। কিডোরা এমন গল্প শুনে কথা হারিয়েছিল। কিডো, দ্যুতি, রিবাই আর রায়ান যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল মিমোর এই অভিযান। মনে হচ্ছিল যেন রূপকথার একটা চরিত্র এতক্ষণ ঘোরাঘুরি করছিল ওদের সামনে।

গল্পটা শেষ করে চুপ করে বসে ছিলেন লোকনাথদাদুও। ঘরে তখন পিন পড়ার নিস্তব্ধতা। বাইরে এর মধ্যে বৃষ্টি থেমে গেছে। কেউ জানে না আবার নামবে কি না। কিডোদের মনে তখন কিছু প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে—মিমো এখন কোথায়, কী করছে ও, আজও কি ও এইভাবে গ্রামের পথ ধরে হারিয়ে যায়, সেই একশো টাকাটা নিয়ে ও শেষ পর্যন্ত কী করেছিল, এখনও কি ওটা ওর কাছে রয়েছে?লোকনাথদাদুকে প্রশ্নগুলো করেছিল ওরা। উত্তর দিতে পারেননি উনি। হয়তো কিডোদের মতো উনিও তখন হারিয়ে গেছেন ওই গ্রামের রাস্তায়।

ছবি:অংশুমান

জয়ঢাকের গল্পঘর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s