ঋতা বসুর আরো গল্পঃ শিকার ও শিকারী, মিষ্টিবুড়ির কাণ্ড, ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি, মৌটুসীর বাসা
বিজু যা দেখে
ঋতা বসু
এটা কবে থেকে শুরু হল বিজুর স্পষ্ট মনে আছে। বিজুর হাফ-ইয়ার্লির রেজাল্টে তিনটে সাবজেক্টে ফেল দেখে মার মাথা গরম হয়ে গেল। দোষটা কিন্তু বিজুর নয়। ইতিহাস আর বাংলা ব্যাকরণের বই নতুন ক্লাস শুরু হতে না হতেই হারিয়ে গেছিল। আর ড্রইং সে কোনওদিনই পারে না। বাবা রেজাল্ট দেখে মাকে বলেছিল, “আহ্লাদ হবার মতো নয় ঠিকই, তবে জ্যোতিষী-টোতিষী ধরে হাতে সুতো বাঁধা, পাথর পরানোর মতো পাগলামি না করলেও চলবে। মাত্র ক্লাস ফোর। আর একটু বড়ো হোক, নিজে থেকেই পড়বে। তোমাকে বলতেও হবে না।”
মা সেসব না শুনে রেণুমাসির সঙ্গে ফোনে ফিসফিস করে কীসব কথা বলল। কথাগুলো যে বিজুর রেজাল্ট নিয়ে এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তারপর একদিন স্কুলের পর তাকে নিয়ে একটা ট্যাক্সি করে ঘিঞ্জি এক রাস্তায় এসে থামল, কারণ ট্যাক্সিওলা বলল, সামনের সরু গলিতে গাড়ি যাবে না। মা তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে ওই সরু গলিটা যেখানে আরও সরু হয়ে গেছে সেইখানে একটা পুরনো বাড়ির সামনে এসে থামল। দরজাটা খোলাই ছিল। বাড়িটার মধ্যে সূর্যের আলো ঢোকে না বলে উঠোনে, সিঁড়িতে হালকা সবুজ শ্যাওলা। কেমন সোঁদা গন্ধ। বিজুর একটুও ভালো লাগছিল না, কিন্তু মা হাতটা শক্ত করে ধরে ছিল বলে সে বাধ্য হয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিল। এত বড়ো বাড়িটায় কেউ কোথাও নেই। সার সার বন্ধ ঘর পেরিয়ে মা প্লাস্টিকের পর্দা ঝোলানো একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরের মাথায় কালো পাতের ওপর রক্তের মতো লাল রঙে লেখা, ‘তন্ত্রসিদ্ধ অবধূত শ্রী হরনাথ। যেকোনও সমস্যার সমাধানে আসুন। বিফলে মূল্য ফেরত।’
ঘরের ঠিক মাঝখানে বসে আছে শ্রী হরনাথ। মাথায় পাগড়ির মতো লাল রঙের কাপড় জড়ানো, কালো আলখাল্লা পরা, চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। তাদের দেখে এক হাত সামনে বাড়িয়ে মুঠো করে শূন্য থেকে কী যেন ধরল। বিজুর মনে হল তার প্রাণটাই বুঝি। হরনাথ মাকে ইশারায় বসতে বলে বিজুর চোখের দিকে তাকিয়ে গড়গড় করে বলে গেল ছোটোবেলায় বেশ কয়েকবার মস্তিষ্কে আঘাত পেয়েছিল। চঞ্চল স্বভাব। নিদ্রাপ্রিয়। পড়াশোনায় মন নেই। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যে রুচি।
বিজু দেখল, মার মুখটা আস্তে আস্তে কেমন যেন কাঁদো কাঁদো হয়ে যাচ্ছে। তারপর হরনাথ যখন বলল ইদানীং পড়াশোনায় অবনতির মাত্রা অত্যধিক, তখন মা একেবারে হরনাথের পায়ের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে বলল, “বাবা, আপনি তো সব জানেন। কী করলে ওর সুমতি আসবে যদি বলে দেন।”
বাবা এক চিমটে গুঁড়ো ধুনুচিতে ছড়িয়ে বলল, “ছেলের ওপর অশুভ শক্তি ভর করেছে।”
ধুনুচির ধুয়োর জন্য, নাকি ভয়ে বিজুর চোখে জল এসে সামনের সব দৃশ্য আবছা হয়ে গেল। হরনাথ গম গম স্বরে তাকে কী যেন বলছে। বিজুর চোখ ঝাপসা হয়ে এল। মনে হল, তাকে যেন সত্যি সত্যি অশুভ শক্তি ঘিরে ফেলেছে।
চোখের সামনেটা পরিষ্কার হতে দেখল, ঘরে মা নেই। শুধু সে আর তন্ত্রসিদ্ধ অবধূত। বিজুর বুকটা এত জোরে ধকধক করে উঠল যে সে এক হাতে বুকটা চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল, “মা কোথায়?”
হরনাথ সে কথার উত্তর না দিয়ে বিজুর কপালে টিপ পরার জায়গায় হাত রেখে বলল, “অশুভ শক্তির চোখ তোর ওপর। যেখানে যাবি তোর পিছু পিছু সে যাবে।”
এটুকু শুনেই বিজু দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড় লাগাল বাইরের দরজার দিকে আর ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাবার আগে যে হাতটা তাকে ধরে তুলল বিজু তার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, “মা, কোথায় গেছিলে আমাকে ফেলে?”
মা অবাক হয়ে বলল, “কাঁদছিস কেন? রেনুমাসির আসার কথা, ঘরটা যদি চিনতে না পারে তাই বারান্দায় দেখতে গেছিলাম। তুই কি ভাবলি আমি তোকে ফেলে চলে গেছি? কী বোকা রে তুই!”
মাকে দেখে দু’হাতে ধরে বিজুর নিঃশ্বাস একটু স্বাভাবিক হল, কিন্তু সে আর এক মিনিটও ওই ঘরে থাকতে রাজি নয়। মা বাধ্য হয়ে হরনাথকে বলল, “দেখছেন তো কীরকম বিরক্ত করছে? আমি আরেকদিন আসব।”
বিজু দেখল, তন্ত্রসিদ্ধ হরনাথের মুখে কীরকম রহস্যময় হাসি। তিনি হাত নেড়ে ওদের চলে যেতে বললেন।
ঠিক তারপর থেকেই শুরু হল। প্রথমে খেলতে গিয়ে বিজু দেখেছিল তাকে। সেইজন্য খেলার নামে ওর আতঙ্ক। অথচ বিজুদের বাগানে গিরি, পান্না, মিন্টি, সাজি প্রতিদিন বিকেলে খেলার টানেই ছুটে আসে। কুমির কুমির, এল-ও-এন-ডি-ও-এন লন্ডন, রাজামশাই—আরও অনেকরকম খেলা আছে তাদের ঝুলিতে। শীত আর গরমকালের খেলা একইরকম। কিন্তু বর্ষাকালে সবসময় বাগানে খেলা যায় না বলে বিজুদের মস্ত ঢাকা বারান্দায় বসে তারা ইনডোর গেমস খেলে। লুডো, ক্যারাম—এসব ছাড়াও তাদের নিজস্ব আরও অনেকরকম খেলা আছে। তারা সবাই ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকে। ছোটো ফ্ল্যাটে দু’জন বন্ধু একসঙ্গে হলেই মায়েদের মাথা গরম। তাই বিজুদের বাড়িতেই তাদের যতরকম কাণ্ডকারখানা। এর মধ্যে বিজু যদি খেলব না বলে বসে থাকে তাহলে তারাই বা কী করে! সারা বিকেল, ছুটির দিনের সকালটা তারা বরাবর এখানেই কাটায়। এখন জায়গার অভাবে খেলা বন্ধ। দলটা তাই খুব মনমরা। কিন্তু তারা বিজুর ওপর রাগও করতে পারছে না। খেলতে শুরু করেই কীরকম ভয় পেয়ে যায়। তাদেরও খেলতে দেয় না। কী রোগা আর শুকনো হয়ে গেছে।
বিজুকে এই কয়দিনে কত যে ডাক্তার দেখানো হল! কোনও উপকার হচ্ছে না। তারাও অনেকরকম চেষ্টা করছে, কিন্তু বিজু যে কে সেই।
পান্নার মামা মস্ত ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন। সে বলল, “ওই সব বাচ্চা বাচ্চা খেলা ছেড়ে ওকে ফুটবল, ক্রিকেট খেলতে বল। ঘরের কোণে বসে পুতুল খেলে একেবারে ন্যাতপ্যাতে হয়ে গেছে।”
বিজুর বাবা মস্ত এক ফুটবল নিয়ে এলেন। বন্ধুরাও খুব উত্তেজিত। বিজু বেশি ছোটাছুটি করতে পারবে না বলে ওকে গোলপোস্টে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। যতক্ষণ উলটোদিকের গোলে বল ছিল ততক্ষণ বেশ খেলা হচ্ছিল। বিজুর কাছা্কাছি বল আসতেই বিজু খেলব না বলে দৌড়ে পালিয়ে গেল। মামার দাওয়াই কাজে লাগল না বলে বন্ধুরা খুবই হতাশ হলেও হাল ছাড়ল না। বিজুকে তারা বলল, “তুই যদি বাড়ির বাগানে খেলতে না চাস তো চল স্কুলের মাঠে যাই।”
বিজু বলল, “কোনও লাভ নেই। ওখানেও আসবে।”
এই বলে সে দৌড়ে গিয়ে বিছানায় মুখ ঢেকে শুয়ে পড়ল।
কে আসবে?
এটা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না বলেই বিজু বলে না। বিজুর সঙ্গে সঙ্গে বিজুর বাবারও খুব মন খারাপ। বিজুকে বলেন, “আমার মনে হয় ছোটো ছেলেরা দু’দিন না খেয়েও দিব্য থাকতে পারে, কিন্তু খেলাধুলো না করে একদিনও থাকা উচিত নয়।”
বিজুর মা রেগে গিয়ে বললেন, “তুমি শুধু খেলাধুলোটাই দেখছ। এদিকে পড়াশোনার পাট ঘুচে যাচ্ছে! এভাবে চললে ওকে ক্লাস ফোর জুতো চোর হয়েই থাকতে হবে।”
এটা শুনলেই বিজুর কান্না পায়। ফাইভ-সিক্সের ছেলেরা সারাক্ষণ এটা বলে বিজুদের রাগায়। পান্না ঠোঁট উলটে বলে, “বলুক না, আর মাত্র ক’টা মাস।”
এখন ওরা সব ক্লাস ফাইভে চলে যাবে। বিজু একলা পড়ে থাকবে সেটা ভেবে বিজুর আবার কান্না পেতে থাকে। খালি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে আর মনে হয় এই জায়গাটাই সবথেকে ভালো। তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। খুব নিশ্চিন্ত লাগে।
মা আর রেণুমাসি মিলে গেছিল হরনাথের কাছে। তিনি বলেছেন, “ছেলেকে নিয়ে এসো। রোগ সারিয়ে দেব।”
বিজু কিছুতেই যেতে রাজি হয়নি। বমি-টমি করে একশা। বিজুর জেদ দেখে বাবাও বলেছে, “থাক না, ও যখন যেতে চাইছে না তখন জোর কোরো না।”
বিজুর মা একলাই গিয়েছিল। তান্ত্রিক হরনাথ একটা সোনালি রঙের সুদর্শন চক্রের গায়ে নানা রঙের সুতোর ঝালর লাগানো জিনিস দিয়েছে। বিজুর ঘরে রাখলেই নাকি ফল হবে। বিজু শুনেছে, বাবা মাকে চাপা গলায় এত দাম দিয়ে এই জিনিসটা কিনবার জন্য ধমক দিচ্ছে। মা বলছে, এটা খুব পাওয়ারফুল। কার কার নাকি ভীষণ উপকার হয়েছে।
আর যারই হোক, বিজুর কোনও লাভ হল না। খবর পেয়ে বিজুর দাদু এলেন। তিনি মিলিটারিতে ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। অনেক দেশ ঘুরেছেন। খুব সাহস। তিনি এসে বিজুর অবস্থা দেখে অবাক। বললেন, “খেলতে না চাও, খেলবে না। পড়তে না চাও, পড়বে না। কিন্তু কাল থেকে আমার সঙ্গে মর্নিং ওয়াকে বেরোতে হবে। আমার সঙ্গে অস্ত্র থাকবে, তোমার কোনও ভয় নেই।”
দু-চারদিন দাদুর হাতের শক্ত পাঞ্জার সঙ্গে পাঞ্জা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিজুর মনের ভয়টা একটু যেন হালকা হল। দাদু নানা কথার মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে জেনে নিলেন, ‘রাজা একটা বালিকা চাইল’ খেলতে গিয়ে একজন করে খেলুড়ে আউট হচ্ছিল। বিজুর পালা যখন এল তখন সত্যি সত্যি একজন এগিয়ে এসেছিল বিজুকে নিয়ে যাবে বলে। অন্যরা কেউ তাকে দেখতেও পায়নি। বুঝতেও পারেনি। বিজু ঠিক সময়ে পালিয়ে এসেছিল, নয়তো লোকটা ওকে ঠিক ধরে নিয়ে যেত। স্কুলে ফুটবল খেলতে গিয়ে বল নিয়ে গোলের কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখে গোলকিপার পরাগের পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে সেই লোকটা। বিজু লাইনের বাইরে গেলেই খপ করে ধরবে তাকে।
দাদু বলল, “ভারি পাজি তো লোকটা। তবে আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। এবার এলে আমাকে দেখিয়ে দিও। এমন অস্ত্র আছে আমার কাছে যে বাছাধনকে কাবু করতে এক মিনিটও লাগবে না।”
তারপর দাদু একদিন বিজুর ঘরের সোনালি সুদর্শন চক্রটা বনবন করে লাট্টুর মতো ঘোরাচ্ছিলেন। বিজুর মা দেখতে পেয়ে হাউমাউ করে ছুটে এল। “এটা ঈশান কোণ থেকে নাড়ানো একদম বারণ!”
“কেন?”
“একজন দিয়েছেন বিজুর মঙ্গলের জন্য।”
“এই সস্তা রং করা টিনের খেলনাটা লাট্টুর মতো ঘোরা ছাড়া আর অন্য কিছু করতে পারবে কি?”
তারপর দাদু কথায় কথায় ক্রমশ জানতে পারলেন বিজুর হাফ-ইয়ার্লি রেজাল্ট আর তার প্রতিকারের জন্য তান্ত্রিকের কাছে যাওয়ার কথা। বিজুর ওপর অশুভ শক্তির চড়াও হবার ব্যাপারটাও তার মাথা থেকে বেরিয়েছে এটাও জানতে পারলেন।
গিরি-সাজি-পান্নাদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “একদম প্রথমে ঠিক কোন সময়ে তোমরা বুঝলে যে বিজু খেলতে গিয়ে ভয় পাচ্ছে?”
বন্ধুরা সবাই নখ কামড়ে ভুরু কুঁচকে প্রাণপণে একদম প্রথম ঘটনাটার কথা মনে করার চেষ্টা করতে লাগল। শেষে দলের মধ্যে সবথেকে শান্ত সদস্য পান্না বলল, “আমার মনে আছে। রেজাল্ট বেরোনোর তিনদিন পর আমরা বারান্দায় বসে ‘আমি যা দেখি তুমি তা দেখো’ খেলছিলাম। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। আমি একটা বাগানো কান, বড়ো বড়ো চোখের লোককে দেখছিলাম। বিজু আমার চোখ ফলো করে বার করার চেষ্টা করছিল আমি কী দেখছি। হঠাৎ ওর মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। ‘আসছে আসছে’ বলে লাফ দিয়ে উঠে ঘরে গিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল।”
“ও কী দেখল? কেউ কি সত্যিই আসছিল?”
সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, “অন্য কেউ আসেনি। এটা সত্যি, বাগানো কান লোকটা এই বাড়ির দিকেই আসছিল। তা সে তো কুরিয়ার কোম্পানির লোক। চিঠি দিয়ে চলে গেল। তাতে এত ভয় পাবার কী আছে?”
“হুম।”
দাদু গম্ভীর হয়ে সব শুনলেন। কী বুঝলেন কে জানে। তান্ত্রিকের চেম্বার কোথায় জেনে নিলেন। এরপরের তিন-চারদিন দাদু খুব ব্যস্ত হয়ে রইলেন। কোথায় কোথায় ঘোরাঘুরি করলেন কেউ জানতে পারল না। তারপর দাদু একদিন সকালে মাকে ডেকে চুপি চুপি বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ। আমি চারদিকে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, ওই তন্ত্রাচার্যর অনেক ক্ষমতা। বিজুর সমস্যাটা ওই মনে হয় দূর করতে পারবে।”
মা উৎসাহ পেয়ে বলল, “আমি তো কবে থেকে বলছি। বিজু যেতে চায় না বলে ওর বাবাও বারণ করছে। আমি নয়তো অনেকদিন আগেই চলে যেতাম।”
দাদু বললেন, “আমি সঙ্গে থাকলে বিজু আপত্তি করবে না।”
ঠিক তাই। বিজু একটু গাঁইগুঁই করে রাজি হল, কিন্তু দাদুকে বলে রাখল, “তাহলে তুমি কিন্তু শক্ত করে আমার হাত ধরে থাকবে।”
দাদু বলল, “তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। আমি থাকতে কেউ তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।”
আজও লাল পাগড়ি কালো আলখাল্লা পরে তন্ত্রাচার্য বসে আছে। সামনের ধুনুচি থেকে ধোঁয়া উঠছে। দাদুকে দেখে গম্ভীরভাবে মাকে জিজ্ঞেস করল, “ইনি কে?”
“আমার বাবা।”
হরনাথ আর কোনও কথা না বলে ধুনুচিতে কীসের একটা গুঁড়ো ছড়িয়ে দিতেই ঘরটা নীল রঙের ধোঁয়ায় ভরে গেল। সেই ধোঁয়ার আড়াল থেকে হরনাথ হাতছানি দিয়ে বিজুকে ডাকামাত্র বিজু শক্ত করে দাদুর হাত চেপে ধরল। দাদু ফিসফিস করে বললেন, “এগিয়ে যাও। আমি আছি তোমার পেছনে।”
বিজু গিয়ে হরনাথের ঠিক সামনে আসনপিঁড়ি হয়ে বসামাত্র একটা ষণ্ডা পালোয়ান মতো লোক হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে একেবারে হরনাথের ওপর চড়াও হল। এক ধাক্কায় মাথার পাগড়ি ফেলে দিতেই টাক মাথা বেরিয়ে গেল। হরনাথ কেমন হতভম্ব হয়ে গেছে। লোকটা বলল, “ঠগবাজ, চোর, জোচ্চোর! কাল সর্পযোগ বলে আমার ভাইয়ের থেকে কত টাকা হাতিয়েছ?”
লোকটার গায়ে বেশ জোর। হরনাথকে হাত ধরে দাঁড় করিয়ে গা থেকে আলখাল্লাটা টেনে খুলে দিয়ে বলল, “তোমার মুখোশ আমি খুলে দেব। কত লোককে ঠকিয়েছ আজ পর্যন্ত গুনে দেখেছ?”
পাগড়ি আর আলখাল্লা ছাড়া রোগা বুড়ো হরনাথকে একদম অন্য মানুষ মনে হচ্ছে। কোথায় গেল সেই দাপট। চিঁ চিঁ করে লোকটাকে বলল, “আমাকে ছেড়ে দাও। আমি টাকা ফেরত দিয়ে দেব।”
এবার দাদু এগিয়ে এলেন। “একে তো টাকা ফেরত দেবে। আর এই বাচ্চা ছেলেটার কী হবে?”
হরনাথের মুখ দেখে মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলবে। কোনওরকমে বলল, “আমায় ক্ষমা করে দিন। কথা দিচ্ছি, এই তল্লাট ছেড়ে চলে যাব।”
“আর অন্য জায়গায় গিয়ে আবার লোক ঠকানোর ব্যাবসা ফাঁদবে, তাই না?”
রকমসকম দেখে বিজুর মার মুখ শুকিয়ে গেছে। বিজুকে কোলের কাছে টেনে বলল, “শুনেছিলাম ইনি একজন বাকসিদ্ধ মহাপুরুষ। আমি কী বোকা! ভালো করতে গিয়ে ছেলেটাকে প্রায় মেরে ফেলছিলাম!”
দাদু কঠিন গলায় বললেন, “তোমারও শাস্তি হওয়া উচিত। শিক্ষিত মানুষ হয়ে কী করে এই ভুল করলে? পাশ-ফেলই কি জীবনের সব? পড়া পড়া করে নিজেরা পাগল হও, ছেলেগুলোকেও পাগল করো। সেইজন্য এই লোকগুলো জো পেয়ে যায়। সময়মতো বিজু ঠিকই পড়াশোনা করত। শিক্ষিত ঘরের ছেলে কী করবে তাছাড়া?”
মারকুটে লোকটা বলল, “ঠিক বলেছেন। ক’দিন ধরেই ভাবছি আসব, কিন্তু সঙ্গী না থাকাতে এখানে আসার জোর পাচ্ছিলাম না। আপনি বলাতে আমিও একটু জোর পেলাম। বোকা আর ভিতু লোকেদের জন্যই এদের এত বাড় বেড়েছে। আমি পুলিশে খবর দিচ্ছি।”
দাদু বললেন, “পুলিশে আমিও খবর দিতে পারতাম। তাতে আমার কিছু সুবিধে হত না। ঠিক এখান থেকেই আমার নাতির ভয় শুরু, এখানেই সেটা ভাঙতে হবে। ও যদি নিজের চোখে দেখে বুঝতে পারে এই ভণ্ড তান্ত্রিক একটা সাধারণ চোর, যার কাজই হচ্ছে ভয় দেখিয়ে লোক ঠকানো তাহলে ওর মনের মধ্যে যে আতঙ্ক গেঁথে গেছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।”
সবাইকে চমকে দিয়ে বিজু মার হাত ছাড়িয়ে হরনাথের একদম সামনে গিয়ে বলল, “তুমি যা দেখো আমি তাই দেখি। অন্য আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না।”
অলঙ্করণ রাহুল মজুমদার