গল্প মৌটুসীর বাসা ঋতা বসু শরৎ ২০১৯

ঋতা বসুর আগের গল্পঃ শিকার ও শিকারীমিষ্টিবুড়ির কাণ্ড, ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি

মৌটুসি উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায়। বৌয়ের ডিম পাড়ার সময় হয়ে গেল, এদিকে তার কোনও জায়গাই  পছন্দ হয় না। নিরিবিলি, পরিষ্কার আর কুড়ি-বাইশ দিন বিপদ-আপদ ছাড়া জায়গা পাওয়াই তো মুশকিল। মৌটুসির কি কম বিপদ? নামের মতোই মিষ্টি সে। তার শত্রুও কম নয়। কাক-চিল সবাই মুখিয়ে আছে তার ছানাদের ছিঁড়ে খাবার জন্য। সেইজন্য ওরা যাদের ভয় পায় সেই মানুষদের গা ঘেঁষেই ওদের ডিম পাড়তে হয়। কিন্তু মানুষগুলো তো ক্রমশই ছড়ানো ছেটানো বাড়ি ছেড়ে ছোট্ট দেশলাই বাক্সের মতো বাসা তৈরি করছে। তাদেরও খুব মাপজোক করে বানানো বাসা। নিজেরাই থাকে কোনওরকমে। এর মধ্যে মৌটুসির জায়গা কোথায়?

নানা জায়গা ঘুরে এক বুড়ির বাড়ি পছন্দ হল। বারান্দার বোগেনভিলিয়ার ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে টিভির তার এসে ঢুকেছে বসার ঘরে। বুড়ির চুল সাদা। গায়ের রঙ সাদা। সকালবেলা বারান্দার গাছে জল দিয়ে কাচের দরজা টেনে বারান্দামুখো হয়ে বই হাতে বসে থাকে সারাদিন। তাই কাকপাড়ার সবথেকে দুষ্টু কেলে কাল্টু কুচকুচেরা ভুলেও বারান্দায় বসে না। পাড়ার দুই উৎপাত ঝাঁটা-গোঁপ ম্যাও আর সর্দার হুলোও এদিকে ঘেঁষে না।

ভারি খুশি হয়ে মৌটুসি আর তার গিন্নি সেই জটলা পাকানো টিভির তারের মধ্যে কাঠি, শুকনো পাতা, ছেঁড়া পাতলা কাগজ বুনে একটা ছোট্ট থলের মতো বাসা বানাল। বাসার ভেতরটা অন্ধকার। শত্রুর কাছ থেকে লুকিয়ে থাকবার জন্য জায়গাটা ভারি মনের মতো।

ডিম ফুটে ছানা বেরোল ঠিক যেন দুটো তুলোর দলা। কর্তা-গিন্নি মিলে ওদের নাম দিল লালমৌ আর নীলমৌ। ভাগ্যিস এরা মানুষছানাদের মতো সারাদিন খাই খাই করে না। মৌটুসিগিন্নির তাই ভারি সুবিধে। সকাল-বিকেল ঠোঁটে করে ছানাদের জন্য খাবার নিয়ে আসে। খাওয়ানো হয়ে গেলে বাসায় বসে গর্ত থেকে ঠোঁটটা বার করে পাহারা দেওয়া ছাড়া তার আর কোনও কাজ নেই। লালমৌ আর নীলমৌ তখন আপন মনে খেলা করে। মায়ের কাছে গল্প শোনে। বেশ ছিল তারা।

হঠাৎ একদিন বিপদ দেখা দিল। সাদা বুড়ির প্রাণের বন্ধু ঢ্যাঙা বুড়ি এল, কোলে তার আদরের পুষি। বলল, “এতদিন আসতে পারিনি। একসঙ্গে ছ’টা ছানা হল বলে পুষি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছি। কাল আবার আসব। পুষিমণি এই বারান্দাটায় খেলা করতে খুব ভালোবাসে।”

এই বলে ঢ্যাঙা বুড়ি তো চলে গেল। এদিকে পুষিমণির রকমসকম দেখে মৌটুসির মুখ শুকিয়ে গেল ভয়ে। কোলের মধ্যে বসেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে মৌটুসির বাসার দিকে তাকিয়ে ছিল লোভী চোখে আর মৌটুসির ছানাদের দেখে জিভের জল টানছিল।

মৌকর্তা আসামাত্রই মৌগিন্নি খবর দিল, “কাল ঢ্যাঙা বুড়ির সঙ্গে পুষি আসবে, আর অনেকক্ষণ থাকবে। এবার আর রক্ষা নেই। লালমৌ আর নীলমৌ এখন রেলিং পর্যন্ত উড়তে পারে। কাল ওদের বুড়ো নিমগাছ পর্যন্ত ওড়া শেখার কথা।”

জোরে একটা শ্বাস ফেলে মৌগিন্নি বলল, “আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কাল পুষির ভোজটা কীরকম জমবে।”

মৌকর্তা কোনও কথা না বলে ঠোঁট ওপরে তুলে অনেকক্ষণ ভাবল। তারপর পালক ঝাড়া দিয়ে উড়ে গেল কোথায়। ফিরে এসে বলল, “ঘুমোও। কাল পুষি আসবে না।”

পালকের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে চোখের জল ফেলছিল মৌগিন্নি। এখন কর্তার কথা শুনে ডানা ঝাপটে পালক ফুলিয়ে একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল, “পুষির কী হয়েছে? পা ভেঙেছে, না পেটখারাপ?”

মৌকর্তা বলল, “ওসব কিচ্ছু না। কালোদের পাড়ায় গিয়ে দূর থেকেই কেলে কাল্টু আর কুচকুচেদের শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম, পুষির ছ’টা নাদুসনুদুস বাচ্চা হয়েছে। এদিকে তার এত শরীর খারাপ যে মোটেই দেখাশোনা করতে পারছে না। বেচারা ছানাগুলো খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে। তাই শুনে কালোগুণ্ডারা কা-কা খা-খা করে নাচ জুড়ে দিল। কাল ওদের পাড়া ঝেঁটিয়ে সবাই যাবে ঢ্যাঙা বুড়ির বাড়ি। ওরা যতক্ষণ থাকবে, পুষি নড়বে না বাচ্চা ছেড়ে। তার মধ্যে লালমৌ আর নীলমৌ নিমগাছ ডিঙিয়ে শিমূলগাছ পেরিয়ে পৌঁছে যাবে দূরের ওই উঁচু উঁচু গাছগুলোর মাথায়।”

অলঙ্করণঃ জয়ন্ত বিশ্বাস

জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস

1 thought on “গল্প মৌটুসীর বাসা ঋতা বসু শরৎ ২০১৯

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s