রুমেলা দাসের আগের গল্প/উপন্যাস/অণুগল্পঃ বাদুড় মানুষ, মিত্র ও মিথ, উইশ, পরিচিত
কখনও রুমাল থেকে চার-পাঁচটা চকোলেট। কখনও বেজায় সাদামাটা একটা কিংবা দুটো কাগজ থেকে বেরিয়ে পড়ে লাল-নীল কাচের গুলি। আর সেইদিন? এক্কেবারে অবাক করে যে ইয়াবড়ো কালো ছাতাটা মাথায় দিয়ে রোজ রোজ বাজার যায় জেঠু, তার মধ্যে থেকেই বেরোল কিনা আস্ত চোখ পিটপিট বন্দুক ধরা পুতুল। রেণুর চার বছরের জীবনে এসব অবাক হবার মতোই ঘটনা। এগুলোর নাম ম্যাজিক। হামাগুড়ি ছেড়ে যবে থেকে ধরে ধরে দাঁড়াতে শিখেছে, বুঝতে শিখেছে একটু আধটু। তবে থেকেই এসব ম্যাজিক ও দেখে। আর ভাবে, পৃথিবীর সমস্ত লুকিয়ে রাখা ভালো হয়তো জেঠুর কাছেই আছে। জেঠু জানে না এমন কিছু নেই। রেণু জানে, এই ম্যাজিকের গল্প সবার সামনে বলতে নেই। নাহলে মা-বাবা যদি কখনও বকে! তাই সবসময় জেঠুর পিছন পিছন ঘোরে। সুযোগের অপেক্ষায় থাকে কখন সবাই ব্যস্ত থাকবে, আর জেঠুও নিজের ম্যাজিকের ঝুড়ি নিয়ে বসে একটা একটা করে সারপ্রাইজ দেবে ওকে।
রেণু, ওর বাবা-মা আর জেঠু এই চারজনেই থাকে বাড়িতে। মোট তিনটে ঘর। সামনে লাগোয়া একটুকরো বাগান আর ছাদ। এটাই ওর রাজত্ব। দাদু-ঠাকুমাও আছে। কিন্তু ওরা আকাশের তারা হয়ে গেছে। রেণু প্রতিদিন স্নান করে ওঁদের প্রণাম করে। প্রথমদিকে ওর একটু তালগোল পাকিয়ে যেত। সারা বাড়ি দৌড়তে দৌড়তে ছোট্ট পাদুটোয় ব্যথা করত। লুকোচুরির সময় ওদের শোবার ঘর দিয়ে ঢুকেও হঠাৎ করে কখন যে আচমকা পাশের ঘরে এসে পড়ত বুঝতে পারত না। আবার মা বকাঝকা করে ঠাকুরঘরের দরজা এঁটে দিলেও আরেকভাবে ঠিক পৌঁছে যেত লক্ষ্মীর সিংহাসনের পাশে। সবই যেন জেঠুর ম্যাজিকের মতো।
রেণু বড়ো হচ্ছিল। ওর ঝুড়িতেও একটা দুটো করে এভাবেই ম্যাজিক জমা হচ্ছিল ক্রমশ। আর ছোট্ট ছোট্ট ম্যাজিকগুলো জুড়ে বড়ো বড়ো ম্যাজিক দেখার অপেক্ষা শুরু করছিল ও।
এক… দুই… তিন। ওকে হয়তো আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। জেঠু বলেছে, ‘সময় হলেই দেখতে পাবি। সবুর কর।’ তবে ব্যাপারটা ঠিক কী হবে জানে না। রাগ হয়। কী এমন ম্যাজিক বাপু যে ওকে আগে থেকে বলা যায় না? ও তো কাউকে বলবে না। জেঠুর একটা দোকান আছে। ওখান থেকেই জিনিসগুলো এনে কিছু একটা বানাচ্ছে। চুপিসারে দেখার চেষ্টা যে করেনি তা নয়। কীসব চকচকে গুঁড়ো ছড়ানো ছিল আর দুটো রঙিন কাগজ। দরজা ফাঁক করে দেখছিল আর ভাবছিল। মায়ের ছাদ থেকে নামার পায়ের আওয়াজ শুনে সবটা দেখতে পায়নি। অগত্যা অপেক্ষা ছাড়া উপায় কী?
একদিন হঠাৎই বাড়ির সবাই খুব গম্ভীর হয়ে গেল। কয়েকজন কাকুও এসেছিল। জেঠুকে ওরা ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে যায়। রেণু ছুট্টে গেছিল। জেঠু বিছানায় শুয়ে শুয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল। হাত দিয়ে ডেকেওছিল। ও যেতে চেয়েছিল। মা বলেছিল, ‘জেঠুর শরীর ভালো নেই রেণু!’ ওর মনটা উসুখুসু করছিল। কী হল জেঠুর? কেনই বা মা ওকে জেঠুর কাছে যেতে বারণ করেছিল? এসব মাথায় ঘুরতে ঘুরতে কখন যে রেণু ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না। চোখ খুলল যখন, অনেকটা সকাল হয়ে গেছে। ঢেউ খেলানো পর্দা দিয়ে রোদ্দুর এসে পড়েছে রেণুর মুখে। কালো হলুদ শালিকটা তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে জানালাটায়। ইশ, এক শালিক দেখতে নেই যে! ও চটপট উঠে পড়েই দিল এক দৌড় জেঠুর ঘরে। জেঠু চা-বিস্কুট খাচ্ছিল।
“কাল তোমার কী হয়েছিল?”
“কিচ্ছু না!”
“রেণু! সকাল সকাল এসেই বিরক্ত করছ জেঠুকে? কতবার বারণ করলাম?” কড়া গলায় বকতে শুরু করে রেণুর মা।
“আহ্ সৌমি, ওকে বকছ কেন?”
“দাদা, আপনি তো জানেন ও আপনাকে একটুও বিশ্রাম করতে দেবে না।”
জেঠু ওর মাথায় হাত বোলাচ্ছিল। কিন্তু ওর মা তখনও বকবক করছিল। রেণু ভাবছিল, এই সুযোগে যদি জেনে নেওয়া যায় জেঠুর বড়ো ম্যাজিকটা আসলে কী।
এক সপ্তাহ পর
রেণু এখন আসে জেঠুর ঘরে। মা বকে না। ভুঁড়ির উপর উঠে ধপাস-ধাঁই খেলাটাও চালিয়ে যায়। বেশ মজা লাগে। জেঠু বলেছে, খুব তাড়াতাড়ি বড়ো ম্যাজিক দেখতে পাবে রেণু।
সেদিন দুপুরে রেণু একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। একটা গাড়ি খুব জোরে জোরে হর্ন দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। জেঠুকে সাদা গাড়িতে তুলে কোথায় যেন নিয়ে চলে গিয়েছিল অনেকে। রেণু ফাঁকা ঘরে একলা দাঁড়িয়ে ভাবছিল। জেঠু কবে আসবে? কবে ওকে ম্যাজিক দেখাবে!
রেণু এখন গুনতে শিখেছে। চারদিন হয়ে গেছে। জেঠু এখনও আসেনি। কিছুদিন পর ও দেখেছিল ঠাকুমা-দাদুর পাশে জেঠুর একটা নতুন ছবি এসেছে। আর মা ছবিটাকে নমো করতে বলছে। কৌতূহল বেড়ে যাচ্ছিল। ও দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েছিল জেঠুর ঘরে। অনেক খুঁজে শেষমেশ আলমারির মাথায় টুলের উপর দাঁড়িয়ে পেয়েছিল একটা সুতোর বান্ডিল। আর কাঠিতে লাগানো কাগজ। কিন্তু সুতোটা হাতে তুলে নিতেই আঙুলগুলো চিনচিন করতে লাগল। “উহ্, মা!” রেণু এক দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে মাকে জাপটে ধরেছিল।
মা ওর হাতদুটো ধুয়ে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তখনও আঙুলদুটো খুব ব্যথা করছিল। মা জিজ্ঞেস করেছিল ওকে। বুঝতে পারছিল না কী বলবে মাকে। জেঠু কী এমন ম্যাজিক বানাচ্ছিল যাতে ও হাতে ব্যথা পেল? আর জেঠুই বা ওকে না বলে কোথায় গেল? একরাশ অভিমান পিঁপড়ের মতো পায়ে হেঁটে জমা হচ্ছিল। ও হাত দেখিয়ে দিয়েছিল জেঠুর ঘরে।
“এ তো সুতো। মাঞ্জা দিচ্ছিল দাদা। ঘুড়ি বানানোর জন্য। কাচের গুঁড়ো! তাতেই হাত কাটলি?”
রেণুর বুকের মধ্যেটা তোলপাড় করে উঠল। জড়িয়ে জাপটে আঁকড়ে ধরল মাকে। বাগানের শিউলিগাছটা থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ এসে লাগছিল ওর নাকে। রেণু জানালার দিকে তাকায়। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। চোখদুটো বন্ধ করে আরও একবার তাকায়। হ্যাঁ, ঠিকই তো! জেঠু! দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ইয়াবড়ো একটা ঘুড়ি। সমস্ত কষ্ট উবে গেল ওর। তাহলে কি সত্যি সত্যি ম্যাজিক দেখার সময় এল? রেণু মায়ের কোল থেকে নেমে একছুটে দৌড়ে গেল বাগানের দিকে।
অলঙ্করণঃ সায়ন মজুমদার
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস
ভালো গল্প
LikeLike
ধন্যবাদ
LikeLike