রাজীবকুমার সাহার অন্যান্য গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ
রাজীবকুমার সাহা
এক
আজ ময়নামতির ঘাটে বাৎসরিক মেলা। এই ঘাটে শেষ ফাল্গুনের বারুণী মেলা বয়সে প্রাচীন নয়। কেমন করে ঘাটের বুড়োবেলতলায় এই মেলার প্রচলন হয়েছিল তা নির্দিষ্ট করে বলা শক্ত। হয়তো বা ঐ পুণ্যতিথিতে কোনও এক বছর স্নানার্থী ভক্তদের সমাগম হঠাৎ বেড়ে হয়ে ঘাটের চতুর দোকানদার নিজস্ব লোকবলে আরও কিছু খোলা দোকানপাট বাড়িয়ে নিয়েছিল বুড়োবেলতলায়। লোকজনও উৎসাহিত হয়ে উঠল। বছর বছর এই মেলার শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে লাগল।
অথচ ময়নামতি একদিন তার বাপের হাত ধরে এই গাঁয়ে এসে উপস্থিত না হলে এ-ঘাটের বুঝি অস্তিত্বও থাকত না। যুগলহাটির গাঙ বিনা পরিচয়েই কালের নিয়মে একদিন মজে হেজে যেত।
মেলার দিন সকাল সকাল ভবা স্নান সেরে, মাথায় আচ্ছা করে সুগন্ধি তেল চাপিয়ে, পাট করে চুল আঁচড়ে মেলার এ-প্রান্ত থেকে ঐ-প্রান্ত টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। রিক্সার হাতলে মাইক বেঁধে কাল সারা বিকেল ধরে আশেপাশের পাঁচ গাঁয়ে মেলার প্রচার করে ফিরছিল মেলা কমিটি। ভোরের আলো যেই না ফুটতে শুরু করল, অমনি পিল পিল করে ভক্তের দঙ্গল ময়নামতির ঘাটে উপস্থিত হয়ে জলে নামবার অভিপ্রায়ে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিল। বারুণীর সঙ্গে আজ কী একটা অন্য যোগও নাকি রয়েছে ফাউ। সুতরাং মেলা এ-বছর জমবে মস্ত, তা কমিটির আগে থেকেই অনুমান ছিল। দোকানপাটও অন্যান্যবারের তুলনায় ঢের বেশি বসেছে এবারে।
ভবা ঘুরতে ঘুরতে ভিড় ঠেলে কোনওক্রমে বুড়োবেলতলায় পৌঁছবার চেষ্টায় ছিল। মেলা ঘুরে এসেছে অথচ বেলতলায় একটিবার মাথা ঠেকায়নি, মার কানে গেলে বিস্তর গালমন্দ আছে কপালে।
ভিড় ঠেলে অতিকষ্টে সামান্য এগিয়ে যেতেই কোত্থেকে প্রবল এক শিশু-কান্না এসে কানে লাগল তার। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, অল্পদূরেই একখানা খেজুরগাছের ঝিরিঝিরি ছায়ায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে ছিট কাপড়ের ফ্রক পরা বছর চারেকের এক শিশু মায়ের আঁচল টেনে ধরে চিল-চিৎকার জুড়েছে। পেছন থেকে জনপ্লাবনের ধাক্কায় দুই দণ্ড স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাপারখানা বুঝে নেওয়ার জো নেই। তবে ভবার গায়ের জোর অসম্ভব। এরই আশ্রয় নিয়ে কোনোক্রমে ভিড় কাটিয়ে খেজুরগাছের তলায় এসে উপস্থিত হল সে। দেখে, কোন গ্রাম থেকে অল্পবয়সী এক অভাবী গেরস্থ-বৌ বুড়োবেলতলায় পুজো দিতে এসেছে। সঙ্গে আর কেউ নেই। বেচারি না পারছে এই ভিড়ে মেয়ে কোলে করে অধিষ্ঠানের দিকে এগোতে, না সাহস পারছে মেয়েকে একা গাছতলায় বসিয়ে পুজো সেরে আসতে। অথচ বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। রোদে মাথা তেতে উঠছে। অভুক্ত থেকে শরীরও অবশ হয়ে আসছে ক্রমশ। মেয়ে ওদিকে অনবরত কেঁদেই চলেছে। এইটুকুনি প্রাণ, অথচ গলার কী জোর! বেচারির বোধহয় খিদের উদ্রেক হয়েছে।
ভবা নিজে যেচেই ওই মেয়ের জিম্মা নিতে রাজী হলে বৌটি একরকম নিশ্চিন্ত হয়ে পুজোর নৈবেদ্য তুলে নিয়ে ভিড়ে মিলিয়ে গেল।
মেয়েটার মুখের দিকে এতক্ষণ ভালো করে নজর দেওয়ার অবকাশ পায়নি ভবা। এবারে চোখ পড়তেই চমকে উঠল বেজায়। সেই চোখ, সেই মুখের আদল, মায় থুতুনির তলায় সামান্য কাটা দাগটা পর্যন্ত বিলক্ষণ স্পষ্ট। শিউরে উঠল ভেতরে ভেতরে সে। নিষ্পলক দুই চোখের পাতা একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লে হুঁশ ফিরল তার। চারদিকের দোকানপাটে একনজর বুলিয়ে প্রস্তাব দিল, “অ্যাই, জিলিপি খাবি? অ খুকি?”
খুকি জিলিপির নাম শুনে বড়ো বড়ো ভেজা চোখ মেলে ভবার মুখে তাকিয়ে পরম উৎসাহে ওপর-নিচে মাথা নাড়তে ভবা নিচের ঠোঁটখানার এককোণ কামড়ে ধরে বলল, “চল তবে, তোকে জিলিপি কিনে দিই গে। আয়।”
ভিড় ঠেলে এক ঠোঙা জিলিপি কিনে খুকির হাতে দিতে গিয়ে ভবার মাথায় কী একটা খেলা করে গেল। তলিয়ে ভেবে দেখবার আগেই সে মেয়েকে অপটু হাতে কোনোক্রমে কোলে তুলে নিয়ে মেলার পাশ কাটিয়ে দিল টেনে দৌড়। এখনই কানুকাকার বাড়ি গিয়ে ওঠা দরকার। ভবার অপরিণামদর্শী মন অজানা এক পুলকে উদ্বেলিত হয়ে উঠল। দূর থেকে নজর পড়তে খুকির মাও আলুথালু বেশে কখন পেছন পেছন দৌড়তে শুরু করেছে ভবা খেয়াল করল না।
দুই
ক্যানেস্তারার পাত ঘেরা ঘুপচি রসুইঘরটার দোরে কাঁচুমাচু কানাইলাল লম্বা লম্বা পায়ে হাজির হয়ে বলল, “রান্না কদ্দুর রে, মা? এই পোয়াটাক ট্যাংরামাছ এনেছিলাম, কুটতে পারবি তো?”
ময়নামতি তখন উনুনের দিকে মুখ করে ফ্যান গালছিল। বঙ্কিম গ্রীবা বাপের অসহায় মুখের দিকে ঘোরাতেই তার ফিক করে হেসে ফেলার জোগাড় হয়েছিল। তবে ধরা দিল না। কপট গম্ভীর চোখের ইশারায় একখানা পাত্র দেখিয়ে বলল, “ওতে ঢেলে রাখো। কুটতেও পারব, আর বেগুন-কালোজিরের রসাও। ও ছাড়া তো ট্যাংরা তোমার মুখে রুচবে না জানি। ইস, কাচা রুমালটা যে এক্কেবারে… যাও, কলতলার বালতিতে জমা করো গে যাও।”
বাপ-বেটির সংসার। আবার মায়ে-পুতেরও বলা চলে। বছর তেরোতেই মা মরা ময়না খাঁটি গিন্নিবান্নি হয়ে উঠেছে। অবশ্য উপায়ই বা কী? উড়নচণ্ডী বাপকে কড়া হাতে সামলানো, সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম তাকেই দেখতে হয়। মায়ের কথা ময়নার স্মরণে আসে না। সে স্কুলে যেতে পায় না বটে, কিন্তু লেখাপড়াতে দারুণ উৎসাহ। কানাই তা বুঝে ঘরেই এক মাস্টার রেখে দিয়েছে।
শেয়ালদা স্টেশনের উত্তরে নবীন বসাক লেনের একেবারে শেষে কচুরির দামে ভর্তি এক ডোবার পাশে কয়েক ঘর কুলি-মিস্ত্রি নিয়ে এদের বসবাস। খালি জমিতে চারধারে রেলের কামরার মতো ছেঁচা বেড়ার ঘর তুলে দিয়ে বাড়িওয়ালা রাস্তার সীমানায় মুদিখানা খুলে বসেছে। জলের লাইন নিয়ে, কাপড় মেলবার দড়ির অধিকার নিয়ে এই বাড়িতে চুলোচুলির অন্ত নেই। আগে ক্ষণে ক্ষণে বিচলিত হয়ে পড়লেও ময়না এখন আর ওতে কান দেয় না। সে তার বেহিসাবি বাপকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। কানাইর না আছে চালচুলোর খবর, না আছে ভবিষ্যতের চিন্তা। সে বউবাজারে এক চালের আড়তে সরকারি করে। মাসমাইনে যা পায় অর্ধেক চালান যায় বাসাবাড়ির মিষ্টি কথার হাত পাতুনেদের পকেটে। সে ধার আর আদায় হয় না। তক্কে তক্কে থেকে ময়না এসে মধ্যে না পড়লে বুঝি বাকি অর্ধেকও বিলিয়ে দেয়, সংসারের খরচ জোটে না। এছাড়া কানাইর অহেতুক বিলাসিতার দরুন মাসের কুড়ি দিন পার না হতেই টানাটানি লেগে যায়।
মাস তিনেক পরে চৈত্রের এক রাতে আকস্মিক ঝড়জল মাথায় করে কানাই এসে ভিজে কাপড়েই কাঁচা মেঝেতে হাত-পা ছেড়ে বসে পড়ল। চোখেমুখে কালবৈশাখীর মেঘের চেয়েও ঘন পোঁচের কালি। নিচু মাথায় অস্ফুটে বলল, “চাকরিটা গেল রে, মা। বড়োবাবু আজ পাকাপাকি জবাব দিলেন।”
আতঙ্কিত ময়নার মুখে কথা সরল না প্রথমে। একটু পরে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “টাকাটা জোগাড় হয়নি না, বাবা? তুমিই দায়ী রইলে তবে শেষে?”
ময়না বিলক্ষণ জানে, তার বাবার খরচের হাতটা লম্বা বটে, কিন্তু চুরি করতে পারে না।
“না রে, মা। সে টাকাটার হদিশ মেলেনি। দু’মাস আগের হিসেবের গরমিল… কে করেছে, কে সরিয়েছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না। বাবুরা পুলিশে দেয়নি এই ঢের। ভালোয় ভালোয় নিজে থেকেই ছেড়ে আসতে বলেছে কাজটা।”
কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে ময়না জিজ্ঞেস করল, “এখন?”
মলিন হেসে কানাই আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করে, “কিছু একটা জোগাড় হয়ে যাবে ঠিক। তুই ভাবিস না। তোর এই বুড়ো ছেলের হাড় ক’খানার জোর এখনও ফুরোয়নি। মুড়ি-গুড় কিছু একটু থাকলে দে দিকিনি, আজ দুপুরে খাওয়া হয়নি।” বলেই কী মনে পড়তে জামার পকেট হাতড়ে খবরের কাগজে মোড়া ছোট্ট এক পুঁটুলি বের করে হাতে ধরিয়ে দিল মেয়ের। “নে ধর, তোর তেল আর সাবান। খাতা-কলমটা কালপরশু এনে দেব’খন। মোড়ের দোকানটার ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে দেখলাম। ভেবেছিলাম চোত-সংক্কান্তিতে তোর দু’খানা ছাপা কাপড়ও অমনি…”
আশ্চর্য ময়নার ভেজা পুঁটুলিখানা হাতে নেওয়ার ফাঁকে কখন গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল, কানা হ্যারিকেনের শিষ ওঠা অপ্রতুল আলোয় কানাইলালের তা গোচরে এল না।
না, কানাই কিছু একটা আর জোগাড় করতে পারেনি। প্রথমে এ-বাজার সে-বাজার ঘুরে দোকানপাট, আড়তে-মজুতে যা হোক একটা কাজ জোটাবার বিস্তর চেষ্টা করল। লাভ হল না। সামান্য পুঁজি সম্বল করে কলম-লজেন্স-সেফটিপিন ফেরি করে বেড়াল। অনভ্যস্ত ব্যাবসায় অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্রমে পিছিয়ে পড়ল। শেষে কম দামে কিছু ফল কিনে স্টেশনের বাইরে বসল। ফল শুকিয়ে উঠল, কিছু পচে গেল। বিক্রিবাটা বিশেষ হল না। মাঝখানে ময়নার হাতে যৎসামান্য যা ছিল তাও বেরিয়ে গেল। শেষকালে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে কলকাতায় থেকে খোরাকি জোটানোই দায় হয়ে পড়ল।
তিন
যুগলহাটি থেকে রেলস্টেশন মাইল তিনেক দূরে। সন্ধের মুখমুখ কানাই মেয়ের হাত ধরে যখন গাঁয়ে এসে ঢুকল তখন গোয়ালে গোয়ালে চট ভিজিয়ে আগুন করে মশা তাড়াবার তোড়জোড় চলছে। গৌর বৈরাগীর উঠোনের বেড়া পাশ কেটে যাবার সময় কানে এল, “কে যায়?”
কানাই দিক পরিবর্তন করে এগিয়ে এসে জবাব দেয়, “আমি গো গৌরমামা, কানু।”
ময়না দেখল, কে একজন আবছা অন্ধকারে মাটির নিকানো দাওয়ায় উবু হয়ে বসে থেলো হুঁকোয় ঠোঁট চেপে গুড়ুক গুড়ুক শব্দ তুলছে। আর টানে টানে কলকের মুখ একেকবার দপ করে জ্বলে উঠছে।
হুঁকোয় মুখ চেপেই গৌর চোখ ওপরে তুলে দেখলেন। হুঁকো নামিয়ে বললেন, “কোন কানু? ফণীদের ভাগনে? তা এসময়ে কোত্থেকে?”
“কলকাতা থেকে, মামাবাবু। পাট চুকে গেল, মেয়েকে নিয়ে পাকাপাকি চলে এলাম আপনাদের শরণে।”
কানাইর উত্তর কানে যেতেই গৌর ময়নার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। বললেন, “অ, এ-মেয়ে তোমার? তা বড়োগিন্নি তো অনেকদিন স্বর্গবাসী। ঘরবাড়ি ফাঁকা। তা থাকবা নাকি এ বাড়িতে, ছোটোগিন্নি? অ্যাঁ?” বলে নিজেই হেসে উঠলেন উচ্চৈঃস্বরে।
ময়না ঠোঁট টিপে হেসে মুখে আঁচল চাপা দিল। কানাই হেসে বলল, “অমন জামাই কি আর কপালে আছে, মামাবাবু? তা যাই পা চালিয়ে, সন্ধে বয়ে গেল। ওই মামার দেওয়া টুকরো জমিটাতেই যা হোক একটা ঠাঁই বাঁধব মনস্থ করেছি। আমার তো আর নিজস্ব সম্বল কিছু নেই।”
বাপ-মা মরা কানাইকে মামা ফণী গোস্বামী কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিলেন। স্বর্গবাসী হবার আগে ভাগনেকে দুই ছেলের সমান অংশীদারি করে একটুকরো জমিও লেখাপড়া করে গিয়েছিলেন। লায়েক হয়ে কলকাতায় গিয়ে চাকরি করবার বাই উঠলে কানাই যুগলহাটি ছেড়ে চলে গেলেও তার জমি এ যাবত সুরক্ষিতই ছিল। এতকাল পরে এইবারে সে-জমিতে বাঁশ পড়ল, খড়ের চালা উঠল। বাপ-মেয়েতে গোছগাছ করে নতুন সংসার পাতল।
ময়নাদের বাড়িটা নদীর ধার ঘেঁষে। নদীর এইখানটায় কোনও ঘাট নেই। আকন্দের ঝোপ। কানাই দিন তিনেকের চেষ্টায় আগাছা সাফ করে, চার টুকরো তালগাছ চার ধাপে খুঁটেতে আটকে চলনসই ঘাট তৈরি করে ফেলল একখানা। ধীরে ধীরে আশেপাশের দু-চারজন বউ-ঝিও এই ঘাটে এসে নামতে শুরু করল। একসময় এই ঘাট পুরোদস্তুর গাঁয়ের মেয়ে-বউদের দখলে চলে গেল। পুরুষদের এই ঘাট ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হল। মুখে মুখে কবে এই ঘাটের নাম হয়ে গেল ময়নামতির ঘাট।
ভবা, সুশি, গবু, বেন্দারা ঘাটের পাশের খোলা মাঠে দিনভর বুড়ি ছোঁয়া, গোল্লাছুট, ধাপ্পা-হুঁশ, ডাংগুলি খেলে বেড়ায়। ক্ষণে মারামারি, ক্ষণে হাসাহাসি করে। আর ময়না আঁধার মুখে চৈত্রসংক্রান্তিতে থোকা থোকা কুর্চি ফুলের মালা গেঁথে দরজায় টাঙায়, বর্ষার মুখে উঠানের কোণে গন্ধরাজের চারা পুঁতে। ঘরকন্নার কাজ সামলায়। তার প্রাণ কাঁদে অন্য বিষয়ে। কলকাতায় থাকলে, আর সংসারটা আগের মতোই চললে আর বছর তিনেকের মধ্যেই সে ম্যাট্রিকে বসতে পারত। যুগলহাটিতে এসে সে অবকাশ আর রইল না। এখানে ছেলেপিলেরা নামমাত্র ইশকুলে যায়, সন্ধেয় হ্যারিকেন জ্বেলে পড়া করতে বসেই ঢুলতে থাকে। আট ক্লাসের ওপর এই গাঁয়ে কোনও ইশকুলও নেই।
কানাই এই বর্ষায় একখানা মস্ত মানকচুর ক্ষেত করেছে। হাওলাত-বরাত করে একজোড়া গাইও কিনে এনেছে। কষ্টেসৃষ্টে সংসারের হাল ধরেছে। ময়না ক’দিনের চেষ্টায় সুন্দর তালপাতার পাখা তৈরি করতে শিখে গেছে। পাখার গায়ে আলতা দিয়ে আল্পনা কেটে দাওয়ার বাতায় গুঁজে রাখে। বিক্রিবাটাও মন্দ হয় না। সংসার আর অচল রইল না।
চার
এক রাতে কানাইকে ভাত বেড়ে দিয়ে ময়না আবদার জুড়ল, “উত্তরের ফাঁকা ভিটেটায় একটা চালা তুলে দাও না বাবা, ইশকুল গড়ব।”
কানাই আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ইশকুল! কে পড়বে? পড়াবেই বা কে?”
“লোকের কি অভাব হবে, বাবা? বুড়ো-ধাড়িগুলোর তো প্রায় কারোই বর্ণপরিচয়টুকুও নেই এ-গাঁয়ে। আমি এদের লিখতে পড়তে শেখাব। তুমি অমত কোরো না। সন্ধের পর তো বসেই থাকি কলুকাকিমা, নয় বিনুপিসিদের সঙ্গে। ওদের তো শুধু ওই কে কী করল, কে কী বলল আর কে কী খেল। আমার ছাই ভালো লাগে না ওসব।”
মেয়ের গোমড়া মুখের দিকে একবার মুখ তুলেই ফিক করে হেসে ফেলল কানাই। বলল, “বেশ তো। এ আর বেশি কী? দিন কতক অপেক্ষা কর, মঙ্গলির বাছুরটা হোক। তখন তো আর গোয়ালে সবগুলোর জায়গা হবে না। হাটে বেচে দিতে হবে মঙ্গলিকে বাছুরসুদ্ধু। টাকা ক’টা হাতে পাই, তোর ইশকুল গড়ে দেব আমি। কেমন, দিদিমণি?”
দিন দুয়েকের দুধ জমিয়ে ময়না সেদিন পায়েস রেঁধেছিল বিকেলে। খুশি হয়ে প্রায় সবটুকুই উপুড় করে দিল বাপের পাতে।
হপ্তাখানেক পরের কথা।
সেদিন সন্ধে ঘনালে গোয়ালঘরের সামনে গাই-গরুদের জাব খাওয়াতে গিয়ে ময়না অঘটন বাধিয়ে ফেলল একটা।
মঙ্গলির ফুটফুটে একখানা কপাল-চাঁদা বাছুর জন্মেছে। ডাগর চোখদুটোতে যেন যত্ন করে কে পুরু কাজল লেপে রেখেছে। এত চঞ্চল বাছুর ময়না জন্মে কখনও দেখেনি। মঙ্গলি নিজেও এই অস্থিরমতি শিশুটিকে আগলে রাখতে বড়ো ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। কোমর ঝুঁকিয়ে জাব রাখতে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে কখন ময়নার থুতুনির নিচে এসে দাঁড়িয়েছে সে বাছুর। মঙ্গলিও চকিতে সন্তানকে চেটে দেওয়ার জন্যে মাথাটা ঝুঁকিয়ে এগিয়ে এলে একখানা শিং সজোরে ময়নার থুতুনিতে আঘাত করল এসে। মুহূর্তের মধ্যে থুতুনি ফেটে গলগল করে রক্ত ভেসে তার ডুরে শাড়ির পাড় ভিজে উঠল। দিন কতক পর জায়গাটা শুকিয়ে এল বটে, কিন্তু দাগ একটা রয়ে গেল।
পাঁচ
ময়না যেদিন ভবাদের দলে ভিড়ে খেলতে এল গবু, সুশি সাদরে হাত ধরে টেনে নিল তাকে। সেদিন খেলা সাঙ্গ হবার পর স্থির হল যে অনেকদিন হয়ে গেছে, আজ একবার জম্পেশ করে পাকা তেঁতুলে কাঁচা লঙ্কা থেঁতো করে কাঁঠালের মুচি মেখে না খেলে আর চলছে না। সিংগিদের পরিত্যক্ত বাগানে প্রচুর কাঁঠালের মুচি এসেছে এবছর। পাশের বাড়িটাই সুশিদের। পাকা তেঁতুল চেয়ে আনা যাবে। আর কাঁচা লঙ্কার তো ক্ষেতই রয়েছে নদী-চরে।
সন্ধে বয়ে যাওয়ার মুখে। ময়না সিংগিদের বাগান থেকে ফিরে বাড়িতে পা দিয়েই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। গোয়ালে আগুন ধরেছে। সবটা গ্রাস করতে বাকি আছে এখনও। গরু-বাছুর মিলে গোটা পাঁচেক অবলা প্রাণী। প্রাণ বাঁচাতে দড়িদড়া ছিঁড়ে পালাবার ব্যর্থ চেষ্টায় ছটফট করে চলেছে নিরন্তর। ডেকে চলেছে তারস্বরে। মশা তাড়াতে কানাই কখন ভিজে খড়ের নিস্তেজ আগুনে ধোঁয়া করে কোথায় চলে গেছে। হয়তো খড় দরকারমতো ভেজেনি।
ময়নার দৃষ্টি একটুক্ষণের জন্যে আবছা হয়ে উঠল। পরক্ষণেই মাথায় কী খেলতে একদৌড়ে রান্নাঘর থেকে বটিখানা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে সোজা গোয়ালঘরে ঢুকল গিয়ে। প্রথমে গরু-বাছুরগুলোর গলার দড়ি কেটে মুক্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
যুগলহাটির মূল বসতি থেকে কানাইর ভিটেখানা খানিকটা তফাতে হবার দরুন লোকজন ছুটে আসার আগেই গোয়ালঘরটা ছাই হয়ে গেল।
তিনদিন পার হতে চলল ময়না চোখ মেলেনি। কবিরাজমশাই নিত্যি দু’বেলা এসে দেখে যাচ্ছেন। সর্বাঙ্গই পুড়ে গেছে প্রায়। তাতে জড়িবুটির প্রলেপ পড়েছে। দশ-বারো ক্রোশের মধ্যে হাসপাতালের ব্যবস্থা নেই। অর্ধচেতন ময়নার শুধু অস্পষ্ট এক গোঙানি ছাড়া আর কোনও সাড়াশব্দ নেই।
শেষরাতে ময়নার বিকার উপস্থিত হল। প্রথমে সে সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের মতো পাশে বসে ঢুলতে থাকা বাবাকে আশ্চর্য গলায় জিজ্ঞেস করল, “এ কী! তুমি শুতে যাওনি এখনও?”
কানাই ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসতেই ময়না আবার জিজ্ঞেস করল, “খেয়েছ?”
ময়নার কণ্ঠস্বর অত্যন্ত স্বাভাবিক। ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি। চোখদুটো জুড়ে শুধু অসম্ভব ক্লান্তি।
কানাই পুলকিত হয়ে বলল, “এখন কেমন বোধ করছিস, মা? যন্ত্রণাটা কমেছে একটু? আর ভয় নেই। দেখিস, শিগগিরই সুস্থ হয়ে উঠবি তুই। অনন্ত কোবরেজ শুনেছি সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। খাবি কিছু, মা? অ্যাঁ? মিছরি গুলে দিই একটু জলে?”
ময়নার চোখমুখ যন্ত্রণায় কুঁচকে উঠল এবারে। অত্যধিক ছটফট করতে লাগল সহসা। চারদিকে ঘূর্ণায়মান চোখের তারায় কী এক বিভীষিকা। আপন মনে বিড়বিড় করতে লাগল, “গরুগুলো কোথায়? মঙ্গলির বাছুরটা? উত্তরের ভিটেতে আমার ইশকুল… কতজন পড়তে এসেছে দেখো দেখো। গৌরদাদু, রামহরিজ্যাঠা… বিনুপিসি কই, বাবা? অ্যাঁ? ঘরটা এত অন্ধকার করে রেখেছ কেন?”
কানাই কতক বুঝল, কতক না বুঝে সন্তর্পণে কান পেতে রাখল ঝুঁকে। মেয়ের অর্ধদগ্ধ চুলে হাত বোলাতে বোলাতে ডুকরে উঠল। “গরুগুলো সব বেঁচে আছে রে মা, নিরাপদেই আছে। তুই সময়মতো দড়ি কেটে না দিলে… আর মঙ্গলির বাছুরটার সামনের দু’পায়ে একটু আধটু ছ্যাঁকা লেগেছে বটে, ও সেরে যাবে। ওই দুষ্টুটাই হয়তো কোন ফাঁকে ঘেঁটেছিল আগুনটা। তুই একটু ঘুমো মা, একটু ঘুমনোর চেষ্টা কর। সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখিস।”
ময়নার তখন নাভিশ্বাস উপস্থিত হয়েছে। বিস্ফারিত চোখে হাঁ করে বার কয়েক শ্বাস টেনে শেষে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল সে। আর জাগল না।
কানাইর তন্দ্রা ভেঙেছিল দরজায় কবিরাজমশাইয়ের মুহুর্মুহু ধাক্কায়। ভোরের আলো ফুটলে বৃদ্ধ অনন্ত কবিরাজ এসে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলে বেরিয়ে গেলেন। কানাইর মস্তিষ্কের কোষে কোষে কী একটা খেলে গেল সহসা।
***
কথা শুরু হয়েছিল ময়নামতির ঘাট নিয়ে, বারুণীর মেলা নিয়ে, ভবার মেয়ে চুরি করে পালানোর কথা নিয়ে।
শিশু কোলে ভবা হাঁকুপাঁকু করে কানাইলালের বাড়ির দিকে দৌড়ে আসছিল। পথ আটকালেন রামহরি চক্কোত্তি। চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে ভবা, অমন ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চিস কনে? এ মেয়ে কার?”
ভবা এতক্ষণে যেন ডাঙা পেল। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “কানুকাকার কাছে। ময়না ফিরে এইছে জ্যাঠামশায়, এই দেখেন মুখটা। বলেন, ময়না নয়?”
খুঁটিয়ে একটুক্ষণ নিরীক্ষণ করেই রামহরির কুঞ্চিত চোখমুখ বিস্ময়ে ভরে উঠল। অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন, “এ কী! এ কীভাবে সম্ভব! সেই চোখ, সেই মুখ…” ভবাকে বললেন, “যা যা, শিগগির যা। মেয়েটার মুখটা দেখলে যদি কানুটা আবার আগের মতো…”
রামহরির কথা মুখ থেকে পড়ার আগেই ভবা আবার দৌড় দিয়েছে। তার সঙ্গে দৌড়ে তাল রাখতে পারলেন না রামহরি। পিছিয়ে পড়লেন ক্রমশ। খুকির মা তো আরও পেছনে।
রামহরি পথে গৌর বৈরাগীকেও ডেকে নিয়েছিলেন। দু’জনে মিলে কানাইর ভিটেয় উপস্থিত হয়ে দেখেন, ভবা দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে আছে। মেয়েটি অল্প দূরে মাটিতে বসে কেঁদে সারা হচ্ছে। হাতের জিলিপি কচলে কিছু খেয়েছে, কিছু নাকে মুখে লেপেছে। ভবার চোখমুখ হতাশাগ্রস্ত। রামহরিদের সামনে পেয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল, “কানুকাকা নেই, জ্যাঠামশায়। এই দেখেন না, কার বাড়ি থেকে ভাতভর্তি থালা রেখে গেছে, মাছি ঘুরছে। ঘর খালি। ময়নার ছেলেবেলার খেলনা-পুতুল, জামাকাপড় কিচ্ছুটি নাই।”
রামহরি চমকে উঠলেন। বললেন, “সে কি! কানু তো ঘরটা আগলেই পড়ে থাকত মেয়েটা যাওয়ার পর। কেউ দিলে খেত, নয়তো উপোস করত। আজ বছর আষ্টেক হয়ে গেল…”
গৌর একটা জোর শ্বাস ফেলে বললেন, “হ্যাঁ, মেয়েটা মারা যাওয়ার পর কানুর মাথাটায় যে কী হয়ে গেল ঈশ্বর জানেন। মেয়ের স্মৃতি আগলেই পড়ে থাকত দিনরাত। কারও সনে একটা কথাও কইত না। ডাকলে ঘোলা চোখে তাকাত মুখের পানে।” তারপরই হঠাৎই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন, “কিন্তু এইভাবে তো বসে থাকলে চলবে না হে। লোক জোগাড় দেখো, রামহরি। কানুকে খুঁজে বের করতে হবে। কোথাও যদি কারও কিছু অনিষ্টি-টনিষ্টি করে বসে আবার! বলা তো যায় না। আর মেয়েটাকে তুই এক্ষুনি মেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যা ভবা। ওর মার হয়তো পাগলপারা অবস্থা। আর তোমারও বলিহারি যাই রামহরি! চোখের সামনে দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে পালাল ছেলেটা, তুমি আটকালা না!”
রামহরি বড়োই বিব্রত বোধ করলেন। আমতা আমতা করে বললেন, “না মানে খুড়োমশাই, ওই মেয়ের চোখমুখ দেখেই ময়নার… মানে, মাথাটা কেমন গুলিয়ে গেল হঠাৎ…”
কথা শেষ হবার আগেই বিলাপরত খুকির মা উপস্থিত হয়ে ছোঁ মেরে কোলে তুলে নিল মেয়েকে। ভবাকে তো এই মারে সেই মারে অবস্থা। গৌর আর রামহরি উভয়ে মিলে কারণ বুঝিয়ে কোনোক্রমে শান্ত করলেন।
না, গাঁসুদ্ধু লোক তন্নতন্ন করে খুঁজেও কানু পাগলার হদিস পায়নি। কে এসে খবর দিল, নদীর ঘাটে ময়নার জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ঘাটের পাশের কাদামাটিতে বড়ো বড়ো পায়ের ছাপ বসে আছে। জলের অভিমুখে। ফিরতি ছাপ নেই।
রাত এক প্রহর অতিক্রান্ত হয়েছে তখন। হৈহল্লা একটা কানে ঢুকতেই ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসলেন গৌর বৈরাগী। দক্ষিণের জানালাটা মেলে শিউরে উঠলেন। ঘাটের কাছে কানাইর ভিটেখানা দাউ দাউ করে জ্বলছে। লোকজন জড়ো হচ্ছে। আর ঘাটের পথ বেয়ে উলটোদিকে ‘আগুন আগুন’ রবে একটা আর্তনাদ ছুটে পালাচ্ছে আঁধার-অনন্তে।
অলঙ্করণঃমৌসুমী
কেয়াবাত রাজীবদা..খুব ভাল লাগল…জীবনের গল্প লিখতে তোমার জুড়ি নেই
LikeLike
ধন্যবাদ, সুদীপ! ভালো লেগেছে জেনে আশ্বস্ত হলাম।
LikeLike
কী অপূর্ব লিখেছ দাদা। চোখ ভিজে আসছে
LikeLike
ধন্যবাদ, রুমেলা!
LikeLike
কে বলে মানিক বন্দ্যো নেই! আর বেশি বললে কম বলা হবে।
LikeLike