গল্প যমরাজের খোঁজে শিশির বিশ্বাস বর্ষা ২০১৯

শিশির বিশ্বাস-এর সমস্ত গল্প   

যমরাজের খোঁজে

শিশির বিশ্বাস

আমাদের এই গল্পের শুরু সেকালের পুরুষপুর নগরের এক পান্থনিবাসে। পুরুষপুর তখন কুষাণ সম্রাটদের রাজধানী। বড় শহর। তাই পান্থনিবাসটিও বড়। আরাম আর ফুর্তির ঢালও ব্যবস্থা। তিন বন্ধুর দিনগুলো তাই ভালই কাটছিল। সেদিন খাওয়ার ঘরে সবে সকালের নাস্তা নিয়ে বসেছে, বাইরে ঢং-ঢং শব্দে ঘন্টার আওয়াজ। হইচই।

ওরা দিন কয়েক আছে এখানে। এমন হয়নি কখনও। খাওয়া থামিয়ে বড়বন্ধু বলল, “হঠাৎ এত চিৎকার চ্যাঁচামেচি কিসের?”

উত্তরে বাকি দু’জন খেতে খেতেই ঠোট ওলটাল। কিন্তু বড়বন্ধু থামল না। আসলে তার মাথায় কিছু ঢুকলে সহজে নামতে চায় না। তার উপর দলের চাই। ঘাড় ফিরিয়ে মেজোবন্ধুকে বলল, “যাও, একবার খবর নিয়ে এসো তো। গুরুতর কিছু একটা হয়েছে মনে হচ্ছে।”

গুরুর ফরমায়েস যখন হয়েছে, কিছু একটা করতেই হয়। অথচ এই সময় খাবার ফেলে ওঠার ইচ্ছে একেবারেই নেই। সে পাশে ছোটবন্ধুর দিকে ঘাড় ফেরাল, “ওহে ছোট, যাও তো, নিয়ে এসো খবরটা।”

সবে খেতে বসে এখুনি ওঠার ইচ্ছে ছোটবধূরও নেই। উত্তরে চোখ নাচিয়ে বলল, এই সামান্য কাজে ছুটোছুটির দরকার কী? দাঁড়াও খোঁজ নিচ্ছি। বলেই সে অদুরে এক ছোকরা কর্মচারীকে উদ্দেশ করে হাঁক পাড়ল, “হেই ভেঁড়া।”

সেই হাঁক শুনে ছেলেটি প্রায় কাঠ হবার জোগাড়। তিনজন নাস্তা নিয়ে বসার পরেই সমানে শুরু হয়েছে হাঁকডাক। হরেক বায়নাক্কা। বেচারা এখনও সব সামাল দিয়ে উঠতে পারেনি। ফের তলব হতেই সে এক ছুটে সোজা মালিকের ঘরে। হাউমাউ করে বলল, “কত্তা, তিন বাবু সেই থেকে সমানে চাচামেচি করতে লেগেছে। আপনি আসুন একবার।”

শুধু আজ সকালেই নয়, দিন কয়েক হল ভিনদেশি নতুন এই অতিথিদের হাঁকডাকে কর্মচারিরা সব তটস্থ। বাবুদের মেজাজ বোঝাই দায়। কখন কী বায়নাক্কা হয়, ঠিক নেই। কেউ তাই সহজে কাছে ঘেঁসতে চায় না। খোদ মালিক নিজেও অতিষ্ঠ। ভিনদেশি শাসালো খদ্দের। তবু বিদেয় হলেই বাঁচেন। অগত্যা হন্তদন্ত হয়ে ছুটলেন। কাছে হাজির হতেই ছোটবন্ধু হক পাড়ল, “বাইরে এত গোলমাল কেন বলুন দেখি? কী হয়েছে?”

সেই কথায় হাঁফ ছাড়লেন তিনি। কপালের ঘাম মুছে বললেন, “মাফ করবেন মহাশয়। খানিক আগে বাইরে একজন খুন হয়েছেন। পৌরসভার গাড়ি তারই লাশ নিতে এসেছে।”

“খুন! সে কী কথা!” সমস্বরে তিনজন বলল।

“আজ্ঞে হ্যাঁ। খুন।”

“কে খুন হল বলুন তো?”

“আজ্ঞে,” ফের কপালের ঘাম মুছলেন ভদ্রলোক, “তিনি আপনাদের এক বন্ধুই মনে হয়। গত রাত্তিরে এখানেই আপনাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ হই-হুল্লোড় করে গেছেন।”

“অ্যাঁ! সে কী কথা! আমাদের বন্ধু!” বলতে বলতে তিন বন্ধু হাতের আস্তিন গুটিয়ে যেভাবে গুলি পাকাল, দু’পা পিছিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।

“আজ্ঞে হ্যা, একটু আগে খুন হওয়া মানুষটা আপনাদের বন্ধুই বটে।”

“তা খুনি ধরা পড়েছে?”

“আজ্ঞে না, ধরা পড়েনি। আসলে খুনি স্বয়ং যমরাজ কিনা!”

“যমরাজ!” একসাথে চেঁচিয়ে উঠল তিনজন, “সে আবার কে?”

“আজ্ঞে যমরাজের নাম শোনেননি? মানুষ খুন করাই তো তাঁর কাজ।”

“কোথায়, কোথায় সেই শয়তানটা?” একসাথে হইহই করে উঠল তিনজন।

“আজ্ঞে, যমরাজ কোথায় নেই বলুন!” কপালের ঘাম মুছলেন পান্থশালার মালিক, “হুট করে কোথা থেকে হঠাৎ তলোয়ার হাতে ছুটে এল। তারপর আপনাদের বন্ধুর মাথা ধড় থেকে নামিয়ে দিয়েই চোখের নিমেষে চম্পট।”

ততক্ষণে তিন জোয়ান উঠে দাঁড়িয়েছে। “শয়তানটা কোন দিকে গেছে বলুন দেখি? আমরা কিন্তু ছাড়ব না ওকে।” “আজ্ঞে সোজা উত্তরের দিকে। সবাই দেখেছে।”

“তাহলে যাচ্ছি আমরা। শয়তানটার ব্যবস্থা করে আসছি।”

“আজ্ঞে তাই আসুন। আমরাও বাঁচি একটু।”

তিন জোয়ান ততক্ষণে ঘর ছেড়ে পথে নেমে পড়েছে। প্রায় স্বগতোক্তির মতো মালিকের শেষ কথাটা তাই আর কানে গেল না কারো।

হনহন করে উত্তর দিক বরাবর অনেকটা পথ হেঁটে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা শহর ছাড়িয়ে এল। কিন্তু কোথায় যমরাজ! তেমন কিছুই নজরে পড়ল না কারো। ভেবেছিল সহজেই কাজটা সেরে ফেলতে পারবে। এসব ওদের কাছে প্রায় জলভাতের সমান। কিন্তু কোথায় কী! শহর পেরিয়ে আসার পর এদিকে মানুষজনও নেই! ওরা কী করবে ভাবছে, হঠাৎ নজরে পড়ল, অদুরে এক গাছতলায় বসে একটা মানুষ। গোড়ায় তো মনে হয়েছিল, এই বোধ হয় সেই যমরাজ! কিন্তু কাছে যেতে ভুল ভাঙল। যমরাজ কোথায়? হতকুৎসিত এক বৃদ্ধ মানুষ। গাছতলার ছায়ায় বসে ঝিমোচ্ছে। ছোটবন্ধু অবশ্য দমল না। বৃদ্ধের সেই মুখের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, “বুড়ো হলেও লোকটাকে সন্দেহের বাইরে রাখা ঠিক হবে না। এই নির্জন মাঠের মাঝে এভাবে বসে থাকার কারণটাই বা কী? চল একটু বাজিয়ে দেখা যাক।”

যুক্তি মন্দ নয়। তিনজন এরপর পায়ে পায়ে হাজির হল বুড়োর কাছে। বড়বন্ধু চড়া গলায় বলল, “ওহে বুড়ো, বলি হচ্ছে কী এখানে?”

থম মেরে ঝিমোচ্ছিল লোকটা। ডাক শুনে মাথা তুলে পিটপিট করে তাকাল। তারপর হাঁ করে বড় একটা দম নিয়ে বলল, “কী আর হবে বাবারা। বুড়ো হয়েছি। এখন যমরাজ কবে নেন, সেই অপেক্ষায় আছি।”

“অ্যাঁ যমরাজ!” তিনজন লাফিয়ে উঠল একসাথে, “বল কী হে! আমরা তো সেই যমরাজের খোঁজেই বেরিয়েছি! ব্যাটা আমাদের এক বন্ধুকে আজ সকালেই মেরে দিয়ে ভেগেছে। শয়তানটা কোথায় থাকে বল দেখি?”

“কাছেই বাবারা,” বুড়ো থেমে দম নিল খানিক। তারপর মুখ তুলে দূরে মাঠের মাঝে একটা বড় বট গাছের দিকে আঙুল তুলে দেখাল।

এক মুহূর্ত দেরি না করে কোমরে গোঁজা ছোরা বের করে তিন বন্ধু এরপর রে-রে করে ছুটল সেই বটগাছের দিকে। কিন্তু কাছে পৌঁছে যা দেখল, তাতে কারো মুখেই কোন কথা সরল না। হাঁ করে খানিক তাকিয়ে থেকে শেষে তিনজন একসাথে ধুপ করে বসে পড়ল সেখানে। কী কাণ্ড! যমরাজ কোথায়? গাছতলায় পড়ে রয়েছে একরাশ মোহর! সব সোনার।

বলা বাহুল্য, ব্যাপারটা সামলাতেই মিনিট কয়েক লেগে গেল ওদের। মেজোবন্ধুই মুখ খুলল প্রথম, “অযথা দেরি করে লাভ নেই। কেউ এসে পড়ার আগে মালগুলো নিয়ে সরে পড়া দরকার।”

“সে তো অবশ্যই,” বড়বন্ধু বলল, “এ যা মোহর রয়েছে এখানে, সারা জীবন আর চিন্তা করতে হবে না। পান্থশালার হতচ্ছাড়া মালিকটা কালও তাগাদা দিয়ে গেছে। একটা মোহর মুখের উপর ছুঁড়ে দিলে আর রা কাড়বে না। কিন্তু একটা ব্যাপার ভেবেছো, এই দিনদুপুরে এতগুলো মোহর নিয়ে শহরে ঢোকা কি ঠিক হবে? কারো নজরে পড়ে গেলে মুশকিল। বমাল সন্দেহে সোজা চালান করে দেবে ফাটকে। আম আর ছালা দুটোই যাবে!”

“এই একটা কাজের কথা বলেছো গুরু। ছোটবন্ধু মুখ খুলল এবার, আমিও বলি, মোহরগুলো নিয়ে সন্ধের আগে শহরে ঢোকা একেবারেই ঠিক হবে না।”

“তাহলে ভাগবাঁটোয়ারার ব্যাপারটা সেরে ফেলা যাক। ওটা সমান হওয়া চাই কিন্তু।” কথা শেষ করে মেজোবন্ধু বড়র দিকে তাকাল। সন্দেহ ছিল, দলের চাই বড়বন্ধু রাজি হবে কিনা। কিন্তু সে সহজেই মেনে নিল ব্যাপারটা। বলল, “সে তো বটেই। আমরা তিনজনেই যখন একসাথে মোহরগুলোর খোঁজ পেয়েছি, তখন সবারই সমান অধিকার। কিন্তু ভাবছি অন্য একটা ব্যাপার। সারা দিন কাটাতে হবে এখানে। তাড়াহুড়োয় সকালে পেটে তেমন কিছুই পড়েনি। আমি বলি, চট করে কেউ শহরে গিয়ে কিছু খাবার নিয়ে আসুক। তারপর খেয়েদেয়ে ভাগবাঁটোয়ারায় বসা যাবে।”

পরামর্শ মন্দ নয়। কিন্তু যাবে কে? এই অবস্থায় মোহর ছেড়ে নড়তে কেউই রাজি নয়। ছোটবন্ধু বলল, “কেউ যখন রাজি নয়, তখন এক দান চৌপাট হয়ে যাক। যে হারবে, তাকেই যেতে হবে খাবার আনতে।”

চৌপাট সেকালে এক রকমের পাশা খেলা। পাশার মতোই দুটি লম্বা খুঁটি চেলে খেলা হয়। খুঁটির চারটি তলে থাকে দুই থেকে পাঁচটি পর্যন্ত ফোঁটা। চৌপাট খেলায় দান চালতে ছোটবন্ধুর কেরামতি বিলক্ষণ জানা আছে আছে ওদের। খুঁটি প্রায় কথা বলে তার হাতে। হারানো মুশকিল। কেউ অই বড়ো একটা ওর সঙ্গে খেলতে রাজি হয় না। তাতে ছোটবন্ধুর বিশেষ সমস্যা হয় না। এই বিদেশে ঠিক খেলুড়ে জুটিয়ে ফেলে। অল্প সময়ের মধ্যেই পকেট ফাঁকা করে ফেলে তাদের।

জানা থাকতে এমন ওস্তাদ খেলুড়ের সঙ্গে কে আর শখ করে খেলতে নামে! কিন্তু এই ক্ষেত্রে অন্য উপায় কোথায়? তাই বাকি দু’জনকে রাজি হতেই হল। চৌপাটের খুঁটি ছোটবন্ধুর সঙ্গে সব সময়ই মজুত থাকে। কোমরে গোঁজা একটি খুঁটি বের করে প্রথমেই চাল দিল সে। কী কান্ড! সূর্য আজ পশ্চিম দিকে উঠেছে নাকি! খুঁটিতে নম্বর উঠল সবচেয়ে কম। মোটে দুই। ভরসা পেয়ে একে একে চাল দিল বাকি দুজন। এক জনের উঠল চার। অন্য জনের একদম পাঁচ। সুতরাং হার হল ছোটবন্ধুর। অগত্যা তাকেই শহরের দিকে যেতে হল খাবার আনতে।

সে স্থান ত্যাগ করার পরে খানিক উসখুস করে বড়বন্ধু বলল, “বাপু, আসল কথাটা ভেবেছো?”

মেজোবন্ধু বুদ্ধিতে অত দড় নয়। তাই বড়বন্ধুর মোসাহেবি করেই চলে। ঢোঁক গিলে বলল, “কী?”

“বলছি মোহরগুলোর কথা। তিন ভাগ না হয়ে যদি দু’ভাগ, মানে আমি আর তুমি ভাগ করে নিই কেমন হয়?”

“সে তো খুব ভাল হয় গুরু!” উৎসাহে চকচক করে উঠল তার চোখ, “কিন্তু হতচ্ছাড়া ছোট তার ভাগ ছাড়তে চাইবে কেন?”

“যাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।” চটপট উত্তর দেয় বড়বন্ধু।

“কী করে?”

“কেন। আমরা দুজন মিলে নিকেশ করে দেব ওকে। পারবে না?”

“খুব পারব ওস্তাদ!” একগাল হেসে উত্তর দিল মেজোবন্ধু।

দু’জন অতঃপর পরামর্শ করে ফেলল। খাবার নিয়ে ফিরে এলেই দু’জন অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে ছোটর উপর। তারপর খাবার খেয়ে মোহরগুলো ভাগাভাগি করে সন্ধের পরে চুপিসাড়ে সরে পড়বে।

ওদিকে ছোটবন্ধুও বসে নেই। এসব ব্যাপারে তার মাথা বরাবই সাফ। আর সেই কারণে চৌপাটের চালে ইচ্ছে করেই হেরেছে, বোকা দুটো বুঝতেই পারেনি। তারপর মতলব এঁটে খাবার আনতে ছুটেছে শহরের দিকে। ভাগাভাগি নয়, মোহরগুলো একাই কীভাবে হাতানো যায়, সেই মতলব অনেক আগেই কেঁদে ফেলেছে সে।

শহরে এসে ছোটবন্ধু তিন জনের মতো খাবার কিনল। আর নিল তিন বোতল দামি পানীয়। তারপর ভয়ঙ্কর কড়া বিষ কিনে দুটো বোতলে সেটা মিশিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে যাত্রা করল বন্ধুদের উদ্দেশে।

গল্পের তেমন বেশি আর বাকি নেই। এরপর যা হবার তাই হল। খাবার নিয়ে ছোটবন্ধু যথাস্থানে উপস্থিত হতেই বড় দুই বন্ধুর হাতে খুন হল সে। তারপর সেই বিষ মেশানো পানীয় খেয়ে তাদেরও মৃত্যু হল। গাছতলার সেই বুড়ো কিন্তু ওদের সঠিক পথই বাতলেছিল! তাই না?

*কান্টারবেরি টেলস-এর একটি গল্পের ছায়া অবলম্বনে।

অলঙ্করণঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s