গল্প রঙ্গোর রঙ্গো মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য শরৎ ২০২০

মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের আরো গল্প  কালাচাঁদ  হাইলাকান্দির হুডিনি,  ভূত জোলাকিয়া   রংঝুরি রহস্যভয় আমাদের বিচিত্র অনুষ্ঠান, অশৈলী কান্ড জোড়াকদমে  

মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য

ফোঁস করে ইয়াব্বড় একটা শ্বাস ফেললেন সনাতন সাঁতরা। নষ্ট ডিমের কুসুম যেমন হয়, তেমন ঘোলা রংয়ের পাঞ্জাবি পরে আছেন। সাদা ধুতিটাকে লুঙ্গির মতো করে পরা। শীত পড়েছে বলে গায়ে জড়িয়ে রেখেছেন বিদঘুটে আলোয়ান। কদমছাঁট কাঁচাপাকা চুল, কুচকুচে কালো গায়ের রং। নিয়মিত ব্যায়াম করেন বলে গুলিপাকানো চেহারা। গদি দেওয়া একটা চেয়ারে বসে আছেন, তাঁর পায়ের দু’পাশে নন্দী আর ভৃঙ্গী নামে বাঘের মতো দুটো জার্মান শেফার্ড উবু হয়ে বসা। তাদের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে সনাতনকাকু বললেন, “জলপাইগুড়ি থেকে দু’পা ফেললেই অগুনতি সৌন্দর্যখনি। সেখানে অচেনা একটা পিকনিক স্পটের নাম মনে করতে পারছ না তোমরা?”

আঙুলে কড় গুনে গুনে উনিশটা জায়গার নাম বলে থেমেছি। সনাতনকাকু মুখ ব্যাজার করে মাথা নেড়ে গেছেন। অর্থাৎ নামগুলো পছন্দ হয়নি। রাসেল মাথা চুলকোচ্ছে। পিন্টু, তমাল আর বাপ্পা আমতা আমতা করছে। ভুলু আমাকে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে বলল, “কী রে চপ্পল, তোর স্টক শেষ? আরও কিছু নাম বল না!” 

আমার নাম মোটেই চপ্পল নয়, চপল। কিন্তু হতচ্ছাড়া ভুলু কিছুতেই সে নামে ডাকবে না আমাকে। হাজার বলেও কোনও লাভ হয়নি। আজ পাশের পাড়ার সঙ্গে ফ্রেন্ডলি ক্রিকেট ম্যাচ ছিল। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সনাতনকাকু জরুরি মিটিং ডেকেছেন বলে ম্যাচটা বাতিল করতে হয়েছে। সে কারণে মেজাজ এমনিতেই চটিতং হয়ে ছিল, এখন ভুলু চপ্পল বলে ডাকায় আরও রাগ হয়ে গেল। নাকমুখ কুঁচকে বললাম, “চুপ কর তো, সবসময় রঙ্গ রসিকতা ভাল লাগে না।”

আর্কিমিডিস কী একটা আবিষ্কার করে ‘‘ইউরেকা’ বলে উদ্বাহু হয়ে নাচতে নাচতে স্নানঘর থেকে মহানন্দে বেরিয়ে পড়েছিলেন। সনাতনকাক সেই ভঙ্গিতে দু’হাত তুলে চিৎকার করে উঠলেন, রঙ্গো ! পেয়ে গেছি – রঙ্গো !  

সনাতনকাকুর বেমক্কা চিৎকারে নন্দী আর ভৃঙ্গী ছিটকে সরে গেল একটু দূরে। আমরাও সচকিত হয়ে তাকালাম মানুষটার দিকে। এমনিতে সনাতনকাকু দুঁদে ব্যবসায়ী। লোকে বলে কোটি টাকার ব্যাবসা আছে কলকাতায়। কিন্তু এখন সনাতনকাকুর এই অদ্ভুত উচ্ছ্বাস দেখে খটকা লাগল। ভদ্রলোকের মাথাটাই কি গেল নাকি এই বয়সে এসে!

আমরা মুখ তাকাতাকি করছিলাম। রাসেল গলা খাঁকরে বলল, “ইয়ে মানে বলছিলাম যে, কী পেয়ে গেছেন?”

সনাতনকাকু উত্তেজনায় নিজের উরুতে চটাস করে একটা চাপড় মারলেন। শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠে বললেন, “সে কী কথা ! ডুয়ার্সের ছেলে হয়ে তোমরা রঙ্গোর নাম শোনোনি?”

ভুলু অবাক হয়ে বলল, “রঙ্গো? সেটা আবার কোন জায়গা?”

সনাতনকাকু গোঁফে তা দিয়ে বললেন, “তোমরা তো জানোই যে, আমার ছেলে সৈনিক টলিউডের এক হিরো। গতবছর ওদের ইউনিট রঙ্গো গিয়েছিল ছবির শুটিং করতে। সৈনিক খুব প্রশংসা করেছিল জায়গাটার। বলেছিল রঙ্গো হল উত্তরবঙ্গের এক লুকোনো পাহাড়ি গ্রাম। ভারতের শেষ সীমানা বলা হয় রঙ্গোকে। গোটা গ্রামটা সিনকোনা গাছে ঘেরা। পাহাড় টাহার দিয়ে দুরন্ত স্পট। বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। ভুলুর কথায় এতক্ষণে আমার রঙ্গোর কথা মনে পড়ল।”

ভুলু আমাদের দিকে তাকিয়ে গর্বিত মুখ করে একটা হাসি দিল। কেজো গলায় সনাতনকাকু বললেন, “তাহলে ওটাই ফাইনাল। পরের রবিবার আমরা ওখানেই যাব পিকনিক করতে। কতজন যাবে, কী মেনু হবে, কোন গাড়িতে চেপে যাওয়া হবে সেসব নিয়ে তোমরা নিজেরা বসে নাও একটু। হিসেব টিসেব করে কাল বিকেলে একটা বাজেট দাও আমাকে।”

কৃপণ হিসেবে সনাতন সাঁতরার নামডাক আছে। দান-ধ্যানে একটি পয়সাও তিনি খরচ করেছেন বলে শোনা যায়নি কখনও। ছাই রংয়ের দুর্গের মতো বাড়িটার উঁচু প্রাচীর ঘেরা বিশাল বাগানে দুটো বাঘের মতো কুকুর ছাড়া থাকে। তিনি আর ধনেশ্বরদা নামে বয়স্ক একজন কাজের লোক ছাড়া আর কেউ এই বাড়িতে থাকে না। প্রাসাদের মতো বাড়িটার বাইরে জেলখানার মতো লোহার গেট রয়েছে। ভিখিরি থেকে সেলসম্যান, কেউই সাহস করে সেই গেট খুলবার সাহস পায় না। আমরাও পারতপক্ষে ওই চৌহদ্দি মাড়াই না। সেই সনাতনকাকু আমাদের পিকনিকের খরচ দেবেন এটা ভাবতেই রীতিমতো অবাক লাগছে।

আমাদের খটকা দূর করে সনাতনকাকু বললেন, “গত মাসে তোমরা জ্যোৎস্নাময়ী ট্রোফি জিতেছ। তার ট্রিট হিসেবে পিকনিকের খরচ আমি দেব। ক্লাব প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমারও তো কিছু দায়িত্ব আছে ! এক কাজ করো, স্টেশনপাড়ায় চম্পু যাদবের গাড়ির ব্যবসা। দু’-চারটে বাস-টাস আছে। আমি ফোন করে নিচ্ছি। একটা ছোট বাস হলেই আমাদের সকলের হয়ে যাবে। তোমরা কাল সকালে একবার গ্যারাজে গিয়ে কথা বলে এসো চম্পুর সঙ্গে।” 

মিটিং শেষ। আমরা ফিরে আসছিলাম সনাতনকাকুর বাড়ি থেকে। ঝুপ্পুস ঝুপ্পুস সব আম, কাঁঠাল, লিচু আর চালতাগাছ রয়েছে বিরাট বাগানে। হরেক রকম রঙের রকমারি ফুলগাছও রয়েছে ভেতরে। তার মধ্যে দিয়ে চলে গেছে মোরাম বিছানো রাস্তা। যত্নের ফুল বা ফলের গাছে যাতে হাত না দিই সেটা নজরদারি করার জন্য নন্দী আর ভৃঙ্গী আমাদের গেট অবধি পৌঁছে দিয়ে গেল।

আমরা গেটের ওপাশে চলে গিয়েছিলাম। ভুলু দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ। বাঘের মতো কুকুরদুটোকে আমরা রীতিমতো ভয় পাই। সেখানে ভুলু জিভ তালুতে ঠেকিয়ে চুক চুক করে ডাকতে গিয়েছিল কুকুরদুটোকে। নন্দী ভুলুকে জরিপ করে গম্ভীর স্বরে একবার ভৌ করল। পিলে চমকানো ডাক। ফলে কাঁচুমাচু মুখে পিছু হঠল ভুলু। ফেরার সময় আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, “বুঝলি চপ্পল, ভেবে দেখলাম এসব বাঘের মতো কুকুর পোষা ঝকমারি। তার থেকে ছোটখাট দুষ্টুমিষ্টি কুকুরই ভাল।”

আমি কাঁধ থেকে ভুলুর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললাম, “আমাদের শহরে বেশ কিছু দোকানে কুকুর বিক্রি হয়। শুনেছি অনলাইনেও অনেক সাইট আছে। সেখান থেকে কেউ কেউ আনায় কুকুরছানা। তোর ইচ্ছে হলে পছন্দমতো কুকুর কিনে আন, কে বারণ করেছে।”

ভুলু পাংশুমুখে বলল, “ভালোজাতের কুকুরের অনেক দাম। তাই বাবাকে রাজি করাতে পারছি না কিছুতেই।” 

অনেকের বাড়ি থেকেই সপরিবারে বনভোজনে যাওয়া হয়। কিন্তু সে-সব চড়ুইভাতি নিরামিষ্যি গোছের। বিলিতি ছবির দৃশ্য যেমন হয়। জঙ্গল লাগোয়া কোনও নিরিবিলি নদীর ধারে ঘাসের ওপর পরিপাটি করে পাতা হয় চেককাটা নকশার চাদর। শালসেগুনের পাতা ঝরে পড়ে হাওয়ায়। ফ্লাস্কের কফি, পাঁচ থাকে টিফিন বাক্সে লুচি বা পরোটা, সঙ্গে আলুরদম আর কষা মাংস। দু’-এক হাত ব্যাডমিন্টন, রোদ আর ছায়ার জাফরিতে বসে খাওয়াদাওয়া। তার আগে মেমোরি গেম, অন্ত্যাক্ষরি, রুমালচোর। ওসবে প্রাণের আরাম কিংবা আত্মার শান্তি থাকে না, যেটা থাকে ক্লাবের পিকনিকে। পরের রবিবার রঙ্গো যাব ভেবে মনটা এখন থেকেই নাচতে শুরু করে দিল সকলের। 

পিকনিকের স্থান নির্বাচন ভাইটাল ব্যাপার। সেটা হয়ে গেছে। চাঁদা তোলার ব্যাপার নেই যেহেতু সনাতনকাকু নিজেই পুরো খরচ স্পনসর করছেন। এখন কাজ বলতে বাজার করা, রান্নার ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলা আর গাড়ি ভাড়া করা। আমরা টিম বানিয়ে সব দায়িত্ব ভাগ করে নিলাম। রান্নার ঠাকুরের সঙ্গে কথা হল। তারপর চম্পু যাদবের গ্যারাজে গিয়ে গাড়ি দেখে এলাম। বাসটা খুব নতুন না হলেও পুরনো নয়। যখন ফিরে আসব, চম্পুদা বলল, “এই বাস ডুয়ার্সের রুটে চলে। গাড়িটা চালায় বুধুয়া। ব্যাপার হল, এই তল্লাটে ওর থেকে ভাল ড্রাইভার নেই। তবে ব্যাটার একটাই দোষ। বুধুয়ার একটু আধটু নেশা করার অভ্যেস আছে। তোমরা ওকে একটু চোখে চোখে রেখো, তাহলেই হবে।” 

চম্পুদার কথাটার মধ্যে কেমন গোলমেলে গন্ধ ছিল। পাহাড় বলে কথা। একটু এদিক ওদিক হলেই মুশকিল। অতল খাদ অপেক্ষা করে থাকবে আমাদের জন্য। নেশাখোর ড্রাইভারের কৃপায় পপাত চ মমার চ হয়ে গেলেই বিপদ। কিন্তু নেশাখোর ড্রাইভার নিয়ে তেমন গা করলেন না সনাতনকাকু। আমার আশংকা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “ফুটবলে পুলিশম্যান থাকে দেখেছ? বাঘা স্ট্রাইকারের সঙ্গে একজন ফেউ লাগিয়ে দেওয়া হয় যাতে সেই স্ট্রাইকার বল ধরতে না পারে। পিকনিকের দিন ধনেশ্বরকে পোস্টিং করে দেব বুধুয়ার পিছনে। কোনও চিন্তা নেই।” 

নির্দিষ্ট দিনে সকলে জমায়েত হলাম সনাতনকাকুর বাড়ির সামনে। আমরা বাহারি সোয়েটার আর জ্যাকেট পরেছি। এদিকে সেই ঘোলা রংয়ের পাজ্ঞাবিটা আজকেও পরে আছেন সনাতনকাকু। তার ওপর কালো লেদার জ্যাকেট। সঙ্গে বেঢপ সাদা রঙের ট্রাউজার। ঠাকুর এসে গেছে তার শাগরেদ নিয়ে। বুধুয়াদাও এসে গেল সময়মতো। আমি কৌতূহলী হয়ে জিঞ্চেস করলাম, “আচ্ছা বুধুয়াদা, এই রঙ্গো জায়গাটা ঠিক কোথায়?”

বুধুয়াদা বুঝিয়ে বলল, “চালসা থেকে মেটেলি হয়ে যেতে হয় কুমাই-দলগাঁও-রঙ্গো। জনপ্রিয় টুরিস্ট-স্পট সামসিং, সুন্তালেখোলা, ঝালং, বিন্দু, ন্যাওড়া ভ্যালির ওদিকেই আছে রঙ্গো। দলগাঁও থেকে রঙ্গো মোটে সাত কিমি। এই দুটো জায়গা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। দিব্যি ভালমানুষের মতো মিহি গলায় কথা বলছিল বুধুয়াদা। পাট করে আঁচড়ানো চুল, শান্তসুবোধ চেহারা, দেখে কে বলবে যে এই লোক ঘোর নেশাখোর!

এসে গেল বুধুয়াদার ওপর নজরদারি করার দায়িত্ব যার সেই ধনেশ্বরদাও। সনাতনকাকু দুশো টাকা ধনেশ্বরদার হাতে দিয়ে দিয়েছিল। বুধুয়াদাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে টাকাটা হাতে ধরিয়ে দিল ধনেশ্বরদা। বলে দিল, “এটা প্রেসিডেন্ট সাহেব দিয়েছেন। সারাদিন কোনও উল্টো পাল্টা কাজ নয়। আমাদের জলপাইগুড়ি পৌঁছে দিয়ে নেশা করো যত খুশি, কোনও আপত্তি নেই।”

বুধুয়াদা টাকাটা সুরুৎ করে নিজের পকেটে চালান করে দিল। এক হাত লম্বা জিভ বের করে বলল, “নেশা করা ছেড়ে দিয়েছি আমি। শুধু শুধু শরীর নষ্ট। তবে টাকাটা পেয়ে ভাল হল। চাল-ডাল হয়ে যাবে কয়েক দিনের।”

গাড়ি ছাড়তে না ছাড়তেই ডিম-পাঁউরুটি-কলা দিয়ে দেওয়া হল সকলের হাতে। শুরু হল আমাদের সমবেত গলায় গান – উই শ্যাল ওভারকাম। বাস তিস্তা ব্রিজ ছাড়াতেই বুঝলাম বুধুয়াদা জাত ড্রাইভার। আঁকাবাঁকা চড়াই পথে উঠে পড়ল দিব্যি। গাড়ি চালাতে চালাতে রঙ্গো সম্বন্ধে নানারকম তথ্য জানাতে জানাতে এল। জানা গেল – সমুদ্র থেকে সাড়ে চার হাজার ফিটের থেকেও উঁচু জায়গা রঙ্গো। সিনকোনা চাষের ওপর নির্ভর করে থাকে এই গ্রামের মানুষ। ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগে এমন কিছু গাছগাছড়ার চাষও হয় এখানে। এই পাহাড়ি ছো- গ্রামে বাজার, পোস্ট অফিস ছাড়াও হাতে গোনা কিছু বাড়িঘর আছে। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ বৌদ্ধ ও হিন্দু। স্থানীয়দের মাতৃভাষা নেপালি।

দেখতে দেখতে সময় কেটে গেল। বুধুয়াদা নির্বিঘ্নে আমাদের নামিয়ে দিল স্পটে। বাস থেকে নেমে পড়লাম সকলে। পাহাড়ি নদী বয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। তার ধারে আমাদের পিকনিকের জায়গা ঠিক করা হল। রান্নার ঠাকুর আর তার সাগরেদ দায়িত্ব নিয়ে নিল রান্নার। আমরা ডেকরেটার থেকে ভাড়া করে আনা ডাবু কড়াই, নৌকো, বারকোশ, ঝাঁঝরি হাতা, খুন্তি হাতে হাতে পৌঁছে দিলাম রান্নার জায়গায়। এবার এক প্রস্থ চা। শোঁ শোঁ পাম্প স্টোভ। শিলনোড়া আর হামানদিস্তায় মশলা পেষা শুরু হল। পিন্টু একগাল হেসে বলল, “এটাই হল পিকনিকের আসল কনসার্ট।”

লুচি আর সাদা আলুর তরকারি খেয়ে নিলাম সকলে। এবার শুরু হল শতরঞ্চিতে বসে আলুর খোসা আর কড়াইশুঁটির দানা ছাড়ানো। একটুক্ষণ বাদে আমরা দু’তিনটে দলে ভাগ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম এলাকাটা রেইকি করতে। আমি, তমাল আর ভুলু একসঙ্গে হাঁটছিলাম। তমাল বলল, “কাল রাত্তিরে গুগল ঘেঁটে দেখেছি যে, এদিকে দেখার মধ্যে আছে সিনকোনা চাষের জমি, দলগাঁও ভিউ পয়েন্ট, জিরো পয়েন্ট, আর সানসেট পয়েন্ট।”

আমি বললাম, “আসার পথেই তো পড়ল রঙ্গো মনাস্ট্রি। হাঁটলে দশ মিনিট লাগবে। চল, ওটাই দেখে আসি আগে।”

একে শীতকাল, তার মধ্যে পাহাড়ি জায়গা, কনকনে হাওয়া দিচ্ছে থেকে থেকে। পা চালিয়ে হাঁটছিলাম আমরা। আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ে ভুলু বলল, “চপ্পল, তুই তো জানিস আমার ফ্যারেঞ্জাইটিসের ধাত। আমি মাংকি ক্যাপটা বাসে রেখে এসেছি। ভেবেছিলাম লাগবে না। এখন দেখছি ঠান্ডাটা জাঁকিয়েই পড়েছে। তোরা দাঁড়া, আমি বাস থেকে টুপিটা নিয়ে আসি।”

গাছগাছালির ওদিকে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাসটা। পঞ্চাশ মিটারের বেশি দূর নয়। আমি ব্যাজার মুখে বললাম, “তাড়াতাড়ি যা, দেরি করিস না।”

আধঘন্টা হয়ে গেল, ভুলু আর ফেরে না। এদিকে ওদিকটা থেকে কেমন তর্কাতর্কির শব্দ ভেসে আসছে মনে হল। তমাল চিন্তিত গলায় বলল, “কী হল! ভুলু এখনও ফিরছে না কেন? চল তো দেখে আসি একবার।”

গিয়ে দেখি ভুলুকে ঘিরে রেখেছে জনা দশেক স্থানীয় ছেলেছোকরা। তারা আঙুল উঁচিয়ে শাসাচ্ছে ভুলুকে। কাঁচুমাচু মুখ করে ভুলু আত্মপক্ষ সমর্থন করার চেষ্টা করছে। আমাদের দেখে যেন ডুবে যেতে যেতে খড়কুটো পেল বেচারি। ভুলুর মুখে শুনলাম গোটা বেত্তান্ত। বাঁদুরে টুপিটা আনতে বাসের দিকে ভুলু হেঁটে ফিরছিল। তাকিয়ে দেখে একটা ফুটফুটে সাদা ঝুপ্পুস লোমওয়ালা কুকুরছানা বাসের একেবারে পেছনের সিটে দাঁড়িয়ে ভুলুকে দেখে ল্যাজ নাড়ছে আর আহ্লাদে কুঁই কুঁই করছে।

আশেপাশে কেউ নেই। আর কি লোভ সামলানো যায়? ছানাটাকে টুক করে তুলে নিয়েছিল ভুলু। নিজের কিটব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে শ্বাস নেওয়ার জন্য একটু জায়গা খুলে রেখে বাস থেকে নেমেছিল। আর তখনই চক্ষু চরকগাছ। স্থানীয় ছেলেছোকরার দল ঘিরে ধরেছে তাকে। পুকুরচুরি হয়, তা বলে কুকুরচুরি? হয় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে নয় থানায় যেতে হবে।

আমি আর তমাল ভুলুর হয়ে ওকালতি শুরু করলাম। বিস্তর বাগবিতন্ডার পর পাঁচশো টাকায় রফা হল। ভুলুর কাছে অত টাকা ছিল না। আমি আর তমাল ধার দিলাম কিছু। শেষ অবধি পাঁচশোটি গাঁটের কড়ি খসিয়ে ভুলু মুক্তি পেল। ফুটফুটে কুকুরছানাটাকে কোলে নিয়ে শিস দিতে দিতে ফিরে গেল ছেলেগুলি। ভুলু সেদিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বলল, আজ কার মুখ দেখে যে বেরিয়ে ছিলাম কে জানে ! 

রঙ্গো মনাস্ট্রি দেখতে গেলাম আমরা। ভুলু আমাদের সঙ্গে ধীর পায়ে হাঁটছিল নিমতেতো মুখ করে। একটা পান-সিগারেটের দোকান ছিল পথের ধারে। প্রৌঢ় দোকানি ইশারায় ডাকলেন আমাদের। তিনি দেখেছেন সব। তিনিই ফাঁস করলেন ব্যাপারটা। আগেও নাকি এমন বেকুব বহু পাবলিক হয়েছে। কুকুরছানাটা এদের মধ্যে একজনের। পিকনিক পার্টি দেখলে কুকুটাকে ছেড়ে দিয়ে আড়াল থেকে বাজপাখির দৃষ্টিতে নজর রাখে ওরা। ভুলুর মতো কারও প্রাণে পুলক উথলে উঠলে তখন তাকে চেপে ধরে। এভাবেই তাদের পিকনিকের রেস্ত উঠে যায়।

মনখারাপ করে আমরা ফিরে এসেছি পিকনিক স্পটে। সনাতনকাকু বকাবকি করলেন একটু। ভুলুর ঘটনাটার কথা বললে বকুনি খেতে হবে, তাই চেপে গেলাম। এদিকে ততক্ষণে হালকা হাওয়ায় উড়ে যেতে শুরু করেছে তেজপাতা ফোড়নের গন্ধ, মাংসের ঝোলের সুবাস। রান্না শেষ হওয়ার পর খবরের কাগজ পেতে দেওয়া হল মাটিতে। মাটির খুরি, লেবু, নুন। কলাপাতায় পরপর পড়তে লাগল ভাত-ডাল-বেগুনি, মাটন, চাটনি। পাঁপড়টা অবশ্য তাড়াহুড়োতে আধভাজা। এ ছাড়াও পাতে আছে দুটো অতিরিক্ত পদ। মিঠে রোদ্দুর আর মিহি ধুলো।

খাওয়া দাওয়া শেষে ঝোরার জলে হাত আঁচিয়ে এসে সকলের টনক নড়ল। বুধুয়াদা কোথায়! অনুসন্ধান করে দেখা গেল বুধুয়াদা যে মিস্টার ইন্ডিয়ার মতো একা গায়েব হয়েছে তা নয়, তার ওপর যাকে নজর রাখতে বলা হয়েছিল সেই ধনেশ্বরদা সুদ্ধু ভ্যানিশ।

 খোঁজ খোঁজ খোঁজ। অবশেষে ঘন্টাখানেক বাদে বিকেল যখন ফুরিয়ে আসছে তখন টাল খেতে খেতে হাজির দুই মূর্তি। ধনেশ্বরদা সোয়েটার পরে নদীতে স্নান করে এসেছে। মাথা অবধি জলে চুপচুপে ভেজা। বুধুয়াদা খালি গা, পরনে শুধু জাঙিয়া পরা। ধনেশ্বরদাকে চেপে ধরতেই সে ফাঁস করল ঘটনাটা। অন ডিউটি পুলিশম্যানকে হাঁড়িয়ার মতো দিশি মদের টোপ দিয়ে কাবু করে ফেলেছে বুধুয়াদা। দুজনেই পাশের গ্রাম চলে গিয়েছিল। সেখানে কোন ডেরায় গিয়ে সনাতনকাকুর দেওয়া টাকা দিয়ে দু’জনে গলা অবধি হাঁড়িয়া টেনে এসেছে।

সনাতনকাকু দু’জনকে এই মারেন কি সেই মারেন। বিস্তর বকাবকি তো চললই। এদিকে সন্ধে হয়ে আসছে। আমাদের সকলের মুখ শুকিয়ে আমসি। আমরা তো কেউ বাস চালাতে পারি না, ফিরব কী করে! বুধুয়াদা দাঁড়াতে পারছে না নেশার ঘোরে। তার মধ্যেও লজ্জাবোধ আছে দেখছি। কান-টান চুলকে বলল, “টেনশনের কিছু নেই। আমাকে শুধু স্টিয়ারিংয়ে বসিয়ে দিন। আমি ঠিক চালিয়ে নিয়ে যাব।”

ধনেশ্বরদার সঙ্গে বুধুয়াদার আজই পরিচয় হয়েছে। এক বেলাতেই দু’জনের দোস্তি শোলে ছবির জয় আর বীরুর মতো হয়ে গেছে। ধনেশ্বরদা টাল খেতে খেতে নিজের সোয়েটার আর ফুলপ্যান্ট দলা পাকিয়ে রেখে এল বাসের শেষ সিটের নিচে। তারপর বন্ধুর হয়ে সালিশি করে বলল, “বুধুয়াদার মতো এত ভাল ডেরাইভার দুনিয়াতে আর লাই। ও ঠিক আমাদের জলপাইগুড়ি লিয়ে যাবে।”

মুখ তাকাতাকি করছিলাম আমরা। রাসেল, পিন্টু, তমালরা কয়েকজন মিলে বুধুয়াদাকে টেনেটুনে বসিয়ে দিল স্টিয়ারিংয়ে। সে কী সিন! এই প্রবল শীতের মধ্যে একেবারে খালি গা, পরনে শুধু জাঙিয়া, স্টিয়ারিংয়ের সামনে রাখা ঠাকুরের ছবিতে পেন্নাম ঠুকে গাড়ি স্টার্ট দিল বুধুয়াদা। ঝুঁকে পড়ে উইন্ডস্ক্রিনের কাচে মাথা লাগিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করল। এবং কী আশ্চর্য, কুয়াশামাখা অন্ধকার পাহাড়ি পাকদন্ডি পথে একবারও না থেমে বাসটাকে দিব্যি জলপাইগুড়ি অবধি চালিয়ে নিয়ে এল লোকটা।

আমরা বাস থেকে নেমে পড়লাম এক এক করে। বুধুয়াদার নেশা কাটেনি পুরোপুরি। এখনও কী একটা হিন্দি গান গাইছে গুনগুন করে আর হাসছে আপনমনে। তবে হুঁশ ফিরে এসেছে ধনেশ্বরদার। দলা পাকানো সোয়েটার আর প্যান্ট কুড়িয়ে নিয়ে আনতে গেল বাসের শেষ সিট থেকে। আর তখনই রাম চিৎকার ! আমরা যেতে যেতে ফিরে দাঁড়ালাম। ধনেশ্বরদা দেখি নামছে বাসের দরজা দিয়ে। বত্রিশটা দাঁত বেরিয়ে আছে। হাতে সকালের সেই ভুটানি কুকুরছানাটা। কুকুরটা যে আমাদের অজান্তে কখন বাসে উঠে পড়েছে আর শেষ সিটের নিচে ঘুমোতে ঘুমোতে জলপাইগুড়ি অবধি চলে এসেছে সেটা বুঝতেই পারিনি আমরা।

কালো পুঁতির মতো চোখ পশমি সাদা লোমে ঢাকা। কুকুরটা পরমানন্দে কুঁইকুঁই করে আহ্লাদ প্রকাশ করছে আমাদের দেখে। ভুলু এক দৌড়ে ধনেশ্বরদার হাত থেকে কুকুরছানাটাকে নিজের কোলে নিয়ে নিল। লাল টুকটুকে জিভ বের করে কুকুরটা গাল চাটছে ভুলুর। আমার দিকে তাকিয়ে বিশ্বজয়ের হাসি হেসে ভুলু বলল, “বুঝলি চপ্পল, আম আর ছালা দুটোই যায়নি তাহলে। পাঁচশো টাকা গচ্চা গেছে যাক, তার বদলে এই চিনির তালটাকে তো পেলাম ! এর কী নাম দেওয়া যায় বল তো? ”

এগিয়ে গিয়ে দুষ্টুমিষ্টি কুকুরছানাটাকে চটকে নিলাম একটু। একগাল হেসে বললাম, “রঙ্গো থেকে পাওয়া তাই এর নাম দে রঙ্গো!”

জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস

4 thoughts on “গল্প রঙ্গোর রঙ্গো মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য শরৎ ২০২০

  1. যাক, অবশেষে রঙ্গো’তে রঙ্গও হল, রঙ্গোও পাওয়া হল। কী মজা !

    Like

  2. আপনার লেখা বরাবরি আমায় টানে। ভীষণ উপভোগ করলাম গল্পটা।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s