গল্প সাগরে মিলায়ে যায় দোলা সেন বর্ষা ২০১৯

দোলা সেন

 

“অনেক অনেক দিন আগেকার কথা। তা প্রায় দু’শো বছর ধর। তবে অত হিসেব আজকাল মাথায় থাকে না। ঐ আরও দু’শো বছর যোগ বিয়োগ করে নে বরং।”

এই মুস্কিল বুড়ি জিলকে নিয়ে। ঝুলিতে ওর অনেক গল্প থাকে ঠিকই, কিন্তু বাকি খেয়াল টনটনে থাকলেও জায়গা আর সময় বড্ড গুলিয়ে ফেলে বেচারি। তা ফেলুক গে, আমার থোড়াই ইতিহাস পরীক্ষা দেবার আছে? আমি তো আসি জিলদিদার কুকি আর গল্পের টানে।

আমাদের বাড়ির পরে আরো তিনটে বাড়ি। তারপরে রাস্তা আর একটু বালুচর পেরিয়ে মন্ট্রের সমুদ্রের ধারে গজিয়ে ওঠা এই ছোট্ট টিলাটায় উঠে পড়লেই জিলদিদার বাড়ির দরজায় পৌঁছে যাওয়া যায়। এই সন্ধ্যায় এখন বাড়ির সামনের উঠোনটায় বেশ কয়েকটা সীগাল ডানা মুড়ে ঘুমের জোগাড় করছে। সামুদ্রিক শ্যাওলার গন্ধ,সীগালের তীক্ষ্ণ ডাক, টিলার পাথরে আছড়ে পড়া জলের আওয়াজ সব মিলিয়ে জিলদিদার বাড়িটা আমার কেমন যেন রহস্যময় লাগে। সবচাইতে রহস্যময় এই পাখিগুলো। ওরা রোজ দিদাকে কিছু মাছ এনে দেবেই দেবে।এই এলাকায় আর কাউকে ওদের মাছ দিতে দেখিনি কিন্তু। দিদাকে জিজ্ঞাসা করলে বুড়ি মিটিমিটি হাসে আর বলে, – বলবো, বলবো। তোকেই সব বলবো একদিন। কিন্তু ততদিন যেন তুই এসব কথা কাউকে বলিস না।

বলতে আমার ভারি বয়েই গেছে। এমনিতেই দিদার বাড়ি কেউ বিশেষ আসে না। কে জানে, এসব বললে আমার বাবা-মাও হয়তো আসতে বারণ করে দেবে! একলা বাড়িতে এক আমাকেই সঙ্গী পায় দিদা। তাই আমি এলে কুকি আর গল্পের ফোয়ারা ছোটায়।

কিন্তু ক’দিন ধরেই দিদার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। বেশিরভাগ সময়টাই দেখছি শুয়ে কাটাচ্ছে। সীগালগুলো সারাদিন কেউ না কেউ থাকছেই বুড়ির পাহারায়। বুড়ির সঙ্গে ওদের কিসের সম্পর্ক কে জানে! আজ তো আবার জলে অন্যরকম আওয়াজ পেতে, উঁকি মেরে দেখি টিলার ঠিক নীচে জলে খেলা করছে দুটো ডলফিন! সমুদ্রের ভিতর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা যে রকটাকে সবাই বার্ডস রক বলে, সেখানে অনেক সীলমাছের আনাগোনা থাকলেও ডলফিন খুব একটা দেখা যায় না। দৌড়ে গিয়ে দিদাকে খবরটা দিতেই এক বিচিত্র হাসিতে ভরে গেল নানা ভাঁজে ভরে যাওয়া তোবড়া মুখখানা। বলল – আয়, আজ তোকে শোনাবো সেই গল্প – যা এতদিন কাউকে শোনানো হয়নি। শুধু একটাই শর্ত, এ গল্প তুই কাউকে বলবি না।

এই ভূমিকা করে জিলদিদা শুরু করল তার সেই একশ’ দু’শো নাকি পাঁচশো বছরের পুরোনো কাহিনী :

***

সেই অনেক দিন আগে চীনদেশের চি-ফাউ নামে এক জায়গা ছিল। সমুদ্রের ধারের এই জনপদে জেলে আর নাবিকদেরই ভিড় বেশি। তা সেইখানেরই এক নাবিক ছিল জো। সে জাহাজ চালাতে তো পারতই, তার সঙ্গে তার হাতের কাজও ছিল দেখবার মতো। তার হাতের তৈরি গয়না না পরলে ওখানকার মেয়েরা নাকি বিয়েই করতে চাইত না!

দিব্বি ছিল নিজের গাঁয়ে, কিন্তু জল যার নেশা, সে কী আর বেশিদিন ডাঙায় থাকতে পারে? তাই একদিন পোঁটলা পুটলি বেঁধে এক বণিকের জাহাজে উঠে পড়ল জাহাজী হিসেবে। মাকে বললে, – তিনমাস পরে ফিরবো গো, অনেক টাকা নিয়ে। আমাদের আর দুঃখকষ্ট থাকবে না।

তরতরিয়ে জাহাজ গিয়ে ভিড়ল জাপানের হাকাতা বন্দরে। সেখানে জাহাজের মালিক কী কেনাবেচা করল, তা সেই জানে; জো সেই ফাঁকে নীল জল আর সবুজ গাছগাছালিতে ঢাকা সুন্দর বন্দর শহরটি মন ভরে ঘুরে নিল। এবার নাকি তার যাবে আরও পশ্চিমে হাকোদেত বন্দরে। নিজের মনেই ফিক করে হেসে ফেলে জো, জাপানের সব বন্দরই কি হাকাহাকি করে নাকি?বুড়ো মাঝি শুনে বকা দেয়- কারো নাম নিয়ে হাসাহাসি করতে নেই না?

এখানে কিন্তু দেরি করা যাবে না। দরকারি তেল, জল, খাবার সব নিয়ে ঝটপট পৌঁছাতে হবে আদক বন্দরে। আরও অনেক পশ্চিমে সে এক বরফের দেশ! এই গরমের দুটো মাস ছাড়া বাকি সময় বরফেই ঢাকা থাকে সমস্ত মাটি। সেখানে থাকে বিরাট বিরাট ক্যারিবু হরিণ। তাদের মস্তো বড়ো শিং। তার নাকি অনেক দাম। হরিণের মাংস, চমৎকার সব জন্তু জানোয়ারদের চামড়া – জাহাজের সবার চোখ চকচক করে। অনেক, অনেক পয়সার কারবার। শুধু জোয়েরই মনটা খারাপ হয়ে যায়। চুপিচুপি লুকিয়ে লুকিয়ে সে রোজ প্রার্থনা করে, হরিণগুলো যেন চলে যায় বরফ রাজ্যের আরও গহীনে। লোভি মানুষেরা যেন কিছুতেই ওদের খুঁজে না পায়।

আদক এলো। জোয়ের প্রার্থনা মিথ্যে করে জাহাজ বোঝাই হলো পণ্যে। এবার  আরও একটু পশ্চিমের এক বন্দর থেকে তেল কিনলেই এবারের মতো কাজ শেষ। তারপর ঘরে ফেরার পালা। জোয়ের আর কিছু ভালো লাগছে না। ফিরতে পারলে বাঁচে। এমন সময়ে একদিন হঠাৎ সারা আকাশ জুড়ে কুয়াশা নেমে এলো। এই অঞ্চলে এমন কুয়াশা মাঝে মাঝেই নামে, কিন্তু অভিজ্ঞ মাঝিবুড়োর চোখে আজ ভ্রুকুটি। ওই কোণার কালো মেঘটা নাকি তার ভালো ঠেকছে না। দেখতে দেখতে তার আশঙ্কা সত্যি করে সারা আকাশ ছেয়ে গেল কালো মেঘে। তুমুল বৃষ্টির সঙ্গে ধেয়ে এল ভয়ংকর সামুদ্রিক ঝড়। ফুঁসে উঠল সাগর, গর্জে উঠলো হাওয়ার দানব। খোলামকুচির মতো উড়িয়ে নিয়ে চলল জাহাজখানাকে। সেই যে – অনেক দিন নাকি অল্প দিন. অনেক পথ নাকি অল্প পথ – সব হিসেব তালগোল পাকিয়ে সেই ঝড় একসময় একলা জোকে আছড়ে এনে ফেলল এক বালুকাবেলায়। সেই নির্জন সৈকতে কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, জানে না জো। জ্ঞান যখন হল, তখন সে দেখে তার মাথার উপর ঝকঝকে আকাশ, পিঠের তলায় সাদা বালি, পাশে শান্ত ঘননীল সমুদ্র, আর এই বালির চড়ার অপর পারে ঘন সবুজ বন।

জো এদিক ওদিক তাকাল। জনপ্রাণী চোখে পড়ল না। গাছগুলোকে অচেনা লাগায় বুঝল তার চেনা দুনিয়া থেকে সে অনেকটাই দূরে চলে এসেছে। যাক গে, এসে যখন পড়েছে, তখন বেঁচেবর্তে থাকলে একদিন নিশ্চয়ই নিজের দেশে ফিরে যেতে পারবে।

গোল বাধল ঐ বেঁচেবর্তে থাকার কথাটায়। বাঁচতে হলে খেতে হবে। আর সারা গায়ে অসহ্য যন্ত্রণা সত্ত্বেও পেটের মধ্যে যে তোলপাড়টা চলছে, তার নাম খিদে ছাড়া আর কিছু নয়।

কিন্তু খাবে কী? আসেপাশে তো কোন বসতিও দেখা যাচ্ছে না। তীরে পড়ে থাকা শামুকগুলোই ভরসা এখন। চকমকি পাথর ঘসে আগুন জ্বালাল। ঝলসানো শামুক খেতে খুব একটা মন্দ লাগল না তার। একটু খুঁজতেই বনের মধ্যে একটা মিস্টি জলের ডোবাও পেয়ে গেল কপালজোরে। শরীরে আর দিচ্ছিল না। একটা টিলার উপর কতগুলো সাদা পাখি রাতের ঘুমের তোড়জোড় করছে দেখে সেও তাদের পাশে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন শরীরটা চাঙ্গা হতে চারপাশটা আর একটু ভালো করে দেখল। প্রথম দর্শনে যতটা জনমানবহীন মনে হয়েছিল, জায়গাটা সেরকম নয়। একটু দূর দিয়ে একটা রাস্তা দেখা গেল। একটা গ্রামের মতো বসতিও চোখে পড়ল। খুশি হয়ে সেদিকেই চলল জো, কিন্তু তার চেহারা, ভাষা ওখানকার লোকেদের কাছে এতটাই অন্যরকম যে তারা তাকে দেখে কেমন যেন ভয় পেল। কিছুতেই তাদের সঙ্গে থাকতে দিল না। ভাগ্যিস এত বিপদেও তার কোমরে বাঁধা বেল্টটা ভেসে যায় নি! সেখান থেকে কিছু রূপোর মুদ্রা বের করে, সে কোনরকমে কিছু দরকারি জিনিস কিনে সেই টিলার কাছেই ফিরে এল।

কি আর করে বেচারি। জলে ভেসে আসা কাঠের টুকরো দিয়ে লতায় বেঁধে কোনরকমে একটা বাড়ি বানিয়ে ফেলল ক’দিনের চেষ্টায়। খাবার বলতে পাখির মাংস, মাছ আর বনের ফল। তবে কিছুদিনের মধ্যেই দেখল কিছু লোকজন মাঝে মাঝে এখানে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে আসে। তারা আসে, সমুদ্রের ধারে সারাদিন কাটায়, খাওয় দাওয়া করে, আবার সন্ধ্যা হলে ফিরে যায় নিজেদের বাড়ি।

জো করল কী, সমুদ্রের ঝিনুক, গাছের শুকনো ফল – আরও কী কী সব দিয়ে বানিয়ে ফেলল সুন্দর সুন্দর গয়না, ঘর সাজাবার জিনিস। ব্যস, সাজিয়ে ফেলল দোকান। পাশে বসে বাঁশিতে তুলল অচিন সুর। বেড়াতে আসা লোকজনেরা প্রথমে অবাক হয়ে বাজনা শুনল, তারপর কাছে এল। সাজিয়ে রাখা গয়নাগুলো দেখে তাদের ভারি পছন্দও হয়ে গেল। তারপর সব কিনে নিয়ে চলে গেল। সেই পয়সা দিয়ে শহর থেকে আরও অন্য জিনিস কিনে আনল জো। বানিয়ে ফেললো আরও অনেক সুন্দর সুন্দর গয়না। শেষে তো এমন অবস্থা হল যে লোকজনেরা শুধু সমুদ্র দেখতে নয়, জোয়ের তৈরি গয়না কিনতেও আসত।

ওই যে বার্ডস রক! সেখানে সন্ধ্যা নামলেই দলে দলে সীগাল,সামুদ্রিক হাঁস, আরও অনেক নাম না জানা পাখির দল ডানা মুড়ে বিশ্রাম নেয় রাতের মতো। প্রায় ঢেকেই ফেলে পুরো টিলাটাকে। তাদের মলে ভরে যায় সেখানে জলও। আর তাতেই মাছের দলের মহা ফুর্তি। দলে দলে আসে তারা। একজায়গায় কত্তো খাবার! তবে শুধু তো তারাই আসে না। ফুড চেন সম্পূর্ণ করতে সীল মাছেরাও ভিড় জমায় বৈকি! জলের উপর ডিগবাজি খেয়ে তারা মাছ ধরে। কখনো সখনো ডলফিনেরাও টহল দিয়ে যায় এই এলাকায়। অন্তত জো এমনটাই জানত। এমনটাই দেখেছিল।

যেটা জানত না, সেটা হলো, ডলফিনের দলও তাকে দেখেছিল। আর তার বিচিত্র জিনিস বেচার কাজও দেখেছিল। অবাক হয়ে শুনেছিল তার বাজানো বাঁশির সুর। জলের তলে গেল যখন, তখন তারা জলের তলের রাজকন্যাকে শোনাল এই কাহিনী। কৌতূহল হল কন্যার। একদিন সে করল কি, চুপি চুপি, মা-বাবা কারুক্কে কিছু না বলে, ডলফিনের পিঠে চড়ে দেখতে এল ব্যাপারটা কি? জো তো ভারি অবাক! এমনও হয় বুঝি? যাই হোক সে ভারি ব্যস্ত হয়ে কন্যাকে এই গয়না দেখায়, ওই গয়না দেখায়। যতই দেখে কন্যে, ততই তার আগ্রহ যায় বেড়ে। এটা দেখে, ওটা দেখে। দেখতে, দেখতে, দেখতে…

–আরে ওই তালা দেওয়া সুন্দর বাক্সটায় কি আছে দেখালে না তো?

–হুকুম হলে দেখাতে পারি রাজকুমারী, কিন্তু ও গয়না বেচবার জন্য নয়। যদি কিনতে না চান, তাহলেই…

–তা হোক, আমি দেখতে চাই, কিনবো না।

বাক্স খুলে দেখল কন্যা। যতই দেখে, চোখ আর ফেরে না। ভুলে গেল নিজের শপথ। এগুলো তার চাইই চাই।

জো কিন্তু মাথা নাড়ে – এ গয়না আমি আমার বৌয়ের জন্য বানিয়েছি। এ  আমি অন্য কাউকে দিতে পারব না।

অনেক ধন দিতে চাইল সেই কন্যা. অনেক বর দিতে চাইল। কিন্তু জোয়ের সেই এক রা। রেগেমেগে হতাশ হয়ে ফিরে গেল জলকুমারী।

 

ফিরে তো গেল। কিন্তু গয়নাগুলোর কথা আর কিছুতেই ভুলতে পারল না। সাতদিন সাতরাত অনেক ভাবল জলকুমারী। তারপর আবার হাজির হল জোয়ের বাড়ি।

–তোমাকেই বিয়ে করব হে গুণী শিল্পী। আমার সঙ্গে জলতলের সাতরঙা প্রাসাদে চল। সুখে স্বচ্ছন্দে থাকব দুজনে।

এতেও রাজি হলো না জো।

–এই আলো ঝলমলে আকাশ, নিজের হাতে গড়া আমার এই ছোট্ট কুঁড়ে, এই দোকান – আমার পরিশ্রমের আমার স্বপ্নের ফসল। আমার সঙ্গে এসব যদি ভাগ করে নিতে পারো রাজকুমারী, তাহলেই এসো। এদের ছেড়ে সাতরঙা প্রাসাদে বন্দী হয়ে গেলে আমার জীবনের সুর হারিয়ে যাবে। আমি আর কিছু গড়তেই পারব না। বাঁশি বাজাতেও নয়।

কী আর করে মেয়ে! রাজি হয়ে গেল।সমুদ্দুরের রাজা রানী একটু রাগ করলেন বটে, কিন্তু মেয়ের বিয়েতে বাধাও দিলেন না। জলের মাছ, আকাশের পাখিরা নানা দেশ বিদেশ থেকে বিচিত্র সব উপহার এনে হাজির করল। তাদের সঙ্গে জো আর জলকন্যা দুজনেরই খুব ভাব যে। সেই সব জিনিস দিয়ে ওরা দুজনে যখন সেই কাঠের বাড়িটি সাজিয়ে ফেলল, তখন তার থেকে আর কেউ চোখ ফেরাতে পারল না। আর সেই উপহার থেকে সবচেয়ে সুন্দর মুক্তোটা নিয়ে জো তার নতুন বৌকে একটা হার গড়িয়ে দিল।

সুখে স্বচ্ছন্দে দিন কাটতে থাকল ওদের। সময় কালে ওদের একটি ছেলেও হল। সেও বড় হল। তার আরও অনেক দিন পরে জো আর রাজকন্যা একদিন হাত ধরাধরি করে সমুদ্রে তলে ঘন সবুজ শ্যাওলার বিছানায় শুয়ে ঘুমোতে চলে গেল।

সেই ছেলে জিলের বুড়ো ঠাকুরদাদা। আর এখন জিল তো নিজেই বুড়ো হয়ে গেছে। এবার সেও চলে যাবে সমুদ্রের রাজার শ্যাওলার বিছানায় ঘুমোতে। আজ ডলফিনেরা সেই খবরই বয়ে এনেছে।

জিলদিদার হাসিমুখ দেখে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে থাকি।

—সত্যি বলছ? নাকি তুমি বানিয়ে বানিয়ে আমায় ভয় দেখাচ্ছ?

–কালকে এসেই দেখিস। তবে এসব বড় গোপন কথা। কাউকে বলবি না – কথা দে।

–তাহলে আমাকে বললে যে?

–আমার তো আর ছেলেমেয়ে নেই। সারা দুনিয়ায় একমাত্র তুইই আসিস, আমার খোঁজখবর নিস। তাই তোকে বললাম। কাল আসবি কিন্তু ঠিক!

পরদিন। সকাল হতেই দৌড়ে গেলাম জিলদিদার বাড়ি। মা বকছিল বটে, তবে তাতে কান দেবার সময় এখন নয়। ঘরটায় ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কালকেও তো দিদা শুয়েছিল খাটটায়! আজ টানটান করে বিছানা পাতা। খালি খাট। না, একেবারে খালি নয়। খাটের উপরে একটা ছোট বাক্স। কাঁপা হাতে বাক্সটা খুললাম। ঝিকমিকিয়ে উঠল একটা অপূর্ব সুন্দর হার। তার লকেটে একটা বিরাট নীলাভ মুক্তো!

দিদা আমায় মিথ্যে বলেনি তাহলে! বাক্সটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসতেই সীগালগুলো তাদের ডানা ঝটপটিয়ে অনেক দূরে উড়ে গেল। কাল থেকে ওরা আর আসবে না। খুব কান্না পাচ্ছে আমার।  বাক্সটা হাতে করে সমুদ্রের ধারে একটা নির্জন পাথরের আড়ালে বসলাম। অঝোর ধারায় আমার চোখের  জল সাগরের জলে মিশতে থাকল।

কিন্তু কাল দিদা কী যেন বলছিল? এ কথা কাউকে বলার নয়! কিন্তু এই হারটা? বাড়ি নিয়ে গেলেই তো মা জিজ্ঞাসা করবে। কোথায় লুকোবো একে? আর মার মুখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে কথা বলতে শিখিনি এখনোও!  কী করি এখন?

জোয়ার আসছে। ঢেউয়ের মাথায় রোদ্দুর পড়ে হীরের মতো আলোর ফুলকিরা জ্বলছে। টুকটুক করে পায়ের পাতায় টোকা দিচ্ছে জল। উঠে দাঁড়ালাম। দিদার দেওয়া হারটা চোখে, ঠোঁটে ছুঁইয়ে খুব যত্ন করে গলায় পরলাম। পাশের জমে থাকা জলের ডোবাটায় মুখ দেখলাম অনেকক্ষণ ধরে।

তারপর আস্তে করে খুলে নিয়ে আবার বাক্সে ভরলাম। এবার একটু সমুদ্রের ভিতর দিকে এগিয়ে যাবার পালা। ধীরে ধীরে বাক্সটা জলে ভাসিয়ে দিয়ে বললাম – তুমি দিদার কাছে ফিরে যাও। তোমার ছোঁয়াটুকু আমার সঙ্গে রইল।

একটা ডলফিন তিরবেগে ধেয়ে এল। কোথা থেকে কে জানে! মুখে করে বাক্সটা নিয়ে ফিরে গেল গভীর সমুদ্রে। যেতে যেতে হঠাৎ ফিরে তাকাল। জল ছেড়ে লাফিয়ে উঠে ডানায় ডানা ছুঁইয়ে তালি দিল। দিতেই থাকল।

আমি পিছন ফিরে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগালাম।

অলঙ্করণঃ মৌসুমী

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s