গল্প সেই চেয়ারটা অনিন্দিতা নাথ বর্ষা ২০১৯

সেই চেয়ারটা

অনিন্দিতা নাথ

পৃথিবীতে এমন অনেক জিনিস আছে, যার সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। অনেক কিছু আছে যা মানুষ কোনদিন দেখেনি, কিন্তু বিশ্বাস করে। আবার অনেক কিছু এমন আছে যা মানুষ দেখেছে কিন্তু তবুও বিশ্বাস করে না। এই দুটোরই একটা উৎকৃষ্টতম উদাহরণ হল অলৌকিক ঘটনা। আজ আমি আপনাদের শোনাব আমার নিজের জীবনের এক অলৌকিক ঘটনা।

গত বছর পুজোর ঠিক আগে আগেই একদিন সকালে সবে স্নান করে রেডি হচ্ছি অফিসে যাবার জন্য ঠিক সেই সময় ফোনটা বেজে উঠল। ফোনের অপরপ্রান্তে আমার ছোট বেলার এক বন্ধু রাজীব। স্কুল ছাড়ার পর আর কোনো ভাবেই যোগাযোগ ছিল না। খুব খুশি হলাম ওর গলা শুনে। হঠাৎ রাজীব আমাকে ওদের বাড়ি সিতখালি আসতে আমন্ত্রণ করে। সামনে পুজো, টানা দশ বারো দিন ছুটি থাকবে আর সে-সময় কলকাতায় এত হৈ হৈ, বড় বিরক্ত লাগে। তাই কথা দিলাম পুজোর ছুটিতে ওদের ওখানে যাব।

নির্দিষ্ট দিনে শিয়ালদহ থেকে ট্রেন নিলাম বনগাঁ লোকাল। ভয়ানক ভিড়, আমি ম্যানেজ করে একটা সিট পেয়েছি, যেহেতু শেষ স্টেশনে নামব তাই চিন্তা নেই। কানে হেড ফোন খুঁজে চোখ বুজলাম। ঘন্টাদুয়েক কোথা থেকে কেটে গেল কে জানে। বনগাঁ স্টেশনে নেমে ভ্যানে উঠে পড়লাম বাগদা ছাড়িয়ে ওদের গ্রাম সিতখালি।

রাজীব ছোট থেকেই মামা বাড়িতে মানুষ। ওর মা চলে যাবার পর বাবা যখন দ্বিতীয় বিবাহ করলেন তখন ওর বয়স তিন কি চার। সেই থেকেই দাদুর কাছে, সৎ মায়ের কাছে দাদুই পাঠাননি মামা মামীর সংসারে থাকলেও দাদুর পৃষ্ঠপোষকতায় রাজীব আদরেই বড় হয়েছে।

ভ্যান রিক্সা নিজের গতিতে দুলকি চালে মেঠো পথ ধরে চলেছে। সিতখালী গ্রামটা , বাংলাদেশ বর্ডারের কাছে। রাজীবদের বাড়িতে দুই মামা, মামী, তাদের মেয়েরা চাকরবাকর নিয়ে গোটা বারো জনের পরিবার। আমার ছোটবেলাটা এই গ্রামেই কাটে, তারপর বাবার পোস্টিং কলকাতায় হয়, আমরাও কলকাতা চলে আসি। সেই থেকে রাজীবের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন। আজ আবার এত বছর পর পুরোনো জায়গায় ফিরে এসে খুব ভালো লাগছে।

সিতখালি গ্রামটা বড্ড বেশি পুরোনো সময়কে আঁকড়ে রয়েছে। এই ২০১৮ সালেও ওখানে গরুর গাড়ি, ইছামতি নদীতে নৌকো সবুজ ধান খেত, আল বাঁধানো ধানী জমি, পুকুর ভর্তি মাছ সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে পূর্ববঙ্গের একটুকরো অংশ দেশভাগের ফলে এদেশে পড়ে আছে। সেই গ্রামের এক মাত্র ডাক্তার ছিলেন রাজীবের দাদু শঙ্কর চ্যাটার্জি। ওর দাদুরা বংশ পরম্পরায় ডাক্তারি করেছেন।

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, প্রায় ঘন্টাখানেক পর রাজীবদের গলির মুখে ভ্যানচালক নামিয়ে দিল। আরো দু’পা বাড়ালেই ওদের বাগানবাড়ি তবুও ঢুকতে চাইল না। আমি রাস্তা চিনি তাই জোর করলাম না।

কয়েক পা এগোতেই বাড়িতে এসে পৌছালাম। বাড়িখালা পোড়া বাড়ির মতো পড়ে আছে। অনেককালের পুরনো বাগান, এবং তার অবস্থা এমন যে তাঁকে বাগান না বলে জলা বলাই উচিত। পুকুরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম, পানায় তার জল নজরে পড়ে না, ঘাটগুলোরও ভগ্ন দশা। বাড়ির অবস্থাও তথৈবচ। ভাঙা জানালা, ভাঙা থাম, চুন বালি সব খসে পড়েছে।

অসংখ্য ঝিঁঝিঁপোকার আর্তনাদ ছাড়া কোথাও জনপ্রাণীর সাড়া নেই। অথচ বাড়ির ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। একটু জোরেই ডাকলাম “রাজীব! আমি পিনাকী। বাড়িতে আছিস?”

বাড়ির ভিতর থেকে রাজীবের আওয়াজ পেলাম। মনে জোর এল। কয়েকবছরে ওই বাড়ির এই অবস্থা হবে তা আমার কল্পনাতীত।

রাজীব আমায় দেখে খুব খুশি হল। ওর সঙ্গে ওদের বসবার ঘরে এলাম। এত বড় বাড়ি কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। রাজীবকে জিজ্ঞাসা করতে ও বলল সবাই নিজের নিজের ঘরে আছে। আমি ও খুব ক্লান্ত। তাই বেশি কথা বাড়ালাম না।

রাজীবের চেহারা আগের তুলনায় অনেক খারাপ হয়ে গেছে। চোখে মুখে বয়স্কদের মত বলিরেখা, চোখের তলায় কালি। জিজ্ঞাসা করতে এড়িয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ ওর সঙ্গে গল্প করে আমিও ডিনার সেরে ঘুমোতে এলাম ওপরের ঘরে।

দোতলার একটা ঘরে শোয়ার ব্যবস্থা করা আছে, বড় বারান্দায় গ্রিল দিয়ে ঘেরা। কিন্তু বারান্দার কোনায় অদ্ভুত একটা জিনিস চোখে পড়ল, একটা চেয়ার। চেয়ারের যেখানে হেলান দিতে হয় সেই আকৃতিটা পুরো মানুষের অবয়ব, হাতল দুটো মানুষের হাত, পায়াগুলো চারটে পা। খুব অদ্ভুত চেয়ার। এমন চেয়ার কোনোদিনও দেখিনি। ঠিক যেন মনে হচ্ছে একটা মানুষ হাঁটু মুড়ে বসে আছে। রাজীবকে জিজ্ঞাসা করতেই ওর মুখের ওপর একটা ভয়ের ছায়া নেমে এল।

“ও কিছু না, ওটা দাদু কিনেছিলেন। ও আমরা ব্যাবহার করি না। তুই কিন্তু ভুলেও ওতে বসবি না। এখন অনেক রাত হয়েছে। ঘুমো। কাল সব বলব।”

আলো-আঁধারি রহস্যের মাঝে আমায় ছেড়ে দিয়ে রাজীব নিজের ঘরে গেল। ক্লান্তিতে বিছানায় শরীরটা লম্বা করতেই চোখের পাতা ভারী হয়ে এল, ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুমের ঘোরে দেখছি চেয়ারটা অন্ধকারে সারা বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে সঙ্গে পৈশাচিক অট্টহাসি। সারা শরীর কেমন ভারী হয়ে এসেছে, ঘামে ভেজা পুরো শরীর। ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। ওহো! তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম।

বাইরে কেমন ঠকঠক শব্দ, দরজার ফাঁক দিয়ে দেখি সত্যি চেয়ারটা জীবন্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভয়ে মুখে হাত চাপা দিয়ে রয়েছি। মনে হচ্ছে এক মৃত্যুপুরীতে এসে পড়লাম। আমার নিঃশ্বাসের শব্দ, হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মনে হয় এই চেয়ারটাও শুনতে পাচ্ছে। ধীরে ধীরে আমার দরজার দিকে এগিয়ে আসছে এক ধাক্কায় দরজা খুলে দিল। আমার গলা দিয়ে এক আর্তনাদ বেরিয়ে এল।

হঠাৎ দেখি রাজীব পিছনে দাঁড়িয়ে, হাতে একটা ছোট বোতল, সেই বোতল থেকে জল ছুঁড়ে মারছে চেয়ারের পায়াতে। তাতেই ওটা আবার জড়রূপে ফিরে আসে।

“এ ঘরে আর এক মুহূর্ত নয়। রাতে একে বেশিক্ষণ জড় করে রাখার শক্তি আমার জানা নেই। তুই চল ঠাকুর ঘরে।”

অনেক কিছু প্রশ্নের উত্তর পেলাম না। কিন্তু সে-মুহূর্তে আর বিলম্ব না করে বেরিয়ে এলাম ওই ঘর থেকে। রাজীব আমাকে নিয়ে চলে এল চিলেকোঠার ঠাকুর ঘরে।

“এখানে থাক। দিনের আলো না ফুটলে এ ঘর থেকে বেরোনো যাবে না।”

ঠায় বসে কখন চোখ ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে জানি না , চোখ খুলে দেখি বাইরের আকাশ পরিষ্কার, পেঁজা তুলোর মত মেঘ, আজ অষ্টমী, দূরে কোথাও মায়ের আরাধনা হচ্ছে। পুজোর মন্ত্র ভেসে আসছে। বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরলাম। কিছুপরে রাজীব আসে, হাতে একটা সাদা খাম।

“একটা উপকার কর ভাই, আমি এই বাড়িতে বন্দী, কোনভাবেই এখান থেকে বেরোতে পারবো না। অনেককে ডেকেছি সাহায্যের জন্য কেউই আসেনি। তুই এতটা করলি। আমার আর একটা উপকার কর। এই চিঠিতে একজনের ঠিকানা আছে তাকে নিয়ে আয় এ বাড়িতে। তিনি ছাড়া কেউ বাঁচাতে পারবে না।”

“কিন্তু কী হয়েছে একটু খুলে বলবি? আমার তো সব কিছু মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। কাল রাতে কী হয়েছিল?  আর ওই চেয়ারটা জীবন্ত হল কীভাবে?”

রাজীবের মুখে ভয় আর শোকের ছায়া নেমে আসে। ভারাক্রান্ত গলায় বলে, “শোন তাহলে। মাসছয়েক আগের কথা। আমার দাদু আর তাঁর এক বন্ধু ভবানী চৌধুরী তন্ত্রমন্ত্র চর্চা করতেন। প্ল্যানচেট করে আত্মাকে পরপার থেকে টেনে এনে তাকে বশ করে বিভিন্ন কাজে লাগাতেন। ঐ প্ল্যানচেট, তন্ত্রমন্ত্র, গুপ্ত সাধনা এইসব নিয়ে মাতামাতি করতেন ও মাঝেমাঝেই হুটহাট করে এদিক ওদিকে উধাও হয়ে যেতেল। শ্মশান টশানে যেতে দেখা গেছে তাঁকে শুনেছি।

“তারপর?”

“তারপরই, আসলে, মানে একদিন হঠাৎ আর দাদুকে খুঁজে পাওয়া গেল না।”

“কোথায় গেলেন?”

“সেটাই তো কথা! বাড়ির বাইরে যাননি। রাতে সদর বন্ধই ছিল। আগের রাতেও রাতের খাবার খেয়েছেন নিজের ঘরে বসে। সকালে আমাদের বাড়ির কাজের লোক চা দিতে গিয়ে দেখে দাদু ঘরে নেই। নেই তো নেইই। সারা বাড়ি খুঁজেও পাওয়া যায়নি। থানা পুলিশ করেও কোন লাভ হয়নি। কিছুদিন পরে ভবানীবাবু একদিন সকালে এই চেয়ারটা সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। খানিকটা জোর করেই এটাকে এ-বাড়িতে রেখে যান। মামাদের বহু আপত্তি সত্ত্বেও তিনি এটাকে এখানে রেখে গেছেন। যাবার আগে বলেন, ‘এ-চেয়ার থেকে কারো মুক্তি নেই, শঙ্করকে ফিরিয়ে আনতে হলে এ-চেয়ারকে ধ্বংস করতে হবে। কিন্তু এ-বাড়ির বংশধর জাতকের দ্বারা এ-কাজ সম্ভব নয়। আর তোমাদের এ-বাড়ির বাইরে আজ থেকে বেরোনো মানা। বেরোলেই মৃত্যু নিশ্চিত।’

“মামারা শোনেনি ওঁর কথা, চেয়ারটা আসার দুদিনের মাথায় বড়মামা আর মেজমামাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারপর একে একে মামীরা। ভাইবোনগুলো বেঁচে গেছে ওরা শহরের বাইরে থাকে বলে। এখন এই যক্ষপুরীতে আমি বন্দী। আমি যেহেতু এ বাড়ির বংশধর নই তাই আমি বেঁচে আছি। কিন্তু গৃহবন্দী। ভবানীবাবুর গুরুদেব কিঙ্কর গোস্বামী। তাঁকে নিয়ে আয়। কিঙ্কর গোস্বামী সাইকোলজির প্রফেসার ছিল। এখন  রিটায়ার্ড। রিটায়ারমেন্টের পরে এখানে এসে প্যারাসাইকোলজি নিয়ে চর্চা করছেন। আর একটা কথা লোকমুখে পেরেছি।  ভুবনবাবুও সেদিনের পর থেকে নিখোঁজ।”

আর কথা না বাড়িয়ে এগোলাম কিঙ্কর গোস্বামীর বাড়ির দিকে। কিঙ্করবাবুর বাড়ি পৌঁছে দরজা টোকা দিতেই এক বৃদ্ধ গেট ফাঁক করে মুখ বাড়িয়ে জানতে চাইল, “কাকে চাই?”

“কিঙ্কর বাবু আছেন?”

চাকরটি দরজা খুলে ভিতরে আমাকে বসিয়ে ওপরে গেল। বাড়ির ভেতরটা আলোআঁধারি ইন্টিরিয়র ডেকোরেশন করা। কালো আর ধূসর রঙের আধিক্য। খুব সুন্দর। ভদ্রলোক যে-ই হোন, তাঁর তারিফ না করে পারছিলাম না।

কিছু বাদেই ঘরে ঢুকলেন এক সৌম্যকান্তি লম্বা চওড়া বয়স্ক মানুষ। সাদা সিল্কের মত বড়ো বড়ো চুল কাঁধ পর্যন্ত। পরনে কালো সিল্কের ধুতি পাঞ্জাবী। গম্ভীর সুন্দর গলায় বললেন, “আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।”

তারপর আমার মুখে সব ঘটনা শুনে বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন, “যাব। নিশ্চয় যাব। কিন্তু আজ নয়। নবমী ছেড়ে যখন দশমী তিথি লাগবে তখন যাব। কিন্তু তোমাকে কিছু জিনিস জোগাড় করতে হবে। পাশের পাড়ায় মায়ের পুজো হচ্ছে সেখানে গিয়ে আমার নাম বলে ওই জিনিসগুলো নিয়ে নিজের কাছে রাখবে, রাজীবকে বলবার দরকার নেই। আর হ্যাঁ শঙ্কর চ্যাটার্জি যে ঘরটায় থাকতেন ওখানেই সব রাখবে।”

সেদিনের মত কথা বলে আবার ফিরলাম রাজীবের বাড়িতে। সারাদিন যেমন তেমন করে কাটালাম। রাতে একা এই ঘরে শোয়ার সাহস করিনি। আগের রাতের মত চিলেকোঠার ঠাকুরঘরেই কাটালাম। সারা রাত ধরে নীচে শোনা যাচ্ছে চেয়ারের পায়ার ঠকঠক শব্দ।

আজ রাত কাটলে কাল নবমী। কাল সন্ধে সাতটা আটে দশমী লাগবে। রাত কেটে ভোর হল। সকাল থেকে কিঙ্করবাবুর কথা মত পুজোর জোগাড় করতে লাগলাম। বিকেল পাঁচটা একটা বড় কালো গাড়ি গেটের ধারে এসে থামল। গাড়ি থেকে নামলেন কিঙ্কর গোস্বামী। আজ একেবারে অন্য রকম লাগছে। মুখে চোখে কঠিন ভাব, যেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে এসেছেন। ওঁকে নিয়ে দাদুর ঘরে এলাম।

ঘরে নানারকম প্রাচীন বই আর পুঁথি ছড়িয়ে ছিটিয়ে যত্রতত্র। বেশির ভাগই কালো জাদু, তন্ত্রবিদ্যা, পরলোকচর্চা সংক্রান্ত। ঘরের জানলা-দরজা বন্ধ থাকায় ভ্যাপসা গন্ধ ছাড়ছে। কড়িকাঠে বিস্তর ঝুল জমে আছে। দেওয়ালের গায়ে কাঠকয়লা দিয়ে কীসব চিহ্ন আঁকা। দুপুর থেকে রাজীবকে আবার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সারা বাড়িতে কোথাও নেই।

কিঙ্কর বাবু বেশ কিছুক্ষণ সবকিছু লক্ষ করে বললেন, “তোমার বন্ধুটি কোথায়?”

“ওকে সকাল থেকে…”

“পাওয়া যাচ্ছে না, তাই তো?” ওঁর মুখের ভাব একেবারে অন্যরকম কিছু ইঙ্গিত করছিল। গম্ভীর স্বরে বললেন, “রীতিমত দক্ষ হাতে আঁকা কিছু জ্যামিতিক প্যাটার্ন। তন্ত্রসাধনায় এমন অনেক চিহ্নের ব্যবহার আছে। শঙ্করবাবু প্রেতচর্চায় সিদ্ধিলাভ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এতটুকু ভুলের জন্য এক বিরাট সর্বনাশ ডেকে এনেছেন।

তারপর চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কিছু মন্ত্র বলতে শুরু করলেন তিনি। তার কথাগুলো আমার কর্ণগোচর হচ্ছিল না। তারপর হঠাৎ চোখ খুলে বলেন, “ঘোর সর্বনাশ। শঙ্কর আর ভবানী সাধনায় সফল হবার আশায় এ কী করেছে?”

ভয়ার্ত মুখে জিজ্ঞাসা করলাম,  “কী হয়েছে?”

“প্রেতচর্চার সময় শ্মশানের পোড়া কাঠ দিয়ে এই চেয়ার বানায়। এর বলে ওরা অসীম শক্তিকে নিজেদের বশে আনতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই কাঠে যার অস্থির গুঁড়ো লেগেছিল সে আর কেউ নয়, সাক্ষাৎ কাল। আগের জন্মে তিনি ছিলেন মহাতান্ত্রিক তারকনাথ। সেই পাপী তান্ত্রিকের আত্মা ওই চেয়ারে বন্দী। সেই আটক করে রেখেছে তোমাদের গোটা পরিবারকে। সবাই এ-বাড়িতে আছেন, কিন্তু রয়েছেন দুই কালের মাঝে আটকে। সেখানে সময় অবিচল। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। “

“এখন উপায়?”

“যে জিনিসগুলো আনতে বলেছিলাম এনেছ?”

“হাঁ ওখানে …”

আমার আনা জিনিসগুলো দেখে স্মিত হাসলেন তিনি, “এবার শুরু করা যাক। তুমি ভয় পাবে না। মন শক্ত করে বস।”

শঙ্কর বাবুর ঘরটা পুরো অন্ধকার করে দেওয়া হল। ভিতরটা চন্দন কাঠের ধূপের গন্ধে মম করছে। মেঝেতে দামি কার্পেটের ওপর ছোট্ট কাঠের একটা টেবিল। চারদিকে ঘিরে চেয়ার। একটা মোটা মোমবাতি জ্বলছে টেবিলের ওপরে। লক্ষ করলাম টেবিলের ওপরে দাবার ঘরের মত ঘর কেটে এ থেকে জেড পর্যন্ত লেখা রয়েছে।

কিঙ্কর বাবু বললেন “শুরুর আগে কয়েকটা কথা বলে নেওয়া দরকার। দুষ্ট আত্মা সহজে আসতে চায় না। কথাটা ঠিক, তবে এর আগেও আমি দু’তিনবার এই ধরনের আত্মাকে হাজির করিয়েছি। সেক্ষেত্রে মিডিয়াম অর্থাৎ আমার ওপর মানসিক চাপ অনেক বেশি। পড়ে। সময়ও একটু বেশি লাগে। আশা করি তুমি আমার সঙ্গে সহযোগিতা করবে। আর মনঃসংযোগ করার সময়ে চোখ বন্ধ রাখবে।” সম্মতি জানতেই উনি কাজ শুরু করলেন।

ঘরের ডানদিকে মেঝের ওপর একটা তেপায়া চন্দনকাঠের টেবিল রাখলেন। তার ওপরে কিছু মন্ত্র খোদাই করে লেখা। টেবিলটার ওপর রাখা একটা ডায়রি। পৃষ্ঠাগুলো নিজে থেকেই উল্টে যাচ্ছে। প্রতিটা পৃষ্ঠার ওপর দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা মন্ত্র। কিঙ্করবাবু খুব জোরে জোরে সেই মন্ত্র পড়ছেন। চারপাশ থেকে সহস্র মানুষের চিৎকার আর  অট্টহাসিতে ঘর ফেটে পড়ছে।

আমার পুরো শরীর তখন ঘামে ভিজে গেছে। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছি। কোথা থেকে ক্ষীণ স্বরে কেউ বলছে “মুক্তি…ই…ই…”

তারপর টেবিলটা নড়তে শুরু করল। জবাবে বাইরে থেকে ঠক ঠক শব্দ উঠল। খানিক বাদে চেয়ারটা শঙ্করবাবুর ঘরে এসে ঢুকল। সেই চেয়ারের ওপর বসে আছে রাজীব, ভয়ানক মুখের ভঙ্গী, চোখ দুটো জ্বলন্ত কয়লার মত লাল।

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি, এ কোন রাজীবকে দেখছি? কিন্তু কিঙ্করবাবু মন্ত্রপাঠ বন্ধ করলেন না। এবার চেয়ারটার মাথাটা ধীরে ধীরে মানুষের আকৃতি নিল। মুখে চরম জিঘাংসা, চোখ দুটো ভাটার মত জ্বলছে, লালা ভরা জিভ বাইরে ঝুলছে। পোড়া গন্ধে ঘর ভরে উঠল।

শঙ্করবাবুর ঘরের দেয়ালে যেখানে অনেকে জ্যামিতিক প্যাটার্ন আঁকা সেইদিকে লক্ষ করে কিঙ্করবাবু মন্ত্রপুত জল ছুঁড়ে মারলেন। তাতে থরথর করে কেঁপে উঠে দেয়াল সরে যেতে দেখা গেল সেখানে ঘুমন্ত অবস্থায় আছেন শঙ্করবাবু ও ওঁর গোটা পরিবার। সবাইকে দেখে আমি উত্তেজিত হয়ে উঠে পড়োতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কিঙ্করবাবু চোখের ইশারায় মানা করলেন।

চেয়ারে বন্দী মৃত তারকনাথের আত্মা আর রাজীব বুভুক্ষু জানোয়ারের মত এগিয়ে আসে কিঙ্কর বাবুর দিকে। মুখটা বলে ওঠে, “কিঙ্কর তোকে আজ আমার ফাঁদে পা দিতেই হল। তুই আমার সাধনাকে নষ্ট করেছিলি। আজ তোকে ছাড়ব না। মনে পড়ে সেদিন আমি এই রাজীবকে ওর বাবার কাছ থেকে নিয়েছিলাম নরবলির জন্য। তুই আর ওই শঙ্কর মিলে আমার সাধনা ভঙ্গ করলি। পুলিশে দিলি, জেলেও পাঠালি। কিন্তু দেখ ভাগ্যের পরিহাস! আমার চিতার কাঠ দিয়ে তৈরি চেয়ার আমায় আবার এই বাড়িতে টেনে এনেছে। সেই শিশু আজ জোয়ান। ওর শরীর মন এখন আমার নির্দেশে চলছে। হাঃ হাঃ হাঃ। আজ তিনটে নরবলি দিয়ে আমি আবার মনুষ্য রূপে ফিরব।”

কিঙ্করবাবু পুজোর মণ্ডপ থেকে আনা যজ্ঞের বিভূতি দিয়ে গোলাকার একটা বৃত্ত কাটলেন। মৃদু স্বরে মন্ত্র পাঠ চলছে। রাজীবের শরীরটা চেয়ার সমেত শূন্যে ভাসছে। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও সেই বৃত্তের ভিতরে প্রবেশ করতে পারেনি। এবার সে রাগে ছুটে যায় শঙ্করবাবুর পরিবারের দিকে।

ঠিক সেই মুহূর্তে নিজের ব্যাগ থেকে মা দুর্গার হাতের খাঁড়া বের করে মন্ত্রচারণ করেন কিঙ্করবাবু,

জটাজুট সমাযুক্তাং অর্ধেন্দু কৃতশেখরাম্।

লোচনত্রয় সংযুক্তাং পূর্ণেন্দু সদৃশাননাম্।।

অতসীপুষ্প বর্ণাভাং সুপ্রতিষ্ঠাং সুলোচনাম্।

নবযৌবন সম্পন্নাং সর্ব্বাভরণ ভূষিতাম্।।

সূচারু দশনাং তদ্বৎ পীনোন্নত পয়োধরাম্।

ত্রিভঙ্গস্থান সংস্থানাং মহিসাসুরমর্দীনিম্।।…

চেয়ারে বসে থাকা রাজীব জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারের মাথায় কিঙ্করবাবু এক কোপ মারেন। কাটা কলাগাছের মত কাঠের চেয়ারটা ছটফট করতে করতে থেমে যায়। রাজীবের দেহ থেকে এক কালো ধোঁয়া উঠে এসে ঘরময় গোলাকার ঘূর্ণীর আকারে ঘুরতে ঘুরতে বাইরে বের হয়ে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরে বিকট শব্দে বাজ পড়ে। আমরা সবাই মিলে চেয়ারটাকে বাইরে এলে আগুন ধরিয়ে দিই। আকাশ ফাটালো হাহাকার করে এক কালো ধোঁয়া গগনমুখী হয়।

ওদিকে গ্রামবাসীদের ঘন্টা উলু শঙ্খধ্বনি শোনা যায়। মা দুর্গার বরণ শুরু হয়েছে।

ঘরে ঢুকে দেখি রাজীব, আর তার পুরো পরিবার সেই ঘরের মেঝেতে ঘুমন্ত অবস্থায় শুয়ে আছেন। কিঙ্করবাবু যুদ্ধজয়ের ভঙ্গীতে বলেন, “কিছুক্ষণের মধ্যেই সবার চেতনা ফিরবে। চিন্তা নেই। ফাঁড়া কেটে গেছে। আমি তোমাদের গৃহবন্ধন গাত্রবন্ধন করে দিচ্ছি। আর কোন ভয় নেই।”

উনি চলে যাবার কিছু পরেই সবার জ্ঞান ফেরে। রাজীবের গোটা পরিবার আবার জীবনের মূল স্রোতে ফিরে আসে। আমিও তার পরদিন কলকাতায় ফিরি।

ওই ঘটনার প্রায় মাসছয়েক কেটেছে, রাজীবের সঙ্গে আজকাল প্রায়ই ফোনে কথা হয়।

আজ শনিবার, অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি আমার বাবা শ্যামবাজারের কোনো অ্যান্টিকের দোকান থেকে আবার একটা সেই একইরকম দেখতে মানুষের মুখওয়ালা রকিং চেয়ার কিনে এনেছেন।

সারারাত বাড়ির ভিতরে আবার সেই শব্দ ঠক ঠক ক ক ক ক…

ছবিঃ মৌসুমী

জয়ঢাকের গল্প ঘর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s