গল্প স্বপ্ন পূরণ জয়তী অধিকারী বর্ষা ২০১৯

(১)

রোজ সকাল থেকেই লামার ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া না থাকলেও লামার ঠিক ভোরবেলাতেই ঘুম ভেঙে যায়। সেই ছোটবেলার অভ্যেস। তখন লামার ঘুম ভাঙাত ওর ‘মাঈ’, মানে মা। মাথার চুল ঘেঁটে, গালে চুমু খেয়ে কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিত ঘরের সামনে সরু ফালিটায়। লামা কিছুতেই চোখ খুলতে চাইত না। আবার ছুটে গিয়ে বিছানায় রাজাইয়ের নীচে ঢুকে পড়তে চাইত। কিন্তু মায়ের হাত থেকে রক্ষা পেলেও বাবাকে খুব ভয় পেত লামা। তাই পাপাজি যখন ডাক দিত, “লামা”, তখনই এক লাফে উঠে সোজা ছুট লাগাত বাথরুমের দিকে। কোনরকমে দাঁত মেজেই জামাকাপড় বদলে ছুটতে হত স্কুলে। আর এখন, সকালে উঠেই লামা ছোটে রিকিকে ঘুম থেকে তুলে স্কুলের জন্যে রেডি করবে বলে। লামার বয়স মাত্র এগারো হলে কি হবে, সে পাঁচ বছরের রিকিকে খুব যত্ন করেই ঘুম থেকে তুলে বাথরুমে নিয়ে যায়, ঠিক যেমন তার মা তাকে নিয়ে যেত। মাঝে মাঝেই লামার চোখের পাতা ভিজে ওঠে। আজ যদি তার মা বেঁচে থাকত, তাহলে কি আর তাকে এভাবে কলকাতায় এসে লোকের বাড়ি কাজ করতে হত! এসব এখন ভেবে লাভ নেই। রিকির পুলকার এসে চলে গেলে বাড়িতে তুলকালাম হবে। তখন সব দোষ এসে পড়বে লামার ওপর। লামা তাড়াতাড়ি রিকির জন্যে ফ্রিজে রাখা দুধটা বের করে মাইক্রোওয়েভে ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েই রিকিকে ঘুম থেকে তুলল। সকালে রিকিকে দুধ-কর্ণফ্লেক্স খাইয়ে দিতে হয়। কোনদিন আবার ডিমসিদ্ধ আর টোস্ট। এখানে এসে লামা আস্তে আস্তে এগুলো শিখে গেছে। তবে একটাই বাঁচোয়া যে বাবু, মানে রিকির বাবা ওকে রান্না করতে বারণ করেছে। বাবু ওকে খুবই ভালবাসে। এখানে আসার পর বলেওছিল যে লামাকে স্কুলে ভর্তি করে দেবে। কিন্তু আন্টি যখন বলল যে তাহলে রিকির দেখাশোনা কে করবে, তখন বাবু মত পাল্টালো। লামাকে বোঝালো যে রিকি স্কুল থেকে ফিরলে তখন তো বাড়িতে একা লামাই থাকে, তাই ওই সময়টা ওরা দুজনে খেলতে পারবে। আর লামাও সেটাই মাথা নীচু করে মেনে নিয়েছিল। অন্যান্য পাহাড়ী ছেলেদের মতই লামা অল্পতেই খুশি।

(২)

লামাদের গ্রাম গাড়োয়ালের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে, নাম ‘বুকি’। সেখানে ইলেক্ট্রিসিটি আছে, কয়েকজনের বাড়িতে টিভিও আছে। কিন্তু লামাদের বাড়িতে টিভি ছিল না। একটা রেডিও ছিল, তাও মাঝে মাঝেই খারাপ থাকত। সে আর ওর বন্ধু ভীমা পাশের  বাড়িতে গিয়ে অনেক সময় টিভি দেখত। লামাদের বাড়িটা পাথরের উপর পাথর বসিয়ে কাদা লেপে বানানো। আর মাথার উপর পাতলা পাতলা পাথরের টুকরো সাজিয়ে ছাদ। লামা জানে ওগুলোকে শ্লেট পাথর বলে। ওর পাপাজি বলেছে। সেখানে রামদানা শুকোতে দিত লামার দাদা, সঞ্জু। আর পাখিতে না খেয়ে যায়, সেটা দেখার দায়িত্ব ছিল লামার। একটা সরু লাঠি নিয়ে লামা “হুর্‌র্‌র্‌ হুট হুট” করে ছুটে যেত। পাখিগুলো উড়ে গেলেই সে হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠত আনন্দে। লামাদের গ্রামের অনেক নীচ দিয়ে একটা নদী বয়ে গেছে। মাঈ বলেছিল ওটা নাকি “গঙ্গা” নদী, “বহুত পাওন হ্যায়”। ওদের বাড়ির যে কোন জায়গা থেকেই তাকালে অনেক পাহাড় দেখা যায়। তাদের মধ্যে বেশীর ভাগই বরফে ঢাকা। লামার যখন সাত বছর বয়স, ওর মা কয়েকদিন খুব অসুখে ভুগেছিল। সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও বাঁচানো যায়নি। পাপাজি ফিরে এসে লামাকে বলেছিল তার “মাঈ” নাকি আকাশের তারা হয়ে গেছে। সেখান থেকেই লামাকে দেখবে। তাই লামা যেন সেই সব কাজই করে যা তাকে তার মা শিখিয়ে গেছে। লামা মাঝে মাঝেই জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করত কোন তারাটা তার মাঈ, তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

লামার পাপাজি পুরুষানুক্রমে পোর্টারের কাজ করে। প্রায় সময়ই ওনাকে বিভিন্ন ট্রেকিং গ্রুপকে নিয়ে যেতে হয় উঁচু পাহাড়গুলোয়। আর একটু বড় হলে লামাকেও একবার নিয়ে যাবে বলেছে তার বাবা। সঞ্জু তাদের ছাগল-ভেড়া চড়ায় আর রান্না করে। পাপাজি বলেছে আর কিছুদিন পর থেকে সঞ্জু পাহাড়ের সব রাস্তা চিনতে শিখবে। তাকেও তো এই কাজই করতে হবে বড় হয়ে। লামা ছোট বলে বাবা মায়ের খুব আদরের। মাঈ আকাশে চলে যাবার পর থেকে লামার পাপাজিই তাকে দেখাশোনা করত। রাত্রে শোবার সময় কত গল্প বলত লামাকে। রোজ নতুন নতুন গল্প, পাহাড়ের গল্প। তাদের গ্রাম থেকেই দূরে দেখা যায় দ্রৌপদী-কা-দাঁড়া – তার গল্প। গ্রাম থেকে বেশ কিছুটা উপরে উঠে একটা ঝর্ণা দেখা যায় – তার গল্প। তবে পাপাজি জানতই না যে ওই ঝর্ণাটা সে আর ভীমা একদিন গিয়ে দেখে এসেছে। নিজেদের তখন বেশ বড় বড় মনে হচ্ছিল। কিন্তু লুকিয়ে গিয়েছিল বলে একটু ভয় ভয়ও যে করছিল না, সেটা বললে বাজে কথা বলা হবে। তবে পাপাজির কাছে লামা শুনেছিল ওই ঝর্ণাটা থেকে প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরে একটা ‘তাল’, মানে লেক আছে। তার নাম খেরা তাল। সেই তালের গল্প শোনার পর থেকেই লামা ভেবেছে কবে সে আর ভীমা ওই জায়গাটায় যেতে পারবে! স্বপ্নের মত লাগত লামার। আচ্ছা, খেরা তাল-এ কি চাঁদনি রাতে পরিরা নেমে আসে? লামার খুব ইচ্ছে হয় সঞ্জুর এই গল্পটা বিশ্বাস করতে। কিন্তু সঞ্জু অনেক সময় ওকে বুরবক বানানোর জন্যে বানিয়ে বানিয়ে অনেক গল্প বলে আর মুখ টিপে হাসে।

যখন ওর পাপাজি পাহাড়ে যেত, লামার এক চাচা এসে তাদের বাড়ি থাকত। যেবার ওর বাবা কালিন্দী পাস গেল, বলেছিল ফিরে এসে লামাকে নিয়ে শহরে যাবে। টিভিতে লামা দেখেছে শহরের ছবি। ঠিক সিনেমার মত।  কত বড় বড় বাড়ি মাথা উঁচু করে দেখতে গেলে ঘাড়ে ব্যথা হয়ে যায় নাকি! আর অনেক বড় বড় বাড়ি আছে, সেখানে শুধুই দোকান। সেই সব দোকানে পাওয়া যায় না এমন কোন জিনিসই নেই। লামাকে যখন ওর বাবা বলেছিল শহরে বেড়াতে নিয়ে যাবে, লামা ভেবেছিল ভীমাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে। না হলে ওর জন্যে অনেক কিছু কিনে নিয়ে আসবে। কিন্তু লামার বাবা আর ফেরেনি। সেবার কালিন্দী পাসে খুব তুষারঝড় হয়েছিল। চাচাকে বলতে শুনেছে… অ্যাভালাঞ্চ। লামার বাবা খুব সাহসী ছিল, অনেকবার তুষারঝড়ের মুখ থেকে ফিরে এসেছে। সে’সব গল্প নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে বসে শুনেছে লামা ওর মাঈ আর দাদার সঙ্গে। কিন্তু এবারে তিনজন ট্রেকার আর ছ’জন পোর্টারের সাথে লামার বাবাও হারিয়ে গেল বরফ রাজ্যে। তখন থেকে লামা আর ওর দাদাকে ওই চাচাই দেখাশোনা করত।

একবার ওদের গ্রামে একদল ট্যুরিস্ট এলো। সেখানে রিকির বাবা মা ছোট্ট রিকিকে নিয়ে এসেছিল। ট্যুরিস্টরা এলেই অনেক লজেন্স দেয় বলে লামা আর ভীমা আশেপাশে ঘোরে। তাছাড়া শহরের মানুষগুলোকে দেখতে তাদের খুব ভালো লাগে। কী সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় ওদের! লামাদের তো জামা বলতে হয় ছেঁড়া জামাকাপড়, নাহলে ভেড়ার লোম থেকে বানানো কম্বলের জামা। খুব ঠান্ডা পড়লে ঘরের মধ্যে বুখারি জ্বালা থাকে। মাঈ মাঝে মাঝেই তাতে কাঠকয়লা দিয়ে আগুনটা উসকে দিত, আর ঘরটা গরম হয়ে উঠত। সঞ্জু এখন সব শিখে গেছে। ভীমাকে একজন ট্যুরিস্ট একবার একটা জ্যাকেট দিয়েছিল। লামাকেও দিতে চেয়েছিল। কিন্তু লামা নেয়নি। তার মাঈ বলেছিল, “লামা, কভি ভিখ মাৎ মাংনা।” লামাকে দেখেই রিকি ছুটে এসেছিল আর ওর সাথে খেলতে চাইছিল। লামাও ওর সাথে খেলা করছিল। দু’দিন পরে যখন রিকিদের ফিরে যাবার সময় হল, রিকি কিছুতেই লামাকে ছাড়তে চাইছিল না, খুব কান্নাকাটি করছিল। তখন রিকির বাবা খোঁজ খবর নিয়ে লামার কাকাকে অনুরোধ করেছিল যদি ওরা লামাকে তাদের সাথে কলকাতায় পাঠাতে রাজি হয়। ওর চাচা তো হাতে চাঁদ পেয়েছিল যেন। একজনের দায়িত্ব তো কমবে।

(৩)

রিকিকে স্কুল ড্রেস পরিয়ে মোজা-জুতো সব পরিয়ে দিয়ে বাবুর কাছে পৌঁছে দিল লামা। বাবু ওকে পুলকারে তুলে দিয়ে এসেই অফিসের জন্যে রেডি হয়। আর আন্টিও বাবুর সাথেই বেরিয়ে পড়ে অফিসের জন্যে। রান্না করে যে, মিন্তিমাসি, সে অবশ্য থাকে বিকেল পর্যন্ত। কিন্তু রিকি স্কুল থেকে ফিরে না-আসা পর্যন্ত লামা টুকটুক করে ঘর গোছায়। সব জিনিসের ধুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করে রাখে। বাবুর বই-পত্তর, আন্টির সাজগোজের জিনিস, রিকির খেলনা – সব জায়গামত গুছিয়ে রাখে। আর মাঝে মাঝেই বারোতলা উঁচু বারান্দা থেকে দূরের আকাশটা দেখে। এখানে আকাশ ধূসর। তাদের গ্রামের মত নীল নয়। নীচে রাস্তার দিকে তাকালে লামার কেমন ভয় ভয় করে। এপাশ থেকে ওপাশে ছুটে যাওয়া গাড়িগুলো ঠিক রিকির খেলনা গাড়িগুলোর সাইজের। সারাদিন এত গাড়ি কোথা থেকে যে আসে, আর কোথায় যে যায়! শহরে কি সব লোকের গাড়ি থাকে? লামা অবাক হয়ে ভাবে। তার শহরে আসার স্বপ্নটা পূরণ হল ঠিকই, কিন্তু এভাবে তো সে আসতে চায়নি কখনও। লামার চোখ জ্বালা করে, চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে আসে। মিন্তিমাসি এসে লামার কাঁধে হাত রাখে, “কী রে? মন কেমন করছে?” লামা তাড়াতাড়ি চোখ মুছে হেসে ওঠে, “নাহি তো।” মিন্তিমাসি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার নিজের কাজে চলে যায়।

(৪)

আজকে লামা খুব খুশি। বাবু বলে গেছে আজ তারা দুজনেই তাড়াতাড়ি ফিরে রিকি আর লামাকে নিয়ে যাবে শপিং মলে। শপিং মানে জানে লামা, কেনাকাটা। তার মানে আজ সেই সিনেমার মত জায়গাটায় যেতে পারবে লামা। বাবু বলে রেখেছে ওর সবথেকে ভালো জামা প্যান্টটা যেন বের করে রাখে। লামার হাসি পেয়ে গেল। সবথেকে ভালো মানে তিনটে শার্ট আর দুটো প্যান্টের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া। আর ওগুলোর সাথে যে জুতোটা কিনে দিয়েছিল বাবু, সেটা। লামা বারবার মিন্তিমাসিকে জিজ্ঞাসা করছে, কখন ছ’টা বাজবে! রিকি ঘুম থেকে উঠলে আজ আর ওকে নিয়ে নীচে পার্কে যাবে না সে। রিকি হয়ত একটু বায়না করবে। কিন্তু ওকে ভালো করে বোঝাবে লামা, আজ তারা বেড়াতে যাবে। কত্ত মজা করবে!

সময়মতই বাড়ি ফিরে বাবু আর আন্টি ওদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। লামা খুব এক্সাইটেড আজ।

গাড়িতে বসে লামা জানালার কাচে চোখ লাগিয়ে শুধু দেখতে লাগল। গিলতে লাগল বলাই ভাল। আর উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছিল, “আহ্‌ হা! ইৎনি বড়ি বড়ি ইমার্‌তে! আরে বাবুজি, দেখিয়ে দেখিয়ে কিৎনে সারে খিলোনা!” রিকির বাবা ঋতম মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগল। লামাকে তার যে বেশ পছন্দ সেটা বোঝাই যায়। কিন্তু রিকির মা অদ্রিজা লামার এই হ্যাংলাপনা একদম সহ্য করতে পারে না। যদিও ঋতম ওকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে একটা পাহাড়ি গ্রামের সরল বাচ্চাছেলের এই ফিলিংসটা খুব ন্যাচারাল। কিন্তু অদ্রিজা প্রতিবার বলেছে ওর বিহেভিয়ার বড্ড এমব্যারেসিং। কখন যে কী বলে বসবে, কী করে বসবে, তার জন্যে না অপ্রস্তুতে পড়তে হয় সবার সামনে।

“প্লিজ ডোন্ট ওরি দ্রিজা, আই উইল হ্যান্ডল হিম,” বলে গাড়িটা পার্কিং লটে ঢুকিয়ে দিল ঋতম।

গাড়ি থেকে নেমে রিকির হাত ধরে মলে ঢোকার সময় অদ্রিজা একবার লামাকে সাবধান করে দিল সে যেন এমন কোন কাজ না করে যাতে তাদের লোকের সামনে বেইজ্জত হতে হয়। ঋতম ওর পিঠে হাত দিয়ে বলল, “লামা তুই আমার সাথেই থাকিস। কেমন? ইধার উধার বিলকুল মাৎ ভাগ্‌না।” লামা হেসে মাথা হেলিয়ে বলল, “জি বাবুজি।”

কিন্তু এসকেলেটরের সামনে এসেই লামার চোখ কপালে। এই চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে সে কেমন করে উঠবে? এমন সিঁড়ির কথা তো সে জীবনেও শোনেনি কোনদিন! অদ্রিজা রিকির হাত ধরে সেই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সরসর করে উঠে যাওয়ার পরও তার ভয় কাটে না।

ঋতম ওকে বুঝিয়ে বলল, “দেখ লামা, মুঝে দেখ। ম্যায় য্যায়সে পাঁও রাখুঙ্গা ইয়ে সিঁড়িকে উপর, তুঝে ভি ওয়সেহি চড়না পড়েগা। সমঝা? উসকে বাদ তু সির্ফ খাড়া রেহ্‌না। ইয়ে সিঁড়িয়াঁ আপনে আপ হামলোগোকো উপর চড়্‌হা দেগি। ঠিক হ্যায়?” লামার গলা তখন শুকিয়ে কাঠ। ভয়েতে তার বুকের ভিতর যেন বিজলি চমকাচ্ছে। এদিকে পেছনে অনেক লোকজন এসে দাঁড়িয়ে আছে আর বিরক্ত হচ্ছে। অনেকেই বলছে, “ডিসগাস্টিং! কোথা থেকে যে এসে যায় কে জানে।”

 ঋতম ওকে একটু সরিয়ে এনে ভাল করে বোঝালো যে এখানে উপরে যেতে হলে এই সিঁড়ি দিয়েই যেতে হবে। তারপর প্রায় টেনে হিঁচড়ে লামাকে দাঁড় করিয়ে দিল এসক্যালেটরের উপর। লামা দু’তিনবার টাল সামলাতে না পেরে পেছন দিকে হেলে পড়ে যাচ্ছিল। প্রতিবারই ঋতম ওকে সামলে নিল। আর বেশ রেগে গিয়েই বলল, “তু ঠিকসে খাড়া ভি নাহি রেহ্‌ সাকতা কেয়া?” লামার তখন চোখে জল এসে গেছে। বাবুজী এমন রেগে রেগে কথা বলবে তার সাথে এ তো সে কোনদিনই ভাবেনি। এদিকে অদ্রিজা তখন রিকিকে নিয়ে উঠে গেছে চারতলায়। ঋতম কোনরকমে লামাকে নিয়ে দোতলায় ওঠার পর অদ্রিজাকে জানাল যে লামাকে নিয়ে উঠতে সমস্যা হচ্ছে। অদ্রিজা তো ফোনের মধ্যেই যা তা কথা বলতে শুরু করল। লামা ছলছলে চোখে ঋতমের মুখের দিকে তাকিয়ে এটুকু বুঝতে পারল যে ঋতমও তাকে নিয়ে বেশ বিরক্ত। তখন সে ঋতমকে বলল, “বাবুজী, আপ যাইয়ে। হাম ইয়েঁহি রুকতে হ্যায়। আপলোগ যব উতারিয়েগা, মুঝে সাথমে লেকে যানা।” কিন্তু ঋতম ওকে একা রেখেই বা যায় কী করে! ওদিকে রিকি আর অদ্রিজাও ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। ঋতম ওদের ফুড কোর্টে গিয়ে খাবারের অর্ডার করতে বলে লামাকে নিয়ে এলো একটা কোণের দিকে আর বলল, “দেখ লামা, তু ইঁহাসে কাঁহি মাৎ যানা। সমঝা? হামলোগ যবতক না আয়ে, ইয়েঁহি রেহ্‌না।” লামাকে একা বসিয়ে রেখে ঋতম চলে গেল।

(৫)

লামা চুপ করে বসে বসে অবাক হয়ে দেখছিল কত লোকজন, কতরকম জামাকাপড় পরা, আর কী ব্যস্ত সবাই। পাশাপাশি সমস্ত দোকানগুলোই দেখার মত করে সাজানো। তাদের গ্রামের কেউ এসব কল্পনাও করতে পারবে না। মন্ত্রমুগ্ধের মত লামা উঠে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল একটা দোকানের দিকে। তাকভর্তি জামাকাপড়ের রাশি। মাঝখানে আবার গোল গোল চাকার মত, সেখান থেকেও ঝোলানো আছে কত রকমের জামা-কাপড়! লামা যত দেখছে হাঁ হয়ে যাচ্ছে। তার আর খেয়াল রইল না যে ঋতম তাকে ওই জায়গাটা থেকে নড়তেও বারণ করেছিল। একের পর এক দোকানে লামা ঢুকছে আর দু’চোখ ভরে দেখে বেরিয়ে আসছে। কেউ কেউ আবার তাকে ইংরিজিতে জিজ্ঞাসাও করছিল কিছু, কিন্তু লামা কিছু না বলে বেরিয়ে এসেছিল। সত্যিই এমন জায়গার কথা সে কোনদিনই জানতে পারত না এখানে না এলে। ঋতমের প্রতি কৃতজ্ঞতায় লামার চোখের পাতা ভারী হয়ে এল।

সামনেই একটা দোকানে কত সুন্দর সুন্দর জিনিস সাজানো রয়েছে। লামা মন্ত্রমুগ্ধের মত ঢুকে পড়ল সেখানে। কাচের তৈরি মূর্তিও যে এত সুন্দর হতে পারে লামা কোনদিন কারুর কাছে শুনলেও বিশ্বাস করত না। তার মধ্যে আবার আনারের মত লাল রঙ, আশমানের মত নীল, তাদের বুকি গ্রামের উপরে যে বুগিয়ালটা আছে, সে রকম সবুজ। দেখতে দেখতে লামার চোখে পড়ল একটা ডলফিনের শো’পিস। লামা ডলফিন কোনদিন দেখেনি, এমনকি ছবিতেও না। এরকম একটা সুন্দর মাছের মত জিনিস, তার পিঠের দিকটা ঘন নীল আর পেটের কাছটা ক্রমশ হালকা হতে হতে পাখনাগুলো আর লেজটা পুরো কাচের মত। একটা কাচের ফোয়ারার উপর দুটো ওইরকম মাছ – একটা বড় আর একটা ছোট্ট। ঠিক যেন মায়ের পেটের কাছে তার বাচ্চা। লামার মনে পড়ল সেও ওর মায়ের পেটের কাছে ওভাবেই ঢুকে শুয়ে থাকত। লামা এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে শো’পিসটা হাতে তুলে নিল একটু ভালো করে দেখার জন্যে। তখনই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোকের ফোনটা বেজে উঠতে উনি পকেট থেকে ফোনটা বের করতে যেতেই লামার হাতে ধাক্কা লেগে গেল, আর শো’পিসটা পড়ে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। লামা এরকম একটা ঘটনায় প্রচন্ড ভয় পেয়ে দু’পা পিছিয়ে যেতেই দোকানের সিকিউরিটি এসে তাকে চেপে ধরল আর টেনে নিয়ে গেল ম্যানেজারের কাছে। লামা যতই তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে সে ওটা হাতে নিয়ে শুধু দেখছিল, সে ইচ্ছে করে ভাঙেনি। পাশের লোকটার হাতের ধাক্কাতেই ওটা পড়ে গেছে, কিন্তু কেউ ওর কোন কথাই শুনতে চাইল না। ম্যানেজার ওকে ধমক দিতে দিতে কী যে বলছে লামা কিছুই বুঝতে পারল না। কিন্তু এটা বুঝতে পারছিল যে তার হাত থেকে একটা খুব দামি জিনিস পড়ে ভেঙে গেছে। চারপাশে কত লোক জমে গেছে। সবাই বলাবলি করছে নির্ঘাত চুরি করার ধান্দায় ছিল। কেউ কেউ আবার বলছে এই সব ছেলেগুলো বেশিরভাগই পকেটমার হয়।

লজ্জায় অপমানে লামার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। তার কথা কেউ বিশ্বাসই করছিল না। ম্যানেজার যখন ওকে জিজ্ঞাসা করল ওর সঙ্গে কে আছে, লামা ঋতমের পুরো নামও বলতে পারছিল না, ঠিকানাও না। তাই সকলেই বিশ্বাস করে নিল যে লামা একটা চোর বা পকেটমার। যে লোকটার সঙ্গে ধাক্কা লেগে এই পরিস্থিতি, তাকে সামনে দেখে লামা তার কাছে গিয়ে অনুরোধ করতে লাগল, যাতে তিনি বলেন যে ঠিক কী হয়েছে। কিন্তু তিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে “হাউ ডু আই নো” বলে চলে যেতেই কয়েকজন লামার জামার কলার চেপে ধরল।

“এই বয়সেই কী ধড়িবাজ দেখুন!”

“আরে, এরাই বড় হয়ে ব্যাংক ডাকাতি করে আর নাহলে হিউম্যান বম্ব হয়ে যায়।”

“এত কথার দরকার কী, পুলিশে দিয়ে দিলেই তো হয়!”

এইসব শুনতে শুনতে লামার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগল। সে অসহায়ের মত চারপাশে তাকিয়ে শুধু ঋতমকে খুঁজতে লাগল। সে বারবার ম্যানেজারকে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগল যে সে চোর নয়। যেটা হয়েছে সেটা সে ইচ্ছে করে করেনি। তার সাথে লোক আছে, তারা উপরে কোথাও আছে। ফিরে এলেই বোঝা যাবে যে ওনারা যা ভাবছেন সব ভুল। কিন্তু কেউ ওর জন্যে এত সময় নষ্ট করতেই রাজী নয়। ম্যানেজার মলের সিকিউরিটিকে ফোন করার মিনিট দশেকের মধ্যেই একজন গার্ড এসে ওকে ধরে নামিয়ে নিয়ে গেল। সেই এসক্যালেটরের সামনে আসতেই লামা হঠাৎ রিকির নাম ধরে চিৎকার করতে শুরু করল। যদি ওরা লামার গলা পেয়ে আসে! তখন গার্ডটা ওকে জিজ্ঞাসা করল, “রিকি কে?” লামা জানাল সে ওদের বাড়িতেই কাজ করে, ওদের সাথেই এসেছে এখানে। গার্ড তখন শপিং মলের সব জায়গায় অ্যানাউন্স করালো রিকি আর লামার নাম। নীচের কাউন্টারে পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর ঋতম আর অদ্রিজা রিকিকে নিয়ে এসে হাজির হল।

“হোয়াট হ্যাপেনড স্যার? হোয়াটস রং উইথ হিম?”

সিকিউরিটি-ইন-চার্জ ঋতমকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি এই ছেলেটাকে চেনেন?”

ঋতম কী বলবে ভেবে না পেয়ে একবার লামার দিকে তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, “ইয়েস, হি ইজ আওয়ার হেল্পিং হ্যান্ড অ্যাট হোম। বাট হোয়াট ডিড হি ডু?”

সিকিউরিটি-ইন-চার্জ দোকানের ম্যানেজারের কাছ থেকে যেটুকু জেনেছিলেন সেটাই ঋতমকে জানালেন আর বললেন, “ও একটা ক্রিস্ট্যালের কস্টলি শো’পিস চুরি করতে গিয়ে ভেঙে ফেলেছে। এখন হয় আপনাকে ওটার দাম দিতে হবে, আর নাহলে আমরা ওকে পুলিশে দিতে বাধ্য হব।”

ঋতম খুব অবাক হয়ে লামার দিকে তাকাতেই লামা এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল, “বাবুজী, বিসওয়াস্‌ কিজিয়ে, ম্যায়নে কোই চোরি নাহি কি। ম্যায় তো সির্ফ উও মূরত দেখ রহে থে…”

গালের উপর ঋতমের হাতের একটা সজোরে চড় খেয়ে লামা স্তম্ভিত হয়ে গেল। বাবুজিও তাকে চোর ভাবল! তার কথা বিশ্বাস করল না!

ঋতম ওকে সিকিউরিটি-ইন-চার্জের হাতে তুলে দিয়েই অদ্রিজা আর রিকিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল মল থেকে।

(৬)

স্তব্ধ লামার দিকে একবার তাকিয়ে সিকিউরিটি-ইন-চার্জ কয়েকবার মাথা নেড়ে ওকে কলার ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। হতবাক লামা অসহায়ভাবে যেতে যেতে হঠাৎ তার কানে এলো খেরা তাল শব্দটা। চকিতে সে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগল কে বলছে খেরা তালের কথা। একটা জুতোর দোকানের সামনে তিনটে ছেলে দাঁড়িয়ে গল্প করছে আর তাদের কথায় ভেসে আসছে খেরা তাল, দ্রৌপদী-কা-দাঁড়া নামগুলো। লামার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল আর সে সিকিউরিটি-ইন-চার্জের হাত থেকে নিজেকে আচমকা ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিয়েই ছুটে গিয়ে দাঁড়াল ছেলেগুলোর সামনে। তারপর সে ওদের জিজ্ঞাসা করল যে তারা খেরা তাল কী করে চেনে? ছেলেগুলো অবাক হয়ে বলল যে তারা ওখানে ট্রেক করতে যাবে, তাই আলোচনা করছে। লামা তখন হাতজোড় করে কাকুতি মিনতি করতে লাগল যে তারা যেন ওকে সঙ্গে নিয়ে যায়। এদিকে সিকিউরিটি-ইন-চার্জ এসে আবার ওর হাত চেপে ধরেছে। তিন বন্ধু মিলে সন্ত্রস্ত লামার কাছ থেকে জানল কী হয়েছে। তারপর ওই সিকিউরিটি-ইন-চার্জকে অনেক অনুরোধ করে লামাকে ছাড়িয়ে নিল। ছেলেটার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ও মিথ্যে কথা বলছে না। তাছাড়া যা বোঝা গেল ওর গ্রাম ওদিকেই। ওরা ওকে ওর গ্রামেও পৌঁছে দিতে পারবে।

তিন বন্ধুর একজন, দীপন লামাকে সঙ্গে করে ওর বাড়িতে নিয়ে এল। দুদিন সেখানেই থেকে লামা ওদের সাথে ট্রেনে চেপে বসল। এই দু’দিনেই দীপন ওর কাছ থেকে সব জেনে নিয়েছে। লামার গ্রাম, কী করে এখানে এল, মলের ঘটনা, ঋতমের ব্যবহার – সবকিছুই। আর রাগে ছটফট করে ভেবেছে ঋতমের মত অমানবিক লোকগুলোর জন্যেই একটা জাতের বদনাম হয়।

(৭)

হরিদ্বার থেকে উত্তরকাশী পৌঁছে দীপনরা ওদের ট্রেক-রুটটা ফাইনালি দেখে নিচ্ছিল যখন, লামা একপাশে বসে শুনছিল। চেনা নামগুলো তার কানে ঢুকছিল আর চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়াচ্ছিল। তাই দেখে দীপন বলল, “এই তো আর একদিন পরেই বাড়ি যাবি। কাঁদিস না।” লামা হঠাৎ দীপনের হাতটা জড়িয়ে ধরে বলল, “দাদা, মুঝে খেরা তাল তক্‌ লে যাওগে সাথ্‌মে? বচ্‌পনসে মেরা সপ্‌না হ্যায় উও তাল দেখ্‌নেকা। ওয়াপ্‌সীমেঁ হাম আপলোগোঁকো মেরা ঘরমেঁ লে যায়েঙ্গে।”

জ্ঞান হওয়া থেকে পাহাড়ী পথে চলে বড় হওয়া লামা দীপনদের সাথে চারদিন হেঁটে আর টেন্টে থেকে অবশেষে পৌঁছলো খেরা তাল – তার স্বপ্নের জায়গা। চারপাশের পাহাড়ের গায়ে সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা গাছের ছায়া এসে পড়েছে তালের জলে, সবুজ রঙের মেখলা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে যেন সেই লেকের জল। সেই সবুজে ছায়া পড়েছে একটা বরফে মোড়া পাহাড়চূড়ারও। পাপাজির কাছে শোনা গল্পের সাথে মিলিয়ে নিয়ে নিতে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো লামার। এই সেই পবিত্র তাল, যার জলে কখনও একটা পাতাও পড়ে থাকে না! এখানেই অপ্সরারা জ্যোৎস্নারাতে নেমে আসে স্নান করতে! সে পায়ে পায়ে তালের কাছে নেমে গিয়ে দু’হাতে বরফঠান্ডা জল আঁজলা করে নিয়ে ছড়িয়ে দিল নিজের মুখে। একবুক নিঃশ্বাস নিয়ে লামা পূব আকাশে তাকিয়ে দেখল একটা তারা মিটমিট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সেদিকে তাকিয়ে লামার চোখ জলে ভরে এল। তারাটা অবিকল যেন তার মায়ের হাসি-মুখ।

অলঙ্করণঃ সায়ন মজুমদার

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে