গল্প হাতি কলাগাছ ও একটি কিশোর শাশ্বতী চন্দ শরৎ ২০১৯

শাশ্বতী চন্দের আরো গল্প  খরগোশের ডিম ও তুয়ার অংক খাতা, উড়ান, পিকুর রাঙাজ্যাঠা

শাশ্বতী চন্দ

“কী সব গল্প বলছিস, ও দাদা, ভূতের, বাঘের গল্প। ভয় করে না নাকি? একা একা আছি।”

হেসেছিল তপন, “দূর বোকা ছেলে। একা কোথায়। আমি তো আছি।”

“তুই কি মা নাকি? নাকি বাবা? তুই তো তুই। আমার থেকে একটুখানি বড়ো। তুই থাকলেও একা থাকা হয়।”

ভাইয়ের কথা শুনে হেসে ফেলেছিল তপন। তা বটে। মাত্রই তো আট বছর বয়স নীলুর। এখনো রোজ রাতে মায়ের আঁচল মুঠো করে ধরে ঘুমায়। এভাবে বাবা মা কে ছেড়ে থাকেনি তো কখনো। তপনও থাকেনি এর আগে।তবু তো তপন অনেকটাই বড়ো। ক্লাস সেভেনে পড়ে।তাই না ছোট ভাই নীলুর দেখভালের দায়িত্ব তপনের ওপর দিয়ে বাবা মা মেজ ভাই অপুকে নিয়ে শিলিগুড়ি গিয়েছেন। এখন নীলুকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঘুম তো ওকেই পাড়াতে হবে।সে গল্প বলেই হোক, বা মাথায় হাত বুলিয়েই হোক।

“গল্প তো গল্পই। তাতে আবার ভয়ের কী? ভীতু গঙ্গারাম একটা।”

“ভয়ের না? যদি ভূত চলে আসে?”

“দূর পাগল। আর বাঘের গল্প বললে কি বাঘ চলে আসবে?”

বিছানায় সোজা হয়ে বসে নীলু, “যদি আসে? আলিপুরদুয়ারেই তো চিতাবাঘ এসে লুকিয়ে ছিল নালায়। সেই যে পার্কের পাশে। তোর মনে নেই? তাহলে আমাদের গ্রামে কেন আসতে পারবে না?”

কথাটা ভুল নয় নীলুর। তপন জানে। জঙ্গলের ধারের এই বনবস্তিগুলোর সত্যি এ একটা বড় সমস্যা। বাবা বলেন, “আগে জঙ্গল আরো বেশি ছিল। মানুষজনও কম ছিল। তবু বন্য জন্তু চট করে গ্রামে ঢুকে আসত না। মানুষের পৃথিবী আর পশুদের পৃথিবী আলাদা ছিল। মানুষ জঙ্গলে ঢুকে পড়লে তাদের বিপদ হত। নচেৎ নয়।”

কিন্তু এখন প্রায়ই লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে চিতা। বাইসনও। হাতির হানা তো আছেই। আজ এ গ্রাম থেকে খবর আসে তো কাল আরেক গ্রাম থেকে। কারণ আর কিছুই না। বাবা বলেন, “মানুষের লোভ। জঙ্গল কেটে সাফ করে দিচ্ছে। বসতি বাড়াতে বাড়াতে জঙ্গলের দখল নিচ্ছে। কোথায় যাবে অসহায় প্রাণীগুলো?”

সত্যি তো তাই। কোথায় পাবে খাবার? তাই না চলে আসে মানুষের রাজ্যে! তারপর মানুষের তাড়া খেয়ে, ক্ষতবিক্ষত শরীরে ফিরে যায় জঙ্গলে। কেউ কেউ ফিরতেও পারে না। চারপাশ থেকে ঘিরে ধরা মানুষের ছোঁড়া অস্ত্রে ঘায়েল হয়ে রক্তভেজা শরীরে ঘুমিয়ে থাকে।

নীলুকে টেনেটুনে বিছানায় শোয়ায় তপন। বাইরে জ্যোৎস্নাধোয়া রাত চিকমিক করছে। আষাঢ় মাসের ভেজা রাত।সন্ধে থেকে তুমুল বৃষ্টি হয়েছে। সরলা জ্যেঠিমার বাড়ি ভাত খেয়ে ফেরার সময় ঝুপ্পুস ভিজেছে দুই ভাই। এখন বৃষ্টি নেই। বৃষ্টির মেঘও নেই। ভ্যাপসা গরম একটা। মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটা ঢিকির ঢিকির করে ঘুরছে ঠিকই তবে সে ঘোরায় তেজ নেই। তাই হাওয়ার আরামও নেই। হুকিং করে নেওয়া ইলেকট্রিকে ভোল্টেজ থাকে না তেমন। সন্ধেবেলায় দু’ঘরে দুটো বাল্ব জ্বলে, এই না কত! এটুকু না হলে পড়াশোনা করতেও কষ্ট হত তপনদের।

একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ে নীলু। ঘুমের ঘোরে মা কে ডাকে। মায়া হয় তপনের। জড়িয়ে ধরে শোয় ভাইকে। কিন্তু তারই চোখে ঘুম নেই। বাবা মাকে ছাড়া একা একা থাকা তারও তো প্রথম। নীলুর সামনে লুকিয়ে রাখলেও এখন এই রাতে মন কেমন করছে মায়ের জন্য। মায়েরও নিশ্চয় করছে মন কেমন তপন আর নীলুর জন্য।

আসলে না গিয়েও উপায়ও তো ছিল না। মাঠেঘাটে সারাদিন খেলে বেড়ায় অপু। কোথা থেকে যে পেরেক ঢুকেছিল পায়ে কে জানে। ডানপিটে ছেলে বাড়িতে বলেনি প্রথমে। গাঁদা পাতার রস লাগিয়ে ভেবেছিল, অন্য সব কাটাকুটির মত এটাও সেরে যাবে। তারপর ব্যথা। ব্যথার চোটে জ্বর। পা ফুলে ঢোল। বস্তিতে ডাক্তারি করেন স্যামুয়েল আংকেল। জ্বর, পেটের অসুখের ওষুধ দেন। তাঁকে  দেখানো হল। তিনি বললেন, “ভালো বুঝছি না। আলিপুরদুয়ারে নিয়ে গিয়ে দেখাও।” তা যাওয়া হল আলিপুরদুয়ারে। সেখানে বড় ডাক্তার দেখানো হল আলিপুরদুয়ায় হাসপাতালের। তিনি বললেন, “ পায়ে পচন ধরেছে। কেটে ফেলতে হবে।”

বাড়িসুদ্ধ লোকের মুখ শুকিয়ে গেল। তপনের এক দূর সম্পর্কের মাসি থাকেন শিলিগুড়িতে। সেখানের হাসপাতালে আয়ার কাজ করেন। সেখানে ফোন করলেন মা। শিলিগুড়িতে নাকি অনেক ভালো ভালো ডাক্তার আছে। যদি না কেটে ওষুধ দিয়ে সারানোর ব্যবস্থা করা যায়। মাসি বলল নিয়ে আসতে নীলুকে। দেখিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। সেজন্যই বাবা মা আজ ভোরেই অপুকে নিয়ে চলে গিয়েছেন শিলিগুড়ি। গাড়ি ভাড়া করে।

যাওয়ার সময় মা তপনকে বলে গিয়েছেন, “কলা আছে ঘরে। কালই কাঁদিটা নামিয়েছে তোর বাবা। কলা আর চিঁড়ে গুড় দিয়ে মেখে খেয়ে ইস্কুলে চলে যাস । ইস্কুলের মিড্ডে মিলে খাবি। রাত্তির বেলাটা নাহয় একটু মুড়ি বাতাসা খেয়ে কাটিয়ে দিস বাপ। একটা রাতের ঝামে্লাই তো শুধু।  পারবি না রে?”

ঘাড় নেড়েছিল তপন। না পারার তো কিছু নেই। তবু মা কী ভেবে বটুয়া থেকে দুটো দশ টাকার নোট আর একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে তপনকে দিয়েছিলেন, “ যদি নীলু বেশি ব্যাগাত্তা  করে খুনিয়ার মোড়ে গিয়ে মোমো খেয়ে আসিস। ঠাকুর করুন, অপুর কিছু না হোক।ঙ্খবর সব ভালো হলে তোদের জন্য শিলিগুড়ির মিষ্টি নিয়ে আসব।”

কিন্তু মুড়ি বাতাসা খেতে হয়নি তপনদের। সরলা জ্যেঠিমা জানতে পেরে খেতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ডাল, আলুভাজা, আর কুঁচো চিংড়ির বড়া দিয়ে পেটভরে ভাত খাচ্ছিল যখন সরলা জ্যেঠিমার বাড়িতে বসে তখনই মনিকাকা খবরটা আনল। বাবা ফোন করেছিলেন মনিকাকার মোবাইলে। কাল ফেরা হবে না। পরশু তরশুও নয়। অপুকে অনেকগুলো টেস্ট করাতে হবে। ডাক্তারবাবু বলেছেন। তারপর সে রিপোর্ট আবার ডাক্তারকে দেখিয়ে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে।

নীলুর মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল সে কথা শুনে। সরলা জ্যেঠিমারও। তপন ঠিকই খেয়াল করেছে। তপন বড়ো হয়েছে এখন। অনেককিছুই বুঝতে পারে। এই বনবস্তির সবার অবস্থাই তো তাদেরই মত। কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালায়। বিশেষ করে এই বর্ষাকালটা যেন চলতেই চায় না। বনের ওপরেরই তো নির্ভর করে বেঁচে থাকে তারা। বা বলা ভালো টুরিস্টদের ওপর। বর্ষাকালে টুরিস্ট আসে না। বক্সা যাওয়ার রাস্তার ধারে চায়ের দোকান চালান তপনের বাবা। বর্ষায় বিক্রিবাটা কম। তাই টানাটানি লেগে থাকে। সরলা জ্যেঠিমার ছেলে পিন্টুদাও সাফারি জিপ চালায়। রোজপাতি তারও এখন কম। তার ওপর দুজনকে বাড়তি যদি কয়েকদিন খাওয়াতে হয়, নিজেদেরই তো টান পড়বে! তাই তখনই তপন ঠিক করে নিয়েছিল, কাল থেকে নিজে রান্না করবে রাতের বেলায়। চাল আলু তো আছেই। একটু সেদ্ধ ভাত করে নিতে পারবে না গ্যাস জ্বালিয়ে! নিজের হাতে কখনো করেনি তো কী? মাকে করতে দেখেছে তো। ওর বন্ধু সীতা যদি মাছের ঝোল, ঘুঘনির মত কঠিন কঠিন রান্না পারে তাহলে তপন কেন পারবে না? ঠিক চালিয়ে নেবে। মোমো খায়নি। টাকাটা আছে। ডিম কিনে আনবে নাহয়। দু’এক ফনা কলা নিয়ে যদি বাজারে বসে, আরো কিছু টাকাও পেয়ে যাবে।চিন্তা কী!

তলিয়ে গিয়েছিল তপন আস্তে আস্তে। ঘুম আঠার মত জুড়ে বসেছিল চোখের পাতায়।সে ঘুমের মধ্যেই আবছা শুনতে পেল, “ দাদা, ও দাদা দ্যাখ, ঘরে একটা পাইপ ঢুকছে।”

পাশ ফিরে শুতে শুতে বলেছিল তপন, “ ঘুমের মধ্যে কথা বলার অভ্যাস তোর গেল না। ঘুমিয়ে পড়।”

মৃদু ধাক্কা দিল নীলু, “ ও দাদা, দ্যাখ না।”

“কেন জ্বালাচ্ছিস বল তো।” বলতে বলতে চোখ খুলেই থমকে গেল তপন। ঘর কই? আলো? জমাট অন্ধকার জানালায়। অন্ধকার নড়ছে। না। অন্ধকারের পাইপ। জংলা গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরময়।

দূরে কোথাও ক্যানেস্তারা পেটাচ্ছে কেউ। ঢং ঢং ঢ্যাং। অনেক লোকের চিৎকার। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে সেই শব্দ। বনবস্তির ছেলে তপন। লক্ষণ চিনে নিতে দেরি হল না। অস্ফুট আর্তনাদ বের হয়ে আসার আগেই ঠোঁটে হাত চাপা দিয়ে আটকাল। নীলুকে বুকে জড়িয়ে পাটিসাপটার মত গোল হয়ে গড়াল বিছানায়। চেপে ধরল নীলুর মুখ গায়ের জোরে। গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। নীলু চিৎকার করে উঠতেই চাপা স্বরে, “ চুপ। একদম কথা না। আমার সঙ্গে আয়। তাড়াতাড়ি।” বলেই হাত ধরে টানল নীলুর। হামাগুড়ি দিতে লাগল।একবার পিছনে ফিরে দেখল নীলুও হামাগুড়ি দিচ্ছে কিনা।

ভাগ্যিস দরজাটা জানালার উল্টোদিকে। দরজার কাছে এসে সোজা হয়ে দাঁড়াল । হাত কাঁপছে। তবু সাহস করে খুলে ফেলল ছিটকানি।  বাইরে আসতে না আসতেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল ওদের বাড়ির একটা দেওয়াল।

“দাদা! হাতি?” নীলুর কান্না মেশানো গলা শোনা গেল।

“হ্যাঁ।” তপনের গলা বুজে আসে। ওদের বাড়িটা ভেঙে ফেলবে। বাড়ির ভিতরের কিছু আর আস্ত থাকবে না। কোথায় থাকবে ওরা? তারপরেই আবার মনে হল, প্রাণে তো বেঁচে গিয়েছে। সেটাই অনেক।

চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকিয়েছে অনেকটাই। তবু হালকা জ্যোৎস্নাতেই দেখা যাচ্ছে। তিনটে হাতি শুঁড় দিয়ে দিয়ে লন্ডভন্ড করছে

উল্টোদিক থেকে ধেয়ে আসছে বস্তির লোকেরা। হাতে মশাল। ক্যানেস্তারা বাজাচ্ছে । চিৎকার করছে মুখে। ওদের দিকে দৌড়াল তপন নীলুর হাত মুঠিতে নিয়ে। কিন্তু দলে মিশে হাতি তাড়ানোর ক্ষমতা আর নেই। এত ভয় পেয়েছে যে শ্বাস পড়ছে দ্রুত। বসে পড়ল বটগাছের তলায়। লোকের কথা শুনে বুঝল হাতির পাল নেমেছে ধান ক্ষেতে। ছিঁড়েখুড়ে একশা করছে সারা বছরের শস্য। এমন সময় সরলা জ্যেঠিমার আর্তনাদ শোনা গেল, “অনিমাদের ঘর ভেঙে ফেলল! ছেলেদুটোর কী হল? হায় হায়, বেঘোরে মরল বুঝি বাচ্চাদুটো।”

সাড়া দেওয়ার ক্ষমতাও বুঝি আর তপনের নেই। নীলুও বাহুতে মুখ গুঁজে বসে আছে।কান্না পাচ্ছে খুব। নেহাত কাঁদলে নীলু আরো ভেঙে পরবে তাই প্রাণপণে নিজেকে সামলাতে চাইছে তপন।

পরের দু’তিনদিন ধরে শুধুই হাতির কথা ভেসে বেড়াতে লাগল বনবস্তিতে। কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারো আবার আঁচ লাগেনি গায়ে। তবে সকলেরই মুখ থমথমে। বয়স্ক মানুষরা বলতে লাগলেন, এর আগে কবে, কীভাবে হাতির হানা দেখেছেন তাঁরা। সেদিন সারা রাত চেষ্টার পর ভোর নাগাদ হাতির পালকে তাড়িয়ে জঙ্গলে ঢুকিয়েছে। দুটো বসতভিটে ভেঙেছে। কানুর মুদির দোকান লন্ডভন্ড করেছে। ধানক্ষেতের সর্বনাশ করেছে। তছনছ করেছে তপনদের ঘর লাগোয়া কলাবাগান। স্কুলের মিড-ডে মিলের চাল রাখার ঘরও ভেঙেছে। বনদপ্তর থেকে লোক এসে দেখে গিয়েছে। ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। ঘর বানানোর টাকাও। কিন্তু সে আর আজ বললেই কাল দেবে না। ততদিনে থাকবে কোথায় তপনরা?

বাবা খবর পেয়ে চলে এসেছেন। মা অপুকে নিয়ে থেকে গিয়েছেন মাসীর বাড়ি। ওই পা দিয়ে বারবার আসা যাওয়ার ধকল নেবে কী করে অপু! তাছাড়া ডাক্তার দেখানোর ব্যাপারও আছে। মন খারাপ হয়েছিল তপনের মা কে না দেখতে পেয়ে। তবে মা যে আজ বীরগঞ্জে ফিরবেনই না, মাসী হাসপাতালে মাকেও আয়ার কাজ জোগাড় করে দিয়েছেন, মাসীর বাড়িতেই ভাড়ায় থাকবেন মা, অপু, তপন আর নীলু। বাবা থেকে যাবেন এখানেই। একা। দোকান ফেলে যে যাওয়ার উপায় নেই। দু’চারদিনের মধ্যেই তপন আর নীলুকে শিলিগুড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবেন বাবা। স্কুল থেকে টিসি নিয়ে গিয়ে নতুন স্কুলে ভর্তি করানো হবে।

আপাতত সরলা জ্যেঠিমার বারান্দায় বেড়ার আড়াল তুলে থাকছে তিনজনে। ভাঙা বাড়ি থেকে টুকরোটাকরা আস্ত জিনিস, বাসনপত্র তুলে আনা হয়েছে। মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে তপন। নীলুও। এই জায়গাটাকে যে এত ভালোবাসত আগে তো বোঝেনি। নীলু যে নীলু, যে মায়ের সঙ্গে শিলিগুড়ি যাওয়ার জন্য জোর বায়না জুড়েছিল, শিলিগুড়িতে বিশাল বিশাল শপিং মল আছে,পার্ক আছে, সেগুলো দেখার জন্য ব্যাকুল  হয়েছিল, তারও মন খারাপ। একটা জায়গায় ঘুরতে যাওয়া মজার হতে পারে। কিন্তু শিকড় উপড়ে অন্য জায়গায় পাকাপাকি চলে যেতে কষ্ট হয় বৈকি। তপনের পায়ে পায়ে ঘুরছে আর বলছে, “হাতিগুলোর জন্যই হল। কেন এল আমাদের বস্তিতে? সেজন্যই তো সব ভেঙে গেল। আমাদেরও আর এখানে থাকা হল না।”

তপন চুপ করে থাকে। গভীরভাবে ভাবে কী যেন।

যাওয়ার দিন সকাল থেকে তপন নেই। নীলুও জানে না কিছু। ঘুম থেকে দেখেছে দাদা পাশে নেই। খোঁজ শুরু হল। মাঠে, স্কুলে, বন্ধুদের বাড়িতে। নেই। কোথথাও নেই। তারপর নীলুই খুঁজে পেল। বন থেকে যে রাস্তাটা বেরিয়ে এসে বস্তিতে ঢুকেছে সেই রাস্তার পাশে বসে কী যেন করছে উঁবু হয়ে।

“কী করছিস রে দাদা?” প্রশ্ন করতে যেতেই দেখতে পেল নীলু তপন বর্ষার জল পাওয়া নরম মাটি খুঁড়ছে কোদাল দিয়ে। গর্ত হচ্ছে গোলাকার। সেই গর্তে একটা ছোট চারা বসিয়ে দিল। কলা গাছের চারা। আরো কয়েকটা চারা পড়ে রয়েছে পাশে। সেগুলোও পোঁতা হবে।

নীলু বলল, “আমাদের বাগানের চারা তো। এখানে পুঁতছিস কেন রে দাদা? আমাদের বাগানে হলে তো আমরা খেতে পারতাম। না হলে বিক্রি করে অন্য জিনিস কিনতাম।”

“সবাই যদি নিজেদের খাওয়ার কথা ভাবি তাহলে ওদের কথা কে ভাববে?”

“কাদের কথা?”

“হাতিদের কথা।”

“তুই হাতিদের জন্য কলাগাছ পুঁতছিস এখানে? হাতিগুলো আমাদের বাড়ি ভেঙে দিয়েছে। আমাদের খাবার নষ্ট করেছে। আর তুই ওদের আদর করে কলাগাছ খাওয়াতে চাইছিস?”  নীলুর রাগ ও বিস্ময়, দুইই খেলা করে একসঙ্গে।

“আমরাও তো ওদের ঘর ভেঙে দিয়েছি। আমরা মানে মানুষরা। আগে বন কত ঘন ছিল জানিস? বাবার থেকে শুনে নিস। আমিও ছোটবেলায় অনেক ঘন বন দেখেছি। বন কেটে ফেলছি আমরা। ওদের খাবার নেই। তাই তো ওরা বস্তিতে এসে হামলা করে।ওরা যদি এখানেই খাবার পেয়ে যায় তাহলে আর বস্তিতে ঢুকবে না। মানুষও ভালো থাকবে। ওরাও। না? তাই তো যাওয়ার আগে এগুলো পুঁতে যাচ্ছি। এখান থেকেই কলাবাগান হয়ে যাবে।দেখবি।”

হয়ত বোঝে নীলু। হয়ত বা বোঝে না। তবে দাদার পাশে সেও উবু হয়ে বসে মাটি খোঁড়ে । হাতির জন্য কলাগাছ পুঁততে।

অলঙ্করণঃ ইন্দ্রশেখর 

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s