ছোটুর খাওয়া দাওয়া-চিত্ত ঘোষাল
ছোটু খেতে ভালোবাসে। একটু বেশিবেশিই ভালোবাসে। জন্মাবার পরই নাদুসনুদুস সুনামটি সে পেয়েছিল। নাদুসনুদুস কথাটায় কোনো দোষ নেই, বরং বেশ একটা আদর-আদর ভাব আছে। কিন্তু এখন ঠাম্মা ছাড়া আর কেউ তার সম্পর্কে ওই কথাটা বলে না। বাড়ির অন্যরা কিছুই বলে না। ইস্কুলের বন্ধুরা যা মুখে আসে তা-ই বলে। মোটু, গজকচ্ছপ, হোঁদলকুতকুত –এই রকম বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি কত কী।
একদিন ইস্কুলে এইসব শুনে মনে খুব কষ্ট হয়েছিল ছোটুর। বাড়ি ফিরে ছ’খানা পরোটা আর আট পিস আলুর দম দিয়ে টিফিন করেও যখন মনের কষ্ট কাটল না, তখন ঠাম্মার পাশে বসে খুব কাঁদল ছোটু।
তার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে ঠাম্মা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে দাদুভাই? কাঁদছ কেন? মা বকেছে?”
“না……।” ছোটু তখন ফোঁপাতে ফোঁপাতে ইস্কুলের সব কথা বলল ঠাম্মাকে।
শুনে ঠাম্মা রেগে আগুন, “কী! আমার নাতিটা একটু নাদুস-নুদুস তাই কারও সহ্য হয় না। সব বাপ-মায়ের কুশিক্ষের ফল। আসুক আজকে খোকা, এর একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব।”
খোকা মানে ছোটুর বাবা। সে অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে না ফিরতে ঠাম্মা তাকে ডেকে পাঠাল।
“কী ব্যাপার মা? এত জরুরি তলব?” বাবা বলল।
ঠাম্মা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ইয়াব্বড়ো করে ছোটুর দুঃখের কথা বলে বলল, “শোন খোকা, এর বিহিত তোকে করতেই হবে। ইস্কুলে গিয়ে হেডমাস্টারকে বলে বাঁদরগুলোকে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা কর।”
“কিন্তু মা, এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে হেডমাস্টারমশাইকে বিরক্ত করা কি ঠিক হবে? তা ছাড়া অত বাচ্চাকে উনি ঠেকাবেন কী করে?”
“তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল ঠাম্মা, “এটা কি বাপের মতো কথা হল খোকা?”
ঠাম্মার কথায় বাবার বোধহয় একটু অপমান হল। বলে, “এত এত খেয়ে আর পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে তোমার নাতির চেহারাখানা যা হয়েছে…”
বাবাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল ঠাম্মা, “ছিঃ! ছি ছি ছি ছি ছি ছিঃ ছিঃ! ওইটুকু তো খায়। তা নিয়েও বাপ হয়ে তুই খোঁটা দিস। যা, তোর মুখদর্শন করতে চাই না আমি।”
বাবা তখনকার মতো পালিয়ে বাঁচল।
দিন কয়েক পরে ছোটু একদিন ঠাম্মাকে চুপিচুপি বলল, “ঠাম্মা, আমার না পা-টনটন হাঁটু-কটকট করে।”
“কী সর্বনাশ,” ঠাম্মার চোখ কপালে, “রোজ করে?”
“হ্যাঁ, রোজ করে।”
“হায় হায়! এ তো ভয়ানক কথা। হাঁটু কটকট করবে আমার, তোর কেন করবে? খোকা, ও খোকা…”
ঠাম্মার চিৎকারে বাবা ছুটে এল।
“ডাকছ কেন মা? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে বড়ো কোনো বিপদ হয়েছে,” বাবা বলল।
“হয়নি! ছোটুর পা টনটন করে, হাঁটু কটকট করে…… বিপদ না?”
“ঠিক আছে,” বাবা বলল, “কাল পাড়ার শম্ভু ডাক্তারকে দেখিয়ে আনব।”
ঠাম্মা রেগেমেগে ধমক দিল, “কী বুদ্ধি! শম্ভু ডাক্তার জ্বরজারি পেটখারাপ সারাতে পারে, এসব কঠিন ব্যামোর চিকিৎসা তার কম্ম নয়। ছোটুকে বড়ো ডাক্তার দেখাতে হবে।”
বাবা ঠাম্মাকে যেমন ভক্তি করে, ভয়ও করে। বলল, “বেশ, তুমি যখন বলছ ব্যথা-বেদনার বড়ো ডাক্তার দামোদর খাঁড়ার কাছে নিয়ে যাব।”
“হ্যাঁ, তা-ই যাবি।”
দামোদর খাঁড়া ভীষণ বড়ো ডাক্তার। পাঁচশো টাকা ফি। পাঁচ মিনিটের বেশি সময় দেয় না কোনো রুগিকে। ছোটুকে নিয়ে তার বাবা গেল চেম্বারে। সাত দিন আগে নাম লেখাতে হয়েছিল। ছত্তিরিশ নম্বরে ছোটুর ডাক এল।
ছোটুকে নিয়ে বাবা ডাক্তারের ঘরে ঢুকতে ডাক্তার বলল, “রুগি কে?”
“এ।” বাবা ছোটুকে দেখিয়ে বলল।
“আপনি?”
“আমি এর বাবা।”
ডাক্তার কটমট করে ছোটুর দিকে তাকিয়ে থেকে বাবাকে বলল, “বলে যান কী কী কষ্ট।”
বাবা অনেক কথা বলার চেষ্টা করছিল, ডাক্তার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “বাস্ বাস্, আর বলতে হবে না। যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে।” বলে ডাক্তার খাঁড়া ঘচঘচ করে প্রেসক্রিপশন লিখতে লাগল। লিখতে লিখতেই বাঁ হাতখানা বাবার দিকে বাড়িয়ে বলল, “দিন। পাঁচশো।”
বাবা তার হাতে পাঁচশো টাকার একখানা নোট দিল। ড্রয়ার খুলে ডাক্তার নোটখানা রেখে ঘটাং করে ড্রয়ার বন্ধ করে প্রেসক্রিপশন বাবার হাতে দিল। তখন সে তাকিয়ে ছিল ছোটুর দিকে। ছোটুর মনে হল মুখখানা যেন এখন একটু হাসি-হাসি। ছোট্ট করে যেন তাকে একটা ভেংচিও কাটল ডাক্তার। ছোটু অবাক হবে না ভয় পাবে বুঝতে পারছিল না।
এদিকে বাবা প্রেসক্রিপশন নিয়ে পড়ে দেখে তাতে একটা ছড়া লেখা।
বেশি খেলে মোটা হয়
মোটা হলে ব্যথা হয়।
ব্যথা চাও সারাতে?
খাওয়া হবে কমাতে।
“এ কী! এ তো একটা পদ্য!” অবাক বাবার মুখ থেকে বেরিয়ে এল।
“পদ্যে প্রেসক্রিপশন লেখা যাবে না এমন কোনো আইন আছে নাকি? জানেন আপনাদের ভালোর জন্যে যদি আমাকে ডাক্তার না হতে হত তাহলে আমি কত বড়ো কবি হতাম?”
ছোটুর মনে হল ডাক্তারের গলায় একটু দুঃখ, একটু রাগ।
বাবা ভয়ে ভয়ে বলল, “তা নয়। মানে, আগে তো কখনও এমন দেখিনি তাই…”
“ঠিক আছে। প্রায় এক মিনিট সময় বাজে নষ্ট হল। আসুন।” ডাক্তার বলল।
বাড়ি ফিরে বাবা ঠাম্মাকে সব বলল। শুনে ঠাম্মার সে কী রাগ কী রাগ।
“ঘোড়ার ডিমের ডাক্তার! ওইটুকু শিশুকে বলে খাওয়া কমাতে! বাড়বৃদ্ধি হবে কী করে? ডাক্তারি করে কেন, ছড়া লিখলেই পারে। খোকা, তুই বিশু ঠাকুরপোর কাছে ছোটুকে একবার নিয়ে যা। ওর পরামর্শ নে।”
পাড়ার বিশুদাদু ঠাকুরদার ছেলেবেলার বন্ধু। খুব বুদ্ধি তার মাথায়। তার বুদ্ধির এক-আধ টুকরো পাবার জন্যে অনেকে যায় তার কাছে। বাবাও ছোটুকে নিয়ে গেল। তাদের দেখে বিশুদাদু বলল, “এই যে হরার ব্যাটা খোকাবাবু, কী সমিস্যে তোমার? আমার কাছে তো সমিস্যে ছাড়া কেউ আসে না।”
লজ্জা পেয়ে একটু ঘাড় চুলকোল বাবা, তারপর ছোটুর ব্যথা-বেদনা, ডাক্তার দেখানোর সব ঘটনা বলল বিশুদাদুকে। বিশুদাদু শুনল মন দিয়ে। তারপর ছোটুকে কাছে ডেকে পেটে একটা ঠুসো মেরে বলল, “পেট তো নয় যেন জয়ঢাক। তা মোটকু মিয়া, খ্যাঁটন কমানো যাবে কি?”
ঠুসোটায় পেটে বেশ লেগেছিল ছোটুর, সে ঠুসোর জায়গাটা খামচে ধরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
“বোঝা গেল, বিশুদাদু বলল, গিলিংশাই যেমন চলছে চলবে।” তারপর কপালে আঙুলের টোকা মারতে মারতে চোখ বুজে মিনিটখানেক ভাবল। চোখ খুলে দাঁত-নেই হাসি হেসে বলল, “খাওয়া কমানো না যাক বাড়ানো তো যাবে। মোটকু মিয়া, চল্ আমার সঙ্গে। তুমি বাড়ি যাও হে ছোটুর পিতা মহাশয়।”
ছোটুর খাওয়া বাড়িয়ে ওর কী উপকার হবে? বুঝতে পারে না বাবা। তবু বিশুদাদুর মুখের ওপর তো কথা বলা চলে না। সে ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথ ধরে। ওদিকে ছোটুর কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে বিশুদাদু বলে, “যা আজ খাওয়াব তোকে রোজ খাবি। যত বেশি খাবি তত ভালো হবে তোর। প্রথম প্রথম খাওয়ার সময় তোর সঙ্গে আমি থাকব। পরে একলা একলা। বাড়িতে ইস্কুলে যেমন খাস খাবি। কোনো কিচ্ছু কমাতে হবে না। কিন্তু একটা কথা, তোকে আজ আমি যা খাওয়াব তার কথা কাউকে বলতে পারবি না এখন। মাকে না, বাবাকে না, ঠাম্মাকে না, বন্ধুদের না, কাউকে না। যখন আমি অনুমতি দেব তখন বলবি। প্রমিস?”
ছোটুর মুখে হাসি ফুটেছে, সে বিশুদাদুর বাড়ানো হাতে হাত রেখে বলল, “প্রমিস।”
তিন মাস পরের ঘটনা। ছোটু খাচ্ছে-দাচ্ছে আগের মতোই। কিন্তু বুকের থেকে তিন ইঞ্চি এগিয়ে থাকা ভুঁড়ি এখন পিছিয়ে গিয়ে বুকের সমান। আগের চাইতে ছোটু এখন অনেক ছটফটে, চনমনে। ঠাম্মা ছাড়া সবাই খুশি।
ইস্কুলের বন্ধুদেরও এটা চোখে পড়ছিল। একদিন ক্লাসের বন্ধু বিভু বলল, “কী ব্যাপার বল্ তো ছোটু, কোথায় গেল তোর সেই থলথলিয়া ভুঁড়ি? কী করে সিলিম হচ্ছিস? খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দিয়েছিস নাকি?”
“দূর পাগলা, কমাব কেন, বাড়িয়েছি।” ছোটু বলল দুষ্টু-দুষ্টূ হেসে।
“ইয়ার্কি হচ্ছে?”
“ইয়ার্কি না, সত্যি বলছি। টিফিনে দেখিস না? কমিয়েছি?”
“না তো। তবে?”
“বাড়িয়েছি।” জোর দিয়ে বলল ছোটু।
এর মধ্যে আরও দু’চারজন বন্ধু জুটে গিয়েছিল। তাদের একজন বলল, “খাওয়া বাড়িয়ে কেউ সিলিম হয়? আমরা বুদ্ধু নাকি যে যা বলবি তা-ই বিশ্বাস করে নেব?”
“বেশ ছুটির পরে কাল তোদের দেখাব। নিজের চোখে দেখবি খাওয়া কত বাড়িয়েছি।”
পরদিন বিশুদাদুর অনুমতি নিয়ে ইস্কুলে গেল ছোটু। ছুটির পরে বন্ধুদের নিয়ে গেল দত্তদিঘির পাড়ে। স্কুলব্যাগ নামিয়ে রেখে বন্ধুদের বলল, “তোরা এইখানে দাঁড়িয়ে দ্যাখ্ আমার খাওয়া।” বলে দিঘির পাড় ধরে দৌড়তে শুরু করল ছোটু।এক পাক খেয়ে এসে দশটা ডিগবাজি খেল। আবার এক পাক। আবার দশটা ডিগবাজি। এমনি করে ছোটু পাক খায় আর ডিগবাজি খায়। বন্ধুরা অবাক হয়ে ওকে দেখতে থাকে। ঘেমেনেয়ে একসময় থামল ছোটু। হাঁপাতে হাঁপাতে বন্ধুদের বলল, “কেমন দেখলি আমার খাওয়া?”
“খাওয়া! কোথায় খাওয়া?” সাদিক বলল।
“বা রে,” ছোটু বলল, “দিঘিটাকে দশ পাক খেলাম, প্রত্যেক পাকের শেষে দশটা করে ডিগবাজি খেলাম। মোট খেলাম দশটা পাক আর একশোটা ডিগবাজি। কম খেলাম? তোরাই বল্। এগুলো খেতে শুরু করার পর থেকেই, বুঝলি কিনা, আমি একেবারে ফিটস্য ফিট। অন্য খাওয়াও সব আগের মতোই চলছে। এই ধর্-না বাড়ি গিয়ে সাঁটাব কমসে কম এক ডজন লুচি, ছোলার ডাল দিয়ে। এখন মানবি তো তোরা খাওয়া বাড়িয়েও রোগা হওয়া যায়?”
বন্ধুরা মাথা চুলকোতে লাগল। আর ফুলকো ফুলকো লুচির স্বপ্ন দেখতে দেখতে ছোটু ছুটল বাড়ির দিকে।
ছবিঃ শিবশংকর ভট্টাচার্য
জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে