গল্প

সোনার কাঠি 

galpoaniruddha01 (Small)

প্রেরণা

তুলি একটি ছোট্ট মেয়ে, ক্লাস সিক্সে পড়ে। হ্যারি পটার খুলে বসে পড়ার অবসরে। একদিন মা এনে দিলেন ‘ঠাকুরমার ঝুলি’।

“এ কী, এ যে বাংলা গল্প”, অবাক হ’ল তুলি।

“পড়েই দেখিস, এই ঝুলিতেও অনেক যাদু আছে। এসব গল্প কত শুনেছি ঠা’মা-দিদার কাছে।” তুলি বইটা তুলে নিল ডিনার সারার পর। সাধু ভাষার হোঁচট, কিন্তু গল্পটা সুন্দর। দেখতে দেখতে ‘কলাবতী রাজকন্যা’ শেষ। সেদিন রাতে তুলির স্বপ্নে নিঝুম পুরীর দেশ।

পরদিন ডিনারের সময় তুলি মায়ের কাছে এসে বলল, “আমার কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে। রাজা, রানি, রাজকন্যা এখন কি আর নেই?”

“গণতন্ত্রে যে নাগরিক, দেশের রাজা সেই।” বললেন মা, “সেই সুবাদে তোরাই রাজকন্যে।”

তুলি বলল, “আরও একটা প্রশ্ন তোমার জন্যে। রূপকথার রাজপুত্তুর অনেক লড়াই করে রাজকন্যার দেশে গিয়ে সোনার কাঠি ধরে গোটা রাজ্য জাগিয়ে তোলে। আর দ্যাখো, রাজকন্যা – তার কাজ কি কেবলই ঘুম, সাজগোজ আর কান্না?”

বাবা বলেন অবাক হয়ে, “ঠিক বলেছে তুলি – একরত্তি মেয়ের মুখে নতুন দিনের বুলি! এ যুগে সব রাজকন্যাও দেশ-বিদেশে যাবে, আকাশ-পাতাল খুঁজে শেষে সোনার কাঠি পাবে। সোনালী সেই উপলব্ধির যাদুর ছোঁয়া লেগে এখনও যাদের চোখ খোলেনি তারাও উঠবে জেগে।”

 প্রয়োগ

সুমিত তিনদিন স্কুলে আসছে না। মোবাইলও সুইচড-অফ। বন্ধুরা চিন্তায় – কী হল? ছেলেটা একদিনও অ্যাবসেন্ট হয় না! কে যেন টিচারদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে বলল, ওর অসুখ।

“এই তুলিকা, তুই তো ওর পাড়াতেই থাকিস। একটু খোঁজ নিস না?” সৈকত বলল।

“বাড়ি চিনি না যে।” তুলি চিন্তিতভাবে বলল, “ঠিক আছে, অফিস থেকে ঠিকানা জেনে নেব।”

সেদিন বিকেলেই তুলি সুমিতদের ফ্ল্যাটে গিয়ে কলিং বেল বাজাল। দরজা খুলে এক মহিলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালেন।

“আমি সুমিতের বন্ধু তুলিকা। ও স্কুলে যাচ্ছে না, তাই খোঁজ নিতে এসেছি।”

“ভেতরে এস। আমি সুমিতের মা।”

“তোমার নাম?” ভেতরে যেতে যেতে তুলি জিজ্ঞেস করল।

“নীলিমা। কিন্তু কেন – কেউ তো জিজ্ঞেস করে না?”

“বা রে, তুমি কী কাকিমা জানতে হবে না?”

নীলিমা অবাক খুশিতে তুলির গাল টিপে দিলেন। তারপর তাঁর মুখ বিষণ্ণ হয়ে উঠল।

“জানো, সুমিতের খুব অসুখ। এক্ষুণি ডাক্তার দেখিয়ে ফিরছি।”

“ওর কী হয়েছে?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল তুলি।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে নীলিমা বললেন, “ও খুব ভয় পেয়েছে। কথা বলছে না।”

তুলির মুখ চুণ হয়ে গেল। বলল, “কেন, কীসের জন্য?”

“সেটাই তো জানা যাচ্ছে না। ডাক্তারবাবু বলেছেন সেটা জানতে পারলে হয়তো ওকে সুস্থ করে তোলা যাবে।”

“ওর সঙ্গে দেখা করা যাবে?”

“যাও, তোমরা বন্ধুরা যদি কথাবার্তা বলে কিছু একটু করতে পারো। তবে ওকে কথা বলাতে বোধহয় পারবে না।”

ওদের কথা শুনে সুমিতের বাবা বেরিয়ে এলেন। তাঁর দিকে চেয়ে নীলিমা বললেন, “অরুণ, এ সুমিতের ক্লাস ফ্রেন্ড তুলিকা। ও কিন্তু খুব ম্যাচিওর্ড মেয়ে, নাম না বললে তোমার সঙ্গে আলাপই করবে না।”

“গুড ইভনিং, অরুণ কাকু।” তুলি মাথা ঝুঁকিয়ে বলল। অরুণের ক্লিষ্ট মুখে একফালি হাসি ফুটে উঠল। বললেন, “যাও, বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে এস।”

সুমিতকে দেখে তুলি একটা ধাক্কা খেল। হাসিখুশি ছেলেটা সব সময় ‘জোক’ করে। খুব নরম, শান্ত প্রকৃতির, গুড বয়। আজ কিন্তু বিছানায় জবুথবু হয়ে বসে কেমন শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তুলিকে দেখে যেন তার চোখে একটা ঝিলিক দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে গেল।

“গুড ইভনিং, সুমিত। কী হয়েছে, স্কুলে যাচ্ছিস না?”

সুমিত চুপ।

“তোর কী হয়েছে? আমাকে বল, আমি কা-উক্কে বলব না।”

সুমিতের ঠোঁট কাঁপল, কী যেন বলার চেষ্টা করল, কিন্তু শেষ অবধি অসহায়ভাবে চুপ করে রইল।

“আচ্ছা বেশ, না বললি। তাচ্চেয়ে আয় আমরা লাঞ্চের সময় যা করতাম, ‘অন্তাক্ষরী’ খেলি। দাঁড়া, আমিই নয় শুরু করছি।” বলে ভুরুটুরু কুঁচকে তুলি ইচ্ছে করেই একটু মোটা গলায় গেয়ে উঠল, “আমার হা-আ-ত ধরে তুমি নিয়ে চ-লো-ও সখা, আমি যে-এ পথো-ও চিনি না-আ-আ। নে ধর – ‘না’।”

তুলি এমন মজা করলে সুমিত হেসে কুটিপাটি হয়। আজও ওর মুখে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল, কিন্তু তারপরই আবার সেটা মিলিয়ে গিয়ে ফিরে এল বিষণ্ণভাব। তুলি একটু হতাশ হলেও মুখে সেটা প্রকাশ না করে চোখ মটকে বলল, “বুঝেছি। তুই কিছু খাসনি, তাই গলায় জোর পাচ্ছিস না। দাঁড়া, তোর জন্য খাবার আনি।”

হাসিমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে তুলি যখন নীলিমার কাছে এল, তার মুখে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে।

“কাকিমা, সুমিতের জন্য কিছু একটু খাবার করে দেবে?”

নীলিমা চিন্তিতভাবে বললেন, “এখন তো ও ফলটল খায়। কিন্তু খাবে কি? আজকাল তেমন রুচি নেই।”

“সে আমি ঠিক খাইয়ে দেব। কিন্তু তুমি এবার বলো তো, ঠিক কী হয়েছিল? কখন থেকে ওর এই অবস্থা?”

“গত শুক্রবার সন্ধেবেলা ওর হোম-ওয়ার্ক হয়ে গেছে। ঘরে বসে কী যেন করছে। হঠাৎ দৌড়ে বেরিয়ে এসে আমায় আঁকড়ে ধরল, চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। আমি সাথে সাথে ওর গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম – কী হয়েছে, বাবা? ও কী যেন বলতে চাইল, কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বেরোল না। ভাবলাম খুব ভয় পেয়েছে, একটু পরই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বেশ কিছু সময় কেটে যাবার পরও ও কিছুই বলে না। আমরা তাড়াতাড়ি ওর ঘরে গিয়ে দেখলাম ভয়ের কিছু আছে কিনা। কিন্তু নাঃ, তেমন কিছুই খুঁজে পেলাম না। তারপর থেকেই –”

“ও কি কোনও বই পড়ছিল, বা মুভি দেখছিল?”

“একটা কমিক বই খোলা ছিল, অ্যাস্টারিস্ক আর ওবেলিস্কের।”

“সে তো পেটফাটা হাসির কমিক। আর কোনও স্মার্টফোন?”

ওর মুখের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে নীলিমা বললেন, “না না, ওকে আমরা স্মার্টফোন দিইনি। স্রেফ দরকারে ফোন করার জন্য একটা সাদামাটা মোবাইল –”

কথাবার্তা শুনে অরুণ ভেতর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তুলি তাঁর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, “আচ্ছা কাকু, তুমি ওদিন কাকিমাকে বকোনি তো?”

“ওরে পাকা বুড়ি!” নীলিমা এগিয়ে এসে তুলিকে একটু আদর করে বললেন, “না রে – তোর কাকু ভীষণ নরম মানুষ, আমাকে কক্ষণও বকে না। বরং আমিই কাকুকে মাঝে মাঝে বকে দিই, তোর বন্ধুকে একটুও বকে না দেখে।”

“কাকুতো ঠিকই করে, সুমিত এত ‘গুড বয়’!”

“তাও তো বটে। কিন্তু বল তো, তার হঠাৎ কী হল?” নীলিমার চোখ আবার ছলছল করে উঠল।

“কাকিমা, তুমি চিন্তা কোরো না। ডাক্তারকাকু বলেছে না, ও ভালো হয়ে যাবে?”

“সে তো ওর ভয় পাওয়ার কারণটা বের করতে পারলে তবে। কিন্তু আমরা যে কিছুই বুঝতে পারছি না, ও নিজেও তো কিছু বলতে পারছে না।”

“ওকে দিয়ে লেখাবার চেষ্টা করেছ?”

“করেছি। কিন্তু সে ব্যাপারেও ওর কোনও উৎসাহ নেই। কে জানে এখন কী হবে!”

“ভেবো না, কিছু একটা উপায় ঠিক বেরিয়ে যাবে। তুমি বরং ওর জন্য একটু খাবার দাও।”

বিছানায় সুমিতের পাশে বসে তুলি ওকে একটা একটা করে আপেলের টুকরো খাইয়ে দিচ্ছে। প্রথমে সুমিতের মোটেই ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তুলি কথাবার্তা বলে, মজা করে ওকে লাইনে এনেছে। খাওয়া শেষ হলে তুলি একগাল হেসে বলল, “বাঃ, গুড বয়!”

খালি প্লেটে কতগুলো আপেলের বিচি পড়ে আছে। টিচার বলেছে জঞ্জাল সব সময় আবর্জনার পাত্রে ফেলতে হয়। তুলি তাই করে। শুধু ফলের বিচির ব্যাপারে ও একটু দুষ্টুমি করে – সুযোগ পেলেই ওগুলো মাটিতে ছড়িয়ে দেয়। সাধারণতঃ কিছু হয় না, তবে একবার ওর ফেলা পেঁপেবিচি থেকে কয়েকটা চারাগাছ গজাতে দেখে ওর ভীষণ আনন্দ হয়েছিল।

এখানেও তাই তুলি এদিক-ওদিক চেয়ে ঘরের মাঝবরাবর একটা খোলা জানালা দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল – নিচে যদি মাঠ বা বাগান থাকে, ওপর থেকে বিচিগুলো ছুঁড়ে দেবে বলে। কিন্তু দু’পা যেতেই হঠাৎ একটা অস্পষ্ট গোঙানি শুনে ও চমকে পেছন ফিরল। দ্যাখে সুমিত দুহাত তুলে ওকে নিষেধ

করছে। উত্তেজনায় তার মুখ লাল, কিন্তু সেসব ছাপিয়ে তার চোখে ফুটে উঠেছে এক বিকট ভয়ের ছাপ।

“কী রে, কী বলছিস – ওদিকে যাব না?”

সুমিত নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তুলি সাথে সাথে বলল, “বেশ, যাব না। তবে তোর যখন এত আপত্তি – দাঁড়া, জানালাটা ভেজিয়ে দিয়ে আসি।”

তাহলে ঐ জানালাটাতেই সুমিতের ভয়! ভেজানোর নাম করে ওদিকে গিয়ে কিন্তু তুলি এক ঝলকে চারপাশ দেখে নিয়েছে। তারপর এসে সুমিতের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “নে, এবার নিশ্চিন্তে একটু ঘুমো দেখি।” সত্যিই সুমিত কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ অপলকে সেদিকে তাকিয়ে থেকে তুলির মনে হল সুমিত যেন এক রূপকথার রাজপুত্তুর – কোন মায়াবীর রূপোর কাঠির ছোঁয়ায় অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আপন মনে বলল, “ওকে জাগিয়ে তোলার সোনার কাঠিটা আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে।”

“কাকিমা, সুমিত ঐ জানালাটা দিয়ে কিছু দেখে ভয় পেয়েছে।”

তুলির কথায় নীলিমা একটু অবাক হয়ে বললেন, “কিন্তু ওটা দিয়ে তো বাইরের তেমন কিছু দেখা যায় না।”

“এক ঝলকে দেখে আমারও তাই মনে হল। তবে কি কোনও জন্তু বা – ইয়ে, মানুষ ওখানে এসে –”

এবার অরুণ বললেন, “না না, ঐ খাড়া দেওয়াল বেয়ে কারও আসা সম্ভব নয়। তারপর আবার গ্রিল লাগানো। এতদিন আছি, কোনওদিন কিছু আসেওনি। এক যদি বাইচান্স বেড়াল এসে পড়ে – কিন্তু সুমিত তো বেড়াল খুব ভালোবাসে।”

“কিন্তু ও ওখান থেকেই ভয়ের কিছু দেখেছে”, বিশ্বাসী কণ্ঠে বলল তুলি। এবার তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। নীলিমা অবশ্য তাকে একটু কিছু মুখে না দিয়ে যেতে দিলেন না।

সুমিতদের ফ্ল্যাটটা তিনতলায়। নিচে নেমে তুলি ওদের জানালার ঠিক তলায় এল। নাঃ, দেওয়ালটা খাড়া। কোনও পাইপও নেই। স্পাইডারম্যান-গোছের কোনও হীরো বা অপরাধীর পক্ষে কি টিকটিকির মতো বেয়ে, কার্নিশ ধরে উঠে জানালা দিয়ে উঁকি মারা সম্ভব? ভাবতে ভাবতে তুলি কমপ্লেক্সের গেটে এসে পড়েছে। সেখানে দ্যাখে সিকিউরিটি অফিসার বসে গম্ভীরভাবে কীসব দেখছেন। তাঁর বুকের ব্যাজে লেখা – ত্রিলোক শর্মা। একটু নজর করে তুলি বুঝল – কমপ্লেক্সে সিসি টিভি লাগানো, তার ফুটেজ দেখা চলছে।

এখানে সবাইকে সই করে ঢুকতে-বেরোতে হয়। বেরোবার সই করার সময় তুলি মিঃ শর্মার দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসল। ভদ্রলোক খুশি হয়ে বললেন, “বন্ধুর বাড়ি এসেছিলে?”

“হ্যাঁ।” তুলি বলল, “আসলে কি জানো আঙ্কল, আমার বন্ধুর একটা দরকারি জিনিস হারিয়ে গেছে। তাই ও খুব মন খারাপ করে বিছানায় শুয়ে আছে।”

“কী জিনিস?” চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।

“সোনার কাঠি, সে আপনি বুঝবেন না।” নিজের মনে বলল তুলি। তারপর মিঃ শর্মার দিকে ফিরে বলল, “আঙ্কল, ঐ চুরিটা যখন হয়েছে – মানে গত শুক্রবার সন্ধে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে – তখন কোনও ভিজিটর এসেছিল?”

“আরে, এ যে দেখছি লিলিপুট গোয়েন্দা!” মনে হল মিঃ শর্মা বেশ মজা পেয়েছেন। তারপর খাতা দেখে বললেন, “মোটে একজন – সে ইস্ত্রিওয়ালা, গত চার বছর ধরে এখানে আসা-যাওয়া করছে।”

“আঙ্কল, বাইরের থেকে কেউ এলে কি খাতায় সই না করে ঢুকতে পারে?”

“এখানের রেসিডেন্ট ছাড়া সবাইকেই সই করে ঢুকতে হয়।” বলেই মিঃ শর্মা একটু কিন্তু-কিন্তু করে বললেন, “আর যদি কেউ কোনওভাবে নজর এড়িয়ে ঢুকেও যায়, সিসি টিভি ফুটেজ আছে না?”

তুলি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে একটু অবাক হয়ে তারপর তিনি হেসে ফেললেন, “ও, খুদে ইয়োমকেশ বক্সীর বুঝি ফুটেজ চাই? আচ্ছা, দাঁড়াও।” এরপর মিনিট কতক কম্পিউটার হাতড়ে তিনি ফুটেজ চালু করলেন। তুলি দেখল শুধু গেট নয়, সুমিতের জানালার দিকের দেওয়ালটাও দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ ফুটেজ চলার পর সে নিশ্চিত হল ওই ইস্ত্রিওয়ালা এসে লিফটের দিকে চলে গেছে, তাছাড়া আর কেউ আসেনি। আর দেওয়াল বেয়েও কেউ বা কিছু ওই সময়ে ওঠেনি।

“তুমি তো চ্যাটার্জি সাবের বাড়ি গিয়েছিলে? উনি তো বলেননি কিছু খোয়া গিয়েছে।”

“না, টাকায় দামি কিছু নয় – তবে আমার বন্ধুর জন্য ওটা খুব দরকারি। এনিওয়ে, থ্যাঙ্ক ইউ আঙ্কল – এখন বুঝলাম ওটা হারিয়েই গিয়েছে, চুরি যায়নি। তাহলে ঠিক আবার খুঁজে পাওয়া যাবে।”

তুলি এ পাড়া মোটামুটি চেনে। সুমিতদের জানালা দিয়ে বাইরে যা দেখা যায় তা হচ্ছে কম্পাউন্ডের মধ্যে একটু খোলা জায়গা, বাইরে একটা রাস্তা, তারপর একটা পার্ক। তার ওপাশে একটা পরিত্যক্ত কারখানার শেড। কম্পাউন্ডে ভয়ের কিছু যে ছিল না, সেটা সিসি টিভি দেখে বোঝা গেছে। আর রাস্তায়, পার্কে তখন লোকজন – সেখানে কিছু ঘটলে তো জানাই যেত। বাকি থাকে পার্কের ওপাশের কারখানার শেডটা। কিন্তু সেটা এত দূরে যে ওখানে কিছু দেখে ভয় পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে?

বাড়িতে গিয়ে তুলি মা-বাবাকে সব খুলে বলল। তাঁরা খুব চিন্তিত হলেন। বাবা বললেন, “মিঃ চ্যাটার্জির নম্বরটা দিস তো, ফোন করব। আমার এক ডাক্তার বন্ধুর এসব ব্যাপারে খুব অভিজ্ঞতা। দরকার হলে যোগাযোগ করিয়ে দেব।”

পরদিন তুলি স্কুলে গিয়ে সুমিতের খবরটা ভাঙল। বন্ধুরা সবাই বিষণ্ণ।

“সুমিত শেষ অবধি পাগল হয়ে গেল!” দুঃখ করে বলছিল গৌরব।

“অমন বলিস না।” তুলি ওকে বকে দিল, “কারুর পেট খারাপ বা জ্বর হওয়া মানে তো এই নয় যে সে মরে গেল। তাকে ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়ে ওষুধ দিয়ে সারিয়ে তুলতে হবে। শরীরের মতো মনেরও অসুখ করে, তখন মনের ডাক্তারবাবুদের কাছে যেতে হয়। তাঁরা কথাবার্তা বলে, দরকার হলে ওষুধপত্র দিয়ে রোগ সারিয়ে দেন। কী যেন নাম তাঁদের –”

“ঐ সাইকো কী যেন?” নন্দিতা ভয়ে ভয়ে বলল।

“হ্যাঁ, অমনই একটা কিছু। সুমিত কেন ভয় পেয়েছে বললেই তিনি ওকে সারিয়ে তুলবেন।”

“কিন্তু ভয় পাবার কারণটা যে বোঝা যাচ্ছে না।” মণিকা বলল।

“হুঁ, সেটাই বের করতে হবে”, বলে তুলি গভীর চিন্তায় তলিয়ে গেল।

ছুটির সময় হঠাৎ ঋদ্ধি তুলির কাছে এল। ঋদ্ধি ক্লাসের গুড বয়, ফার্স্ট বা সেকেন্ড হয়। সাধারণতঃ নিজের পড়াশোনা নিয়েই থাকে, বিশেষ কারও সাথে মেশে না। সুমিতের অবশ্য ও খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

“আচ্ছা তুলি, তুই তো কাল সুমিতের বাড়ি গিয়েছিলি। একটা জিনিস যদি তোর চোখে পড়ে থাকে –”

“কী জিনিস?”

“ইয়ে – একটা বাইনোকুলার। আসলে আমি সুমিতকে শুক্রবার দেখতে দিয়েছিলাম, সোমবার ফেরত দেবার কথা। এখন ওর এই অবস্থা। এদিকে যন্ত্রটার মালিক বাচ্চুদা যে কোনও দিন ফেরত চাইতে পারে। কী করি, বল তো?”

ঋদ্ধি প্রায় কাঁদোকাঁদো। কিন্তু হঠাৎ তুলির দিকে চেয়ে সে অবাক হয়ে গেল। তার চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে, মুখে ফুটে উঠেছে বিস্ময়ের ছাপ। ফিসফিসিয়ে বলল, “কী বললি, বাইনোকুলার?”

“হ্যাঁ রে, ওকে দিয়েছিলাম।”

“ইউরেকা!” বলেই তুলি বাড়ির দিকে প্রায় দৌড় লাগাল। আর ঋদ্ধি ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে রইল।

“আয়”, নীলিমা তুলিকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, “সুমিত একটু ভালো, তবে এখনও –”

“কাকিমা, ও ভাল হয়ে যাবে। মনে হয় ওর ভয় পাওয়ার কারণটা এবার বের করতে পারব। আচ্ছা কাকিমা, ওর কাছে একটা বাইনোকুলার দেখেছ?”

“বাইনোকুলার – উঁহুঃ, আমরা তো ওকে বাইনোকুলার দিইনি।”

“ও এখন কী করছে?”

“বোধহয় ঘুমোচ্ছে। ডেকে দেব?”

“না না, দরকার নেই।” বলে তুলি দৌড়ে সুমিতের ঘরে ঢুকে গেল।

সুমিত সত্যিই ঘুমোচ্ছে। ভালোই হল, ওকে না বলে ঘরে তল্লাসি করা যাবে। এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল তুলি, কিছু চোখে পড়ল না। টেবিল, মেঝে, খাটের তলা কিছুই বাদ গেল না। কিন্তু নাঃ, তেনার দেখা নাই!

“এভাবে হবে না, মনের মধ্যে খুঁজতে হবে”, সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের কথাটা নিজের মনে আউড়ে তুলি ভাবতে বসল। ওর ধারণা সত্যি হলে, সুমিত জানালায় দাঁড়িয়ে ঐ বাইনোকুলার দিয়ে দূরে এমন একটা কিছু দেখেছে, যাতে ও ভীষণ ভয় পেয়েছে। তারপরই ও দৌড়ে কাকিমার কাছে গিয়েছে। কাকিমা যন্ত্রটা দেখেনি, ওটা পথে কোথাও পড়ে গেলেও তো অ্যাদ্দিনে চোখে পড়ত। তাহলে?

তুলি এবার জানালার কাছে গিয়ে বাইরে উঁকি মারল। যা ভাবা – জিনিসটা জানালার ঠিক নিচে কার্নিশের ওপর পড়ে আছে। নিশ্চয়ই সুমিত ভয় পাবার পর ওর হাত ফস্কে পড়ে গেছে! তুলির ছোট্ট ছোট্ট হাত অবশ্য অদ্দুর পৌঁছলো না। শেষে কাকু একটা হুকওয়ালা লাঠি জোগাড় করে ধীরে ধীরে ওটাকে তুলে আনলেন।

কী সৌভাগ্য, সুমিত তখনও ঘুমোচ্ছে। তুলি জানালায় দাঁড়িয়ে যন্ত্রটা বাইরে ঘোরাল আর সাথে সাথে সুদূর তার হাতের মুঠোয় চলে এল। সেই পার্কের ওপারের পরিত্যক্ত কারখানার শেডটা যেন সামনেই দেখা যাচ্ছে। তুলি সেখানে ফোকাস করল আর তার হাত থেকে বাইনোকুলারটা পড়ে যাবার উপক্রম হল। তার মুখচোখের অবস্থা দেখে কাকু তাড়াতাড়ি যন্ত্রটা হাতে নিলেন আর পরক্ষণেই বলে উঠলেন, “উঃ, কী ভীষণ কাণ্ড!” তারপরই তিনি দ্রুতহাতে মোবাইলে একটা নম্বর ডায়াল করতে লাগলেন।

তুলি বাইনোকুলারটা আবার চোখে লাগাল। না, কোনও ভুল দেখেনি – ঠিক যেন তার ক’হাত দূরে বেঞ্চে বসে একটা ছোট ছেলে। তার সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত আর তার সামনে-পেছনে দুটো ভয়ঙ্কর দেখতে লোক পিস্তল আর চাবুক নিয়ে হাত-পা নেড়ে তাকে শাসাচ্ছে। এতদূর থেকে মনে হচ্ছে যেন একটা সাইলেন্ট ফিল্ম!

তারপর তো ঘটনা এমন ঝড়ের বেগে ছুটতে লাগল যে তুলি আর তাল রাখতে পারল না। অরুণ কাকুর সাথে এস-পি মিঃ সেনের চেনা ছিল। তাঁকে ফোন করামাত্র তিনি ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। তারা গিয়ে ঐ গুণ্ডা দুজনকে গ্রেফতার করে অভিমন্যু বলে ছেলেটিকে উদ্ধার করল। পরদিন কাগজে, টিভিতে হৈ-চৈ – এক ক্লাস নাইনের ছেলের দারুণ সাহস আর এক ক্লাস সিক্সের মেয়ের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ফলে দুই খুনি প্রমাণসহ গ্রেপ্তার। ঘটনার বিশদ বিবরণ প্রকাশ করা হলেও ওই ছেলেমেয়ে দুজনের নাম গোপন রাখা হল, যাতে ওরা পরে ঐ খুনেদের দলের প্রতিশোধের লক্ষ্য না হয়।

কিন্তু তাতে তো তুলির মূল উদ্দেশ্য সফল হল না। সুমিত যে এখনও সুস্থ হল না! কিন্তু ডঃ মুন্সী বললেন ওর অসুস্থতার কারণ যখন জানা গেছে, তখন আশা করা যাচ্ছে তিনি ওকে আবার স্বাভাবিক করে তুলতে পারবেন। ডাক্তারবাবু, সুমিতের মা-বাবা, এস-পি মিঃ সেন আর তুলি মিলে ডাক্তারবাবুর চেম্বারে এক ছোটোখাটো কনফারেন্সের পর একটা প্ল্যান ঠিক করা হল।

সেদিন শনিবার, স্কুল ছুটি। সন্ধেবেলা তুলি সুমিতের বাড়ি গিয়ে ওর সাথে দেখা করল। সুমিতকে একটু ফ্রেশ লাগছে। তুলি কিছুক্ষণ গল্পগাছায় ওকে মাতিয়ে রেখে শেষে টুক করে ছাড়ল, “কী রে, অ্যাদ্দিন চুপচাপ ঘরে বসে – চল, একটু বেরিয়ে আসি।”

সুমিতের চোখে হঠাৎ ভয়ের ছায়া। তুলি মিষ্টি হেসে বলল, “ভয় পাচ্ছিস? তোর ভয়ের কারণ কেটে গেছে। চল, দেখবি।” বলে ওকে হাত ধরে জানালার দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করল।

সুমিত আপত্তি করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তখনই ঘরে ঢুকল একটি বছর চোদ্দর ছেলে। সুমিতের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভয় কীসের? চেয়ে দেখ – আমি কি ভয় পেয়েছি?” সুমিত ওর দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল, “তুমি – তুমি না ঐখানে ছিলে? তোমাকে না মারছিল?”

ছেলেটি সুমিতের কাঁধ চাপড়ে বলল, “না রে, গুণ্ডা দুটো ধরা পড়েছে। আমাকে আর কেউ মারবে না। কিন্তু ভাগ্যিস তুই সেদিন আমায় দেখেছিলি, নইলে –”

কিন্তু ওকে শেষ করতে না দিয়েই তুলি চেঁচিয়ে উঠেছে, “সুমিত কথা ব-লে-ছে!” আর সাথে সাথে ঘরে ঢুকে পড়েছেন নীলিমা, অরুণ, ডঃ রুদ্র আর মিঃ সেন। সবাই হাসছেন। প্রথম কথা বললেন ডঃ রুদ্র, “তাহলে আমাদের প্রথম প্ল্যানেই কাজ হাসিল, দ্বিতীয়টার আর দরকার হল না।”

তুলি বলল, “তা’বলে আমরা কিন্তু প্রোগ্রাম বাতিল করছি না। এদিকে আয় সুমিত, দ্যাখ –”

সুমিতকে ও হাত ধরে জানালার কাছে নিয়ে এল। এবার সুমিত তেমন আপত্তি করল না। তুলি এবার ওর হাতে বাইনোকুলারটা তুলে দিল। সুমিত মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই ভাঙা কারখানার শেডের দিকে ফোকাস করল আর বলে উঠল “এ কী!”

তুলি খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল। সুমিতের চোখের সামনে তখন একটা

আলোকমালায় সাজানো উঠোন। সেখানে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা সেজেগুজে খুশিতে ঘুরছে-ফিরছে।

“ওখানে একটা পার্টি হচ্ছে।” বললেন মিঃ সেন, “পুলিশের তরফ থেকে আমরা পার্টিটা দিচ্ছি, তোমাদের তিনজনের সম্মানে। চলো, এখন আমরা ওখানে যাব।”

 যেতে যেতে অভিমন্যু সুমিতকে শোনাল তার রোমহর্ষক কাহিনী। ও উত্তর কলকাতায় থাকে। মোবাইলে ফটো তুলে বেড়ানো ওর বাতিক। সেদিন বাড়ির থেকে একটু দূরে এক নির্জন রাস্তায় কিছু গাছপালার ফটো তুলছে, এমন সময় দেখে দুটো গুণ্ডা একজনের ব্যাগ কেড়ে নিয়ে পালাচ্ছে। ও তখন অনেকটা দূরে, কাছাকাছি কেউ নেইও যে চিৎকার করে ডাকবে। তাই ও মোবাইলেই ঘটনাটার ভিডিও তুলতে থাকে। হঠাৎ দেখে ব্যাগের মালিক একজন গুণ্ডাকে জাপটে ধরল আর গুণ্ডাটা মালিকের বুকে গুলি করল। অভিমন্যুর বুক হিম হয়ে গেল। তক্ষুণি অন্য গুণ্ডাটা ওকে দেখতে পেয়ে তাড়া করল। অভিমন্যু পাগলের মতো দৌড়তে দৌড়তে একফাঁকে এক চেনা পানওয়ালার কাছে ওর ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা সাবধানে রেখে দাও, আমি পরে নেব।” কিন্তু তারপর পালাতে গিয়ে সে লোকদুটোর হাতে ধরা পড়ে গেল।

খুনে দুজন বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে ওকে একটা গাড়িতে তুলল, তারপর এখানে-ওখানে ঘুরিয়ে ওদের এই ডেরায় নিয়ে এল। ওরা দেখেছিল যে ছেলেটা মোবাইলে খুনের ঘটনাটার ফটো তুলছে, কিন্তু ওর কাছে মোবাইলটা পেল না। অভিমন্যু তখন ওদের ধাপ্পা দিল যে মোবাইল ও একজনের কাছে রাখতে দিয়েছে আর বলে এসেছে যে সাতদিনের মধ্যে যদি সে ওটা ফেরত নিতে না আসে তবে যেন ওটা পুলিশকে দিয়ে দেওয়া হয়। খুনে দুজন জিনিসটা কোথায় বলার জন্য ওর ওপর অনেক অত্যাচার করে আবার লোভ দেখায় যে জিনিসটা পেলেই ওরা ওকে ছেড়ে দেবে। সাতদিন যত ঘনিয়ে আসে, অত্যাচার ততই বাড়তে থাকে। কিন্তু সব সহ্য করেও ও মুখ বন্ধ করে থাকে – কারণ ও জানত খুনের ও-ই একমাত্র সাক্ষি, তাই জিনিসটা হাতে পেলেই লোকদুটো ওকে শেষ করে দেবে।

এভাবে আধপেটা খেয়ে চাবুক আর পিস্তলের বাটের মার সহ্য করে ও কদ্দিন টানতে পারত কে জানে। এমনও নয় যে ও কোনও লোকের চোখে পড়তে পারত। ঐ ডেরাটার আশেপাশে কোনও লোকবসতি নেই। কারখানার উঁচু দেওয়ালের জন্য পাশের পার্ক থেকেও কারখানার ভেতরে কী হচ্ছে দেখা যায় না। তাছাড়া কারখানার লাগোয়া অংশে খুব ঝোপঝাড় দেখে সেদিকে লোকজনও বিশেষ যায় না। অনেক দূরে সুমিতদের যে হাউসিং কমপ্লেক্স, সেখান থেকেও ঐ কারখানা নজরে আসার কথা নয়। কিন্তু ঘটনাচক্রে যেদিন ওরা অভিমন্যুকে নিয়ে এল সেদিনই ওই শেডের দিকে বাইনোকুলার তাক করল সুমিত।

 “আমি হঠাৎ দেখি, ঠিক যেন আমার সামনেই দুটো ভয়ঙ্কর চেহারার লোক একটা ছেলেকে অমানুষিক মার মারছে। দেখেই আমার মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল, মনে হল ওরা এবার আমাকে ধরবে।”

“হ্যাঁ, ঠিক তাই মনে হয় – যেন ঘটনাটা আমাদের থেকে ক’হাত দূরে ঘটছে।” তুলি ওকে সমর্থন জানাল।

galpoaniruddha03 (Small)“তারপর যে কী হল ঠিক বলতে পারব না। যেন আমার বুকের ওপর একটা বিরাট পাথর চেপে বসে আছে, কিছু বলতে গেলেই কে চেঁচিয়ে উঠছে – খুন করে ফেলব! ইস, আমি যদি তখন হুঁশে থাকতাম – তবে এই ছেলেটা আরও কতদিন আগে রেহাই পেত!”

“বেটার লেট দ্যান নেভার!” অভিমন্যু সুমিতের পিঠ চাপড়ে ভরসা দিতে দিতে বলল, “কিন্তু দেখলি তো –যতটা দেখায়, ভয় আসলে তত বড় নয়। ভবিষ্যতে মনে রাখিস।”

সুমিত ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

নীলিমা তখন তুলির দিকে চেয়ে বললেন, “কিন্তু তারপর তোরা দুজনেই কিন্তু রেহাই পেলি এই ছোট্ট বন্ধুটার জন্যে। ধারালো বুদ্ধি দিয়ে ও একের পর এক ধাপ পেরিয়ে আসল সত্যে না পৌঁছলে অভিমন্যুর ব্যাপারটাও আমরা জানতাম না আর সুমিতও তাহলে সুস্থ হোত কিনা কে জানে!”

সবার সপ্রশংস দৃষ্টির সামনে তুলি একটু লজ্জা পেয়ে কথা ঘোরাবার জন্য বলল, “আচ্ছা, অভিমন্যুর মোবাইলটা আবার পাওয়া গেল?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওটার ভিডিওতে তো খুনের ঘটনাটা স্পষ্ট ধরা পড়েছে। খুনিদের সাজা দিতে আর কোনও অসুবিধা হবে না।” বললেন মিঃ সেন।

“অভিমন্যুর বাড়ির লোকজন কোনও খোঁজ করেনি? পুলিশে খবর দেয়নি?”

“তা আবার দেয়নি! কাগজে, টিভিতেও নিরুদ্দেশ ঘোষণা করা হয়েছিল।”

“তবু পানওয়ালার খেয়াল হয়নি?”

“নাঃ! সে নাকি সারাদিন দোকানে বসে থাকে, তাই কাগজ পড়ার বা টিভি দেখার সময় পায় না। শুধু এফ-এম রেডিওয় গান শোনে।”

তুলি বিজ্ঞের মতো বলল, “সেনকাকু, এবার থেকে তাহলে তোমরা নিরুদ্দিষ্টদের বাড়ির লোকজনকে কাগজ, টিভির সাথে সাথে এফ-এম রেডিওতেও বিজ্ঞাপন দিতে বোলো।” সবাই হেসে উঠল।

তারপর আর কী? অনেক নাচাগানা, আনন্দ-ফুর্তি, খাওয়া-দাওয়ার মধ্য দিয়ে পার্টি সারা হল। যাবার আগে মিঃ সেন এই ঘটনার তিন নায়ক-নায়িকাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন তারা বড় হয়ে কী হতে চায়।

“আমি নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট হব”, সুমিত বলল। অভিমন্যুর ইচ্ছে, সে ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার আর ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার হবে।

“আর আমাদের পিন্ট সাইজের সত্যান্বেষী?”

সবার কৌতুহলী দৃষ্টির সামনে তুলি কিন্তু কী যেন ভেবেই চলেছে। শেষে প্রায় নিজের মনেই ফিসফিসিয়ে বলল, “আমি সোনার কাঠি খুঁজব।”

“সোনার কাঠি খুঁজবে?” কিছুক্ষণ অবাক হয়ে থাকার পর মিঃ সেন হো হো করে হেসে উঠলেন, “মানে গোয়েন্দা হবে? বাঃ, বাঃ! তদ্দিনে এই কাকুটা হয়তো চাকরিতে থাকবে না। তবু তুমি আমার কাছে এস, আমি সাহায্য করব।”

পরিণতি

চলো এবার দেখে আসি যাদুর ঝাঁপি চড়ে – কী ঘটছে এখন থেকে বছর বারো পরে। অভিমন্যু সাব-এডিটর জার্নালিজম প’ড়ে। সুমিত এখন ‘বোসন’ নিয়ে ‘সার্ন’-এ রিসার্চ করে। সেদিনের সেই ছোট্ট তুলি আজকে পাক্কা ‘লেডি’। ডাক পড়লেই যাবার জন্যে গাড়িও আছে রেডি। তবে কী, তার কাজটা তো সেই সোনার কাঠি খোঁজা – বোবাকাঠি হঠিয়ে মনের হালকা করা বোঝা। গোয়েন্দা নয়, তুলি এখন শিশুর কাউন্সিলার। ওদের কাছে তুলি আন্টি বেজায় পপুলার।

এখন সবার জীবন যেন ফোর্থ গীয়ারে, তাই ইঁদুর দৌড়ে ছোটোদেরও কোনও রেহাই নাই। অঙ্ক, ড্রইং, ক্রিকেট, গীটার – চাপের ঘুর্ণিঝড়ে ছুটতে গিয়ে মন কখনও মুখ থুবড়ে পড়ে। ছুটতে ছুটতে পড়ে গিয়ে শরীরে চোট পেলে আঘাত কোথায় লেগেছে তার খোঁজ সহজেই মেলে। মনের আঘাত খুঁজে পাওয়া অত সহজ নয়। ছোট ছোট বুকের ভেতর জমতে থাকা ভয় একদিন মন অবশ করে। পারফরমেন্স ডাউন। ফ্যালফেলিয়ে বসে থাকা ঠিক যেন এক ক্লাউন। “কী হল রে? তুই তো পারিস, আর একটু পড়।” তাতেও কোনও কাজ না হলে টিটকিরি, কিল, চড়। তবুও যদি কেস গুবলেট, বেবাক ফন্দি ফাঁক, তখন পড়ে লেক টাউনের তুলি আন্টির ডাক।

তুলি এসে দরদ দিয়ে সমস্যাটা বোঝে। খুদের সাথে ভাব করে সে সোনার কাঠি খোঁজে। কোথায় ব্যথা খুঁজে পেলে স্নেহের পরশ লাগায়। ভরসা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে অসার মনকে জাগায়। বলে – ভয়কে যত দেখায় অতটা সে নয়, ছুটতে গেলে ছাড়তে হবে হোঁচট খাবার ভয়। পরীক্ষা ফেল হয়েও জেনো নোবেল পাওয়া যায়। বুক ফুলিয়ে এগিয়ে চলো তোমার দুনিয়ায়।

ভবিষ্যতের গপ্পোটুকু বিশ্বাস না হলে – বছর বারো ধৈর্য ধরো, দেখবে কেমন ফলে!

ছবিঃ ইন্দ্রশেখর

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে