কাশীতে
শিবশংকর ভট্টাচার্য
“এই শুনছো? ঘুমিয়ে পড়লে? এই-” গৌরী ঠেলছেন শান্তিকে। কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল শান্তির।
“কী বলছ?”
“কী কান্ড,দরজা জানলা বন্ধ না করেই শুয়ে পড়েছ!”
ধড়মড় করে উঠে বসলেন শান্তি। উঠেই থতমত খেয়ে গেলেন। মাঘমাসের কড়া শীতের রাত। দরজা জানলা সব হাট করে খোলা! কিন্তু তিনি তো একরকম ভুল করেন না! রোজ সব বন্ধ করেই তো তিনি শুতে আসেন। যাক হয়তো ভুলেই গেছেন। উঠে সব খিল-ছিটকিনি এঁটে সদর দরজায় তালা দিয়ে এসে শুয়ে পড়লেন শান্তিজীবন। দূরে কোথাও পেটাঘড়িতে ঘন্টা পড়ল ঢং। রাত একটা।
শান্তিজীবন কাশীতে বদলি হয়ে এসেছেন বেশ কিছুদিন হল। বড়ো দায়িত্ব নিয়ে সরকারী অফিস সামলাতে হয়। থাকবার জন্য যে বাড়িটা পেয়েছেন তাকে রাজবাড়ি বললে ভুল হবে না। কাশীর মত প্রাচীন আর বনেদি শহরেও এরকম বিশাল বাগানওয়ালা বাড়ি বেশি নেই।
কলকাতা থেকে কাশীতে বেড়াতে এলেন শান্তিজীবনের বড়দিদি বীণাপাণি আর তাঁর ছেলে শ্যামল। বাড়িটা বড় ভালো লেগে গেল তাঁদের। শ্যামলের ছবি আঁকার হাত আছে। বাড়িটার কয়েকটা ছবি এঁকে ফেললেন। ছবিতে প্রাণ দেবার জন্য কিছু মানুষও আঁকলেন। রাতে ঘুমিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখলেন দোতালার সিঁড়ি বেয়ে নেবে আসছে আনেক লোকজন। বাড়িতে যেন কারো বিয়ে হচ্ছে। ঘুম ভেঙে যাবার পরেও যেন লোকজনের ব্যস্ত চলাফেরার শব্দ পেলেন শ্যামল। রাতের ঘুম চলে গেল তাঁর।
বীণাপাণীরও মনে হল কারা যেন তাঁর দিকে নজর রাখছে সবসময়। বাগানে গিয়েও শান্তি নেই। কে যেন পিছু পিছু হাঁটছে। বেশ ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। ভাইকে বাড়ি বদল করতে বলে কলকাতায় ফিরে গেলেন বীণাপাণী।
শহরে মাঝখানে পনেরো কুড়ি বিঘে জমির মাঝ বরাবর বাড়ি। দু’মানুষ উঁচু দেউড়ি থেকে চওড়া নুড়িবিছানো রাস্তা চলে গেছে বাড়ি অবধি। দোতলা বাড়ি এখনকার মাপে ছ’তলা সমান উঁচু। দশ-বারোটা চওড়া সিঁড়ি ভেঙে একতলার ঘর। পথের দুপাশে ফুলের বাগান,লেবু আর পেয়ারাবাগান। বাড়ির পেছনে তরিতরকারির বাগান আর বিশাল মিষ্টি জলের ইঁদারা। তিন-চারজন মালি বাগানে দেবার জল তোলে পুরোন কাঠের লাটাখাম্বা ধরে ঘুরে ঘুরে সুর করে গান গাইতে গাইতে। মাঝে মাঝে ময়ূররা এসে বসে থাকে ছাদের ওপর। পায়রার দল সকাল-বিকেল উঠোনে নেমে আসে দানা খেতে। তাদের বকমবকম ছাড়া সারাদিন কোথাও কোন শব্দ নেই।
কাশীর শীত বড় তেজি! কিন্তু রোদ পোহাবার জন্য ছাদে যাবার উপায় নেই। দোতলার লোহার দরজায় বড়ো বড়ো তালা ঝুলছে!অতবড়ো বাড়ির ওপরতলায় কেউ থাকে না। বাড়ির মালিদের কাছে খবর পাওয়া গেল আগে মালিক জমিদারবাবু থাকতেন,এখন তিনি অন্য জায়গায় থাকেন। ম্যানেজার বা নায়েববাবু মাসে মাসে ভাড়া নিয়ে যান। কেন থাকেন না জিজ্ঞেস করলে কোন জবাব পাওয়া যায় না।
কী জানি কেন শান্তিজীবনের মনে একটু খটকা লেগেই রইল। বিশেষ করে সে রাতের ঘটনার পরে। গুন্ডা বদমাশদের ব্যাপারে কাশী শহরের বেশ বদনাম আছে। যতবড়ো পাঁচিলওয়ালা বাড়িই হোক, রাত্তিরে দরজা বন্ধ রাখার একটা রেয়াজ আছে। শান্তি কিছুতেই মানতে পারেন না সেদিন তাঁর ভুল হয়ে গেছিল। তবে আজকাল ডায়েরি লেখার আগে দরজা জানলা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দেন, ডায়েরিতে সে কথা লেখাও থাকে।
দিন কতক বাদে আবার গৌরী ব্যস্ত হাতের ঠেলায় ঘুম ভেঙে গেল শান্তির! ভয়ে গৌরীর কথা বলার ক্ষমতা নেই। আবার দরজা জানলা হাট করে খোলা। আর চাঁদের ঝাপসা আলোয় দেখা গেল ঘরের মধ্যে দুটো বড়ো বড়ো কুকুর! ভয় পাবার কথা হল এ রকম কুকুর কাশীর শ্মশানঘাটে দেখতে পাওয়া যায়, যারা আধপোড়া মরা মানুষের মাংস খায় বলে শোনা যায়! তখন গরিব মানুষেরা অনেক মৃতদেহের মুখাগ্নি করে গঙ্গার ধারেই ফেলে রেখে যেত।
হাতের কাছেই বেডসুইচ ছিল। আলো জ্বলে উঠবার পর কুকুরটুকুর দেখা গেল না। শান্তি ডায়েরি দেখালেন গৌরীকে। দরজা বন্ধ করার কথা স্পষ্ট লেখা আছে। বাকি রাত জেগেই কাটল দুজনের।
কয়েকদিন বাদে আবার এক মেরুদন্ড হিম করে দেবার মতো ঘটনা! সেদিন ভরা অমাবস্যা। মাঝরাতে শান্তির ঘুম নিজের থেকেই ভেঙে গেল। বিছানায় উঠে বসে বেশ কিছুক্ষন অনুভব করলেন পালঙ্ক ঘিরে কিছু মানুষ ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে, স্পষ্ট পায়ের শব্দ শুনছেন শান্তি। কারো পায়ে পরা নুপুরের শব্দও শুনতে পাচ্ছেন। গৌরীরও ঘুম ভেঙেছে! ভয়ে ভয়ে বেডসুইচ টিপলেন শান্তি। ঘরে কেউ নেই! দরজা জানালা হাঁ করে খোলা।
সকালে উঠেই পুলিশে খবর দিয়ে রাখলেন শান্তি। অবশ্য এ ব্যাপার তারা কী করতে পারবে সে ব্যাপারে সন্দেহ ছিল তাঁর। পুলিশ অভয় দিলেও তাদের আচরণে মনে হলো যেন কিছু গোপন করতে চায় তারা। সহকর্মীরা সকলেই বাড়ি বদলের পরামর্শ দিলেন। প্রতিবেশীদের সাথে তেমন যোগাযোগ না থাকলেও কেউ কেউ সেধে এসে বলে গেলেন অন্য বাড়ি দেখে নিতে।
শান্তি উঠেপড়ে বাড়ি খোঁজ করতে লেগে গেলেন। সে সময় কাশীতে ভালো বাড়ি খালি পাওয়া বেশ কঠিন ছিল।
কোনও কারণে বেশ কিছুদিন আর কোনও ঘটনা না ঘটায় বাড়ি ছাড়ার তাগিদাটা কমে গেল। কেউ কেউ বললেন ভাল বাড়িটা হাত করবার জন্য বদলোকেরা কোনও রকমে ভয় দেখাতে চায়। বাড়ি ছাড়ার দরকার নেই তাড়াহুড়ো করে। হয়তো জানালা দরজায় কোন গোলমাল আছে। নিজের থেকেই খুলে যায়।
বাড়ির ছোটোদের সাথে মাঝে মাঝে জমিদারের নাতি খেলতে আসত। অন্য বাড়ি থেকে চাকরেরা নিয়ে আসত তাকে। বছর সাত কি আট বয়স তার। বাইরের বাগানে খেলাধুলো করে বিকেল বিকেল বাড়ি ফিরে যেত ছেলেটা। ভুলেও বাড়ির ভেতর আসতে চাইতো না। কে এক বীরুমালা নাকি ভয় দেখাবে। বন্ধুরা যখন তাকে বোঝাবার চেষ্টা করত ও বাড়িতে বীরুমালা বলে কেউ থাকেনা। ও আঙুল দিয়ে ছাদের দিকে দেখাত-ওইতো!
ছোটোদের কথার গুরুত্ব চিরকালই কম দেয়া হয়। তবে তারা মাঝেমাঝেই নানান খবর দিতে আরম্ভ করল। বাড়িটা নাকি জ্যান্ত। দোতলার জানালাগুলো চোখ পিটপিট করে। পেয়ারা আর লেবু কে যেন আগে পাড়িয়ে কুড়িয়ে এনে দেয় বাগানে গেলেই। এ খবর যার মুখে শোনা গেল তার বয়েস তখন সবে তিন পেরিয়েছে। মাঝ থেকে ছোটোদের বাগানে যাওয়া বন্ধ হল।
বিনা মেঘে বজ্রাঘাত বলতে যা বোঝায় তাই ঘটল এবার। সপ্তাহদুয়েক কোনও রকম অসুবিধে না হওয়ায় নিশ্চিন্ত সকলে। ঠাকুরমা নাতিনাতনীদের গল্প বলতে বলতে ঘুম পাড়াচ্ছেন। শান্তি দরজা-জানালা বন্ধ করে ডায়েরি লেখা শেষ করেছেন। হঠাৎ দোতলার ওপর থেকে অদ্ভুত একটা শব্দ তাঁর কানে এল! ধুপ ধুপ শব্দ। যেন কেউ ভারী পা ফেলে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু দোতলায় তো কেউ থাকে না! ওপরে যাবার সিঁড়ির ভারী লোহার গেট তালাবন্ধ থাকে, শান্তিজীবনের কাছে তার চাবি!
শব্দের জোর বাড়ছে একটু একটু করে। কখনও হামানদিস্তায় মশলা বাটার শব্দ। খাট্ পালংক টানাটানি। কাচ ভাঙার শব্দ। সব মিলিয়ে ভয়ংকর অবস্থা! তবে কি পাইপ বেয়ে কেউ ছাতে উঠে গেল? যদি উঠেও থাকে তবে সে সবাইকে জানান দিতে চায় কেন? ফোন গেল থানায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক গাড়ি বন্ধুকধারী পুলিশ নিয়ে ইন্সপেকটর বাড়ি ঘিরে ফেললেন।
রাতের অন্ধকারে বাড়িটা যেন কোন নাম না জানা প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ারের মতো খাপ পেতে রয়েছে। কাছে গেলেই গিলে খাবে। সারাবাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও শব্দের কোনও কিনারা করা গেলনা। দোতলার মর্চে ধরে যাওয়া তালা খুলে সার্চলাইটের আলো ফেলে দেখা হল। মেঝেতে বছরের পর বছর জমে থাকা ধুলোর ওপর কোন পায়ের ছাপ পড়েনি কারও। খাট পালংক যথাস্থানেই আছে। কাচ ভাঙার বা অন্য কিছু ভাঙচূরের কোন চিহ্ন নেই কোথাও। পুলিশ বা আর কাউকে শব্দের ব্যপারটা বিশ্বাস করানোই মুশকিল হলো।
পরদিন অবশ্য পুলিশের সামনেই শুরু হলো শব্দের তান্ডব, ঠিক একই সময়ে! স্থানীয় পত্রিকার এক উৎসাহী সাংবাদিক খবর পেয়ে হাজির ছিলেন। ভূতুড়ে তাণ্ডবের খবর ছড়িয়ে গেল সারা দেশ জুড়ে!
তান্ডব চাললো অনেকদিন ধরে একটানা। শুরু হত প্রতিদিন ঠিক রাত দশটায়। দর্শক সংখ্যা বাড়তে বাড়তে হাজার ছাড়ালো। অনেকেই দূর দেহাত থেকে আসায় সারারাত থেকে যেতেন। দুমাস ধরে সমস্ত পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে লাগলো এই ঘটনা, কিন্ত কেউ কোনও কিনারা করতে পারল না। অতিথিদের চা খাওয়াবার খরচ সারা মাসের খরচের থেকেও বেশি হতে লাগল। পুলিশের ক্ষমতার বাইরে চলে গেল এই মেলার মতো ভিড় সামলানো!
ইরান থেকে কোন এক সৈয়দ ধর্মগুরু চিঠি পাঠালেন শান্তিজীবনের নামে। তাতে তিনি তিনটি অতৃপ্ত আত্মার কথা লেখেন। তারা ক্ষতি করবার চেষ্টা করছে ওই বাড়ির বাসিন্দাদের। তিনি মন্ত্রবলে জানতে পেরে একটি মন্ত্রপূত কবচ পাঠাচ্ছেন, শান্তি যেন ধারণ করেন। ডাকবিভাগ অবশ্য খাম খুলে কবচটি বার করে নিয়েছিল আগেই।
কাশীর দু তিনজন পান্ডা একদিন শান্তিজীবনের কাছে এলেন। এ বাড়িতে বছরচারেক আগেও নাকি ভূতের উৎপাত হয়েছিল, জমিদারবাবু যজ্ঞ করবার পড়ে গোলমাল থেমে যায়। তাঁদের মতে আবার যজ্ঞ করা দরকার। তা না হলে বাড়ির লোকেদের অমঙ্গল হতে পারে। শান্তি তাঁদের যজ্ঞের আয়োজন করতে বললেন। কারণ গত কয়েকমাসে বাড়ির ছোটোদের শরীর একেবারেই ভালো চলছিল না। ডাক্তারি পরীক্ষায় কোন কারণ না পেলেও ক্রমাগত পেটের অসুখ আর জ্বর্ লেগেই ছিল।
অগত্যা ধুমধাম করে যজ্ঞ করবার পর হঠাৎ সেই শব্দের তান্ডব একদিন থেমে গেল। যজ্ঞের আগুনে নানারকম নোংরা আবর্জনা যে কোথা থেকে এসে পড়ছিল কেউ বলতে পারে না! পান্ডারা বললেন আগেরবারের যজ্ঞে আগুন থেকে নাকি মানুষের মাংস পোড়ার গন্ধ পাওয়া গেছিল।
*******
অফিস থেকে খোঁজ করে অবশেষে নতুন বাড়ি পেয়ে গেলেন শান্তিজীবন। কাশীর ঐ বাড়িটি ছেড়ে চলে আসার পরে পুলিশের পুরো খাতা থেকে জানা গেল এক ভয়ংকর ইতিহাস!
বাড়িটির মালিক এক বাঙালি বনেদি জমিদার। বিপত্নীক জমিদারের তিন মেয়ে থাকত দোতলায়। তিনি নিজে একতলায় থাকতেন। কিছু চাটুকার বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে মাঝে মাঝেই জমিদার রাতে বাড়িতে থাকতেন না। নায়েবের ছেলেকে বিশ্বাস করে মেয়েদের দেখভাল করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁর অবর্তমানে। বড়ো মেয়ে বিয়ে হয়ে যাবার পরেও এ বাড়িতেই থাকতো, মাঝে মাঝে জামাই এসে থেকে যেত। জমিদারের বড় মেয়ের ছেলে হবার পর এক রাতের ঘটনায় সব ওলটপালট হয়ে গেল।
শীতের মতো কাশীর গরমকালও বিখ্যাত। গৃহস্থদের ছাতে শোবার রেওয়াজ। ছমাসের ছেলেকে নিয়ে তিন বোন ছাদে ঘুমিয়ে আছে। রাইফেল হাতে নায়েবের ছেলে আছে পাহারায়। এমন সময় হঠাৎ ছোটো মেয়ের ঘুম ভেঙে যায়। নায়েবের ছেলে গুলিভরা রাইফেলের নল বড় মেয়েটির কপালে ঠেকিয়ে চাপা গলায় তর্জন করছে। বিপদ বুঝে ছোটো শিশুটিকে কোলে নিয়ে ছোটো মেয়েটি ছাদের একটি বাথরুমে লুকিয়ে পড়ে। তারপর সেখান থেকে পরপর তিনটি গুলির শব্দ কানে আসে তার। নায়েবের ছেলে বড় মেজো দুই বোনকে গুলি করে আত্মহত্যা করেছে। এই ঘটনার কারণ কী কেউ বলতে পারে না। টাকা দিয়ে পুলিশের মুখও বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে ও বাড়িতে কারও থাকা হয়নি।
ছবিঃ শিবশংকর ভট্টাচার্য