পতিত ও ম্যানুয়েল পেড্রো
শিশির বিশ্বাস
উঁচু একটা কাঁচা রাস্তা নদীর ধার বরাবর চলে গেছে পাকা সড়কের দিকে। পুরোনো কেল্লার কাছে পরিত্যক্ত লাইটহাউসের পাশ দিয়ে খালের দিকে আর একটা উঁচু রাস্তা। দু”য়ের মাঝে খানিকটা নিচু জমি। ভরা জোয়ারের সময় নদীর জল একটা কাটা নালা দিয়ে ঢুকে পড়ে ভিতরে। সেই সাথে মাছ। জোয়ার শেষে ভাটা শুরু হলে পুবপাড়ার ছিদাম মন্ডলের ছেলে পতিত নালার মুখে জাল লাগানো কাঠের দরজাটা বন্ধ করে দেয়। ভাটায় জল নেমে গেলে আটকে পড়া মাছগুলো নিয়ে ছুটতে হয় বাজারে মহাজনের আড়তে।
রাস্তার ঢালে খেজুর গাছের পাশে ছোট এক খড়ের চালা। পতিতের আস্তানা। মাছ পড়ুক না-ই পড়ুক,সারাদিন পাহারা দিতে হয়। দিন-রাত মিলিয়ে দুটো জোয়ার। কেজিটাক মাছও আজকাল ধরা পড়ে না। কাজটা আগে ছিদাম মন্ডলই দেখাশোনা করত। কিন্তু ওই সামান্য আয়ে সংসার চলে না। ছিদাম তাই ন’গাছিতে মাটি কাটার কাজে গেছে। অগত্যা স্কুল ছাড়তে হয়েছে পতিতকে। বারো বছরের ছেলে পতিত কাজটা ভালই রপ্ত করেছে। কখন জোয়ার-ভাটা শুরু হবে,এখন আর ওকে জলের টান দেখে বুঝতে হয় না। আকাশে সূর্য দেখেই বলে দিতে পারে। রাত্তিরে তারা। আসলে সব ব্যাপারই বেশ চটপট ধরে নিতে পারত। স্কুলে যখন যেত,ক্লাসেই পড়ানো বিষয়গুলো চটপট ধরে নিতে পারত। ক্লাস ফোর পর্যন্ত উঠেওছিল।
এই যে পুরোনো কেল্লা,লাইটহাউস,এ সম্বন্ধে অনেক কিছুই ও বলে দিতে পারে। সেবার বেশ মজা হয়েছিল। পিকনিকের মরসুম। জনাকয়েক যুবক ঘুরতে-ঘুরতে চলে এসেছিল এদিকে। কেল্লার পিছনে ধানক্ষেতের ধারে পড়ে থাকা মস্ত লোহার বস্তুটা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু হয়ে গিয়েছিল ওদের মধ্যে। জিনিসটা কী,অনেক ভেবেও কেউ বুঝে উঠতে পারছিল না। গায়ের লেবেলটাও পড়া যাচ্ছে না। হরফগুলো ইংরেজির মতো,কিন্তু ইংরেজি নয়। অনেক ভেবেচিন্তে একজন মত প্রকাশ করল,এটা লোহার থাম জাতীয় কিছু।
পতিত একটু দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ করছিল। হঠাৎ বলে ফেলল,“ওটা কামান দাদাবাবু।” গোটা দলটাই প্রায় চমকে উঠে ওর দিকে তাকিয়েছিল। কয়েকজোড়া চোখে অবিশ্বাসের ছাপ।
“কামান! তুই কী করে জানলি?”
একটুও ঘাবড়ায়নি পতিত। তবে পুরো জবাবটা দেয়নি। দেয়নি ইচ্ছে করেই। শুধু বলেছিল,“এটা যে কেল্লা দাদাবাবু। কেল্লায় কামান থাকবে না?”
একমাথা রুক্ষ চুল,খালি গা,ময়লা ইজের পরা ছেলেটার কথায় কৌতুকের খোরাক পেয়ে এবার হেসে উঠেছিল সবাই। অবশ্য কয়েকজন একেবারে উড়িয়ে দেয়নি। মত প্রকাশ করেছিল,জিনিসটা কামান হলেও হতে পারে। তবে কামানের এমন ঢাউস আকার সাধারনত হয় না। তাই বিশ্বাস করা শক্ত।”
কেন যে শক্ত,সেটা বুঝে উঠতে পারেনি পতিত। অবশ্য কথা না বাড়িয়ে চলে এসেছিল সেখান থেকে। এই কামানগুলো বসানো থাকত কেল্লার মাথার উপর নদীর দিকে মুখ করে। পুরো নদীটা ছিল তার পাল্লার মধ্যে। শত্রুপক্ষের কোনও জাহাজ যে নদীর ওপার ঘেঁষে পালিয়ে যাবে,সে উপায় ছিল না। কেল্লা থেকে কামান দেগে ডুবিয়ে দেওয়া যেত। মোহনার কাছে প্রায় সমুদ্রের মতো চওড়া নদী। তিন-চারশো বছর আগে নিশ্চয় আরও চওড়া ছিল। বড়ো আকারের কামান না হলে চলবে কেন? তাছাড়া ওই কামানগুলো তো আর এদেশে তৈরি হয়নি! জাহাজে করে নিয়ে আসা হয়েছিল সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারের দেশ থেকে।
এসব ছাড়া আরও অনেক কিছুই পতিত বলতে পারত ওদের। যেমন কামানের গায়ে ওই যে লেবেলটা,ওটা পর্তুগাল নামে একটা দেশের ভাষা। যে কারখানায় কামানটা ঢালাই হয়েছিল,লেবেলটা তাদের। পতিত গুনে দেখেছে মোটমাট ওইরকম সাতটা কামান ছড়িয়ে আছে কেল্লার আশেপাশে। কয়েকটার তো বেশিরভাগই তলিয়ে গেছে মাটির নীচে। কিন্তু এসব কাউকে বলে না ও। বেশ বোঝে,তার যা বয়স,বিদ্যের দৌড়,তাতে ওর মুখে এসব মানায় না। বললে বিশ্বাসও করবে না কেউ। অথচ এই পুরোনো পরিত্যক্ত কেল্লাটা নিয়ে অনেক কিছুই চিন্তা করেছে ও। ভরদুপুরে বাঁধের পাশে চালার নীচে বাঁশের তক্তপোশে শুয়ে,অথবা নিরিবিলি বিকেলে কেল্লার আশেপাশে ঘুরতে-ঘুরতে। ওর এই বারো বছরের খুদে মগজে যতটা সম্ভব ততটা। কিন্তু কিছুতেই থই পায়নি। এই কেল্লাটা যারা তৈরি করেছিল তারা ভিনদেশি। কোথায় কোন সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে এসে এই এতবড় কেল্লাটা কী করে যে তারা তৈরি করল,পতিতের কাছে সেটাই এক বিস্ময়!
জলের তোড়ে কেল্লার অনেকটাই আজ ভেঙে পড়েছে। তবু যেটুকু অবশিষ্ট আছে,তাতে মূল আকৃতির অনেকটাই অনুমান করা যায়।বিরাট কেল্লার বেশিরভাগই ছিল মাটির নীচে। নদীর পার বরাবর বেশ কতকগুলো খিলান আকৃতির চওড়া দেওয়াল। ফাঁকে-ফাঁকে দরজা কাটা। উপরে ছাদ। ছাদের উপর মাটি ফেলে ঢালু করে জমির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই এক নদীর দিক ছাড়া বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। ভিতরে বসে সৈন্যরা দিন-রাত নদী পাহারা দিত। বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল সুড়ঙ্গ পথে। বেশিরভাগ সুড়ঙ্গের মুখ বন্ধ হয়ে গেলেও কয়েকটা এখনও বর্তমান। এতবড় একটা কেল্লা তৈরি করতে কতদিন লেগেছিল তাদের? এত লোক-লশকরই বা তারা পেল কোথায়? ইট,মাল-মশলা? সবই কি তারা জাহাজে করে নিজের দেশ থেকে বয়ে এনেছিল? এদেশের কেউ তাদের বাধা দিল না! দিব্যি উড়ে এসে জুড়ে বসল! সকলের নাকের ডগায় কেল্লা তৈরি করে গোটা নদীর মোহনা নিজেদের দখলে রেখে দিল বছরের পর বছর। ওদের বাধা দেবার মতো মানুষ কি সেই সময় এদেশে ছিল না?
ভাবনাগুলো পতিতের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আজ বছরখানেক ধরে। ব্যাপারটা ওর খুদে মগজে ঢোকাবার মূলে এক অপরিচিত ব্যক্তি। তার আগে কেল্লা কথাটার অর্থই জানত না। ওর ধারণা ছিল কেল্লা মানে কোনও জমিদার বাড়ির গুপ্ত কুঠুরি।
ধুতি-পাঞ্জাবি পরা সেই মানুষটি বোধহয় কোনও স্কুলমাস্টার হবেন। বছর চল্লিশের মত বয়স। চোখে সরু ফ্রেমের চশমা। সঙ্গে জনাকুড়ি ছেলেমেয়ে। ছাত্রদের নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন। পিকনিকের মরশুম নয়। চারপাশ বেশ ফাঁকাই। কেল্লার আশেপাশে ঘুরে-ঘুরে ছেলেদের বোঝাচ্ছিলেন তিনি। চশমার ওধারে চোখ দুটো থেকেথেকেই জ্বলে উঠছিল। ছেলেদের কানে অবশ্য তার বিশেষ কিছু ঢুকছিল না। অধিকাংশই তখন নানা দলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত। দু’চারজন যারা মাস্টারমশায়ের কাছে রয়েছে তারাও কোনওক্রমে হুঁ-হাঁ করে সময় কাটাচ্ছে। বোঝা যায়,নেহাত চক্ষুলজ্জার খাতিরে মাস্টারমশায়ের সঙ্গ ছাড়তে পারছে না।
প্রায় ঘন্টাদেড়েক ছিল ওরা। পুরো সময়টা পতিত আঠার মতো লেগে ছিল মানুষটার কাছে। বলাবাহুল্য,কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে। প্রতিটি কথা প্রায় গিলে খেয়েছিল। আরে বাসরে! এইটুকু জায়গায় যে এত রহস্য আর রোমাঞ্চ লুকিয়ে রয়েছে,স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সে।
সব দেখা শেষ হলে মাস্টারমশায় যখন ছেলেদের নিয়ে রওনা দিলেন সে-ও ধাওয়া করেছিল পিছনে। একেবারে সেই বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। যদি আরও কিছু জানা যায় সেই আশায়।
বলাবাহুল্য নদী,ভগ্ন কেল্লার ধ্বংসাবশেষ,ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা পরিত্যক্ত কামান, সবকিছু সেদিন থেকে এক নতুন রূপে ধরা দিয়েছে পতিতের কাছে। আগে দিনগুলো কাটতেই চাইত না,এখন কোথা দিয়ে সে সময় পেরিয়ে যায় বুঝতেই পারে না। সারাদিন টো-টো করে ঘুরে বেড়ায় কেল্লার চারপাশে। ঝোপে ঢাকা সুড়ঙ্গ মুখ নীচে নেমে যায়। মাস্টারমশায়ের বর্ণনা আর নিজের কল্পনার সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। আপশোস হয়,ইস যদি আর একবার সেই মানুষটাকে কাছে পাওয়া যেত তো কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জেনে নিতে পারত।
মাস্টারমশায় আর আসেননি,তাঁর দেখাও আর পায়নি পতিত। কিন্তু এই সময় হঠাৎ এক রাতে ম্যানুয়েল পেড্রোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। শুধু প্রশ্নের উত্তরগুলোই নয়,জীবনের ধারাটাই পালটে গেল পতিতের।
ব্যাপারটা অদ্ভুত। তারিখটা মনে নেই। পুর্ণিমার রাত। ভরা জোয়ার চলছে। বাঁধের দরজাটা খুলে দিয়েছে পতিত। জল ঢুকছে হু-হু করে। অমাবস্যা আর পুর্ণিমার ভরা জোয়ারেই যা কিছু বেশি মাছ পাওয়া যায়। কপাল ভাল থাকলে জলের টানে ভারি মাছও দু’একটা ঢুকে পড়ে। সুতরাং এই সময় খুব হুঁশিয়ার থাকতে হয়। জল তোড়ে নামতে শুরু করলেই জালের দরজাটা বন্ধ করে দিতে হয়। কুঁড়ের ভিতরে শুয়ে আজ তাই পতিতের চোখে ঘুম নেই। আকাশের তারা দেখে বোঝা যাচ্ছে,ভাটা শুরু হতে এখনও ঘন্টাখানেক বাকি আছে। বাঁশের তক্তপোশের উপর খানিক এপাশ-ওপাশ করে একসময় উঠে বসে ও। ঝাঁপ ঠেলে বাইরে এসে দাঁড়ায়।
জোৎস্নায় ম-ম করছে চারদিক। নদীর জলে সেই ঝিকিমিকি। চোখ জুড়ানো দৃশ্য। কিন্তু দূরে নদীতে চোখ পড়তেই হঠাৎ থমকে যায় ও। নদীর মাঝে ওটা কী দাঁড়িয়ে? জাহাজ মনে হচ্ছে! চোখ দুটো কচলে নেয়। না,চোখের ভুল নয়। ফুটফুটে জোৎস্নার আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে জাহাজটা। খানিক আগেও একবার বাইরে বের হয়েছিল। তখন জাহাজটা দেখেনি। সন্দেহ নেই,এই সময়ের মধ্যে এসে নোঙর করেছে। কদাচিৎ দু’একটা জাহাজ কলকাতা বন্দরে ঢুকবার মুখে এদিকে নোঙর করে বটে,কিন্তু এমন জাহাজ কোনও দিন দেখেনি পতিত। জাহাজের মাঝে একটা চিমনি থাকে। ধোঁয়া বের হয়। এ জাহাজটার কোনও চিমনি নেই। বদলে মোটা একটা মাস্তুলের মতো খুঁটি সোজা উঠে গেছে উপর দিকে। গুচ্ছের দড়িদড়া ঝুলছে। পতিতের মনে হল,জাহাজটা বোধ হয় পালে টানা। নোঙর করা রয়েছে বলে পালগুলো নামিয়ে ফেলা হয়েছে।
জাহাজটার দিকে কতক্ষণ তাকিয়েছিল খেয়াল নেই ওর। বোধ হয় মিনিটকয়েক হবে। ওই সময় হঠাৎ কাছেই কড়কড় আওয়াজ শুরু হতে পিছন ফিরে তাকাতে ভীষণভাবে চমকে উঠল।
এ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সে! চারপাশের মাঠ,ধানক্ষেত,নতুন বাঁধ,পাওয়ার লাইনের উঁচু টাওয়ার বা পুরোনো লাইটহাউসের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। চারপাশে শুধু ঝোপঝাড় আর ঘন জঙ্গল। খালটার কোনও অস্তিত্ব নেই। কেবল কেল্লার দিকেই ঝোপজঙ্গল কিছু নেই। অনেকটা জুড়ে মস্ত এক মাঠ। মাঠের এক পাশে সার-সার কতকগুলো খড়ের চালা। চাঁদের আলোয় দূর থেকে হলেও বেশ বোঝা যাচ্ছে,অনেক মানুষ সেখান কাজে ব্যস্ত। কড়কড় শব্দটাও ওদিক থেকে আসছে।
গোড়ায় খানিক হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিতে দেরি হয়নি পতিতের। আসলে ভয় ব্যাপারটা ওর অভিধানে নেই। থাকলে এই বিজন প্রান্তরে রাতের পর রাত একা কাটাতে পারত না। ব্যাপারটা সরেজমিনে দেখার জন্য পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেলে ও।
নাহ্,দেখার ভুল নয়। কেল্লার চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। তবে ঢালু নদীর পারে খোঁড়াখুঁড়ির চিহ্ন। গাঁথুনির কাজ চলছে। মাথায় করে ইট,চুন-সুরকির মশলা বয়ে আনছে কুলিরা। মাটি কাটছে কেউ। তাদের বেশিরভাগই কঙ্কালসার শরীর। মনে হয় অনেক দিন পেট ভরে খেতে পায়নি। পতিত আরও লক্ষ করল,মানুষগুলোর দু’পায়ের গোড়ালিতে লোহার বেড়ি পরানো। বেড়ির সঙ্গে শেকল। ইচ্ছে থাকলেও কেউ জোর হাঁটতে পারছে না। অনেকে রীতিমতো খোঁড়াচ্ছে। তবু এক মুহূর্তের জন্য থামছে না। নিঃশব্দে যন্ত্রের মতো কাজ করে চলেছে।
খানিক দূরে মস্ত ইটের ভাটি। এক জোড়া তেজি বলদ জোয়াল কাঁধে অবিরাম পাক খাচ্ছে। ইট তৈরির মাটি পেষাই হচ্ছে। মজুরের দল পেষাই মাটির তাল মাথায় করে এনে ফেলেছে এক জায়গায়। পায়ে শেকল পরা কারিগরেরা ছাঁচে ফেলে ইট তৈরি করছে। সব কিছুই চলছে নিঃশব্দে। ব্যতিক্রম শুধু ওই কড়কড় আওয়াজ। শব্দটা সুরকি পেষাইয়ের। জোয়াল কাঁধে চার জোড়া তেজি বলদ ঘুরছে এক সাথে। পাথরের মস্ত চাকির ভিতর কড়কড় শব্দে ইটের টুকরো পেষাই হয়ে বেরিয়ে আসছে।
কঙ্কালসার মানুষগুলো এই রাতদুপুরে কেন যে এমন যন্ত্রের মতো কাজ করে চলেছে,বুঝতে বিলম্ব হয় না। ভিড়ের ভিতর গোড়ায় দেখতে পায়নি,অদ্ভুত পোশাক-পরা কয়েকজন ভিনদেশি মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে ওদের ভিতর। লম্বা দৈত্যাকৃতি চেহারার মানুষগুলোর মাথায় পাখনা লাগানো বিশেষ ধরনের কাপড়ের টুপি। মুখ ভর্তি দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। পরনে চাপা পাজামা। গায়ে জামার উপর বুক খোলা আলখাল্লার মতো কোট। কোমরে খাপে গোঁজা তরোয়াল। হাতে চাবুক নিয়ে লোকগুলো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চারপাশে। কাজে সামান্য গাফিলতি হলেই,কখনও বা বিনা কারণে সাঁই-সাঁই শব্দে চাবুক চালাচ্ছে শীর্ণ মানুষগুলোর উপর। যন্ত্রণায় শরীর কুঁকড়ে উঠলেও হাতের কাজ থামছে না।
অবাক হয়ে দেখছিল পতিত। হঠাৎ আলতো করে কাঁধের উপর হাত রাখল কেউ।
“বয়,টোমার প্রশ্নগুলির উত্তর পাইয়াছ?”
পতিত ঘাড় ফিরিয়ে দেখল,ওর পাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে এক ভিনদেশি সাহেব। সেই একই পোশাক। মুখ ভরতি দাড়ি-গোঁফ। তবে অন্যদের মতো অবিন্যস্ত নয়। চেহারায়,পোশাকে বেশ একটা আভিজাত্যের ছাপ। কোমরে গোঁজা বড়োসড়ো একটা পিস্তল জাতীয় অস্ত্র।
বলাবাহুল্য,পতিত ভয় পায়নি একটুও। বরং চোখের সামনে এতক্ষণ ধরে যা দেখছে তাতে হঠাৎ এই সাহেবের উপস্থিতি কিছুমাত্র অস্বাভাবিক মনে হল না। সাহেবের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,“তুমি কে সাহেব? এখানে এলে কোত্থেকে?”
সামান্য হেসে সাহেব বলল,“বয়,আমার নাম ম্যানুয়েল পেড্রো। বহুত দূর লিসবন হইতে আসিয়াছি। নদীর মোহনায় এই কিল্লা তৈয়ারি হইতেছে আমারই অধীনে। দুই বৎসর কালের ভিতর কিল্লার কাজ সম্পূর্ণ করিতে হইবে,তাই দিবারাত্র কাজ চলিতেছে।”
পতিত বলল,“এখানে কতজন কাজ করছে সাহেব?”
পেড্রো বলল,“সর্বমোট দেড় সহস্র দাস লইয়াছি। তবে এই মুহূর্তে ছয়শত দাস কার্য করিতেছে। অন্যরা বিশ্রামে আছে। ভোর হইলেই উহাদের কাজে লাগানো হইবে। তোমাদের দেশ হইতেই উহাদের লওয়া হইয়াছে। মাত্র ছয়মাসের মধ্যে কার্য অনেকটাই অগ্রসর হইয়াছে। কিল্লার বনিয়াদের কাজ সম্পূর্ণ। জলে ডুবিয়া আছে,তাই দেখিতে পাইতেছে না।”
যে প্রশ্নটা পতিতের মনে অনেক দিন থেকে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে,এবার সেটাই জিজ্ঞাসা করল ও,“তোমরা এখানে কত জন আছ সাহেব?”
“আমরা সর্বমোট দেড়শত ব্যক্তি আসিয়াছি। তবে মুহূর্তে উহাদের পরিচালিত করিতেছে বিশ ব্যক্তি। বাকি সকলে জাহাজে আছে।”
পেড্রো থামল একটু। পতিতের কাঁধে ছোট্ট নাড়া দিয়ে বলল,“বয়,এইবার নিশ্চয় বুঝিতে পারিয়াছ,সপ্তসমুদ্রের ওপার হইতে আসিয়া কী প্রকারে বঙ্গদেশে প্রবেশ করিবার নদী মোহনা নিজেদের দখলে লইয়াছিলাম। তোমাদের দেশ হইতেই শ্রমিক সংগ্রহ করিয়া মাত্র দুই বৎসর কালের মধ্যে কী প্রকারে এই বিশাল কিল্লা তৈয়ারি করিয়াছিলাম।”
পেড্রো থামল। পতিতের মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,“খুব বুঝতে পেরেছি সাহেব। এদেশে সেইসময় মানুষ ছিল না। তাই পেরেছ। ওই যে ছয়শো মানুষ ঘাড় গুঁজে কাজ করে চলেছে,ওরাও কেউ মানুষ নয়। হলে তোমাদের মাত্র কুড়িজন মানুষের সাধ্য ছিল না ওদের দিয়ে এভাবে পশুর মতো কাজ করাবার।”
“গুড,ভেরি গুড।” ভীষণ খুশি হয়ে ম্যানুয়েল পেড্রো পতিতের পিঠ চাপড়ে দিল,“তুমি বিলকুল যথার্থ বলিয়াছ বয়। তোমাদের দেশে তখন প্রকৃত মানুষ সংখ্যায় অধিক ছিল না। সেই কারণে এই অসাধ্যসাধন করতে পারিয়াছিলাম। কিন্তু বয়,আমি বর্তমানেও এদেশে তেমন মানুষ বিশেষ দেখিতে পাইতেছি না। অবশ্যই তুমি কিছু ব্যতিক্রম। আমি অনেকদিন হইতেই তোমাকে লক্ষ করিতেছি। তোমার ভিতর আগুন রহিয়াছে। বয়,আমি বলিতেছি,তুমি লেখাপড়া শিখো। পুনরায় স্কুলে যাইতে আরম্ভ কর।”
পেড্রোর কথায় এবার হেসে ফেলল পতিত। বলল,“তুমি হাসালে সাহেব। মাত্র দশটা টাকা রোজের জন্য আমার বাবাকে বারো মাইল দূরে নগাছিতে মাটি কাটার কাজে যেতে হয়েছে তা জানো? সংসার চলে না,তাইতো সামান্য কয়টা পয়সা রোজগারের জন্য আমাকে এই বিজন প্রান্তরে রাতদিন পড়ে থাকতে হয়। ইচ্ছে করলেই কি আর লেখাপড়া শেখা যায় সাহেব!”
“আমি টোমার সহিত জোক করিতেছি না বয়। সব জানিয়াই বলিতেছি।” পেড্রোর গলা এবার বেশ ভারি। পতিত দেখল সাহেবের দু’চোখের কোলে দু’ফোঁটা জল চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে।
“বয়,সুদূর লিসবন হইতে এই দেশে আসিয়াছিলাম। তাহার পর কতদিন অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে,এদেশের মায়া আজও ছাড়িতে পারি নাই। আজও কিল্লার চারিপাশে একা ঘুরিয়া বেড়াই। বয়,তোমাদের এই দেশটাকে বোধ হয় আমি ভালবাসিয়া ফেলিয়াছি।”
একটু থেমে পেড্রো আবার চলতে শুরু করে,“বয়,এই কিল্লার অভ্যন্তরে কিছু বাদশাহী মোহরের সন্ধান আমার জ্ঞাত রহিয়াছে। ইহা ছাড়া কিছু রৌপ্যমুদ্রাও আছে। ওই রৌপ্যমুদ্রাগুলির সন্ধান তোমাকে দিতেছি। উহা লইয়া তুমি লেখাপড়া আরম্ভ করিবে। স্বর্ণমুদ্রা তোমার এখনই প্রয়োজন লাগিবে না। যখন লাগিবে আমি পুনরায় তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিব। এখন মনোযোগ সহকারে শুনো–।”
পতিতের ঘুম যখন ভাঙল তখন শেষরাত্তির। পুব আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। চোখ কচলে ধড়মড় করে উঠে বসল ও। বাইরে এসে যা দেখল,তাতে কিছু আর করবার নেই। বাঁধের খোলা দরজা দিয়ে ভাটার জল হু-হু করে নেমে যাচ্ছে। ভিতরে সামান্য জলই আর অবশিষ্ট। মাছও বেরিয়ে গেছে। হায় হায়! মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে হল পতিতের। ঘুমিয়ে পড়ে কী সর্বনাশটাই না আজ হয়ে গেল! আবার কী এক আজব স্বপ্ন! সেকালের পালের জাহাজ,বোম্বেটে ম্যানুয়েল পেড্রো,মোহর,ধুৎ–
ঘুম চোখে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে গিয়েও হঠাৎ থমকে গেল ও। মজার স্বপ্নই বটে। স্বপ্নে গুপ্তধনের হদিশ। ম্যানুয়েল পেড্রোর শেষ দিকের কথাগুলো কিন্তু এখনও পরিষ্কার মনে রয়েছে। একবার খুঁজে দেখবে নাকি?
মুহূর্তে মনস্থির করে পতিত ছুটল একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে কেল্লার যে অংশের অনেকটাই ভেঙে পড়েছে,সেই দিকে। পেড্রো যে সুড়ঙ্গর কথা বলেছিল সেটা খুঁজে নিতে অসুবিধা হল না। দ্রুত ভিতরে ঢুকে পড়ল ও। সোজা নেমে ডানদিকে বাঁক। এক,দুই,তিন নম্বর থামের পিছনের দেওয়াল। শেষ রাতে পুর্ণিমার আলো নদীর জলে প্রতিফলিত হয়ে ভাঙা দেওয়ালের ফোকর গলে ভিতরে এসে পড়েছে। অন্ধকার তাই তেমন ঘন নয়। তবু প্রায় হাতড়েই জায়গাটা বের করতে হল। দেওয়ালের গোড়া থেকে ইট ধরে গুনতে শুরু করল,এক-দুই-তিন-চার–পাঁচ-ছয়-সাত। আধো অন্ধকারে দেওয়ালের নির্দিষ্ট জায়গায় বাঁ হাতটা রেখে ডান হাতে একটা ইটের টুকরো তুলে ক’বার ঠুকল। ভিতরটা ফাঁপা।
পুরোনো নোনা-ধরা ইট। চুন-সুরকির ক্ষয়ে যাওয়া গাঁথুনি। অন্ধকারেই ঠুকে-ঠুকে গোটা কয়েক ইট বের করে ফেলল পতিত। ঝনঝন শব্দে কতকগুলো চাকতির মতো বস্তু নীচে গড়িয়ে পড়ল। দেওয়ালের ভিতরে একটা কুলুঙ্গি। খুব বড়ো নয়। অন্ধকারেও পতিতের বুঝতে বাকি রইল না,কুলুঙ্গিটা কাঁচা টাকায় ঠাসা। সব রুপোর।
*******
পতিত আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। পর-পর দু’বছর ক্লাসে প্রথম হয়েছে ও। সংসারের হালও কিছু ফিরেছে। ওর বাবা ছিদাম মন্ডল বাজারের কাছে ছোটো একটা দোকান দিয়েছে। দু’বছর পেরিয়ে গেছে,ম্যানুয়েল পেড্রোর দেখা আর পায়নি। সেজন্য অপেক্ষায় রয়েছে পতিত। দেখা হলে ভিনদেশি মানুষটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলবে,“না চাইতেই তুমি আমায় যা দিয়েছ সাহেব তাই যথেষ্ট। সোনার মোহরের দরকার নেই। আমি নিজেকে সোনা বানাতে চাই। সত্যিকারের মানুষ হতে চাই আমি।
ছবিঃ শিবশংকর ভট্টাচার্য