বন্ধু
রুচিস্মিতা ঘোষ
মা রোজ পিকলুকে বসিয়ে দিয়ে যায় এই পার্কে। এখানে অনেক গাছ। গাছে গাছে অনেক ফুল। সব ফুলের নাম জানে না পিকলু। গোলাপ, নয়নতারা, রঙ্গন, কলাবতী আর ডালিয়া — শুধু এই পাঁচটা ফুলই সে চিনতে পারে। সে যে গাছের তলায় বসে আছে, সেই গাছটা্র নাম কৃষ্ণচূড়া। এখন বসন্তকাল, গাছটা ফুলে ফুলে লাল হয়ে গেছে। ফুলের পাপড়ি ঝরে গাছের নীচটাও লাল। পার্কের সবুজ ঘাসে একঝাঁক রঙিন ফুল হাত পা ছুঁড়ে খেলছে। রঙ বেরঙের জামায় তাদের এক একজনকে সত্যি সত্যিই এক একটা রঙিন ফুলের মত লাগছে। বিকেল বেলার নরম রোদ সুড়সুড়ি দিচ্ছে পিকলুর সারা পিঠ জুড়ে। তার খুব ইচ্ছে করছে সেও একটা ফুল হয়ে ওই ফুলগুলোর সঙ্গে মিশে যায়। কিন্তু পিকলুর একটা পা পোলিওতে নষ্ট হয়ে গেছে। সে ভাল করে হাঁটতেই পারে না, দৌড়বে কী করে!
তার বয়সী বাচ্চাগুলো দোলনায় দোল খায়, সি-স চড়ে, মেরি-গো-রাউন্ডে গোল হয়ে ঘোরে। কয়েকটা বাচ্চা ছেলে কেমন বল খেলছে। দৌড়াদৌড়ি, লুকোচুরি আরো কতরকমের খেলা যে খেলে ওরা! সে খেলতে পারে না। শুধু বসে বসে তাদের খেলা দ্যাখে।
পিকলুর মাঝেমাঝে তাই ভারী মনখারাপ হয়। না-হয় তার একটা পা খোঁড়া, তাই বলে কি পিকলুর সঙ্গে গল্প করতেও নেই? কাছে আসতেও নেই? মাঝেমাঝে খেলা ছেড়ে দু -একজন কি পিকলুর কাছে এসে গল্প করতে পারে না? একদিন পিকলুর যখন এমনি মনখারাপ, গাছের ডাল থেকে একটা পাখি মিষ্টি সুরে ডেকে উঠল। পিকলু মাথা তুলে দেখল গাছের ডালে ভারী সুন্দর একটা পাখি বসে রয়েছে! তার সারা গায়ে কেউ যেন হলুদ মেখে দিয়েছে, গলার কাছটা নীল, চোখের তারায় লাল রঙ। এরকম অদ্ভুতপাখি সে জীবনে দ্যাখেনি। সে ভারী অবাক হয়ে যখন দেখছে পাখিটাকে, ঠিক তখনই তাকে আরো অবাক করে দিয়ে পাখিটা মানুষের গলায় বলে উঠল, “মনখারাপ করছিস কেন পিকলু? আমি তো আছি। তোর সঙ্গে গল্প করব।”
পিকলু হেসে বলল, “পাখিরা বুঝি কথা বলে? আর তুমি গল্পই বা জানলে কী করে?”
পাখিটা তার ঠোঁট ফাঁক করে খানিকটা হেসে নিল। তারপর বলল, “আমি আজ থেকে তোর বন্ধু। আমরা পাখিরা নিজেদের ভাষায় কথা বলি ঠিকই, তবে তোরা তো আর আমাদের ভাষা বুঝিস না, তাই আমরাই মানুষের ভাষা শিখে ফেলেছি।”
পিকলু অবাক হয়ে বলল, “সত্যি বলছি, এরকম পাখি আমি জীবনে দেখিনি। তোমার নামটা বলবে?”
পাখিটা বলল, “এই পার্কে অনেক রকমের পাখি আছে। তাদের গায়ে কত যে রঙ! আমরা সকলে এ দেশ থেকে ওদেশে ঘুরে বেড়াই। আমাকে তুই হলুদ পাখি বলে ডাকতে পারিস।”
পিকলু হেসে ফেলল। বলল, “যাঃ! পাখি আবার মানুষের বন্ধু হয় নাকি?”
পাখিটাও তর্ক জুড়ে দিল, “কে বলেছে হয় না? বোকা ছেলে, এই কথাটাও জানিস না? যে কোনো প্রাণীই মানুষের বন্ধু হতে পারে। ভালবাসা থাকলেই হয়। হাথী মেরা সাথী সিনেমাটা দেখিসনি বুঝি?”
পিকলু বলল, “তোমার বুঝি একটাও পাখি-বন্ধু নেই?”
হলুদ পাখি বলল, “থাকবে না কেন? তারা তো এই পার্কেই আছে। গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে ওড়াউড়ি করছে, নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। আমি তোকে রোজ দেখি, একা মনমরা হয়ে বসে থাকিস। তাই ভাবলাম তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করি।”
হলুদ পাখির কথায় পিকলুর মনটা ভাল হয়ে গেল। না-হয় ওই বাচ্চা ছেলে মেয়েগুলো তার সঙ্গে ভাব করে না, তা বলে কি তার বন্ধু থাকতে নেই?আজ থেকে হলুদ পাখিই তার বন্ধু। তার সঙ্গেই সে গল্প করবে।
পিকলুর তো আর ডানা নেই যে, ইচ্ছে করলেই সে উড়ে যাবে। হলুদপাখির ডানা আছে, তবু সে উড়ে যায় না। শুধু পিকলুর জন্যই কৃষ্ণচূড়া গাছটার ডালে বসে দোল খায়। তার জন্য অপেক্ষা করে আর পিকলু এলেই টুক করে নীচে নেমে আসে। সে তাকে অদ্ভুত সুন্দর সব গল্প শোনায়। দুষ্টু রাজার গল্প, সুয়োরানি আর দুয়োরানির গল্প, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর গল্প, সুখু-দুখুর গল্প, রাক্ষস-খোক্কসের গল্প। এমন গল্প পিকলুকে আজ পর্যন্ত কেউ শোনায় নি। এমন কি তার মা-ও না। হলুদপাখির থেকে সুয়োরানি আর দুয়োরানির গল্প শুনে পিকলুর এক একসময় মনে হয় তার মা-ই বুঝি সেই দুয়োরানি। তার মা-র যে বড় দুঃখ! সকাল থেকে বাড়ির সব কাজ সেরে, রান্নাবান্না করে পিকলুকে নাইয়ে-খাইয়ে দুপুর গড়াতে না গড়াতেই তাকে এই পার্কে বসিয়ে সে একটা দোকানে কাজ করতে যায়। পিকলুর মনে হয় তার বাবাই কি তবে সেই দুষ্টু রাজাটা, যে তার মাকে ছেড়ে সুয়োরানির কাছে চলে গেছে? না-কি বাবা সেই রাক্ষসটা যার মনে-প্রাণে পিকলুর জন্য একটুও দয়া-মায়া নেই? পিকলু কিন্তু এসব কথা জানায় না হলুদ পাখিকে। সে শুধু তার গল্পগুলোই মন দিয়ে শোনে। পিকলুর আজকাল আর তেমন মনখারাপ করে না। তার সব মনখারাপ এখন ভাল-লাগায় বদলে গেছে।
এদিকে বসন্তকাল হাসে। পার্কের গাছেরা মাথা দোলায়। কৃষ্ণচূড়া গাছটাও ডালপালা নেড়ে বলতে চায়, দ্যাখ, পিকলু একটা বন্ধু পেয়েছে। পিকলু আর হলুদপাখির ভালবাসা পাগলা হাওয়ার মত তিরতির করে বয়ে বেড়ায় সারা পার্কে। সেই ভালবাসার হাওয়া একদিন ছুঁয়ে দেয় একটা ছেলেকে। ছেলেটা খেলতে খেলতেই সেদিন খেয়াল করে গাছের তলায় বসে থাকা খোঁড়া ছেলেটা নিজের মনে একটা হলুদ পাখির সঙ্গে কথা বলছে। ভারী কৌতূহল হয় তার। সে চুপিচুপি এসে দাঁড়ায় কৃষ্ণচূড়া গাছটার পাশ ঘেঁষে। অবাক হয়ে দ্যাখে, হলুদপাখিটা কেমন মানুষের গলায় গল্প শোনাচ্ছে, আর খোঁড়া ছেলেটাও বেশ মাথা নেড়ে নেড়ে ওর সঙ্গে কথা বলছে। এত অবাক সে কোনোদিন হয়নি। কিন্তু সে যে দৌড়ে গিয়ে অন্য বাচ্চাদের এসব কথা বলবে, তার ইচ্ছে করে না। আসলে ভালবাসার হাওয়াটা যে তাকে ছুঁয়ে ফেলেছে। ভালবাসার সেই আশ্চর্য টানে সে গাছের পাশ থেকে সরে এসে পিকলুর পাশে বসে পড়ে আর পিকলু চমকে ওঠে। কোনোদিন তার কাছে ওরা কেউ আসেনি। কেমন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাকে দেখেছে। হলুদপাখি কিন্তু ছেলেটাকে দেখেও উড়ে গিয়ে গাছের ডালে বসে না, বরং ভারিক্কি চালে বলে, “হাঁ করে দেখছিস কী? যা-না, যেমন খেলছিলি, তেমন খেল।”
বাচ্চা ছেলেটা তাও আব্দারের সুরে বলে, “না, আমি খেলব না। আমিও তোমার গল্প শুনব।” হলুদপাখি তখন মাথা নেড়ে বলে, “এতদিন তো এই ছেলেটাকে তোরা কাছেও ডাকিসনি। এখন কী মনে করে?”
ছেলেটা মুখ কাচুমাচু করে বলে, “ভুল হয়ে গেছে, হলুদপাখি।” তারপর পিকলুর দিকে তাকিয়ে বলে, “সরি!সরি! এই, তোর নাম কী রে?”
পিকলু একটু বিরক্তই হয়েছে, হলুদপাখি আর তার মাঝখানে ছেলেটা হঠাৎ এসে পড়েছে বলে। তবে কী-না ছেলেটা তো ভাব করতেই এসেছে আর তার ভুলও স্বীকার করে নিয়েছে, তাহলে বন্ধু হতে দোষ কী? সে তাই তার নাম জানায় ছেলেটাকে আর তারও নাম জেনে নেয়। এভাবে ছেলেটার সঙ্গে সেদিন পিকলুর ভাব হয়ে যায়।
হলুদপাখির রাগ কিন্তু তখনও যায়নি। সে গম্ভীর হয়ে বলে, “এই ছেলে, দেখতে পাস না পিকলু তোদের মত খেলতে পারে না? ওর কথা তোরা কোনোদিন ভাবিসনি কেন? আজ আমার গল্প শোনার লোভে ওর সঙ্গে ভাব করতে এসেছিস? তা বেশ! বোস। বোস। গল্প শোন।”
এইভাবে হলুদপাখির সঙ্গে গল্পে গল্পে একদিন বসন্তকালও ফুরিয়ে যায়। গরমের কাঠফাটা রোদে কৃষ্ণচূড়া আর তেমন ছায়া দিতে পারে না। লাল ফুলগুলো শুকিয়ে ঝরে পড়ে। কুলকুল করে ঘেমে ওঠে পিকলু। তার গায়ের জামাটাও ভিজে গেছে। সে হলুদপাখিকে আকুল হয়ে খোঁজে আর অবাক হয়ে দ্যাখে হলুদ পাখি পিকলুকে দেখেই নীচে নেমে আসছে। সে নীচে নেমেই রোদের তাপ থেকে বাঁচাতে চায় পিকলুকে। তার হলুদ ডানা ছড়িয়ে ঢেকে দেয় পিকলুর মাথা।
পার্কের অন্য বন্ধুরা আজকাল বেশ দেরি করে আসে। রোদের তেজ কমে গেলে তারা একে একে আসবে। পিকলু তাদের জন্য অধীর অপেক্ষা করে। এখন এক এক করে পিকলুর অনেক বন্ধু হয়ে গেছে। তারা পালা করে পিকলুর সঙ্গে খেলে। এমন অনেক খেলা আছে, যা বসে বসেও খেলা যায়। পিকলুর সঙ্গে তারা তেমন খেলাই খেলে। দু-একজন আবার কখনো কখনো পিকলুর হাত ধরে আস্তে আস্তে হাঁটে। কেউ তাকে গান শোনায়, কেউ শোনায় মজার মজার ছড়া। একটা ছেলে পিকলুকে উপহার দিয়েছে ভারী সুন্দর একটা ছবির বই। একটা বাচ্চা মেয়ে তার জন্য বাড়ি থেকে নানারকমের খাবার নিয়ে আসে। বন্ধুদের মধ্যে কেউ পিকলুকে দেয় চকোলেট, কেউ দেয় ক্যাডবেরি আবার কেউ দেয় কেকের টুকরো। হলুদ পাখির মনে আনন্দ আর ধরে না। সে ভাবে, এর নামই বুঝি ভালবাসা?
এদিকে ঋতুবদলের নিয়ম অনুযায়ী বর্ষা পেরিয়ে শরৎ আসে। শরতের পর হেমন্তকাল। হেমন্তকাল আর থাকে কতক্ষণ! দেখতে দেখতে একদিন শীতও নেমে আসে পার্কে। সেই দিনটা ছিল কনকনে ঠান্ডা। পিকলুর গায়ে একটা ফুলহাতা শার্ট। ঠান্ডায় সে কাঁপছে। হলুদপাখির এখনও পর্যন্ত দেখা নেই। পিকলুর বন্ধুরা একে একে নানা রঙের সোয়েটারে সেজে পার্কে ঢুকছে। তাদের দেখে পিকলুর দু”চোখ জলে ভরে আসে। তার মা এই শীতেও তাকে একটা সোয়েটার বুনে দিতে পারেনি। সে হঠাৎ দেখতে পায়, একটা বাচ্চা মেয়ে তার দিকেই ছুটে আসছে। মেয়েটা নীল রঙের একটা নরম সোয়েটার পরেছে। একেবারে কাছে এলে সে মিলিকে চিনতে পারে। পিকলুকে শীতে কাঁপতে দেখে মিলি তার নীল রঙের সোয়েটারটা খুলে পিকলুকে পরিয়ে দেয়। পিকলুর চোখের জল মুছে দেয় তার ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে আর হেসে বলে, “ধুর বোকা কাঁদছিস কেন? আমার অনেক সোয়েটার আছে। এটা তোর জন্য।”
পিকলু লজ্জা পেয়ে বলে, “আমাকে সোয়েটারটা দিয়ে দিলে, এবার যে তোমার শীত করবে।”
মিলি হেসে বলে, “আমার গায়ে আর একটা পাতলা সোয়েটার আছে, দেখতে পাচ্ছিস না?”
লাল-নীল, হলুদ-সবুজ সোয়েটাররা এবার দৌড়ে দৌড়ে আসছে পিকলুর কাছে। পিকলুকে জিজ্ঞেস করছে, পিকলু আজ হলুদপাখিকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? সে কোথায় গেল? পিকলুও একটু অবাক হয়েই বলে, “আমি তো এসেই তাকে খুঁজেছি। সে এখনও কেন নীচে নেমে এল না?”
বাচ্চারা তখন সকলে মিলে হলুদপাখিকে ডাকাডাকি করছে, “হলুদপাখি কোথায় তুমি?”
হলুদপাখি কিন্তু কোত্থাও যায়নি। সে কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে চুপটি করে বসে বাচ্চাদের কান্ডকারখানা দেখছিল। সকলের ডাক শুনে সে এবার টুক করে নেমে এল নীচে। বাচ্চাদের বলল, “ধন্যবাদ বাচ্চারা। তোমরা আজ সক্কলে পিকলুর বন্ধু হয়ে গেছ। আমি খুব খুশি”। এই কথা বলেই সে উড়ে এসে পিকলুর কাঁধে বসল, তার ঠোঁটটা পিকলুর গালে ছুঁইয়ে বলল, “মন খারাপ করিস না পিকলু। এবার আমাকে যেতে হবে যে। পার্কের অন্য পাখিরা দল বেঁধে আজ অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে। আমাকেও তাদের সঙ্গে যেতে হবে। এখন তো তোর অনেক বন্ধু। আমাকে ভুলে যাস।”
হলুদপাখির কথা শুনে পিকলু দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে। পিকলুর হাত তার ছোট্ট মুঠিতে ধরে থাকে মিলি আর অন্য বাচ্চারা পিকলু আর মিলিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। ওরা দেখে হলুদপাখি সত্যি সত্যিই ডানা মেলে আকাশে উড়ে যাচ্ছে অন্য পাখিদের সঙ্গে। শীতের কুয়াশা ছেয়ে তখন সন্ধ্যা নামছে পার্কে। পিকলুর চোখের জল মিশে গেল সেই কুয়াশায়।
গ্রাফিকস্- ইন্দ্রশেখর