তরুণকুমার সরখেল
ঋক তার ঠাকুমা আর বাবার কাছে দেশের বাড়ির অনেক গল্প শুনেছে। তাদের দেশের দোতালা বাড়িটা বাবার ঠাকুরদা স্বর্গীয় রামগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় বানিয়েছিলেন। ঋক কখনো এরকম বাড়িতে থাকেনি। ঘরের দেওয়ালগুলো খুব চওড়া বলে বাইরের তাপ ভেতরে ঢুকতে পারেনা। তবে একটা অসুবিধে হল ঘরে কোন জানালা নেই। ঋক শুনেছে আগেকার দিনে গ্রামের বাড়িগুলো এরকমই হত। চোরেদের ভয়ে ঘরে জানালাই থাকত না। শুধু একটা মাত্র প্রধান দরজা থাকত,তাও আবার বেশ ভারী আর শক্ত কাঠে তৈরি।
চওড়া দেওয়ালের পুরনো দিনের ঘরগুলোতে ধুলো জমেছে প্রচুর। সনাতনদা গতকাল থেকেই ঝাড়পোছের কাজে লেগে পড়েছে। উপরের দুটো ঘর এখনো বন্ধ হয়েই পড়ে আছে।
বেশ মজবুত। তালাটাও অন্য ঋক ঠাকুমাকে গিয়ে বলল,“উপরের দুটি ঘরই তো তালা বন্ধ। চাবি কোথায়?”
ঠাকুমা বলল,“চাবি আছে নীচের ঘরের আলমারিতে। ”
ঋক এক ছুটে আলমারি থেকে চাবির গোছা নিয়ে এল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর একটা ঘরের তালা খুলতে পারল। এ ঘরটাতেও প্রচুর ধুলো-ময়লা-ঝুল জমেছে। ঘরের মাঝখানে একটা বড় খাট পাতা। একদিকে জলচৌকি আর একটা কাঠের চেয়ার পাতা রয়েছে। দেওয়ালের পলেস্তারা দু’এক জায়গায় খসে পড়েছে। মনে হয় অনেকদিন ব্যবহার হয়নি এই ঘরটা।
সনাতনদা বলল,“তুমি পাশের ঘরটা খোল দেখি। আমি ততক্ষণে এই ঘরের ঝুলটুল গুলো ঝেড়ে ফেলি। ”
ঋক চাবি নিয়ে পাশের ঘরটায় চলে এল। এই ঘরের দরজাটা ধরণের। ঋক এরকম তালা আগে দেখেনি। সে একটার পর একটা চাবি লাগিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু না,কিছুতেই খুলতে পারল না। সনাতনদা পাশের ঘর থেকে একবার ডাক পড়ল, “কই খোকাবাবু দরজা খোলার শব্দ পেলাম না তো। তালায় জং ধরেছে মনে হচ্ছে। একটু তেল দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে। ”
ঋক কী যেন একটা ভাবল। তারপর তালাটার মধ্যে গোপন কোন ফুটো আছে কি না দেখতে লাগল। সত্যিই তাই। তালাটার ডানপাশে ছোট্ট একটি ঢাকনা খুঁজে পেল সে। ঢাকনাটা আঙুল দিয়ে টেনে তুলতেই চাবি ঢোকানোর জায়গাটা পেয়ে গেল।
এই ঘরটা ছিল ঠাকুরদার পড়ার ঘর। ঘরের তিনটে দেওয়ালেই বইয়ের আলমারি। প্রচুর সংগ্রহ ছিল ঠাকুরদার। প্রতিটি আলমারির গায়ে সাদা রং দিয়ে আলমারিতে কি ধরণের বই ও কোন কোন লেখকের বই আছে তার খানিকটা ধারণা পাওয়া যাবে। বনৌষধি, রামায়ণ,মহাভারত,পুরাণ,গীতগোবিন্দ,ভারতের সাধক,বিদেশি অনুবাদ সাহিত্য, রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র- মানিক- তারাশঙ্কর- বিভূতিভূষণ কে নেই এই ঘরে। তবে সবকিছুর মধ্যেই পাতলা ধুলোর আস্তরণ।
ঋক সকাল থেকে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখল। ঘুরতে ঘুরতে নীচের একটা ঘরে এসে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘরটি খুবই সাধারণ কিন্তু ঋক দেখল পশ্চিম দেওয়ালের উপর ছোট্ট একটি দরজা।
“এই দরজা দিয়ে কি বাইরে যাওয়া যায়?” ঋক ঠাম্মার কাছে জানতে চাইল।
“না,এটা চোরকুঠুরি। আসলে ছাদে ওঠার সিঁড়ির নীচে আগেকার দিনে এরকম একটা চরকুঠুরি তৈরি করা হত। চোরদের নজর এড়ানোর জন্য চোকুঠুরিতে কাঁসা-পেতলের জিনিসপত্র,সোনা- রুপোর গয়না রেখে দেওয়া হত, ” ঠাম্মা হেসে বলল,“এই চোরকুঠুরিটার মধ্যেও সেরকম কোন গুপ্তধন লুকানো থাকতে পারে।”
ঋক বলল,“একবার দরজাটা খুলে দেখব?”
ঠাম্মা বলল,“ভেতরটা অন্ধকার। তাছাড়া ভেন্টিলেটার দিয়ে যত রাজ্যের চামচিকে ঢুকে এই চোরকুঠুরিতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ভেতরটা ভ্যাপসা গন্ধে ভরে আছে। ঢোকাই দায়।”
ঋক তার বাবার কাছে গ্রামের বাড়ির অনেক গল্প শুনেছে কিন্তু এই চোরকুঠুরির গল্প কোনদিন শোনেনি। আসলে ঋক কিছুদিন আগে একটা গল্প পড়েছিল। সেখানে ঘর লাগোয়া এরকম একটি ছোট্ট দরজা দিয়ে একটি সুড়ঙ্গপথে ঢোকা যেত। তাতেই তার এত আগ্রহ।
ঋক সে আগ্রহ মেটাতে একটি ছোট্ট টর্চলাইট এনে চোরকুঠুরির দরজা খুলে বাইরে থেকে উঁকি মারল। প্রথমেই তার নজর পড়ল তিনচারটে চামচিকে ঘরের সিলিং ধরে উলটো হয়ে ঝুলে আছে। ভ্যাপসা গন্ধ তার নাকে ঢুকছিল। ঘরের মেঝেতে ধুলো জমে রয়েছে। দেওয়াল জুড়ে মাকড়সার জাল। দেওয়ালের এক কোণায় একটি মরচে পড়া বল্লম ছাড়া ঘরে আর তেমন কিছু নেই।
ঋকের স্কুলে এখন গরমের ছুটি। সে ও ঠাম্মা আগেই গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছে। মা আর বাবা আসবে আরো দু’দিন পর। চোরকুঠুরি লাগোয়া ঘরে একটা বুকশেল্ফ থাকায় ঋকের এই ঘরটাই খুব পছন্দ হয়ে গেল।
ঘুমটা সবে একটু ধরেছিল এমন সময় কে যেন ডাকল,“খোকাবাবু,ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?”
ঋক একবার ডাক শুনেই ধড়মড় করে উঠে বসল। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না। সে কি তবে স্বপ্ন দেখছিল!
তার মনের কথা বুঝতে পেরেই কে যেন আবার বলল,“না খোকাবাবু, স্বপ্ন নয়। আমি রঘু। আমিই তো তোমায় ডাকছিলাম। ”
ঋক ভালো করে তাকিয়ে দেখল তবু কাউকেই দেখতে পেল না। একটু দূরে ঠাম্মা একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রেখেছিল। ঋক খাট থেকে হ্যারিকেনের আলোটা একটু বাড়িয়ে দিল। আর তখনই সে দেখতে পেল একজন দশাসই লোক তার খাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটির গায়ে চাদর। হাঁটুর উপরে ধুতি। খালি পা। মাথায় কদমছাঁট চুল। হাতে একটা মরচে পড়া বল্লম। লোকটা ঋকের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে।
“তুমি কে?”
“ওই যে বললাম খোকাবাবু,আমি রঘু। রঘু ডাকাত!তবে সত্যিকার নয়। রঘু ডাকাতের অরিজিনাল ভূত। আসলে আমার সময়ে অনেক নকল রঘু ডাকাতও ছিল কি-না,তাই।”
“তা তুমি এতদিন পরে এখানে কেন? আমরা তো আজকেই এখানে এসে পৌঁছেছি। সে সংবাদ তুমি পেলে কেমন করে?”
রঘু এবার তার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত চালিয়ে বলল,“সে অনেক কথা। সেই গল্প শোনাব বলেই তো মাঝরাত্রে তোমার কাছে আসা। তবে তোমার ঘুমের ব্যাঘাত হবে না। যা কিছু বলব সংক্ষেপেই বলব। ওই যে চোরকুঠুরিটা দেখছো আমি এখন ওখানেই থাকি। অবশ্য যখন বেঁচে ছিলাম তখনও টানা তিন-দিন ওই চোরকুঠুরিতে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমাদের কত্তা মানে তোমার বাবার ঠাকুরদা আমায় এখানে থাকতে দিয়েছিলেন। কী? বিশ্বাস হচ্ছে না,তাই তো? না হবারই কথা। তখন ইংরেজদের শাসন চলছিল এদেশে। এই গ্রামের লোকেদের উপরও টেলার চার্চার ও তার বাহিনী একবার হামলা করেছিল। গ্রামের গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দিয়েছিল। আমি থাকতাম কুস্তোড় পাহাড় সংলগ্ন জঙ্গলে। টেলার চার্চার সাহেবের বাহিনীর হামলা আটকাতে আমি তোমাদের এই গ্রামে এসে কত্তাবাবুর সাথে যুক্ত হই। ডাকাতি করে যে সব সোনা-দানা পেয়েছিলাম সে সব কত্তাবাবুর হাতে তুলে দিই। তিনি সেই টাকা দেশের কাজে লাগালেন। পরে ডেপুটি কমিশনার সাহেব আমাকে ধরে নিয়ে যাবার নির্দেশ দিলে আমি এই চোরকুঠুরিতে আত্মগোপন করেছিলাম। তারপর পালিয়ে মোহনপুরা জঙ্গলে গিয়ে লুকিয়ে পড়ি। ”
ঋক বলল,“এসব ঘটনা আমাকে তো কেউ কোনদিন শোনায়নি! ”
রঘু অনেকক্ষণ ধরে বল্লমটা বাঁ হাত দিয়ে ধরে ছিল। এবার সেটা ডানহাতে নিয়ে বলল, “শোনায় নি তো কী হয়েছে? আমি তো শোনালাম। এই রে, গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল দেখছি! এ বার তুমি ঘুমিয়ে পড়,কেমন?”
ঋক বলল,“বল্লমটায় মরচে পড়ে গেছে যে। এই বল্লমে কোন কাজ হয়?”
“কাজ না হলেও এটা আমাকে হাতে রাখতে হয়,আমি যে রঘু ডাকাত খোকাবাবু সেটা ভুলে গেলে চলবে?”
হঠাৎ সাত আটটা চামচিকে এসে মাথার উপর ফরর্ ফরর্ করে উড়তে লাগল। তাদের ডানা ঝাপটানির চোটে রঘু বিরক্ত হয়ে সুড়ুৎ করে চোরকুঠুরিতে ঢুকে পড়ল।
“এত বড়ো দশশাই চেহারার লোকটা ঐ ছোট্ট দরজা দিয়ে এত সহজে ঢুকল কী ভাবে?” ভাবল ঋক।
চামচিকেগুলো এবার ঋকের মাথার কাছে পাক খেতে লাগল। দু’একবার তার মাথার চুলও ছুঁয়ে গেল। ঋক হুশ-হাশ শব্দ করে হাত দিয়ে সেগুলোকে তাড়াতে লাগল।
ঠিক তখনই ঠাম্মা পাশের ঘর থেকে এসে বলল, “ভয় পাস না ঋকসোনা,ওগুলো ভোরবেলায় এভাবেই ফর্ ফর্ করে উড়তে থাকে। তুই চোরকুঠুরির দরজা খুলে রেখেছিস বলেই ওগুলো ঘরে ঢুকে গেছে। ”
ঠামার কথায় ঋকের চোখ থেকে ঘুমটা ভালো করে কেটে গেল। বিছানায় বসে ঋক চোরকুঠুরির দিকে তাকিয়ে রইল। সে সারারাত ধরে কি স্বপ্নই না দেখেছে!রঘু ডাকাত!টর্চার সাহেব!
আসলে রাত্রিবেলায় ‘বাংলার ডাকাত” বইটা পড়তে পড়তে সে ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল। আর ঘুমের মধ্যে চোরকুঠুরিতে দেখা মরচে পড়া বল্লমটা হাতে নিয়ে রঘু ডাকাত অবলীলায় তার স্বপ্নে এসে হাজির। আবার মজার কথা স্বপ্নটা আবার পুরো স্বপ্নও নয়। ভোরবেলায় ঘর জুড়ে চামচিকেরা সত্যিসত্যিই ঘোরাফেরা করছিল। সব মিলিয়ে ঋকের স্বপ্নটা বেশ জমজমাট। এমনকি যে রঘু ডাকাতের ছবিটা সে বইয়ের পাতায় দেখেছে,স্বপ্নের রঘুও অবিকল সেরকমই। ঋক খোলা বইটা বন্ধ করে শেলফে রেখে দিল।
কৌতূহল মেটাতে স্নানের আগে ঋকি একবার চোরকুঠুরিতে ঢুকে পড়ল। সিলিং থেকে অনেকগুলো চামচিকে ঝুলে আছে। মেঝেতে প্রচুর ধুলোবালি। ঘরের ডানদিকে ছোট্টো একটি সুড়ুঙ্গ। ঋক সেখানে টর্চের আলো ফেলে একটা টিনের বাক্স আবিষ্কার করল। বাক্সে কি গুপ্তধন রয়েছে?
বাক্স খুলে ঋক যা পেল তা গুপ্তধনের চেয়ে কম কিছু নয়!একটা আতসকাচ,বেশ কিছু পুরনো হলদে হয়ে যাওয়া খবরের কাগজ। সে ধুলো ঝেড়ে খবরের কাগজটার নাম পড়ে দেখল, “তরুণশক্তি”। আরো দু’একটি হাবিজাবি জিনিসের পরে সে খুঁজে পেল আসল গুপ্তধন। কাচ দিয়ে বাঁধানো একটা মানপত্র। মানপত্রটি শ্রীযুক্ত রামগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় মানে রঘু আঙ্কেলের কত্তাকে দিয়েছিলেন “তরুণশক্তি” পত্রিকার সম্পাদক,আর তাতে প্রধান অতিথি হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু স্বয়ং। বাঁদিকে তারিখ দেওয়া আছে ফাল্গুনী পূর্ণিমা,১৯২৮।
ঋক মানপত্রটি খুব সাবধানে টিনের বাক্সে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর দেওয়ালে ঠেস দেওয়া মরচে পড়া বল্লমটায় হাত রেখে বলল,“রঘু আংকল,আমি কিন্তু বাক্সটা বাইরে নিয়ে চললাম।” ঋকের কথা শেষ হতেই দেওয়াল থেকে একটা চামচিকে উড়ে এসে আলতো করে তার চুল ছুঁয়ে আবার ঘরের ছাদে উলটো হয়ে ঝুলে পড়ল।
ছবিঃ মৌসুমী