“মামা, মামা দেখো, আমি কী পেয়েছি!”
লেখার টেবিলে মাথা রেখে প্রাণপণে ভাবছিলুম তখন। সেই বছর দুয়েক আগে একটা গল্প বেরিয়েছিল নামী পত্রিকায়। কিছু টাকাও পেয়েছিলুম। কিন্তু বন্ধুদের খাওয়াতে খাওয়াতে সে টাকা শেষ কবেই। শেষ বন্ধুকে খাইয়েছিলুম ওর কাছ থেকেই টাকা ধার করে। বন্ধু ক’দিন থেকে টাকাটার জন্য তাগাদা দিচ্ছে— হয় নতুন গল্প লেখ, নয়তো টাকা শোধ কর। শাসিয়ে রেখেছে, যদি ছ মাসের মধ্যে যদি গল্প প্রকাশ করতে না পারি তাহলে ও ফেসবুকে আমার পুরনো গল্পটা স্ক্যান করে পোস্ট করে দেবে। তাতে লিখে দেবে, এই গল্পটি আমার লেখা নয়। সমনামী কারও লেখা চালিয়াতি করে নিজের নামে চালিয়েছি।
কম্পিউটার, ফেসবুকে আমি তেমন সড়গড় নই। চোর বদনাম দেওয়া ফেসবুকের সেই লাইক-কমেন্ট-শেয়ারের ধাক্কা সামলাতে পারব না। তাই তিনদিন ধরে প্রাণপণে ভাবছি। মাত্র পাতা-দেড়েক লিখতে পেরেছি।
এমন সময় ভাগ্নেবাবু আমার ভাবনার ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকলেন। মাথা তুলে দেখলুম, দু’হাতের মুঠোয় কী সব ধরা আছে। মুখে খুশি খুশি ভাব। আমার বিরক্ত চোখের সামনে মুঠো মেলে বলল, “দেখো মামা, কোকিলের দুটো ডিম পেয়েছি।”
“কোকিলের ডিম! কোথা থেকে পেলি?”
“চিলেকোঠার ছাদ থেকে।”
“চিলেকোঠার ছাদ থেকে! এই বাঁদর! ওটা তো কাকের বাসা। তুই কাকের বাসায় হাত দিয়েছিলি? তাই বলি কাকগুলো কেন এত চেঁচাচ্ছে! ফ্যাল ফ্যাল, ফেলে দে।”
বলার সঙ্গে সঙ্গে উনি হাত আলগা করে দিলেন। দুটো ডিমই ফটাস। আমার গল্প কুসুমে মাখামাখি হয়ে গল্পের কবিরাজি কাটলেট হওয়ার অপেক্ষায়। রাগে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞাসা করলুম, “খাতার ওপরে ডিম ফেললি কেন?”
“বা রে! তুমিই তো বললে?”
“আমি তোকে টেবিলের ওপরে ডিম ফেলতে বলেছিলুম? হতভাগা, মর্কট! ”
সামলাতে না পেরে লাগিয়ে দিলুম ঠাস করে এক চড়। হাঙরের মতো হাঁ করে ভাগ্নে চেঁচাতে শুরু করল। চিৎকারের চোটে মা আর দিদি দু’জনেই উপস্থিত। ওরা কিন্তু ভাগ্নের এতটুকু দোষ দেখতে পেল না। মা তো রেগে গিয়ে আমার ওপরেই একচোট নিল, “ভাগ্নে মারলে হাত কাঁপে জানিস?” বললুম, “আমার তো মারার আগে থেকেই কাঁপছিল, রাগে।”
দিদি বোধহয় আমার রাগের কারণ বুঝতে পারছিল। ও বলল, “টেবিলে দুটো ডিম ফেলেছে বলে আমার ছেলেকে মারলি! মনে আছে, কী করেছিলি আমার ওয়ার্ক এডুকেশনের খাতায়? লতাপাতা এঁকে খাতাটা নষ্ট করেছিল কে? পরীক্ষার তিনদিন আগে রাত জেগে খাতা তৈরি করতে হয়েছিল। এক ঘা-ও মেরেছিলুম তোকে?”
আমি সাফাই দিয়ে বললুম, “তুই তো মাকে বলছিলি, খাতায় সুন্দর করে ছবি এঁকে দিতে। আমি ভেবেছিলুম, মা এত কাজ করে কখন আবার তোর খাতায় আঁকবে? তাই সাহায্য করেছিলুম। তোর পছন্দ না হলে আমি কী করব। এখন দোষটা তো তোর। তুই কেন ছেলেকে শিখিয়েছিস, কাকের বাসায় কোকিলের ডিম থাকে?”
দিদি বলল, “আমি শিখেছিলুম বলে শিখিয়েছি।” বলে আরও কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু তার আগে ভাগ্নেই বলে উঠল, “মা জান তো আমি মামাকে ওটাই জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলুম। মামা ডিম ফেলে দিতে বলল বলে আমি ফেলে দিলুম। মামা আমাকে মারল। ওমা, মা, বল না, কোকিল কেন কাকের বাসায় ডিম পারে?”
“এই দীপু, বল ভাগ্নেকে। খুব তো গল্প লিখিস! দিদির এখন সময় নেই। ও আমার সঙ্গে রান্নাঘরে যাবে।” মা আমাকে রেগেমেগে নির্দেশ দেয়। সেই সঙ্গে শাসিয়ে যায়, “আর এক ঘা-ও যদি মেরেছ ওকে তাহলে ভাপা ইলিশ থেকে তুমি বাদ।”
দু’জনে গটগট করে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে দিদি হাত নেড়ে, মুখ ভেংচে অঙ্গভঙ্গি করে, যার মানে, ঠিক হয়েছে। আমার ছেলেকে মারা! এখন কেমন মজা দেখ।
মজাটা যে বেড়ে তা গল্প শুরুর আগেই টের পেলুম। কোকিল কেন কাকের বাসায় ডিম পারে? আমি কী করে জানব! ডারউইন কি কিছু বলে গিয়েছেন? পক্ষীবিদ অজয় হোম কিছু বলেছেন? তবে কি মৎস্যপুরাণের মতো আমাকে এখন মুখে মুখে বায়সপুরাণ বানাতে হবে? ঠিক হ্যায়, পুরাণ কথা দিয়েই কাজ হাসিল করে দেব। “জ্যাক অ্যান্ড জিল” পড়া বাচ্চা তো! ঠিক ঘায়েল হয়ে যাবে।
“বুঝলি, সে অনেকদিন আগের কথা।”
“কতদিন আগের মামা? একশো বছর?”
বুঝলুম বাচ্চা ছেলে তো, তাই ওর কল্পনাশক্তি একশোর সীমানা পার করতে পারছে না। বললুম, “সে অ-নে-ক বছর। কোটি কোটি বছর। তখন পৃথিবী সবেমাত্র তৈরি হয়েছে।”
“কে তৈরি করল?”
“ব্রহ্মা রে ব্রহ্মা।”
“ব্রহ্মার কি কারখানা ছিল?”
বেসিক প্রশ্ন। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার উৎপাদন হতো কীসে? কারখানায় না জমিতে? জানি না তো! কারখানা-জমির টানাপড়েন সাংঘাতিক। তাই সেদিকে না গিয়ে মোলায়েম সুরে বললুম, “ব্রহ্মার কারখানা ছিল কি না সেটা তো বইতে লেখেনি। কিন্তু তুই বেশি কথা বলিসনি। তাহলে আমি কিন্তু ভুলে যাব। শোন, পৃথিবী তো তৈরি হল। এবার সমস্যায় পড়লেন ব্রহ্মা। গাছপালা, পশুদের নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। ওরা ঠিক সংখ্যায় বাড়বে। কিন্তু পাখিদের কী হবে? ওরা তো সবসময় ওড়াওড়ি করবে। তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর মিলে ঠিক করলেন, পাখিরা ডিম পাড়বে। কিন্তু পাড়বে কোথায়? তার জন্য তো একটা সুরক্ষিত জায়গা চাই। ব্রহ্মার চিন্তা দূর করতে বিষ্ণু বললেন, ‘প্রজাপালন তো আমার বিভাগ। আমি জানি, কীভাবে প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন করতে হয়। আপনি শুধু দেবরাজ ইন্দ্রকে বলে দিন, সরস্বতী যেন ওর কারিগরি শিক্ষাবিভাগ থেকে বিশ্বকর্মাকে কিছুদিনের জন্য প্রাণিসম্পদ বিভাগে বদলি করে। বিশ্বকর্মা নীড় রচনা শেখাবেন পাখিদের।’ বিষ্ণুর কথা শুনে ব্রহ্মা চারগালে হাত দিয়ে বসে রইলেন। নীড় আবার কী?”
ভাগ্নে জানতে চাইল, “চার গালে কেন মামা?”
আমি বললুম, “ব্রহ্মার চারটে মুখ, চারটে হাত। তাই উনি যখন ভাবেন তখন চারগালে হাত দিয়েই ভাবেন। তা বুঝলি, ব্রহ্মাকে চিন্তিত দেখে বিষ্ণু বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা। তিনি বললেন, ‘হে চতুরানন, আপনি বৃথাই চিন্তা করছেন। ও কাজ বিশ্বকর্মার ওপরে ছেড়ে দিন। বিশ্বকর্মা শিক্ষালয় স্থাপন করে পাখিদের শিখিয়ে দেবেন কীভাবে নীড় রচনা করতে হয়।’
“বিষ্ণুর পরামর্শমত সব পাখিদের জোড়াকে বিশ্বকর্মার ইস্কুলে ভর্তি করা হল। তখন সবরকম পাখিই ছিল দুটো করে। দুটো শালিখ, দুটো চড়াই, দুটো প্যাঁচা— সব দুটো করে।
“স্কুলে ভর্তি হতে হবে শুনেই হাঁসদুটো মানস সরোবরের জলে ঝাঁপ দিল। ওরা পড়াশোনা করতে চায় না। ঘুরতে চায়। ব্রহ্মা বললেন, ‘নীড় রচনা ওদের শিখতেই হবে। পালিয়ে পার পাবে না। আমি ইস্কুলছুটদের জন্য আলাদা শিক্ষক নিয়োগ করব। বাকিরা বিশ্বকর্মার ক্লাসে চলে যাক।’
“বুঝলি, বাকিরা ক্লাসে গেল আর সেই হাঁস দুটোর জন্য ব্রহ্মা ময়দানবকে মাস্টার রাখলেন। ময়দানব কে জানিস তো? বিশ্বকর্মা যেমন দেবতাদের ইঞ্জিনিয়ার ময়দানব তেমনি দৈত্যদের ইঞ্জিনিয়ার। বেশ রাগী মাস্টার। ময়দানব সরোবরের পাড়ে গিয়ে হাঁস দুটোকে চইচই করে ডাকলেন। কিন্তু ওরা এল না। ময়দানব চেঁচিয়ে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি চলে আয়। দেরি করার উপায় নেই। বিকেলে দৈত্যরাজ বলির বাড়িতে টিউশন আছে। ওঁর ছেলেকে আমি বজ্র তৈরি করা শেখাচ্ছি। এমন বজ্র তৈরি করব দেখবি। ইন্দ্রর থেকেও হেভি হবে। তোদের বাসাটাও ফ্যান্টাস্টিক হবে। চলে আয়, চইচই।’
“হাঁসগুলো আসবে কী, ময়দানবের গম্ভীর গলা আর বিকট চেহারা দেখেই ভয় পেয়ে গেল। ওরা সরোবর ছেড়ে উড়ে গিয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ল। ওদের আর বাসা তৈরি শেখা হল না। তখন ক্লাসে ফাঁকি দিয়েছিল বলেই হাঁসেরা এখনও বাসা বাঁধতে পারে না। জলাশয়ের পাড়ের ঝোপে ডিম পারে।
“জানি। ডিসকভারি চ্যানেলে দেখেছি।”
“বাহ্, খুব ভাল। তারপর শোন, ইস্কুল-ছুট হাঁসগুলো কিছু না শিখলেও ময়দানব মাসে মাসে মাইনে পেতেন। রোজ ক্লাসের সময়ে একবার করে সরোবরের পাড়ে গিয়ে চেঁচান। ওঁর চিৎকার শুনে হাঁসগুলো ঝটপট বনের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। ময়দানব চলে যান। ওইসময় তিনি নতুন টিউশনি নিয়েছেন। দেবসেনাপতি কার্তিককে নতুন অস্ত্র তৈরি শেখাচ্ছেন। ময়দানবের অস্ত্রব্যাবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। দেবতা আর দৈত্য দুদিক থেকেই লাভ। ওদিকে, বিশ্বকর্মার ক্লাস রমরম করে চলছে। দারুণ উন্নতি করছে টুনটুনি আর বাবুই। বিশ্বকর্মা যতবার ক্লাস টেস্ট নিয়েছেন, ততবারই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে বাবুই আর টুনটুনি জোড়ার মধ্যে। একবার ওরা ফার্স্ট তো একবার এরা।”
“মামা, আমাদের ক্লাসের রাকেশ আর রাহুলের মধ্যে এরকম কম্পিটিশন হয়।”
“তা তো হবেই। মানুষ, না-মানুষ সবই তো ব্রহ্মার সৃষ্টি। তারপর শোন, ভাল ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে বিশ্বকর্মার কোনও সমস্যা ছিল না। সমস্যা হল গবেটগুলোকে নিয়ে। শকুনি আর ঈগল ভীষণ মাথামোটা। বিশ্বকর্মা এতরকম মডেল করে দেখালেন। কিন্তু কোনওটাই ওরা শিখতে পারল না। শিখবে কী করে? শকুনিরা তো সারাক্ষণ ক্লাসে ঝিমোয় আর ঈগল-জোড়া ক্লাসরুমের পাশে পারিজাত ফুল গাছে লাফিয়ে বেড়ানো কাঠবেড়ালিগুলোকে ধরার জন্য চংবং করে।”
“মামা সুমিত না ঈগলের মতো। ও জানলা দিয়ে শিউলালের ভেলপুরির দোকানের দিকে চেয়ে থাকে। কত মার খায় সে জন্য।”
বুঝলুম, গল্প ভালই এগোচ্ছে। এবার তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। না হলে ব্যাটাকে নীচে পাঠানো যাবে না। বললুম, “শুধু ওরা নয়, পায়রাজোড়াও সমস্যা করে। দুজনেই সারাক্ষণ ডানার পালক সাফ করতে ব্যস্ত। চড়ুইজোড়া ভীষণ চঞ্চল। ছটফট করে আর পাশে বসা সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী ভাবের প্যাঁচা-প্যাঁচানির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। প্যাঁচারা রেগে গিয়ে চড়ুইদের আস্তে করে ধমক দেওয়ার চেষ্টা করলেও ক্লাস গমগম করে ওঠে। বিশ্বকর্মা রোজই প্যাঁচাদের ডানার ওপরে দাঁড় করিয়ে দেন।
“একদিন প্যাঁচা করেছে কী, বিশ্বকর্মা অন্যদিকে ফিরতেই চড়ুইকে দিয়েছে ডানার এক ঝাপটা। চড়ুই ছিটকে গিয়ে পড়েছে দু বেঞ্চ আগে বসা টিয়াজোড়ার ঘাড়ে। সঙ্গে সঙ্গে টিয়াদের ক্যাঁচক্যাঁচ আর এদিকে চড়ুইয়ের চ্যাঁচানি। বিশ্বকর্মা প্যাঁচা-চড়ুই সবাইকে বাইরে বের করে দিলেন।”
“মামা, আমাদের ক্লাসের দীপ্তকে রোজ ওইরকম বাইরে করে দেন বেশিরভাগ স্যার।”
মনে মনে বললুম, তা তো হবেই। আমি তো তোর-আমার ছোটবেলা থেকে চুরি করে গল্পটা বানাচ্ছি। মুখে বললুম, “তুই আবার কথা বলছিস? এবার কিন্তু গল্প বলা বন্ধ হয়ে যাবে।”
“না, না। আর একটা কথা বলে চুপ করে থাকব। মামা কাক-কোকিল কোথায় গেল? ওরা ক্লাসে নেই?”
“আছে, আছে। সবাই আছে। ওদের কথা এখন বলছি না। বলতে শুরু করলে আর কারও কথা বলা যাবে না। বুঝলি, বদমাশ আর গবেট পড়ুয়াদের কী হবে সেটা জানতে বিশ্বকর্মা বিষ্ণুর সঙ্গে দেখা করলেন। প্রাণীসম্পদ উন্নয়ন তো ওঁরই ডিপার্টমেন্ট। বিশ্বকর্মার মুখ থেকে ফাঁকিবাজ আর মাথামোটা ছাত্র-ছাত্রীদের ফিরিস্তি শুনে বিষ্ণু বললেন, ‘তুমি তো ভারি বোকা হে বিশু!’ ”
“বিশু কে মামা?”
“বিশু মানে বিশ্বকর্মা। বিষ্ণু তো তিন প্রধান দেবতাদের একজন, তাই উনি কম গুরুত্বপূর্ণ দেবতাদের ডাকনাম ধরে ডাকেন। বিষ্ণু বললেন, ‘তোমার মতো গবেট মাস্টার তো দুটি নেই দেখছি! বেতনটি ঠিকঠাক পাচ্ছ তো হে? কে তোমাকে শিল্পকলা-চারুকলা ফলিয়ে বিদ্যার মান উন্নত করতে বলেছে? তুমি শুধু কোনমতে একটা বাসা খাড়া করা শিখিয়ে দাও। যাতে ডিমগুলো গড়িয়ে না পড়ে। আমি সরস্বতীর দফতরে রিপোর্ট করে দেব, সব পাশ। কেউ ফেল করার মতো নেই। মনে রাখবে, যারা ভাল ফল করার তারা এমনিতেই করবে। তাড়াতাড়ি মিশন-নীড় শেষ করো বিশু। আমাদের কাছে খবর আছে, যুদ্ধ লাগল বলে। তোমার মেধাশ্রম অস্ত্র তৈরিতে খরচ করো। যাতে দৈত্যরা ভয় পায়।’
“ ‘হে নারায়ণ, শকুনি আর ঈগল তো বাসার নামে একটা করে বিশাল ঝোপঝাড় তৈরি করছে।’
“ ‘তাই করতে দাও না। শুধু বলে দেবে, মাঝে যেন ডিম রাখার আর তা দেওয়ার মতো ফাঁক রাখে।’
“ ‘অন্যদের কী হবে?’
“ ‘অন্যদের? পায়রা যেমন অলস বলছ তাতে ওদের মানুষের দালান-কোঠায় বাসা করাই ভাল। চড়ুইকে বাড়ির ঘুলঘুলিতে ঢুকিয়ে দাও। যেহেতু প্যাঁচা কারও সঙ্গে মিশতে পারে না তাই ওরা গাছের কোটরে থাকুক। টিয়াদের খুব কাটাকাটির স্বভাব তো? ওরা গাছের কাণ্ড কেটে বাসা তৈরি করুক না। সমস্যা শেষ। এবার আমি আসি?’
“‘না, নাহ্। যাবেন না প্রভু। এখনও আসল সমস্যা বলা হয়নি। কাক আর কোকিল জোড়াদের নিয়ে কী করি? ওরা এত জ্বালাতন করে যে ইচ্ছে করে দু’চারটে থাপ্পড় লাগিয়ে দিই।’
“ ‘খবরদার ওই কাজটি করো না, বিশু। গণেশের চ্যালা গণদেবতাদের জান তো? ওরা সব হাফ-দেবতা। ফুল দেবতা হওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজছে। তুমি মারলেই তা নিয়ে আন্দোলন শুরু করবে। সেই সুযোগে ব্রহ্মার কাছ থেকে নম্বর বাগিয়ে ফুল দেবতা হয়ে যাবে।’
“ ‘তা বলে জ্বালাতন করলেও মারা যাবে না?’
“ ‘না হে, সে সুখ নেই। কাক-কোকিলকে সহিংস বা অহিংস যে পদ্ধতিতেই শেখাও না কেন, শোধরাবে না। ওদের সৃষ্টির সময়ে পিতামহ ব্রহ্মার মতিভ্রম ঘটেছিল। তাই এই অবস্থা। শোনো বিশু, তুমি শুধু চোখ-কান বুজে তোমার সময়টা কাটিয়ে দাও।’”
“মামা, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“সবটা বোঝার দরকার নেই। গল্পে কাক-কোকিল ঢুকে পড়েছে, এটা বুঝতে পারছিস তো? ব্যাস! এবার শোন। বিষ্ণুর সঙ্গে কথাবার্তা হওয়ার পরে কাক-কোকিলের অত্যাচার যেন শতগুণে বেড়ে গেল। কাক-জোড়া সহপাঠীদের জিনিস চুরি করে। কোকিলেরা অন্যদের ভ্যাঙায়। এমনকী বিশ্বকর্মাকেও নকল করে। বিশ্বকর্মার রাগ হয়। কিন্তু কিছুই করতে পারেন না। বুঝলি, একদিন ভীষণ রেগে গিয়ে তিনি তেড়ে গেলেন কাক-কোকিলের দিকে। দেবেন আজ তুলে এক আছাড়। কাকের ডানা পাকড়াবেন বলে যেই হাত বাড়িয়েছেন ওমনি কোকিলটা চেঁচিয়ে উঠল, ‘মারবেন না, মহাশয়। আমরা ব্রহ্মার কাছে নালিশ করব।’ বিশ্বকর্মা বুঝলেন, বিষ্ণুর সঙ্গে তাঁর কথা সব এরা শুনেছে। তাই এত বাড়বাড়ন্ত। মুখে বললেন, ‘চাকরি যায় যাবে, তোদের চারটেকে আজ ক্লাসের বাইরে ছুড়ে ফেলে দেব।’ তিনি সবকটাকে বাইরে বের করে দিলেন।”
“ঠিক হয়েছে বের করে দিয়েছে। আমাদের ক্লাসের সঞ্জয় আর পার্থকেও বের করে দেন স্যারেরা, তবে আমরা পড়া শুনতে পাই।”
শুনে ভাল লাগল। তাহলে দুষ্টু ছেলেদের শাস্তি দেওয়ার দরকার আছে। মুখে বললুম, “একবার শাস্তি দেওয়ার পরে বিশ্বকর্মার সাহস বেড়ে গেল। উনি দেখলেন, তেমন কোনও বিপদ ঘটছে না। কাক-কোকিল একটু ট্যাঁ-ফো করলেই ক্লাসের বাইরে। ওরাও কি কম বদমাশ! একদিন বাইরে গেল। দু’দিন গেল। তিনদিনের দিন থেকে বদমায়েশি শুরু করল। একদিন ব্রহ্মার মানসপুত্র দক্ষ যাচ্ছিলেন। কাক আর কাকিনী সোজা গিয়ে ওঁর শিংয়ে বসে দু’কানে দুই ঠোক্কর। যেরকম করে কাকেরা গরুর কানের পোকা বাছে। জানিস তো দক্ষের মাথাটা ছাগলের? ব্রহ্মার জন্য ফল নিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠোক্করের চোটে দক্ষের হাত থেকে ফলগুলো ছিটকে পড়ে গেল। কোকিল সঙ্গে সঙ্গে ফল ঠুকরে খেতে শুরু করল। বিশ্বকর্মা ছুটে এসে কোনওমতে দক্ষকে ঠান্ডা করেন।
“তারপর একদিন ঘটে গেল সেই অঘটন। সেদিনও ওরা বাইরে। ক্লাসের বাইরে স্বর্গের ফুল পারিজাত গাছের নীচে বিশ্বকর্মার হাতিটা দাঁড়িয়ে থাকে। কাক-কোকিল ফিসফিসিয়ে কীসব বলল। তারপর চারজনেই উড়ে পারিজাতের ডালে গিয়ে বসল। কোকিল মিঠে স্বরে বলতে শুরু করল, ‘জানিস, ওইদিকে একটা কলাবাগান আছে। কাঁদি কাঁদি সোনালি, মিষ্টি কলা ঝুলছে।’
“ ‘জানিনি আবার! কত খেইচি।’
“শুনেই বিশ্বকর্মার হাতি শুঁড় তুলে দুবার ঝোল টানার মতো করে শুঁকে নিল। ওরা বুঝল হাতির লোভ লেগেছে। কাক একেবারে নীচের ডালে এসে হাতিকে বলল, ‘যাবে নাকি গো হাতিদাদা? কলাগাছগুলোও হেব্বি। থামের মতো বিশাল বিশাল।’
“হাতি হ্যাঁ-না করতে করতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘না গো, এক্ষুণি প্রভুর ছুটি হবে। আমাকে দেখতে না পেলে বকবে।’ কাকিনী বলল, ‘আরে দূর! এই তো সবে সবাইকে কুটি ধরা শেখাচ্ছে। ওরা কুটি তুলবে, বাসা বাঁধবে। বিশ্বকর্মাকে দেখাবে। তবে তো ছুটি!’
“হাতির ইচ্ছা থাকলেও বকুনি খাওয়ার ভয়ে যেতে সাহস পাচ্ছিল না। তাছাড়া এরা কেন বাইরে সেটাও জানতে হয়। হাতি জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমরা কেন বাইরে গো?’
“কাক বলল, ‘আমরা সবচেয়ে ভালো বাসা বুনতে শিখেছি বলে কেলাসের অন্য পাখিরা খুব হিংসে করে। সে জন্য মাস্টার বলল, যা তোদের ক্লাসে থাকার দরকার নেই। তা কী ঠিক করলে?’ হাতি জানতে চাইল, ‘বেশি দেরি হবে না তো?’ কাক অভয় দিয়ে বলল, ‘আরে না, না। এই তো যাব আর আসব।’
“কলাবাগানটা আসলে ছিল দৈত্যরাজ বলীর। হাতি বাগানে ঢুকে যেই কলাগাছের দিকে এগিয়েছে কোকিল বলল, ‘এদিকে নয়, ওদিকে।’ হাতি সেদিকে ঘুরতেই কাক আর কাকিনী দু’দিক থেকে আক্রমণ করল হাতির চোখে। ব্যথায় চিৎকার করে উঠে ছুটতে গিয়ে হাতিটা ধাক্কা মারল একটা কলাঝাড়ে। ধাক্কা মারার সঙ্গে সঙ্গে শয়ে শয়ে ভীমরুল হুল ফোটাতে শুরু করল। যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে হাতি ছুটতে শুরু করল। ঠোক্করের চোটে চোখেও কিছু দেখতে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই কলাবাগান তছনছ।”
একবার তাকিয়ে দেখলুম ভাগ্নেবাবুর দিকে। উনি চোখ গোলগোল করে গল্প শুনছেন। আবার শুরু করলুম। “বুঝলি, বাগানে একটা গোপন ঘর ছিল। সেখানে ময়দানব বলীর ছেলেকে অস্ত্র তৈরি শেখাতেন। হাতির প্রচণ্ড হাঁকডাক শুনে বেরিয়ে এসে ময়দানব দেখেন, বিশ্বকর্মার হাতি ছোটাছুটি করছে। হাতিটাকে প্রহরী দিয়ে ধরার ব্যবস্থা করে তিনি বলীকে খবর পাঠালেন। এদিকে বিশ্বকর্মাও ইস্কুল ছুটির পরে হাতি খুঁজছেন। এমন সময় ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র এসে হাজির। ইন্দ্র উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ‘সর্বনাশ হয়েছে! তোমার হাতির জন্য বলী দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আমার রাজ্যপাট গেল।’ বিশ্বকর্মা অবাক। ব্রহ্মা বললেন, ‘ময়দানব বলীকে বুঝিয়েছে, ও বলীর পুত্রকে সাংঘাতিক মারণাস্ত্র তৈরি এবং ব্যবহার শেখাচ্ছিল। দেবতারা না কি কায়দা করে তোমার হাতি পাঠিয়ে ওদের মারণাস্ত্রের গোপন কারখানা ভাঙতে পাঠিয়েছিল।’
“বিশ্বকর্মা বললেন, ‘হে চতুরানন, আপনি যত শীঘ্র সম্ভব দেবর্ষি নারদকে দূত হিসাবে পাঠান। দেবর্ষি যেন অনুরোধ করেন, আমাকে হাতির কাছে নিয়ে যেতে। তাহলেই সত্য জানা যাবে।’ বুঝলি, নারদের সব জায়াগাতেই ভাল যাতায়াত। তাঁর কথায় বিশ্বকর্মাকে হাতির কাছে যেতে দেওয়া হল। হাতি তখন খুব কাঁদছে। সব সত্য জানা গেল। বলীও দেখলেন, হাতির দু’চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। সারা গায়ে ফোলা ফোলা। বাগানে ভীমরুলের ভাঙা চাকটিও মিলল। তিনি লিখিত ক্ষমা চেয়ে হাতি ফেরত দিলেন। আশ্বাস দিলেন, ভুল বুঝিয়ে দেবাসুরে যুদ্ধ লাগানোর চেষ্টার অপরাধে ময়দানবকে বরখাস্ত করে তদন্ত চালানো হবে।
“বিশ্বকর্মা হাতি নিয়ে ফেরত আসছেন। একটা গাছ থেকে কাক-কোকিলেরা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। ওদের আনন্দ দেখে বিশ্বকর্মা রেগে গিয়ে অভিশাপ দিলেন, ‘তোদের জন্যই আমার হাতির এই অবস্থা। অভিশাপ দিলাম, তোদের ওই বন্ধুত্ব থাকবে না। কোকিল, তোরা কোনওদিন বাসা বাঁধতে শিখবি না। কাকের ডিম ফেলে ওদের বাসাতেই ডিম পাড়বি। তাহলেই তোদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে।’ বুঝলি, সেই থেকে কোকিল কাকের বাসায় ডিম পাড়ে।”
“আচ্ছা মামা, কাকের ডিম যদি ফেলেই দেয় তাহলে কাক কেন এত বেশি? কোকিল কেন এত কম? আমাদের ওখানে তো কোকিল দেখাই যায় না।”
“এ তো আমি জানি না বাবা। এসবই সালিম আলি জানেন।”
“সালিম আলি কে মামা?”
“একজন পক্ষীবিশারদ।”
“পক্ষীবিশারদ কী মামা?”
ওরে বাবা! এ যে প্রশ্নের মালট্রেন। এ তো শেষ হওয়ার নয়। পক্ষীবিশারদ কী জানার পরে প্রশ্ন করবে তাঁরা কী করেন? কেন করেন? কোথায় এত পাখি দেখতে যান? আজ আর গল্প লেখা হবে না। প্রশ্নের গাড়ি গুনতে গুনতে কখন রাগের মাথায় ঠাস করে আবার চড় লাগিয়ে দেব। আমার ইলিশ ভাপা বন্ধ হয়ে যাবে। তার থেকে পালাই বাবা। দুপুরবেলা খাবার সময় বাড়ি ঢুকব। মা-দিদি কি না দিয়ে থাকতে পারবে?
মনে হতেই তড়াক করে লাফিয়ে ছুট লাগালুম। আমাকে পালাতে দেখে ভাগ্নেও চ্যাঁচাতে শুরু করল, “ও মামা, পালাচ্ছ কেন? ও মা, ও দিদুন, দেখ না মামা গল্প না বলে পালাচ্ছে। ও মা, ম্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ…”
আমি তখন রাস্তায়। প্রাণপণে ছুটছি।
ছবিঃ শিমুল