গল্প

প্যাঁচে পয়জারে পঞ্চানন-জয়দীপ চক্রবর্তী

galpojoydeep01 (Small)পঞ্চানন পাল মানুষটা এমনিতে খারাপ নয়। নিজের গাঁয়ে সে বেশ পরোপকারী হিসেবেই পরিচিত। তাছাড়া সে পাঁচজনের কথায় বড় একটা থাকে না। কারো সাথে ঝগড়াঝাঁটি, মন কষাকষিও নেই তার। পঞ্চাননের পূর্বপুরুষেরা বেশ বিত্তবান ছিলেন একসময়। শুধু এ গ্রাম নয়, আশ পাশের দশ বিশটা গ্রামে সুনাম ছিল তাঁদের। গ্রামের পুরোন লোকেরা এখনও তাকে ডেকে মাঝে মাঝেই দুঃখ করে বলেন, “ওহ, হাত ছিল বটে পঞ্চা তোর বাপ পিতামহের। অমন বনেদি চোর সারা দেশে ঢুঁড়ে বেড়ালেও হবে না আর। কী শিল্প রে! পাশে বসে পকেট সাফ করে দেবে হাসতে হাসতে। মানুষ টেরটিও পাবে না। পুলিশকে চিঠি দিয়ে চুরি করতেন তাঁরা গেরস্তের বাড়িতে। ছা পোষা মানুষেরা সম্ভ্রম করত তাঁদের। কপালে হাত ঠেকিয়ে নমো করত সন্ধেকালে। আর বলতে নেই, কী মন ছিল রে বাপু তাঁদের। একবার বিশ্বাস পাড়ার নিশি বিশ্বাসের বাড়িতে চুরি হল লক্ষ্মীপুজোর রাতে। অত মানুষজনের মধ্যে মা লক্ষ্মীর গলার বিছে হারটা গায়েব হয়ে গেল। কেউ টেরটি পেল না। পরদিন পুলিশে না গিয়ে নিশি বিশ্বাস সটান চলে এল তোর বাপের কাছে। রাগ নয়, অভিযোগ নয়, নরম গলায় বললে, ‘বিশু, মায়ের গলার বিছে হারটা মেয়ের বিয়েতে দেব কথা দিয়েছি বেয়াইবাড়িতে। সামনের মাঘে বিয়ে ঠিক হয়েছে মেয়ের। মায়ের গলায় দিয়ে গয়নাটা পয়মন্ত করে নেব ভেবেছিলুম। ওটা খোয়া গেলে বিয়েটাই যে ভেঙে যাবে বাবা। ও গয়না তো আর দুবার বানাবার সামর্থ্য নেই আমার।’ চোখে জল এসে গেল তাঁর। বিশু পাল গম্ভীর গলায় বলল শুধু, ‘বাড়ি যান কত্তা, আমি আছি। দেখছি কী করা যায়। আমি থাকতে আপনার মেয়ের বিয়েতে ক্যাচাল হতে দেব না।’ বললে বিশ্বাস করবে না হে, বিসর্জনের আগেই দেবীর গলায় গয়না ফিরে এল। এবারেও গয়না কখন ফেরত এল, কে আনল কেউ কিছুই জানতে পারল না। কী শিল্প ভাবো। আহা এঁরাই ছিলেন প্রকৃত শিল্পী। আমরা গাঁয়ের লোকেরা এঁদের নিয়ে গর্ব করতে পারতুম।”

তা এই হাতযশের প্রভাবে টাকা পয়সা গয়নাগাটি ভালোই উপার্জন করেছিলেন তাঁরা। তার সবটা যে খরচ হয়ে গেছে তাও না। আসলে সব খরচ করা যায়ও না। এ সব গয়না বিক্কিরি টিক্কিরি করতে গেলে ঝক্কি আছে। দূরে যেতে হবে। বিশ্বস্ত স্যাকরা হওয়া চাই। তারপর দামদস্তুর নিয়ে নরমেগরমে তক্কাতক্কি করে লাভটা বুঝে নিতে হয়। এত সব বায়নাক্কা পঞ্চাননের পোষায় না। এক সময় গায়ে গতরে খেটে রাতে ভিতে অনেক পরিশ্রম করে যা আয় টায় করে গিয়েছিলেন তার বাপ ঠাকুদ্দারা তাই দিয়েই দিব্বি চলে যায়। চাষের জমি আছে। সেখানে সারা বছরের চাল হয়ে যায়। ক্ষেতের ফসলে বছর কেটে যায়। পুকুরে মাছ আছে। তবু শুধুমাত্র বংশের ধারাটাকে বজায় রাখার জন্যেই পঞ্চাননকে রাতে ভিতে বেরোতে হয় মাঝে মাঝে। মরার আগে বাবা বলে গিয়েছিলেন, “আমি চোখ বুজলে আর যাই করিস বাবা, বংশের জাত ব্যাবসাটা ছাড়িস নি। এ অনেক সাধনার ধন, হেলায় নষ্ট করিস নি বাপ, আমাদের আগে গত হয়েছেন যাঁরা তাঁরা মনে ভারী কষ্ট পাবেন। তাছাড়া অবহেলায় সব বিদ্যেই ভোঁতা হয়ে যায়। সেই শিশুকাল থেকে ভালো শিক্ষক দিয়ে যে বিদ্যে শিখিয়ে গেলুম তোকে, অনভ্যাসে তা হাত থেকে ফসকে কোথায় হারিয়ে যাবে বাবা। সবসময় মনে রাখিস, পৃথিবীর কোনো বিদ্যেই ফেলনা নয়। কখন কী কাজে লেগে যায় কেউ বলতে পারে না…”

বাবার শেষ কথাটা ফেলতে পারে নি পঞ্চানন। প্রয়োজন নেই, কিন্তু অভ্যাসটা ধরে রেখেছে সে। তাই বলে এমন নয় যে গেরস্থের সোনাদানা টাকাপয়সা চুরিচামারি করে সে। সে তো আসলে চোর নয়, সে শিল্পী। একটা বিশেষ বিদ্যে চর্চায় রেখে দিতে চায় সে শুধু। আর সে জন্যেই একটু আধটু এ গ্রাম ও গ্রাম ঘোরাঘুরি করতে হয় তাকে। আর এই ধরনের ঘোরাঘুরিতে সবাই জানে শাস্ত্রমতে রাত্তিরটাই শুভ। কেননা দিনেদুপুরে মানুষজন জেগে থাকে যখন, এ ব্যাবসাটা ঠিকঠাক জমে না। জাগ্রত মানুষ এ ক্ষেত্রে বড় বিপদের। তারা কাজের সময় স্বভাবদোষে অহেতুক বড় গোল পাকায়। আর তাদের গোল পাকানোর কথাটা মাথায় এলে সাধারণ খেটেখুটে খাওয়া গৃহস্থ মানুষগুলোর জন্যে পঞ্চাননের মনটাও ভারী দুর্বল হয়ে যায়। সারাদিন পরিশ্রমের পর কোথায় একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোবে মানুষ সে উপায় নেই। বেমক্কা ঝামেলায় ফেলা তাদের।

তবু করতে হয় এ কাজ। হাতটাকে চালু রাখার তাগিদ তো আছেই, তাছাড়া ইউনিয়নে মান সম্মানেরও ব্যাপার আছে একটা। এই ইউনিয়নের ব্যাপারটা আগে ছিল না, সম্প্রতি হয়েছে। ‘তস্কর স্বার্থ সুরক্ষা সমিতি’ এখন নিয়ম করে মাসে একবার মিটিংয়ে বসছে বর্ষীয়ান চোর সত্যকাম মন্ডলের নেতৃত্বে। সত্য জেঠুর সাথে পঞ্চাননের প্রায় পারিবারিক সম্পর্ক। সেই ছোটোবেলা থেকে এ বাড়ি ও বাড়ি যাতায়াত তাদের। কাজেই বয়স্ক লোকটার কথা ফেলা মুশকিল। লাস্ট মিটিং এ আলাদা করে পঞ্চাননকে ডেকে বলেছেন তিনি, “ছোট বয়েস থেকে দেখছি তোমায়। যাই বল, কাজে কম্মে উন্নতির ইচ্ছে তোমার বাপু বড়োই কম। এমন করলে তো চলে না হে। কত বড় বংশের ছেলে তুমি এ কথা ভুলে গিয়ে এর গাছের কাঁঠাল, ওর মাচার লাউ এইসব চুরি করে অযথা নিজের প্রতিভাটাকে নষ্ট করছ বসে বসে। পষ্ট বলি শোনো, সামনের মাস থেকে আমাদের ইউনিয়নভুক্ত যারা তাদের নিয়ে বেস্ট কালেক্টারস পুরস্কার চালু করছি আমি। আমার ইচ্ছে, প্রথমবারের পুরস্কারটাই যেন তোমার হাতে তুলে দিতে পারি।”

এ কথায় সত্যিই বেশ চাপে পড়ে গেছে পঞ্চানন। কিছু একটা না করলেই নয় এবার। সত্যজেঠু প্রফেশনের ক্ষেত্রে নিজে সত্যের পূজারী। অন্যেরাও কেউ সততার ভান করছে জানলে বেজায় চটে যান। মিটিং এ এমন কথাও তিনি বলে দিয়েছেন, “আমি জানি আজকাল পুলিশ টুলিশের সাথে অনেকে বন্ধুত্ব পাতিয়ে কাজের ক্ষেত্রটাকে ঝুঁকিহীন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রাণপণে। আমি কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে এই শঠতা বরদাস্ত করতে রাজি নই। এ লাইনে কাজ করতে হবে বুক ফুলিয়ে। নিজের সামর্থ্য ও শিক্ষার ওপর ভরসা রেখে সততার সঙ্গে। তাতে ঝুঁকি তো থাকবেই। মনে রাখবে এটাও একটা অ্যাডভেঞ্চার। এটা একটা অতি উচ্চমানের শিল্পও। আর তাই এখানে ফাঁকি চলবে না। মহাপুরুষের কথা স্মরণে রাখবে সর্বদা। তাঁরা পই পই করে বলেছেন ফাঁকির দ্বারা মহৎ কাজ কখনও হয় না।”

সন্ধে গড়িয়েছে খানিকক্ষণ আগে। আজ সারাদিন পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গুটি গুটি পায়ে হাফিজের চায়ের দোকানে এসে বসল পঞ্চানন। হাফিজ ছেলেটি ভারী ভালো। সারাদিন কাজেকর্মে থাকে। কারো সাথে ঝগড়াঝাঁটি নেই। ব্যবহারটিও অমায়িক। ছেলেটিকে খুব ভালো লাগে পঞ্চাননের। মনে হয় রোজগার হয়ত কম ওর, তবু দিব্বি আছে সৎ পথে। সত্যি বলতে কি এই পারিবারিক ব্যাবসাটি একেবারেই পছন্দ নয় পঞ্চাননের। গেরস্থ লোকেরা এ শিল্পের কদর দেয় না আর। তার বাপ ঠাকুদ্দাদের আমলে এলাকার মানুষ যে চোখে দেখত আজ আর সে দিন নেই। তাছাড়া পঞ্চানন নিজেও মানুষটি বড় নরম মনের। অকারণ সাধারণ মানুষকে হেনস্থা করতে এক্কেবারেই প্রাণ চায় না তার। কিন্তু সত্যজেঠুকে এসব বলে লাভ নেই। তিনি সেকালের লোক। এ কালের কথা কানেই নেবেন না। তাছাড়া তার বাবার কথারও অমান্যি হয়ে যাবে লাইন থেকে একেবারে সরে গেলে। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাফিজকে চায়ের অর্ডার দিল পঞ্চানন। সঙ্গে দুটো বিস্কুট। কাজের সময় পেট খালি রাখা যাবে না, আবার হেউ ঢেউ খেয়ে ঢেঁকুর তোলাও চলবে না।

চায়ের গেলাসে হাল্কা চুমুক দিয়ে চারদিকে একবার সন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে নিল পঞ্চানন। না কেউ তাকে তেমন আলাদা করে নজরে রাখছে না। পঞ্চানন তার ছোট্ট ঝোলায় রাখা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিগুলোয় আলতো করে হাত বুলিয়ে নিল। অনেকদিন হল জিনিসগুলোর ব্যবহার হয়নি ঠিকমতন। এই যন্ত্র দিয়েই তার ঠাকুরদা কাজ করেছেন। তার বাবাও। গা শির শির করে উঠল পঞ্চাননের। একটু আনমনাও হয়ে গেল সে। আর ঠিক সেই সময়েই লোকটা এসে দোকানে ঢুকল।

লোকটার চেহারায় তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। পরনে জিন্স আর লম্বা পাঞ্জাবি। বাঁ হাতে কমদামের ঘড়ি। মাথায় অল্প টাক হাফিজের দোকানের সি এফ এল আলোয় চক চক করছে। তার মধ্যে যেটা চোখে পড়ার মতন তা হল লোকটার হাতের আংটিগুলো। দু’ হাতের দশটা আঙুলে নয় নয় করে গোটা সাতেক আংটি লোকটার। তার মধ্যে চারটে বেশ দামি। অভ্যস্ত চোখ পঞ্চাননের। কাজেই পাঞ্জাবির নীচেও জিন্সের হিপ পকেটে উঁচু হয়ে থাকা মানিব্যাগটা দিব্বি বুঝতে পারল সে। লোকটার গা থেকে একটা গন্ধ পঞ্চাননের নাকে ভেসে আসছিল। মনটাকে থিতু করে নাক টেনে গন্ধটা আর একবার যাচাই করে নিল সে। সাধারণ লোকে এ সব গন্ধ টেরও পায় না। কিন্তু পঞ্চানন পায়। এটাই শিক্ষা। ছোটবেলায় রীতিমতন গুরুগৃহে থেকে এসব বিদ্যে রপ্ত করতে হয়েছে তাকে। তাদের রাতের ব্যাবসায় এসব বিদ্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

গন্ধবিচার করেই পঞ্চানন বুঝতে পারল এ লোকটা খুব সুবিধের নয়। সতর্ক হল সে। সাধারণত কাজের ক্ষেত্রে এ ধরনের লোক এড়িয়ে যাওয়াটাই রীতি। কিন্তু পঞ্চানন আজ অন্যরকম করে বিষয়টা ভাবতে শুরু করল। লোকটা এ অঞ্চলের নয়। আগে কখনও এ দিকে দেখাও যায় নি তাকে। তাহলে মতলবটা কী এর? লোকটার আরো একটু কাছে সরে এসে বসল পঞ্চানন। একটু খেলিয়ে দেখলে মন্দ হয় না।

পঞ্চাননকে তার দিকে সরে আসতে দেখে সরু চোখে তার দিকে তাকালো লোকটা। এই তাকানোটার জন্যেই যেন অপেক্ষা করছিল পঞ্চানন। লোকটার দিকে অমায়িক হেসে সে হাত বাড়াল, “আপনার কাছে দেশলাই হবে একখান? বিড়ি ধরাব…”

“না,” খুব বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল লোকটা।

পঞ্চানন দমল না। এক গাল হেসে বলল, “খান না বুঝি?”

“না।” সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে অন্য দিকে তাকালো সেই লোকটা।

স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে লোকটা তার সাথে কথা বলতে চাইছে না। অন্য যে কেউ হলে এ সময়ে চুপ করেই যেত হয়ত। কিন্তু পঞ্চানন দমল না। হাসিটাকে আরও মোলায়েম করে সে বলল, “এ অঞ্চলে নতুন বুঝি? চিনলাম তো ঠিক আপনাকে?”

“আপনি কি এ অঞ্চলের সব মানুষকেই চেনেন নাকি?” একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল লোকটা।

“আজ্ঞে তা চিনি বৈকি। চেনাশোনাটাই তো কাজ আমার…” লোকটার বিরক্তিকে পাত্তাই দিল না পঞ্চানন।

“আমার এক দূর সম্পর্কের সম্বন্ধীর বাড়ি এসেছিলাম। একটা বৈষয়িক কাজে। ওই তো ওইদিকে বাড়ি।” বলে এক দিকে হাত তুলল লোকটা। তার হাত দেখে কোন দিক তা বোঝা গেল না।

“তপন মন্ডলের কথা বলছেন?” হাত কচলায় পঞ্চানন, “ও গাঁয়ের খুব পয়সাওলা লোক। তবে কিনা টাকা পয়সার ব্যাপারে বড্ড উদাসীন। ফেলে ছড়িয়ে এমনভাবে রাখে…”

galpojoydeep02 (Small)পঞ্চাননকে কথা শেষ করতে না দিয়েই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা। হাফিজকে পয়সা দিয়ে দোকানের বাইরে বেরিয়ে গেল। প্যান্টের পকেট থেকে কাকে যেন ফোন করছে।

লোকটা সম্পর্কে ক্রমশই খুবই কৌতূহলী হয়ে পড়ছিল পঞ্চানন। তার মন কেবলই সতর্ক করছে তাকে। কী যেন একটা ঘটাতে চলেছে লোকটা। শরীরটাকে অন্ধকারে মিশিয়ে দিয়ে সে লোকটার কথা শোনার চেষ্টা করতে লাগল।

সবটা শুনতে পেল না সে। তবে শেষের কথাটা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। চাপা স্বরে কাকে যেন আশ্বাস দেবার ভঙ্গীতে বলে উঠল লোকটা, “চিন্তা করবেন না। কালু ওস্তাদ কথার খেলাপ করে না। একবার যখন বলেছি তখন অরফ্যানেজটা থাকবেই না আর। দুদিনের মধ্যেই আগুন জ্বলে যাবে ওখানে। শর্ট সার্কিট—” বলেই বিচ্ছিরি রকম হ্যা হ্যা করে হেসে উঠল লোকটা, “ভেতরে লোক ফিট করার চেষ্টা করছি আমি। হয়ে গেছে প্রায়। তবে খরচ খরচা একটু বেশি পড়ে যাচ্ছে এই আর কি..”

হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল পঞ্চাননের। লোকটা বলে কী ! তলে তলে এত বড়ো ষড়যন্ত্র চলছে ! তাদের পাশের পাড়ায় জনচারেক রিটায়ার্ড লোক মিলে একটা অনাথ আশ্রম খুলেছিল বছর সাত আট আগে। রাস্তার অনাথ বা গরিবগুর্বো ছেলেমেয়েদের থাকাখাওয়া পড়াশোনা শেখার বন্দোবস্ত হয়েছে এখন সেখানে। বছর দুই হল জায়গাটার ওপরে কিছু লোকের নজর পড়েছে বলে শুনেছিল সে। এ জমিটা বেচে খালপাড়ে উঠে যাবার জন্যে চাপ আসছিল খুব। ওই আশ্রমের প্রধান রসিক মাস্টারমশাই বলছিলেন একদিন চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে, “জীবনের সর্বস্ব দিয়ে একটা স্বপ্নকে সত্যি করতে নেমেছি ক’জনে মিলে। আমাদের পাবারই বা কী আছে আর হারানোরই বা কী আছে বলো? তা আমায় এসে কিনা শহরের এক বাবু লোভ দেখাচ্ছেন, ভয় দেখাচ্ছেন। এ জায়গাটা তাদের হাতে ছেড়ে দিলে এখানে নাকি শপিং মল হবে। ভাবো একবার…”

শত প্রলোভনেও নিজেদের কাজ থেকে, স্বপ্ন থেকে লোকগুলো সরে আসেনি একটুও। পঞ্চানন মনেমনে খুব শ্রদ্ধা ভক্তি করে মানুষগুলোকে। এ কালে কজন মানুষ আর অমন স্বপ্ন দেখতে পারে ! স্বপ্ন দেখা তো ক্রমশ উঠেই যাচ্ছে জীবন থেকে। মনে মনে খুব প্রার্থনা করত সে, এরকম মানুষজন যে ক’জন আছেন এখনও তাঁদের স্বপ্নগুলো যেন দুম করে মরে না গিয়ে বেঁচেবর্তে থাকে যেন অনেকদিন। এ লোকটা কি রসিক মাস্টারমশাইদের স্বপ্ন চুরি করতে চায় নাকি ! অন্ধকারে দাঁড়িয়েই ঘন ঘন দু দিকে মাথা নাড়ায় পঞ্চানন, “উঁহু, এ কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না।”

মনে মনে কর্তব্য স্থির করে ফেলে সে। ওই মোবাইলটা হাতানো দরকার। জানা দরকার আড়ালে থেকে কে পুড়িয়ে দিতে চাইছে অন্যের জন্যে নিজেদের সব বিলিয়ে দেওয়া মানুষগুলোর স্বপ্নটাকে। কাজটা পঞ্চাননের কাছে কিছুই নয়। তবু সময় নিল সে। লোকটার ডেরাটাও দেখে রাখা ভালো। লোকটার সাথে অন্তত তিন চার কিলোমিটার হাঁটতে হল সে রাতে পঞ্চাননকে। তবে তাদের প্রফেশনে এ হাঁটাটা বলতে গেলে কিছুই নয়। তারপর লোকটার বাড়ির পিছনে কচু গাছের জঙ্গলে অপেক্ষা করে থাকতে হল আরো প্রায় ঘন্টাদুয়েক। সে সময় পায়ের ওপর দিয়ে সর সর করে কী যেন একটা চলে গেল একবার। সাপ হওয়াই স্বাভাবিক। তাছাড়া ও অঞ্চলের মশাগুলোও  বড্ড বড় এবং বেপরোয়া। পঞ্চাননের অবশ্য এ সবে তেমন কষ্ট হল না। এ লাইনে এসব নস্যি। নার্সারি ক্লাশেই এসব প্রতিকূলতা জয় করার কৃৎকৌশল শিখে ফেলে তারা।

মাঝরাত পার হয়ে সবে একটু যখন রাতটা ভোরের দিকে ঢলেছে, ব্যাগ খুলে যন্ত্রপাতিগুলো সন্তর্পণে বের করে ফেলল পঞ্চানন। কাজ শুরু করে ভারী আহ্লাদ হল তার। হাতটা দিব্বি আছে এখনও। মাখনের মতন সিঁধ কেটে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল সে। লোকটা একা ঘুমুচ্ছিল। নাক ডাকছে গুড় গুড় করে। পেট দুলছে। ঘরে অন্ধকার। যদিও পঞ্চাননের তাতে খুব একটা অসুবিধে হবার কথা নয়। অসুবিধে সত্যি বলতে কি হলও না তার। লোকটার মাথার বালিশের পাশ থেকে খুব যত্ন করে মোবাইল ফোন আর মোটা মানিব্যাগটা তুলে নিল সে। তারপর বিছানার ওপরে ঘুমন্ত মানুষটার হাতের আঙুল থেকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সে দামি আংটিগুলোকেও খুলে ফেলে নিজের ঝুলিতে ভরে প্রায় বাতাসেরই মতন নিঃশব্দে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়ালো। আকাশে নক্ষত্রেরা তখনও মিট মিট করছে, তবে অন্ধকার ফিকে হয়ে এসেছে।

বড় করে শ্বাস ফেলে পঞ্চানন। মনটা অনেকখানি হালকা লাগছে এখন। কচুবাগানের দিক থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামে সে। অনেকটা পথ যেতে হবে। থানার নতুন বড়োবাবুর কোয়াটার এখান থেকে অনেক দূর। পঞ্চানন হাঁটা শুরু করল। বড়বাবুর বয়েস বেশি না, তবে মানুষটা সাচ্চা এবং সৎ। নিশ্চিন্তে ভরসা করা যায় এমন মানুষ থানায় বড় একটা দেখা যায় না, কিন্তু এ লোকটি এক্কেবারে অন্যরকম। তথ্য-প্রমাণ হাতে পেয়ে কিছু একটা ব্যবস্থা তিনি নেবেনই এ বিষয়ে সন্দেহ নেই পঞ্চাননের।

লোকগুলো ধরা পড়ে গেছে। থানার বড়োবাবু থেকে কাগজের রিপোর্টার সক্কলে ধন্য ধন্য করেছে খুব পঞ্চাননকে। পঞ্চাননের কাছে ওই লোকটার মানিব্যাগ থেকে পাওয়া টাকা আর তার আংটিগুলো ছিল। তার ইচ্ছে ছিল ওগুলো অনাথ আশ্রমের কাজেই ব্যবহার হোক, কিন্তু রসিক মাস্টারমশাইরা সে টাকা বা আংটি নিতে রাজি হন নি। সেগুলো এখন থানায়। বড়োবাবুরই জিম্মাতে। পঞ্চানন মনে মনে ঠিক করেছে গায়েগতরে খেটে কিছু টাকা আশ্রমকে দেবে পরে-পশ্চাতে।

সত্যজেঠু খুব বকাঝকা করেছেন পঞ্চাননকে। আগামী ছ’মাস তস্কর সমিতির সভা থেকে বহিষ্কার করেছেন তাকে সমিতির সংবিধান-বহির্ভূত কাজের শাস্তিস্বরূপ। সকলের সামনেই বিচ্ছিরি অপমান করে তাকে শুনিয়েছেন সে তার বাপ ঠাকুদ্দার নাম নিজে মুখে আনারই নাকি যোগ্য নয়। পঞ্চাননের দশা দেখে স্বর্গে বসে তাঁরা নাকি লজ্জায় আর একবার মরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

তস্কর সমিতি থেকে শাস্তি পাওয়ায় পঞ্চাননের দুঃখু নেই। সে বরং ও ধার একেবারেই মাড়াতে রাজি নয় আর। কিন্তু সত্যজেঠুর শেষের কথাটায় বড় চিন্তায় পড়ে গেছে সে। রাতে নিজের ঘরে একা একা বিছানায় শুয়ে ভারী দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তার। ঠাকুদ্দাকে দেখে নি সে। কিন্তু বাবা তাকে বড় স্নেহ করতেন। তাঁর মৃত্যুতে বড্ড শোক পেয়েছিল সে। সেই তিনি তার জন্যে আরও একবার মরতে বসেছেন এ কথাটা শোনা থেকে মনটা বড় অস্থির হয়ে আছে তার। তাঁর পুনর্বার মৃত্যুসম্ভাবনায় চোখে জল এসে গেল তার। আর ঠিক তখনই ছায়া ছায়া শরীর নিয়ে কে যেন পাশটিতে বসে পঞ্চাননের  মাথায় হাত রাখল। সাধারণ মানুষের চেয়ে পঞ্চাননের দৃষ্টি অনেক সূক্ষ্ম। লোকটাকে চিনতে কোন অসুবিধা হল না তার। নিজের কাজে লজ্জিত পঞ্চানন শুয়েশুয়েই বাবার সামনে মাথা হেঁট করে ফেলল।

বিশু পাল কিন্তু একটুও ক্ষুণ্ণ না হয়ে তার মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলে চললেন, “লজ্জা পাবার কিছু নেই রে পঞ্চা, ঠিকই করেছিস তুই। আমরা তোর কাজে খুশিই হয়েছি…”

“কিন্তু সত্য জ্যাঠা যে-”

“সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদেরও পালটে ফেলতে হয়,” পঞ্চাননকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করেন বিশু পাল, “সত্য নিজেকে পাল্টাতে পারে নি। ও টিকতেও পারবে না হয়ত বেশিদিন। তুই পেরেছিস বাপ-”

“কিন্তু তোমার শেষ ইচ্ছাটা—”

“অর্জিত শিক্ষার প্রয়োগের কথা বলছিস পঞ্চা ? ”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি যে কথা দিয়েছিলুম আপনাকে।”

“কথা তো রেখেইছিস রে বাপ,” বিশু পালের ছায়া ছায়া মুখটা হঠাৎ হাসি হাসি হয়ে উঠল, “সেই বিদ্যের বলেই না এতগুলো শিশুকে এই অন্যায়ের হাত থেকে বাঁচালি! তবে? বিদ্যেটা ছাড়িস না কিন্তু বাপু। চাইলে পরে ও দিয়েও লোকের ভালো–”

গলার আওয়াজটা ফিকে হয়ে এল আস্তে আস্তে। পঞ্চানন মাথা নীচু করে হাত বাড়াল সামনের দিকে। আরেকবার যদি বাবার পা দুটো ছোঁয়া যায়। কিন্তু তার হাত দুটো বাতাসে ভেসে গেল। বিশু পাল চলে গেছেন। পঞ্চাননের আর মনকেমন করে উঠল না বাবার জন্যে, বরং মনের মধ্যে যেন আনন্দের একটা অচেনা ফুরফুরে হাওয়া বইতে শুরু করল আজ…

ছবিঃ ইন্দ্রশেখর

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে