হাতি শিকারি হালুম মামা -দোয়েল বন্দ্যোপাধ্যায়
কেটলিপিসি চায়ের জল চাপিয়ে বললেন, “যার নাম হালুম, সে কী করে হাতি শিকারি হয় এ বাপু আমার মাথায় ঢুকছে না। হাতিকে তো জম্মে কোনওদিন হালুম ডাকতে শুনিনি!”
হেঁসেলের ঠিক বাইরে হালুমমামা তার বন্দুকখানা পরিষ্কার করছিলেন। কেটলিপিসির কথায় ভয়ানক রেগে গিয়ে বললেন, “তা সবকিছুই যদি এত সহজে তোমার মাথায় ঢুকত তবে তুমি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে!”
কেটলিপিসি গজগজ করতে-করতে চায়ে গুচ্ছখানেক চিনি গুলতে লাগলেন। এসব আমাদের বাড়িতে নিত্যিদিনের ঘটনা। তবে হালুমমামা আমাদের ঠিক কীরকম মামা সেটা আজও বুঝলাম না। একদিন মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, হালুমমামা তোমার কেমন ভাই?”
মা ভারী মন দিয়ে কী একটা সেলাই করছিলেন। সূচের এক ফোঁড় দিয়ে বললেন, “ওই তো ওইরকম।”
“কী রকম?”
“জ্বালাসনে বাপু। তোর ঠাকুমাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর!”
তাই করলাম। ঠাকুমার বয়স হয়েছে। আমাদেরই আজকাল ঠিক ঠাহর করতে পারেন না তো হালুমমামা। সে যাই হোক আমার প্রশ্ন শুনে ঠাকুমা তিন দিন তিন রাত্তির খুব ভাবলেন। তারপর ফোকলা দাঁতে বললেন, “দেখো দাদুভাই, হালুম তো সে অনেকদিন ধরেই এ বাড়িতে আসা যাওয়া করছে। তবে সে যে ছোটোবউমার কেমন ধারা ভাই, সে আমার মনে নেই। ছোটোবউমার ভাই কিনা আদৌ তাও জানি না! মেজবউমার দাদাও হতে পারে আবার বড়ো বউমার ভাইপোও হতে পারে! বয়স হয়েছে তো, তাই কে যে কার কে হয় মনে রাখতে পারি না আজকাল। এই দেখো না, আমি যে আমার কে হই সেটাও বিলকুল ভুলে গেছি!”
আমি অবাক হলাম। “এ আবার কী কথা? তুমি আবার তোমার কে হবে?”
“ কে জানে। চোখে ভাল দেখিনা, কানে ভাল শুনি না। বাড়ি ভর্তি লোক গিজগিজ করছে। কার সঙ্গে কার যে কী সমপক্ক সব গুলিয়ে যায়। তাই বলছিলুম আর কী।”
ঠাকুমার কাছে যে প্রশ্নের জবাব পাব না টের পাচ্ছি। তবে একটা কথা ঠাকুমা ঠিকই বলেছেন। বাড়িতে লোকজনের অভাব নেই। তাদের মধ্যে কে যে আপনার লোক, কে যে পর, কে যে প্রতিবেশী আর কে যে নেহাতই সময় নষ্ট করা লোক বোঝা দায়।
সোনাজেঠু বলেন “এখন আর কী লোক দেখছিস রে নেবু, এর পঞ্চাশ বছর আগে আরও লোক ছিল এ বাড়িতে। তাদের মধ্যে কিছু লোকজনকে যেই না বলা হত ‘এদ্দুর থেকে এয়েচ কদিন একটু জিরিয়ে যাও’, ওমনি তারা ভালমানুষি হেসে ‘সে আর বলতে’ বলেই দিন দশেক থেকে যেত। যদিও বেশিরভাগ লোককেই এসব বলতে হত না। তারা ‘আমরা হলাম গিয়ে কলকাতার মুখুজ্জেদের জ্ঞাতি, আমাদের কী আর থাকার জায়গার অভাব আছে গো। নেহাত তোমরা কষ্ট পাবে বলেই মাসখানেক থাকতে রাজি হয়েছি’ এইসব বলে-টলে দিব্যি একমাসের বদলে তিন মাস থেকে যেত।”
তা মেলা লোকজন যখন তাদের ফাইফরমাশও যে হাজার রকমের হবে সে আর বলতে। কেউ গলা সাধে তাই প্রতি ঘণ্টায় গরম জল চাই, কারও খোকা-খুকুর জন্য গরম দুধ চাই। তাছাড়া এসব বাদ দিয়েও চিনি ছাড়া চা, দুধ ছাড়া চা, লেবু চা সমেত হ্যানত্যান হাজার জিনিসের আবদার লেগেই থাকতো। শুধু সেটুকু সামলাতেই বাড়ির লোকেরা একদম হিমশিম খেত।
তাই বুদ্ধি করে কেউ একজন কেটলিপিসিকে নিয়ে এল। কেটলি অন্তপ্রাণ কেটলিপিসি সারাদিন চা তৈরি, জল গরম, দুধ গরম, এসব করতে শুরু করল। বাড়ির লোকও হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। সেইদিন থেকে আজ পর্যন্ত কেউই কেটলি ছাড়া পিসিকে আর পিসি ছাড়া কেটলিকে দেখেনি।
অতদিন আগে তো আর গ্যাসে রান্না হত না। উনুনের প্রয়োজন হত। আর সেই উনুন জ্বালতে দরকার হত মণ-মণ ঘুঁটে। অতএব কেটলি পিসির যোগ্য সঙ্গত দিতে বিহার মুলুকের কোন এক তালুক থেকে আমদানি করা হল ঘুঁটেলালকে। হালুমমামার সঙ্গে কেটলিপিসির যতটা শত্রুতা ঘুঁটেলালের সঙ্গে ঠিক ততটাই ভাব। দুজনেই একসঙ্গে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন কিনা!
ঘুঁটেলালের মতলব কিন্তু অন্য। বড়ো-বড়ো শের ভালু মেরে নাম কেনার তার ভারী লোভ। মাঝে-মধ্যেই সে হালুমমামার পিছনে ঘুরঘুর করে। এদিকে সেই কথা আবার কেটলিপিসির কানে গেলেই বিপদ। শত্রুর সঙ্গে হাত মেলানোর অপরাধে ঘুঁটেলালকে তিনি আস্ত রাখবেন না। ঘুঁটেলাল তখন বুদ্ধি করে ব্রিটিশদের ওই ‘ডিভাইড-রুল’ গোছের ফন্দি করল। সে কেটলিপিসিকে কানে-কানে বলতো, “কুছু চিন্তা করিবেন না কেটলি বহিন, আমি ওই শিকারিকে একদম ভাগিয়ে দিব।” একইভাবে হালুম মামার গাত্রমর্দন করার সময় মামার সাধের বন্দুকের দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে বলতো,”কুছু চিন্তা করিবেন না হালুমবাবু, আমি ওই কেটলিকে একদম ভাগিয়ে দিব।” ঘুঁটেলালের খুব ইচ্ছে হালুমমামা তাকে শিকারে সঙ্গী করে নিক। যদিও হালুমমামা তাকে এই বিষয়ে এখনও কোনও আশ্বাস দেয়নি।
“আচ্ছা হালুম তো কারও নাম…নিদেনপক্ষে ভাল নাম তো হতেই পারে না, তাই না?” এই প্রশ্নও অন্তত পাঁচশবার করেছি বাড়ির বড়োদের। বাড়ির বড়োরা কেমন হয়, সেতো আমার মত ছোটোরা বিলক্ষণ জানে। দিনরাত্তির আপিস কাছারি, মামলা মোকদ্দমা এইসব হাবিজাবি নিয়ে মেতে আছে। আমার প্রশ্নের উত্তর তারা দেবে কেন? বড়োকিদিদি বলল, “ওর নাম নির্ঘাত গিরিগোবর্ধন!”
“কেন কেন?”ছোটোরা উৎসুক হয়ে জানতে চাইল।
“দেখিসনা কেমন একটা ঢাউস তোরঙ্গ নিয়ে ঘোরে!”
“ইল্লি আরকী!” আমার দাদা বলল। “ওর নাম সর্বদমন। আমি নভেলে পড়েছি। শিকারিদের ওইরকমই নাম হয়।” বলা বাহুল্য কেউ তার কথা বিশ্বাস করল না মোটেও। সে তখন, “তোমরা আর কী জানবে, তোমরা তো কেউ নভেল-টভেল পড় না!” এই বলে খুব দেমাক দেখিয়ে দুমদুম করে পা ফেলে চলে গেল। শেষে ঘুঁটেলাল গোঁফে তা দিয়ে বলল, “হামি জানি হালুমবাবুর আসলি নাম কী আছে?”
“কী?”
“উসকা নাম জরুর ডুগডুগিরাম আছে!”
“ডুগডুগিরাম একটা নাম হল?”
ঘুঁটেলাল বলল, “হালুমবাবু যখন বাতচিত করে ওর মাথাটা ডুগডুগির মত এদিক-ওদিক হিলতে থাকে!” সকলে ওর দিকে কটমট করে চাইতেই, “বহত কামকাজ বাকি আছে” বলে সুরুত করে কেটে পড়ল।
যাই হোক, আমি যে হালুমমামার অস্তিত্ব নিয়ে অস্বস্তিতে আছি সেটা বুঝতে পেরেই বোধহয় কেটলিপিসি ঠারে-ঠারে বললেন, “গণ্ডাখানেক লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করে কী কিছু হয়? গরিবের কথা বাসি হলে ফলে! জিনিসপত্র সোনাদানা নিয়ে যখন একদিন চম্পট দেবে তখন বুঝবে সে তোমার কেমন মামা ছিল!” অনেকদিন ধরেই কেটলিপিসির বিশ্বাস যে হালুমমামা ভয়ংকর কোনও এক ডাকাত দলের সর্দার। শুধু নাম পালটে আমাদের বাড়িতে রয়েছে।
সোনাজেঠি ধমক দিলেন। “তুই থাম দেখিনি কেটলি। যে মানুষের বুকের উপর আস্ত হিমালয় চাপিয়ে দিলেও ঘুম ভাঙেনা সে করবে চুরি! তাহলেই হয়েছে আর কী! হালুম গায়ে সর্ষের তেল মেখে হাতে সিঁদ কাঠি নিয়ে চুরি করতে যাচ্ছে এ দৃশ্য দেখে আমি হেসেই মরে যাব!”
“অসম্ভব!” বিকট একটা চিৎকার শোনা গেল। হালুমমামা এতক্ষণ থামের আড়াল থেকে সব শুনছিলেন। এবার সেই সবুজ রঙের ঢাউস তোরঙ্গ নিয়ে বেরিয়ে এলেন। “ ওকি হালুম তোমার হাতে তোরঙ্গ কেন?” সোনাজেঠি জানতে চাইলেন।
“কেন আবার? আমি চলে যাচ্ছি তাই।”
“ বলা নেই কওয়া নেই চলে যাচ্ছি বললেই হল?”
“না সোনাদিদি এ বাড়িতে আমি আর এক মুহূর্ত থাকবো না। এত্ত অপমান!”
“কিন্তু আজ যে চিংড়ি মাছের মালাইকারি হচ্ছে?”
“তাতে আমার কী? চিংড়ি তো দূরঅস্ত আমি এবাড়ির জলগ্রহণ করবো না!”
“সেটি হচ্ছে না। বামুনের বাড়ি থেকে ভর দুপুরে তুমি না খেয়ে ট্যাঙট্যাঙ করে চলে যাবে সে আমি হতে দেব না। গেরস্তের কল্যাণ অকল্যাণ বলে কিছু নেই নাকি? শাশুড়িমা জানতে পারলে আমায় আর আস্ত রাখবেন না!”
তারপর সে মেলা বাগবিতণ্ডা শুরু হল। হালুমমামা যাবেনই আর সোনাজেঠিও তাকে যেতে দেবেন না। শেষে ঠাকুমা লাঠি ঠুকঠুক করে এসে বললেন, “বড়োবউমা বাক্স নিয়ে হালুম আবার কই যায়?”
“ বাড়ি ছেড়ে চললুম!” হালুমমামা গম্ভীর মুখ করে বললেন।
ঠাকুমা শুনতে পেলেন না। আহ্লাদী মুখ করে বললেন, “তা বেশ। তবে আজ তো চিংড়ির মালাইকারি হচ্ছে। মেজবউমা রান্না করবে। এদিকে অশৈলী কান্ড দেখ নারকেল খানাই বাজার থেকে আনতে ভুলে গেছে। সেতো চিংড়ির খোসা ছাড়িয়ে এঁটো হাতে বসে আছে। খোকারা কেউ বাড়িতে নেই।বাবা হালুম তুমিই ভরসা এখন। বাজার থেকে একজোড়া ভাল দেখে নারকেল নিয়ে এস দেখি। জানই তো মেজবউমার আবার পিটপিটে বাতিক। বেশিক্ষণ এঁটোকাঁটা ঘেঁটে এলেই বাড়িশুদ্ধ সক্কলকে এই অবেলায় নাইয়ে ছাড়বে!”
হালুমমামা আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন। আর বাকিরা প্রমাদ গুনল। সত্যিই তো। মেজজেঠির সব ভাল কিন্তু বড়ো শুচিবাইগ্রস্ত। মেজজেঠু একবার মুখে হাত না দিয়েই খুকখুক করে কেশেছিলেন বলে পৌষমাসের ঠান্ডায় তাকে জোর করে চান করিয়েছিলেন। ঠান্ডা লেগে তারপর তো মেজজেঠুর একেবারে যায়-যায় অবস্থা! সে অবশ্য অন্য গল্প। পরে একদিন বলব।
হালুমমামা কোনও কথা না বলে সাধের তোরঙ্গ যথাস্থানে রেখে নারকেল আনতে গেলেন। সে নারকেলের গুণেই হোক বা মেজজেঠির রান্নার গুণ, চিংড়ির মালাইকারি অনবদ্য হয়েছিল। সবাই সেটা চেটেপুটে আয়েশ করে খাচ্ছে এমন সময় হালুমমামা এসে সকলের হাতে একখানা করে ছোট্ট চিরকুট গুঁজে দিলেন। ঠাকুমাও বাদ পড়ল না। কিন্তু মুশকিল হল সকলে খেয়ে উঠে আঁচিয়ে মুখশুদ্ধি খেয়ে সেই চিরকুট খুলে কিছুই বুঝতে পারল না। কারণ মামার হাতের লেখা এককথায় জঘন্য।
বড়োজেঠু ওকালতি করেন। চশমা এঁটে বললেন, “কাল একবার সদর থেকে জজসাহেবকে দিয়ে পড়িয়ে আনব!” বাবা বললেন, “আমার মনে হয় বড়োদা, হালুম কোনও বিদেশি ভাষায় এটা লিখেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এটা ফার্সি অথবা হিব্রু ভাষা!”
“তোমার মুন্ডু!” মেজজেঠু খাপ্পা হয়ে উঠলেন, “সারা জীবন চোর-ডাকাত ধরে আমার জীবন কেটে গেল আর এটা বুঝতে পারব না! আমি নসিবপুরের ভানু দারোগা বলছি এটা কোনও গুপ্তধনের সংকেত!”
“তোমরা কেউ কিচ্ছুটি জান না,” আমার সবচেয়ে ছোটো ভাই তুবড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। বেশিদিন ইশকুলে যাচ্ছে না কিন্তু ভারি চৌখস ছেলে। এরমধ্যেই বানান করে সহজপাঠ পড়ে গড়গড়িয়ে।
“এতে শুধু লেখা আছে আজ সন্ধে ছয় ঘটিকায়, ঠাকুর দালানে!”
“কই ? তাই নাকী? ওমা সেকী? কী কান্ড! হ্যাঁ এই তো ছয় লেখা, বুঝতে পারিনি তো?” এইবলে সকলে সেই চিরকুটের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আর ঠিক তখনই টুক করে পরদা তুলে মুখ বাড়িয়ে হালুমমামা বললেন, “ভুলে যেওনা কিন্তু আজ সন্ধে ছয় ঘটিকা শার্প!”
বলেই সাঁ করে চলে গেল। চিরকুটে কী লেখা আছে জানতে পেরে সকলে নিশ্চিন্তি হয়ে ভাতঘুম ঘুমোতে গেল। শুধু কেটলিপিসি মুখ ভেংচে বলল, “বলবেই যদি এত লেখাপড়ার কী দরকার ছিল!”
২
আমরা ছোটোরা ভেবেছিলাম বড়োরা কেউ আসবে না। হালুমমামা এ বাড়িতে যতই নিত্যি আসাযাওয়া করুক তার কার্যকলাপে সায় দেওয়ার লোক যে এবাড়িতে কেউ নেই সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। ও হরি! কোথায় কী? সেগুড়ে বালি ঢেলে সকলেই সন্ধে ছটার সময় ঠাকুরদালানে এসে উপস্থিত হল। এমনকি কেটলি হাতে পিসিও বেলভার মুখ করে গুটিগুটি পায়ে সকলের পিছনে ছোট্ট কাঠের চৌকিতে বসলেন। ঠাকুরদালানের যে উঁচু বেদী যেখানে প্রতি বছর মা অন্নপূর্ণা আসেন আমাদের বাড়ি ওখানেই হালুমমামা বেজায় ছোটাছুটি করছিল। হাতে একটা ছোট্ট ডায়েরি। বার-বার সেটা খুলে দেখছে আর সকলকে আশ্বাস দিয়ে বলছে, “আর একটু সবুর কর এখুনি শুরু হবে!”
ঠাকুমা বললেন, “ও হালুম, তুই কী কোনও পালা-টালা বেঁধেছিস?”
হালুমমামা বিরক্ত হয়ে বললেন, “উফ, একটা সিরিয়াস আলোচনা করতে চলেছি এর মধ্যে আবার পালা কোত্থেকে এল?”
বাবা বললেন, “তা যা বলতে চাও বলে দাও দিকিনি চট করে। আর কত সবুর করব?”
“এই তো ছোড়দাদা এখুনি শুরু করছি।”
সোনাজেঠির গা থেকে ভুরভুর করে জর্দাপানের গন্ধ আসছিল।তিনি ফিসফিস করে মার কানে-কানে বললেন, “বলি ও ছোটোবউ হালুম বলবেটা কী?”
মা বললেন, “জানিনে বাপু। সে যে কী বলে কী করে ঈশ্বরই জানেন।”
দুই জেঠু হাঁক পাড়লেন। “আর তো দেরি করা চলবে না হালুম। আমাদের তো কাজকম্ম আছে নাকি?”
হালুমমামা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ এইবার শুরু করছি। বন্ধুগণ, আপনাদের সকলকে হালুমশিকারির তরফ থেকে ধন্যবাদ। আপনারা আপনাদের মূল্যবান সময়ের কিছুটা আমাকে দিয়েছেন। আপনারা সকলেই জানেন ময়নাগড়ের জঙ্গলে…”
এতটা বলার পর ঠাকুমা বললেন, “এদ্দিনে হালুম একটা কাজের কথা বলেছে। গয়না গড়ানো সব সময়ই মঙ্গলের। গয়না হল মেয়েদের সম্পদ। আমার তিন বউমার তো সেদিকে কোনও মনই নেই। ছোটোবউমা তো এত বিদ্যে দিগগজ সারাদিন বই মুখে বসেই আছে, মেজবউমা সারাদিন হেঁশেল আঁকড়ে পড়ে আছে আর বড়োবউমা? তার কথা আর কী বলব? দুখানা জর্দা পান পেলেই আহ্লাদে আটখানা হয়ে ঠ্যাঙঠ্যাঙি নাচবে!”
ব্যাস, এই কথা যেই না বলা মা সমেত দুই জেঠীমা ভেউভেউ, ফ্যাচফ্যাচ, হাউমাউ করে কেঁদে কেটে একশা হয়ে ঘোষণা করলেন তারা তিনজনেই বাপের বাড়ি চলে যাবেন!
ঠাকুমা অবাক হয়ে বললেন, “আ মোলো যা ওরা আবার কাঁদে কেন গা? ভর সন্ধেবেলা যত অলুক্ষুণে কাণ্ড! বড়োখোকার বাবা তো শেষদিন পজ্জন্ত আমায় বলে গিয়েছেন সেজবউ তুমি এবার একটা সোনার সাতনড়ি হার তৈরি করেই নাও!”
“আহ মা, গয়নার কথা হচ্ছে না এখানে। ঘুঁটেলাল মাকে ঘরে দিয়ে আয় তো।“ সোনাজেঠু বললেন।
“দোষেরটা কী করলাম। নিজের কানে পষ্ট শুনলাম হালুম বলছে গয়না গড়িয়ে রাখা মঙ্গল!”
“চলিয়ে-চলিয়ে মাঈজি,” ঘুঁটেলাল ঠাকুমাকে ঘরে দিয়ে এল।
“উফ, বাপরে বাপ,” হালুমমামা বললেন, “একটা সিরিয়াস কথা কেউ মন দিয়ে শুনছেই না। এর মধ্যে কোত্থেকে সাতনড়ি হার এল আমার মাথায় ঢুকছে না।”
কেটলিপিসি নিমঠোনা দিলেন, “সব যদি তোমার মাথায় ঢুকতো তুমি দেশের রাষ্ট্রপতি হতে কিনা!”
“বড়দা, আমি কিন্তু বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।”
সোনাজেঠু সকলকে হাত দেখিয়ে থামালেন। “শান্ত হও সবাই। হালুম যা বলতে চাইছে ওকে বলতে দেওয়া হোক। তারপর তোমরা একে-একে নিজের বক্তব্য প্রকাশ কর।”
সোনাজেঠুর কথায় কাজ হল। সকলের সমবেত ফিসফিস, গুজগুজ বন্ধ হল। হালুমমামা আবার বলতে শুরু করলেন। “বন্ধুগণ, আপনারা সকলেই জানেন এই নসীবপুরকে ঘিরে রয়েছে ময়নাগড়ের গভীর জঙ্গল। আর এই জঙ্গলেই শুরু হয়েছে এক হাতির উপদ্রব। সেই পাগল হাতির জ্বালায় লোকে জঙ্গলে যেতে পারছে না, শিশুরা জঙ্গলের পথ দিয়ে ইশকুলে যেতে পারছে না, মহিলারা শুকনো কাঠ কুড়ুতে যেতে পারছেন না। কিন্তু দিনের পর দিন তো এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। তাই সরকার বাহাদুরের অনেক অনুরোধে এই হালুম শিকারি সেই হাতিকে জব্দ করার দায়িত্ব নিয়েছে। যে কারণে…”
“এক মিনিট। আমার এ বিষয়ে কিছু প্রশ্ন আছে।” সোনাজেঠু নিজেই এবার হালুমমামাকে থামালেন। আগেই বলেছি জেঠু ওকালতি করেন। তাই উকিলের মত করেই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “হালুম, আমার প্রথম প্রশ্ন হল হাতিটা যে পাগল হয়েছে তুমি জানলে কী করে?” আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হল সরকার বাহাদুর কী সত্যিই তোমায় এরকম কোনও কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন? নাকি তুমি নিজেই…”
“সরকার বাহাদুরের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই!” কেটলিপিসি ক্রূর হাসি হেসে বললেন। “দেখো গে যাও নিজেই যেচে পড়ে মুক্তকচ্ছ হয়ে দায়িত্ব নিয়েছেন!”
“অপমানিত হওয়ার একটা সীমা আছে বড়দা। ওরে কে আছিস আমার তোরঙ্গখানা নিয়ে আয়। আটটা ছাপান্নর গাড়িটা মনে হয় পেয়ে যাব!”
“আহা চটো কেন হালুম? এই কেটলি তুই চুপ করে থাক।”
“কেন চুপ করব শুনি?” কেটলি পিসি ঝাঁঝিয়ে উঠলেন। “বিষের সঙ্গে খোঁজ নেই কুলোপানা চক্কর! হাতি মারবে? হুঁ! ভাঁড়ার ঘরে ইঁদুরের উৎপাত হয়েছে কদিন ধরে। সেই ধাড়ি ইঁদুর একখান মেরে দেখাক আগে তারপর হাতি মারতে যাবে!”
উফ, তারপর সে এক ভয়ানক দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়ে গেল। কেটলিপিসি ভার্সাস হালুমমামা। কেটলিপিসি কিছুতেই মানতে রাজি নন যে হালুমমামাকে হাতি শিকারের দায়িত্ব সরকার বাহাদুর দিয়েছেন। এদিকে হালুমমামার দাবি সরকার বাহাদুরের লেখা সিলমোহর দেওয়া চিঠি নাকি তার কাছে আছে। নেহাত সেটা বেজায় জরুরী চিঠি বলে তিনি কাউকে দেখাতে পারবেন না।
সোনাজেঠু আবার আসরে নামলেন।“অর্ডার, অর্ডার!আমারই ভুল। হালুমকে মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া উচিত হয়নি। আগে হালুম সবটা বলবে আমরা শুনবো তারপর যা কথা বার্তা হওয়ার হবে। আর ইউ! কেটলি! স্পিকটি নট!”
সভা আবার শান্ত হল। কেটলিপিসি মুখ বেঁকিয়ে কেটলি কোলে বসলেন। হালুমমামা গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করলেন, “প্রশ্নগুলো তুলে আপনি ভালই করেছেন বড়দা। এতে সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। শুনুন আপনারা, হাতিটি যে সুস্থ নয় সেটা আমাকে ময়নাগড় এবং খোদ আপনাদের নসীবপুরের মানুষজনই বলেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আপনারা কেউ একথা জানেন না কেন? তার একটাই কারণ। আপনারা কেউ শিকারি নন। আমার চোখ কান সব সময় খোলা। আমি সাপের মত দ্রুত যাই, আমি বাঘের মত সতর্ক, আমার দৃষ্টি বাজের মত, আমার গতি হরিণের মত, আমার মস্তিষ্ক…”
“হনুমানের মত!” কেটলিপিসি ফুট কাটল, আমি পষ্ট শুনলাম। কিন্তু ঠিক তখনই পাশের বাড়ির এক খোকা ভ্যা করে কেঁদে উঠল বলে হালুমমামা কথাটা ঠিক শুনতে পেলেন না। তিনি ভয়ানক আবেগতাড়িত হয়ে বলেই চললেন, “এক হাতির কাছে মানবতা আজ বিপন্ন,এই অসহায় পরিস্থিতিতে…”
“কী বলতে চাও পস্টাপস্টি বল দেকিনি বাপু…হেঁসেল এক হাঁটু হয়ে আছে…কাজ কম্ম কিছু নেই নাকি? তখন থেকে উষ্টুম ধুস্টুম বকেই চলেছে!” মেজজেঠি খেঁকিয়ে উঠলেন। বাড়িতে এতগুলো লোকের মাঝে এই মেজজেঠিকেই হালুমমামা একটু সমঝে চলেন। তিনি আমতা-আমতা করে বললেন, “বলব বৈকি মেজদিদি।একটু গৌড়চন্দ্রিকা…যাকগে! মোদ্দা কথা হল-”
বলে একবার আড়চোখে কেটলিপিসির দিকে তাকিয়ে বললেন, “কেউ বিশ্বাস করুক ছাই করুক না করুক তাবড় শিকারিরা হার মেনে নেওয়ার পর সরকার বাহাদুর আমার সঙ্গে অনেক গোপন পরামর্শ করে এই গুরুদায়িত্ব আমার কাঁধে অর্পণ করেছেন।”
এতক্ষণে সকলে হালুম মামার এত লম্ফঝম্পের কারণ বুঝতে পারল। বাবা বললেন, “সে তো খুবই গর্বের বিষয় হালুম। তুমি যে সফল হবে সেই কামনাই করি। কিন্তু তার জন্য এভাবে সকলকে ঠাকুরদালানে ডেকে…”
হালুমমামা ভারি মোলায়েম করে হাসলেন। “সকলকে ডাকার কারণ আছে বৈকি ছোড়দাদা। সরকার বাহাদুর আমার সঙ্গে আরও তিনজনকে জঙ্গলে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। যেহেতু আপনাদের সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ তাই আপনাদের মধ্যে থেকেই সেই তিনজনকে আমি বেছে নেব! আশা করি এই ব্যাপারে আপনারা আমাকে নিরাশ করবেন না।”
সোনাজেঠি বললেন, “এ আবার কী কথা? আমরা শিকারের কী বুঝি?”
“সে আমি শিখিয়ে পড়িয়ে নেব, সেটা কোনও সমস্যা নয়।”
লক্ষ করলাম হালুম মামার সঙ্গে শিকারে যেতে হবে শুনে বড়োরা বেশ নেতিয়ে গেল। তবে আমরা ছোটোরা বেজায় উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত হল ঘুঁটেলাল। সে প্রায় হালুমমামার পায়ের কাছে পড়ে গিয়ে কাকুতিমিনতি করতে লাগল। “হালুমবাবু আপনি হামাকে লিয়ে চলেন।আমি ওই পাগলা হাতিকে একদম ভাগিয়ে দিবে!”
“তিষ্ঠ!” হালুমমামা অভয়মুদ্রা দেখালেন। “লিয়ে চলেন বললেই তো আর নিয়ে যাওয়া যায়না ঘুঁটে! আমি জানি অনেকেই যেতে চান তাই…”
মা বললেন, “না বাপু আমরা বউরা কেউ যেতে চাই না…কিগো তোমরা কেউ যাবে নাকি?”
বাবা বললেন, “আমি শিক্ষক মানুষ, ছাত্র পড়াই। এসব শিকার, গুলি, বন্দুক, না-না এসব আমার দ্বারা হবে না। শুনেছি বড়দা ছোটোবেলায় খুব ডানপিটে ছিল!”
“আহা সে তো ছোটোবেলায়। এখন কি আর সেই বয়স আছে। প্রেসার, সুগার…বাত! ওরে বাবা আমি ওসবে নেই! তবে আমাদের ভানু তো দারোগা! ও যদি সাহস করে…”
মেজজেঠু এতক্ষণ ঝিমোচ্ছিলেন। নিজের নাম শুনেই স্যালুট করার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সব শুনেটুনে বললেন, “সে যাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু হাতি নেহাতই নিরীহ প্রাণী! দাঁত আছে কিন্তু সেটা দিয়ে কামড়ায় না, নখ নেই, বড়ো-বড়ো চোখ নেই…হ্যাঁ বাঘ-টাঘ শিকার করলে একবার ভেবে দেখতাম বটে!”
হালুমমামা ঘুঁটেলালের সঙ্গে কিসব কথা বলছিলেন। তাই কেউ যে যেতে চায়না সেটা তার কানে গেল না। উল্টে তিনি হাসিমুখে বললেন, “আমি জানতাম। আপনাদের এত উৎসাহ দেখে হালুম শিকারী আপ্লুত। আরে আপনারা হলেন গিয়ে বীরের বংশ! তবে কী, তিনজনই তো মাত্র যেতে পারবে তাই আমি ঠিক করেছি একটা লটারি করব। যার নাম উঠবে সেই যাবে।”
এই উপায়ে মোটামুটি সকলেই নিমরাজি হল। যদিও ঘুঁটেলাল খুব কান্নাকাটি করতে লাগল। তাকে পাত্তা না দিয়েই লটারি শুরু হয়ে গেল। প্রথম যার নাম উঠল সে হল আমি স্বয়ং। আমি তো যারপরনাই খুশি। কিন্তু মা কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। বাবা তখন কানে-কানে ফিসফিস করে বললেন, “কেঁদো না। নাম উঠেছে বলেই কি যেতে হবে নাকি?”
দ্বিতীয় নাম উঠল ঘুঁটেলালের। সে তো পেল্লায় একটা লাফ দিয়ে, “জয় বজরংবলি! বলিয়েছিলাম না হালুমবাবু হামার নাম আসবেই!” বলে রামা হো রামা হো গাইতে গাইতে চলে গেল।
আর একটাই নাম বাকি, সকলেই ভয়ানক দুশ্চিন্তা করছে…তৃতীয় নামটা দেখে হালুমমামা নিজেই কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। সকলে উঁকিঝুঁকি মেরে নামটা দেখে খুব নিশ্চিন্ত বোধ করল আর কেটলি পিসির হাত থেকে কেটলিটা ঠক করে পড়ে গেল!
৩
হালুমমামা, আমি, ঘুঁটেলাল এবং….কেটলিপিসি এরা যাবে হাতি শিকারে। ঠাকুরদালানে বজ্রপাত হলেও বুঝি এতটা কেউ মুখ গোমড়া করতো না।
“এত চিন্তার কী আছে? মামা তো যাচ্ছে সঙ্গে,” আমি বললাম।
“হাঁ, শিকারিবাবু একদম হামাদেরকে টিরেনিং দিয়ে দিবে।”
“রাখো তো তোমার টিরেনিং!” সোনাজেঠু বললেন, “নেবু একটা বাচ্চা ছেলে। ও কী শিকার করবে? আর তুই যে এত লাফাচ্ছিস জীবনে তো একটা মশাও মারিসনি…তার ওপর কেটলি! উফ দারুণ দল তৈরি হয়েছে বটে। একা রামে রক্ষে নেই সুগ্রীব দোসর!”
অবশ্য কে যে রাম আর কে যে সুগ্রীব সেটা ঠিক বোঝা গেল না। মোট কথা আমাদের শিকারে যাওয়ায় কারও মত নেই। কেটলিপিসি এতক্ষণ চুপটি করে বসে ছিলেন। এবার কেটলিখানা কোলে করে এগিয়ে এসে শান্ত গলায় বললেন, “আমি যাব! কিন্তু আমার কতগুলো শর্ত আছে।”
“বটে? কী শর্ত শুনি? সরকারি কাজে যাচ্ছ এই না ঢের তার ওপর আবার শর্ত?” হালুমমামা বললেন।
“প্রথমত শিকারে গেলেও আমি এই কেটলিটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব, না বললে চলবে না। আর দ্বিতীয়ত শিকার সম্পন্ন হলে ওই সরকার বাহাদুরের চিঠিখানা আমায় একটি বার দেখাতে হবে!”
“ইইহ! খুব মজা, না! প্রথমত কেটলি নিয়ে কেউ শিকারে যায় না। আর দ্বিতীয়ত ও চিঠি আমি দেখাতে পারব না। আগেও বলেছি।”
“সে তোমার ব্যাপার। ভেবে দেখো। রাজি থাকলে জানিও।” কেটলিপিসি চলে গেলেন।
জানা গেল হালুমমামা নাকি আগে থেকেই পাঁজি দেখে রেখেছেন। আসছে হপ্তায় মঙ্গলবার যাত্রা শুরু হবে। কিন্তু তাতে কী? কেউ তো ছাই রাজিই হচ্ছে না। নিরুপায় দেখে হালুমমামা ঠাকুমার শরণাপন্ন হলেন। ঠাকুমাকে যখন অনেক কষ্টে সমস্ত ঘটনা বোঝাতে হালুমমামা সক্ষম হলেন দেখা গেল ঠাকুমা মামারই পক্ষে! তার কারণ অবশ্য অন্য। ঠাকুমা বললেন, “বড়োখোকা, বড়োবউমা এবং বাকিরা মন দিয়ে শোনো। শিকারের আমি কিছু বুঝিনা। কিন্তু মা অন্নপূর্ণার যেখেনে পুজো হয় সেখেনে যখন একবার এই কথা উঠেছে তখন দাদুভাই, ঘুঁটে এবং কেটলি হালুমের সঙ্গে নিশ্চয়ই যাবে।”
মেজজেঠু বললেন, “কিন্তু মা ওখানে তো তখন প্রতিমা ছিল না!”
“তাতে কী রে হতভাগা?” ঠাকুমা রেগে গেলেন। “চারশ বছরের পুরোনো পুজো। তোদের পূর্বপুরুষরা এখনো এই ঠাকুরদালানের আশেপাশে ঘোরেন সেটা জানিস? লেখাপড়া শিখে খুব বিদ্যান হয়েছ না তোমরা? প্রতিমা নেই তো কী হয়েছে? আমি এখনো বেঁচে আছি বুঝেছ তোমরা। আমি বলছি ওরা যাবে, আলবাত যাবে!”
ব্যাস! আর কী? আমি আর ঘুঁটেলাল ধেইধেই করে নাচতে লাগলাম। ঠাকুমার কথা মানে সুপ্রীম কোর্টেরও উপরে…তাই সকলের মুখে কুলুপ পড়ে গেল। স্থির হল আমরা চারজন আগামী মঙ্গলবার সকালে ময়নাগড়ের জঙ্গলে যাচ্ছি। ও হ্যাঁ বলতে ভুলে গেছি। কেটলিপিসির শর্তগুলো হালুমমামা তখনকার মত মেনে নিয়েছিল!
৪
ঠাকুমা সম্মতি দিয়ে দেওয়ার পর থেকেই হালুম মামা আমাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে দিলেন। আমি যদিও ভেবেছিলাম শিকারের প্রশিক্ষণ সাংঘাতিক রকমের কিছু একটা হবে, কিন্তু দেখা গেল সে’রকম কিছু নয়। হালুমমামা এমন সব গপ্পো ফাঁদলেন যেগুলো শুনে মনে হল হাতি, বাঘ, সিংহ কোনও কিছু শিকার করাটাই কোনও ব্যাপার নয়। শেষের দিকে আমার ভীষণ ঘুম পেতো আর বড়ো-বড়ো হাই উঠত। কেটলিপিসিরও খুব একটা উৎসাহ দেখলাম না। একমাত্র ঘুঁটেলাল মন দিয়ে হালুমমামার সমস্ত কথা শুনত আর মাঝে মাঝেই বলত, “উফ শিকারিবাবু একদম জবরদস্ত টিরেনিং দিচ্ছে আমাদের!”
আমি যেটা বুঝলাম এই টিরেনিংয়ের মূল কথা হচ্ছে, হাতিকে ধরা বা তার দিকে গুলি চালানো ইত্যাদি সব রোমাঞ্চকর কাজ হালুমমামা নিজেই করবেন আর আমরা শুধু চোখ-কান খোলা রেখে তাঁকে অনুসরণ করবো।
প্রশিক্ষণ পর্ব শেষ হল। আমরা সকলের আশীর্বাদ নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। মায়ের কান্না ছলছল চোখ, ভাইবোনদের অভিনন্দন আর বাবা জেঠাদের চিন্তিত মুখ আস্তে আস্তে আবছা হয়ে এল। একটু-একটু মন খারাপ লাগছিল। ভেবেছিলাম ময়নাগড়ের গভীর জঙ্গলে যখন যাব…
*********
গভীর জঙ্গল? কোথায় কী? আমি আর কেটলিপিসি মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগলাম। ঘুঁটেলালও একটু দমে গেল। ময়নাগড়ের জঙ্গলে গভীরের ‘গ’ ও নেই। কতগুলো ঝুপসি কাঁটাঝোপ, লম্বা-লম্বা কয়েকটা জারুল গাছ আর ইতিউতি কয়েকটা শাল আর পলাশ গাছ। কেটলিপিসি আমার কানে-কানে বলল, “কীরকমের ধাপ্পাবাজ মালুম হল এবার? খুব তো নেত্য করছিলে!”
ঘুঁটেলাল বলল, “শিকারিবাবু ই কাইসা জঙ্গল আছে? এখানে হাঁতি কাইসে থাকবে?”
হালুমমামা চোখ গোলগোল করে বললেন, “আহ, শিকারে এসে এত কথা কেউ বলে না। জঙ্গল দিয়ে কি আমি জল ধুয়ে খাব? তোমরা যে যার পোজিশন নিয়ে নাও। ঘুঁটে তুই একদম আমার পিছনে থাক।”
“পিছে থাকবো তো হাঁতি কাইসে মারবো?”
“ধুত্তোর! বলছি না কথা বলতে নেই শিকারে…এতদিন ধরে কী প্রশিক্ষণ…” হালুমমামার কথা শেষ হল না। জঙ্গলের উত্তর দিক থেকে সত্যি একটা হাতির ডাক শোনা গেল। হালুমমামা বিজ্ঞের মত হেসে ঘুঁটেলালকে বললেন, “শুনলি তো? এবার বোঝা গেল এখানে হাঁতি কাইসে থাকবে?”
ঘুঁটেলালের এত বীরত্ব উধাও। সে ফ্যাকাশে মুখে বলল, “আপ সহি বোলা হালুমবাবু। আমি পিছেই থাকি!”
আমি আর কেটলিপিসি গাছের পিছনে পজিশন নিলাম। সামনে বন্দুক বাগিয়ে হালুমমামা আর পিছনে ঘুঁটেলাল। হাতির ডাকটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। মিথ্যে বলব না, এবার একটু ভয়-ভয় করছিল। শুনেছি পাগলা হাতি নাকি পা দিয়ে পিষে…মায়ের কান্না-কান্না মুখটা মনে পড়ল। চোখ বুজে ফেললাম।
হঠাৎ শুনলাম ঘুঁটেলাল হোহো করে হাসছে। চোখ খুলে দেখি ওদের সামনেই একটা হাতি! একটা বাচ্চা হাতি! বেড়ালপানা মুখ করে খুদে-খুদে চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
“আরে এতো একদম ছোটা হাতি আছে। একদম আমার ফুলঝারিয়ার মত দেখতে!” ফুলঝারিয়া ঘুঁটেলালের সাত বছরের মেয়ের নাম। হালুমমামা থতমত খেয়ে বন্দুক নামিয়ে ফেললেন। তারপর হাতিটাকে কাক তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললেন, “এই যাহ! হ্যাট হ্যাট…হুস!”
হাতিটা তাতে মোটেও দমে গেলনা। গুটগুট করে এগিয়ে এসে হালুমমামার বিশাল ভুঁড়িতে মাথা ঘষতে লাগল।
“কী জ্বালা!” হালুমমামা বললেন। আমি আর কেটলিপিসি গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছি। কেটলিপিসির মুখে মিটিমিটি হাসি।
“এই তাহলে তোমার সেই ভয়ংকর পাগলা হাতি হালুমদাদা?”
“ইয়ে মানে…এর কথা তো…সরকার বাহাদুর যে বললেন…” হালুমমামা ভয়ানক অপ্রস্তুত!
“রাখো তো তোমার সরকার বাহাদুর। আহারে বাছার মনে হয় খিদে পেয়েছে।”
কেটলিপিসির কেটলিতে দুধ ছিল। সেটা সেই হাতির মুখে ধরতেই সে ব্যাটা চুকচুক করে সবটা খেয়ে নিল। কেটলিপিসি তাচ্ছিল্য করে হালুমমামার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এইবার বোঝা গেল কেটলি নিয়েও শিকারে আসা যায়!”
“কিন্তু এই হাতিটাকে নিয়ে এখন কী করা যায়?” আমি জানতে চাইলাম।
“হামার মনে হচ্ছে নেবুবাবু ই হাঁতি জরুর মা সে আলাদা হয়ে ইস জঙ্গলমে গুম হয়ে গ্যাছে!”
“ঠিক বলেছিস রে ঘুঁটে। একে আমরা এখন বাড়ি নিয়ে যাই। পরে দাদাবাবুরা ঠিক করবেন কী করা হবে।”
“নিয়ে যাবে মানে? এর দেখাশোনা কে করবে শুনি?” হালুমমামা জানতে চাইলেন।
“আমি করবো। আমি ওর নাম দিলাম মিউমিউ!”
“হাতির নাম মিউমিউ?” মামা বিস্মিত।
“হাতি শিকারির নাম যদি হালুম হয় তাহলে হাতির নাম মিউমিউ হলে ক্ষতি কী?”
মিউমিউ দিব্যি হ্যাংলার মত শুঁড় দিয়ে পিসির শাড়ি জড়িয়ে আমাদের বাড়ি চলে এল। তারপর তাকে নিয়ে বাড়ির লোকের সেকি আদিখ্যেতা! আমাদের পুরোনো গ্যারেজে তার স্থান হল। মিউমিউ দিব্যি সেখানে মানিয়ে নিল। হালুমমামা বোকা-বোকা হেসে বললেন, “আসলে আমার নাম শুনেই হাতির দল ভেগেছে…এ ব্যাটা কোনওভাবে দলছুট হয়েছে আর কী!” তবে সে কথাকে কেউ বিশেষ আমল দিল না।
বাবা আর জেঠুরা কিন্তু বললেন মিউমিউকে নিতে নাকি বনদপ্তর থেকে লোক আসবে। সেই খবর শুনেই আমরা সকলেই কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম। ঠাকুমা বললেন, “আমার নাতি আমার বাড়িতেই থাকবে!”
সকলে যত বলে “ঠাকুমা, নাতি নয় হাতি” তত তিনি বলেন, “মোটেও না। এটা নাতি, আপাদমস্তক আস্ত একটা নাতি।”
আমি ভারি মনখারাপ করে বসে রইলুম। আজ বিকেলে মিউমিউ চলে যাবে। কখন দেখি বেজার মুখে হালুমমামাও আমার পাশে এসে বসেছেন।
“কিরে মন খারাপ লাগছে?”
“হ্যাঁতো।” গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে এসেছে। “মিউমিউ এখানে থাকলে কী হ্য়? ওকে তো আমরা কত্ত ভালবাসি?”
“নেবু, তুই বলছিলি না শিকারে যাওয়ার সময় তোর মার জন্য মন কেমন করছিল? ভাব তো ও ওর মাকে ছেড়ে কতদিন রয়েছে! বনদপ্তরের সঙ্গে কথা বলে এলাম রে। যে দল থেকে মিউমিউ হারিয়ে গিয়েছিল তার খোঁজ মিলেছে ময়নাগড় থেকে মাইল আষ্টেক দূরে। মিউমিউকে হারিয়ে ওর মার নাকি পাগল-পাগল দশা। ও ফিরেই যাক কী বলিস নেবু?”
এই কথার পর কী আর মিউমিউকে আটকে রাখা যায়? সকলকে কাঁদিয়ে হাসি-হাসি মুখে বনদপ্তরের গাড়িতে মিউমিউ চলে গেল। কেটলিপিসি যাওয়ার আগে ওর গলা জড়িয়ে খুব আদর করলেন। আর মিউমিউ আরও একবার হালুমমামার ভুঁড়িতে মাথা ঘষে দিল। মিউমিউ চলে যাওয়ার পর হালুমমামা বললেন, “ব্যাটার এলেম আছে দেখছি। আমার মত শিকারিকেও মায়ার বন্ধনে বেঁধে দিয়ে গেল!”
কেটলিপিসি চোখের জলটল মুছে গটগট করে এগিয়ে এসে বললেন, “ছেঁদো কথা রাখ তো। চিঠি দেখাও!”
“চিঠি?” মামা আকাশ থেকে পড়লেন। “কার চিঠি?”
“কেন সরকার বাহাদুরের? শর্ত ছিল তো?”
“ও চিঠি নেই।”
“নেই মানে?”
“তোরঙ্গ গুছোতে গিয়ে দেখি হারিয়ে গ্যাছে!”
“বটে? আমি বিশ্বাস করিনা।”
“না করলে ভারি বয়েই গেল।” হালুম মামা চলে গেলেন।
কিন্তু পিসি হাল ছাড়বার পাত্রী নন। একদিন দুপুরে মামা যখন বাড়িতে নেই তিনি সেই বিখ্যাত সবুজ তোরঙ্গ থেকে একটা ছেঁড়া, ময়লা, ভুসকুট্টি চিঠি বের করে আনলেন। তারপর আমাকে চুপিচুপি ডেকে বললেন, “এই দেখো সেই চিঠি, এইবার টপ করে পড়ে ফেলি!”
“কিন্তু বাবা যে বলেন অন্যের চিঠি না বলে পড়তে নেই?”
“অন্যের চিঠি কোথায়? আমার তো শর্ত ছিল। এতে কোনও অন্যায় নেই!”
ভেবে দেখলাম ঠিকই তো। পিসি তো আগেই শর্ত দিয়েছিল। তাছাড়া নিজেরও যে ভয়ানক কৌতূহল হচ্ছিল সেটা আর বললাম না! আমি আর পিসি চিলেকোঠার ছাদে গিয়ে এক নিশ্বাসে সেটা পড়লাম।
দেখলাম তাতে লেখা আছে, “শ্রীযুক্ত হালুমবাবু, দীর্ঘদিন আপনার কোনও সংবাদ পাইতেছি না। আপনার কাছ থেকে আমি তিনশতটাকা আটাশ পয়সা পাইতাম সেটা যে আপনি বেমালুম ভুলিয়া গিয়াছেন সেটা বেশ বুঝিতে পারিতেছি। আপনাকে জানাইয়া রাখি এই তিনশতটাকা এখন সুদে আসলে ফুলিয়া ফাঁপিয়া বিকট আকার ধারণ করিয়াছে। ইতিমধ্যে টাকা ফেরত না পাইলে মামলা করিতে বাধ্য হইবো! ইতি আপনার দাসানুদাস শ্রী বাহাদুর সরকার!”
চিঠি চুরির কথাটা হালুমমামা জানেন না। তবে মিউমিউ চলে যাওয়ার পর মামা আর কোনওদিন শিকারে যাননি।
ছবিঃ মৌসুমী