বুঝতে ভীষণ ভুল-অনন্যা দাশ
পল আর পরিকে দেখাশোনা করতে যাওয়ার কোন ইচ্ছে ছিল না আমার কিন্তু তখন ভারি টাকার দরকার। যে কোর্সগুলো করতে চাই সেগুলোর ফি খুব বেশি। বাবা বেশ কয়েকদিন হল রিটায়ার করেছেন, দিদির বিয়ে আসন্ন তাই বাড়িতে টাকার কথা বলতেই লজ্জা লাগে! এমন সময় একদিন সুলেখা ফোন করে বলল, “এই বেবি-সিটিং করে পয়সা রোজগার করবি?”
সুলেখা আমার বেশ প্রিয় বন্ধু তাই সে আমার অবস্থাটা জানে। আমি শুধু পয়সা রোজগার কথাটুকু শুনলাম আর বললাম, “হ্যাঁ, হ্যাঁ!”
“আগেই বলে দিচ্ছি কাজটা কিন্তু মোটেই সহজ নয়, বরং ভীষণ শক্ত! পরে গন্ডগোল হলে আমাকে দোষ দিবি না একদম!”
“না, না, পাগল! তোকে দোষ দেব কেন? গন্ডগোল যদি হয় তো আমার নিজের জন্যেই হবে। যাই হোক কী কাজ করতে হবে?”
“দিশাদি আর পবিত্রদাকে জরুরি কাজে ব্যাঙ্গালোর যেতে হচ্ছে। ওদের সাত বছরের যমজ বিচ্ছু দুটো ছেলেমেয়ে আছে তাদের দেখাশোনা করার জন্যে লোক খুঁজছে ওরা। ভাল টাকা দেবে তাই তোর কথা মনে হল।”
“ও সে আর এমন কী শক্ত কাজ!”
“হুঁ, ওই আনন্দেই থাক! দিশাদি পবিত্রদা দুজনেই ডাক্তার। তাই বেবিসিটারের অভাব হয়নি ওদের কিন্তু কেউ দুয়েকদিনের বেশি টেঁকে না! আমাকে বলেছিল ওরা কিন্তু আমি বলে দিয়েছি আমি ওর মধ্যে নেই। তারপর তোর কথা মনে পড়ল। ওরা কিছুদিন হল নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছে, পাড়াপড়শি কাউকে তেমন চেনে না।”
আমি একটু কৌতূহল দেখালাম, “কী হয়েছিল অন্য বেবিসিটারদের সঙ্গে? বাচ্চারা একটু দুষ্টুমি তো করেই!”
“ও বাবা, এরা একটু দুষ্টুমির ক্লাস পাস করে এখন অ্যাডভান্সড দুষ্টুমিতে পি এইচ ডি করছে! লাস্ট যে ছিল সে বসে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম থেকে উঠে দেখে তার মাথায় গায়ে কেঁচো, মাকড়সা ইত্যাদি সুন্দর জিনিস ঘোরাফেরা করছে! চিৎকার করে ভয়ে হার্টফেল হয়ে যাওয়ার যোগাড় তার! তার আগেরজনের খাবার চুমকি পুঁতি দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল ওরা! তিনি খেয়ে ফেলে হুলুস্থূল কান্ড! স্কুল থেকে ওদের নামে রোজ নালিশ আসে! দিশাদি আর পবিত্রদা একেবারে হয়রান, নাজেহাল! কিন্তু তোর তো টাকার দরকার তাই কয়েকটা দিন যদি সহ্য করতে পারিস তাহলে ভাল উপায় হবে। রাজি থাকলে আজ বিকেলে ওদের বাড়ি যাস। আমি ওদের ফোন করে বলে রাখব।”বলে ওদের ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিয়ে সুলেখা ফোন ছেড়ে দিল।
সেদিন বিকেলে গিয়ে হাজির হলাম পল আর পরির বাড়িতে। তখন প্রায় রাত আটটা বাজে। দিশাদি বললেন উনি সবে ওদের নিজের বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে ফিরেছেন। দুজনেই তখন ঘুমিয়ে কাদা। কী মিষ্টি দেখতে, একেবারে যেন দেবশিশু!
দিশাদি আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন, “ওদের চেহারা দেখে ভুলো না! একেবারে হাড় বিচ্ছু দুজনেই! আমাদের পরশুই একটা কনফারেন্সে ব্যাঙ্গালোর যেতে হবে তাই কাউকে খুঁজছি। অচেনা কাউকে বাড়িতে ঢোকাতে ভয় লাগে কিন্তু তুমি তো সুলেখার বন্ধু! আমার মা-বাবার কাছে রেখে যেতে পারতাম কিন্তু বাবা আবার কাল শান্তিনিকেতন যাচ্ছেন আর মার একার পক্ষে এদের দুজনকে সামলানো অসম্ভব!”
টাকাকড়ির ব্যাপার নিয়ে কথা বলার কোন প্রয়োজন হল না কারণ ওনারা একটা বিশাল অংকের কথা জানিয়ে দিলেন। আমি তো এক কথায় রাজি।
“আমি ওদের রুটিনটা তোমাকে পাঠিয়ে দেব। যদিও ওরা যা দুষ্টু, স্কুলে যাওয়া ছাড়া কিছুই রুটিন ধরে করে না। তবে একটা কথা, খাওয়া দাওয়ার কোন ঝামেলা নেই। যা দিই তাই খেয়ে নেয়। আসলে শয়তানিতে এত মন যে ওই সব নিয়ে ভাববার সময় নেই! কবে যে মানুষ হবে আর স্কুল থেকে ওই কমপ্লেনগুলো আসা বন্ধ হবে!”
দিশাদি তাঁর কথামত আমাকে ওদের রুটিনটা টেক্সট করে দিয়েছিলেন। ওনাদের রাতের ফ্লাইট বলে আমি বাড়ি থেকে খেয়ে দেয়ে একটা সুটকেস নিয়ে ওদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। আমার সঙ্গে পরিচয় হল পল আর পরির, কিন্তু তখন তারা ফর্মে নেই, ঘুমে তাদের চোখ ঢুলুঢুলু! তাও আমাকে আপাদমস্তক দেখে নিল তারা, মনে মনে যেন ভাবছে, “ও এর সঙ্গে আমাদের তিনটে দিন থাকতে হবে! কী বিপদ!”
দিশাদিরা এয়ারপোর্টে রওনা দেওয়ার আগেই তারা ঘুমিয়ে পড়ল! ওরা বেরিয়ে পড়তেই আমিও দরজা জানালা সব বন্ধ আছে কিনা দেখে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। কাল থেকে ভাগ্যে কী আছে কে জানে ভেবে।
আমার ঘুম এমনিতেই পাতলা আর ভোরের দিকে আরো পাতলা হয়ে যায় তাই পরদিন ভোরে খুট করে একটা শব্দ শুনে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। প্রথমে মনে হয়েছিল আরে কোথায় আমি? তারপর মনে পড়তেই তড়াক করে উঠে পড়লাম। কীসের শব্দ হল? দিশাদি বলেছেন কাজের লোক তো সাড়ে আটটা নটার আগে আসে না আর এখন বাজে সাড়ে ছটা! চট করে বিছানা ছেড়ে একটা শাল গায়ে দিয়ে খুদেদের ঘরে গেলাম! ওমা বিছানায় কেউ নেই! সর্বনাশ! আমি দৌড়ে সদর দরজার কাছে গিয়ে দেখি হ্যাঁ কাছেই একটা চেয়ার রাখা আর দরজা খোলা! ও তার মানে দরজার ছিটকিনি খোলার শব্দেই আমার ঘুমটা ভেঙেছে। আমার চাকরি গেল, পুলিশ কেস হবে, এই সব হাজারটা কথা মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল। জুতো পায়ে গলিয়ে আমিও দরজা দিয়ে বেরলাম। হঠাৎ দেখি ওরা দুজন একটা কুকুরছানাকে সঙ্গে করে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাগান পেরিয়ে ফ্ল্যাটবাড়ির গেটের দিকে যাচ্ছে। আমি সেদিকে যেতে গিয়ে দেখলাম একটা ফ্ল্যাটের দরজা খুলে এক বয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমাকে দেখে বললেন, “তুমি বুঝি পল আর পরির দেখাশোনা করতে এসেছ?”
“খুব ভাল ছেলে মেয়ে ওরা, আমার পায়ে চোট লেগেছে তাই আমি ভুলোকে হাঁটাতে নিয়ে যেতে পারি না বলে ওরা রোজ ভোরবেলায় এসে ওকে নিয়ে যায়!”
“ও তাই নাকি! আচ্ছা আমি একটু আসছি হ্যাঁ, ওরা কোথায় গেল দেখতে হবে। আপনার সঙ্গে আমি পরে কথা বলব!” বলে আমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেটের দিকে ছুটলাম। আমার ভয় হচ্ছিল এত ভোরে দারোয়ান যদি না থাকে আর খুদেগুলো গেটের বাইরে বেরিয়ে যায় তাহলে ভয়ঙ্কর বিপদ হবে! আশ্চর্য ওরা নাকি রোজ এটা করে অথচ দিশাদি আর পবিত্রদা জানেনই না! ওনারা মনে হয় ক্লান্ত থাকেন তাই ঘুম ভাঙে না!
গেটের কাছে গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না! এক মহিলা তার ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ছেলেটার পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম কিন্তু সে একটু অন্য রকম সেটা তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে। পল আর পরি কুকুরটাকে নিয়ে ওর কাছে গেছে আর তিনজনে মহা আহ্লাদে কুকুরটাকে চটকাচ্ছে! কুকুরটা মানে ভুলোও অবশ্য সেই আদরে খুব মজা পাচ্ছে সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে!
আমাকে দেখে ছেলেটির মা এগিয়ে এসে বললেন, “টুবলু ছোটদের স্পেশাল স্কুলে যায়। ওদের গাড়ি আবার এই কাকভোরেই আসে। আগে টুবলু কিছুতেই যেতে চাইত না কিন্তু এখন পল আর পরি ভুলোকে নিয়ে রোজ আসে বলে ওর কী উৎসাহ স্কুলে যাওয়ার জন্যে! ওদের বকবেন না প্লিজ!” বলতে বলতে মহিলার চোখে জল এসে গেল।
তিনজনে মিলে খুব হুটোপুটি খেলা চলল। তারপর টুবলুর গাড়ি এসে যেতে সে স্কুলে চলে গেল। পরি আর পল খুব ঘটা করে বাই বাই করল, “কাল আবার আসব” বলল। তারপরই পিছন ফিরে আমাকে দেখল। এতক্ষণ ওরা খেলায় এত ব্যস্ত ছিল যে আমাকে দেখেইনি!
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলাম, “চলো এবার তো ভুলোকে ফেরত দিয়ে তৈরি হতে হবে! তোমাদের পুল কার এসে পড়বে আর কিছুক্ষণ পরেই!”
পুঁচকে দুটো আর কিছু না বলে আমার সঙ্গে চলল। ভুলোকে তার মনিবের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে ফ্ল্যাটে ফেরা হল। দুজনে যে আমার সঙ্গে খুব একটা কথা বলছে তা না, তবে নিজেদের মধ্যে বকবক লেগেই আছে! ওরা স্কুলের জন্যে তৈরি হয়ে যেতে আমি বললাম, “দেখো, আজ যদি তোমরা স্কুলে একদম দুষ্টুমি না করো তাহলে কিন্তু ফিরে এলে আমরা সবাই ভুলোকে নিয়ে পার্কে যাব আর আমি তোমাদের খুব সুন্দর একটা গল্প বলব কেমন? করবে না তো দুষ্টুমি?”
পল একটু ভেবে বলল, “সায়ন রোজ পরির টিফিন খেয়ে নেয় যে!”
“ও, তারপর?”পল এক গাল হেসে বলল, “তারপর আমি ওর ব্যাগটা নিয়ে উলটে দিলাম! সব বই খাতা পেন্সিল বক্স মাটিতে গড়াগড়ি! টিচার রেগে কাঁই!”
পরি সেটা শুনে হি হি হি করে হাসল।
আমি বললাম, “ঠিক আছে চলো, আজ আমি তোমাদের স্কুলে যাচ্ছি। টিচারকে বলব যে সায়ন পরির লাঞ্চ খেয়ে নেয়!”
স্কুলে গিয়ে টিচারের সঙ্গে কথা বলে আমি তো হাঁ! ওরা যে এমনি এমনি দুষ্টুমি করে তা না, কে কার টিফিন খেয়ে নেয় বা কে দুর্বল কাউকে মারে তাদের জন্যে বদলা নেয়!
টিচার হেসে বললেন, “ক্লাসের সুপার হিরো সাজতে গিয়েই ওদের ওই দশা! আমাদের তো কমপ্লেন শুনতে হয় অন্য মা-বাবাদের কাছে তাই আমরাও ওদের মা-বাবাকে জানাতে বাধ্য হয়েছি কিন্তু আমি জানি ওরা মনের দিক থেকে খুব ভাল! ওদের মা-বাবা তো দেখা করতে আসার সময়ই পান না, এলেই আমি সব বলতাম ওনাদের। শুধু ওরা যদি কাজটা নিজেরা না করে আমাকে এসে বলে তাহলেই ঝামেলা মিটে যায়!”
আমি মনে মনে ভাবছিলাম ও হরি এরা তো সত্যই দেবশিশু, এদের শয়তানের আসনে কে বসাল? ওদের খাবারে চুমকি পুঁতি দেওয়ার ব্যাপারটাও আমার কাছে স্পষ্ট, ওরা খাবারটাকে সুন্দর দেখতে করতে চাইছিল! সেটা যাকে দিয়েছিল তার বোঝা উচিত ছিল! আমার খাবারেও দিয়েছিল। আমি সেগুলোকে সরিয়ে দিব্যি খাবারটা খেয়ে নিলাম দেখে ওদের কী আনন্দ!
স্কুল থেকে ফিরে পার্কে যাওয়ার পথে আমি জিগ্যেস করলাম, “আগে যে দিদি ছিল তার মাথায় কেঁচো ছেড়ে দিয়েছিলে কেন?”
পরি রেগে গিয়ে বলল, “বা রে ও তো লুলু মুলুকে ফেলে দিল! লুলু মুলু হারিয়ে গেল!”
অনেক কষ্টে উদ্ধার করা গেল যে লুলু মুলু আসলে দুটো শুঁয়োপোকা। পল ওদের বাড়িতে এনে রেখে পাতা খাওয়াচ্ছিল প্রজাপতি করবে বলে। যিনি ছিলেন তিনি পোকামাকড় মোটেই পছন্দ করতেন না তাই শুঁয়োপোকা দেখে দুর করে ফেলে দিয়েছেন তাতেই ওদের অত রাগ! ওরা কিন্তু নালিশ করে না! যা করার নিজেরাই করে!
আমি ওদের বললাম, “লুলু মুলু হয়তো এতদিনে প্রজাপতি হয়ে উড়ে গেছে কিন্তু ওদের ভাইবোন পুলু টুলুকে পাওয়া যাবে! আমি জানি ওরা কোন গাছে থাকে! আজ ফেরার পথে ওদের বাড়ি নিয়ে যাব কেমন?”
তিনটে দিন কী ভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না! রোজ সকালে উঠে ভুলোকে নিয়ে গেটের কাছে যাওয়া। টুবলু স্কুলে চলে গেলে ফিরে এসে ওদের স্কুলে পাঠানো তারপর স্কুল থেকে ফিরে পার্কে গিয়ে গল্প শোনা। দিশাদি আর পবিত্রদা ফোনে সব শুনে তো থ!
তিনদিন পর ওদের মা বাবা ফিরতে আমি সুটকেস নিয়ে বাড়ি যাবার জন্যে তৈরি হতে ওরা কিছুতেই আমাকে যেতে দেবে না! বেশি কথা বলছে না কেবল আমার হাত ধরে টানাটানি! শেষে পরি শুধু বলল, “তুমি পলের পুলুটুলু্র প্রজাপতি হওয়া দেখবে না? আর আমার ছোলা গাছগুলো বেরোল কিনা?” ওদের কথার আমি কোন উত্তর দিতে পারিনি সেদিন, তাই আমাকে থেকে যেতে হয়েছে!
ছবিঃ অর্ণব