বেনোর কীর্তি-কিশোর ঘোষাল
টুকাই স্কুল থেকে ফিরে জামা জুতো ছেড়েই পিঠের ব্যাগটা ধপাস করে রাখল বসার ঘরের সোফায়। তারপর এক ছুট্টে চলে গেল তার ঘরের দিকে। যেতে যেতে বলল, “মঞ্জুমাসি, খেতে দাও ভীষণ খিদে পেয়েছে।”
ঘরে গিয়ে আগেই পিসিটা অন করে, স্কুলের জামা প্যান্ট ছেড়ে, চটপট পরে নিল ঘরে পরার টি শার্ট আর বারমুডা। বাথরুমে ঢুকে দরজাটা ধড়াম করে বন্ধ করে গেয়ে উঠল, “দেখেছি রাত্রি জেগে, এক টুকরো মেঘে, লেগেছে চাঁদের জোসনা, পথে টানা রিকশা, ছেলে চায় ভিকষা, তা দেখে উতল হোস না।” সরস্বতীপুজোয় মাইকে গানটা শুনে টুকাইয়ের খুব ভাল লেগেছিল। বাথরুমে ঢুকলে এই গানটাই সে এখন গায়। তোয়ালেতে মুখ হাত মুছে টুকাই বেরিয়ে এল। দেখল মঞ্জুমাসি একটা প্লেটে দুটো লুচি আর একটু আলু চচ্চড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোজ রোজ লুচি পরোটা তার একদম ভালো লাগে না। একটু নাকি সুরে, টেনে টেনে বলল, “ওঁ মোঁওঞ্জুমাঁআসীঈ, রোঁওজ রোঁওজ লুউউচি ভাঁআলোও লাঁআগে না। আঁআআর কিছু নেই?” মঞ্জুমাসি বলল,
“কী করব বলো, তোমার মা পই পই করে বলে গেছেন, স্কুল থেকে ফিরলে তোমাকে লুচি তরকারি দিতে।”
খুব ব্যাজার মুখে টুকাই, চেয়ারে বসে প্লেটটা হাতে নিল। পিসিতে গেমস চালু করতে করতে, লুচি ছিঁড়ে তরকারি সমেত এক টুকরো মুখে নিল। ঠিক তখনই ঘরে এসে চেয়ারের পাশে মেঝেয় বসল বেনো। বেনোর হাতে একটা বাটিতে বেশ অনেকটা মুড়ি আর এক ডাব্বা আলু চচ্চড়ি।
বেনো মঞ্জুমাসির নাতি। মেয়ের ছেলে। বছরখানেক আগে ওর মা মারা গেছে, আর মাসদুয়েক হল বেনোকে তাড়িয়ে দিয়ে বেনোর বাবা আবার বিয়ে করেছে। সেই থেকে বেনো টুকাইদের বাড়িতেই থাকে। কোথায় আর যায় বেচারা? টুকাইএর মা মঞ্জুমাসিকে জিগ্যেস করেছিল, “বেনোর নাম বেনো কেন”?
টুকাই বলেছিল,“ব্যাটসম্যান রিচি বেনোর নাম শোন নি? সেখান থেকেই বেনো, এ আবার না বোঝার কী আছে?”
কিন্তু মঞ্জুমাসি একগাল হেসে বলেছিল, “ঐ যে গো, দিদিমণি, বছর আষ্টেক আগে খুব বানবন্যে হল নি, সেই বারই ও জন্মেছিল বলে, ওর বাপ নাম রেখেছিল বেনো।”
বেনোর সঙ্গে টুকাইয়ের চোখাচোখি হতেই, টুকাই বেনোর হাত থেকে মুড়ির বাটিটা ছোঁ মেরে তুলে নিল, আর লুচির প্লেটটা দিয়ে দিল বেনোর হাতে। বেনো হতভম্ব হয়ে বসে রইল লুচির প্লেট হাতে। ওদিকে আলুচচ্চড়ি মাখা মুড়ি একমুঠো গালে পুরে টুকাই চোখ বন্ধ করে চিবুতে লাগল আরামে।
মঞ্জুমাসি টুকাইয়ের জন্যে আরো লুচি নিয়ে ঘরে ঢুকল। তারপর ওদের কাণ্ডকারখানা দেখে চেঁচিয়ে উঠল, “হেই মা, ও কী করলে গো, দা’বাবু। তোমার মা জানতি পারলে আমাকে আর বেনোকে দুজনকেই তাড়িয়ে দেবে যে গো। তুমি মুড়ি খাচ্চো কী গো দা”বাবু? ও আবার কেউ খায় নাকি?”
“বেনো খাচ্ছিল তো। ও বুঝি মানুষ নয়, মঞ্জুমাসি?”
“শোন কতা ছেলের। ও হচ্ছে মা-মরা বাপে-তাড়ানো অভাগা। ওর সঙ্গে তোমার তুলনা, বাবু? তুমি হীরের টুকরো, সোনা ছেলে। লক্কি বাবা আমার, তোমার জন্যে আরো লুচি ভেজে আনচি। ও মুড়ি তুমি খেও নি।”
“ঠিক আছে, তুমি দুটো লুচি দাও, কিন্তু এই মুড়ি আমি খাবো। আর প্লেটের দুটো বেনো খেয়ে নিক।”
“না, না, দা’বাবু, তোমার মা জানতি পারলে রক্ষে থাকবে নি।”
“মঞ্জুমাসি, আমি তো লুচি খাচ্ছিই, আর না খেয়েও থাকছি না। সব কথা মা জানতে না পারলেই তো হল।”
“না, বাবু, তোমার মা আপিস থেকে ফিরে যখন জিগ্যেস করবে, আমার কিন্তু বুক কাঁপবে।”
টুকাই মুড়ির বাটি খালি করে, শেষ মুঠি মুড়ি মুখে ঢেলে বলল, “মঞ্জুমাসি খাবার দাও, আমার খিদে পেয়েছে।”
তার এই কথায় মঞ্জুমাসি হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে মঞ্জুমাসি বলল, “আনছি বাবু, আনছি। আচ্ছা পাগল ছেলে। মুড়িতে কি স্বাদ পাও কে জানে।”
গতকাল একটা নতুন গেম শুরু করেছিল টুকাই। সেটার লেভেল থ্রি অব্দি খেলে সেভ করে রেখেছিল, আজ লেভেল ফোর থেকে শুরু করবে। টুকাই গেম খেলার সময়, বেনো চেয়ারের পাশে মেঝেয় বসে গেম খেলা দেখে। এই খেলায় টুকাই হচ্ছে কিলারম্যান। কঠিন চোয়াল দারুণ শক্তপোক্ত চেহারা। তার বিরুদ্ধে আছে বিকট দেখতে সব প্রাণী। কেউ গুলি ছোঁড়ে, বোমা মারে। কেউ আগুনের গোলা ছুঁড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। কেউ হুল ফুটিয়ে দেয়। সে সব গায়ে লাগলেই কিলারম্যানের স্বাস্থ্যহানি হয়। এমনিতে তার তিনটে জীবন, প্রত্যেক জীবন মানে একশ ভাগ। স্বাস্থ্য হানি থেকে বাঁচার উপায় নানান ওষুধ, নানান খাবার। তাছাড়া প্রত্যেকটা প্রাণীকে মেরে ফেলতে পারলে নানান পয়েন্ট জমা হয়। পঞ্চাশ হাজার পয়েন্ট জমলেই, একটা জীবন বোনাস মেলে, তখন পিড়িং করে একটা শব্দ হয়।
এই গেম খেলতে খেলতে ডুবে যায় দুজনেই। টুকাই তো নিজেই কিলারম্যান, তার কথা আলাদা, কিন্তু বেনো মেঝেয় বসা থেকে হাঁটু গেড়ে উঠে পড়ে, উত্তেজিত স্বরে বলে, “টুকাইদাদা, ওই যে বাঁদিক থেকে শুঁড় নিয়ে আসছে। টুকাইদাদা, ওই যে ওপর থেকে আগুনের গোলা ফেলার তাল করছে রাক্ষসটা। মেরে দাও। মেরে দাও।” টুকাইও ঘাড় ঘুরিয়ে গুলি চালায় তার বন্দুক থেকে, ঢিচিকাঁউ, ঢিচিকাঁউ। অদ্ভুত জীবগুলি মরে গেলেই পর্দায় ফুটে ওঠে পাঁচশ, তিনশ, দুশ পয়েন্ট। সে পয়েন্ট জমা হয় টুকাইয়ের ভাণ্ডারে।
স্কুল থেকে ফেরার সময় টুকাইয়ের ঘরের লাগোয়া বারান্দায় পশ্চিমের রোদ এসে পড়ে। সে রোদ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। পশ্চিমের আকাশ টুকাইয়ের গুলির আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে একসময় ফ্যাকাশে অন্ধকার নেমে আসে। বারান্দায় দাঁড়ালে যে বিশাল বকুল গাছটা দেখা যায়। তার ঝাঁকড়া মাথায় ফিরে আসে যত রাজ্যের পাখির দল। তাদের কিচিরমিচির ঘোষণা করে দিনশেষের বার্তা। দিনের উষ্ণ হাওয়া, তাপ হারিয়ে শীতল হতে থাকে। বিকেলের হাওয়া টুকাইয়ের বারান্দার পর্দায় বার বার ঠেলা দেয়। টুকাই সাড়া দেয় না। তাদের এই আবাসনের সবুজ মাঠে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়ায় ফড়িং। ঘাসের আড়ালে কেঁচোরা মাটির ভেতর থেকে গুটলি তুলে ভরিয়ে দেয় মাঠ। মাঠ ডাকে, সবুজ ঘাস ডাকে, ফড়িংয়ের ঝাঁক ডাকে, বিকেলের দমকা হাওয়া ডাকে, “টুকাই খেলতে আসবে না?” ঘরে ঘরে টুকাইরা ডুবে থাকে কম্পিউটারের সামনে। তাদের কানে সেই ডাক পৌঁছোয় না।
লেভেল ফোর থেকে লেভেল সিক্স পর্যন্ত যখন পৌঁছোল, টুকাইয়ের অবস্থা খুব একটা সুবিধের নয়। টুকাই মানে কিলারম্যান। তিনটের মধ্যে দুটো জীবন খতম হয়ে গেছে। বাকি যেটা চলছে তার তিরিশভাগ শেষ হয়ে সত্তরভাগ নিয়ে ধুঁকছে কিলারম্যান। লেভেল যতো বাড়ছে, অদ্ভুত জীবদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে, বাড়ছে তাদের গতি, বাড়ছে তাদের নানান ফিচলেমি। চারদিক থেকে তাদের আক্রমণে দিশাহারা হয়ে উঠছে কিলারম্যান। আঘাতে আঘাতে জেরবার হয়ে কমে আসছে জীবনীশক্তি। ওপর থেকে আগুনের গোলা ছুঁড়েছে রাক্ষসটা, সঙ্গে উৎকট হাসি। আগুন ধরে গেছে কিলারম্যানের জামায়। জল চাই জল, কিলারম্যান চিৎকার করছে, হন্যে হয়ে দৌড়চ্ছে কোথায় জল, কোথায় জল…
“চিৎকার করছে কে রে, বেনো”?
“রাক্ষসটা নয়তো, টুকাই দাদা?”
“ধ্যাৎ, কম্পিউটারে নয়, বাইরে কোথাও। গলাটা চেনা, চেনা, মঞ্জুমাসীর মতো।”
গেমসের জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসতে বেশ সময় লাগল দুজনের।
“মঞ্জুমাসীই তো, কি হয়েছে?”
দুজনে এবার খেলা ছেড়ে দৌড়ে গেল রান্নাঘরের দিকে, ওদিক থেকেই আসছে আওয়াজটা। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল, মঞ্জুমাসীর শাড়ির আঁচলে আগুন ধরে গেছে। রুটি সেঁকছিল, পাশে তাওয়ার ওপর ভাজা রুটি রয়েছে অনেকগুলো।
ঘরের ভেতর এভাবে আগুন জ্বলতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল টুকাই। গেমসের এমন অবস্থায় কি করতে হয় টুকাই জানে। বন্দুক দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলতে হয়, রাক্ষসটাকে, আর জলের মধ্যে ঝাঁপ দিতে হয় আগুন নেভানোর জন্যে। একদিকে তার হাতে বন্দুক নেই, অন্যদিকে রাক্ষসটা কে বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু মঞ্জুমাসীর আঁচলে আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে, সেটা বাড়ছে, ছড়িয়ে পড়ছে। আতংকে মঞ্জুমাসি চিৎকার করছে, ঘুরে ঘুরে যতো আঁচল টেনে সামলাতে যাচ্ছে, হাতে মুখে ছেঁকা লাগছে বার বার। অসহায় টুকাইও চিৎকার করে উঠল। হঠাৎ বেনো দৌড়ে গেল বাথরুমে। কল খুলে এক মগ জল ভরল আর একটা বালতি ভরতে দিয়ে এল। ভরা মগ জল নিয়ে সে ছুঁড়ে দিল মঞ্জুমাসীর শাড়িতে। আগুন নিভল না ঠিকই, কিন্তু স্তিমিত হয়ে এল অনেকটা। এবার ভরে ওঠা আধবালতি জল রান্না ঘরে নিয়ে এল, মগে করে মঞ্জুমাসীর পুরো শাড়িটাই ভিজিয়ে দিল। নিভে গেল আগুন। বেনোকে কোলে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল মঞ্জুমাসী।
তাদের চিৎকারে আশেপাশের লোকেরা এসে দরজায় বেল দিচ্ছিল, ধাক্কা দিচ্ছিল। টুকাই গিয়ে দরজা খুলে দিতে সকলে হুড়মুড় করে ঢুকে জিগ্যেস করল, “কী হয়েছে রে, টুকাই, কী হয়েছে?”
“মঞ্জুমাসীর গায়ে আগুন লেগেছিল।”
“সে কী রে, কি করে? কোথায়?”
“এখন নিভে গেছে। বেনো আগুন নিভিয়ে দিয়েছে।”
রান্নাঘর থেকে ভেজা শাড়িতে মঞ্জুমাসী বেরিয়ে এল। এত লোকের সামনে খুব লজ্জা পেয়ে গেল। বলল, “রুটি সেঁকছিলাম, কি করে যে আঁচলটা ধরে গেল। খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। বেনো এসে আমাকে বাঁচিয়ে দিল।”
“যাক বড়ো কিছু হয় নি, ঠাকুরের আশীর্বাদে। যাও মা, যাও, ভেজা কাপড় চোপড় পালটে এসো।” বললেন পাশের ফ্ল্যাটের ঠাকুমা।
আধ ঘন্টার মধ্যে এলেন টুকাইয়ের মা, তার কিছুক্ষণ পরে এলেন বাবা। মা বাবা আসার পরেও অনেকক্ষণ অনেক কথাবার্তা হল। সকলেই বেনোর উপস্থিত বুদ্ধির খুব আলোচনা করল, প্রশংসা করল। তারপর অন্য ফ্ল্যাটের লোকেরা চলে গেল একে একে। এতক্ষণ বেনো বসার ঘরের মেঝেয় সোফার আড়ালে এক কোণায় বসেছিল। তার মুখে চোখে এখনো আতংক। তাকে নিয়েই নানান লোকের নানান কথা শুনে সে আরো গুটিয়ে যাচ্ছিল।
গত একবছরে বেনোর জীবনটাই বদলে গেছে। গ্রামের সহপাঠীদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়া। মাঠে মাঠে খেলে বেড়ানো, দৌড়ে বেড়ানো, পাড়ার যে কোন হুজুগে ছুট্টে গিয়ে হাজির হওয়া সব বন্ধ। ছিল খোলা আকাশ, সূর্যের আলোয় মাখা স্বাভাবিক জীবন। আর এই সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল তার মায়ের স্নেহের শাসন। সময় মতো খাওয়ার ডাক। ঠিকঠাক জামা প্যাণ্টের হদিশ। মা ছিল প্রখর দুপুরের ছায়া হয়ে, বর্ষার আশ্রয় হয়ে, শীতের উষ্ণতা হয়ে। তার মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে সব। মা-মরা ছন্নছাড়া জীবনের সঙ্গে প্রত্যেকদিন বেড়েছে বাবার অবহেলা, আর সামান্য দোষ ত্রুটিতে প্রচণ্ড মার। স্নেহ ভালোবাসার বালাই এতটুকু ছিল না, বাবার বিরক্তি আর ঘৃণা তাকে কুঁকড়ে দিয়েছে রোজ, বাবাকে ভয় পেতে পেতে সে প্রায় বোবা হয়ে উঠেছে দিন-কে-দিন।
মাসদুয়েক আগে দিদিমা যখন তাকে এই কলকাতা শহরে ফ্ল্যাটের বদ্ধ জীবনের মধ্যে এনে ফেলল, সে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টাটাই হারিয়ে ফেলল। এই পরিবারের আদবকায়দা, এই ফ্ল্যাটের আসবাবপত্র, তার প্রায় সমবয়সি টুকাইদাদা, তার স্কুল, তার কম্পিউটার, বই খাতা, টুকাইদাদার অফিসে যাওয়া মা, বাবা। মনে হয় যেন বহুদূরের, ভিন্ন গ্রহের এক জগৎ। যে জগৎটার মধ্যে তার প্রবেশ নিষেধ। তার প্রতি দিদিমার ভালোবাসা কিংবা মায়ার কোন কমতি নেই ঠিকই। কিন্তু এই পরিবারের মধ্যে তার দিদিমার জায়গাটাও যে বেশ নড়বড়ে, সেটা না বোঝার মতো বোকাও নয় বেনো। এ বাড়িতে টুকাইদাদাই যা একটু অন্যরকম, অতটা ভয় লাগে না, কিন্তু আর সকলকে তার খুব ভয়। সেই কারণে সকলের থেকে নিজেকে আড়াল করতে করতে সে এখন ঘরের অন্ধকার কোণেই স্বস্তি পায়। এতক্ষণ তাকে নিয়ে সকলের আলোচনায় তার কী করা উচিৎ বুঝতে না পেরে, সে আরো আড়ালে সরে থাকার কথা ভাবছিল।
বাইরের সবাই চলে যাবার পর টুকাইয়ের মা ও বাবা সোফায় বসে চা খাচ্ছিলেন, টুকাইয়ের মা হঠাৎ জিগ্যেস করলেন, “বেনো কোথায়, মঞ্জু? ওকে দেখছি না?”
“ঐ তো, সোফার পেছনে বসে আছে,” মঞ্জুমাসী বলল। মা ঘাড় ঘুরিয়ে ডাকলেন, “ওখানে কেন? অ্যাই বেনো, বেরিয়ে আয় সামনে।”
বেনো মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে সামনে এসে উল্টোদিকের সোফার পিঠ ধরে দাঁড়াল। তার দিকে তাকিয়ে মা জিগ্যেস করলেন, “সময়মতো জল ঢালার ব্যাপারটা তোর মাথায় কীভাবে এলো রে, বেনো”?
বেনো ঠাণ্ডা মার্বেলের মেঝেয় পায়ের বুড়ো আঙুল ঘষছিল। মাথা নিচু করে রইল, কোন উত্তর দিল না। “তোর বয়েসে এমন মাথা ঠাণ্ডা কাজ, ভাবা যায় না, কী করে করলি? ভয় পাচ্ছিস কেন, বেনো, বল না”
“বল না, বেনো। কথার উত্তর দে,” মঞ্জুমাসী পাশে দাঁড়িয়ে বেনোর কাঁধে হাত রেখে বলল। একবার চোখ তুলে তাকিয়ে, আবার মাথা নিচু করে বেনো খুব আস্তে আস্তে বলল,“গাঁয়ে থাকতে মণ্ডলকাকার ঘরে আগুন লেগেছিল, সেখানে দেখেছিলাম। মণ্ডল কাকিমার কাপড়েও আগুন লেগে গিয়েছিল। সবাই বালতি করে জল ঢালতে, আগুন নিভে গিয়েছিল।”
“ভেরি গুড। একদম বাস্তব থেকে শেখা!” টুকাইয়ের বাবা বললেন। টুকাইয়ের মা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বেনোর দিকে, তারপর বললেন, “স্কুলে যাবি? লেখাপড়া করতে ইচ্ছে হয়”? মায়ের কথায় বেনো মুখ তুলে টুকাইয়ের মায়ের মুখের দিকে তাকালো। ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ। তার দুই চোখে চিকমিক করে উঠল আনন্দ।
“বেশ। কোন ক্লাসে পড়তিস তুই?”
“ফাইভে পড়ছিলাম।”
“ঠিক আছে, কালকে কথা বলে দেখি। এ বছরে হয়তো হবে না, পরের বছর ক্লাস শুরুর সময় তোকে ভর্তি করে দেবো। ততদিন টুকাইদাদার পুরোন বইগুলো নিয়ে বাড়িতেই লেখাপড়া চালু করে দে। ঠিক আছে?” টুকাইয়ের মা উঠে এসে বেনোর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “ভাগ্যে বেনো ছিল মঞ্জুদির কাছে, তা না হলে কী কাণ্ডটা যে হতো আজকে!”
বেনোর মুখে এখন লাজুক হাসি। বহুদিন পর বেনো হাসল। হাসতে পেরে তার ভীষণ ভালো লাগল। এই পরিবারের সকলকে, বিশেষ করে টুকাইদাদাকে আর টুকাইদাদার মাকেও সে খুব ভালোবেসে ফেলল।
ছবিঃ শ্রীময়
জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে