জাতক কথা আম্র জাতক নন্দিনী দাসচট্টোপাধ্যায় বসন্ত ২০১৮

সমস্ত জাতক কথা একত্রে

নন্দিনী দাস চট্টোপাধ্যায়

আম্র-জাতক

কিশোর ছেলেটির নিজের বলতে কেউ নেই। কী এক অসুখে বাড়ির সবাই মারা গেছে। তক্ষশিলায় আচার্যর কাছে সে লেখাপড়া শেখে। পড়াশোনা শেষে কী করবে ভাবতে ভাবতে তার মনে হল দেশভ্রমণে যাওয়ার কথা। যেমন ভাবা তেমন কাজ। যেদিন তার শিক্ষা শেষ হল আচার্যকে প্রণাম করে সে পথে নামল। কোন পিছুটান নেই।

ঘুরতে ঘুরতে সে এসে পড়ল বারানসীর এক প্রত্যন্ত গ্রামে। এখানে বেশিরভাগ লোকই চন্ডাল, সেকালে ব্রাহ্মণরা যাদের নীচু জাত বলত, সেই জাতের।

একদিন সে দেখে বাঁক ভর্তি  পাকা আম নিয়ে একজন চলেছে গ্রামের পথে। আম? এখন? এই অসময়ে? আর কী গন্ধ সে আমের, এত দূর থেকেও যেন ম -ম করছে! মানুষটির পিছু পিছু ব্রাহ্মণকুমার হাজির হলো বাজারে। এ গ্রামে নিশ্চয়ই অসময়ে আম ফলে।

কিন্তু না! বাজারে তো আর কারুর ঝুড়িতে আম নেই! ব্রাহ্মণকুমার একসের আম কিনেই ফেলল। ফলগুলো সত্যিই দেবভোগ্য। ব্রাহ্মণকুমার খেয়াল করল বাজারে সবাই আম -ওয়ালাকে সমীহ করে পন্ডিতমশাই বলছে। জানা গেল, উনি নাকি খুব জ্ঞানী মানুষ। আর এই আমও যে সে আম নয়, মন্ত্রপূত আম।

 ভারী মজার ব্যাপার তো! মন্ত্রটা শিখতেই হবে — এই না ভেবে ব্রাহ্মণকুমার একে তাকে জিজ্ঞেস করে শেষপর্যন্ত হাজির হলো পন্ডিতমশাইয়ের বাড়িতে।”পন্ডিতমশাই, আমি আপনার শিষ্য হতে চাই,” পন্ডিতমশাইকে প্রণাম করে ব্রাহ্মণকুমার।

“কিন্তু বাবা, তোমাকে তো আমি চিনিনা।”

“আমি অনেকদূর থেকে আসছি গুরুদেব। আমাকে নিরাশ করবেন না,” গভীর আকুতি ব্রাহ্মণকুমারের গলায়। 

“তোমাকে দেখে তো ব্রাহ্মণ বলে মনে হচ্ছে। আমি কিন্তু চন্ডাল।”

“গুরুদেব,আমি আপনাকে গুরুর পদে বসিয়েছি। গুরুর কি কোন জাতবিচার হয়? আমি ব্রাহ্মণ,  আপনি চন্ডাল নয়; আমার কাছে আপনি গুরু, আমাকে আপনার পায়ের তলায় স্থান দিন।”

ব্রাহ্মণকুমারের কাকুতি-মিনতিতে পন্ডিতমশায়ের মনটা বুঝি একটু নরম হল। ওঁর বাড়িতে থেকেই ব্রাহ্মণকুমারের পড়াশোনা চলতে লাগল। প্রাণপাত করে ব্রাহ্মণকুমার তার গুরু আর গুরুপত্নীর সেবা করে। বাড়ির সমস্ত কাজ সে স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। গুরুপত্নী তো বেজায় খুশি।

কিন্তু ছেলেটির কিছু জিনিস পন্ডিতমশায়ের নজরে এসেছে যেটা ওঁর ঠিক পছন্দ হয়নি। টোলে পন্ডিতমশাই যখন পড়ান, ও কিন্তু সবার সাথে একাসনে বসে না,  নিজের আসনটা আলাদা করে নেয়। রান্নাঘরে এখন ও-ই সব। সেটা কী গুরুভক্তি,  না ওঁদের হাতের জল খাবে না তাই? তাছাড়া পড়াশোনাতেও তত মন নেই। বরং উনি কোথাও গেলে ওঁর সঙ্গে তল্পিবাহক হয়ে যেতে বেশী আগ্রহী। আর জঙ্গলে আমের মন্ত্রটা পড়তে গেলে সেদিন ও যাবেই। পন্ডিতমশায়ের মাঝে মাঝে মনে হয় ওর অন্য কোন মতলব নেই তো?  স্ত্রীর কাছে শুনেছেন ও নাকি আমের মন্ত্রটার ব্যাপারে প্রায়শই খোঁজখবর নেয়। কী জানি ওটাই ওর উদ্দেশ্য কিনা? পন্ডিতমশায়ের খটকা লাগে।

দিন যায়। ব্রাহ্মণকুমার সুযোগ খোঁজে কখন গুরুদেবের কাছে মন্ত্রের কথাটা পাড়বে। কিন্তু সুযোগ আর আসে না। মাঝে মাঝে মনে হয় মন্ত্রের আশা বুঝি ছেড়েই দিতে হবে। কিন্তু এটাও ঠিক, মন্ত্রটা শিখে শহরে যেতে পারলে আর পায় কে?

এরমধ্যে একদিন গুরুপত্নীর বিশেষ একটা কাজ করে দেওয়ায় তিনি তাঁর স্বামীকে বলরেন,”ও বেচারা কতদূর থেকে এসেছে আপনার কাছে লেখাপড়া শিখতে। ব্রাহ্মণ হয়েও আমাদের  সেবা করে চলেছে চাকরের মতো। এতদিন তো উল্টোটাই দেখে এসেছি। ব্রাহ্মণরা তো আমাদের মানুষ বলেই মনে করেনা।”

“হুম্”–পন্ডিতমশাই নীরব।

“উনি বোধহয় আপনার ঐ আমের মন্ত্রটা পেতে চান। আমার অনুরোধ  মন্ত্রটা আপনি ওকে শিখিয়ে দিন।”

গিন্নির অনুরোধে কর্তা একটু ফাঁপরে পড়লেন। এ মন্ত্রকে কাজে লাগাতে হলে কথায় ও কাজে সৎ হতে হয়। এই শিষ্যটিকে এ ব্যাপারে ঠিক খাঁটি বলে মনে হয় না তাঁর । কী আর করা? গিন্নীর অনুরোধ! সে বেচারা মুখ ফুটে কিছু চায়না তাঁর কাছে। তিনি বললেন, “তোমার কথায় এ মন্ত্র আমি ওকে শেখাব,  তবে এ-ও জানি, ও সেটা রাখতে পারবেনা।”

অগত্যা তিনি ওকে ডাকলেন। বাজিয়ে দেখার জন্যে  বললেন, “তোমার গুরুমা তোমার কাজে অত্যন্ত তুষ্ট। তাঁর আনুরোধে আমি তোমাকে কিছু দিতে চাই। বলো তুমি কী নেবে?”

এই তো সুযোগ! তার এতদিনের কষ্টের ফল তবে ফললো শেষ পর্যন্ত! আর দেরি না করে সে বলেই ফেলল, “গুরুদেব,  আমের ঐ মন্ত্রটা যদি শিখিয়ে দেন—”

ব্রাহ্মণকুমারের হাত কচলানো দেখে মুচকি হাসলেন তিনি। তাঁর এবং গিন্নীর অনুমান তবে অভ্রান্ত!

ওকে নিয়ে চললেন বাইরে। যে কোন একটা আমগাছ পেলেই হবে। আমগাছের গোড়া থেকে ঠিক সাত পা দূরে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করলেন সেই মন্ত্র। সেই সঙ্গে জল ছিটিয়ে দিলেন গাছের গায়ে।  দেখতে দেখতে গাছের পুরোনো পাতার জায়গায় নতুন পাতা গজাল, গাছে মুকুল ধরল। খানিকক্ষণের মধ্যেই মুকুল থেকে তৈরি হল আমের কুশী। সেগুলো বড়ো হতে হতে রং ধরল,  গন্ধ ছড়ালো চারদিকে।

মন্ত্রটা একেবারে হাতে-কলমে শিখিয়ে সাবধান করে দিলেন, “দেখো বাপু,  তোমাকে কেউ কখনো যদি জিজ্ঞেস করে যে এ মন্ত্র কার কাছে শিখেছ, সত্যি কথা বলবে। গুরুকে অস্বীকার করলে সঙ্গে সঙ্গে এ মন্ত্র তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে।”

জিভ-টিব কেটে শিষ্য গুরুর পা ছুঁয়ে বলল, “ছি ছি গুরুদেব,  আমি কখনো আপনাকে অস্বীকার করতে পারি?”

যাই হোক উদ্দেশ্য সফল। পরদিন ভোর হতে না হতেই শিষ্য তল্পি-তল্পা গুটিয়ে তৈরি। এবার যেতে হবে বারানসী রাজ্যের রাজধানীতে।

*******

একদিন দুপুরে খাওয়ার সময় অসময়ের আম দেখে বারানসীর রাজামশাই তো অবাক। তারপর সে আমের যেমন গন্ধ, তেমন স্বাদ! একেবারে দেবভোগ্য আম বললেই হয়। এমনসময় কোথা থেকে এল এমন জিনিস? খোঁজ নিলেন তিনি। তাঁর আদেশে রাজকর্মচারি ছুটল সেই আম-ওয়ালার কাছে, নিয়ে এল তাকে রাজামশাইয়ের সামনে। এ আম-ওয়ালা আমাদের সেই ব্রাহ্মণকুমার।

“কোথায় পেলে এমন অসময়ের আম?”–রাজামশাই শুধোন তাকে।

“আজ্ঞে, আমি মন্ত্র জানি,  মন্ত্রের জোরে তৈরি করি এই আম।”

“বটে! আমাকে দেখাও দেখি তোমার কেরামতি।” 

রাজামশাইয়ের হুকুম বলে কথা!

রাজামশাই আর সভাসদদের নিয়ে সে এল বাগানে। একটা আমগাছ থেকে ঠিক সাত পা দূরে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পড়ে জল ছুঁড়ে দিল সেই গাছের গায়ে। দেখতে দেখতে গাছের পুরোনো পাতার জায়গায় নতুন পাতা গজাল, গাছে মুকুল ধরল। খানিকক্ষণের মধ্যেই মুকুল থেকে তৈরি হল আমের কুশী। সেগুলো বড়ো হতে হতে রং ধরল,  গন্ধ ছড়াল চারদিকে। ব্রাহ্মণকুমার সেই আম পেড়ে নিয়ে রাজামশাইকে দিল। রাজামশাই ভারী খুশি।

ব্রাহ্মণকুমার এখন রাজপুরীতেই থাকে। জীবনটাই এখন অন্যরকম এই এক মন্ত্রের জোরে। রাজামশাইয়ের একেবারে ঘনিষ্ঠ বৃত্তের একজন সে। মাঝে মাঝে রাজামশাই আর তাঁর নিকটজনদের এই আমের ভেল্কী দেখাতে হয় তাকে। একদিন তার ডাক পড়েছে রাজ-বাগানে,  রাজামশাইয়ের কয়েকজন অতিথির সামনে তার ভেল্কী দেখাতে হবে। এমন সময় রাজামশাই জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এই আশ্চর্য মন্ত্র শিখলে কোথায?এমন মন্ত্রের জোর সত্যিই কোনদিন দেখিনি।”

“এই রে!” ব্রাহ্মণ কুমার প্রমাদ গুনল, এখন সবার সামনে যদি বলি যে চন্ডালের কাছে এই মন্ত্র শিখেছি, ব্রাহ্মণ হয়েও তার পদসেবা করেছি এই মন্ত্রের লোভে তবে তো আমার সমস্ত সম্মান ধুলোয় মিশবে!

মনে মনে এই না ভেবে সে ঠিক করল মিথ্যে কথাই বলবে। সে ভাবল, “চন্ডাল গুরু যদিও বলেছিল সত্যি কথা বলতে, কিন্তু সে তো নেহাৎ নিজের নাম জাহির করতে। মন্ত্র যে ভাবে আত্মস্থ হয়েছে  সে আর ভোলার ভয় নেই।”

তাই সে বলল, “এ মন্ত্র তক্ষশীলার এক বিখ্যাত আচার্যের কাছে শেখা।”

“বা:! এবার এঁদের দেখিয়ে দাও তোমার মন্ত্রের গুণ।”

রাজামশাইয়ের আদেশে কমন্ডলুতে জল নিয়ে আমগাছের গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল সে। কিন্তু কী মুশকিল! মন্ত্রের কথাগুলো কেমন কিলবিল করে পাকিয়ে যাচ্ছে! কিছুতেই মনে পড়ছে না। যাহোক তাহোক মন্ত্র পড়ে বারকয়েক জল ছিটিয়েও যখন কিছুই হল না তখন মনে মনে কু-বুদ্ধি এঁটে রাজামশাইকে বলল, “মহারাজ,  আজকের নক্ষত্রযোগে আমার মন্ত্র কাজ করবে না। আমার আগেই আঁক কষে আসা উচিৎ ছিল। আমাকে ক্ষমা করুন।”

রাজামশাই খুব রেগে গেলেন। এই ভাবে অতিথিদের সামনে তাঁকে অপদস্থ করল এই হতভাগা!

সন্ধ্যেবেলায রাজার খাস কক্ষে ডাক পড়ল ব্রাহ্মনকুমারের।

“কী ব্যাপার? আজ পর্যন্ত  কোনদিন তিথি -নক্ষত্রের কথা তো শুনিনি তোমার মুখে?”

ব্রাহ্মণকুমারের ভয় হল। রাজামশাইয়ের তীব্র দৃষ্টি যেন তার ভিতর পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে।

“সত্যি কথাটা বলো।” জমাট বাঁধা বরফের মধ্যে থেকে যেন প্রশ্নটা ছুটে এল।

শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণকুমার স্বীকার করল। বলা ভাল রাজামশাইয়ের চোখই যেন টেনে বার করল আসল কথাটা।

“তুমি গুরুকে অস্বীকার করেছ? ধিক্ কুলাঙ্গার, এ পুরীতে তোমার আর স্থান নেই।”

রাজামশাই তাকে তাড়িয়ে দিলেন ।

“ক্ষমা করুন মহারাজ!”

তার কাতর আর্জিতেও মহারাজের মন গলল না। শেষে তিনি বললেন, ”তুমি আগে তোমার গুরুর কাছে ক্ষমা চাও। তিনি ক্ষমা করলে তবে আমার কাছে আসবে।”

সব হারিয়ে ব্রাহ্মণ আবার চলল সেই চন্ডালগ্রামের উদ্দেশে। কিন্তু সেখানেো তাকে হতাশ হতে হল।

“তুমি মন থেকে আমাকে গুরুর আসনে বসাওনি। শুধুমাত্র স্বার্থের প্রয়োজনে ভান করেছিলে। আমার কাছে অসৎ লোকের কোন জায়গা নেই। তোমাকে অসৎ বুঝেও একবার সুযোগ দিয়েছি, কিন্তু আর নয়। অসৎ মানুষকে কখনোই ক্ষমা করতে নেই।”

গুরুদেবের দরজাও তার কাছে বন্ধ হয়ে গেল। আর কী করা? সব জায়গা থেকে বিতাড়িত হয়ে সে আবার পথে বেরোল। আবার নতুন করে ভাগ্যের পিছনে ঘুরতে হবে তাকে।

******

বুদ্ধদেব এই গল্প বলে তাঁর শিষ্যদের বললেন,  “সে জন্মে আমি ছিলাম সেই চন্ডাল পন্ডিত। মনে রাখবে যাঁর কাছ থেকে কিছু শিখবে তিনিই তোমার গুরু। গুরুকে অস্বীকার করলে কখনোই সে শিক্ষা সফল হয় না।”

ছবিঃ তিতিল

 

 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s