ইয়েডর ওটোকোডেটের গল্প
পঞ্চম পর্ব
যাত্রা শুরুর আগে, সানজা কী মনে করে ভাবল যে একবার ভ্রাতৃপ্রতিম সেনানায়ক তাকাগি উমানোজোর সাথে দেখা করে নিলে হয় সেই সঙ্গে এটাও তার সাথে আলোচনা করে নেওয়া যায় যে কার্যসিদ্ধির জন্য কোন পথে গেলে ভালো হয়। উমানোজো ছিলেন আবার উদ্ধত স্বভাবের লোক। সানজাকে তিনি বেশ নির্দয়ভাবেই জানালেন, “বানজায়েমন তো চোরের অধম বটেই। কিন্তু তোমার অযত্ন আর অসতর্কতাতেই তো তলোয়ারটা খোয়া গেল। আমার কাছে সাহায্য চাওয়া অর্থহীন। তুমি যেভাবে ভালো বোঝো সেভাবে তোমাকেই ফিরিয়ে আনতে হবে তলোয়ারটা।”
“আহ্,” উত্তরে বললেন সানজা, “বুঝতে পারছি বেশ যে তলোয়ারের রকমফের নিয়ে বিচারে তোমাকে হারিয়ে দিয়েছিলাম বলে এখনও তুমি মনে মনে রাগ পুষে রেখেছ। তুমি নিজেও বানজায়েমনের চেয়ে কোনো অংশে কম যাও না দেখছি।”
সানজার মনে নিজের পরিচিত লোকেদের সম্বন্ধে শুধু তিক্ততা ছেয়ে গেল। সে ঘর ছেড়ে বেরোলোই প্রথমে উমানোজোকে হত্যা করে তারপর বানজায়েমনের হদিশ করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। তাই সে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করতে লাগল এক পান্থশালায় আস্তানা গেড়ে।
উমানোজোর ছিল মাছ ধরার শখ। একদিন তিনি তাঁর ষোলো বছরের ছেলে উমানোসুকে-কে নিয়ে গেলেন সমুদ্র সৈকতে, মাছ ধরার জন্য। যখন পিতাপুত্র দুজন মহানন্দে মাছ ধরছেন তখন হঠাৎই তাঁদের নজরে এলো যে এক সামুরাই বুঝি তাঁদের দিকে ধেয়ে আসছে। সামুরাই কাছে এসে পৌঁছোতে দেখা গেল যে সামুরাই আর কেউ নন, সানজা। উমানোজো ভাবলেন যে সানজা বুঝি কোনো জরুরি বিষয়ে আলোচনা করতে এসেছেন। তাই তিনি তাঁর ছিপ ফেলে সানজার সাথে মুখোমুখি দেখা করতে এগিয়ে গেলেন। তখন সানজা চীৎকার করে উঠলেন, “ উমানোজো মশায়, দাঁড়াও, নিজেকে রক্ষা করো এইবারে। তুমি কিনা গিয়েছিলে বানজায়েমনের পক্ষ নিয়ে আমার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে! তুমি তোমার জুড়ির থেকে অনেক কদম এগিয়ে গেছ, কিন্তু তবুও তুমিই এখন এখানে উপস্থিত। আর তাই তুমিই জবাবদিহি করবে তোমার কৃতকর্মের। কোনো লাভ নেই এখন নির্দোষ সেজে। বাঁচাও নিজেকে, কাপুরুষ, বিশ্বাসঘাতক।” আর ঝলমলিয়ে উঠল সানজার খোলা তলোয়ার।
“না গো, সানজা মশাই।” নরম সুরে উত্তর দিলেন উমানোজো যাতে সানজার রাগ কিছু পড়ে যদিও তাঁর নিজের মনে প্রচুর উদ্বেগ জমেছিল, “আমি সত্যিই নির্দোষ এ ব্যাপারে, দয়া করে আপনার শৌর্য এই তুচ্ছ কারণে ক্ষয় করবেন না।”
“চতুর, মিথ্যেবাদী”, চেঁচিয়ে উঠল সানজা, “মোটেও ভেবো না যে তুমি আমাকে কথায় বশ করতে পারবে। আমি জানি তোমার মন কতটা নীচ।” আর তারপর ছুটে গিয়ে উমানোজোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কপালে এক কোপ বসিয়ে দিল সানজা। তাতে উমানোজো বালির ওপর পড়ে গিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল।
উমানোসুকে একটু দূরে মাছ ধরছিলেন। বাবাকে এরকমভাবে আক্রান্ত হতে দেখে ছুটে তাঁর কাছে পৌঁছোনোর চেষ্টা করলেন। আর একটা পাথর কুড়িয়ে ছুঁড়ে মারলেন সানজাকে এই আশায় যাতে সানজার মন অন্যদিকে যায়। কিন্তু তিনি এসে পৌঁছোনোর আগেই সানজা মারণ কোপ দিয়ে দিয়েছেন উমানোজোর শরীরে। ফলে উমানোসুকে যখন পৌঁছোলেন তখন উমানোজোর দেহ সম্পূর্ণ নিষ্প্রাণ।
“থামুন, সানজা মশায়” চীৎকার করে বললেন উমানোসুকে। তলোয়ার উঁচিয়ে বললেন তারপর, “আমার সঙ্গে লড়তে হবে আপনাকে, আমি আমার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেব।”
“তুমি নিশ্চয়ই তোমার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে,” উত্তর দিলেন সানজা, “তাই যথাযথ কর্তব্য। কিন্তু যদিও আমি এইমাত্র তোমার বাবার সাথে ঝগড়া করে তাকে মেরে ফেলেছি, এবং একজন সামুরাইয়ের উপযুক্ত কর্তব্য হিসেবে আমিও খুশি মনেই তোমার হাতে প্রাণ দিতে রাজি; কিন্তু আমার জীবন অন্য একটা কারণে আমার কাছে মূল্যবান। তা হলো এই যে আমি হয়তো বানজায়েমনকে পাকড়াও করে তলোয়ার চুরির শোধ নিতে পারি। যখন আমি আমার প্রভুকে তাঁর তলোয়ারটা ফেরত দেব তখন আমি নিজেকে তোমার সামনে উপস্থিত করতে পারি তোমার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এবং তুমি তখন আমাকে হত্যা করতে পার। এক যোদ্ধার সত্যনিষ্ঠ উচ্চারণ এ। তবে প্রতিশ্রুতি আর শপথ যে আমি রাখব তার নজির হিসেবে আমি আমার স্ত্রী-পুত্রকে তোমার অধীনস্থ করে রেখে যাব। প্রার্থনা করি তোমার প্রতিশোধোৎসুক হাত তুমি সংযত রাখো যতদিন না আমি আমার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে পারি।”
নিজের গোষ্ঠীতে অস্ত্রকুশলতার সিদ্ধিতে আর হৃদয়বত্তার শ্রেষ্ঠত্বে খ্যাত, সৎ ও নির্ভীক যুবা উমানোসুকে, সানজার বিনীত প্রার্থনা শুনে বলল, “ঠিক আছে, আমি আপনার ফেরার অপেক্ষা করব আর আপনার স্ত্রী-পুত্রকে প্রতিশ্রুতির পণ হিসেবে বন্দী করে রাখব।”
“আমার বিনীত ধন্যবাদ জানবে”, বললেন সানজা, “আমি যখন বানজায়েমনকে শাস্তি দিয়ে ফিরে আসব তখন নিজেকে হাজির করব তোমার কাছে তোমার প্রতিশোধের স্বার্থে।”
তখন সানজা চললেন ইয়েডোতে বানজায়েমনের খোঁজে। আর উমানোসুকে তাঁর পিতার কবরে শোক যাপন করতে লাগলেন।
এদিকে ইয়েডো পৌঁছে বানজায়েমন ভয়ানক নির্বান্ধব বোধ করছিলেন। তাঁর রুজি-রোজগারেরও কোনো উপায় ছিল না। যখন তিনি ওটোকাডেটের নেতা ব্যান্ডজুইনের চোবেই-এর নামডাক শুনলেন তখন তিনি তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। তারপর চোবেই-এর দলে ভিড়ে তলোয়ার চালানো শিখিয়ে নিজের দিন গুজরান করতে লাগলেন। কাজটা করতে করতে কেটেও গিয়েছিল বেশ কিছুদিন। কাজটাতে তাঁর কিছু নামডাকও হয়েছিল যখন তখন সানজা পৌঁছোলেন সেখানে আর খুঁজতে শুরু করলেন বানজায়েমনকে। কিন্তু দিন, মাস কেটে ক্রমে বছরও ঘুরে গেল নিষ্ফল খোঁজে। এদিকে তাঁর সমস্ত পয়সা-কড়িও গেল ফুরিয়ে। কিন্তু শত্রুর চালচলনের খবর কেন, শত্রুকে যে কিভাবে খুঁজে পাবে সে সম্বন্ধে সানজা বিন্দুমাত্র হদিশ করে উঠতে পারলেন না। অবশেষে চাতুরীর আশ্রয়ে তিনি ভবিষ্যদ্বক্তার বৃত্তি নিয়ে কাটাতে লাগলেন। এভাবে তাঁর পক্ষে তাঁর দিনের খোরাকটুকু জোটানোও দুরূহ ছিল। এত যন্ত্রণা সওয়ার পরেও তাঁর প্রতিশোধের সম্ভাবনা যেন চিরতরে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় একদিন তিনি মনে মনে ঠিক করলেন যে ইয়োশিওয়ারা যেহেতু শহরের সবচেয়ে জমজমাট এলাকা সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করলে একদিন না একদিন তিনি বানজায়েমনকে নিশ্চয়ই ধরতে পারবেন। তারপর তিনি বাঁশের চাটাইতে বোনা একটা টুপি কিনলেন যাতে তাঁর মুখটা পুরো ঢাকা পড়ে যায় আর তারপর গিয়ে থাকতে শুরু করলেন ইয়োশিওয়ারার রাস্তার ধারে।
একদিন বানজায়েমন আর চোবেই-এর দুই শাগরেদ, টোকেন গোম্বেই আর শিরোবেই, যাঁর অপ্রতিরোধ্য স্বভাবের জন্য যাঁকে “ছোট্টো ঘোড়া” বলে ডাকা হতো, ফুর্তি করছিলেন আর পান করছিলেন ইয়োশিওয়ারার এক চা-ঘরের ওপরের তলাতে। হঠাৎই নিচের রাস্তার দিকে চোখ পড়াতে টোকেন গোম্বেই দেখতে পেলেন যে এক সামুরাই হেঁটে গেলেন। যদিও তাঁর পরনে পুরোনো ছেঁড়া জামা তবুও তাঁর দারিদ্র্য ক্লিষ্ট চেহারার সাথে তাঁর অহঙ্কারদৃপ্ত ভঙ্গিটা মোটেই খাপ খাচ্ছিল না, তাঁকে সামুরাই বলে বেশ চেনা যাচ্ছিল।
“এই দেখো” বলে বাকিদের নজর সেদিকে ফেরাতে চাইল টোকেন গোম্বেই, “ঐ সামুরাইকে দেখো, জামাটা ওঁর যতই নোংরা, ছেঁড়া-ফাটা হোক না কেন চেহারার আভিজাত্যটা কিন্তু বেশ স্পষ্ট। আমাদের সেপাইদের যতই ভালো কাপড় পরানো হোক না কেন আমাদের কিছুতেই ওঁর মতো সুপুরুষ দেখাবে না।”
“বটে” বলল শিরোবেই, “আমার খুব ইচ্ছে করছে ওঁকে এখানে ডেকে এনে আমাদের মধ্যে বসিয়ে একপাত্র সুরা খেতে ওঁর সঙ্গে। আবার আমাদের মতো সেপাই-সান্ত্রীদের মানায়ও না ওঁর মতো লোককে ডাকতে যাওয়াটা।”
“আমরা সহজেই সে বাধা পেরোতে পারি।” বললেন বানজায়েমন, “যেহেতু আমি নিজেও একজন সামুরাই, আমার ওঁর কাছে গিয়ে একটু সদালাপে কিংবা ওঁকে এখানে ডেকে আনার মধ্যে অশোভন কিছুই নেই।”
অন্য দুজনে রাজি হতে বানজায়েমন ছুটে নিচে গেলেন আর অপরিচিত সামুরাইকে অভিবাদন করে বললেন, “আমি আপনার কাছে একটু ধৈর্য প্রার্থনা করি, সামুরাই মশাই। আমি আপনার সেবার্থী ফুওয়া বানজায়েমন। আমি একজন রনিন, আপনাকে দেখে বোধ হচ্ছে যে আপনিও তাই। আশা করি, আপনাকে বন্ধুত্বের সম্মান দিতে চাইলে আপনি আমাকে উদ্ধত ভাববেন না এবং যদি আপনাকে নিমন্ত্রণ করি এই চা-ঘরের ওপরে বসে আমার অন্য দুই বন্ধুর সঙ্গে এক পাত্র সুরা পান করতে।”
অপরিচিত সামুরাই সানজা বই আর কেউ নয়। সেই সামুরাই তাঁর বাঁশের টুপির ঘন বুনোটের মধ্য দিয়ে তাকিয়ে চিনতে ভুল করলেন না তাঁর শত্রুকে। আর চমকে দিয়ে তাঁর মুখের আবরণটা টান মেরে খুলে দিয়ে বললেন, “আরে বানজায়েমন, আমাকে কেমন দেখতে ভুলে গেছ তুমি?”
চলবে