গল্প জুজু যূথিকা আচার্য্য বর্ষা ২০২০

জুজু

যূথিকা আচার্য্য

“নাআআআআ… আমি আর ভাত খাব না। মাগুর মাছ খেতে পচা।”

বাসন্তীমাসি আদর করে বলল আবার, “খেয়ে নাও দিদিভাই, মাগুর মাছ খেলে গায়ে রক্ত হবে, মাথায় বুদ্ধি হবে। দুষ্টুমি করে না দিদি। আর দুটো গরাস শুধু। এই নাও এটা কাকের ডিম, আর এটা হাতির ডিম, কোনটা দিয়ে মাছ খাবে তুমি বলো।”

চার বছরের নোয়েল চোখদুটো সরু করে, পুঁচকে ঠোঁটদুটো টিপে প্লেটের উপর রাখা ভাতের দলা দুটোকে দেখল। তারপর আবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার, “আমি পিকাচুর ডিম খাব…”

বাসন্তীমাসি করুণ চোখে এদিক ওদিক দেখতে শুরু করল এবার। শেষপর্যন্ত নোয়েলের বাবাই রণজয়কে দেখে যেন বেচারা আকাশের চাঁদ হাতে পেল, “ও দাদাবাবু, পিকাসু আবার কী জিনিস গো?”

রণজয় হাসতে হাসতে বলল, “পিকাসু নয় গো দিদি, পিকাচু, জাপানের একটা কার্টুন চরিত্র।”

“অ। আমি ভাবলাম কী না কী। তাই কন। কার্টুন মানে হইল গিয়া ওই যে কী যেন বলে টমেন জেলি, সেই জিনিসই তো?”

“টম অ্যান্ড জেরি। হ্যাঁ দিদি, ওরকমই গো।”

বাসন্তীদিদি ভাতের দলাটাকে একটু চ্যাপ্টা মতন করে বলল, “এই নাও দিদিভাই, পিকাসুর ডিম।”

এবার নতুন বায়না, “পিকাচুর ডিমে পালং শাক লেগে আছে কেন?”

নোয়েলের মা অনিন্দিতার আজ ফিরতে দেরি হবে। অফিসে পরপর অনেকগুলো মিটিং আছে। তাই রণজয় আজ একটু তাড়াতাড়িই চলে এসেছে অফিস থেকে। ঘরে ঢুকেই দেখে এই অবস্থা। বাসন্তীদিদি প্রত্যেকদিন সাড়ে ছ’টার মধ্যে নোয়েলকে ডিনার করিয়ে দেয়, নইলে আটটার মধ্যে ঘুম পাড়ানো যাবে না কিছুতেই।

রণজয়ের হাসি পাচ্ছিল। ওদিকে বাসন্তীদিদির অবস্থা কাহিল। বেচারা দিদি কত সামলাবে?

নোয়েলের এমন উলটোপালটা জেদ হচ্ছে আজকাল, এই তো কয়েকদিন আগে সকালবেলা উঠে কান্না জুড়ল, আকাশের রঙ নীল কেন, পিঙ্ক হল না কেন। আরেকদিন দুপুরে নাকি একটা ইউনিকর্ন এসে নোয়েলের সব অরিও বিস্কুটগুলো খেয়ে নিচ্ছিল, সেই নিয়ে সারা বিকেল মুখভার করে রইল। অনেকবার বোঝানোর পর তবে গিয়ে নোয়েলের বিশ্বাস হল যে সে স্বপ্ন দেখেছিল। পূর্ণিমার চাঁদ রাউন্ড কেন, রেক্ট্যাঙ্গল কেন নয়? বেড়ালের মাথায় শিং নেই কেন? ওয়াটারমেলন বাইরে সবুজ, ভেতরে লাল কেন? নিত্যনতুন সমস্যার অন্ত নেই।

শেষের ভাতটুকু কিছুতেই খাওয়ানো যাচ্ছে না দেখে রণজয় ভাবছিল সে গিয়ে হেল্প করবে কি না। কিন্তু  তার যাওয়ার আগেই যুদ্ধজয় করে ফেলল বাসন্তীদিদি। ঠেলায় পড়ে মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করতে হল যদিও, “খেয়ে নাও দিদিভাই, নইলে কিন্তু জুজু এসে ধরে নিয়ে যাবে!”

জুজুর নাম শুনতেই নোয়েলের মুখখানা এতটুকুন হয়ে গেল। কান্নাকাটি ভুলে দিব্যি টুকটুক করে ভাত মুখ নিয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতো চিবুতে শুরু করল সে। ‘পিকাচুর ডিম’ দুটো শেষ করার পর নোয়েল একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, “বাসন্তীমাসি, জুজু দেখতে কেমন গো?”

“সে ভারি ভয়ানক জিনিস গো দিদিভাই। তার কালো হাঁড়ির মতো মুখ, লাল ভাঁটার মতো চোখ, কুলার মতো কান, মুলার মতো দাঁত… ছোটো ছোটো বাচ্চারা যখন ভাত খায় না, দুষ্টুমি করে, জুজু তখন আসে, এসে বলে, হাঁউ মাঁউ খাঁউ!”

মনে মনে জুজুর কথা চিন্তা করে ভয়ে আঁতকে ওঠে ছোট্ট নোয়েল। রণজয় এসে উদ্ধার করল মেয়েকে। কোলে করে নিয়ে মুখ ধুইয়ে দিতেই শক্ত করে আঁকড়ে ধরে নোয়েল তার বাবাইকে।

বাসন্তীদিদির কাজ আজকের মতো শেষ। মেঝেতে পড়ে থাকা দু-তিনটে ভাতের দানা কুড়িয়ে নিয়ে, বহু যত্নে ডাইনিং টেবিল আর মেঝেটা মুছতে মুছতে সে বলল, “দাদাবাবু, এবার আসছি তাহলে। কালকে সকালে ঠিক সময়ে চলে আসব।”

রণজয় হেসে বলল, “সাবধানে যেও, বাসন্তীদি।”

বিপদ হল রোববার বিকেলবেলা। রণজয়, অনিন্দিতা দু’জনেরই ছুটি সেদিন, তার উপরে আবার দাদান (নোয়েলের দাদু) এসেছে তাদের বাড়ি। কাজেই নোয়েলের আজ ভীষণ মজা। সকাল থেকেই সে কাঠবেড়ালির মতো ল্যাজ তুলে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। বিকেলবেলা দাদান, মা, বাবাই আর নোয়েল চারজনে মিলে ঠিক হল ট্রেজার হান্ট খেলা হবে। খেলার নিয়ম সোজা। দাদান ঘরের বিভিন্ন জিনিসের নাম চিরকুটে লিখে একটা বাটিতে রাখবে। তারপর প্রত্যেককে সেই বাটি থেকে সমান সংখ্যায় চিরকুট তুলতে হবে। তারপর দাদানের কাছে নিজের ভাগের সবক’টা জিনিসের নাম লিখে জমা দিতে হবে আগে। এরপর সময় দশ মিনিট, ওর মধ্যে নিজের জিনিসগুলো খুঁজে এনে দাদানের কাছে জমা দিতে হবে। যে যত তাড়াতাড়ি সবক’টা জিনিস এনে দিতে পারবে সে তত বেশি মার্কস পাবে। প্রথম পুরস্কার এক প্যাকেট সন্দেশ, দ্বিতীয় পুরস্কার একখানা ডেয়ারি মিল্ক চকোলেট আর তৃতীয় পুরস্কার এক প্যাকেট অরিও বিস্কুট। দাদান হুইসল বাজাতেই খেলা শুরু হল।

নোয়েলের ভাগে পড়েছিল,
১) স্কুলের মোজা
২) ক্যালকুলেটর
৩) চামচ
৪) পেনসিল শার্পনার
৫) টেনিস র‌্যাকেট

প্রথম চারটে জিনিস খুব তাড়াতাড়ি জোগাড় হয়ে গেল, কিন্তু র‌্যাকেটখানা যে কোথায় আছে সেটা আর কিছুতেই মনে পড়ছে না। শেষটায় মনে পড়ল, আজকে সকালেই মা আর বাবাই টেনিস খেলছিল। র‌্যাকেটগুলো তারপরে মা সিঁড়ির নিচে কালো সিন্দুকটায় রেখেছে।

এক দৌড়ে নোয়েল পৌঁছে গেল সিঁড়ির নিচে। হাতের জিনিসপত্রগুলো নিচে রেখে যেই না সিন্দুকখানা খুলেছে, কালো সিন্দুকের ভেতরে দপ করে জ্বলে উঠল একজোড়া চোখ। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল নোয়েল, “মাআআআআআ…”

মা, বাবাই, দাদান সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। নোয়েল কিছু দেখে ভয় পেয়েছে। কিন্তু কী যে দেখেছে সেটাই কেউ বুঝতে পারছে না। অনেকবার জিজ্ঞাসা করার পর ভয়ে ভয়ে বলল, “জুজু!” তারপরই আবার কান্না। সন্ধে নাগাদ কাঁদতে কাঁদতে প্রায় জ্বর এসে গেল নোয়েলের। মা, বাবাই, দাদান সবাই চিন্তায় পড়ে গেল, কী যে হল মেয়েটার! এত ভয় পেল কেন?

দাদান বলল, “অনি একটা কাজ কর তো, নোয়েলের হান্টিং লিস্টটা একবার নিয়ে আয়। বসার ঘরে টেবিলের উপর রাখা আছে।”

হান্টিং লিস্ট থেকে দেখা গেল প্রথম চারটে জিনিস নোয়েল খুঁজে নিয়েছিল আগেই। শুধু বাকি ছিল টেনিস র‌্যাকেটখানা। লিস্টে চোখ বুলিয়ে বাবাই মাকে বলল, “সকালে টেনিস খেলার পর র‌্যাকেটগুলো কোথায় রেখেছিলে অনি, মনে আছে?”

অনিন্দিতা একটু ভেবে বলল, “হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন, সিঁড়ির নিচে, রাজস্থান থেকে আনা কালো সিন্দুকটায়। কেন বলো তো?”

রণজয় বলল, “চলো তো গিয়ে ওখানেই দেখি আগে।”

মা আর বাবাই দু’জনেই হাতে একটা টর্চ লাইট নিয়ে এগিয়ে গেল। দাদান এল ওদের পেছনে, নোয়েলকে কোলে নিয়ে। মা সিন্দুকটা খুলল। ভেতরের রঙ এমনিতেই মিশকালো, তার ওপরে খুপরিগুলোও অনেকটা গভীর। “রণ, টর্চটা দাও তো, কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।”

টর্চের আলোটা সিন্দুকের দিকে ঘোরানোর আগেই জ্বলে উঠল আবার চোখজোড়া। তার সঙ্গে ভিতু ভিতু একটু শব্দ, ‘কেঁউ, কেঁউ…’

টর্চের আলোটা ফেলতেই ভেতরে দেখা গেল তাকে। ও মা, কোথায় জুজু, কোথায় কী! কী মিষ্টি, কী মিষ্টি! এ তো ছোট্ট এক কুকুরছানা। কুচকুচে কালো গায়ের রঙ তাই মিশে গিয়েছিল সিন্দুকের রঙের সঙ্গে। বেচারা ভয় পেয়ে গুটিয়ে-মুটিয়ে ছোট্ট হয়ে এককোণে বসে আছে। কখন সদর দরজা খোলা পেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে বোধহয়।

সবাই হো হো করে হেসে উঠল। মা খুব যত্ন করে ছানাটাকে সিন্দুক থেকে বের করে নোয়েলকে ডাকল, “এই যে তোর জুজু। নোয়েল একবার তাকিয়ে দেখ!”

নোয়েল দাদুর কোল থেকেই মাথা ঘুরিয়ে ভয়ে ভয়ে দেখল একবার। কুকুরছানাও বোধহয় নিজের মতোই পুঁচকে কাউকে দেখে একটু সাহস পেয়ে বলল, ‘ভুক!’

এবার বেশ একটু সাহস পেয়ে নোয়েল দাদানের কোল থেকে নেমে কুকুরছানাকে কোলে তুলে নিল।

ব্যস তারপর আর কী, একদিনের মধ্যেই নোয়েলের জ্বর ঠিক হয়ে গেল আর কুকুরছানাও দিব্যি পোষ মেনে গেল। মা আর বাবাই দু’জনে মিলে জুতোর বাক্সে কাপড় বিছিয়ে তার জন্য বিছানা করে দিয়েছে। দাদান ছোটো বাটিতে করে দুধ খাওয়াচ্ছে তাকে। নোয়েল ভারি আদর করে কুকুর ছানার নাম দিয়েছে, কুটুস।

আর হ্যাঁ, চুপিচুপি আরেকটা কথা বলে রাখি, নোয়েলকে জুজুর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই আর। দাদান বলেছে যে কিছু পশুদের চোখে ট্যাপেটাম লুসিডাম নামের একটি পদার্থ থাকে যা অন্ধকারে চকচক করে এবং এতে অন্ধকারে পশুদের দেখতে সুবিধে হয়। সেইজন্যই কুকুর, বেড়াল এবং অন্যান্য আরও কিছু পশুর চোখ অন্ধকার হলেই জ্বলতে থাকে। ওতে ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই, বুঝলে!

অলঙ্করণঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s