জয়ঢাকের খবরকাগজ–২০১৩ থেকে মনমতানো সমস্ত খবরের অর্কাইভ এইখানে
আমাদের দেশে বর্ষাকালে বা গ্রীষ্মকালে ছাতা ছাড়া ঘরের বাইরে পা রাখলেই বিপত্তি। অনেক দেশে শীতকালেও ছাতা ছাড়া বাইরে বেরোনোর কথা ভাবেন না সে দেশের মানুষজন।অনেক দেশে ছাতা আবার ফ্যাশনের অঙ্গ।শুধু শরীরের আচ্ছাদনই নয়, ছাতার অনেক ভুমিকা।অরিন্দম দেবনাথের ছাতা কাহিনী
রেগে গেলে আমরা প্রায়ই বলি ধুর্র্র্র্ ছাতা। আবার কোনকিছু ঠিকমত বুঝতে না পারলে বলি ছাতার মাথা। কেন বলি? ছাতা হল গুটিয়ে রাখা আদতে ছড়ানো বস্তু। দেখতে ছোট, আসলে বড়। ছাতা এখানে একটা অভিব্যক্তি যা এককথায় প্রকাশ করা কঠিন। কিছুকাল আগেও স্কুলের মাস্টারমশাইদের কাছে ছাতা ছিল অবাধ্য ছাত্রদের শাস্তি দেবার এক মোক্ষম হাতিয়ার। আবার কোন বৃদ্ধ লোক মারা গেলে আমরা বলি ‘উনি ছাতার মত আগলে রেখেছিলেন।’
এহেন ছাতার উদ্ভাবন যে কবে হয়েছিল তা সঠিক বলা দুরূহ।অনুমান আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ছাতার জন্ম হয়েছিল। তাল জাতীয় পাতা থেকে তৈরি এই ছাতা ছিল মূলত রোদ থেকে রক্ষা পাবার উপকরণ -‘প্যারাসল’।
আদি যুগে ছাতা ছিল সম্ভ্রমের প্রতীক।সাধারণ মানুষের অধিকার ছিল না ছাতা ব্যবহারের। রুচির পরিবর্তন ও প্রযুক্তির হাত ধরে প্যারাসল উন্নত হতে হতে জল নিরোধক হয়ে নিঃশব্দে সর্বসাধারনের দৈনন্দিন উপকরণ ‘আম্ব্রেলায়’ পরিণত হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের হাতে আসতে ছাতা নিয়ে নেয় কয়েক হাজার বছর।
ভারত, মিশর সহ বহু দেশের প্রাচীন চিত্র ও ভাস্কর্যে দাসেদের শাসকদের মাথায় রোদনিবারণী ধরে থাকাতে দেখা গেছে। প্রাচীনকালে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ছাতাকে বুদ্ধের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করত। হিন্দুধর্মেও দেবদেবীর মাথার ওপর ছাতা ব্যবহার হয়েছে। গ্রিসে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালে দেবদেবীর মূর্তির ওপর ছাতা ধরা হত। এথেন্স শহরে সম্ভ্রান্ত মহিলারা দাসীদের হাতে ধরা সানসেড বা ছাতার তলায় ঘুরে বেড়াত। গ্রিস থেকে মহিলাদের ছাতা ব্যবহার করার প্রথা রোম সহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে প্রাচীন মিশরে সে যুগের রাজা ও অভিজাত মানুষদের পাণ্ডুবর্ণের ত্বককে রোদের প্রখর তাপ থেকে রক্ষা করতে ছাতার উদ্ভাবন হয়েছিল বলে মনে করা হয়। সে সময় মিশরের লোকেরা ছাতাকে জল নিরোধক করার কথা ভাবেননি।কারণ মরুপ্রদেশে বৃষ্টি কোথায়?
জলনিরোধক চামড়ার ছাতার জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ১১ শতকে চীন দেশে। অত্যন্ত দামি, জল নিরোধক চামড়ার ছাতা সে সময় চীন দেশের রাজপরিবার ও অভিজাত মানুষদেরই ব্যবহার করার অধিকার ছিল। সে সময় ছাতা ধরার জন্য একজন আলাদা লোক থাকত – ছাতাবাহক।
ইউরোপ ছাতার আর্বিভাব হয় অনেক পর। একদম প্রথম দিকে গ্রিস ও রোমে ধনী সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারা দুর্মূল্য বাহারি মিশরীয় রোদনিবারক ছাতা ব্যবহার করত। খ্রিস্টের জন্মের ২০০ বছর পর চীন দেশের ব্যবসায়ীরা ইউরোপে জলনিরোধক চামড়ার ছাতা নিয়ে এল। সে সময় ইউরোপের পুরুষরা ছাতাকে নিচু নজরে দেখত ও মহিলাদের ব্যবহারের সামগ্রী বলে ধরে নিয়েছিল। বৃষ্টি, তুষারপাত ও রোদ্দুরে পুরুষরা মোটা কোট ও টুপিতেই সাচ্ছন্দ ছিল।
চতুর্থ শতাব্দীর শেষে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপ জুড়ে রাজনৈতিক ডামাডোল শুরু হল। একের পর এক রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধ, তীব্র খাদ্য সঙ্কট, ভেঙে পড়া অর্থনীতি, প্রযুক্তিগত অনুন্নয়ন, নিম্নমানের স্বাস্থ্যবিধিতে ধীরে ধীরে ছাতার ব্যবহার হারিয়ে গেল ইউরোপ থেকে।প্রায় এক হাজার বছর পর ষোলশ শতাব্দীর শেষ দিকে নবজাগরণের হাত ধরে ছাতা আবার ফিরে এল ইউরোপের মহিলাদের কেতার সামগ্রী হিসেবে। জন্তুজানোয়ারের হাড় অথবা বেত থেকে তৈরি শিক ও বাঁট, রেশমের কাপড়ের ওপর কাজ করা পাখির পালখের ঝালর দেওয়া অত্যন্ত দামি রোদনিবারক প্যারাসল আবার দেখা যেতে লাগল ইউরোপের ধনী পরিবারের মহিলাদের হাতে। ইটালি, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে ছাতার পুণঃপ্রবেশ শুরু হল চায়না থেকে।

ছাতা কিন্তু তখনও রয়ে গেল মহিলাদের ব্যবহারের উপকরণ হিসেবেই। আঠারশো শতাব্দীর মাঝামাঝি জোনাস হানওয়ে (Jonas Hanway) নামক এক ব্রিটিশ পর্যটক তথা লোকহিতৈষী ও ইংলিশ মাগডালেন হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা, ছাতার উপকারিতা বুঝতে পেরে ছাতা নিয়ে সব জায়গায় যেতে শুরু করলেন। সাধারণ মানুষকে ছাতার উপকারিতা বোঝাতে শুরু করলেন। হিসেব করে দেখালেন, বৃষ্টির দিনে একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করা থেকে ছাতা ব্যবহার অনেক সস্তা। টাঙ্গা ওয়ালারা ব্যাপারটাকে ভাল ভাবে না নিলেও দ্রুত পরিস্থিতি বদলে গেল। প্রায় তিরিশ বছর ধরে অসংখ্য ব্যঙ্গ বিদ্রুপ সহ্য করার পর, জোনাসের ছাতাকে সর্বজনগ্রাহ্য বস্তু হিসেবে ব্যবহারের প্রচার প্রয়াস কাজে দিল। পুরুষরাও আনন্দের সাথে ছাতা ব্যবহার করা শুরু করল। ছাতা ঘুরতে লাগল পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে সবার হাতে হাতে। ব্যবসায়ীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল ছাতার বাজার ধরতে। বিভিন্ন ধরনের উন্নত কারিগরির ছাতা জন্ম নিতে শুরু করল। ১৭৮৬ সালে ইংল্যান্ডে ছাতার ইতিহাসটাই পাল্টে দিয়ে মারা যান জোনাস।
কিন্তু এই সময় সর্বসাধারণের জন্য তৈরি মোম ঘষা মোটা কাপড়ের ছাতাগুলো ছিল বেজায় ভারী। একবার ভিজে গেলে এগুলো খোলা ও বন্ধ করা ছিল খুব কষ্টকর। আর এই খোলা বন্ধ করতে গিয়ে এই ছাতাগুলো প্রায়শই ফুটো হয়ে যেত।
১৭৮৬ সালে জন বেলা নামের এক ভদ্রলোক স্টিলের হাতল দেওয়া ও বাঁটের সাথে শিক লাগানো ছাতার পেটেন্ট অর্জন করলেন। বাজারে এল মোটা ভারী কাপড়ের বদলে লিনেন, সুতি ও রেশম কাপড়ের ওপর মোমের প্রলেপ দেওয়া তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক হালকা ছাতা।
১৯২০ সাল নাগাদ রোদে পোড়া তামাটে চেহারা জনপ্রিয় হল ইউরোপে। ফলে প্যারাসল বা শুধুমাত্র রোদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ছাতা বাজার থেকে একেবারেই লোপ পেয়ে গেল। বাজারে জনপ্রিয়তা লাভ করে গোল কালো টুপি বা হ্যাট। কিন্তু ছাতা হারিয়ে গেল না। বাটের গায়ে সুন্দর ভাবে কাপড় জড়িয়ে ছাতা হয়ে উঠল একধারে সুন্দর ভাবে ছড়ি তথা বৃষ্টি ও তুষারপাত থেকে বাঁচার সুন্দর উপকরণ।
১৯২৮ সালে হান্স হাউপ্ট (Hans Haupt) ভাঁজ করলে হাত ব্যাগে ঢুকে যায় এরকম ছাতা আবিষ্কার করলেন। এর কিছুদিন পর শুরু হল বিশ্ব জুড়ে যুদ্ধ। আবার রক্তস্নাত হয়ে উঠল পৃথিবী। নতুন নতুন উদ্ভাবন চাপা পড়ে গেল গোলা বারুদের আওয়াজ ও ধোঁয়ায়।
ছাতার রকমফের
ক্লাসিক আম্ব্রেলা
লম্বা গোটান ছাতা। ভাঁজ করে ছোট করা যায় না। কিন্তু হাঁটার ছড়ি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
অটোমেটিক আম্ব্রেলা
কারিগরি ছাতা। এক হাতেই খোলা ও বন্ধ করা যায়। ভাঁজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নেওয়া যায়।
পকেট আম্ব্রেলা
তিন বা তার বেশি ভাঁজ করে পকেটে ঢুকিয়ে নেওয়া যায়।
বাবল আম্ব্রেলা
স্বচ্ছ প্লাস্টিকে তৈরি ছাতা। স্বচ্ছ প্লাস্টিকে তৈরি হওয়ায় দেখতে কোন অসুবিধা হয় না।
হাই উইন্ড (স্টর্ম) আম্ব্রেলা
প্রবল হাওয়ায় ও ভারী বৃষ্টিতে চলার উপযোগী ছাতা। জাস্টবাস্টার কোম্পানির তৈরি ছাতা ৫৫ মাইল প্রতি ঘণ্টা বেগের হাওয়ার বিরুদ্ধে ঠিক থাকতে পারে।
১৯৬৭ সালে সেই ভাঁজ করা ছাতার পেটেন্ট হস্তগত করলেন ব্রাডফোর্ড ফিলিপ। ছাতা ভাঁজ হয়ে ঢুকে গেল অফিস ব্যাগে। এরপর থেকে ছাতার উন্নতি হতে লাগল দ্রুত। বাহারি, হালকা, জলনিরোধক রকমারি আকারের ছাতা ছেয়ে গেল বিশ্ব জুড়ে।
ছাতা এখন আর শুধু রোদ বৃষ্টি থেকে বাঁচার সামগ্রী নয়। ছাতা এখন ঘরসজ্জার উপকরণ। ছাতা দিয়ে সাজানো হয় বিয়ে বাড়ি, হোটেল, খেলার মাঠ। একবিংশ শতাব্দীর মানুষের কাছে ৩৫০০ বছর আগে আবিষ্কৃত ছাতা এক অপরিহার্য অংশ। বছরে পৃথিবী জুড়ে কত ছাতার ব্যবহার হয় বলা মুশকিল। ২০০৮ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছিল শুধুমাত্র আমেরিকাতেই বছরে প্রায় তিন কোটি ছাতা বিক্রি হয়। আর এর সিংহ ভাগটাই আসে চায়না থেকে।