টাইম মেশিন ঠগির আত্মকথা অলবিরুণী বর্ষা ২০১৯

আগের পর্বগুলো

এইভাবে বেশ কয়েকদিন পথ চলবার পর আমরা তিয়ারি নামে বুন্দেলখণ্ডের বড়সড় একটা শহরে এসে ঘাঁটি গাড়লাম। এরপরে ঝালোন অবধি আর কোনও বড়ো শহর নেই। ফলে এই শেষ জায়গাটায় একটা ভালো শিকার করেই ঘরে ফেরবার ইচ্ছে ছিল সবার। কিন্তু তিয়ারিতে দিন দুয়েক বসে থেকেও ভালো কোনও বুনিজের সন্ধান পাওয়া গেল না।

দ্বিতীয় দিনও যখন সোথারা মুখ ভার করে ফিরে এল, আমার মাথায় তখন রোখ চেপে গেল। তার পরের দিন ভোরে আমি ভালো জামাকাপড় পরে সেজেগুজে কয়েকটা ঠগিকে আমার চাকরবাকর সাজিয়ে সঙ্গে নিয়ে শহরে ঢুকে খানিক এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালাম প্রথমে। তারপর একটা চবুতরার ওপর জনাতিনেক ভালো চেহারার মুসলমান বৃদ্ধকে বসে থাকতে দেখে কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “এখানে ভালো মণিকারের দোকান কোথায় পাব বলতে পারেন? আমি ক’টা দামি পাথর কিনতে চাইছিলাম।”

“সত্যি সত্যি কিনতে চান, নাকি আমাদের এখানে তেমন দোকান-টোকান আছে কি না তাই যাচাই করছেন?” এক বৃদ্ধ পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন।

“ছি ছি, এটা কী বললেন? আমার বয়সি একজন মানুষ আপনাদের মতো বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে তেমন তামাশা করতে পারে নাকি?”

বৃদ্ধ আমার দিকে একঝলক দেখে নিয়ে বললেন, “হুম। ভালো কথা। তাহলে আমাদের এই আমার পাশে বসা শেখ নাসিরুদ্দিনের সঙ্গেই কথা বলুন। ইনি এ শহরের একজন প্রধান রত্নব্যবসায়ী, উপস্থিত ঘোড়া থেকে নেমে এসে আমাদের সঙ্গে একটু বসুন। তারপর শেখসাহেব আপনাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ব্যাবসার কথাবার্তা বলবেন।”

নেমে বসতে না বসতেই হুঁকো আর শরবত এসে গেল। খানিক সময় যেতে না এতেই ভালো বন্ধুত্বও হয়ে গেল আমাদের মধ্যে।

“তা মশায়ের নামটা জানতে পারি কি?” প্রথম যে বৃদ্ধের সাথে আমার কথা হয়েছিল তিনিই খানিক পরে আমায় প্রশ্ন করলেন।

আমি নিজের নামটা বলে বিনীত গলায় বললাম, “আমি হিন্দুস্থানের একজন দরিদ্র সৈয়দ, প্রভু মহম্মদের ভৃত্য…”

বৃদ্ধ উত্তেজিত হয়ে বলেন, “মাশাল্লা! কী বলেছিলাম আমি? এর যা চেহারা, হাফিজের শের-এর মতো সুন্দর ভাষা, এ সৈয়দ না হয়ে যায় না!”

“আপনারা আমাকে লজ্জা দেবেন না। আমি একজন সাধারণ সৈনিক, যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে-ঘুরেই জীবনটা কাটিয়ে ফেললাম। শিক্ষাদীক্ষার সুযোগই পেলাম না ভালোমতো। আপনাদের প্রশংসার যোগ্য আমি নই।” আমি মাথা নিচু করে জবাব দিলাম।

“কার দলে ছিলেন? সিন্ধিয়ার?”

“আজ্ঞে না। আমি কাজ করেছি দক্ষিণে। এলিচপুরের সলাবত খানের সেনাদলে।”

“তিনি তো খুব বড়ো যোদ্ধা শুনেছি,” সবাই একযোগে বলে উঠল, “আমাদের শত্রুপক্ষের হয়ে লড়েছেন বটে, তবে বেজায় বীর।”

“হ্যাঁ, তা যা বলেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন সলাবত খান। কেউ কখনও তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিঠ দেখাতে দেখেনি।”

“তা এখন চললেন কোথায়?”

“ঝালোনে ফিরছি। সলাবত খান সেনাবাহিনীতে লোক কমিয়ে দিলেন। আমার আর ওখানে বিশেষ কাজ রইল না। তাই দেশে বাবার কাছে ফিরে এসেছি কিছুকাল। ঝালোনের রাজার কাছে কাজ জুটিয়ে নিয়েছি একটা। তিনি লোক ভালো। সুখেই আছি। তিনিই আমায় একটু দৌলত রাও-এর দরবারে পাঠিয়েছিলেন একটা সমস্যার মীমাংসার জন্য। আল্লাহর কৃপায় সেসব কাজ ভালো করেই মিটিয়ে এখন বাড়ি ফিরছি।”

আরো কিছুক্ষণ একথা সেকথা বলবার পর আমি বললাম, “আজ তাহলে আমি উঠি। কিছু জরুরি কাজ ছিল।”

সঙ্গে সঙ্গে শেখ নাসিরুদ্দিন উঠে দাঁড়িয়ে কোমরের কাপড়টা ভালো করে গুঁজতে গুঁজতে চপ্পলে পা ঢুকিয়ে বলে, “আরে সে কী কথা! আমার বাড়িতে চলুন আগে! যা খুঁজতে এলেন সেসব না দেখেই চলে যাবেন নাকি! বেশি দূর নয় আমার বাড়ি। আপনার বেশি সময় নেব না।”

আমি অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললাম, “তাহলে আমি চলি।”

“আরে দাঁড়ান দাঁড়ান মীরসাহেব। পান-আতর না নিয়ে চলে যাবেন মানে? আমাদের আদবকায়দা কিছু নেই নাকি?” বলতে বলতে অন্য বৃদ্ধটি একজন চাকরকে ডেকে পাঠিয়ে পান-আতর আনতে বললেন। তারপর সেসব এলে আমার দাড়িতে হাতে আতর লাগিয়ে হাতে একটা সাজা পান ধরিয়ে দিয়ে তাঁদের বিদায় অনুষ্ঠান শেষ হল।

সেখান থেকে উঠে আমরা শেখসাহেবের পিছু পিছু যাচ্ছি, তখন আমার চাকর সেজে থাকা একটা ঠগি আমায় রামাসিতে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল, “এ আমাদের বুনিজ তো?”

আমি নিচু গলায় তাকে ধমক দিয়ে বললাম, “একটাও কথা বলবি না। আগে আগে লোক সরাতে সরাতে চল, ভাব কর যেন আমি যেন একজন রাজাগজা গোছের মানুষ।”

শুনে তারা তাড়াতাড়ি আমাদের সামনে গিয়ে হাঁকডাক করে লোকজন সরাতে সরাতে চলল।

বাড়িতে এনে শেখ আমায় হাত ধরে ভেতরের বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বসালেন। সামনে চওড়া উঠোন। তাতে ছোট্ট একটা ফোয়ারা। তার চারপাশে অনেক ফুলগাছ। মাথার ওপরে কলাগাছের বড়ো বড়ো সবুজ পাতার ছায়া। জায়গাটা ভারি শান্ত, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা, আর একেবারে তকতক করছে পরিষ্কার।

বাড়িটা দেখতে দেখতে আমি ভাবছিলাম, আমার বাড়িটাও এইরকম সুন্দর করে বানাব। এইরকমই একটা শান্তির জায়গা হবে সেটাও। সেকথা ভাবতে ভাবতেই অবশ্য মনে মনে আমি এই লোকটাকে ফাঁদে ফেলবার ফিকির খুঁজে চলেছিলাম একলা একলা বসে। শেখ নাসিরুদ্দিন তখন আমায় বসিয়ে রেখে বাড়ির ভেতর থেকে তার বিক্রির জিনিসপত্র আনতে গেছে।

।৪২।

খানিক পরে শেখ ফিরে এল। হাতে একটা ছোটো বাক্স। তার সঙ্গে বছর বারোর একটা ছেলেও এল। শেখের বড়ো ছেলে। ভারি সুন্দর দেখতে। চোখমুখ বুদ্ধি আর আত্মবিশ্বাসে ঝকমক করছে। তাকে দেখে আমি বললাম, “আপনি সৌভাগ্যবান মানুষ। একদিন আমারও এমন একটা ছেলে ছিল। কিন্তু আল্লাহর মর্জি অন্য ছিল। আজ আমার ঘর খালি। থাক গে, নিজের দুঃখের ভার অন্যের মাথায় চাপিয়ে কী লাভ! আপনার ক’টি ছেলে?”

“তিনটে। ওরাই আমার সব, বুঝলেন মীরসাহেব! ভোগ করবার জন্যই কেউ যদি নাই থাকল তাহলে আর টাকাপয়সা দিয়ে হবেটা কী, বলুন না! তাছাড়া আপনার বয়স এখনও অল্প। আশা ছাড়বেন না। আল্লাহকে ডাকুন। তিনি ভক্তের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারবেন না।”

“না না, আমার সন্তান আছে। একটা মেয়ে আছে আমার। তার ওপরেই আমার সব আশা। মেয়েটার বিয়ে ঠিক করেছি সামনেই। সেজন্যই কয়েকটা মুক্তো কেনবার ইচ্ছে।”

“এই যে দেখুন। পছন্দ করুন,” ছোটো বাক্সটা খুলে দিয়ে তার থেকে একের পর এক চোখ ঝলসানো মুক্তো বের করতে করতে শেখ বলছিল, “সুরাট থেকে সেরেনদিপ, সব জায়গার বাজার-বাছাই মুক্তো আছে আমার কাছে। এ-জিনিস রাজারাজড়ার দেহেও বেমানান হবে না সৈয়দসাহেব।”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “সে তো ঠিকই। অসাধারণ সব রত্ন এসব। কিন্তু আমি গরিব সৈনিক। এত দামি জিনিস কেনবার সাধ্য কোথায় আমার। একটু কম দামের জিনিস যদি দেখাতেন। এই ধরুন শ’তিনেক টাকার মধ্যে…”

তাই শুনে শেখ বাক্স থেকে বেছে একটা সুন্দর মালা তুলে এনে আমায় দেখাল। এক নজরেই জিনিসটা আমার পছন্দ হয়ে গেল। দামও আমি যেমনটা চেয়েছিলাম তার মধ্যেই ছিল। মালাটার জন্য আমি বায়না দিয়ে দিলাম। পরে এসে টাকা দিয়ে নিয়ে যাব। কিন্তু বাক্সটার দিক থেকে আমার চোখ সরছিল না। বড়ো বড়ো মসৃণ মুক্তোর তৈরি একগাছা মালা হাতে তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে আমি বললাম, “মহারাজ যদি এ মালাছড়াটা দেখতেন…”

শেখ সঙ্গে সঙ্গে বলে, “মহারাজ এসব জিনিস কিনবেন বলে মনে হয়?”

“নিঃসন্দেহে। ঝালোন ছেড়ে রওনা হবার ক’দিন আগেই মহারাজের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। উনি তখন কিছু দামি মুক্তোর সন্ধানে ছিলেন। কাছাকাছি কোথাও ঠিকমতো জিনিস না পেয়ে একবার তো ঠিক করলেন সুরাটে লোক পাঠাবেন মুক্তোর জন্য। কিন্তু তারপর অতদূরের রাস্তা, সময় নষ্ট, পথের বিপদ-আপদ এইসব কথা ভেবে মাথা থেকে সে চিন্তা সরিয়ে রেখেছেন।”

শেখ খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলে, “তাহলে আপনি বলছেন জিনিসগুলো নিয়ে যেতে পারলে মহারাজের কাছে বিক্রি হয়ে যাবে?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। আগামী বছর মহারাজের মেয়ের বিয়ে। এখন থেকেই তাই গয়নাগাঁটি জোগাড়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে।”

“আসলে ব্যাপারটা কী জানেন, দু’বছর ধরে জিনিসগুলো আমার কাছে পড়ে আছে, কিন্তু দাম দেখে কেউ আর কিনতে সাহস পায় না। যা জিনিস, তার তুলনায় দাম কিন্তু তেমন বেশি নয়। আমি বেশি লাভ রাখতেও চাই না এ জিনিসে—তবুও…”

“তা দাম কীরকম হবে বলুন তো?”

“আপনার কাছে হলে ছ’হাজার টাকা, তবে রাজার কাছে পুরো আট হাজারই চাইব।”

আমি একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “আমার একটা প্রস্তাব আছে। রাজা আমার কথা বেশ মানেন। আমি যদি রাজার কাছে আপনাকে নিয়ে গিয়ে এটা আট হাজার টাকাতেই বিক্রি করিয়ে দিতে পারি, তাহলে দালালি বাবদ যে তিনশো টাকা দিয়ে আমার মেয়ের জন্য মালাগাছা কিনেছি সে টাকাটা আমায় ফেরত দিতে হবে। প্রস্তাবটা ভেবে দেখুন শেখসাহেব।”

“সে ঠিক আছে। কিন্তু ঝালোন তো কম দূরের রাস্তা নয়! সেখান থেকে ফিরব কেমন করে? রাজদরবারে বিক্রিবাট্টার খবর তো আর চাপা থাকবে না। ফেরার পথ ধরতেই চোরডাকাতে না মেরেধরে সব কেড়ে নিয়ে যায়!”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমার রাজাকে আমি জানি। এতদূর থেকে তাঁর পছন্দের জিনিস নিয়ে যাচ্ছেন যখন, তখন তিনি ফেরবার সময় আপনার সঙ্গে লোকজন কিছু দিয়ে দেবেন ঠিক। তবে হ্যাঁ, ভয় পেলে অবশ্য না যাওয়াই ভালো।”

শেখ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বলল, “দাঁড়ান, আমি জ্যোতিষী কী বলে শুনে নিই একবার।”

“আরে ছি ছি, শেখসাহেব। কী যে বলেন! শেষে একটা হিন্দুর কথা শুনে আপনি কী করবেন না করবেন তাই ঠিক করবেন? এ ভারি লজ্জার কথা। বলি এত ভয়ের কী আছে! যাবার সময় তো আমি নিজে আপনার সঙ্গে থাকব পঞ্চাশজন রাজার সেপাই নিয়ে। ফেরার সময় রাজাই আপনার সঙ্গে কয়েকজন ভালো ঘোড়সওয়ার পাহারাদার দিয়ে দেবেন। তাহলে বিপদটা আপনার হবে কোথা থেকে? দু’বছর ধরে এতগুলো টাকা আটকে রেখেছেন, একটা খদ্দের জোটেনি। এখন এইটুকু বিপদের ভয়ে শেষে হিন্দু জ্যোতিষীর ঘরে দৌড়োবেন? সে যদি বলে দেয় যাবেন না, তাহলে তো ফের একবার টাকাটা আটকে রেখে বসে থাকতে হবে।”

শেখজির ছেলে এইবার বলে, “মীরসাহেব ঠিক বলেছেন, বাবা। কোনও বিপদ হবে না। চলো, আমিও তোমার সঙ্গে যাব এবারে। তুমি বলেছিলে না, এবারে যখন কোথাও যাবে, আমায় সঙ্গে করে নিয়ে যাবে?”

শেখ মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, “প্রস্তাবটা আপনার খুবই লোভনীয়। হাজার আটেক টাকা তাহলে পাওয়া যাবে বলছেন? এরকম দাম পেলে ঝুঁকিটা নিয়েই নেয়া যায়, কী বলেন? নইলে জিনিসগুলো আমার গলার কাঁটা হয়ে আটকে আছে এই দু’বছর। কেন যে মরতে পিণ্ডারির জিনিস কিনতে গেছিলাম!”

“পিণ্ডারির জিনিস?”

“হ্যাঁ মীরসাহেব, চিতু না দোস্ত মহম্মদ কার দলে যেন কাজ করত লোকটা। তারপর ফিরিঙ্গিদের উৎপাতে দল ভেঙে যেতে সে তার কয়েকটা চেলাচামুণ্ডা নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। শেষে নিজের লোকজনকেই টাকাপয়সা দিতে না পেরে যখন মারধোর খাবার দশা হয়েছে তখন আমার কাছে এসে জিনিসটা বেচে টাকা নিয়ে নিজের পিঠ বাঁচায়।”

“তার মানে জিনিসটা আপনি বেশ সস্তায় পেয়ে গেছেন, তাই তো?”

“তা পেয়েছি। দুর্দশায় পড়ে কেউ যখন কিছু ব্যাবসা করে তখন তাকে খানিক ঠকতে তো হয়ই। কিন্তু তাহলেও এ-জিনিস আট হাজার টাকায় কেউ যদি কেনে তো সেটাও সস্তাই হবে। এর চেয়ে অনেক খেলো জিনিস আমি মহাদজি সিন্ধিয়াকে দশ হাজার টাকায় বেচে এসেছি। কিন্তু তিনি এখন আতান্তরে আছেন। মুক্তো কেনা মাথায় উঠেছে। ফলে আমার হয়েছে মুশকিল।”

“তাহলে যাওয়াই ঠিক, কী বলেন শেখজি? আমি কাল রওনা হয়ে যাচ্ছি। আমার সঙ্গেই যদি চলেন তাহলে পথে বিপদ আপদের ভয় থাকবে না। যেতে আসতে বড়োজোর মাস খানেক সময় লাগবে। তাছাড়া আবহাওয়া এখন ভালো আছে। আমার দলটা বড়ো, কাজেই রাতের বেলা পথ চলতে পারব। দিনে রোদের তাপে চলবার কষ্টটাও হবে না।”

“তা বলতে পারেন মন আমি একরকম স্থিরই করে নিয়েছি। শুধু ভেতরের ওঁদের মতটা একবার একটু জেনে নিতে হবে। সন্ধের নামাজের সময় নাগাদ যদি একবার আসেন তাহলে পাকা কথা বলে দেব। মানে বুঝতেই তো পারেন, ঘরের মেয়েমানুষের মত না থাকলে লম্বা রাস্তা চলতে একটু কেমন কেমন লাগে।”

“ঠিক আছে তাহলে। ওই কথাই রইল। সন্ধেবেলা আমি একবার এদিকে এসে আপনার মতটা জেনে যাব। আসলে দিনকাল যা পড়েছে, তাতে নিজের লাভ ছাড়া তো কেউ আর অন্যের কথা ভাবে না! কিন্তু এতে আমার কোনও স্বার্থ নেই শেখজি। একজন সাচ্চা মুসলমান হয়ে আরেকজন মুসলমানের উপকারে আসতে পারছি সেটাই আমার স্বার্থ। আচ্ছা, আল্লা হাফিজ।” এই বলে আমি উঠে পড়লাম।

পথে বেরিয়ে আমার সঙ্গের ঠগিটা আবার জিজ্ঞাসা করল, “এ কি আমাদের বুনিজ হবে?”

আমি হাসতে হাসতে বললাম, “থাম ব্যাটা মূর্খ। টোপটা গিলেছে সবে। গলায় বঁড়শি আটকায়নি এখনও। তবে হ্যাঁ, বঁড়শি যদি না বেঁধে তাহলে আমার দাড়িতে কাদা ছুড়িস সবাই মিলে। আমীর আলির বুদ্ধি অত কম নয়।”

ঘাঁটিতে ফিরে বাকি লোকজনকে আমার হবু শিকারের কথা বলে, সে এলে কীভাবে কী করতে হবে সেসব শেখাতে কিছুটা সময় গেল। আমি নিশ্চিত ছিলাম শেখ আসবেই। কিন্তু তার ছেলেটাকে যেকোনও মূল্যে আটকানো দরকার। ওকে আমি মারতে পারব না। এ-বাড়ির একজন লোক মরাই যথেষ্ট।

এইসব সাতপাঁচ কথা ভাবছি এমন সময় লালু এল। এসেই চিৎকার শুরু করে দিয়েছে, “মীরসাহেব, আপনি কি পাগল হলেন? রাস্তায় লোক পেলাম, মারলাম, সে একরকম। কিন্তু এইভাবে বাড়ি থেকে লোক টেনে বের করে নিয়ে গিয়ে মারা! না না, এ উচিত হবে না।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “সে কি! তুমিও শেষে উলটো গাইছ? ব্যাপারটা কী?”

“মীরসাহেব, ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় বুঝুন। শহরের লোকজন আপনাকে শেখের বাড়িতে যেতে দেখেছে। আপনি কোত্থেকে আসছেন সেকথাও আপনি সবাইকে বলে এসেছেন। তারপর ফের আপনারই সঙ্গে শহর ছেড়ে যাবার পর লোকটা যখন উধাও হয়ে যাবে তখন লোকে কিন্তু আমাদের খুঁজে বের করবেই।”

“ধুর বোকা,” আমি হাসলাম, “কিচ্ছু হবে না। আমি কি করছি সে আমি ভালো করেই জানি। তুমি এ নিয়ে বেশি ভেব না।”

“না, সে আমি ভাবছি না। যা উচিত মনে হল, বললাম। কিন্তু আপনি যদি সবদিক ভেবেচিন্তে মনে করেন ঠিক কাজ করছেন, আমার তাহলে আর কী বলবার থাকতে পারে। তা বুনিজটা ভালো হবে বলছেন? টাকাপয়সা ভালো পাওয়া যাবে?”

“সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকো লালু। মোটা টাকা পাওয়া যাবেই এবারে। আর জানোই তো, আমি খেলতে নেমে কখনও হার মানি না।”

“সে তো ভালো করেই জানি মীরসাহেব। তা আমায় কিছু করতে হবে নাকি?”

“হ্যাঁ, হবে। আমার পেছন পেছন এসে বাড়িটা একবার দেখে নেবে। বোকাটা যাবার আগে একটা জ্যোতিষী খুঁজবে ভাগ্যটা দেখিয়ে নেবার জন্য। ওর বাড়ির চাকরবাকরের কাছ থেকে কোন জ্যোতিষীর কাছে ও যায় সেটা বের করে নিয়ে সেই জ্যোতিষীকে পাকড়ে আগেভাগে কিছু টাকা দিয়ে এসো। শেখ হাত গোনাতে এলে তাকে বলতে হবে কালকের দিনটা রওনা দেবার পক্ষে শুভ, আর পরশুদিন থেকে অশুভযোগ শুরু হয়ে যাচ্ছে। সাবধানে কাজ করবে। এর ওপর সবকিছু নির্ভর করছে।”

“ঠিক আছে। চলুন, বাড়িটা দেখিয়ে দেবেন। তবে চেহারাটা একটু বদলে নিন প্রথমে। নইলে আপনাকে চিনে ফেললে মুশকিল হবে। বাকিটা আমি সামলে নিচ্ছি।”

“ভালো কথা বলেছ।” বলে আমি তাড়াতাড়ি আমার ভালো জামাকাপড় পালটে নোংরা, ছেঁড়া জামাকাপড় পরে নিলাম। তারপর মুখটাকে ভালো করে ঢেকে চোখদুটো শুধু বের করে রাখলাম। তখন আমায় দেখে কেউ তিয়ারি বাজারের একটা গেঁজেল গুণ্ডা ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারবে না।

সেই চেহারাতেই আমি লালুকে নিয়ে গিয়ে বাড়িটা দেখিয়ে দিয়ে তার হাতে একশোটা টাকা দিয়ে ফিরে এলাম।

সন্ধের পর ফের সকালের পোশাকে আমি শেখের বাড়িতে ফিরে গেলাম। বারান্দায় গিয়ে বসে টাকা দিয়ে প্রথমে আমার বায়না দিয়ে রাখা মুক্তোর মালাটা কিনলাম। তারপর কাজের কথা শুরু হল। জিজ্ঞাসা করলাম, “তাহলে কী ঠিক করলেন শেখজি, কাল আমার সঙ্গে যাচ্ছেন? নাকি যাবেন না বলে ঠিক করলেন?”

“আরে না না, মীরসাহেব। আমি যাব। তবে ছোটো একটা সমস্যা হয়েছে। অন্দরের ওঁদের গিয়ে যাবার কথা বলতে মানা তো করলেন না, কিন্তু সবাই মিলে একসঙ্গে ধরে বসলেন, জ্যোতিষের কাছে ভালো দিন একটা দেখিয়ে নিতে হবেই। আমি অনেক বোঝালাম, একজন সাচ্চা মুসলমান হয়ে এসব করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা সে কথা মানলে তবে তো! শেষে এমন কাণ্ড বাধল, যে ওঁদের তুষ্ট করতে আপনি বের হয়ে যাবার পরপরই দশটা টাকা দিয়ে এই মহল্লার এক ব্রাহ্মণের কাছে দিন গুনতে একটা ছেলেকে পাঠিয়ে দিলাম। লোকটার জ্যোতিষ হিসেবে বেশ নামযশ আছে। সে গুনে বলে, কালকের দিনটা নাকি বেজায় খারাপ। তবে হ্যাঁ, পরশু থেকে দিন ভালো পড়ছে, তখন গেলে কোনও আপত্তি নেই। তা কী বলেন মীরসাহেব, একটা দিন আরও আপনি এখানে অপেক্ষা করে যাবেন নাকি?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “সে একেবারে অসম্ভব ব্যাপার, শেখসাহেব। একেই তো বেশ দেরি হয়ে গেছে, তার ওপর এইসব কারণে আরও দেরি করলে মহারাজ যদি আমার ওপর বিরক্ত হন তাহলে ধনেপ্রাণে মারা যাব যে! আমি ওই কালকেই রওনা দেব, সে আপনি সঙ্গে যান বা নাই যান।”

শেখজি খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে তারপর বলে, “মীরসাহেব শুনুন, কাজটা হলে পরে আপনাকে যে দুশো টাকা দালালি দেবার কথা হয়েছিল সেটা আমি তিনশো করে দিলাম। ভেবে দেখুন, একশো টাকা কিন্তু কিছু কম নয়। কী? আর একদিন থেকে যেতে পারবেন তো?”

এই মিথ্যে কথাটা বলবার জন্য ধূর্ত শেয়ালটাকে আমার সেইখানেই গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। সকালেই কথা হয়েছিল আমি দালালি নেব তিনশো টাকা। সেটাকে কমিয়ে বাড়িয়ে এখন আমায় বোকা বানাবার চেষ্টা করছে লোকটা। বললাম, “না শেখজি, হাজার টাকা দিলেও আমার কাল সকালের পর এখানে থাকবার উপায় নেই। তবে একটা কথা আমার মনে হচ্ছে। আপনার জ্যোতিষী আপনাকে ভুল বোঝায়নি তো? দশ টাকার কিছু বেশি আশা করে বসে আছে হয়তো। সেটা দিলে দেখবেন দিনটা হয়তো ফের শুভই হয়ে যাবে। এমন কাণ্ড কিন্তু ঘটে থাকে। এ ব্যাপারটা ভেবে দেখেছেন কি?”

“আপনি বলছেন? সেরকম কিছু করে থাকলে ব্যাটাকে ওর মন্দিরের মধ্যে গরুর চামড়ার জুতো দিয়ে পিটিয়ে আসব আমি। কিন্তু মনে হয় সেসব হবে না। আরে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের কোথায় কী রয়েছে সেসব ও-ব্যাটা বদলাবে কেমন করে?”

“একবার পরীক্ষা করেই দেখুন না। লোকটা যদি সৎ হয় তাহলে যে টাকাটা আপনি পাঠাবেন সেটা ও আপনার চাকরের মুখে ছুঁড়ে মেরে দেবে। সেক্ষেত্রে আপনার আর যাওয়া হবে না। আর যদি টাকাটা নিয়ে ও দিন বদলে দেয় তাহলে বোঝা যাবে লোকটা ঠগ। ওর কোনও কথাতেই বিশ্বাস করা যায় না। দু’দিকেই আপনার লোকসান। তার চেয়ে বলি কী, ওসব জেনানা-টেনানার কথা না শুনে পুরুষমানুষের মতো বের হয়ে পড়ুন তো! কিচ্ছু হবে না দেখবেন।”

“পারব না, মীরসাহেব। ঘরে চারজন বউ আমার। তারা একসঙ্গে রেগে গেলে সামলাতে পারব না।”

“তাহলে আর কী করা। আপনার ইচ্ছে তো আছে, কিন্তু জেনানার হুকুম ছাড়া যাবার ক্ষমতা নেই। তাহলে  যাবেন না।”

“যা বলেছেন, মীরসাহেব। এত লাভের একটা কাজ করব, তাতে যাবার ইচ্ছে থাকবে না কেন? কিন্তু এই বউগুলোর জ্বালায়…”

কথা বলতে-বলতেই পাশের একটা মসজিদের ছাদ থেকে আজানের শব্দ ভেসে এল। আমরা দু’জনেই নিজের নিজের আসন পেতে পশ্চিমের লাল আকাশের দিকে মুখ করে নামাজ পড়তে বসে গেলাম। ঠিক করে নিয়েছিলাম যতক্ষণ পারা যায় অপেক্ষা করব, যদি ওদিকে লালু কোনও ব্যবস্থা করে ফেলতে পারে।

রাত বাড়ছিল। শেখকে আমি ঝালোনে গেলে কেমন খাতিরদারিটা পাবে তার একটা মনগড়া ছবি শোনাতে শোনাতে মনে মনে যখন প্রায় ঠিকই করে ফেলেছি যে আর একটা দিন এখানে থেকেই যাব, তখন শেখের এক চাকর এসে ওর কানে কানে কী একটা যেন বলে গেল। শুনে শেখ প্রথমে একটু চমকে উঠল, তারপরেই দেখি তার মুখটা হাসিতে ভরে গিয়েছে। বলে, “একটু বসুন মীরসাহেব। বারবাড়িতে দেওয়ানখানায় একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আমি এক্ষুনি আসছি।”

শেখ বের হয়ে গেলে আমার বুকটা উত্তেজনায় কাঁপছিল। তাহলে লালু কি কাজটা করে ফেলেছে! নাকি কোনও বিপদ হল! দুটোর যেকোনও একটাই হতে পারে। চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম। বিপদে পড়লে পালাবার কোনও রাস্তা নেই। তবে হ্যাঁ, এদিকে ঢোকবার রাস্তাটা সরু। একসঙ্গে বেশি লোক একবারে ঢুকে আসতে পারবে না। একাই অনেকটা লড়াই দিতে পারব দরকার হলে। কোমর থেকে তলোয়ারটা বের করে এনে আমি তৈরি রাখলাম। সেই সঙ্গে বাইরের দিকে ঝুঁকে কান পেতে চেষ্টা করছিলাম কী কথাবার্তা হচ্ছে যদি একটু শোনা যায়।

একটু বাদেই অবশ্য সন্দেহের নিরসন হল। দেখি, দেওয়ানখানা থেকে শেখ বাইরে বের হয়ে আসছে। তার সঙ্গে একজন মাথা কামানো সাদা কাপড় পরা লম্বা চেহারার লোক। এ নিঃসন্দেহে হিন্দু ব্রাহ্মণ। শেখের জ্যোতিষীই হবে তাহলে। তারা বাইরে বের হয়ে এলে তাদের কথাবার্তা শুনে আমার যেটুকু উদ্বেগ ছিল তাও ঘুচে গেল।

“চিন্তার কিছু আর নেই তাহলে বলছেন?”

“না,” ব্রাহ্মণ জবাব দিল, “হিসেবের ভুলটা এইমাত্রই চোখে পড়ল। তাছাড়া গণনা বলছে যাবার জন্য আপনি বিশেষভাবে আগ্রহীও হয়ে আছেন। কী, তাই তো?”

“আপনি ঠিক ধরেছেন। যেতে পারলে আমার বিশেষ লাভ হবে।”

“তাহলে নিশ্চিন্তে চলে যান। নারায়ণের কৃপায় আপনি সফল হবেন।”

“অনেক ধন্যবাদ শিবনাথ, ভালোয় ভালোয় ফিরে আসি, তারপর আপনার দেবতাকে আমি একটা মোটা নজরানা পাঠিয়ে দেব।”

“হ্যাঁ। সেটা ভুলবেন না যেন। আমি আসি।”

“হ্যাঁ শিবনাথ, আসুন। আল্লা হাফিজ।”

একটু বাদেই শেখ আমার কাছে ফিরে এল। বলে, “খবর ভালো। জ্যোতিষী খবর দিল, কালকের দিনটা আসলে বেজায় শুভ। তাছাড়া আমার ভাগ্যেও এবারে একটা লম্বা সুসময় শুরু হয়েছে। ভাবুন মীরসাহেব, কী সৎ এই মানুষটা! নিজে বাড়িতে এসে ভুল স্বীকার করে খবর দিয়ে গেল, কোনও টাকাপয়সার আশা না করেই। ইচ্ছে করলেই তো কিছু না বলে আমায় দুশ্চিন্তায় রেখে দিতে পারত। আর একে কিনা আপনি খারাপ মানুষ ভাবছিলেন?”

“হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। অবাক কাণ্ড! আচ্ছা, লোকটা পরে কোনও সুবিধে পাবে সেই আশায় এমনটা করেনি তো?”

“আরে না না, সুবিধে আবার কী পাবে? ব্যাটা কাফির। ওর জ্ঞানটা আমি কেবল নিজের সুবিধের জন্য কাজে লাগাই। এরপর আমি ওকে দেব তো লবডঙ্কা।”

আমি মনে মনে বললাম, ‘মিথ্যেবাদী কোথাকার। তুমি ওর কথায় ওঠো-বসো। ব্যাটা আবার হাজি। সাধে আরবি প্রবাদে বলে যে একবারের হাজি থেকে সাবধানে থেকো আর দু’বারের হাজির বাড়ির কাছ থেকে নিজের বাস উঠিয়ে নিয়ে যেও? দাঁড়াও, শিগগিরই তোমাকে আল্লাহর কাছে এইসব মিথ্যে কথা বলবার জন্য জবাবদিহি করতে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ মুখে অবশ্য সেসব কিছু বুঝতে না দিয়ে বললাম, “তাহলে হাজিসাহেব, রাত বাড়ছে, আপনি বরং রওনা দেবার বন্দোবস্ত করুন। আরেকটা কথা। সঙ্গে কিন্তু দুয়েকটা চাকরবাকর ছাড়া আর বেশি কাউকে নেবেন না। আমার সঙ্গে যা লোক আছে তাতেই আপনার দেখভালের কাজ হয়ে যাবে। আর ছোটো ছেলেটাকে কিন্তু কোনওমতেই সঙ্গে আনবেন না। আমরা যাব খুব তাড়াতাড়ি। বেচারা ওতে ক্লান্ত হয়ে পড়বে, আর তাতে মাঝখান থেকে আমাদের খামোখা দেরি হয়ে যাবে।”

“সে আপনি যেমন বলবেন তেমনভাবেই আসব, মীরসাহেব। সঙ্গে একটা টাট্টুর সহিস ছাড়া আর কাউকে আনছি না আমি। বেশি লোকজন সাথে দেখলেই লোকের মনে সন্দেহ হয় এর কাছে টাকাপয়সা আছে।”

“তাহলে সেই কথাই রইল। ভোর হবার মুখমুখ এসে পৌঁছে যাবেন। আমরা তৈরি থাকব।” এই বলে আমি শেখের বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম।

ঘাঁটিতে ফিরে দেখি লালু আমার তাঁবুর সামনে অপেক্ষা করছে। আমায় দেখেই সে হেসে কুটোপাটি। বলে, “সে যা মজা হয়েছে, কী বলব মীরসাহেব!”

“হ্যাঁ, বলো শুনি সবকথা।”

“আপনি আমাকে শেখের বাইর কাছে ছেড়ে চলে আসবার পর বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে একটা গাছের ছায়ায় শুয়ে আমি বাড়িটার ওপর নজর রাখছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে বাড়ি থেকে একটা হিন্দু চাকর বের হয়ে এল। ব্যাটার লাল চোখ দেখেই আমি বুঝে গেলাম এ মাতাল। কাছে গিয়ে বললাম, ‘কাছাকাছি কোনও শুঁড়িখানা আছে?’ শুনেই তার চোখদুটো চকচক করে উঠল। বলে, ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। চলুন নিয়ে যাচ্ছি।’ আমি বললাম, ‘চলো তাহলে দু’জন মিলে দু’পাত্তর খাওয়া যাক।’ শুঁড়িখানায় গিয়ে মদ কিনে ব্যাটাকে খানিক খাওয়াতেই হড়বড় করে সবকথা বলে ফেলল। মালিকের সব কেচ্ছার গল্প শুনতে হল বসে বসে। শেষে বলে মালিক নাকি কোথায় যাবার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন, কিন্তু জ্যোতিষী বাধা দিয়েছে। বলে দিন ভালো নয়। ওঠবার আগে তার মুখ থেকে জ্যোতিষীর হালহদিশ জোগাড় করে নিলাম। লোকটার নাম শিবনাথ। কাছেই একটা মন্দিরে থাকে।”

“শিবনাথকে আমি দেখেছি,” আমি জানালাম, “বেশ তাগড়া চেহারা। ভালো ঠগি হতে পারত এ-পথে এলে।”

“আপনি আবার শিবনাথকে কোথায় দেখলেন?”

আমি তখন লালুকে সন্ধেবেলার গল্পটা বললাম। শেখ আর শিবনাথের কথোপকথন নকল করেও দেখালাম। শুনে-টুনে লালু বলে, “মন্দির খুঁজে বের করে শিবনাথকে গিয়ে ধরে বললাম, ‘আমার বাচ্চাটার জন্য একটা মাদুলি দিন।’ লোকটা আমার দিকে এমন দৃষ্টিতে চাইল, যে আমার রক্ত জমে যাবার জোগাড়। কী সাংঘাতিক দৃষ্টি! এমনভাবে দেখছে যেন আমার সব গোপন কথা পড়ে ফেলছে। খানিক সেইভাবে আমায় দেখে নিয়ে বলে, ‘চলো আমার সঙ্গে। গোপনে কথা আছে।’ গলার আওয়াজটা অবশ্য বেশ নরম। তাইতে আমার সাহস বাড়ল একটু। মন্দিরের সামনে আমায় নিয়ে গিয়ে বলে, ‘জুতো খুলে ভেতরে এসো। এ জায়গাটা নোংরা করবে না।’ সেখানে গিয়ে বসে ফের দেখি আমায় ওইরকম দৃষ্টিতে দেখছে। কী করব ভাবছি, তখন লোকটা হঠাৎ আমাদের ঠগিদের সংকেত-বাক্যটা বলে উঠল।”

“ঠগিদের সংকেত-বাক্য?”

“হ্যাঁ মীরসাহেব। শুনে প্রথমে আমিও চমকে উঠেছিলাম। কিন্তু একটু পরেই সব বোঝা গেল। আমাদের ঠগিদের সবচেয়ে পুণ্য তীর্থ বিন্ধ্যাচলের পুরুত লোকটা। বেনারসে গিয়ে জ্যোতিষবিদ্যা শিখে এখানে এসে কারবার ফেঁদে বসেছে। হাত গুণে ভালো রোজগার হচ্ছে বলে আর এদেশ ছেড়ে যায়নি। এর কাছে আর লুকোবার কী আছে? আমি আমাদের মতলবটা সব খুলে বললাম। শুনে প্রথমে তো কিছুতেই রাজি হয় না। শেষে পাঁচ আশরফি নজরানা দিতে সুর বদলাল। গ্রহ-নক্ষত্রের কথাবার্তা পালটে দিয়ে তক্ষুনি উঠে রওনা দিল শেখকে বুঝিয়ে দিয়ে আসতে।”

“সে কাজটা বামুন ভালো করেই করেছে। আমাদের ঠকায়নি।” আমি বললাম।

“সে তো করেছে। কিন্তু টাকা চাইছে যে অনেক! শেষে খবর দেবার জন্য যা পাওনা হয় তার সঙ্গে একজন ভুত্তোটের ভাগে কাজটা থেকে যত টাকা আসবে সেই পরিমাণ জুড়ে দেব বলে রাজি করিয়েছি।”

“তাতে খুশি হয়েছে তো?”

“সে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। দেখলেন না শেখকে কেমন বুঝিয়ে দিয়ে এল? তাছাড়া বিন্ধ্যাচলের পুরুত ঠগিদের কাছে কবে কথার খেলাপ করেছে বলুন তো?”

“কিন্তু কাজ হয়ে গেলে টাকাটা পৌঁছোব কীভাবে?”

“সেকথাও হয়ে গেছে। ভাগের টাকাটা একটা হুন্ডি করে লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই হবে।”

“ঠিক আছে। এখন দলের লোকজনদের গিয়ে তৈরি করো। সবাই সাবধান। ভালো বুনিজ। খেলিয়ে তুলতে হবে ঠিকমতো। আর মন্দিরটা কোথায় বলতে পারবে? আমি তাহলে একবার গিয়ে দেখা করে আসতাম। এমন একজন উপকারী মানুষ!”

“যেতে হবে না মীরসাহেব। আমি বলেছিলাম, কিন্তু উনি বললেন, আপনার অনেক নামডাক উনি শুনেছেন বটে কিন্তু বেশি দেখাসাক্ষাত করতে গেলে পরে কখন কী ঝামেলা হয়, তার চেয়ে দেখা-টেখা বেশি না করাই ভালো।”

।৪৩।

শেখকে সঙ্গে নিয়ে মূল রাস্তা এড়িয়ে আমাদের চেনা নানান গলিঘুঁজি দিয়ে আমরা দিনচারেক এদিক সেদিক করে পথ চললাম। উদ্দেশ্য ছিল যাতে পরে কেউ আমরা কোথা দিয়ে গেছি ধরতে না পারে। চতুর্থ দিনের শেষে আমরা যেখানটাতে এসে পৌঁছোলাম, সেখান থেকে খানিক দূর গেলেই একটা ঘন জঙ্গল পড়ে। ঠিক করে নিলাম পরদিন ওই জঙ্গলের মধ্যেই শেখকে নিকেশ করে দেব।

পরদিন আমরা সকাল সকাল রওনা হয়ে গেলাম। খানিক দূর পথ চলে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতে যাব, এমন সময় আমার ঘোড়ার সামনে দিয়ে কী একটা চলে গেল। তাকিয়ে দেখি আবার একটা খরগোশ আমার সামনে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। এ-দৃশ্য দেখলে আতঙ্কে বড়ো বড়ো ঠগি সর্দারই বুনিজ ছেড়ে ঊর্ধশ্বাসে পালাবে। এত বড়ো দুর্লক্ষণ আমাদের মতে আর দুটো হয় না। কিন্তু আমি শুধু মনে মনে হাসলাম একটু। এর আগেও খরগোশ দেখেছি আমি কাজের আগে। কোনও অসুবিধেই হয়নি। বিনা কারণে ভয় পাবার মানুষ আমীর খান নয়। ক্রোশ দুয়েক যাবার পর একটা ঠিকঠাক জায়গা দেখে শেখ আর তার সঙ্গে আসা দু’জন লোককে আমরা পরলোকে পাঠিয়ে দিলাম। তার একটা লোক অবশ্য লড়েছিল। আনন্দী নামে আমার দলের একটা লোকের গলায় কোপ মেরে শুইয়ে দিয়েছিল, কিন্তু আর কোনও ক্ষতি করবার আগেই তাকে কয়েকজন মিলে ধরে শেষ করে দেয়।

কাজ মিটে গেলে সমস্যা হল আনন্দীকে নিয়ে। তার চোটটা খুব খারাপ। শেষ অবধি বাঁচবেও না হয়তো। খুব কষ্ট পাচ্ছিল বেচারা। কিন্তু সেই জঙ্গলের মধ্যে তাকে নিয়ে তখন কিছু করবারও উপায় নেই। পরের গ্রাম অবধি বয়ে যে নিয়ে যাব তারও উপায় ছিল না। তলোয়ারের কোপ খাওয়া মানুষ দেখলে লোকের সন্দেহ হতই। আর, এত বড়ো দল ডাকাতের খপ্পরে পড়েছিলাম সেকথাটাও বলা যেত না। শেষে লালুর সঙ্গে পরামর্শ করলাম ব্যাপারটা নিয়ে। সে বলে, এর কষ্টের শেষ করে দিন মীরসাহেব। তাহলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তবে দলের লোকজন না দেখে ফেলে আবার। দলের বেশিরভাগ লোকজই ততক্ষণে জায়গাটা ছেড়ে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। যে ক’জন ছিল তারাও সবাই শেখ আর তার লোকজনকে কবর দিতে ব্যস্ত। আমি সেই ফাঁকে তলোয়ার খুলে আনন্দীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে ওই অবস্থাতেই হাতজোড় করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আমি আমার কর্তব্যে তখন অটল। এক কোপে তার সব দুঃখের ইতি করে দিলাম। তারপর তার টাকাপয়সাগুলো বের করে নিয়ে পরনের ধুতিটা দিয়ে তার শরীরটা মুড়ে লুগাইদের কাছে বয়ে নিয়ে গেলাম। কবরের গর্তটা তখন প্রায় ভরে উঠেছে। তারা কাজ করতে করতেই বলে, “আনন্দী আর বাঁচল না বুঝি। আহা যা কোপ খেয়েছিল, তারপরে আর না বাঁচবারই কথা।”

পরের গ্রামে পৌঁছে টুপুনির গুড় খেয়ে শেখের বাক্স খুলে প্রায় পঁচিশ হাজার টাকার মুক্তো পাওয়া গেল। রাজার জন্য সেই মালাটা ছাড়াও সে আরও একগাদা দামি দামি মুক্তো নিয়ে চলেছিল সঙ্গে।

এরপর আমরা আর দেরি করলাম না। যত তাড়াতাড়ি বাকি রাস্তা শেষ করে ঝালোনে গিয়ে উঠলাম। বাবা সেখানে অনেকদিন আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। বলল, পথে নাকি আর বিশেষ কোনও কাজকর্ম হয়নি তার।

ফের একবার আজিমাকে আর আমার মেয়েটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বড়ো শান্তি পেলাম আমি। শুধু গণেশ আর তার দলবল তখনও ফেরেনি। শুনলাম, সে নাকি বেনারসের দিকে গিয়েছে। তার ওপর আমার সেই মুন্সির ছেলেটাকে মারা নিয়ে রাগ তখনও যায়নি। ঠিকই করে রেখেছিলাম, সুযোগ পেলেই তার একটা বদলা আমি নেব।

এরপর বেশ কয়েক মাস বেশ শান্তিতে কাটিয়ে দিলাম আমি। তবে সে শান্তি যে ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতা সে কথা তখন আমার বোঝবার কোনও উপায় ছিল না। ঠিক করেছিলাম, ঠগিবৃত্তি আমি একেবারেই ছেড়ে দেব। আর বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো নয়।। এবারে সুখী গৃহস্থ হয়েই বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দেব আমি। আসলে আজিমাকে আমার খুব ভয় লাগতে শুরু করেছিল হঠাৎ। অনেক সময় মাঝরাতে সে যখন আমার বুকে নিশ্চিন্তে মাথা রেখে ঘুমোত তখন ভেতরে ভেতরে আমার বুকটা কাঁপতে থাকত। যদি আজিমা কখনও ঘুণাক্ষরেও জানতে পেরে যায় যে তার স্বামী একটা খুনে ঠগি, তাহলে কী ভীষণ ভয় পাবে সে! পালিয়ে যাবে, ঘেন্নায় লজ্জায় ভয়ে মরে যাবে একেবারে। না না, এখানে আর নয়। ঠিকই করে নিয়েছিলাম, মেয়েটার বিয়ে মিটে গেলে সবসুদ্ধু নিয়ে একেবারে দিল্লিতে গিয়ে উঠব। সেখানে নতুন দেশ, কেউ আমাদের চিনবে না, সেই বেশ হবে।

কিন্তু নিয়তিকে কে আটকাবে? আমি যখন নিশ্চিন্তে বাড়িতে বসে এইসব ভাবছি আর মেয়ের বিয়ের যোগাড়যন্ত্র করছি, তখন এক ফিরিঙ্গি সাহেব কয়েকদিনের জন্য আমাদের রাজার কাছে এসে থেকে গিয়েছিল। দু’জন মিলে অনেক গুজুরফুসুর করল ক’দিন ধরে। লোকে জানল, রাজা ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে একটা আঁতাতে আসতে চাইছেন তারই ব্যাপারে কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে অন্য ছিল। ফিরিঙ্গিরা এই অঞ্চলের ঠগিদের একটা মারণ মার দিতে চাইছিল যাতে তারা আর কোনওদিন মাথা তুলতে না পারে। এসব ছিল তারই প্রস্তুতি।

ঝড়টা এল আমার মেয়ের বিয়ের দিন। সেদিন সকাল থেকে আমরা সবাই খুব ব্যস্ত। বাড়িতে লোকজন গমগম করছে। হাসিঠাট্টা কাজেকর্মে সবাই খুব আনন্দে আছে, এমন সময় দুপুরবেলা রাজবাড়ির পেয়াদা এসে বলে আমাকে আর বাবাকে দরবারে ডাকছে। এক্ষুনি যেতে হবে। কী এক জরুরি পরামর্শ আছে নাকি। তাকে বারবার বললাম, আজ বাড়িতে মেয়েটার বিয়ে, আজকের দিনটা যেতে দাও। তারা কিন্তু নাছোড়বান্দা। শেষে নিরুপায় হয়ে ভালো জামাকাপড় পরে রাজবাড়িতে চললাম।

রাজা দরবারে মুৎসুদ্দি আর সেপাইসান্ত্রী নিয়ে বসে ছিলেন। যেই না ঢুকেছি, সঙ্গে সঙ্গে দু’পাশ থেকে কতকগুলো সেপাই এসে আমাদের দু’জনকে চেপে ধরে আমাদের অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিয়ে, মাথার পাগড়ি ছিঁড়ে ফেলে দড়িদড়া দিয়ে বেঁধে ফেলল আমাদের। সে বাঁধন এত শক্ত যে মনে হচ্ছিল হাত ফেটে রক্ত বের হয়ে আসবে আমাদের। অনেক ধ্বস্তাধ্বস্তি করেও তাদের ছাড়াতে পারলাম না যখন তখন ভাগ্যের হাতে নিজেদের ছেড়ে দিলাম আমরা। ভবানী ও আল্লাহর যদি এই ইচ্ছেই হয় তাহলে আমি প্রতিবাদ করবার কে?

আমি শান্ত হয়েছি দেখে রাজা বললেন, “ওহে আমীর খান, এ কী ভয়ানক কথা শোনা যাচ্ছে হে? তুমি নাকি ঠগি? আরে ছি ছি, এতদিন তোমায় তো ভালো লোক বলেই জানতাম। সেই তোমার নামেই কিনা মানুষ মারার নালিশ? বলো, তোমার কী বলার আছে শুনি।”

আমি বললাম, “ঈশ্বর সাক্ষী মহারাজ, এসব একেবারে মিথ্যে কথা। কোনও বদমায়েশের চক্রান্ত এসব। আপনার কানে বিষ ঢেলেছে আমাদের নামে। আপনার রাজত্বের একটা লোক এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলুক দেখি এতকাল ধরে আমায় যে দেখছে কোনওদিন কারও সঙ্গে একটা খারাপ ব্যবহার পর্যন্ত করেছি কি না? সেই আমাকে আর আমার বুড়ো বাবাকে আমার মেয়ের বিয়ের দিনে এমন অপমানটা করতে পারলেন আপনি?”

মহারাজ মাথা নেড়ে বললেন, “আরে আমিও তো তাই জানতাম। এখন লোকে এসে উলটোপালটা নালিশ করলে আমার আর কী করার আছে? প্রমাণও আছে নাকি তোমার বিরুদ্ধে। কই হে, সাক্ষীসাবুদ কারা কারা আছে সব ডাকো দেখি! একে একে এসে যা বলার বলে যাক এদের সামনে। এতে আর অত লুকোছাপার কী আছে?”

আমি একবার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। মুখটা দেখে কষ্ট হচ্ছিল আমার। এতদিন ধরে হাজার বিপদে যাকে অবিচল দেখেছি সেই মানুষটাই আজ ভয়ে কেমন যেন কুঁকড়ে গেছে। আমার দিকে কেমন মরা দৃষ্টিতে একবার তাকাল শুধু।

নকিবের ডাক শুনে যে লোকটা সভার মধ্যে এসে দাঁড়াল তাকে দেখেই আমি বুঝলাম আর আমাদের রক্ষা নেই। লোকটার নাম সূরজ। ছোটোবেলা থেকেই বাবার কাছে কাজ করতে দেখেছি ওকে। আমার ঠগিধর্মে দীক্ষার দিন থেকে থেকে শুরু করে পিণ্ডারি অভিযানের আগে পর্যন্ত সবকটা অভিযানে ও আমাদের সঙ্গে ছিল। দীর্ঘক্ষণ ধরে সভায় দাঁড়িয়ে ও আমার সমস্ত অভিযান আর মানুষ মারার ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিল। কোথায় কোথায় মানুষ মেরে লুকিয়ে রেখেছি, কোন অভিযানে কত টাকা পেয়েছি তার খুঁটিনাটি সমস্ত ও খুলে বলল সেখানে দাঁড়িয়ে। তারপর বলে, “এরা বাপ ছেলে বুন্দেলখণ্ডের সবচেয়ে ভয়ানক ঠগি সর্দার। চাইলে একদিনের মধ্যে দু-তিনশো ঠগি জুটিয়ে নিয়ে পথে বের হয়ে পড়বার ক্ষমতা ধরে।” সবশেষে বাবার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলে, “এই বুড়োটাকে দেখুন মহারাজ। সারাজীবনে কত মানুষের প্রাণ নিয়েছে এ তার কোনও হিসেব নেই। এখন এই বুড়ো বয়সে পীরফকিরের মতো হাবভাব বানিয়েছে। কিন্তু ঠগিবৃত্তি ছাড়েনি। ভাবছেন এখানে ধর্মকর্ম নিয়ে থাকে? না মহারাজ। মাস দুয়েক আগেও এ বিরাট একটা ঠগি অভিযান চালিয়ে অনেক ধনরত্ন লুট করে ফিরেছে, আর ফেরার পথে শেষ যে শিকারটা করেছে সে আপনারই এক বিশ্বস্ত প্রজা।”

মহারাজ চমকে উঠে বলেন, “আমার প্রজার গায়ে হাত? কী সাংঘাতিক! বল, বল, খুলে বল সব। ভয় পাস না।”

সে মাথা নেড়ে বলল, “ভয় আমি পাই না মহারাজ। ভয় পেলে এই দুই সাক্ষাৎ যমদূতের সামনে দাঁড়িয়ে এতগুলো কথা বলতেই পারতাম না। শুনুন তাহলে। আপনার প্রজা সাহুকার যশোবন্ত মলকে চেনেন তো?”

রাজা উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, “কী বলছ তুমি? যশোবন্ত মল! কিন্তু সে তো…”

“না মহারাজ। লোকে জানে সে এখন সাগরে আছে। কিন্তু আসলে এই বুড়োটার দলের ভুত্তোট তাকে গলায় রুমাল দিয়ে মেরেছে, আর বুড়ো তখন পাশে দাঁড়িয়ে তাই দেখতে দেখতে হেসেছে। এ খুনটা আমি নিজে চোখে দেখিনি। কিন্তু সাক্ষী আছে। তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে নিতে পারেন।”

গোটা সভায় তখন যেন একটা ছুঁচ পড়লেও শোনা যাবে। মহারাজ দেখা গেল বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। বলেন, “তুই নিজে তো দেখিসনি। তাহলে…”

ক্রমশ

টাইম মেশিন সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s