টাইম মেশিন ঠগির আত্মকথা অলবিরুণী বসন্ত ২০২০

আগের পর্বগুলো

।৪৫। 

লোকগুলোকে যথাসময়ে মেরে বেশ ভালোই রোজগার হল আমার। এদের সঙ্গে চলতে চলতে ঝালোনের কাছাকাছি এসে গিয়েছিলাম ফের। ঠিক করলাম, ছদ্মবেশে সেখানে ঢুকে মোল্লার কাছে আমার মেয়ের দেখভালের জন্য আমার লুকিয়ে রাখা টাকাপয়সা সব দিয়ে আসব। শুনে হুরমত বলে, সেও যাবে সঙ্গে। বাকি দলটাকে কল্পি-তে পৌঁছে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে বলে আমরা দু’জন ঝালোনের দিকে রওনা হয়ে গেলাম।

গোঁসাইয়ের ছদ্মবেশ নিয়েছিলাম আমরা দু’জন। সারা গায়ে ছাই-কাদা মেখে, কোমরের সঙ্গে একটা করে লাউয়ের খোলা বেঁধে নিয়ে দু’জন মিলে গিয়ে ঢুকলাম ঝালোন শহরে। একসময় কত প্রিয়ই না ছিল আমার কাছে জায়গাটা। কিছুদিন আগে এইখানে বসেই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর ঠগিধর্ম নয়, এবারে সংসারধর্ম পালন করব আমি। আজ ভিখিরির সাজে সেই শহরের বুকে দাঁড়িয়ে বারবার শুধু মনে হচ্ছিল, কী অবাস্তবই না ছিল আমার সেই প্রতিজ্ঞা! হাস্যকর একটা স্বপ্ন!

নিজের বাড়িটার ধ্বংসস্তূপের পাশ দিয়ে যেতে যেতে আমার বুকের ভেতর তোলপাড় চলছিল, কিন্তু বাইরে আমি তার একবিন্দু প্রকাশ পেতে দিলাম না। শহরের দরজার বাইরে একটা কুয়োর কাছে গিয়ে বসলাম দু’জন। যেখানে আমার টাকাপয়সা পোঁতা রয়েছে, এ জায়গা থেকে সেটা বেশি দূরে নয়।

সন্ধের মুখমুখ কাছের একটা কবরখানায় গিয়ে ঢুকলাম আমি। চারপাশে গজিয়ে অঠা আতা-ঝোপ আর বুনো ঘাসে জায়গাটা অন্ধকার হয়ে আছে। যে কবরটার মধ্যে আমার টাকাপয়সা পুঁতে রাখা রয়েছে তার কাছাকাছি যেতেই বুক দুরদুর শুরু হয়ে গেল আমার। যদি কেউ টের পেয়ে গিয়ে টাকাপয়সাগুলো তুলে নিয়ে গিয়ে থাকে? মেয়েটা তো আমার পথের ভিখিরি হয়ে যাবে তাহলে! সঙ্গে করে নিয়েও তো যেতে পারব না। নিয়ে গেলে যে মানুষ মারার খেলা তাকে প্রতি মুহূর্তে সহ্য করতে হবে। তার চেয়ে ভিখিরি হয়ে জীবন কাটানোও শ্রেয়।

কবরটাকে খুঁজে বের করে তার ওপরের একখানা পাথর সরিয়ে ফেললাম আমি। তারপর তার ভেতরে রাখা মাটির হাঁড়িটাকে অক্ষত দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম একটা। তাড়াতাড়ি হাঁড়িটা নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে একটা ঝোপের ভেতরে গিয়ে বসে তার মুখের ঢাকনা খুললাম। কী কী রেখেছিলাম তার মধ্যে সেসব আমার মনেও ছিল না ভালো করে। এখন হাঁড়ির মুখ খুলে যা দেখলাম তাতে আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। ত্রিশটা আশরফি, চারটে সোনার বাঁট, দু-ছড়া মুক্তোর মালা আর একটা ন্যাকড়ার পুঁটুলিতে বাঁধা কিছু দামি পাথর। ঠিক করলাম পাথরগুলো রেখে দেব। ওর দাম কম করে হাজার টাকা হবে, কিন্তু রেখে দিলে পরে কখনও রত্নব্যবসায়ীর ছদ্মবেশ ধরতে হলে কাজে এসে যাবে।

ফিরে এসে হুরমতকে সবকথা বলতে সেও খুব খুশি হল। সন্ধেবেলা অন্ধকার নামবার পর তাকে রেখে আমি একাই শহরের ভেতরে গিয়ে ঢুকলাম। মোল্লাসাহেবের আস্তানায় পৌঁছে হায়দরাবাদের মৌলা আলি ফকিরের নাম করে ভিক্ষা চেয়ে ডাক দিলাম বাইরে থেকে। বাইরে থেকে বারান্দায় মোল্লাসাহেবকে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছিল। হাঁক দিতে-দিতেই আমি দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। মোল্লাসাহেব তখন একমনে দুলে দুলে কোরান পড়ছিলেন। আমি গিয়ে তাঁর সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে তিনি চোখ তুলে তাকালেন।

আমায় দেখে একটু সন্ত্রস্ত হয়ে বলেন, “পীরফ-ই-খুদা! গোঁসাই হয়ে তুমি আমায় প্রণাম করছ কী মনে করে? আমায় তো তুমি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে গোঁসাই!”

আমি বললাম, “মোল্লাজি, আমি জীবন বিপন্ন করে ছদ্মবেশে আপনার কাছে এসেছি। আপনি আমাকে এই বেশে চিনতে পারবেন না। একটু ধৈর্য ধরে আমার কথাটা শুনুন।”

তিনি একটু চুপ করে থেকে তারপর বললেন, “একজন হিন্দু হয়ে মুসলমান মোল্লার বাড়ি এসেছেন—আপনাকে আমি চিনি না বটে, কিন্তু বলুন আপনার কী বলবার আছে।”

আমি বললাম, “আপনার সঙ্গে কিছু গোপন কথা আছে আমার। ভয় পাবেন না, আপনার কোনও ক্ষতি করতে আমি আসিনি। আমি হিন্দু নই। আমি আপনারই মতন একজন মুসলমান।”

তিনি মৃদু হেসে বললেন, “ভয় আমি পাইনি। আমার মতো একজন বুড়ো মোল্লার কে কী ক্ষতিই বা আর করতে পারে বলো! তবে হ্যাঁ, গোপন কথা বলবে বলছ যখন, তাহলে দাঁড়াও আমি দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিয়ে আসি আগে।”

একটু পরে বাড়ির দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে খিল আটকে দিয়ে ফিরে এলেন মোল্লাসাহেব। আমি বললাম, “ভালো করে চেয়ে দেখুন তো, আমায় চিনতে পারেন কি না।”

মোল্লাসাহেব আমার মুখের দিকে নিবিষ্ট চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তোমার গলার স্বরটা আমার চেনা ঠেকছে বটে, কিন্তু তোমায় কোথাও দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না। কে তুমি?”

আমি বললাম, “আমার আসল নাম ঝালোনে কেউ উচ্চারণ করে না। আমি আমীর আলি।”

মোল্লা তাঁর আসনের এককোণে সরে গিয়ে ভীত গলায় বলে উঠলেন, “পনাহ্‌-ই-খুদা! তুমিই তাহলে সেই খুনে ডাকাত!”

“হ্যাঁ মোল্লাজি, আমি খুনে, আমি ডাকাত, সেসব কথাই ঠিক। কিন্তু আমার কাছ থেকে আপনার ভয় পাবার কোনও কারণ নেই। আমার বুকের একটা পাঁজরাকে আপনি আশ্রয় দিয়েছেন। আমার মেয়েটা—কেমন আছে সে? বেঁচে আছে তো?”

“তুমি পাগল হয়ে গেছ আমীর আলি!” বলতে বলতে মোল্লাসাহেবের গলা কাঁপছিল, “এইভাবে কেউ আসে? তুমি জানো না, ধরা পড়লে তোমাকেও তোমার বাবার দশা করবে?”

“জানি মোল্লাসাহেব। ভালো করেই জানি। কিন্তু আমার মেয়েটার শুধু একটু খবর পাবার জন্য আমি সে বিপদ একবার নয়, হাজারবার মাথায় তুলে নিতে পারি। শুধু একবার বলুন, সে ভালো আছে তো?”

“দুর্ভাগা! তোমার পাপের পুরষ্কার তুমি পেয়েছ। সেকথা আমি আর তুলব না। শুধু জেনে রাখো, মেয়ে তোমার ভালোই আছে। কিন্তু এখনও সে তোমার জন্য আর তার মায়ের জন্য বড়ো দুঃখে আছে। তার মা চলে গেছেন, সে একরকম ভালোই হয়েছে। তিনি পুণ্যবতী ছিলেন। ঈশ্বর তাই তাঁকে দয়া করেছেন। এই দুঃখ আর অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে তাঁকে চলতে হবে না আর।”

“ইয়া খুদা! আল্লা আমায় এত পাপের পরেও এই শাস্তিটা দেননি তাহলে! আচ্ছা মোল্লাজি, সে আমার কথা এখনও মনে করে?”

“করে, আমীর আলি। কিন্তু তাকে বলেছি, তুমিও মারা গেছ। তোমায় আর কোনওদিন সে দেখতে পাবে না।”

“ঠিকই করেছেন আপনি। অভাগা মেয়েটাকে আপনি যে দয়া করেছেন, আমার এই পাপ হাতে আমি তার প্রতিদান দিতে পারব না, তবে প্রার্থনা করি আল্লা যেন তার উপযুক্ত প্রতিদান আপনাকে দেন। এখন আপনাকে একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে আমার কাছে। না না, আমার কথাটা শোনবার আগেই প্রতিজ্ঞাটা আপনাকে করতে হবে মোল্লাজি, আমার মেয়েটার জন্য এই একটাই শেষ অনুরোধ আমি আপনাকে করব। তারপর আর কোনওদিন আপনাকে আমার মুখ দেখাব না আমি।”

মোল্লাজি ম্লান হেসে বললেন, “যা বলার আছে বলে ফেলো, আমীর আলি। কথা আমি তোমায় কিছু দিচ্ছি না। কত হাজার হাজার বুদ্ধিমান মানুষকে তুমি ঠকিয়েছ এতকাল, সে বিদ্যায় এই বৃদ্ধ মোল্লা তো তোমার কাছে শিশু।”

“তাহলে শুনুন, মোল্লাজি। কাছেই একটা জায়গায় আমার কিছু টাকাপয়সা, সোনাদানা পোঁতা ছিল। বেশি কিছু নয়, কিন্তু যা আছে সেটুকুই আমি আপনার কাছে দিয়ে যেতে চাই। ওতে আমার মেয়ের খরচখরচা চালিয়ে তার বিয়ের খরচও উঠে যাবে আপনার।”

হঠাৎ মেরুদণ্ড টানটান করে উঠে দাঁড়ালেন মোল্লা। বললেন, “মানুষের রক্ত-লাগা টাকা এই মোল্লার বাড়িতে ঢুকবে না, আমীর আলি। ওতে মরা মানুষের অভিশাপ লেগে থাকে। ও তুমি তোমার কাছেই রাখো। ও টাকায় সৎপথে জীবন চালিয়ে যদি তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত কিছুটা হলেও করতে পারো, সেই চেষ্টা করো।”

“মাপ করবেন মোল্লাজি। ও-টাকা আমার পাপের রোজগার নয়। আমার স্ত্রীর সম্পত্তি। দক্ষিণ থেকে আসবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। তা না হলে পাপের টাকা দিয়ে আমার মেয়ের জীবনটাকেও বিষিয়ে দেবার কথা আমি ভাবতেও পারতাম না।”

“কোরান ছুঁয়ে শপথ করে একথাটা তুমি বলতে পারবে? তাহলে তোমার কথা বিশ্বাস করব আমি। নচেৎ নয়।” বলতে বলতে আমার হাতে কোরানটা তুলে দিলেন তিনি।

বইটা ঠোঁটে ছুঁইয়ে, কপালে ও চোখে ঠেকিয়ে নিয়ে আমি অক্লেশে মিথ্যে শপথটা করে ফেললাম। নিজের মেয়ের জন্য করছি, ওতে আমার কোনও গ্লানি ছিল না। তারপর বইটা নামিয়ে রেখে বললাম, “এবার বিশ্বাস করবেন তো মোল্লাজি?”

“করলাম। তোমার টাকার সদ্বব্যবহার হবে সে ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। টাকাপয়সা কি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ?”

“না। এইবারে গিয়ে নিয়ে আসব।” এই বলে তাড়াতাড়ি বের হয়ে গিয়ে মাটির হাঁড়িটা নিয়ে এসে আমি মোল্লাসাহেবের সামনে সেটা উপুড় করে দিয়ে বললাম, “এই যে। আমার যা কিছু ছিল তার সবটাই আমি আপনার কাছে গচ্ছিত করে রেখে গেলাম। এইবার একটা ভিক্ষা আছে। আমায় এক্ষুনি বহুদূরে চলে যেতে হবে। আর তো কখনও ফিরে আসব না, তাই যাবার আগে মেয়েটার মুখটা একবার দেখে যাবার বড়ো ইচ্ছে ছিল। আমায় আপনি মানা করবেন না, মোল্লাজি।”

“না। মানা করব না, আমীর আলি। সে এখন আমার অন্দরমহলে পড়শির মেয়েটার সঙ্গে খেলছে। এসো আমার সঙ্গে। মনে রেখো, শুধু একটা ঝলক। তার বেশি নয়। তারপর থেকে ও আমার মেয়ে, তোমার আর কেউ নয়।”

উঠোন পেরিয়ে অন্দরমহলের দরজার কাছে আসতে ভেতর থেকে দুটো মেয়ের হইচইয়ের আওয়াজ কানে এলো। তার মধ্যে থেকে আমার মেয়েটার সুরেলা গলাটা আমি ঠিকই চিনে নিতে পারছিলাম। একেবারে ওর মায়ের গলার শব্দের মতো। ও আমি যতদিন বেঁচে থাকব, হাজার গলার মধ্যেও ঠিক চিনে নিতে পারব।

দরজার আড়াল থেকে সন্তর্পণে উঁকি দিলাম আমি ভেতরে। ওই তো আমার মেয়েটা! বন্ধুদের সঙ্গে হেসে হেসে খেলা করছে। দুবলা পাতলা চেহারা। সবার সঙ্গে মিলেমিশে দিব্যি সুখে আছে। ইচ্ছে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে এই শেষ একবারের মতো ওকে বুকে জড়িয়ে ধরি। অনেক কষ্টে সে ইচ্ছেটা দমন করলাম আমি। এই ছদ্মবেশে আমায় চিনতে পারবে না বেচারা। মিছিমিছি ওকে ভয় পাইয়ে কী লাভ? অনেক কষ্টে নিজেকে সেখান থেকে সরিয়ে এনে আমি দরজা ছেড়ে সরে এলাম। আহা, ভালো থাক, সুখে থাক মেয়েটা। ও যে বেঁচে আছে, ভালো আছে, এইটুকু সান্ত্বনা নিয়েই আমি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব।

বারবাড়িতে এসে মোল্লাকে আরেকবার কদমবুশি করে বললাম, “আমি তাহলে আসি। মেয়েটার যত্ন নেবেন। আল্লা আপনার মঙ্গল করবেন। যার সঙ্গে ওর বিয়ে দেবেন সে যেন ওর বাপের খবর কখনও না জানতে পায় এইটুকু প্রার্থনা থাকল আপনার কাছে।”

মোল্লার বাড়ি ছেড়ে চলে আসবার পর হাঁটতে হাঁটতে আমার বাড়িটার ধ্বংসস্তূপটার পাশে পৌঁছে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না আমি। এতক্ষণ যেটুকু মনের জোর ছিল, চোখের জলে সেই সবকিছুই একেবারে ভেসে গেল এবারে। যেখানটায় বাড়ির দরজা ছিল সেইখানটাতে মাটির ওপর বসে পড়লাম। মুখ দিয়ে কোনও আওয়াজ বের হচ্ছিল না আমার। শুধু বন্ধ দুটো চোখ থেকে অনর্গল উষ্ণ জলের স্রোত বয়ে নামিছিল আমার দু’গাল বেয়ে। টপটপ করে ঝরে পড়ছিল আমার সামনের মাটিতে। কত সুখের স্মৃতি মিছিল করে চলেছিল আমার বন্ধ চোখের সামনে দিয়ে! একটা সুখের স্বপ্নই ছিল যেন সবকিছু। ঘুম ভাঙতে স্বপ্নের মতোই কোনও চিহ্ন না রেখে হারিয়ে গেল। জেগে উঠে দেখলাম, দুনিয়ায় আমি একেবারে একা। কেউ নেই আমার। কোনও আশা নেই, কোনও স্বপ্ন নেই। আমার ভালো থাকায় বা মন্দ থাকায় আর দুনিয়ায় কারও কিছু যাবে-আসবে না কোনওদিন।

হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। এখানে এইভাবে বসে থাকাটা বিপজ্জনক হতে পারে। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, রাত গভীর হয়েছে। শেষবারের মতো আমার একসময়কার সব আনন্দের সব আশার উৎস সেই বাড়িটার ধ্বংসস্তূপের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে আমি তাড়াতাড়ি পা চালালাম। শহরের দরজা তখন বন্ধ হতে যাচ্ছে। একেবারে শেষমুহূর্তে সেখানে পৌঁছে শহর থেকে বের হয়ে গেলাম আমি।

কল্পিতে পৌঁছে আলোচনা করে ঠিক হল, নৌকা ভাড়া করে নিয়ে আমরা লক্ষ্ণৌ চলে গিয়ে আস্তানা গেড়ে বসব। সেখানে তখনও রাজসরকারের শাসনের তত কড়াকড়ি নেই। শহরটাও ছড়ানো। ভালো কাজকর্ম পাবার আশা থাকবে। সেইমতো নদীপথে লক্ষ্ণৌতে গিয়ে ঘাঁটি গাড়া হল। কাজকর্ম শুরুও হয়েছিল ভালোই। বিভিন্ন সরাইখানার দারোয়ানগুলোকে হাত করে সে শহর ছেড়ে দূরদেশ থেকে আসা যাত্রীদের খবর নিয়ে তাদের ফাঁদে ফেলে দু-মাসের মধ্যে প্রায় ত্রিশখানা শিকার সেরে ফেললাম আমরা। টাকাপয়সাও আসছিল প্রচুর। কিন্তু এত সৌভাগ্য বেশিদিন সইল না আমাদের। হঠাৎ করেই ধরা পড়ে গেলাম একদিন আমরা।

লক্ষ্ণৌয়ের রাস্তায় আমাদের পুরনো এলাকা মুরনির এক বুড়ো ভুত্তোটের সঙ্গে দেখা। আমায় সে ছোটবেলা থেকে চেনে। ভারি সাফ হাত। দেখামাত্র তাকে আমাদের দলে ভর্তি করে নিয়েছিলাম। লক্ষ্ণৌ পৌঁছোবার পর এক শুক্রবার সাতজন যাত্রীর একজটা দলকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে শহরের বাইরে গেছি আমরা ষোলোজন ঠগির একটা দল। বুড়োও সেদিন আমাদের দলে ছিল। তাদের নিয়ে ক্রোশ চারেক দূরে আমাদের পছন্দের একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে যখন মারা হচ্ছে তখন হঠাৎ ঘোড়সওয়ার সৈনিকের একটা দল নিঃশব্দে এসে আমাদের ঘিরে ফেলল। আসলে পরপর সাফল্যের ফলে আমাদের একটু আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছিল। ফলে নজরদার মোতায়েন না করেই কাজটা শুরু করে দিয়েছিলাম আমরা। তার জন্যই এই বিপত্তি। আমরা ন’জন ধরা পড়ে গেলাম। বাকিরা পালাল। আমাদের শিকারের মধ্যে দু’জন তখনও বেঁচে ছিল। তাদের সেবাশুশ্রূষা করে খানিক ঠিক করতে তারা গড়গড় করে সব কথা বলে দিল। কী করে আমরা সরাইখানায় গিয়ে তাদের কথায় ভুলিয়েছি, কী করে তাদের সঙ্গে নিয়ে সেই ভোররাত্রে শহরের বাইরে এনেছি আর তারপর কীভাবে ঝিরনি দিয়ে তাদের মারা শুরু করা হয়েছিল তার কিছুই বাদ গেল না।

আমাদের ন’জনকে পিছমোড়া করে বেঁধে শহরে ধরে আনা হল। ঠগি ধরা পড়তে শহরেও তখন লোকজনের মধ্যে বেজায় উত্তেজনা। কাজির কাছে অপরাধের শুনানি শেষ হলে আমাদের নিয়ে জেলখানায় ঢুকিয়ে দেয়া হল। জানা গেল, রাজার রায় আসা অবধি আমাদের সেখানেই থাকতে হবে।

ক্রমশ

টাইম মেশিন সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s