নিউগেট ক্যালেন্ডার আগের পর্বগুলো
(মৃত্যুদণ্ড ২৪ সেপ্টেম্বর ১৬৫২)
ক্যাপ্টেন হাইন্ডের বাবা ঘোড়ার সাজসজ্জা বানানোর ব্যাবসা করতেন।অক্সফোর্ড শায়ারের চিপিং-নর্টন এলাকায় বাড়ি ছিল তাঁর। মানুষটা সৎ। পড়শিদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলতে জানতেন। নিয়মিত চার্চে যেতেন।জেমস তাঁর একমাত্র ছেলে। নয়নের মণি। তাকে যথাসম্ভব ভালো শিক্ষাদিক্ষা দিতে কোনো কসুর করেননি তিনি। বছর পনেরো বয়েস অবধি জেমস তাই নিয়মিত স্কুলে গিয়েছে। অঙ্কে তার মাথা খুবই সাফ ছিল। স্কুলে অঙ্ক, ইংরিজির পাঠের পাশাপাশি বাড়িতে বাবার কাছে চলত বাইবেলের পাঠ। কাজেই পনেরো পেরিয়ে ষোলোয় পা দিতে যখন তাকে শহরেরই এক কসাইয়ের কাছে কাজ শিখতে ভর্তি করে দেয়া হল তদ্দিনে সে ব্যাবসায় যেটুকু অঙ্ক দরকার হয় তাতে দিব্যি পটু। পাশাপাশি বাইবেলটাও তার কন্ঠস্থ।
তবে কসাইয়ের সঙ্গে জেমসের মোটেই বনত না। লোকটা গোমড়ামুখে, আর কথায় কথায় জেমসের খুঁত ধরা তার পছন্দের কাজ ছিল। কাজেই বছরদুয়েক তার কাছে থাকবার পর একদিন অতিষ্ঠ হয়ে জেমস সেখান থেকে লম্বা দিল।
কসাইয়ের দোকান থেকে বেরিয়ে জেমস সোজা ধরে পড়ল তার মা’কে। এই ছোটো জায়গায় তার মন টিকছে না মোটে। লণ্ডন যেতে চায় সে। মা যদি রাহাখরচ বাবদ কিছু টাকার বন্দোবস্ত করতে পারে সেই তার দাবি।বেচারা মা আর কী করে! কষ্টেসৃষ্টে তিনটি পাউন্ড জোগাড় করে ছেলের হাতে গুঁজে দিয়ে চোখের জলে বিদায় জানাল তাকে।
লণ্ডনে এসে জেমসের পাখা গজাল। দেশের বাড়িতে বাপ-মায়ের সঙ্গে থাকতে যা করা যেত না তেমন সব কাজ করবার অনেক সুযোগ এই শহরে। নেশা করা, বন্ধুদের সঙ্গে নানান সরাইখানায় গিয়ে ফুর্তিফার্তায় রাতভোর কাটিয়ে দেয়া তখন তার কাছে রোজকার ব্যাপার।
আর এই করতে গিয়েই একদিন তার জীবনের মোড় ঘুরে গেল একেবারে। সেদিন একটা সরাইখানায় রাতে তেমন এক ফূর্তির আসর বসেছে। সেখানেই জেমসের সঙ্গে একটা মেয়ের আলাপ। সে মেয়ে দেখতে যেমন সুন্দর তেমনই তার চোখেমুখে কথা।
দুজন মিলে একসঙ্গে বসে গল্প করছে এমন সময় হঠাৎ কোত্থেকে কয়েকটা পুলিশের লোক এসে তাদের দুজনকেই দড়িবেঁধে নিয়ে চলল পউলট্রি জেলখানায়।
জেমস তো তখন বেজায় হাউমাউ জুড়েছে। তার কী দোষ? সে তো কিছুই করেনি। পুলিশে অবশ্য সে-সব কথায় কান দিল না মোটে। সটান তাকে চালান করে দিল জেলখানায়।
দিনকয়েক পরে জানা গেল, আসলে মোই মেয়েটা চোর। সেদিন সরাইখানায় ঢোকবার আগে সে একটা লোকের পকেট থেকে পাঁচটা সোনার গিনি সরিয়েছিল। ভদ্রলোক পুলিশে খবর দিতে তারা এসে মেয়েটার সঙ্গে জেমসকে বসে থাকতে দেখে ভুল করে তাকেও জেলে নিয়ে এসেছে।
মেয়েটা অবশ্য ছাড়া পায়নি। তার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ হতে তাকে নিউগেট জেল-এ পাঠানো হয়েছিল ফাঁসির আদেশ দিয়ে। জেমস আর কখনো তাকে দেখেনি, কিন্তু ঐ একটা সন্ধেয় মেয়েটার সঙ্গে বসে থাকাটুকুই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে গেল। কারণ তদন্ত চলবার সময় সে-কটাদিন তাকে জেলে থাকতে হয়েছিল সেই সময়টায় তার আলাপ হয়েছিল টমাস অ্যালেন নামে এক হাইওয়ে ডাকাতের।সে-ও তখন একটা ডাকাতির সন্দেহে জেলে আটকা।
তবে সেযাত্রা টমাসের বিরুদ্ধেও কোনো প্রমাণ জোগাড় করা যায়নি। অতএব সে-ও ছাড়া পেয়েছিল। আর তা সে পেয়েছিল জেমস-এর সঙ্গে একই দিনে।
ছাড়া পেয়ে দুই নতুন বন্ধু একটু ফূর্তি করবার জন্য গিয়ে উঠল একটা সরাইখানায়। তখন তারা জানত না এই বন্ধুত্বই একদিন দুজনকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দেবে। কিছু আগে আর পরে এই যা।
সরাইখানায় বসেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল, জেমস টমাসের শিষ্য হবে। ডাকাতির পেশার নানান রোমাঞ্চকর গল্প শুনে জেমস ঠিক করে নিয়েছিল ওই তার ঠিকঠাক পেশা হবে। ফূর্তি আর টাকা দুটোই মেলে ওতে।
দুজন মিলে একসঙ্গে প্রথম ডাকাতিটা করল শ্যুটার্স হিল বলে একটা জায়গার নির্জন হাইওয়েতে। এক ভদ্রলোক সেখানে তাঁর চাকরকে সঙ্গে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন। দূর থেকে তাঁদের দেখে টমাস বলল, “আজ তোমার হাতেখড়ি হবে জেমস। এগিয়ে গিয়ে একলা ডাকাতিটা করো দেখি! আমি আড়ালে রইলাম। দরকার হলেই হাজির হব’খন।”
তা আড়াল থেকে টমাস যা দেখল তাতে শিষ্যের ক্ষমতায় সে বড়োই খুশি। কারণ জেমস গিয়ে শমধামক দিয়ে ভদ্রলোকের কাছ থেকে পনেরো পাউন্ড মত টাকা আদায় তো করেছেই, তার ওপর, ডাকাতির শেষে আবার ভদ্রলোকের হাতে বিশটা শিলিং গুঁজে দিয়ে বলেছে, “এই নিয়ে কোনমতে কষ্টেসৃষ্টে বাড়ি ফিরে যান সার।”
ভদ্রলোক ডাকাতের মুখে এহেন কথাবার্তা শুনে তো বিস্ময়ে মুহ্যমান। খানিক বাদে মাথা নেড়ে বলেন, “তুমি মানুষটা ধার্মিক। নিশ্চিন্ত থাকো, আমি ডাকাতির খবর পুলিশকে দেব না। আর, কখনো যদি দৈবক্রমে সরকারে উঁচু পদে কাজ পাই, তাহলে আমি তোমাকে দেখব।”
এরপর ভদ্রলোক চলে যেতে টমাস এসে তো খুশিতে জেমসের পিঠ চাপড়তে শুরু করেছে। বলে, “যেমন সাহস, তেমন মাথা সাফ তোর। যা করেছিস, তারপর লোকটা আর পুলিশে যাবে না। বেঁচে গেলাম এযাত্রা।
আন্দাজ এই সময়টাতেই রাজা প্রথম চার্লস তাঁড় প্রাসাদের দরজায় খুন হন, ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের হাতে। ডাকাত হলে কী হয়, টমাস আর জেমস দুজনেই ছিল রাজভক্ত। কাজেই ডাকাতির ক্ষেত্রেওপ তারা এবার সেই ভক্তির প্রমাণ রাখল। ঠিক করে নিল, যে দল রাজাকে মেরেছে তাদের একটা মানুষকেও নাগালে পেলে আর ছাড়া নয়।
এর কিছুদিন বাদে, রাজহত্যার নায়ক অলিভার ক্রমওয়েল দলবল নিয়ে তাঁর দেশের বাড়ি হান্টিংটন থেকে লণ্ডনের দিকে ফিরছিলেন।দেখেই তো দুই বন্ধু ঘোড়ায় চেপে তলোয়ার নিয়ে তেড়ে গেছে তাঁড় দিকে। অলিভারও তৈরি ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি নিজে, তাঁর সঙ্গে আসা সাত সেপাই মিলে তলোয়ার হাতে লাফিয়ে উঠলেন।
বেগতিক দেখে রণে ভঙ্গ দিল জেমস আর টমাস। কিন্তু ক্রমওয়েলের দলবল তখন তাদের ছাড়বে না। বেশ খানিক দৌড় আর লড়াইয়ের পর টমাস ধরা পড়ল। সেই ছিল তার জীবনের শেষ ডাকাতির চেষ্টা। তার কিছুদিনের মধ্যেই ফাঁসি হয়ে যায় তার। ওদিকে জেমস কিন্তু এত সহজে ধরা দেবার পাত্র নয়। ঘোড়ার খুরে ধুলো উড়িয়ে সে ছুটল মাঠঘাট পেরিয়ে। ক্রমওয়েলের সেপাইরা তার নাগাল পেল না। সেযাত্রা প্রাণে বেঁচে গেল জেমস, কিন্তু অত জোরে ছুটে এসে তার ঘোড়াটা মারা পড়ল।
এইবারে জেমসের হল মুশকিল।একে তো বন্ধু টমাস আর সঙ্গে নেই। সে একা। তার ওপর নতুন ঘোড়া কেনবার মত রেস্তও নেই পকেটে। তবে জেমসের কপাল তখন ভালো চলছে। একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে দেখে রাস্তার পাশে একটা গাছের সঙ্গে একটা ঘোড়া বাঁধা। তার গায়ে আবার একটা পিস্তলওয়ালা বেল্টও ঝুলছে। দেখেই তো জেমস বুঝে গেছে ব্যাপারখানা কী? তাড়াতাড়ি ছুটে এসে সে ঘোড়ার বাঁধন খুলে নিয়ে বলে, “আহা এই তো আমার ঘোড়া।” এই বলে যেই না সে লাফিয়ে তার পিঠে চড়েছে ওমনি পেছনের ঝোপের ভেতর থেকে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, “ওরে বদমাশ। ওটা আমার ঘোড়া। শিগগির নাম।”
বলা বাহুল্য ঝোপের ভেতর থেকে সে লোকের ছুটে বেরিয়ে আসবার উপায় নেই। ভারী বেগতিক দশায় রয়েছে তখন সে। অতএব জেমস বিশেষ তাড়াহুড়ো করল না। ঘোড়াটাকে দুলকি চালে চালাতে চালাতেই সে বলল, “শোন হে। ঘোড়া পেয়ে মেজাজ ভারী শরিফ হয়ে আছে কিনা, তাই তোমার টাকাপয়সা আর কিছু ছুঁলাম না। ওই নিয়ে খুশি মনে ঘরের ছেলে ঘরে যাও দেখি। পরের বার দেখা হলে কিন্তু অত টাকাপয়সা ছাড়া যাবে না এই বলে দিলাম।”
বলতে বলতেই ঘোড়ার পেটে জুতোর গুঁতো দিয়ে সে বনবনিয়ে রওনা দিল পরের অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে।
***
আরো একবার ঘোড়া চুরি করেছিল জেমস। তবে তার কায়দাটা ছিল আরো মজার। সেবার কোনো কারণে আয় রোজগারে বেশ টান ধরেছিল জেমস হাইন্ডের।নিজের ঘোড়াটাকেও বেচতে হয়েছে। হাতে সামান্য কিছু শিলিং ছিল, তারই খানিক দিয়ে একটা বুড়ো বেতো ঘোড়া কোনোমতে ভাড়া নিয়ে সে চলেছে রাস্তা দিয়ে।
বেতো ঘোড়া টুকটুক করে চলে। রাস্তার আর সব ঘোড়া তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যায়। এমনি করতে করতে হঠাৎ দেখা গেল এক ঘোড়সওয়ারের তাকে নিয়ে খানিক মজা করবার শখ হয়েছে।তার ঘোড়া ভারী তাগড়া।আর তেমনই তেজি। গতি জেমসের পাশে পাশে চলতে চলতে বলে, “এমন পক্ষিরাজ কোত্থেকে জোটালে হে?”
জেমস আড়চোখে সেই ঘোড়াটাকে ভালো করে মেপে নিল একবার। ঘোড়ার পেছনে আবার একটা ট্রাঙ্ক বাঁধা। নিঃসন্দেহে তাতেও বেশ কিছু দামি জিনিসপত্তর থাকবে। তারপর লোকটার কথার জবাবে একটু হেসে টুপিতে হাত ঠেকিয়ে বলে, “হুজুর, যার যা কপাল। আপনি হলেন ভগবানের বরপুত্র। নইলে এমন স্বপ্নের ঘোড়া কি আর যার তার ভাগ্যে জোটে!”
প্রশংসায় দেখা গেল লোকটা খানিক গলেছে। জেমসের পাশে পাশেই চলতে চলতে সে বলে, “তা বটে। এ ঘোড়ার দুটো ডানা নেই এই যা। নইলে একেবারে খাঁটি পক্ষিরাজ। এক দমে গোটা রাত ছুটতে পারে। ছোটার সময় খুরে পাথর ঠেকলে আগুন ছেটকায়!”
তা এইভাবে ঘোড়ার গুণকীর্তন করতে করতে বেশ খানিক দূর আসতে পথের মাঝখানে পড়ল একটা বিরাট বড়ো গর্ত। তার দুপাশ দিয়ে সরু পথ বেয়ে সাবধানে আসাযাওয়া করতে হয়।গর্তটা দেখে জেমস কপালে একটা চাপড় মেরে বলে, “হা আমার কপাল। আমার বেতো ঘোড়াটাকে নিয়ে এখন ওই ধার দিয়ে দিয়ে পেরোতে হবে। কতক্ষণ যে লাগবে কে জানে। তবে এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী? এ যা গর্ত তাতে আমার বেতো ঘোড়া তো কোন ছাড়, আপনার ওই তেজি ঘোড়াও ও-গর্ত লাফিয়ে পেরোতে পারবে না।”
কথাটায় দেখা গেল ঘোড়সওয়ারের সম্মানে লেগেছে। বলে, “ওর দুগুণ বড়ো গর্তও এক লাফে পেরিয়ে যায় আমার পক্ষিরাজ।”
শুনে জেমস মুচকি হেসে বলে, “এক বোতল মদ বাজি রইল।”
শুনে ঘোড়সওয়ার ঘোড়া নিয়ে খানিক পিছিয়ে গেল প্রথমে। তারপর ছুটে এসে গর্তের মুখে ঘোড়াকে পায়ের খোঁচা দিতেই গর্তের ওপর দিয়ে বিরাট এক লাফে সে গিয়ে পড়ল তার অন্যধারে।
দেখে জেমসের তো চোখ গোল হয়ে গেছে। বলে, “বাপ রে কী তেজ।”
“তা তো বুঝলাম। এখন বাজির বোতলটা?”
জেমস হাসল, “খানিক পেছনে একটা সরাঈ ছেড়ে এসেছি। আপনি ফের লাফিয়ে ফিরে আসুন। ওখানে গিয়ে বাজির বোতলটা কিনে দিয়ে দেব।”
শুনে ঘোড়সওয়ার তো ফের লাফ মেরে গর্ত পেরিয়ে এপাশে এসে হাজির। জেমস তখন ভারী দুঃখী চোখে ঘোড়াটার কেশরে হাত বোলাচ্ছে। বলে,”আমার বেতো ঘোড়াও যদি অমন লাফাতে পারত। আহা! কী সুখ! বাতাসে পাখির মত উড়ে যাওয়া। তবে গরিব মানুষের কী আর অত সুখ জোটে?”
শুনে ঘোড়সওয়ারের দেখা গেল দয়া হয়েছে। বলে, “আমার ঘোড়াটা নিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখবে নাকি হে? আহা লজ্জা কী? এসো এসো।”
যেন নিতান্তই অনিচ্ছায় নিজের বেতো ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এসে তার রাশটা লোকটার হাতে ধরিয়ে দিল জেমস। তারপর সেই তেজি ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে একবার পেছনে হাত দিয়ে সেখানে বাঁধা ট্রাঙ্কটা দেখে নিয়ে বলল, “যাই তাহলে?”
বলে ঘোড়া নিয়ে ছুট দিয়ে বিরাট একটা লাফে গর্তের ওপারে গিয়ে পড়ে, চিৎকার করে বলে, “আমার ঘোড়াটা ভাড়ার। একটু ফেরৎ দিয়ে দেবেন ভাই কেমন?”
এই বলে টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে সে লোকটার ট্রাঙ্কশুদ্ধু পগার পাড়।
(পরের সংখ্যায় জেমসের আরো কীর্তিকলাপ)