নিউগেট ক্যালেন্ডার আগের পর্বগুলো
স্বভাবকবি ডাকাত ওয়াল্টার ট্রেসি
ওয়াল্টার ট্রেসির বাবার অবস্থা মোটামুটি ভালোই ছিল বলা যায়। বছরে ন’শো পাউন্ড রোজগার। বাড়ি নরফোক-এ। পাদ্রি হবার পড়াশোনা করবার জন্য ওয়াল্টারকে বিশ্ববিদ্যালয়েও পাঠিয়েছিলেন তার বাবা। মৃত্যুর সময় তিনি তার জন্য প্রায় একশ কুড়ি পাউন্ডের উত্তরাধিকার রেখে যান।
তবে মুশকিল হল ওয়াল্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা কিছু করেনি বিশেষ। উলটে বাবার পাঠানো টাকায় মহানন্দে ফুর্তিফার্তাতেই মন দিয়েছিল। ফল হল এই, তার পড়াশোনাটা হল না ওদিকে বড়োলোকি চালচলনটা দিব্যি গজিয়ে গেল।
বাবা মারা যেতে অথৈ জলে পড়ল ওয়াল্টার। নিজের রোজগারের কোনো সামর্থ্য নেই। ওদিকে বছরে একশ কুড়ি পাউন্ড পৈত্রিক সম্পত্তি দিয়ে কোনমতে খেয়েপরে বাঁচা গেলেও, আনন্দফুর্তির জীবন কাটাবার জন্য সে টাকা একেবারেই যথেষ্ট নয়।
অতএব ওয়াল্টার বাধ্য হয়েই রোজগারের সহজ রাস্তা দেখে নিল। মাঝেমধ্যেই হাইওয়েতে গিয়ে ডাকাতি করে লোকজনের টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে সে তার ফুর্তির টাকা জোগাড় করে। তা বিধাতা তার সে গুড়েও বালি দিলেন কিছুদিন বাদে। একদিন ডাকাতি করতে গিয়ে তার মুখে লাগানো মুখোশটা গেল খুলে। যাকে সে ধরেছিল সে আবার তার চেনাপরিচিত লোক। চিনে ফেলেই সে তো শহরে এসে সব কথা ফাঁস করে দিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তাড়িয়ে দিল তাকে।
ফলে ওয়াল্টারের নরফোক থেকে বাস উঠল। ওয়াল্টার অবশ্য তাতে মোটেই ঘাবড়াল না। সেখান থেকে বেরিয়ে সে সটান এসে হাজির হল চেশায়ার এলাকায়। এখানে কেউ তাকে চেনে জানে না বিশেষ। এক বড়োলোক ভেড়াওয়ালার বাড়িতে গিয়ে সে কাজ নিল। কদিনের মধ্যেই ভেড়াওয়ালাকে খুশি করে তার একমাত্র মেয়েরও মন
জয় করে নিতে বেশি অসুবিধে হল না শহুরে চালবাজ ওয়াল্টারের। তারপর যথাসময়ে মেয়েটিকে বিয়ে করে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভেড়াওয়ালার সব সম্পত্তি বেচেবুচে সেই টাকাপয়সা বগলদাবা করে চম্পট দিল সে।
চেশায়ার থেকে বেরিয়ে ওয়াল্টার এসে পৌঁছুল ওয়ার বলে একটা জায়গায়। সঙ্গে ভালোমতন টাকাপয়সা রয়েছে। কাজেই সে বাসা নিল একটা সেরা সরাইখানায়। সেখানে এদিকওদিক তাকিয়ে তার চোখ পড়ল এক ছোকরার দিকে। সে বেশ বড়োলোকের ছেলে। কথাবার্তায় বোঝা গেল অক্সফোর্ডের ছাত্র সে। সঙ্গে একটা মোটাসোটা তোরঙ্গও রয়েছে।
অতএব ট্রেসি ওয়াল্টার গিয়ে তার সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলল চটপট। তারপর দুই বন্ধু মিলে জোরদার খানাপিনা হল। খাওয়ার শেষে দু’বোতল মদও শেষ করল যখন দুজন মিলে ততক্ষণে সে ছোকরা তো নতুন বন্ধুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দুজন মিলে এক ঘরে এক বিছানায় শুয়ে শুরু হল নানান গল্প। অনেক রাত অবধি গল্পসল্প করে যখন তারা ঘুমোল ততক্ষণে ঠিক হয়েছে পরদিন থেকে একসঙ্গেই পথ চলবে তারা।
পরদিন সকালে খাওয়াদাওয়া সেরে তারা ঘোড়ায় চেপে রওনা হল। ততক্ষণে ট্রেসি নিজের পরিচয় দিয়েছে একজন পর্যটক হিসেবে। উদ্ভট সব দেশি বিদেশি অ্যাডভেঞ্চারের গল্প বানিয়ে বানিয়ে বলে একেবারে মুগ্ধ করে দিয়েছে নতুন বন্ধুকে। আরও জানিয়েছে, কলেজ ইউনিভার্সিটি নাকি কখনো চোখেও দেখেনি সে। ভারী কৌতুহল তার সে-সব জায়গার ব্যাপারে। অতএব নতুন বন্ধুটি পথ চলতে চলতে তাকে মনের আনন্দে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প শোনায়। সেখানে যে কেমন সব দারুণ দারুণ বদমায়েশি করা হয় ছেলের দল মিলে সে-সব গল্পও রসিয়ে রসিয়ে বলে ট্রেসিকে।
এইসব কথাবার্তা চলতে চলতেই ট্রেসি মাঝে মাঝে বন্ধুর তোরঙ্গটার গায়ে হাত বোলাচ্ছিল। হাত বোলায় আর বলে, “ইউনিভার্সিটির ছাত্র হে তুমি! সোজা কথা নয়। এমন একজন উঁচুদরের মানুষ হয়ে এই ভারী তোরঙ্গ মুটের মত নিজে নিজে টেনে চলেছ এ কি ভালো দেখায়?”
ছাত্র শুনে মাথা নেড়ে বলে, “যা আক্রার বাজার পড়েছে ভাই তাতে সঙ্গে লোকজন নেবার শখ বজায় রাখা বড়ো কঠিন।”
ট্রেসি শুনে ভুরু কুঁচকে উদ্বিগ্ন মুখে বলে, “কিন্তু শুধু ওজন বইবার জন্য নয়। সঙ্গে মানুষ থাকলে সেটা এমনিতেও ভালো হে। এই ধরো না, একলা চলেছ, তা কেউ যদি বাক্স কেড়ে নেয়? মনে তো হচ্ছে ভালো টাকাপয়সা নিয়ে চলেছ ওতে।”
ছোকরা তাতে মাথে নেড়ে চিন্তিত গলায় বলে, “কথাটা ঠিকই বলেছ। প্রায় ষাট পাউন্ড মতন নিয়ে চলেছি সঙ্গে। এম এ পরীক্ষা দেবার ফি।”
কথাটা শুনে ট্রেসি হেসেই অস্থির। বলে, “এ তো বিরাট সম্পত্তি হে! সরাইখানায় থাকতে যদি এ-কথা আমায় একটিবার বলতে, তাহলে ঠিকটাক লোক ধরে ওই টাকায় তোমায় একটা বড়োসড়ো খামারবাড়ি কিনিয়ে দিতে পারতাম আমি। সে না করে শুধুমুদু একটা কাগজের টুকরোর জন্য অতগুলো টাকা উড়িয়ে দেবে… না হে। এ কোনো কাজের কথা নয়।
“তবে ব্যাপার হল, এখন তো আমরা ওয়ার ছেড়ে অনেক দূর চলে এসেছি। চারদিকে কয়েক মাইলের ভেতর জনমনিষ্যি নেই। এখন আর কোত্থেকে তোমায় জমিটমি কেনাব? তাই আমি ঠিক করেছি উপস্থিত টাকাটা আমিই নেব, বুঝলে! আমার টাকার খানিক দরকারও রয়েছে এখন। তারপর পরে নাহয় কখনো…”
বলতে বলতেই সে ছাত্রের ঘোড়ার পিঠ থেকে তোরঙ্গটা খুলে এনে নিজের ঘোড়ার পিঠে চাপিয়েছে।
দেখে তো ছেলেটা প্রথমে খানিক হাঁ হয়ে রইল। তারপর সম্বিত ফিরতে সে বেজায় চ্যাঁচামেচি জুড়েছে, “আরে আরে, এ কী? আপনি আমার টাকাপয়সা কেড়ে নেবার মতলবে আছেন নাকি? ডিগ্রিটা পেলে সাসেক্সে একটা গির্জায় আমার পাদ্রির চাকরি পাকা। কত মানুষের কাছে ধারধোর করে টাকাটুকু জুটিয়েছি আমি তা আপনি জানেন না। চাকরিটা না পেলে সে-সব শুধব কেমন করে? একটু ভেবে দেখুন মশায়। এইভাবে টাকাপয়সাগুলো কেড়ে নিলে শুধু যে আমার জীবনটাই নষ্ট হবে তাই নয়, ওপরওলাও তাঁর একজন প্রচারক হারাবেন যে! পাপ হবে আপনার! মহাপাপ! এইভাবে বন্ধুর ছল করে নিরীহ লোকের সর্বনাশ করলে, রাজার আইন তো ভাঙবেনই, স্বয়ং ভগবানও আপনাকে ক্ষমা করবেন না।”
ট্রেসি খুব মন দিয়ে ছোকরার কাকুতি মিনতিটা শুনছিল। খানিক দুঃখও সযেঁ তার হচ্ছিল না তা নয়। কিন্তু অতগুলো টাকার লোভও সামলানো সহজ কথা নয়। অতএব খানিক ভেবেচিন্তে সে ব্রিচেস-এর পকেট থেকে একটা চামড়ার থলে বের করে আনল। তাতে সাকুল্যে চার পাউন্ড মতন ছিল।সেইটা বের করে ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে বলে, “ভাই হে, এই বুকে এখনো দয়ামায়া আছে। তোমায় কিছু সাহায্য করবার মত অবস্থা আমার নয়, কিন্তু তবু তোমার দুঃখ দেখে আমি আর থাকতে পারলাম না। এতে চার পাউন্ড রয়েছে। তোমার ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ওই টাকাটুকু দিয়ে বলো, বাকি টাকা তুমি রাস্তায় আর এক পেয়াদার হাতে তুমি তোমার এম এ ডিগ্রির ফি দিয়ে এসেছ। বোলো, কাগজে আঁচড় কেটে আর অন্যের গবেষণা চুরি করে মোটা হওয়া মাস্টারগুলোর চাইতে সেই পেয়াদার ও-টাকা অনেক বেশি ভালো কাজে লাগবে।”
এই বলে ট্রেসি হতভম্ব ছোকরাকে রাস্তার মাঝখানে রেখে দিয়ে সেখান থেকে উধাও হল।
খানিক বাদে কাছাকাছি একটা গ্রামে পৌঁছে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বাক্সটা খুলে ফেলল ট্রেসি। তার থেকে বের হল দুটো পুরোনো শার্ট। গুটিছয়েক হেডব্যান্ড, ছাত্রদের ছেঁড়াখোঁড়া গাউন একটা, দুটো ছেঁড়া জুতো আর গর্তে ভরা মোজা আর অনেকটা বেকন। টাকাপয়সা বলতে একটা ফুটো কড়িও সেখানে ছিল না।
দেখে ট্রেসির রাগে দুঃখে নিজের চুল ছেঁড়বার দশা। ট্রাঙ্কে যা আছে সে-সবের দাম সব মিলিয়ে চল্লিশ শিলিংও হবে কি না সন্দেহ, আর তাই গছিয়ে কিনা চার চারটে কড়কড়ে পাউন্ড হাতড়ে নিয়ে গেল তার কাছে থেকে!
এরপর ট্রেসির আরো দুটো ডাকাতির খবর মেলে। তার প্রথমটা ছিল বিখ্যাত কবি বেন জনসনের ওপরে ডাকাতি।
বেন জনসন সেবার বাকিংহ্যামশায়ারে এসেছিলেন কোনো কাজে। সেখান থেকে লণ্ডন ফেরবার পথে তাঁর ট্রেসির সঙ্গে দেখা। ট্রেসি তাঁকে চিনত। রাস্তায় দেখা হতেই এসে সে তাঁর ঘোড়ার লাগাম ধরেছে। বলে, “কবিমশায়, কিছু টাকাপয়সা দেয়া হোক।”
শুনে বেন জনসন মোটেও ঘাবড়ালেন না। বরং তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
“পালাও রে দুরাচার, কিম্বা তোর বর্মের শপথ
ছুটিবে বন্দুক, তোর শোণিতে রঞ্জিত হবে পথ
মহাপাপী আত্মা তোর পাঠাইব নরকের দ্বারে
শয়তান সম্রাট তার, ভ্যালেন্টাইন বলো গিয়া তারে”
ট্রেসিও পেছপা হবার পাত্র নয়। শুনেই তার মুখে মুখে হাজির জবাব,
“তুমি কি বিখ্যাত ‘বেন?’ নাকি শেক্ষপিয়ারের ভূত?
অথবা মদের ঘোরে টলমল মাতাল অদ্ভুত?
ভেবেছ কি কাব্য-অস্ত্রে এই বুকে জাগাইবে ভয়?
জেনে রাখ মূর্খ কবি সে কখনো হইবার নয়।
আমি তো স্বয়ং ট্রেসি! হাতে অস্ত্র, বিদ্যাদেবী মুখে
শব্দ বুনে কাব্য গড়ি, অর্থ লুটি অস্ত্র ধরে বুকে
এইবার দেহ ওর এই পথে লুটাবে ধুলায়
সমাধিতে লেখা রবে, ‘ইহারে লুটেছে কবিতায়’
এই বলে সে বন্দুকটা বের করতে বেন জনসন বুঝলেন এ-যাত্রা টাকাপয়সা বাঁচাবার আর কোনো উপায় নেই। অতএব ভালোমানুষের মত দশটি সোনার মুদ্রা দিয়ে সে-যাত্রা তাঁর মুক্তি মেলে।
এইখানে ট্রেসির গল্প ছেড়ে বেন জনসনের সে-যাত্রার আরেক দুর্গতির কথা একটু বলে নেয়া যাক। ট্রেসির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে লন্ডনের দিকে আসতে আসতে তিনি ফের একদল ডাকাতের খপ্পরে পড়েছিলেন সেবারে। তারা অবশ্য অত কবিটবি নয়। সিধে ধরে টাকাপয়সা যা আছে কেড়ে নিয়ে হাতপায়ে দড়ি বেঁধে কবিকে নিয়ে তারা একটা ক্ষেতের ভেতর ডাকাতি করে বেঁধে ফেলে রাখা আরো দুটো লোকের সঙ্গে ফেলে রেখে তারা উধাও হল। বাঁধা অবস্থায় তাদের একজন হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “ওরে আমার বউবাচ্চা সব গেল, আমিও গেলাম।”
তাই শুনে তার পাশের লোকটা আরো জোরে চেঁচিয়ে বলে, “তা গেলেন যদি, তো আমাকেও খুলে দেন, আমিও যাব গো!”
পরদিন সকালে এক চাষী এসে সেই দেখে দড়িদড়া খুলে তাঁদের মুক্তি দেয়। ছাড়া পেতেই বেন জনসন পাগলের মত অট্টহাসি হাসতে শুরু করেছেন। হাসেন আর বলেন,
“দড়ি বাঁধা পড়ে আছি সব গেছে ডাকাতের হাতে
পাশে বাঁধা দুই মূর্খ মধ্যরাত্রে বৃথা তর্কে মাতে
এক বলে “কী বিপদ হয়ে গেল কী ভীষণ ক্ষতি
আমি গেছি গেছে মোর প্রাণপ্রিয় স্ত্রীপুত্রসন্ততি
“তুমি যদি গেলে” বলে আর মূর্খ করিল ক্রন্দন
“আমিও যাইব তবে। খুলে দাও আমার বন্ধন”
এই বলে দুই মূর্খ রাত্রি যাপে নির্বোধ ক্রন্দনে
দুজনেই বলে “গেছি” দুজনেই রয়েছে বন্ধনে
তবে যাক সে কথা। ট্রেসির আর একটা ডাকাতির খবর পাওয়া যায় আবছা মতন। সে যাত্রা সে একটু বেশিই দুঃসাহসী হয়ে গিয়েছিল। রাস্তায় স্বয়ং বাকিংহ্যামকে ডিউককে ধরে তাঁর টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে পালায় সে। এইবার রাজশক্তি সরাসরি তার বিরুদ্ধে কাজে নামে। এরপর আর বেশিদিন পালিয়ে বেড়ানো হয়নি তার। কিছুদিনের মধ্যেই ধরা পড়ল ট্রেসি ওয়াল্টার। ডাকাতির সাজা হিসেবে উইনচেস্টারে ১৬৩৪ খৃস্টাব্দে তার ফাঁসি হয়। তখন তার মাত্রই আটত্রিশ বছর বয়েস।
একজন প্রতিভাবান, সুরসিক, কাব্যপ্রতিভাসম্পন্ন মানুষ, শুধুমাত্র সামান্য লোভের জন্য এইভাবেই শেষ করে দিয়েছিল নিজেকে। তা না হলে, স্বয়ং বেন জনসনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁর কবিতার জবাবে কবিতার সৃষ্টি করে যেঁ উত্তর দিতে পারে, সোজা পথে থাকলে হয়ত সে-ও এমন একজন কালজয়ী কবি হয়ে উঠতে পারত। আসলে মানুষ নিজের ভাগ্যকে নিজেই গড়ে বা ভাঙে। ট্রেসি ওয়াল্টার তার এক বড়ো উদাহরণ হয়ে থাকবে।