নিউগেট ক্যালেন্ডার আগের পর্বগুলো
সরাইওয়ালা ব্র্যাডফোর্ড
অনুবাদঃ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
অক্সফোর্ড শহরের গল্প। ১৭৪১ সাল। সে-সময় অক্সফোর্ডে একটা সরাইখানা চালাত জোনাথন ব্র্যাডফোর্ড। ছোট্ট সরাইখানা। লোকজন বেশি হয় না তাতে। মাত্রই কয়েকখানা ঘর। কাজের লোকও নেই বেশি। কয়েকজন চাকর আর মালিক ব্র্যাডফোর্ড মিলে তার জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ সবকিছুই সামলায়। রোজগারও বেশি নয়।
তা এহেন সরাইখানায় একদিন সন্ধেবেলা এক অতিথি এসে হাজির হলেন। ভদ্রলোকের নাম মিস্টার হেইস। সরাইখানায় সেদিন মোট তিনজন অতিথি। মিস্টার হেইস দেখা গেল বেশ রইস মানুষ। পোশাক আশাক, আচার আচরণ, রুচি সবকিছুতেই বেশ একটা ধনী ছাপ। সঙ্গে তাঁর একজন গাঁট্টাগোট্টা চাকরও চলেছে। খাবার টেবিলে সরাইয়ের অন্য দুজন অতিথির সঙ্গে খেতে খেতে খোশমেজাজে অনেক গল্পসল্পও করলেন হেইস। তাঁর চাকর নিঃশব্দে মালিকের সেবা করে যাচ্ছিল গোটা সময়টা।
খাবার অর্ডার দিতে গিয়ে বোঝা গেল হেইস মানুষটা দিলদরিয়া আছেন। খরচের পরোয়া না করে দেদার সুখাদ্য আর পানীয় আনবার আদেশ দিলেন তিনি। তৃপ্তি করে খেলেন, অন্যদেরও খাওয়ালেন। তারু জেব থেকে একটা থলে বের করে তার থেকে সোনার গিনি বের করে দাম মেটালেন খাবারের।
দেখেশুনে ব্র্যাডফোর্ডের চক্ষু চড়কগাছ। তার দীনদরিদ্র সরাইখানায় এমন রইস মানুষ বিশেষ কখনো পা দেননি এর আগে।
তবে একবার যখন দিয়েছেন, তখন ফিরে আর তিনি যাবেন না সে বিষয়ে ব্র্যাডফোর্ড তখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন। যে সময়ের ইংল্যাণ্ডের কথা বলছি সেখানে তখন সাধারণ মানুষজনের মধ্যে টাকা আর সততার মধ্যে টাকার ওজন অনেক বেশি থাকত। ব্র্যাডফোর্ডও তার ব্যতিক্রম নন। অতএব তিনি সুন্দর একটা পরিকল্পনা ছকে নিলেন। সহজ কাজ। মাঝরাত্রে অতিথির ঘরে ঢুকে তাঁকে নিকেশ করে…
সেইমতই কাজ শুরু হল। সরাই মালিকের কাছে প্রত্যেক ঘরের একটা করে অতিরিক্ত চাবি এমনিতেই থাকে। সেদিন রাত যখন নিশুতি হয়েছে, গোটা সরাই অন্ধকার করে ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই, ঠিক তখন ব্র্যাডফোর্ডের ঘরের দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। হাতে একটা চোরা লন্ঠন নিয়ে পা টিপে টিপে ব্র্যাডফোর্ড চললেন দোতলায় তাঁর রইস অতিথির ঘরে।
ওদিকে হেইস-এর ঘরের দু পাশের দুটো ঘরে তখন সরাইখানার অন্য দুই অতিথি রয়েছেন। নতুন জায়গা। এমনিতেই ঘুম ভালো আসে না। তা সেই পাতলা ঘুমের ভেতর মাঝরাত্রে পাশের ঘর থেকে হালকা একটা ঝটাপটির শব্দ ভেসে এসেছিল। তবে সেটা কানে গেলেও অন্য অতিথিরা তা নিয়ে আথা ঘামাননি বিশেষ। কিন্তু তার খানিক পরে শোনা গেল ঘরের ভেতর থেকে গোঙানির শব্দ উঠছে একটা। কেউ যেন মৃতুউযন্ত্রণায় গোঁ গোঁ শব্দ করছে সেখান থেকে।
এইবার আর বিষয়টাকে অবহেলা করা যায় না। আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠে দুই অতিথি দু’পাশের দুই ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। দেখা গেল হেইসের ঘরের দরজাটা কানিক খোলা। ভেতর থেকে আলো আসছিল। পা টিপে টিপে দুই অতিথি তার দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢুকতেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা চোখে পড়ল তাঁদের। বিছানার ওপরে পড়ে থাকা হেইসের শরীরটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আর তাঁর ওপরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে, এক হাতে একটা লম্বা ছুরি ধরে, অন্য হাতে ধরা চোরালন্ঠনের আলো সেই মরণাহত শরীরটার ওপরে ধরে রেখেছেন স্বয়ং সরাইখানার মালিক ব্র্যাডফোর্ড।
প্রাথমিক অবাক ভাবটা কাটিয়ে দুই অতিথি এবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন ব্র্যাডফোর্ডের ওপরে।
পুলিশ এল। নিয়মমাফিক সবকিছুই দেখা হল। চাকরদের ঘর থেকে ডেকে আনা হায়েসের চাকর জানাল মালিকের কাছে তার সোনার গিনিভর্তি পুঁটুকি ছিল একটা। তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখা গেল সেই গিনির পুঁটুলি উধাও হয়েছে।
একেবারেই সরল মামলা। মাঝরাত্রে সরাইয়ের একজন অতিথি খুন হয়েছেন। হত্যার জায়গায়, হাতে অস্ত্র সহ অপরাধীর ওপরে তখনও ঝুঁকে থাকা অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছেন খুনী। সেইসঙ্গে টাকাপয়সা উধাও। অতএব গ্রেফতার হলেন ব্র্যাডফোর্ড।
জেরায় জেরায় নাজেহাল হয়ে গেল আসামী। কিন্তু নিহত হায়েসের গিনির পুঁটুলি সে কোথায় রেখেছে তা কিছুতেই কবুল করানো যায় না তাকে দিয়ে। তারপর শেষমেষ সে যে স্বীকরোক্তি দিল সেইটেকে একেবারেই আষাঢ়ে গল্প বলে উড়িয়ে দিলেন সবাই। ব্র্যাডফোর্ড বলল, গিনি কোথায় তা সে জানে না। কারণ সে গিনির কোনো পুঁটুলি পায়নি।
সে স্বীকার করল, হায়েসকে খুন করে ওই টাকাপয়সা চুরি করবার ইচ্ছেতেই সে রাত্রে তার হায়েসের ঘরে গিয়ে ঢোকা। কিন্তু সেখানে ঢুকে চোরালন্ঠনের আলো ফেলে সে দেখেছিল তার ঢোকবার আগেই কী হায়েসকে খুন করে রেখে গেছে। তখনও তার দেহে একটু একটু প্রাণ ছিল। দৃশ্যটা দেখে নাকি সে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে কী করবে তাই ভাবছে এই সময় অন্য দুজন অতিথি এসে তাকে গ্রেফতার করে ফেলে। এর বেশি সে কিছু জানে না।
অতএব মামলা চলল। সরকারি উকিল জোর দিয়ে বললেন, টাকাপয়সার খোঁজ মেলেনি সে মিলতে না-ই পারে। ছুরিতেও রক্ত লেগে ছিল না সে-ও হতেই পারে আসামী ছুরি চালিয়ে সেটা মৃতের পোশাকেই মুছে ফেলেছিল। কিন্তু আসামী যখন নিজেমুখে স্বীকার করেছে সে হায়েসকে মারতে চেয়েছিল, আর তারপর তাকে সদ্যমৃতের ঘরে মাঝরাতে ঢুকে ছুরি হাতে মৃতদেহের ওপর উপুড় হয়ে থাকতে দেখা গেছে এর থেকে এটা পরিষ্কার যে সে-ই খুন করেছে হায়েসকে। অপরাধী তা স্বীকার না করলেও সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ সেদিকেই দিকনির্দেশ করছে।
যুক্তিটা জুরিরা মেনেও নিলেন। অতএব এরপর ব্র্যাডফোর্ড নির্দিষ্ট দিনে ফাঁসিতে চড়লেন।
কিন্তু গল্পটা এখানেই শেষ হল না। এর বেশ কয়েক বছর বাদে অক্সফোর্ডের এক অভিজাত পল্লীর বাসিন্দা এক বৃদ্ধ মৃত্যুর আগে পাদ্রিকে ডেকে পাঠালেন। খৃস্টানরা মরবার আগে অনেক সময় জীবনে যা পাপ করেছে সেই সব কথা পাদ্রি ডেকে অকপটে বলে যায়। তাদের ধারণা, ওই করলে সব পাপ ধুয়ে গিয়ে সব মানুষ স্বর্গে চলে যায় সোজা।
এই ভদ্রলোক কিছুকাল আগে প্রচুর ধনসম্পত্তি নিয়ে উদয় হয়েছিলেন অক্সফোর্ডে। বলেছিলেন নাকি সমুদ্রযাত্রায় অনেক ধনসম্পত্তি আয় করে দেশে ফিরেছেন বাকি দিনগুলো আরামে আর শান্তিতে কাটাবেন বলে। তা পাদ্রি এসে পাশে বসতে তিনি বলেন, “আমি একটা মহাপাপ করেছি ফাদার। আর সেই পাপ থেকেই আমার এত টাকাপয়সা হয়েছে। আমি এক বিরাট বড়োলোক মানুষের চাকর ছিলাম। তাঁর নাম হায়েস। একদিন প্রচুর টাকাপয়সা নিয়ে তিনি একটা লম্বা সফরে বের হয়েছিলেন। আমাকে সঙ্গে নিয়েছিলেন তিনি পথে তাঁর সেবা করবার জন্য। আমার লক্ষ্য ছিল পথেই কোথাও ওঁকে খুন করে টাকাপয়সাগুলো কেড়ে নিয়ে একটু ভালো করে বাঁচব। অক্সফোর্ডে এসে একদিন সন্ধেবেলা ভালো কোনো সরাইতে জায়গা না পেয়ে আমরা একটা ছোটো, নির্জন সরাইতে উঠি। সেখানে রাতে সুযোগ পেয়ে আমি তাঁর ঘরে দেখভাল করবার ছুতোয় ঢুকে তাঁর বুকে ছুরি মেরে ফেলে রেখে তাঁর সব টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়ে আসি চাকরদের ঘরে। ভয়ে ভয়ে ছিলাম যদি ধরা পড়ে যাই। কিন্তু সেদিন মাঝরাতে তাঁর ঘর থেকে শোরগোল উঠল। গিয়ে দেখি ছুরি হাতে সরাইয়ের মালিক ব্র্যাডফোর্ড আমার মালিকের শরীরের ওপর দাঁড়িয়ে আর তাঁকে চেপে ধরে আছে দুটো লোক। ভাবলাম ঈশ্বর মঙ্গলময়। তাই তিনি আমাকে এইভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছেন…
নিউগেট ক্রনিকল-এর এই ঘটনাটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে। সেটা হল এই যে, ঘটোনার পারিপার্শ্বিক থেকে যতই কাউকে অপরাধী বলে মনে করা হোক না কেন, যতক্ষণ না অপরাধের একেবারে নিখুঁত প্রমাণ মিলছে ততক্ষণ কাউকে দোষী বানিয়ে দিলে অনেক সময়েই আসল দোষী ছাড়া পেয়ে তার বদলে অন্য মানুষ সাজা পায়।
আমাদের দেশেও এই ভুল বারে বারে হয়। নইলে ছেলেধরা আর ডাইনি বলে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে এত মানুষকে আজও এদেশে পুড়িয়ে, পিটিয়ে মারা হবে কেন?