গল্প শোনে বাদশা
সুপর্ণা দেব
কতই বা বয়েস? এই তোমাদের মতন। মাত্র তেরো বছর বয়স। হেসে খেলে ঘুড়ি উড়িয়ে দুষ্টুমি করে বেড়ানোর সময়।কিন্তু তা হল না। সিংহাসনে বসতে হল তাকে। কী ভাবছ? সবাই তাকে বেশ বকে ঝকে চুপ করিয়ে রাখত। উঁহু, মোটেই না। ওইটুকু বয়সে সে বেশ কর্তা গোছের ছিল। হাজার হোক সম্রাট বাবরের নাতি বলে কথা ! ছোট থেকেই সে খুব ডাকাবুকো। বুনো হাতির পিঠে উঠে তাকে একেবারে নিজের বশে নিয়ে আসত। সেনা সামন্তদের সঙ্গে নিয়ে গহিন জঙ্গলে ঢুকে তরতরে নদী ডিঙ্গিয়ে আরও ঘন গাছপালার মধ্যে ঢুকে যেত। বুনো জন্তুদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। জন্তুগুলো আবার হিংস্র !
এরকম একদিন উত্তর ভারতের নারওয়ারের জঙ্গলে ঢুকে সে দেখল এক বুনোহাতির পাল। সে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে গেল অনেক দূর।
এরকম ভাবেই সে বড় হল। এবারে তো তাকে আপনি করে বলতে হয়। শারীরিক কসরত যেমন কুস্তি, শিকার, ঘোড়ায় চড়া, হাতি চড়া সেই বাদশার বড় প্রিয় ছিল। তার বাবা আর দাদু লেখাপড়া ভালোবাসতেন, কবিতা লিখতেন। ওঁর দাদু নিজের জীবনী লিখে গেছিলেন। আর বাবা হুমায়ুন তো বইএ মুখ গুঁজে ই থাকতেন। কিন্তু আকবর আর লেখাপড়া শিখলেন কই? তবে তাকে নিয়ে লেখার লোক অনেক ছিল। আর সব বিষয়ে তিনি নিজে তার বাপ ঠাকুরদাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।
এই রকম এক দুরন্ত বাদশার খুব প্রিয় একটা কাজ ছিল গল্প শোনা। হ্যাঁ, সত্যি ! আকবর গল্প শুনতে ভীষণ ভালোবাসতেন।
আকবরের নিজের এক গল্প বলার লোক ছিল। তার নাম দরবার খান। বনজঙ্গল দাপিয়ে আকবর যখন তাঁবুতে ফিরে আসতেন সন্ধেবেলা তখন তার কাকে চাই? দরবার খান। সারাদিন রাজকার্য সেরে ক্লান্ত আকবর কাকে চাইতেন? দরবার খান। অসহ্য গরম, কাজে আর মন বসে না। ডাকো দরবারখানকে। যুদ্ধে চলেছেন বাদশা । মেজাজ তিরিক্ষি । কে আসবে? দরবার খান। দরবার খানকে সবজায়গায় থাকতে হবে। আকবর যেখানেই যেতেন দরবার খান কেও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। মস্ত বড় জমকালো গদিতে ঠেস দিয়ে বসে সিংহাসনের হাতলে লাগানো হিরে চুনি পান্নায় টুক টুক করে তার আঙুল ঠুকতেন বাদশা। মানে বাদশা অধৈর্য হয়ে পড়ছেন। কেন? দরবার খান আসতে দেরি করছে, তাই।
শেষ পর্যন্ত দরবার খান এসে পৌঁছল।
“আরে এসো এসো এসো এসো।” বাদশা উঠে গিয়ে দরবার খানকে জড়িয়ে ধরলেন। “শোনাও তোমার গল্প। শুরু কর। আমরা অনেক ক্ষণ ধরে বসে আছি ! তোমার গল্প শুনিয়ে আমাদের মাতিয়ে দাও। মন ভালো করে দাও।”
বাদশা তারপর সভাসদের দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলতেন, “দরবার খান প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প বলে। কী চমৎকার গল্প বলে! যখন ঝড় বৃষ্টির গল্প বলে তখন তোমরা বৃষ্টিতে একেবারে ভিজে যাবে, ঠাণ্ডা হাওয়ায় কাঁপবে। যখন যুদ্ধের গল্প বলে তখন মাটি কেঁপে ওঠে!”
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলত এই গল্পের আসর। দিনের পর দিন ! হাতের ওপর মাথা রেখে গল্প শুনতে শুনতে বাদশা ভাবতেন ইশ, লেখাপড়াটা যদি শিখতে পারতাম !
বাদশা আকবর জাদু আর অভিযান মানে অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শুনতে খুব পছন্দ করতেন।
দরবার খান এসে মাথা ঝুঁকিয়ে সেলাম ঠুকে বলত, আজকে আপনার খুব প্রিয় বই থেকে গল্প শোনাব, বাদশা। হামজা নামা। আমার গল্পের নায়ক হলেন পারস্যের যোদ্ধা হামজা। খুব সাহসী, খুব শক্তিশালী। একেবারে আপনারই মত, বাদশা।
হামজানামা শুনতে বাদশা খুব ভালোবাসতেন। এতোটাই ভালোবাসতেন যে হামজানামার প্রচুর ছবি তিনি আঁকিয়েছিলেন। বাদশার লাইব্রেরিতে একটা কাঠের বাক্সে প্রায় ১৪০০ ছবি রাখা থাকত। সে সব অসাধারণ ছবি। অনেক শিল্পী মিলেমিশে এই কাজটা শেষ করেছিলেন হামজানামার এক একটা গল্পের ছবি। তুলি বানাতেন তারা খরগোশ, কাঠবিড়ালি বা অন্য কোনো প্রাণীর লোম দিয়ে। গাছের ছাল থেকে আঠা বানাতেন। আঠা আর রঙ মিশিয়ে দিতেন। আর রঙ তৈরি করার জন্য ছিল জব্বর খাটুনি। গাছপালা, পাথর, ধাতু এমনকি পোকামাকড় থেকেও রঙ বানানো হত। দামি দামি পাথর গুঁড়ো করলে খুব চকমকে রঙ পাওয়া যেত। সে সব দারুণ দারুণ ছবি। শক্ত মোটা কাপড়ের ওপর আঁকা।
বাদশার সামনে একটা করে ছবি রাখা হত আর দরবার খান সেই ছবিটা নিয়ে লম্বা গল্প বলে যেত। আবার ছবি বদল করে গল্পও বদলে যেত। সবটাই এই হামজার গল্প।
শুনি তো একটু হামজার গল্প, যে গল্প শুনতে বাদশা আকবর এতো ভালোবাসতেন। তাহলে শুরু হচ্ছে হামজার অভিযান।
অনেক অনেক দিন আগে পারস্যে মানে আজকের ইরানে হামজা নামে এক সাহসী বীর ছিলেন। খালি হাতে ইনি বুনো জন্তুর সঙ্গে লড়তেন। আকাশে বিদ্যুতের মত তার খোলা তলোয়ার ঝলসে উঠত। দুষ্টু লোকেরা ভয়ে কাঁপত। অনেক দেশ ঘুরতেন হামজা। যেখানেই যেতেন দুষ্টু লোকের সঙ্গে লড়াই করতেন। দৈত্য দানবের সঙ্গেও লড়তেন। সেইজন্য সব লোকজন হামজাকে খুব ভালবাসত।
একদিন হামজা দেখলেন নীল আকাশে একটি পায়রা উড়ছে। আহা কী সুন্দর ! ঝকঝকে নীল আকাশ। কিন্তু পায়রাটা ভিনদেশি। হামজা একটু অবাক হলেন। এ পায়রা কোত্থেকে এলো? পায়রাটা একে বারে হামজার পাশে এসে বসে পড়ল। হামজা, পায়রাটাকে জল খেতে দিলেন। দেখলেন পায়রাটার পায়ে একটা কিছু বাঁধা আছে। সেটা একটা চিঠি !
চিঠি লিখেছে দূর সমুদ্রপারের চাষিরা। তারা চিঠিতে লিখেছে, আপনি কিছু করুন। জমিদারেরা সব ফসল কেড়ে নিয়েছে। আমরা খেতে পাচ্ছি না। দুষ্টু জমিদারদের শাস্তি দিন।
সেই দিনই হামজা তার জাদু ঘোড়া আশকারকে নিয়ে চলল সেই দেশে যার নাম সাবায়িল। হামজা সেখানে গিয়ে চাষিদের বললেন তোমরা কাল থেকে আর জমি চাষ করতে যাবেনা। ব্যাস ! হয়ে গেল ! চাষিরা কাজ বন্ধ করে দিল। সে দেশে আর কোনো ফসল ফলে না। জমিগুলো খাঁ খাঁ শুকনো। জমিদারদের ঘরেও কোনো খাবার নেই। তারা মহা বিপদে পড়েছে। তারা তখন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে চাষিদের জমি ফিরিয়ে দিল। তাদের হাতে টাকা পয়সা দিল। সবাই খুব খুশি। হামজাকে নিয়ে সবাই আনন্দে নাচানাচি করছে। সে দেশের রাজা, রাজকুমারীর সঙ্গে হামজার বিয়ে দিলেন। হামজা তার বাড়ি পারস্যে ফিরে এলেন।
এতো আনন্দের মধ্যে কিছু কিছু বিচ্ছু লোক লুকিয়ে থাকে। তারা আবার হামজাকে পছন্দ করত না। তাদের নাম শাহরাশোব আর মাহজুব। একদিন হামজা সমুদ্রের ধারে আশকারের পিঠে চেপে টুক টুক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একা। সঙ্গে কোন অস্ত্র নেই। এই দুই বিচ্ছু লোক শাহরাশোব আর মাহজুব পেছন থেকে একটা মোটা খুব লম্বা লোহার শিকল দিয়ে হামজা কে বেঁধে ফেলে একটা একটা বড় লাল কাপড় দিয়ে ওকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে নৌকোয় তুলে ফেলল। শাহরাশোব, নৌকোয় ভেসে পড়ল হামজাকে নিয়ে। আর মাহজুব ডাঙায় দাঁড়িয়ে দেখল নৌকো অনেক অনেক দূরে চলে গেছে। যাক ! হামজাকে তারা চুরি করতে পেরেছে।
আশকার, হামজার ঘোড়া কিন্তু সাধারণ ঘোড়া ছিল না। তার তিনটে চোখ। তার গায়ে চকচকে লাল রঙের পোশাক। তার সুন্দর দুটো ডানা। গলায় সোনার ঘণ্টা।
হামজার প্রিয়বন্ধুর নাম উমর। অনেকদিন তার সঙ্গে হামজার দেখা হয়নি। হামজা বিয়ে করেছে। উমর খুব খুশি। সে দিন গুনছে কবে দেখা হবে প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে! উমর দেখল আশকার একা একা মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উমর ভাবল, হামজা তো কখনো আশকারকে একা ছেড়ে দেয় না। হামজা তাহলে কোথায়? এরপর এক বিরাট অভিযান। অ্যাডভেঞ্চার। শেষ পর্যন্ত হামজার উদ্ধার ও বিজয়। এ কিন্তু এক দিনের গল্প নয়। এ হল গিয়ে গল্প সমুদ্র। এর একেকটা ঢেউ আবার একেকটা দুর্দান্ত গল্প।
বাদশা আকবর দিনের পর দিন ধরে এই হামজানামার অগুনতি গল্প দরবার খানের মুখ থেকে শুনতেই থাকতেন, শুনতেই থাকতেন। গল্প শুনে মনমেজাজ ফুরফুরে থাকত বলেই আকবর কত ভালো ভালো কাজ করে গেছেন। তার মতন বাদশা আর কটাই বা আছে?
কিন্তু দরবার খানের নাম কি ভুলে গেলে চলে? গল্প দিয়ে বাদশাকে মাতিয়ে রাখত যে, সে তো এক বড় শিল্পী। তাই না?
অনবদ্য শিশু সাহিত্য পেলাম গল্প কথকতায়।সূপণা দেব এর লেখা য়।
জয়ঢাক কে ধন্যবাদ
LikeLike