আগের পর্বগুলো
।৪৪।
বুকের ভেতর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল আমার। একটা সুযোগ পেলে খালি হাতেই ওই রাজটার বুকের ওপর চেপে বসে ওর গলা টিপে শেষ করে দিতে পারতাম আমি তখন। কিন্তু, সে সুযোগ পাবার কোন উপায় ছিল না আমার। বাবাকে মারবার পর আমাকে একটা একটা গর্তের মধ্যে ফেলে দেয়া হল। তার ওপরে লোহ্র হিকের একটা দরজা। সারা শহরের লোক আমায় দেখতে আসছিল, যেন আমি একটা বুনো জন্তু। ছোট ছোট ছেলেরা লাঠি দিয়ে শিকের ফাঁক দিয়ে আমায় খোঁচা মেরে মেরে মজা দেখছিল। একদিন, যখন আমি রাজার সুনজরে ছিলাম, শহরের গণ্যমান্য রইস ছিলাম তখন যারা আমার সাম্ননে চোখ তুলে তাকাবার সাহস পেত না, তারাই এখন আমায় দেখতে এসে আমায় ঢিল ছুঁড়ে মারছিল, আমায় কুৎসিত ভাষায় গাল দিচ্ছিল, থুতু ছুঁড়ছিল আমার মাথায়। আমি তখন পাগলে মত হয়ে গেছি। কাছাকাছি কোন লোক এলেই চিৎকার করে কেবল বলছি, “তোমরা আমার আজিমা কে একবার দেখে এসে আমায় বলো সে কেমন আছে। তাকে বোলো কোন ভয় নেই—তাকে বোলো–”
যে আজিমার নাম আমার জেনানার বাইরে একটা প্রাণী পর্যন্ত কখনো উচ্চারণ করেনি, আমার কথা শুনে খানিক বাদে সেই আজিমার নামটাই সারা শহরের খেলার জিনিস হয়ে দাঁড়াল কিছুক্ষণের মধ্যে। তার নামে অসভ্য, অশ্লীল সব কথা বানিয়ে আমার গর্তের কাছে এসে চিৎকার করে বলে যাচ্ছিল প্রত্যেকটা লোক। সহ্য করতে না পেরে আমি কানে আঙুল দিয়েছিলাম, কিন্তু তাতে তারা আরো দ্বিগুণ উৎসাহে আমার গর্তের কাছে এসে চিৎকার করে সেইসব কথা শুনিয়ে মজা দেখতে লাগল।
এমনিভাবে দিন কেটে রাত এল। আমার যখন আজিমার পাশে শুয়ে থাকবার কথা তখন সেই গর্তের পোকামাকড়, ইঁদুর, টিকটিকি আর কাঁকড়াবিছের সঙ্গে রাত কাটতে লাগল আমার। কষ্ট এড়াতে ঘুমোবার চেষ্টা করলাম্ খানিকক্ষণ, কিন্তু সে রাতে আমার চোখে আসেনি।
অবশেষে রাত কেটে ভোর হল। গর্তের ধুলোর মধ্যে বসেই আমি নামাজ পড়লাম। ক’ফোঁটা জল দেয়া হয়নি আমায়। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছিল আমার। কিন্তু বারবার জল চাইলেও কারো দয়া হল না একটুও।
সকাল হতে ফের সারা শহরের লোকজন এসে ভেঙে পড়ল আমার খাঁচার চারপাশে। তাদের কারো চোখে একফোঁটা দয়ামায়ার চিহ্ন নেই। হাজার হাজার চোখ যেন ছুরির মত এসে বিঁধছিল আমার গায়ে। তখন গরমকাল চলছে। সারাদিন একফোঁটা জল বা একটুকরো রুটি দেয়া হল না আমায়। খাঁচায় পোড়া একটা নরখাদক বাঘের মত সারাদিন লোকের ঠাট্টাতামাশা আর গালাগালের শিকার হয়ে আরো একটা দিন কেটে গেল আমার। সন্ধের অন্ধকারে বসে আমার তখন আমার বাবার ভাগ্যকে ঈর্ষা হচ্ছে। এভাবে সারা শহরের লোকের মুখে দিনের পর দিন অপমান সহ্য করে তিলে তিলে খিদেতেষ্টায় মরার চেয়ে বাবার মত এক মুহূর্তে মারা যেতে পারাটা কত সুখের ছিল!
পরদিন সকাল হল। আমার তখন খিদের বোধটাই মরে গেছে। সারা শরীর জুড়ে শুধু ভয়ানক তেষ্টা। আলো ফোটবার পর একটা লোক এল আমার গর্তের সামনে। আমি তাকে মাথা কুটে ডাকলাম। সে উত্তর না দিয়ে চলে গেল। খানিক বাদে আরেকজন লোক এল সেখানে। একে আমি চিনি। আমার বাড়িতেই কাজ করত লোকটা। বহুদিন আমার নুন খেয়েছে। তার নাম ধরে ডাকতে একবার চমকে আমার দিকে তাকাতে বললাম, “আমায় একটু জল দাও–”
সে ভয়ে ভয়ে বলে, “তা কী করে হবে মীর সাহেব? রাজার হুকুম, কেউ আপনাকে একফোঁটা জল বা খাবার দিতে চেষ্টা করলে তাকে শূলে দেয়া হবে।” এই বলে সে চলে যাবার উপক্রম করেছিল, আমি তখন ফের মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে লোহার শিকে মাথাটা ঠুকতে ঠুকতে ভাঙা গলায় তার কাছে বারবার একটু জল ভিক্ষে করতে তার একটু দয়া হল। কোত্থেকে একটা মাটির সরা জোগাড় করে তাতে করে একটু জল এনে সে আমার সামনে ধরতে আমি এক ঢোঁকে জলটা খেয়ে ফেললাম। তারপর বেশ কয়েকবার সে সরায় করে আমায় জল এনে দিতে খেয়ে শান্তি হল। শেষবারের জলটা আমি রেখে দিলাম পরে খাবার জন্য। ভাগ্য ভালো সে সময়টা আর কেউ তাকে দেখে ফেলেনি। যাবার আগে ছেলেটা কথা দিয়ে গেল, রাতে সে আবার আসবে। কিছু খাবার এনে দেবার চেষ্টা করবে, আর পারলে আমার আজিমার খবরও নিয়ে আসবে তখন।
সারাটা দিন আমার আবার না খেয়ে কেটে গেল সেই গর্তের ভেতর। জল যেটুকু ছিল তাই বারে বারে একটু একটু করে খেয়ে দিনটা কাটিয়ে দিলাম আমি।
রাতে আবার সে এল। একটা কালো কম্বল মুড়ি দিয়ে দরজার সান্ত্রীদের চোখের আড়ালে এসে ঢুকেছে ভেতরে। হাতে কটা রুটি আর একভাঁড় দুধ। সেগুলো শিকের ফাঁক দিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলে, “আপনি খান। আমি এখানে বসে বাড়ির খবর বলি।”
খিদেয় আমার পেটের নাড়ি জ্বলে যাচ্ছে তখন। যে মোটা মোটা মস্তা আটার রুটি তিনদিন আগে আমি আঙুল দিয়েও ছুঁতাম না হয়ত, সেই তখন আমার কাছে অমৃত। খাওয়া শেষ করে আমি বললাম, “গুলাম আলি, আল্লাহ তোমার মঙ্গল করবেন। এইবারে বাড়ির খবর বলো।”
“খবর ভালো নয় মীরসাহেব। আমার দুর্ভাগ্য, আমাকেই এই খবর এনে দিতে হল আপনাকে।”
“আজিমা, আমার আজিমা, বেঁচে নেই তাই না?”
“নাঃ মীরসাহেব। তিনি বেঁচে নেই। মেয়েটাকে মোল্লাসাহেব আশ্রয় দিয়েছেন। নইলে সে-ও পথে পড়েই মরত।”
“পথে পড়ে—আমার বাড়ি? আমার বাড়ির কী হল?”
“নেই মীরসাহেব। রাজা সেপাই পাঠিয়ে আপনার বাড়ি ভেঙেচূরে সব সোনাআনা লুট করে বেগমসাহেবা আর আপনার মেয়েকে এক কাপড়ে রাস্তায় বের করে দিয়েছেন।”
“বেগমসাহেবার অবশ্য সেসব কিছুই গায়ে লাগে নি। আপনার বাবার খুন হওয়া, আপনার গারদে আটক হওয়া আর তার কারণটা শোনার পর থেকেই তো কেমন যেন মরার মত একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর, সেপাইরা যখন তাঁদের পথে বের করে দিল তখন–”
“থাক গুলাম আলি। আর বোলো না। তুমি এখন যাও। আমাকে একা থাকতে দাও একটু,” এই বলে আমি তাকে বিদায় দিলাম। আমার আজিমার শেষ পরিণতিটার বিবরণ শোনবার মত মনের জোর আমার আর বাকি ছিল না। আমার আজিমা—যার জন্য আমি দুনিয়ার সবকিছু করবার জন্য তৈরি ছিলাম—ভালোই হয়েছে সে গেছে। সে ছিল পূণ্যবতী মানুষ। জীবনে পাপ কাকে বলে জানত না। আল্লা তাকে তাই কৃপা করেছেন। রাস্তার ভিখিরি হয়ে বেঁচে থেকে সারা দুনিয়ার ব্যাঙ্গবিদ্রূপের শিকার আর হতে হল না তাকে। শুধু আক্ষেপ হচ্ছিল, মরবার আগে সে জেনে গেল আমি একটা ঠগি, একটা খুনে ডাকাত। এর পর বেঁচেও যদি থাকত, আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবারও সাহস পেতাম না যে! সুখের সময়ে যে খবরটা আমার বুকে শেলের মত বিঁধতে পারত, সেই খবরটা শুনে সেই নরকে বসে আমার বুকের ভেতর ভারি আরাম হচ্ছিল তখন। মেয়েটাকে নিয়েও আর ভয় ছিল না আমার। মোল্লাসাহেব ওকে নিজের মেয়ের মতই রাখবেন।
এর পরদিন থেকে আমায় একটু আধটু খাবার দেয়া শুরু হল। তিন মাস সেইভাবে বন্দি করে রাখবার পর একদিন ফের আমায় দরবারে নিয়ে আসা হল। লোকটা আমায় দিয়ে ঠগিবৃত্তি করিয়ে তার ভাগ নিয়েছে, তারপর আমার বাবাকে মেরে আমার ঘরদোর লুট করে মানুষ মেরে জমানো সব টাকাপয়সা আত্মসাৎকরেছে, আমার বউয়ের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। অথচ সভায় ডেকে সে আমায় বলল, “আমীর আলি, তোমায় আমি ভালো লোক বলে বিশ্বাস
করেছিলাম। এইভাবে তুমি আমার বিশ্বাসে প্রতিদান দিলে? কিন্তু না। আমি তোমায় প্রাণে মারব না। ইসমাইল তোমার বাপ ছিল না সে কথা তো সে বলে গেছে। শয়তান নরখাদকটা, তোমায় তোমার বাপ-মায়ের বুক থেকে ছিনিয়ে এনে নিজের মত নরখাদক শয়তানে বদলে দিয়েছিল। তাকে প্রাণদন্ড দিয়েই আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি। একসময় তুমি আমার অনেক সেবা করেছ। সেই কথা মনে রেখে আমি তোমায় প্রাণে মারব না। কিন্তু, ভবিষ্যতে যাতে আর কারো ক্ষতি করতে না পারো সেজন্য তোমায় আমি দেগে দেবো।”
এই বলে রাজা হাঁক দিয়ে বললেন, “এর কপালে দেগে দেয়া হোক।”
সঙ্গে সঙ্গে আমায় মাটিতে ফেলে হাত পা চেপে ধরে একটা গনগনে তামার পয়সা দিয়ে আমার কপালে একটা ছাপ মেরে দেয়া হল। সে যে কি তীব্র যন্ত্রণা, আমি কী করে বোঝাবো? আর সে যন্ত্রণাকে ছাপিয়ে উঠছিলো, সবার সামনে এইভাবে দাগি হয়ে যাবার দুঃখ।
দেগে দেয়া শেষ হলে রাজা হুকুম দিলেন, “একে আমার রাজ্যের সীমার ছাড়িয়ে দিয়ে এসো। আর আমীর আলি, কোনদিন যদি এ রাজ্যের ত্রিসীমানায় আর দেখি তোমায় তাহলে হাতির তলায় পিষে মারব জেনে রেখো।” এই বলে রাজা দরবার ছেড়ে চলে গেলেন। এর দুদিন পরে তাঁর রাজ্যের সীমানায় এসে আমার হাত পায়ের দড়ি খুলে নিয়ে হাতে দুটো টাকা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হল।
কপালের দগদগে ঘাটার ওপর পাগড়ি জড়িয়ে সেটাকে লুকিয়ে আমি অন্ধের মত দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে ঝালোনের সীমানা থেকে দুটো পা আমায় যতদূর নিয়ে যেতে পারে ততদূর শুধু ছুটলাম সেদিন। তারপর সন্ধে হয়ে গেলে একটা গ্রামে ঢুকে চেনা এক ভুত্তেরার দোকানে বসে একটা টাকা দিয়ে পেট ভরে দুটি খেলাম। সারাটা রাত ঘুমিয়ে সকালবেলা ঘুম ভাঙল যখন, নিজেকে তখন অনেক তাজা ঠেকছে আমার। বিশ্বাস ফিরে আসছিল, আমি আমীর আলি।
গ্রাম ছেড়ে ফের পথে বের হয়ে পড়লাম আমি। বুকের ভেতরটা বেশ হালকা ঠেকছিল। ভাগ্যে যা লেখা ছিল তা তো হয়েছেই। সবই ভবানীর ইচ্ছে। আমি তার কী করব। হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ আমার ডানদিকে একটা গাধা ডাক দিয়ে উঠল। শুনেই মনটা খুশি হয়ে গেল আমার। শুভ সংকেত দিয়েছেন ভবানী। আনন্দে দুহাত তুলে আমি বল উঠলাম, “জয় মা ভবানী। তোমার সংকেতকে তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিয়েছিলাম, সেই অপরাধের শাস্তি তুমি আমায় দিয়েছো মা। সে আমার নিয়তির লিখন ছিল। আর কখনো আমীর আলি এমন ভুল করবে না। এবার , যদি তুষ্ট হয়ে থাকো তো থিবাহুর পাশাপাশি পিলাহুও শোনাও মা।” সঙ্গে সঙ্গেই আমার বাঁদিকেও আর একটা গাধার ডাক শোনা গেল। বুঝলাম দেবি আমার অপরাধ সত্যিই ক্ষমা করেছেন। আবার আমায় ঠগিধর্ম পালনের হুকুম দিয়েন তিনি। এর পর আমি আর কোনদিন ভবানীর সংকেত অমান্য করিনি। অনেক সময় তার জন্য অনেক সরেস শিকার আমায় ছেড়ে দিতে হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার সংকেত অমান্য করবার দুঃসাহস আমি দেখাইনি জীবনে।
মহানন্দে রাস্তা দিয়ে প্রায় ছুটে যেতে যেতে আমি কোমর থেকে আমার রুমালটা খুলে আনলাম। এত দুঃখকষ্টেও এই রুমালটাকে আমি হাতছাড়া করিনি কখনো। হাতে করে তাকে ফের একবার ধরতেই মনে হল যেন পুরনো বন্ধুর হাত ধরলাম ফের। এখন দরকার শুধু একলা একটা শিকার। সঙ্গে তখন আছে মাত্রই একটা টাকা আর কয়েকটা খুচরো পয়সা। গায়ের জামাকাপড়ের অবস্থা তথৈবচ। সেসবের একটা বন্দোবস্ত না করে কোন ঠগিদলের সঙ্গে ভেড়বারও ইচ্ছে ছিল না আমার।
সকাল কেটে প্রায় দুপুর হয়ে গেল, কিন্তু তখনও একলা কোন লোকের দেখা পেলাম না। শেষে পথের ধারে একটা কুয়ো এখে তার জলে স্নান করে একটা গাছের ছায়ায় এসে বসে রইলাম আমি। ক্লান্তিতে চোখদুটো বুঁজে এসেছিল আমার। ঘুম ভাঙলো কাঁধে কার যেন হাতের ছোঁয়ায়। চোখ খুলে দেখি একজন মাঝবয়েসি মুসলমান ভদ্রলোক আমায় নাড়া দিয়ে ডাকছেন। তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম আমি। ভাগ্য ভালো আমার কপাল্টা তখনো পাগড়ি দিয়ে ঢাকা ছিল। ভদ্রলোক তাই সেখানের ছাপটা দেখতে পান নি। আমায় তিনি তাঁর মতই আরেকজন পথিক ভেবে নিলেন। খানিক এ কথা সে কথা হবার পর তিনি একটা পুঁটুলি থেকে রুটি আর আমের আচার বের করে খেতে বসলেন। দেখে আমার পেটের ভেতরের খিদেটাও চাগিয়ে উঠল একেবারে। সকাল থেকে পেটে কিছুই পড়েনি আমার। আমায় খাবারটার দিকে জুলজুল করে তাকাতে দেখে ভদ্রলোক বললেন, “খাবেন?”
দ্বিতীয়বার আমায় অনুরোধ করতে হল না তাঁর।
দুজন মিলে খাওয়া শেষ হতে ভদ্রলোক বললেন, “মীরসাহেব, আপনি বলছেন সামনে কয়েক ক্রোশের মধ্যে আর কোন জল পাবার উপায় নেই; তাহলে আমার জিনিসপত্রগুলোর দিকে একটু যদি খেয়াল রাখেন, আমি এই কুয়োটায় স্নানটা সেরে নিই একেবারে।”
“নিশ্চয়, নিশ্চয়,” আমি জবাব দিলাম। লোকটা তার জামাকাপড় খুলে রেখে একটা লোটা নিয়ে কুয়োর দিকে এগিয়ে গেল। কুয়োর ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে তার মধ্যে নেমে যাবার খানিক পড়ে জলের শব্দ পেয়ে বুঝলাম লোটা দিয়ে জল তুলে মাথায় ঢালছে সে। আমি তৈরি হয়ে গেলাম। উঠে এসে গা মুছে টুছে যে না সে তার ফতুয়ায় দুটো হাত গলিয়ে মাথাটা গলাতে যাচ্ছে, আমি রুমালটা তার গলায় জড়িয়ে দিলাম। এক মুহূর্তে কাজ শেষ।
খানিকবাদে, লোকটার শরীরটা কুয়োর ভেতর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তার পরণের জামাকাপড়গুলো আমি কুয়োর পাড়ে সাজিয়ে রেখে দিলাম। লোটাটাও সেখানেই রাখা রইল। যে কেউ দেখলে ভাববে, স্নান করতে গিয়ে কুয়োয় পড়ে গিয়ে মারা গেছে লোকটা। তার কোমরবন্ধে আটকানো টাকার থলেটা আর ঢালতলোয়ারদুটো সঙ্গে নিয়ে আমি এবার লম্বা লম্বা পায়ে জায়গাটা থেকে সরে পড়ে বড়রাস্তা ছেড়ে পাশের একটা আমবাগানের মধ্যে দিয়ে দূরের একটা গ্রামের দিকে চললাম। সেখানে পৌঁছে খানিক গুড় কিনে টুপুনির গুড় খেয়ে নিয়ে আমি তার থলেটা খুললাম। তা থেকে পাওয়া গেল মোট ঊনিশ টাকা, একটা নোলক আর দুটো আংটি। বাজারে তার দাম হবে কম করে চল্লিশ টাকা। আনন্দে সীমা রইল না আমার। এতে আমার নতুন কাপড়জামা কেনবার পরেও অন্তত তিনটে মাস হেসেখেলে চলে যাবে। ততদিনে একটা ভালো ঠগির দল ধরে নিতে পারবো আমি নিঃসন্দেহে।
এর পরের কয়েকটা দিন এদিক ওদিক খুঁজেও কোন দলের হদিশ পাওয়া গেল না। এখানে ওখানে ঠগিদের দলের যাতায়াতের খুব হালকা চিহ্ন চোখে পড়ছিল বটে, কিন্তু সেসব বেশ কিছুদিনের পুরনো। তবুও সেইসব চিহ্ন অনুসরণ করেই একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমি।
কয়েকদিন পরে একটা গ্রামে একটা দোকানের সামনে বসে আছি এমন সময় একদল লোকের সঙ্গে দেখা। তাদের কথাবার্তায় হঠাৎ ছত্তরপুরের নাম শুনে আমার খেয়াল হল, এই সহজ ব্যাপারটাই আমি ভুলে গিয়েছিলাম। ছত্তরপুরে ঠগি তো থাকবেই! লোকগুলোর কাছে গিয়ে আমি সরাসরি বললাম, আমি একলা একলা পথ চলেছি। যাবো ছত্তরপুরেই। রাস্তাঘাট ভালো চিনি না। তারা যদি আমায় তাদের সঙ্গে নেয় তাহলে আমার খুব উপকার হয়।
তারা বলল, আমি যখন একেবারে একা সেক্ষেত্রে তাদের আপত্তি নেই, তবে তারা প্রথমেই ছত্তরপুরে যাচ্ছে না। চলেছে ওর কাছাকাছি বান্দা বলে একটা জায়গায়। সেখানে দু একদিন থেকে কাজকর্ম সেরে তারা ছত্তরপুরে যাবে। সেই দেরিটুকুতে আমার আপত্তি না থাকলে আমি তাদের সঙ্গে যেতে পারি।
আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম।
“আমরা কাল ভোর ভোর রওনা দেব হে,” তাদের জেমাদার বলল, “রাতটা তাহলে তুমি এখগানেই কাটিয়ে দাও আমাদের সঙ্গে, কী বল?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “তাই হবে। সন্ধের মধ্যে আমি এইখানে এসে পৌঁছে যাবো।” বান্দার নাম শুনেই আমার তখন মনটা ভালো হয়ে গেছে। সেখানেও এককালে অসংখ্য ঠগির ভিড় ছিল।
সেদিন সন্ধেবেলা আমি এসে লোকগুলোর দলে ভিড়ে গেলাম। কয়েকদিনের মধ্যে আমরা এসে পৌঁছোলাম বান্দাতে। শোনা গেল আমার সঙ্গীরা সেখানে দিনচারেক থাকবে। চারদিন আমার পক্ষে আমার সমব্যবসায়ী লোকজ খুঁজে বের করবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। সে চেষ্টা আমার ব্যর্থও হল না। যেদিন আমরা বান্দায় এসে পৌঁছোলাম সেদিন সন্ধেবেলাই রাস্তাইয় গণেশ জেমাদারের দলের হুরমত-এর সঙ্গে দেখা। প্রথমে সে তো আমায় চিনতেই পারে না। তাকে অবশ্য সে জন্য দোষও দেয়া যায় না। শেষে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে তাকে বিশ্বাস করিয়ে আমি তার সঙ্গে তার বাড়িতে গেলাম। সেখানে বসে আমার সব গল্পটল্প শোনাতে অনেকটা সময় কেটে গেল। তারপর গণেশে কথা জিজ্ঞাসা করতে হুরমত বলে তারও অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয়।দলের লোকজন তাকে ছেড়ে গেছে। সাগরের কাছাকাছি জঙ্গলে দু একটা সঙ্গী নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায় এখন। শুনে আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। গণেশকে আমার কোনদিওই পছন্দ ছিল না।
আমি একটা বড় দলের সঙ্গে একা একা চলেছি শুনে হুরমতের একটু উৎসাহ হল। বলে, “মীরসাহেব, আমি বড়জোর জনাপনেরো ঠগি জোগাড় করতে পারি। তার বেশি আর ঠগি নেই এ চত্বরে।”
“মাত্র পনেরোটা?”
“ওই এখন অনেক মীরসাহেব। হাওয়া বেজায় গরম চলছে এখানে। ঠগিদের সুদিন গেছে। কিন্তু একবার যে টুপুনির গুড় খেয়েছে তার পক্ষে ঠগিবৃত্তি ছাড়া কি সম্ভব, আপনিই বলুন? তাই যারা এখনো ধরা পরিনি তারা মিলে তো ঠিকই করে ফেলেছিলাম, বৃষ্টিটা কমলে যেদিকে ভাগ্য নিয়ে যায় চলেই যাবো।”
যাই হোক, পরের দিন সন্ধেবেলায় দলবল জোগাড় করবার পর ফের কথা হবে ঠিক হল।
পরদিন সন্ধেবেলা গিয়ে দেখি হুরমত তার দল তৈরি করে ফেলেছে। তার লোকজন আমার নাম শুনেছে আগেই। আমার সঙ্গে কাজ করতে পারবে জেনে তারা সবাই এক পায়ে খাড়া হয়ে গেছে।ঠিক হল, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তারা এগিয়ে গিয়ে কিছু দূরের একটা গ্রামে অপেক্ষা করবে। সে গ্রামের কাছাকাছি তাদের একটা পছন্দের জায়গা আছে। সেখানে তারা ব্যবসায়ীদের নিয়ে আমার এসে পৌঁছোবার আগেই সব কিছু ঠিকঠাক তৈরি করে রাখবে।
পরদিন সকালে ভবানীর সংকেত নিয়ে দেখা গেল তিনি খুশিই রয়েছেন। অতএব আমাদের কাজ শুরু হয়ে গেল।
ক্রমশ