নিউগেট ক্যালেন্ডার আগের পর্বগুলো
ঘটনাকাল ১৬২৯ খৃস্টাব্দ।
এ কাহিনির সূত্র পাওয়া গেছে স্যা জন মেনার্ড নামের এক প্রখ্যাত আইনজীবির কাগজপত্র থেকে। এখানে তা তাঁর জবানিতেই তুলে দেয়া হলঃ
ঘটনাটা ঘটেছিল হার্টফোর্ডে। রাজা প্রথম চার্লসের রাজত্বের চতুর্থ বছরে। কিংস বেঞ্চে এই মামলার শুনানিতে যা সাক্ষ্যদান করা হয়েছিল আমি তার রেকর্ড রেখেছি মাত্র।
এই মামলার সূচনা আর্থার নরকট-এর স্ত্রী জোয়ান নরকটের অস্বাভাবিক মৃত্যু দিয়ে।
মৃত্যুটি ঘটেছিল একটি ছুরির মাধ্যমে। মৃত্যুর পরে মৃতার দেহ পরিদর্শন, আর্থার নরকটের মা মেরি নরকট, বোন অ্যাগনেস ও তাঁর স্বামী জন ওকম্যানের সাক্ষ্যদান ইত্যাদির ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে এটিকে আত্মহত্যার ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
সাক্ষিরা করোনার ও জুরিদের জানান, জোয়ানকে তার বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। খাট থেকে কিছুদূরে একটি ছুরি মেঝের কাঠে গেঁথে ছিল। জোয়ানের কন্ঠনালী ছুরিটির আঘাতে কাটা অবস্থায় ছিল। এবং তাঁর ঘাড়ের কাছটির হাড় ভাঙা ছিল।
ঘটনার আগের দিন জোয়ান তার শিশুসন্তানকে নিয়ে শুতে যায়। তার স্বামী সেদিন বাড়িতে ছিলেন না। সাক্ষিরা এ-ও বলেন যে সেদিন জোয়ান শুতে যাবার পরে তাঁদের বাড়িতে বাইরের কেউ আসেনি। তাঁরা হলফ করে বলেন, জোয়ান ভেতরের ঘরে শুয়েছিল এবং তাঁরা বাইরের ঘরে শুয়েছিলেন অতএব বাইরের কেউ সে ঘরে ঢুকলে তাঁরা তা নিঃসন্দেহে জানতে পারতেন।
সাক্ষিদের বক্তব্য এবং করোনারের রিপোর্ট শোনবার পর জুরিরা এটিকে আত্মহত্যা হিসেবে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু এর পর প্রতিবেশীদের মধ্যে কিছু গুজব এবং মৃত্যুর পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে জুরিরা একমত হন যে বিষয়টিকে আরো একটু তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। অতএব তাঁরা করোনারকে আদেশ দেন মৃতদেহটি কবর থেকে তুলে এনে ফের একবার পরীক্ষা করা হোক।
এরপর, ঘটনার ত্রিশ দিন পরে মৃতদেহটিকে ফের একবার কবর থেকে খুঁড়ে তোলা হয়। কিন্তু তার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষার পর স্থানীয় নিম্ন আদালতে কেসটি বন্ধ করবার সিদ্ধান্ত নেন। এর কারণ হিসাবে তাঁরা জানান যে মৃতার শরীরে অন্য কোনো আঘাত বা ধ্বস্তাধ্বস্তির কোন চিহ্ন ছিল না। অতএব এক্ষেত্রে কোনো হত্যাকারীর জড়িত থাকবার তত্ত্বটি বিশ্বাসযোগ্য নয়।
এর কিছুকাল বাদে মৃতার নাবালক সন্তান আদালতের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একটি আপিল করে। এতে তাকে সহায়তা করেছিলেন স্থানী চার্চের এক বৃদ্ধ পাদ্রি। তাতে সে অভিযোগ করে মৃত্যুটি একটি হত্যাকাণ্ড এবং তাতে তার ঠাকুরমা, মাসী, মেসো জড়িত।
এর ফলে মামলাটি ফের উচ্চতর আদালতে চালু করা হয়।
সাক্ষির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে পাদ্রি এই বয়ানটি দেনঃ
ধর্মাবতার, মৃতদেহ যখন কবর থেকে তুলে এনে মাটিতে শোয়ানো হল তখন অভিযুক্ত চারজন মানুষকেই আমি মৃতদেহটি ছুঁয়ে দেখতে অনুরোধ জানাই। উত্তরে অভিযুক্তা অ্যাগনেস মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানান, তিনি যেন তাদের নির্দোষীতার সপক্ষে কিছু অলৌকিক প্রমান দেন।
এরপর অভিযুক্তরা মৃতদেহটিকে স্পর্শ করে। এবং এর সঙ্গে সঙ্গে মৃতদেহের ফ্যাকাশে চামড়ায় রক্তের লালিমা ফুটে ওঠে ও তার ভ্রূতে ঘামের বিন্দু জমে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘামের ফোঁটা তার মুখ বেয়ে ঝরে পড়ে। এরপর মৃতার একটি চোখ তিনবার খোলে ও বন্ধ হয়। এরপর সে তার অনামিকাটি তিনবার উঁচু করে ইঙ্গিত করে। সেই সময় আঙুল থেকে ঘাসের ওপর রক্তের বন্দু ঝরে পড়েছিল।
সাক্ষ্যদান শুনে প্রধান বিচারপতি স্যার নিকোলাস হাইড সন্দিহান গলায় বলেন, “এই দৃশ্য আপনি ছাড়া এর কেউ দেখেছিল কি?”
সাক্ষিঃ আর কেউ তা দেখেছিল কি না আমি জানি না । তবে আমার বিশ্বাস সেখানে উপস্থিত প্রত্যেকেই তা দেখেছেন। কারণ তা না হলে, সেখানে উপস্থিত যাঁরা ছিলেন তাঁদের কেউ না কেউ তো আমার কথার প্রতিবাদ করতেন! তাছাড়া আমি এই অঞ্চলের পাদ্রি। সকলের প্রতিই আমার সমান ভালোবাসা। বিনা কারণে মিথ্যা আমি বলবই বা কেন? তাছাড়া ধর্মাবতার পাশের গ্রামের পাদ্রি আমার ভাইও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। আমার বিশ্বাস সে-ও এই ঘটনা চাক্ষুষ করেছে।
এরপর পাদ্রির ভাই কাঠগড়ায় এসে হুবহু একই বিবরণ দেন।
বিষয়টি একেবারেই যুক্তিহীন, অথচ বৃদ্ধ পাদ্রি একজন সম্মানিত ব্যক্তি হওয়ায় তাঁকে সরাসরি খারিজ করাও সম্ভব হচ্ছিল না। অতএব তাঁকে জানানো হল, বিষয়টি অবিশ্বাস্য। কারণ আপাতদৃষ্টিতে তিনি এটিকে সত্য বলে মনে করলেও এর পেছনে কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই এবং সেই কারণে এটিকে আদালত সত্য হিসাবে গ্রহণ করতে অক্ষম।
জবাবে পাদ্রি মৃদু মাথা নেড়ে বলেন, সেক্ষেত্রে এই মৃত্যুটিও আপাতদৃষ্টিতে আত্মহত্যা মনে হলেও সেটিকেও অবিশ্বাস্য বলে মেনে নিতে হবে, কারণ এখানেও এমন কিছু সূত্র রয়েছে যা নিম্ন আদালত গ্রাহ্য করেনি, যদিও তাদের কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই।
কেন তিনি এই কথা বলছেন প্রশ্ন করলে তিনি মৃদু হেসে বলেন, মৃত্যুস্থলের খুঁটিনাটি দৃশ্যের নথি করোনারের কাছে রয়েছে। তিনি কেবল তার থেকেই কয়েকটি সূত্রের উল্লেখ করবেন।
প্রথমত, মৃতার ঘাড় ভাঙা ছিল, এবং তার কন্ঠনালী ছুরিতে কাটা ছিল। ঘাড় ভাঙা অবস্থায় কেউ নিজের গলায় ছুরি চালাতে পারে না, এবং ছুরিতে গলা কাটবার পর কেউ নিজের ঘাড় ভাঙতে পারে না। অতএব আত্মহত্যা এই দুর্ঘটনার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নয়।
দ্বিতীয়ত মৃতা নিজের বিছানায় সুচারুভাবে শুয়েছিল। তার পাশে তার শিশুপুত্র ঘুমন্ত ছিল। বিছানায় শুয়ে আত্মঘাতী হলে এই দৃশ্যটি অবিশ্বাস্য।
তৃতীয়ত, বিছানায় কোনো রক্তপাতের চিহ্ন ছিল না। কেবল খাটের মাথার কাছে খানিক কষানি লেগে ছিল।
চতুর্থত, বিছানার মাথার দিক থেকে মেঝের ওপর রক্তের একটা ধারা দেখা গেছে। আবার বিছানার পায়ের কাছেও মেঝের ওপর থেকে একটা রক্তের ধারা নজরে এসেছে। এই ধারাদুটো একে অপরকে কোথাও স্পর্শ করেনি। আত্মহত্যা হয়ে থাকলে এর অর্থ হবে মৃতা পর পর দুটি জায়গায় গিয়ে নিজের গলা কেটেছেন। যেটি অবিশ্বাস্য, কারণ তার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।
এক্ষেত্রে বরং পরিস্থিতি থেকে একটাই যুক্তগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত নেয়া চলে, মৃতাকে কেউ প্রথমে এক জায়গায় আঘাত করেছে, তারপর তাকে বয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে কাজটি দ্বিতীয় আঘাতে সমাপ্ত করেছে। এর সপক্ষে আরো একটি প্রমাণ রয়েছে, তা হল ঘরটির কার্পেটের তলায় ছড়ানো ছিটানো ভাবে কিছু রক্তের দলা পাওয়া গিয়েছে।
পঞ্চমত, রক্তমাখা ছুরিটি যে মেঝেতে ঘেঁথে ছিল, তার হাতলটি, মৃতার বিছানা যেদিকে , তার বিপরীত দিকে ঝুঁকে ছিল। যদি মৃতা আত্মঘাতী হয়ে তা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলতেন তাহলে হাতলটির তাঁর দিকে ঝুঁকে থাকাটাই যুক্তিগ্রাহ্য হত।
ষষ্ঠত, মৃতার ডানহাতটি ঘরের মেঝেতে ছিল, কিন্তু ছুরির গায়ে যে হাতের ছাপ মিলেছে তা বাঁ হাতের।
কথাগুলো আদালতে একটি গুঞ্জন তোলে। এইবার এক জুরি মাথা নেড়ে জানান, “সাক্ষ্য থেকে ঘটনাটি আত্মহত্যা না হবার সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে একটিমাত্র বিষয় ব্যাখ্যাহীন থেকে যাচ্ছে। হত্যাকাণ্ডটি কে করেছেন, এবং তার সপক্ষে প্রমাণ কী?
জবাবে বৃদ্ধ পাদ্রি মুখটি গম্ভীর করে জানান, ঘটনাটি আত্মহত্যা নয় বলে ধরে নিলে, এবং অভিযুক্তরা আদালতে যে সাক্ষ্য দিয়েছে তা সত্য হলে এই সমস্যারও একটা যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান রয়েছে।
অভিযুক্তরা আদালতকে জানিয়েছে, ঘটনার রাত্রে তারা মৃতার ঘরের বাইরের ঘরেই ছিল। তারা এ-ও জানিয়েছে সেই রাত্রে বাইরের কোনো মানুষ সে বাড়িতে পা দেয়নি। এই দুটি সত্য হলে এর একমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা হতে পারে এই যে তারা নিজেরাই এই হত্যা ঘটিয়েছে। এবং তারা যদি এখন বলে যে তারা মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছিল সেক্ষেত্রে তাদের প্রমাণ দিতে হবে সেদিন রাত্রে সে ঘরে কেউ এসেছিল।
বলা বাহুল্য তেমন কোনো প্রমান অভিযুক্তরা দেখাতে পারেননি। জোয়ানের শাশুরি এবং জামাইকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। অ্যাগনেস সেইসময় গর্ভবতী থাকায় তাকে মার্জনা করা হয়েছিল।
মৃত্যুর আর মুহূর্ত অবধি অপরাধীরা তাদের অপরাধ স্বীকার করেনি।