পরদিন বদ্রীনাথ আর সরফরাজ খানের কাছে গিয়ে আমি বললাম, “নবাবকে কেন সঙ্গে এনেছি সেটা আশা করি অনুমান করতে পারছ।”
বদ্রীনাথ জবাব দিল,“সে তো বুঝতেই পেরেছি। কিন্তু কাজটা করবে কীভাবে? রাস্তায় ধরলে তো ব্যাটা মরবার আগে আমাদের বেশ কটাকে কেটে ফেলবে। আমার এখনই মরবার কোন ইচ্ছে নেই।”
“ভালো বলেছ। ওসব ঝুঁকি আমিও নিতে রাজি নই। তবে সুযোগ খুঁজছি একটা। মনে হয় পেয়েও যাবো খুব শিগগির,” আমি বললাম।
“কিন্তু করবে কীভাবে?”
“বলছি। নবাব গত দুদিন ধরেই বলছে,ভালো একটা নদীটদী পেলে তার জলে ভাঙের শরবত বানিয়ে খাবে। দুদিন ধরে ভালো জলের অভাবে ভাং না খেয়ে তার অবস্থা কাহিল। আমি যা খবর নিয়েছি তাতে কাল আমরা একটা ভালো জলওয়ালা নদী পাব। সেখানে ওর দাসী মেয়েটা যদি ভাং ঘুঁটতে বসে, তাহলে ও ঘোড়া থেকে নামবেই। তখন একটা সুযোগ পেলে ব্যাটাকে ধরা যেতে পারে। কী বলো?”
সরফরাজ সঙ্গে সঙ্গে বলে,“কোন সমস্যা হবে না মীরসাহেব। ব্যাটা যদি একবার বসে পড়ে তাহলে ওর অস্ত্রশস্ত্র আর কোন কাজে আসবে না।”
বদ্রীনাথ কী যেন ভাবছিল। খানিক বাদে বলে, “লোকটা নবাব। সাধারণ কোন বুনিজ নয়। মারলে পরে অন্য বিপদ হয়ে যেতে পারে। আমি বলি,একে যেতে দাও মীরসাহেব। কোন ক্ষতি কোরো না।”
“তোমার কাছে এমন কথা আমি আশা করিনি বদ্রীনাথ,” আমি চিৎকার করে উঠলাম, “আরে নবাব হোক আর যাই হোক,মানুষ তো বটে! মানছি,আমাদের বাপঠাকুর্দা কখনো নবাব মারেনি। কিন্তু তাতে সমস্যাটা কোথায়? আর সবজি খানের মত এমন একটা বীরকে মারতে পারলে আমাদের নামডাকটা কেমন হবে বুঝতে পারছ?”
“বাপঠাকুর্দা কেউ এমন কাজ করেনি সেটাই তো আমার চিন্তার কথা। ভবানী কিন্তু নিয়মভাঙা কাজ হলে অসন্তুষ্ট হন।”
“ঠিক আছে,এ ব্যাপারে ভবানীর সংকেত কী সেটা গুণেটুনে দেখে নাও। সংকেত যদি শুভ হয়,তাহলে ইনশাল্লা,সবজি খানের শিকার আমি করবই।”
বদ্রীনাথ হাসল,“এইবারে একেবারে ঠগির ব্যাটা ঠগির মত কথা বলেছ মীরসাহেব। আমি যা করার করছি। ভবানীর সংকেত যদি শুভ হয় তাহলে আমি তোমার সঙ্গে আছি।”
সেদিন সন্ধেবেলায় বদ্রীনাথ এসে একগাল হেসে বলে,“সব ঠিক আছে। ভবানী দারুণ শুভ সংকেত পাঠিয়েছেন।”
শুনে আমি সোল্লাসে বললাম,“মা অ্যাদ্দিন আমাদের যা সৌভাগ্য দান করে এলেন এ যাত্রায় তার পরে তোমরা যে কেন এত সন্দেহ করছিলে কে জানে। এখন শোন,আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি এখান থেকে চার ক্রোশ দূরে গেলে সেই নদীটা পাব। জল নাকি খুব ভালো তার। দুপাড়েই গভীর জঙ্গলও আছে। ওখানেই কাজটা সেরে ফেলব। লুগাই পাঠিয়ে দিই কবর খোঁড়ার জন্য। কী বল?”
“দরকার হবে না,” বদ্রীনাথ বলে উঠলো, “জঙ্গল যা গভীর বলছ তাতে মেরে সেখানে ফেলে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। আর গর্ত যদি করতেই হয় তাহলে বালি খুঁড়ে গর্ত বানাতে সময় বেশি লাগবে না। দলের বাকি লোকগুলোকে কে কে মারবে সে’সব তো ভাগবাঁটোয়ারা আমাদের আগেই হয়ে গেছে। আমি তো মারব ওই যে লোকটা নবাবের জেমাদার বলে নিজেকে ওইটাকে। বাকিদের জন্যও লোক ঠিক হয়েছে। নবাবকে আমি তোমার জন্য রেখে দিয়েছিলাম। তবে একটা কথা। এর সঙ্গে একলা লাগতে যেও না। চারপাঁচজন মিলে ধরাটাই ঠিক হবে।”
“উঁহু, বেশি লোক লাগবে না আমার। শুধু সরফরাজ খানকে সঙ্গে নেব। ওতেই হয়ে যাবে।”
“ভালো। সরফরাজ খান তাহলে শামসিয়ার কাজটা করবে। পাকড়ে ধরতে ও বেশ ওস্তাদ।”
রাতের মধ্যে পরামর্শ করে সব ঠিকঠাক করে নিয়ে সকালবেলা আমরা বেশ খুশি খুশি ভাব নিয়ে রওনা দিলাম। সে দিনও যথারীতি দলের আগে আগে ঘোড়ায় চেপে আমি আর নবাবসাহেব চললাম।
চলতে চলতে নবাব বলেন, “কী ভীষণ বাজে রাস্তা মীরসাহেব। তিনদিন হয়ে গেল,ভাং ঘোঁটবার মত ভালো জলের একটা পুকুর বা নালা পড়ল না রাস্তায়!”
“একটু ধৈর্য ধরুন খোদাবন্দ,” আমি ভরসা দিয়ে বললাম,“সামনে এগিয়ে দেখি,কোথাও না কোথাও ভালো একটা জলের জায়গা মিলবেই। পেয়ে গেলেই আমরা ঘন্টাখানেকের জন্য সেখানে বিশ্রাম নিয়ে নেব। সঙ্গে কিছু ভালো খেজুর আছে। সেই খেয়ে একটু জলটল খেয়ে নেব।”
নবাবেরও বোঝা গেল বেশ খিদে পেয়ে গেছে। আমার কথা শুনে বলেন,“বেশ বেশ,আমিও কটা খেজুর খাব তাহলে। এই পাহাড়ি হাওয়ায় খিদেটা একটু বেশিই পাচ্ছে আজকাল আমার।”
বেশ কয়েক ক্রোশ যাবার পর গ্রামের লোকেদের কাছ থেকে শোনা সেই ছোট্টো নদীটার দেখা মিলল। সেদিকে দেখিয়ে আমি বললাম,“ওই দেখুন খোদাবন্দ। জলটা কেমন চকচক করছে দেখেছেন? এ জল ভালো না হয়ে যায় না। চলুন গিয়ে ওখানে বসা যাক।”
নদীর ধারে গিয়ে ঘোড়ার জিনের ওপরের কম্বলগুলো নামিয়ে এনে তাই পেতে বসা গেল। নবাবের দাসী ততক্ষণে এসে ওঁর ভাং ঘুঁটতে বসে গেছে। দলের বাকি লোকজনও এসে ছড়িয়েছিটিয়ে বসে গল্পগাছা করছে। আড়চোখে তাকিয়ে আমি একবার দেখে নিলাম,সবাই নিঃশব্দে তৈরি হয়ে গেছে এর মধ্যেই। এমনভাবে ভাগ হয়ে গিয়ে বসেছে যে নবাবের একেকজন সেপাইয়ের কাছে আমাদের তিনটে করে লোক রয়েছে।
আজিমাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেবার দরকার ছিল। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম,“সামনের রাস্তাটা ভালো আছে। তুমি বরং গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যাও। আমরা একটু বিশ্রাম করে নিয়ে তাড়াতাড়ি এসে তোমাদের ধরে ফেলব।”
আজিমা বলল,“হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়। কিন্তু আমাদের রাস্তা শেষ হবে কবে গো? সারা গায়ে ব্যথা হয়ে গেল যে চলতে চলতে।”
বললাম,“আর দুএকদিন কষ্ট করো। কোন একটা শহরে এসে পৌঁছোলেই আমি তোমার জন্য একটা ডুলির বন্দোবস্ত করে দেবো। তখন আর এত কষ্ট হবে না দেখো।”
আজিমা রওনা হয়ে গেলে আমি নবাবের কাছে ফিরে এসে দেখি তাঁর নেশাটা জমে উঠতে শুরু করেছে। হাতে ভাঙের ঘটি নিয়ে বসে তিনি বাবার সঙ্গে গল্পগাছা করছিলেন। আমায় আসতে দেখে বলেন,“এই যে মীরসাহেব,তোমার বাবাকে আমি একটু ভাং খেয়ে দেখতে কতবার অনুরোধ করলাম। উনি শুধু বলেন,এই তেতো রস ওনার সহ্য হয় না। তা তুমি একটু চেখে দেখবে নাকি? স্বর্গীয় জিনিস হে!দুঢোঁক খেলে ঠান্ডা টান্ডা সব পালাবে দেখো। ভাঙের শরবত বানানোয় আমার এই কুরিনা মেয়েটার জুড়ি তুমি পাবে না হে হিন্দুস্তানে!”
বলতে বলতে ভাঙের ঘটিতে চুমুক মেরে নবাবসাহেব গান ধরলেন, “পিয়ালা পিয়া,তো ম্যায়নে পিয়া,ফির কিসিকো ক্যা,” তারপর উড়ুতে চাপড় মেরে বলেন, “আরে দুনিয়াশুদ্ধ লোক জানে সবজি খান সবজি খায়, কিন্তু লড়াইটাও লড়তে জানে! আহা মীরসাহেব,এখন যদি দুটো সুন্দরী মেয়েতে মিলে খানকয় গজল শোনাত তাহলে সাক্ষাৎ স্বর্গ নেমে আসত এই জঙ্গলে হে!”
আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় হেলিয়ে বললাম,“একটা বড়োসড়ো গ্রাম পেলে সেখান থেকে কটা নাচনেওয়ালি ভাড়া করে সঙ্গে নিয়ে নেবো,কী বলেন হুজুর?”
“আহা দারুণ,দারুণ। কী ভালো কথা শোনালে হে,” ভাঙের নেশা জমে গিয়ে নবাবসাহেবের কথা তখন জড়িয়ে আসছে। একটু বাদে হঠাৎ বলেন,“আহা কী কথা শোনালে,নাচনেওয়ালি ঘুঙুর পায়ে এই যে,এইরকম করে নাচবে,দেখো দেখো–”
বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে এলোমেলো পায়ে বেতালা নাচ জুড়ে দিলেন নবাবসাহেব। দেখে হাসতে হাসতে আমাদের পেটে খিল ধরে যাবার জোগাড়। খানিক নেচেটেচে আবার বসে পড়লেন নবাব। বসে পড়েই ফের হাঁক,“কুরিনা,আরো সবজি আন্। ঘুম ঘুম পাচ্ছে যে। ঘুমটা কাটাতে হবে। জলদি আন্।”
আমি মুখ ঘুরিয়ে ঝিরনি দিয়ে দিলাম,“ফজিল খান, হুঁকো আনো।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাকেও দু টান দিও হে!শরবতের সঙ্গে জমবে ভালো–”
আমি রুমাল হাতে নবাবের পেছন দিকে গিয়ে সরফরাজ খানকে ইশারায় বললাম নবাবকে চেপে ধরতে।
“আরে,নবাবসাহেব,দেখুন দেখুন,” বলতে বলতে সরফরাজ খান তাঁর ডানহাতটা গিয়ে চেপে ধরল সঙ্গে সঙ্গে।
“ব্যাটা নফর,তোর এত সাহস,একজন নবাবকে ছুঁয়ে দিলি? তুই–”
বলে সবজি খান চিৎকার করে উঠেছিলো,কিন্তু তার কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আমি তার গলায় রুমালটা পরিয়ে টেনে ধরলাম। সরফরাজখান হাতদুটো ধরে রইল আর বাবা তাঁর পা দুটো ধরে মারল হ্যাঁচকা টান। নবাবের গলা থেকে ঘড় ঘড় করে আওয়াজ বের হতে লাগল। তারপর তাঁর শরীরটা খানিক ছটফট করে একেবারে থেমে গেল। যুদ্ধক্ষেত্রে শতেক জওয়ানের প্রাণ নেয়া সবজি খান আমার রুমালের টানে প্রাণ দিলেন।
নবাবের গা থেকে সরফরজ খান তাঁর অস্ত্রশস্ত্রগুলো খুলে নিচ্ছে এমনসময় পেছন থেকে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার উঠলো। নবাবের দাসী কুরিনার কথা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। সে উল্টো মুখ করে বসে ভাঙ ঘুঁটছিলো। কিচ্ছু খেয়াল করে নি। হঠাৎ পেছনে ফিরে সেই দৃশ্য দেখতে পেয়ে সে চিৎকার করে ছুটে এসে নবাবের শরীরটার ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করল। দাসী হলে কী হয়, নবাবকে সে সত্যি ভালোবাসত। কাঁদে আর বলে,“এ হতে পারেনা। ওঃ মাগো, চোখদুটো কেমন ঠেলে বের হয়ে আসছে, ওঠো নবাব, উঠে বসো—ও মা, এ নড়েনা কেন? কথা বলে না কেন?”
এই বলে সে বুক চাপড়ে এমন কাঁদতে শুরু করল যে সেখানে থাকা যায় না। আমি চাপা গলায় বললাম,“কে আছিস? মেয়েটার কষ্টের শেষ কর। আমি মেয়েদের গায়ে হাত দিই না।”
সরফরাজ খান মেয়েটাকে একদৃষ্টে দেখছিল। কুরিনাকে দেখতে ভারি সুন্দর। খানিক তাকে দেখে নিয়ে সে বলল,“মেয়েটা ভালো। একে বাঁচবার একটা সুযোগ দেয়া যাক।” এই বলে তার কাছে গিয়ে তার হাতটা ধরে সজোরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সরফরাজ বলে,“এই শোন, ন্যাকামো বন্ধ কর। আমার বউবাচ্চা নেই। আমায় বিয়ে করবি কিনা বল? রাজি থাকলে আমার সঙ্গে আয়,নাহলে প্রাণে বাঁচবি না। একটা মরা নিয়ে এত আদিখ্যেতা কীসের? ছিলি তো এর দাসী!”
মেয়েটা নীচু গলায় বলল,“ওসব বোলো না গো! আমি ওনার দাসী ছিলাম। আমায় তোমরা ওঁর সঙ্গেই যেতে দাও।”
“শোন বোকা মেয়ে,” সরফরাজ খান আর একবার চেষ্টা করল,“এই সবার সামনে আমি কথা দিচ্ছি তোকে আমি সুখের সংসার দেব। কথা শোন,নইলে আমার এক ইশারায় প্রাণটা খোয়াবি। ভালো চাস তো উঠে গিয়ে আমার ঘোড়ায় বোস। যে চলে গেছে তাকে ভুলে যা।”
“ভুলে যাব? আমার মালিককে আমি ভুলে যাব? কেমন করে ভুলব? আমায় তোমরা মেরে ফেল গো। আমি ওঁর সঙ্গে যেতে চাই।”
“বোকা মেয়ে,আমার কথা শোন–”
উত্তরে সে মেয়ে ফের নবাবের শরীরটাকে শক্ত করে চেপে ধরল।
আমার রাগ হচ্ছিল খুব। চারপাশে দাঁড়ানো লোকজনকে ধমক দিয়ে বললাম, “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা না দেখে শরীরটা তুলে নিয়ে যা তাড়াতাড়ি।”
শুনে লুগাইরা এগিয়ে এসে মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে শরীরটাকে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল।
দুজন লোক মেয়েটাকে দুদিক থেকে ধরে রেখেছিল। তাদের সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে করতে সে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল।
“নাও,এবার তোমার মেয়ে তুমি নিয়ে যাও,” আমি সরফরাজ খানের দিকে চেয়ে বললাম,“তবে হ্যাঁ এ যেন বেশি চিৎকার চ্যাঁচামেচি না করে। কী করে ঠান্ডা রাখবে সে তোমার মাথাব্যথা।”
কিন্তু সে মেয়েকে বশে রাখে এমন ক্ষমতা সরফরাজ খানেরও ছিল না। চিৎকার চ্যাঁচামেচি ধ্বস্তাধ্বস্তি করে সে সরফরাজ খানকে অস্থির করে দিল একেবারে। একদিকে সরফরাজ খান,অন্যদিকে দলের আরেকটা লোক মিলে তাকে ঘোড়ার ওপর ধরে রেখেছে,আমি পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে তাকে বোঝাতে বোঝাতে চলেছি যে নিজের ভাগ্যকে মেনে নেয়াই তার পক্ষে মঙ্গল,আর সে মেয়ে প্রাণপণে চিৎকার করতে করতে ঘোড়া থেকে নেমে পড়বার জন্য কসরৎ করে যাচ্ছে,এইভাবে আধক্রোশ রাস্তা যাবার পর বাবা এসে বলল,“এসব হচ্ছে কী? সরফরাজ খান,তোমার মত একটা মরদ,ওই একটা ফর্সা চামড়ার মেয়ে দেখে একেবারে গলে গেলে? এখন রাস্তায় যদি লোকজন এসে পড়ে? তাদের সামনে তো ও মেয়ে চিৎকার করে সব বলে দেবে!তখন কী পরিণতি হবে বুঝতে পারছ? তোমার লজ্জা হওয়া উচিত।”
ঘোড়ার অন্যপাশে যে লোকটা মেয়েটার একদিক ধরে রেখেছিল,সে-ও বিরক্ত হয়ে হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলে,“আমার দ্বারাও আর এ কাজ হবে না। তোমার মেয়ে তুমি বুঝে নাও সরফরাজ খান।”
সরফরাজ খান এইবার বেজায় রেগে গিয়ে খাপশুদ্ধ তলোয়ারটা দিয়ে মেয়েটার মুখে ভীষণ জোরে একটা ঘা দিয়ে বলে,“চুপ কর শয়তানী,একেবারে চুপ।”
আঘাতটা এত জোরে দিয়েছিল সরফরাজ খান যে তাতে মেয়েটার গালের চামড়া ফেটে রক্ত বের হয়ে গেল। দেখে বাবা বলে, “হল তো? যে সুন্দর মুখ দেখে এত ঝামেলা পোয়ালে সেই সুন্দর মুখটাই তো নষ্ট হয়ে গেল। তাহলে আর ঝামেলা বাড়াও কেন?”
“চিৎকার তো বন্ধ হয়েছে।” এই বলে সরফরাজ খান ঘোড়ার লাগাম ধরে সামনে সামনে চলতে লাগলো।
বেশিক্ষণ অবশ্য মেয়েটাকে ঠাণ্ডা রাখা গেল না। মার খেয়ে একটু থতমত খেয়ে থেমে গিয়েছিল সে। খানিকদূর যেতে না যেতেই হঠাৎ ঝিমখাওয়া ভাবটা কেটে গেল তার। গাল থেকে গড়িয়ে আসা রক্তটা হাত দিয়ে মুছে নিয়ে রক্তটার দিকে একঝলক করুণ চোখে তাকিয়েই সে এক লাফ দিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ল।
“লাগামটা কেউ ধর তো,মেয়েটাকে তুলে বসাই,” বলে সরফরাজ খান মেয়েটাকে তুলতে যেতে সে এমন চিৎকার আর হাত পা ছোঁড়া শুরু করল যে তাকে তুলে বসাবার কোন উপায় থাকল না। সরফরাজ খান তখন তলোয়ার বের করে তার মাথার ওপর উঁচিয়ে ধরতে সে আরো জোরে চিৎকার করে বলে,“মার্ মার,শয়তানের দল, এক ঘা মেরে মুখ ফাটিয়ে দিয়েছিস,এবার আরেকটা ঘা দে,আমার সব দুঃখের শেষ হয়ে যাক। কী হল,মারবি না আমায়?” বলতে বলতে সে সরফরাজ খানের মুখে এক দলা থুতু ছিটিয়ে দিল।
“নাঃ। এভাবে হবেনা। শুধুশুধুই চেষ্টা করলাম এতক্ষণ,” বলতে বলতে তলোয়ারটাকে খাপে ভরে ফেলে সরফরাজ খান রুমাল বের করে মেয়েটার গলায় ছুঁড়ে দিয়ে মরণটান দিল একটা। সামান্য ছটফট করে মেয়েটা ঢলে পড়ল। রুমালটা খুলে নিয়ে সরফরাজ একটু দুঃখী গলায় বলল,“এমনটা না হলেই ভালো হত। কিন্তু কী আর করব,মেয়েটার কপাল!”
কয়েকজন লুগাই মিলে তাড়াতাড়ি এসে মেয়েটার শরীরটা নিয়ে পথের পাশের একটা ঘনমতন ঝোপের মধ্যে নিয়ে গুঁজে দিতে আমরা তাড়াতাড়ি সে জায়গাটা ছেড়ে এগিয়ে গেলাম। কয়েক ক্রোশ দূরে গিয়ে আজিমার গাড়ির নাগাল পেলাম আমরা।
এই ঘটনাটার পর থেকে সরফরাজ খান কেমন যেন বদলে গেল। সেই হাসিখুশি,দুঃসাহসী মানুষটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলত না বিশেষ। একা একাই থাকত। কেউ সে নিয়ে কিছু বললে দুঃখী দুঃখী মুখে একটু হাসত শুধু। সারাটা জীবনে শয়ে শয়ে মানুষ মেরেছে সে। তার শিকারের মধ্যে মেয়ের সংখ্যাও কম ছিল না। কিন্তু সেদিন ওই একটা তুচ্ছ দাসী মেয়ের মৃত্যু তাকে কেন যে এমন বদলে দিল কে জানে! গ্রামে ফেরার পর নিজের ভাগটা বুঝে নিয়ে সঙ্গেসঙ্গে সেটা দলের গরিব লোকেদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে গায়ে ছাই মেখে একটা কৌপিণ সম্বল করে ফকিরি নিয়ে সে বের হয়ে পড়ল দুনিয়ার পথে। অনেক বছর পরে আমি খবর পেয়েছিলাম,জঙ্গলের মধ্যে যেখানটাতে সে মেয়েটাকে মেরেছিলো সেইখানে একটা ছোট্ট আশ্রম বানিয়ে সে থাকত। সেই বুনো এলাকায় কোন পথিক গিয়ে পড়লে তার যথাসাধ্য সাহায্য করত। বনের পশু ছাড়া তার আর কোন সঙ্গীসাথী সেখানে ছিল বলে মনে হয় না। গ্রাম ছেড়ে যাবার পর সরফরাজ খানকে আমি আর কখনো দেখিনি। তবে দলের অনেকেই খুব আক্ষেপ করত তাকে হারিয়ে। আমাদের দলে তার অভাব কোনদিন পূরণ হয়নি।
এর পর থেকে, গ্রামে ফেরা অবধি আর কোন বিশেষ ঘটনা ঘটেনি সেবার আমাদের। গ্রামে ফেরবার পর ঠগিসমাজে আমার খুব নামডাক হয়েছিলো। বাবা সেই অভিযানের পর ঠগিজীবন থেকে অবসর নেয়ায় আমাকেই সবাই পরবর্তী নেতা হিসেবে মেনে নিল। আজিমার সঙ্গে আমি সুখে সংসার পাতলাম।
আমরা ফিরে আসবার মাসদুয়েক পরে হুসেনের দলটাও ফিরে এলো। সবার লুটের মাল একত্র করে দেখা গেল প্রায় এক লক্ষ টাকা রোজগার হয়েছে সে বছরের অভিযানে। আমাদের ভাগে যা টাকা এসেছিলো তাতে বছরদুয়েক বেশ ভালোভাবেই কেটে গেল আমাদের। এর মধ্যে দু একবার ছোটখাটো অভিযানে বের হবার ইচ্ছে হলেও বাবা আমায় কিছুতেই ছাড়তে রাজি হয়নি। বলে ঘরে যতদিন টাকাপয়সা রয়েছে ততদিন সাধ করে বিপদ ঘাড়ে করতে যাবার কোন দরকার নেই।
ইতিমধ্যে আমার একটা ছেলে হয়েছে। যে সময়টার কথা এবার বলব তখন আজিমার আরো একবার ছেলেপুলে হবে। আগের অভিযানের পর পরপর দু বছর কেটে গিয়ে তিন বছর চলছে তখন। ঘরে বসে থেকে থেকে আমার তখন অসহ্য লাগতে শুরু করেছে। বদ্রীনাথ আর দলের অন্যান্য অনেকে তখন আমায় বারবার অনুরোধ করে চলেছে,একটা বড়ো দল নিয়ে বাংলা মুল্লুকের দিকটা অভিযানে বের হবার জন্য। ও মুল্লুকে ভালো রোজগারের সুযোগ আছে।
কিন্তু বাবা আমায় যেতে দিলে তবে তো! তার কেবলই মনে হচ্ছিল কোন একটা বিপদ হতে পারে সেই অভিযানে। বাস্তবে তাই হয়েওছিল। বেশ বড়ো একটা দল নির্ধারিত সময়ে গ্রাম ছেড়ে বের হয়ে পড়েছিল সেবার। রওনা দেবার আগে ভবানীর সংকেত যাচাই করে নেয়া হয়েছিল। তাতে খুব অশুভ কিছু না দেখালেও একেবারে খারাপ কিছু ছিল না। কিন্তু রওনা হবার কিছুদিনের মধ্যেই ঝগড়াঝাঁটি বেধে দলটা ভেঙে গেল। ছোট ছোট দল হয়ে তারা নানা দিকে চলে গেল শিকারের খোঁজে। কিছুকাল পরে ফিরেও এলো সব। রোজগারপাতি তাদের সেবার বিশেষ কিছু হয়নি। শুধু একটা দলের কোন খোঁজই পাওয়া যায়নি আর। বদ্রীনাথ, ছজন বাছা বাছা লোক নিয়ে বাংলা মুল্লুকের দিকে গিয়েছিল। তাদের দলটা যেন হাওয়ায় উবে গেল একেবারে।
বহুকাল পরে আমি তাদের পরিণতির কথা জানতে পেরেছিলাম। কলকাতায় পৌঁছে দলটা বেশ ভালোরকমই আয় রোজগার করছিল, কিন্তু সেসব টাকা নানান বাজে খরচায় উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে তারা যখন ফেরার পথ ধরল তখন সকলেরই প্রায় হাত খালি।
বেনারসের কাছে পৌঁছে যখন একেবারে উপোস করবার দশা হয়েছে তখন একটা তীর্থযাত্রীর দলকে তারা নিকেশ করে। কিন্তু তাড়াহুড়োয় তারা শরীরগুলোকে ঠিকঠাক মাটিতে পোঁতে নি। এদের মধ্যে একটা লোক বেঁচে যায়। তার মুখে সব খবর শুনে বদ্রীনাথদের খুঁজে বের করে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছে যে লুটের মাল ছিলো সেগুলোকেও চিহ্নিত করে সেই বেঁচে যাওয়া পথিক। বদ্রীনাথদের গোটা দলটাকে ফাঁসিতে লটকে দেয়া হয়েছিল।
বদ্রীনাথ আর সরফরাজ খান দুজনেই এইভাবে চলে গেল। বাবা তখন অবসর নিয়েছে। হুসেনও বয়সের ভারে আর নতুন কাজে লাগবার অবস্থায় নেই। আমি তখন পীর খান আর মোতিরামকে কাছে টেনে নিলাম। দুজনেই তখন আমার মতোই জেমাদার পদে উঠেছে। সৎ আর কর্মঠ মানুষ হিসেবে দলে দুজনেরই নামডাকও হয়েছে। পরের বছরের অভিযানের সব ছক কষা হল আমাদের এই তিনজনে মিলে। পঞ্চাশজন কমবয়েসি দক্ষ ছেলেকে নিয়ে আমাদের দল তৈরি হল।
সে বছর দশেরার পরদিন আমরা গ্রামের কাছেই একটা জঙ্গলের মধ্যে এসে একত্র হলাম। এ জায়গাটা থেকে শুরু হওয়া কোন অভিযানই নাকি সে অবধি বিফল হয় নি। ভারি সুন্দর লাগছিল চারপাশটা। ক্ষেতে ক্ষেতে জোয়ারের ফসল ফলেছে। চারপাশ সবুজ রঙে ভরপুর। চারপাশে পাখির ডাক। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। জমায়েতে গুরুজন হিসেবে আমার বাবা আর হুসেনও হাজির ছিল। নিয়মমাফিক ভবানীর পুজোটুজো সেরে সংকেত নেয়া হল। দেখা গেল ভবানী খুব খুশি। দারুণ শুভ সব সংকেত পাওয়া গেল সেবার। আমার যদিও এসব সংস্কারে কোনকালেই বিশ্বাস ছিল না, তবু দলের সবার ওতে বেশ উৎসাহ বেড়ে গেল দেখে আমিও বেশ খুশিই হলাম।
তার পর বাবা সবাইকে ডেকে বলল যে বয়স বাড়ার ফলে বাবা বা হুসেন আর অভিযানে যাবে না। তার বদলে সে বছরে সবাই যেন আমাকে বাবার প্রতিনিধি হিসেবে দলনেতা বলে মেনে নেয়। এর আগের বছরের ব্যর্থ অভিযানের নজির দেখিয়ে বাবা আরও বলল, কেউ যেন দলের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি না করে। তাতে ভবানী অসন্তুষ্ট হন, আর তার ফলে দলের ওপর দুর্ভাগ্যও নেমে আসে।
বাবার কথা শেষ হলে দলের সবাই ভবানীর নামে শপথ করে আমাকে তাদের নতুন নেতা বলে মেনে নিল।
আমার পরিকল্পনা ছিল, আমরা দক্ষিণের দিকে রওনা হয়ে জব্বলপুর বা নাগপুর অবধি গিয়ে তারপর অবস্থা বুঝে পুবমুখে বা পশ্চিমমুখে ঘুরে দেশে ফিরে আসব। পথে খান্দেশ এলাকাটা ঘুরে নেবো বলে ঠিক করেছিলাম। ও অঞ্চলটা ঠগিদের বিশেষ যাতায়াত নেই। কিন্তু খবর পেয়েছিলাম বম্বের ব্যবসায়ীরা মালবের আফিম কেনবার জন্য ও অঞ্চল দিয়ে অনেক টাকাপয়সা পাঠায় নিয়মিত। আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম,পরিকল্পনা মাফিক কাজ হলে মাত্র কয়েকমাসের মধ্যে আমরা সেই তিনবছর আগের মতই প্রচুর লুটের মাল নিয়ে ফিরতে পারবো এবারেও।
ক্রমশ