টাইম মেশিন

।২৫।

আলোচনাসভার শেষে বাড়ি ফিরে এসে আজিমাকে বললাম, দক্ষিণে সেবার ব্যাবসা করে টাকাপয়সা যা এসেছিল সে’সব প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। বাড়িতে তার কাছে থাকতে যদিও আমার খুব ভালো লাগে, কিন্তু এইবার না বের হলে আর উপায় নেই। বাবা আমায় কিছু টাকা দিয়েছে মূলধন হিসেবে। নাগপুরের বাজারের যা খবর পেয়েছি তাতে সেখানে ভালো ব্যাবসার সম্ভাবনা রয়েছে। সব ঠিকঠাক চললে এযাত্রা ফের মোটা রকম লাভ করতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।

আজিমা সে’সব কথা মোটেই শুনতে রাজি নয়। নানা যুক্তি দেখিয়ে সে আমাকে আটকাতে চাইল,পথে কত বিপদ আপদ আসতে পারে সে’সব ভয় দেখাল। আমি ধৈর্য ধরে তাকে বোঝালাম যে আমার না গিয়ে উপায় নেই। সাগরে আমার লোকজন বেশ কিছু ঘোড়া জোগাড় করে নিয়ে অপেক্ষা করছে। আমি সেগুলোকে নিয়ে নাগপুরের বাজারে বিক্রি করতে যাব। তখন সে ধরে বসল,তাহলে তাকে আর ছেলেটাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। তখন আর এক প্রস্থ বোঝানোসোজানো, কান্নাকাটির পালা চলল। অনেক কষ্টে শেষমেষ তাকে বাড়িতে থাকতে রাজি করানো গেল বটে, কিন্তু যেদিন রওনা দেব তার আগের দিন সে একবোঝা মালা, আংটি, মাদুলি তাবিজ এনে আমার গলায় হাতে কোমরে ঝুলিয়ে দিল। বলে নাকি আমার জন্য নানান ফকির আর মোল্লার কাছ থেকে জোগাড় করে এনেছে। তারপর তাকে, ছেলেকে আশীর্বাদ করে টরে আমি ছাড়া পেলাম।       

বাড়ি থেকে বের হতে যেটুকু মন খারাপ লাগছিল,দলের সঙ্গে গিয়ে যোগ দিতে সে’সব ঘুচে গেল। দেখলাম আমার নেতৃত্বকে সবাই মেনে নিয়েছে। সম্মানটম্মানও করছে। মনে যেন নতুন উৎসাহের জোয়ার এল। নিজেকে বললাম,  “আমীর আলি, এইবার তোমার গৌরবের দিন শুরু হল হে!”

বদ্রীনাথ আর না থাকায় এ যাত্রায় গোপীনাথ আমাদের দলের পুরুৎ। রওনার আগে লক্ষণটক্ষণ বিচার করে সে রায় দিল সব শুভ। প্রথম কয়েক ক্রোশ রাস্তা বাবা আর হুসেন আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আমায় নানান উপদেশ টুপদেশ দিতে দিতে চলল। তার মধ্যে প্রধান উপদেশটা ছিল, পারতে মেয়েদের গায়ে হাত না তোলা। বাবা বলছিল, “আগেকার দিনে তো মেয়েদের গায়ে হাত তোলাই হত না, যদি কোন দলের সঙ্গে মেয়েরা থাকত তাহলে সে দল ভালো শিকার হলেও তাদের ছেড়ে দেয়া হত। মনে করা হত তাঁর স্বজাতীর কাউকে মারলে দেবী ভবানী রাগ করবেন। এখন দিনকাল বদলেছে। কেউ আর সেসব–”

“তুমি নিশ্চিন্ত থেকো বাবা,” আমি বললাম, “আগের যাত্রায় মেয়ে খুন করবার ব্যাপারে আমি তো মানা করেছিলাম, কিন্তু বদ্রীনাথ আর সরফরাজ খান কথা শুনল না। তাদের পরিণতিটা তো দেখলাম!”

“না না, অত সাংঘাতিক কিছু ভেবে বসিস না। আমি আর হুসেনও তো সারা জীবনে কম মেয়ে খুন করিনি। কই আমাদের তো কিছু হল না! আমি বলতে চাইছি যা করবি, বিচার বিবেচনা করে করবি। অযথা যেন কেউ মেয়েদের না মারে।”

গ্রামের সীমানায় পৌঁছে বাবারা ফিরে গেল। আমি আমার দল নিয়ে এগিয়ে চললাম সামনের দিকে।

আমাদের দলের প্রথা হল,প্রথম শিকারটা না হওয়া পর্যন্ত কেউ পান খাবে না বা চুলদাড়ি কামাবে না। ওতে অনেকের খানিক অসুবিধে হয়। এবারের যাত্রায় সে অসুবিধেটা বেশ ভালোরকমই হল। চারদিকে চোখকান খোলা রেখেও এমন একটা দল পাই না যাতে কোন মেয়ে নেই। ওদিকে আমিও পণ করেছি যে দলে মেয়ে আছে তাদের গায়ে হাত দেয়া চলবে না। তার পেছনে বাবার উপদেশ যতটা কাজ করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করছিলো বার বার আজিমার মুখটার কথা মনে পড়ে যাওয়া।

এইভাবে চারদিন খালি হাতে কাটবার পর পাঁচদিনের মাথায় একটা ভালো শিকারের সন্ধান মিলল। সেদিন সকাল-সকাল একটা চৌমাথার মোড়ের কাছে পৌঁছে ন’জন লোকের একটা দলের দেখা পেলাম আমরা। লোকগুলোকে দেখে ভদ্রবংশের বলেই মনে হয়। তিনজন টাট্টু ঘোড়ায় চেপে চলেছে,আর বাকিরা পায়ে হেঁটে। মোড়ে পৌঁছে তারাও,আমরা যে রাস্তাটা ধরব বলে ঠিক করেছিলাম সেই রাস্তাটাতেই ঢুকে এল। দেখে আমাদের খুশি ধরে না। মোড়ের মুখে পৌঁছে আমরা ভান করতে শুরু করলাম যেন কোন পথে যাব বুঝতে পারছি না। তারা আমাদের ঠিক রাস্তাটা দেখিয়ে দিল।

আমাদের এতবড়ো দলটা দেখে একটু আশ্চর্য হলেও, একসঙ্গে পথ চলতে তারা বিশেষ আপত্তি করল না। দলটার নেতাগোছের একজনের সাথে আমি গিয়ে গল্প জমালাম। তার কৌতুহলের জবাবে জানালাম, আমরা পেশায় সৈন্য। নাগপুরে ঘাঁটি। হিন্দুস্তানে ছুটি কাটিয়ে কাজের জায়গায় ফিরছি। আমার প্রশ্নের জবাবে তার কাছ থেকে জানা গেল তারা দুই ভাই, আরো কিছু লোকের সঙ্গে চলেছে ইন্দোর থেকে বেনারসের দিকে। ধর্মকর্ম করবে,আর তার সাথে কিছু দামি কাপড়চোপড়ও কিনে আনবে ব্যাবসার জন্য।

শুনে আমি মনে মনে বললাম, তার মানে কাছে নগদ ভালোই আছে তোমাদের। এরা যে আমাদের সঙ্গে ভিড়েছে তা এখনো কারো চোখে পড়েনি। কাজেই এদের যদি খুব তাড়াতাড়ি নিকেশ করে ফেলা যায় তাহলে আমাদের ওপরে কারো সন্দেহ হবার ভয়টাও থাকবে না। একটু পিছিয়ে পড়ে দলের একেবারে শেষে হাঁটতে থাকা পীর খানকে আমি খবরটা দিয়ে দিলাম। সে গোটা দলের মধ্যে চুপচাপ খবরটা ছড়িয়ে দিল আকারে-ইঙ্গিতে।

চলতে-চলতেই দেখতে পাচ্ছিলাম, গোটা দলটা তৈরি হচ্ছে। প্রত্যেকটা শিকারের সঙ্গে তিনজন করে দলের লোক লেগে গেছে। বাকিরা তাদেরকে ঘিরে এমনভাবে হাঁটছে যাতে কেউ ফাঁক পেয়ে পালাতে না পারে।

রাস্তাটায় আমি আগেরবারও গেছি। ফলে আমার জানা ছিলো,জায়গাটা একেবারে ন্যাড়া লাগলেও খানিক দূরেই একটা নদী রয়েছে। তার বালিভরা খাতে অনেক ঝোপঝাড়। সেখানে শরীরগুলো লুকিয়ে ফেললে কেউ আর কোন চিহ্ন খুঁজে পাবে না।

নদীটার ধারে পৌঁছে, যে লোকটার সঙ্গে আমি কথা বলছিলাম,সে একটু বিশ্রাম নিতে চাইল। বলে,“কাল মাঝরাত থেকে হাঁটছি। এবারে একটু না বসলেই নয়।” আমিও ঠিক তাই চাইছিলাম। কাজেই আপত্তি করলাম না।

ঘোড়াটাকে নিয়ে নদীতে জল খাবার জন্য ছেড়ে দিয়ে দলের মধ্যে ফিরে এসে দেখি,লোকগুলো খাবারদাবার বের করে বসেছে। দলের লোকজন তাদের চারপাশে দাঁড়িয়ে, বসে আরাম করছে,কিন্তু সবাই যার যার নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়েনি একেবারেই।

ভুত্তোটরা নিঃশব্দে রুমালগুলো হাতে তুলে নিচ্ছিল। আমি ঝিরনি দিতে যাবো, ঠিক সেই মুহূর্তে বেশ খানিক দূরে কাদের যেন গলার শব্দ আমার কানে ধরা পড়ল। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলাম আমি। খানিক বাদেই দেখি চোদ্দজন লোকের একটা দল এদিকে আসছে। চেহারা দেখে ভক্তি হয় না বিশেষ। সাধারণ লোক সব। একবার ভাবলাম এগুলোকেও শেষ করে দেব,কিন্তু লোকগুলোর কপাল ভালো। তারা এগিয়ে এসে আমাদের দেখে একেবারেই না দাঁড়িয়ে দু’একটা কথা বলেই নিজেদের পথে চলে গেল।

খানিক অপেক্ষা করে আমি হাঁক দিলাম, “তাম্বাকু লাও।” সঙ্গে সঙ্গে ভুত্তোটরা ঝাঁপিয়ে পড়ল রুমাল হাতে। যে লোকটার সঙ্গে আমি কথাবার্তা বলছিলাম,তার সঙ্গে কথা বলতেবলতেই আমি তার গলায় রুমালটা জড়িয়ে ফেললাম। দেখা গেল তিন বছর ঘরে বসে থেকেও কায়দাকানুন আমি কিছুই ভুলিনি। মুহূর্তের মধ্যে তার মৃতদেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। চারদিকে তাকিয়ে দেখি বাকিরাও তাদের কাজ শেষ করে ফেলেছে। একটা লোক তখনও একটু নড়ছিল। কিন্তু তাকেও থামিয়ে দেয়া হল প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই।

timemachinethogi5501 (Medium)লুগাইদের দিকে ফিরে বললাম, “তাড়াতাড়ি গর্ত খুঁড়ে ফেলো সব।” উত্তরে তাদের একজন হেসে বলল, “সব হয়ে গেছে। দয়ারাম আর আরো চারজন খানিক আগেই ওই ঝোপগুলোর দিকে চলে গিয়েছিলো খেয়াল করেননি?”

সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে আমরা এবারে লোকগুলোর জিনিসপত্র হাতড়াতে শুরু করে দিলাম। খেয়াল করিনি কখন যেন আরো দুটো লোক সেইখানে এসে হাজির হয়েছে। সবকিছু দেখে তারা এমন ভয় পেয়ে গেল যে জায়গা থেকে নড়বার ক্ষমতা চলে গেল তাদের। আমি তাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম, “হতভাগা। আমাদের কাজ যখন দেখেই ফেলেছিস তখন মরবার জন্য তৈরি হ।”

তাদের মধ্যে লম্বা চওড়া চেহারার একটা লোক এইবার ভয় কাটিয়ে বুক টান করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “সাহেব, সময় যখন এসেই গেছে, তখন মরবার ভয় আমি করি না।”

বললাম, “বাঁচবার একটা সুযোগ আমি তোমাদের দিতে পারি। আমাদের দলে ভিড়ে যাও।”

সে অহংকারী গলায় বলল, “কক্ষনো না। তিলক সিং রাজপুত প্রাণের ভয়ে এই পাপের পেশা নেবে না। আমরা মাত্র দু’জন। আপনারা অনেকে আছেন। কিন্তু আপনাদের কারো মধ্যে যদি মরদের রক্ত থেকে থাকে তাহলে সে একা আমার সামনে লড়াই করতে আসুক। দেখি কত ক্ষমতা!” এই বলে সে তার তলোয়ার খুলে দাঁড়াল।

 “আমি নিজে লড়বো তোর সাথে,” এই বলে আমিও আমার কোমর থেকে তলোয়ার খুলে হাতে তুলে নিলাম। দলের মধ্যে একটা বিরাট হইচই পড়ে গেল। সবাই তখন আমায় আটকাতে চাইছে। বলে ও লোকটার সঙ্গে তুমি এঁটে উঠতে পারবে না। আমি তাদের কথা কানে না তুলে বললাম, “চলে আয়। দেখি কত তাকত ধরিস হাতে। ইনশাল্লা এই জায়গা থেকে আজ তুই জ্যান্ত ফিরবি না।”

timemachinethogi5502 (Medium)“চলে আয় ছোকরা। যদি তোমার দলবল এসে না ধরে তো আজ একা লড়লে তোর অত গর্ব আর থাকবে না রে!” বলতে বলতে সে-ও এগিয়ে এলো।

আমি পেছন ফিরে বললাম, “শুনে রাখো,এই লোকটা আমার। অন্যটাকে তাড়াতাড়ি নিকেশ করে দাও, কিন্তু এর গায়ে আমি ছাড়া কেউ হাত দেবে না।”

বলার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই তিলক সিং-এর সঙ্গী অন্য লোকটা মাটি নিলো।

তলোয়ার উঁচিয়ে আমার দিকে এগোতে এগোতে রাজপুতটা বলল, “মরব যখন তখন বীরের মত যুদ্ধ করে মরব। এর মত কুকুরের মৃত্যু আমার জন্য নয়।”

লোকটার হাতে কোন ঢাল ছিলো না। সেটা একটা সুবিধে। কিন্তু উচ্চতায় আর শক্তিতে সে আবার আমার চেয়ে অনেকটা এগিয়ে। বুঝতে পারছিলাম এ লড়াইয়ে কৌশল আর দক্ষতাই আমার একমাত্র সহায়।

একটা ক্ষ্যাপা জন্তুর মত তেড়ে এসে সে আমার চারদিকে দৌড়ে দৌড়ে তলোয়ারের কোপের পর কোপ মারতে শুরু করল। আমি তার একটা জবাবি আক্রমণও করছিলাম না। শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে তার তলোয়ারের আঘাতগুলো আমার ঢাল আর তলোয়ার দিয়ে ঠেকিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি জানতাম,এইভাবে আর কিছুক্ষণ চললেই লোকটার দম ফুরিয়ে যাবে। তখন আমার সময় আসবে।

খানিক বাদে হাঁফাতে হাঁফাতে দাঁড়িয়ে পড়ে লোকটা বলে, “ব্যাটা বিধর্মী বেজম্মা, জায়গা ছেড়ে না নড়ে বাঁচবি ভেবেছিস?”

আমি নিচু গলায় বললাম, “আমায় যা বললি,তাতে তোর আর কোন আশা নেই,” বলতে বলতেই ঝড়ের মত আমি গিয়ে পড়লাম তার ওপরে। লোকটা এইরকম একটা প্রতি-আক্রমণের জন্য একেবারেই তৈরি ছিল না। ক্ষীণ একটা প্রত্যাঘাত সে করল বটে কিন্তু আমি সহজেই সেটা আমার ঢালে আটকে দিলাম। পরমুহূর্তে আমার তলোয়ার গিয়ে তার গলায় ঢুকে গেল।

পীর খান পেছন থেকে হাঁক দিয়ে উঠল, “শুকুর খুদা। ব্যাটাকে উপযুক্ত পুরস্কারই দিয়েছো।” বলতে বলতে সে এগিয়ে এসে আমায় দু’হাতে জড়িয়ে ধরল।

রাজপুতটা তখনো মরেনি। শুয়ে শুয়েই সে আমার দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল আর কিছু বলবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু মুখ দিয়ে বের হতে থাকা রক্তের ফলে তার কোন আওয়াজ বের হচ্ছিল না। সেদিক দেখে আমি বললাম,“এর কষ্টের শেষ করে দাও কেউ। লোকটা ভালো লড়েছে।”

শুনে পীর খান তলোয়ার তুলে নিয়ে তার বুকের মধ্যে গেঁথে দিতে সে একবার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে থেমে গেল। লুগাইরা এসে তাড়াতাড়ি মৃতদেহটার হাত পা ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে গোটা জায়গাটায় কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর কোন চিহ্নও রইলো না আর।

আমাদের মরশুমের প্রথম কাজ থেকে টাকাপয়সা বেশ ভালোই পাওয়া গিয়েছিল।  তাই দেখে দু’একজন যে বাড়ি ফিরে যাবার কথা না বলেছিল তা নয়, কিন্তু বাকিরা সবাই তাদের কথা উড়িয়ে দিল।

অতএব আমরা এগিয়ে চললাম। সাগর পৌঁছোতে পৌঁছোতে আমাদের শিকারের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো ঊনিশে। টাকাপয়সা অবশ্য সেই প্রথম শিকারের পর বিশেষ মেলেনি। এক-একটা শিকারের কাছ থেকে দশ-বিশ টাকা করে পেয়েই খুশি থাকতে হয়েছিলো আমাদের।

হুসেনসাগরের ঝিলটার মতই বড়ো একটা ঝিলের পাশে সাগর শহরটা তৈরি হয়েছে। ঝিল থেকে বয়ে আসা ঠাণ্ডা হাওয়ায় ব্যস্ত শহরটার আবহাওয়া বেশ সুন্দর। এই ঝিলের ধারেই শহরের একপ্রান্তে আমরা গিয়ে ঘাঁটি গাড়লাম। দিনতিনেক সাগরের বাজারে ঘোরাঘুরি করবার পর একদিন সন্ধেবেলা বসে তামাক খাচ্ছি তখন পীর খান এসে বলল, “ভালো খবর আছে। বাজারে আমার চেনা এক ভুত্তেরা (ঠগিদের গুপ্তচর। এরা নানা গ্রামে শহরে ছোটখাটো কাজ আর ব্যাবসা করত, আর ঠগিদের দলকে শিকারের খবর বিক্রি করত) আছে। সে বলল এক রইস সাহুকার দিনসাতেকের মধ্যে সাগর ছেড়ে রাস্তায় বের হবে। যাবে আমরা যেদিকে যাচ্ছি সেদিকেই। কিন্তু আমরা এখানে থাকলে কাজ হবে না। আমার ভুত্তেরার পরামর্শ হল গোটা দলটা কয়েক ক্রোশ গিয়ে গিয়ে পথে কোথাও অপেক্ষা করুক, আর দলের দুতিনজন বিশ্বাসী লোক এখানে থেকে যাক খবরটবর আনা নেয়া করবার জন্য। আপনি কী বলেন?”

“উলহমুদ-উল ইল্লা। ভালো খবর বলেই মনে হচ্ছে পীর খান,” আমি জবাব দিলাম, “যা বলেছে ঠিক তাই করব। কাল ভোর ভোর রওনা হয়ে যাব আমরা। ভালো দৌড়বাজ দুতিনজনকে বেছে নাও পেছনে রেখে যাবার জন্য।”

“একটা কথা মীরসাহেব, লোকটা কিন্তু কাজ হয়ে গেলে বখরা চাইছে অনেক।”

“তাতে আর আপত্তি কী? বিশ্বাসী হলেই হল।”

“সে নিয়ে ভাববেন না। লোকটা কথার খেলাপ করে না। ”

“বেশ। তা কত চাইছে?”

“প্রতি পাঁচ হাজারে দুশো টাকা করে।”

“সাহুকার যদি রইস হয় তাহলে আমাদের অসুবিধে হবে না। গিয়ে বলে এসো আমরা রাজি।”

“ঠিক আছে। আমি চললাম। যদি না ফিরি তো বুঝবেন আমি রয়ে গেছি।” এই বলে বিশ্বাসী কয়েকজন লোককে সঙ্গে করে জামাকাপড়ের ছোটো একটা পুঁটুলি নিয়ে পীর খান বেরিয়ে গেল।

ক্রমশ

ছবিঃ মৌসুমী

আগের পর্বগুলো এই লিংকে