আগের পর্বগুলো
“হ্যাঁ মহারাজ আমি দেখিনি। কিন্তু বুধি দেখেছে। ডাকান তাকে।”
বুধির নাম শুনে আমার শেষ আশাটুকুও চলে গেল। ভেবেছিলাম, সূরয বাবার নামে রাগ করে বানিয়ে বানিয়ে বলছে এমনেকটা ক্ষীণ আশা এতক্ষণ কাজ করছিল আমার মনে। কারণ বাড়ি ফেরবার পর বাবা এই যশোবন্ত মল সাহুকারকে মারবার কথা কিছু বলেই নি আমায়। কিন্তু বুধি বাবার প্রধান লুগাই। তাকে যখন ডেকেছে তার মানে ব্যাপারটা মিথ্যে হবে না।
খানিক বাদে বুধিকে শেকল বাঁধা অবস্থায় সভার মাঝখানে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হল। আমাকে আর বাবাকে বন্দি দেখে তার মুখটা ভারী করুণ হয়ে গেল। সে অন্য ধর্মের মানুষ হলেও বাবা তাকে চিরকাল পুত্রস্নেহে দেখেছেন।বাবার স্নেহে সে দলে উন্নতিও করেছে অনেক। আজ সেই বাবাকে এই দশায় দেখে , আর তার বিরুধে কথা বলতে হবে ভেবে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু সে কিছু বলবার আগেই রাজা কথা বললেন, “হারামজাদা, সব সত্যি কথা বলবি তুই। সরকারের হয়ে সাক্ষি দিবি এই শর্তে ফিরিঙ্গিরা তোর জান বাঁচিয়েছে সেটা মনে রাখিস। কিন্তু ফিরিঙ্গিতে যাই বলুক, এখানে এখন একটাও মিথ্যে কথা বললে, আর এক ঘড়ি সময়ও বাঁচবিনা। হাতির পায়ের নিচে ফেলবো তোকে। এই কে আছিস হাতি নিয়ে আয় এখানে, আর শেকল তৈরি রাখ। এক্ষুণি কাজে আসবে। নে, এবারে বল। যশোবন্ত মলের ব্যাপারটা বল সবাইকে। একটা শব্দ বাদ দিবি না।”
বুধির কপালের শিরাগুলো ফুলে উঠছিলো। তার মুখটার দিকে তখন তাকানো যাচ্ছে না। ওদিকে বাবা ভারী করুণ চোখে তখন তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যেন বুধি যদি বলে সে নির্দোষ তাহলেই সব বিপদ কেটে যাবে। খানিক ওইভাবে থেকে একটা ম্লান হাসি মুখে মেখে বাবা বলল, “বল বুধি বল। মহারাজকে বল, এই বুড়ো ইসমাইলের কোন দোষ নেই। বলে দে-”
“চোপ। সাক্ষিকে কোনভাবে ভুলপথে চালাবে না। আর একটা কথা বললে মুখটা বেঁধে রেখে দেবো তোমার।বিচার তুমি পাবে। একেবারে সুবিচার,” এই বলে পাশে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোকের দিকে ঝুঁকে রাজা বললেন, “আপনি সব ভালো করে খেয়াল করে যান মীরসা’ব, তারপর ফিরিঙ্গিদের গিয়ে বলবেন, ঝালোনের দরবারেও সুবিচার হয়। আর বুধি, ওই দ্যাখ্ হাতি এসে গেছে। ভগবানের নাম স্মরণ কর। গঙ্গা কসম, এক্ষুণি সব কথা না বললে তুই হাতির পায়েই যাবি। কেউ তোকে বাঁচাতে পারবে না। তোর চোখমুখ বলছে তুই সব জানিস।”
বুধি এইবারে একটু ইতস্তত করে বলল, “মহারাজ আর সব খুনের কথা আমি জানি, বলতে পারি, কিন্তু এই একটা খুন আমি কিছু দেখিনি, আমি বলতেও পারব না।”
সূরজ সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, “বুধি মিথ্যে কথা বলছে মহারাজ। ও সব জানে।”
মহারাজ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “শোন্ বুধি, ওই দেয়ালের ছায়াটা এই মসনদের থেকে এক বিঘত দূরে আছে এখন। ছায়াটা মসনদ অবধি পৌঁছোন পর্যন্ত তুই বাঁচবি। তার মধ্যে সত্যি কথা না বললে তোর প্রাণটা যাবে হাতির পায়ে। এখন ভেবে দ্যাখ।”
বুধি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। সভার লোকজনের চোখ তখন সেই আস্তে আস্তে মসনদের দিকে এগোতে থাকা ছায়াটার দিকে আটকে আছে।
বুধির তখন গলগল করে ঘামছে। হাত পা কাঁপছিল তার ছায়াটার দিকে চোখ রেখে। হঠাৎ সূরজ ফের চিৎকার করে বলল, “আরে মূর্খ, এদের বাঁচাবার জন্য তুই হাতির পায়ে নিজেকে পেষাতে চাস? মহারাজকে সব কথা বলে দে, তাহলে প্রাণে বেঁচে যাবি।”
এইবারে কথায় কাজ হল। বুধি ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমায় বাঁচান মহারাজ। আমি ভয়ে মিথ্যে বলে ফেলেছিলাম। যশবন্ত মলকে খুনই করা হয়েছে, আমি নিজের হাতে তার শরীরটাকে কবরে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিলাম। শরীরটা তখনও গরম ছিল মহারাজ।”
“হায় ভগবান! হায় সীতা-রঘুপতি! যশবন্ত তাহলে আর নেই!” মুখে হাত দিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন রাজা। তারপর হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলেন, “নাঃ মেয়েদের মত কান্না আমায় শোভা দেয় না। কমবখ্ৎ, এই শয়তানটা তখন ঠিক কী করেছিল খুলে বল।”
“মহারাজ, সাহুকারের সঙ্গে আমাদের যখন দেখা হল, ইসমাইল তখনই বুঝে গিয়েছিল, আমাদের গোটা দলটাকে একসঙ্গে দেখলে সাহুকার সন্দেহ করবে। তাই দলের বেশির ভাগটাকেই প্রথমে গ্রাম থেকে সরিয়ে দেয় ইসমাইল। সঙ্গে রাখে শুধু বাছা বাছা কয়েকজনকে। তারপর যশবন্তকে একরকম জোর করেই গ্রামের বাইরে আমাদের ঘাঁটিতে এসে থাকতে রাজি করায়। যশবন্ত একটু ইতস্তত করছিল দেখে নিজে গিয়ে তাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসে। সে আসবার অনেক আগে থেকেই তার কবরটা খুঁড়ে তৈরি রাখা হয়েছিল। তাকে নিয়ে আসবার এক ঘন্টার মধ্যে দুজন ভুত্তোট মিলে ইসমাইলের সামনে তার গলায় রু
মাল দেয়। তার সঙ্গে আসা চাকরবাকরগুলোরও একই দশা করা হয়। টাকাপয়সা সাহুকারের সঙ্গে বিশেষ ছিল না। কাজেই লাভ আমাদের বিশেষ হয়নি। তার টাট্টুটা পরদিন গ্রামে বিক্রি করে পঁচিশটা টাকা পাওয়া গেছিল, ওই যা লাভ। সাহুকারের সঙ্গে কয়েক হাজার টাকার হুন্ডি ছিল। সে’সব দিয়ে আমাদের লাভ হত না কিছু, তাই সেগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়।”
“হয়েছে হয়েছে। এবার থাম। যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে,” বলে রাজা সূরযকে থামিয়ে দিলেন।
বুধি কিন্তু না থেমে বলতেই থাকল, “মহারাজ, আর একটা কথা বাকি আছে। ইসমাইল জেমাদারের আঙুলে যে আংটিটা দেখছেন ওটা খুলে নিয়ে দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা! ওটা যশবন্ত মলের আংটি।”
সঙ্গে সঙ্গেই বাবার আঙুল থেকে একটা আংটি টেনে খুলে নিয়ে রাজার সামনে পেশ করা হল। আংটিটা সভার সকলে পরীক্ষা করে দেখলেন। শেষে এক সাহুকার বলল, “ এ আংটি যশবন্তেরই মহারাজ। দেখুন, ভেতরের দিকে ওর নাম খোদাই করা আছে।”
“যথেষ্ট হয়েছে,” গর্জন করে উঠলেন মহারাজ। নাম না থাকলেও আমি জানতাম ওটা যশবন্তেরই আংটি। ওতে বসানো হীরেটা আমি হাজারটা আংটির মধ্যে থেকে চিনে নিতে পারবো। এই কে আছিস, এই ইবিলিশটাকে নিয়ে গিয়ে হাতির সঙ্গে শেকল দিয়ে বেঁধে ফেল তো! হাতি দিয়ে টানিয়ে এটাকে সারা শহর ঘোরাবি, আর ঢেঁড়া দিয়ে দিবি এ ঠগিসর্দার ছিল।”
রাজার পাশে দাঁড়ানো মীর নামের সৈয়দটি হঠাৎ বললেন, “থামুন মহারাজ। আইনের নিয়ম হল, অপরাহীকে নিজের পক্ষে কিছু বলার থাকলে তা বলতে দিতে হবে। শাস্তি দেবার আগে এর কথাও শুনে নিন।”
শুনে রাজা বাবার দিকে ঘুরে বললেন, “বল কমবখ্ৎ, কী বলবার আছে তোর বল।”
শুনে বাবা হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল। মুখ থেকে খানিক আগের সেই ভয়ের ভাব একেবারে চলে গেছে। যতক্ষণ বাঁচবার এতটুকুও আশা ছিল ততক্ষণ মরবার ভয়টাও পেয়ে বসেছিল তাকে। কিন্তু সব আশা শেষ হয়ে যেতে সেই ভয়টাও একেবারে চলে গেছে তখন তার। মাথা উঁচু অরে রাজার চোখে চোখ রেখে বাবা বলে, “নাঃ। মিছে কথা ঠোঁটে নিয়ে মরতে আমি রাজি নই। মরবই যখন তখন আর লুকোছাপা করব না কোন। হ্যাঁ। যশবন্তকে আমিই মেরেছি। কেন মেরেছি জানেন? কারণ সে-ও আপনারই মত একটা শয়তান ছিল রাজা। ঠগিদের দিয়ে মানুষ মারানোর কাজে তার আপনারই মত উৎসাহ ছিল। আর তার বদলে তাদের পরিচয় গোপন রাখবার বিনিময়ে সে তাদের চুষে খেত, ঠিক যেমন করে আপনি খান, সেইভাবে। আমি শয়ে শয়ে লোক মেরেছি, কারণ ওপরওয়ালা তাদের আমার হাতে তুলে দিয়েছেন শিকার করবার জন্য। কিন্তু আপনার এই বন্ধুকে মেরে আমি যা সুখ পেয়েছি তা আগে কখনো পাইনি। নিজের মধ্যেটা একবার তাকিয়ে দেখুন রাজা। আমাদের সব অপ্রাধের বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিলেন আপনি। আমার জীবনের আর কতটুকু দাম। বুড়ো হয়েছি। এবার এমনিতেই একদিন চলে যেতে হত। দুদিন আগে আর দুদিন পরে এই যা তফাৎ। কিন্তু ভবানীর ভক্তের প্রাণ নেবার জন্য আপনাকে ভবানীর কাছে জবাবদিহি করতে হবে রাজা। আমার রক্ত আপনার হাত থেকে কখনো মুছবে না। আমার অভিশাপ আপনার মাথায় চিরকাল লেগে থাকবে। আমার যত অপরাধের পয়সা তার ভাগ আপনি নিয়েছেন, না না অধৈর্য হবেন না, আমায় সবটা বলতে দিন, আর কেউ জানুক না জানুক, আপনি তো জানেন যে আমি মিথ্যে বলছি না, আল্লাহ এর বিচার করবেন। জাহান্নমে যাবেন আপনি রাজা। আপনি–”
“এর মুখ বন্ধ কর কেউ। জুতো গুঁজে দে একটা এর মুখে,” রাজা একটা বুনো জন্তুর মত গর্জন করছিলেন। কষ দিয়ে ফেনা গড়াচ্ছিল তাঁর। বলেন, “একে আমার সামনে থেকে নিয়ে যা। এর ছেলে যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এর মরণটা দেখে–”
সঙ্গে সঙ্গে লোকজন আমাদের দুজনকে টানতে টানতে নিয়ে চলল। কাছাকাছি এসে আমি বললাম, “একটা কথা বাবা, তোমার ছেলের সঙ্গে একটা কথা বলে যাও–”
বাবা আমার দিকে মুখটা ঘুরিয়ে বলল, “আমি চললাম আমীর আলি। বেহেস্তে ফের দেখা হবে আমাদের। তুমি—তুমি আমার নিজের ছেলে নও। আল্লা তোমায় রক্ষা করুন–”
বলতে বলতে বাবার মুখে এসে সজোরে মারল একটা সেপাই। তারপর তাকে টানতে টানতে সামনে নিয়ে এগিয়ে গেল।
যেতে যেতে বাবা রামাসি ভাষায় আমাকে বলে গেল, “এর বদলা নিও আমীর আলি। ফিরিঙ্গিদের কাছে রাক্ষসটার সব কথা ফাঁস করে দিও। ওকে যখন সিংহাসন থেকে টেনে ধুলোয় নামাবে ওরা তখন আমার আত্মার শান্তি হবে।”
বাবার হাতদুটো বেঁধে কোমরে শেকল জড়িয়ে হাতির সামনের পায়ের সঙ্গে বেঁধে দেয়া হল। বাবা চিৎকার করে কলমা পড়ছিল তখন। তারপর মাহুত হাতির মাথায় অংকুশ চালাল। একটা হাঁক দিয়ে বাবার শরীরটাকে খড়কুটোর মত টানতে টানতে ছুটতে শুরু করল হাতি। তার কয়েক পা চলবার সঙ্গে সঙ্গেই বোধ হয় বাবার আত্মাটা শরীর ছেড়ে বেহস্তের পথে রওনা হয়ে গিয়েছিল।
ঝালোনের রাজাও কিন্তু শাস্তি এড়াতে পারেননি। এ ঘটনার পরপরই তাঁর কুষ্ঠরোগ হয়ে। পচেগলে মারা গিয়েছিল রাজা। ঠগিদের বিশ্বাস এ ছিল তাঁর ভক্তকে মারবার জন্য ভবানীর শাস্তি।
ক্রমশ