বাগুইআটি এসি মার্কেটের কাছে পশ্চিমমুখো পথ চলতে চলতে হাতের বাঁয়ে একটা দরজা। সাদামাটা। তাতে নীলের ওপরে সাদা হরফে লেখা দুটো মাত্র শব্দ। “পাখি বাড়ি।” বাইরে থেকে দেখলে বোঝবার উপায় নেই। অথচ দরজা খুলে ঢুকলেই, তার ভেতরে এক আশ্চর্য ম্যাজিক ওয়ার্ল্ড নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন—
পাখিবাবু
রিপোর্ট করলেন অংশুমান দাশ
দিদিমার রক্তাল্পতা – ডাক্তার নিদান দিলেন, কচি পায়রার মাংস। পায়রা এল, পায়রার বাচ্চা। ঠিক রান্নার সময় দেখা গেল –পায়রা নেই, খাঁচা আছে যেমন কে তেমন। উড়তে পারে না, সে পায়রা যাবে কোথায়? পাওয়া গেল দু-সপ্তাহ পরে চিলেকোঠায়, ঝুড়ি চাপা। দিব্যি বেঁচেবর্তে। হাতেনাতে ধরা পড়লেন চোর দিদিমার পেয়ারের নাতি সুব্রত চক্রবর্তী। আহা, ছোটো মানুষ তিনি তখন। শাস্তির বদলে পেলেন পায়রা পোষার ছাড়। ব্যস, সেই শুরু।
টিফিনে যা পেতেন দু-আনা চার-আনা জমিয়ে রাখতেন পাখি কেনার জন্য। হানা দিতেন হাতিবাগানের পাখিবাজারে। প্রথম কিনলেন চন্দনা। তারপর ধীরে ধীরে নানা জাতের দোয়েল, বুলবুলি, ঘুঘু, পায়রা। কখনও মাছ, খরগোশ। কিন্তু মূল নেশাটা তৈরি হয় দেশি পাখিকে ঘিরেই। পাখি-পাগল মানুষজনের সঙ্গে আলাপ হওয়া শুরু হয় –রঞ্জিত মিত্র, সত্যচরন লাহা, রামকৃষ্ণ লাহিড়ি, এমন কি সলিম আলি-র সঙ্গেও। পাখিচোরদের সঙ্গেও আলাপ হল – সুব্রতবাবুর বাড়ি থেকে পাখি চুরি গেছে কত, সেই চোর আবার তিনি ধরেও ফেলেছেন হাতিবাগান অবধি ধাওয়া করে। একসময় প্রায় একশোর ওপর দেশি পাখির প্রজাতির পাখিতে তার ঘরের চিড়িয়াখানা ভরে ওঠে। খুঁজে খুঁজে আনেন ময়ূরের বাচ্চা– তারা বড়ো হয়, ডিম পাড়ে, আবার বাচ্চা হয়। এদের নিয়ে থাকতে থাকতে শিখতে থাকেন। নানা জায়গায় প্রদর্শনী করেন। শেখাতে থাকেন।
ইতিমধ্যে দেশি পাখি পোষার বিধিনিষেধ জারি হয় সরকার থেকে। আর, বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক হবার পর দ্বারভাঙা বিল্ডিং-এ আইন পড়তে পড়তেই ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে চাকরি। এই দুটো ঘটনায় মোড় ঘুরে যায় সুব্রতবাবুর পাখি পোষার রকম সকমে। সুব্রতবাবু বিদেশি পাখি পোষা শুরু করেন। বিমানে চাকরির সুবিধে দেশ বিদেশ ঘোরার সুযোগ, আরা নানা দেশ থেকে নানা জাতের বিদেশি পাখিতে বাড়ি ভরে ওঠে তাঁর। আমেরিকার কোয়েল, ইংল্যান্ডের ফিঞ্চ, সিঙ্গাপুরের কাকাতুয়া, ইন্দনেশিয়ার লরি,হ্যাঙ্গিং
প্যারাকিট, রজেল্লা -নানা রং, ডাক আর বিচিত্র তাদের স্বভাব। একসময় বিদেশ থেকে পাখি আনা সহজ ছিল, তাই এদেশের বাজারেও নানা জাতের বিদেশি পাখি আসত বিনা বাধায়। সুব্রতবাবু নজর দিলেন এই সব বিদেশি পাখির ডিম ফুটে বাচ্চা বানানোর নিয়ম কানুন শেখার দিকে – যাতে জঙ্গল থেকে পাখি ধরার প্রয়োজন কমে, হোক না সে বিদেশের জঙ্গল। কিছু শিখলেন পাখিদের সঙ্গে থাকতে থাকতে, কিছু শিখলেন দেশ-বিদেশের চিড়িয়াখানায় ঘুরে ঘুরে। শিখলেন স্বাভাবিকভাবে কী করে বিদেশি পাখিরা ডিম পাড়ে, তাদের সে সময়ের যত্ন, বাচ্চাদের খাবার দাবার – এইসব। যখন যেখানে সুযোগ পান প্রচার করতে শুরু করেন হরমোন ওষুধ দিয়ে পাখিদের প্রজননের খারাপ দিকগুলি নিয়ে।
একসময় বাড়তে বাড়তে পাখি হয় দু’হাজারেরও বেশি।
এখন আর তত বেশি সংখ্যায় নেই তারা। তবু অনেকেই আছে এখনও। বনদপ্তরের সঙ্গে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে পাখি পোষা নিয়ে মামলা আর বিরোধে ক্লান্ত সুব্রতবাবু। একসময় উঠোনে ঘুরে বেড়াত ময়ূর, দেশি ও বিদেশি পাখির বিপুল সংগ্রহ দেখতে পাখি-পাগলরা ভিড় জমাতেন সবসময়। আজ অনেকটাই নিঃসসঙ্গ সেই উঠোনে দাঁড়িয়ে অবশিষ্ট পাখিদের বাসস্থানগুলোর দিকে দেখাতে দেখাতে এখনও জ্বলে ওঠে মানুষটার চোখ।
তাঁর উঠোন ও ছাদ জুড়ে পক্ষী আবাসের নানান কক্ষে এখন রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির কাকাতুয়া, বড়োসড়ো চেহারার আমাজন, গ্রে প্যারট, নানারঙের টিয়া, রেড-রাম্প, সেনাগাল, লরি। এমনই অনেক প্রিয় পাখি নিয়ে পাখির চলন্ত এই এনসাইক্লোপিডিয়া এখনও রয়েছেন তাঁর বাগুইহাটির পাখি বাড়িতে।
সারাজীবন ধরে সঞ্চিত পাখি সম্পর্কিত জ্ঞানভাণ্ডারকে উজাড় করে দিয়ে পাখিবাবু সুব্রত চক্রবর্তী লিখেছেন একটা অমূল্য বই- আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত “পাখিওয়ালার ডায়েরি।” বাংলা ভাষায় পক্ষিতত্ত্ব ও পাখি পালন নিয়ে এই আয়তন ও গুণমানের বই সম্ভবত আর নেই।
বড্ড ভুলে যাই আমরা। আসলে প্রতিমুহূর্তে এত কিছু নতুন নতুন জানবার জিনিস এসে হাজির হচ্ছে যে গতকালটাকে ডিলিট না করলে স্মৃতিতে স্থান অকুলান হয়ে যায়। তাই আজকে কাগজপত্রে ফেসবুকে পাখিদের অস্তিত্বসঙ্কট নিয়ে নতুন হাহুতাশ চলবার সময়, সুব্রত চক্রবর্তীকে আমরা মনেও রাখি না। তাঁর কলম থেকে বের হওয়া সেই অসামান্য সুপরামর্শগুলোর অস্তিত্ব আছে বলেও জানতে পারে না আজকের পক্ষিপ্রেমী মানুষ–
“ভালোবাসার তাগিদে সংগ্রাহক তাঁর নিজের পছন্দসই খাদ্যবস্তুরই একাংশ তাঁর পোষা পাখিকে খেতে দিচ্ছেন। তার মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের রান্না-করা আমিষ ও নিরামিষ খাবার, চা, পান, তামাক, মদ ইত্যাদি আরো কত কী। আবার কিছু সংগ্রাহক টিয়াজাতীয় পাখিদের শুধুমাত্র ভেজা ছোলা আর পাকা লঙ্কা এবং বুলবুলি, ময়না জাতীয় পাখিদের জলছাতু খেতে দেন। ওঁরা খোঁজও রাখেন না যে টিয়া জাতীয় পাখিদের প্রধান খাদ্য হল শস্যদানা এবং বুলবুলি জাতীয়দের ফল ও কীটপতঙ্গ।”
অথবা দিয়ে যান আশ্চর্য সব টিপ্স্– সিঙ্গিং বুশ লার্ককে বালি স্নানের জন্য কয়লার উনুনের ভেতরের পোড়ামাটি গুঁড়ো করে দিতে হয়। রোজ ফিঞ্চের ভালো ডাক শুনতে হলে তার কাছে রাখতে হবে বেলফুলের মালা। অরেঞ্জ হেডেড থ্রাশ-এর পালক ঝরা রোগ সারে মাছ ধোয়া জলে স্নানে।
পাখিবাবু সুস্থ আছেন তাঁর পাখিদের নিয়ে। উৎসুক দর্শককে সাদরে দেখিয়ে শুনিয়ে বুঝিয়ে দিতে তাঁর তুলনা নেই। তবে ও-বাড়ির রাস্তা এখন অনেক মানুষই ভুলে গেছেন এই যা।
তবে, পাখিরা নিশ্চয় তাঁকে ভোলেনি।
তথ্যসূত্রঃ প্রথম ও শেষ ছবিটি শ্রী সুব্রত চক্রবর্তীর সহায়তায় তাঁর সংগ্রহে থাকা পুরোনো সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে সংগৃহীত। মাঝের পাখিদের দুটি ছবি তাঁর বাড়ির বর্তমান ডানাওয়ালা বাসিন্দাদের। লেখার শুরু ও শেষে দুই পর্বে সুব্রতবাবু ও তাঁর পাখিদের ঘরবসত নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্রের ইউটিউব লিঙ্ক দিয়ে সহায়োতা করেছেন শ্রী সুব্রত চক্রবর্তী। তাঁর বাড়িতে গিয়ে সংগৃহীত বিভিন্ন তথ্য ও পেপার কাটিং দিয়ে সহায়তা করেছেন দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য । যোগাযোগটি ঘটিয়ে এবং ভিজিটের সময় সঙ্গে থেকে সহায়তা করেছেন আরো এক পক্ষিপ্রেমিক শ্রী কৌশিক শীল।