গল্প তুষারাঞ্জলি পারিজাত ব্যানার্জি বর্ষা ২০২০

তুষারাঞ্জলি

পারিজাত ব্যানার্জি

‘‘বরফদাদু কবে বাড়ি ফিরবেন, বাবা?’’ তিতির অধৈর্য হয়ে ওঠে।

ধৈর্য হারান অমরেশও। “আহ্‌, তিতির! কতবার বলেছি, ওই নামে ন’কাকাকে ডাকবে না তুমি! তাতে ওঁর শরীর আরও খারাপ হয়ে যায়। আর তুমি সেই কিনা…”

সাত বছরের তিতিরের চোখ ভর্তি হয়ে জমা হতে থাকে বরফগলা জল! “বাহ্‌! দাদুই তো বলে ওঁকে বরফদাদু বলে ডাকতে। কই ন’দাদু বলে ডাকলে তো সাড়া দেন না তিনি! আমার কী দোষ!”

অমরেশের চোখও সামান্য ঝাপসা হয় তাঁর কাঁচে জমতে থাকা বাষ্পের প্রতিক্রিয়ায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ন’কাকার ভুবন ভোলানো সেই মায়াবী হাসি ও ছোটবেলার কাকার ছাদের ঘরের সেই অমলিন সব স্মৃতি। মেয়ের কোঁকড়ানো ঢেউ খেলানো কোমর ছাপানো চুলে হাত রাখেন তিনি। “মা, এই অসময়ে রাগ করিস না রে। বুঝতেই তো পারছিস, মনমেজাজ তেমন কিছুই ভালো নেই আমার। যবে থেকে ন’কাকা হাসপাতালে ভর্তি, তবে থেকে আর সত্যিই কী করছি কাকে কী বলছি কিছু মনে রাখতে পারিনা রে!”

তিতির কাছে এগিয়ে আসে বাবার। আরামকেদারার সঙ্গে একদম লেপটে গিয়ে ফিসফিস করে বলে ওঠে, “এইসব সাধারণ রোগভোগে দাদুর কিচ্ছু হবে না। দেখে নিও! দাদু কতবার বলেছেন তাঁর প্রাণভ্রমরা অন্য জায়গায় লুকোনো। খুব যত্ন করে তার দু’বেলা রোজ দেখাশোনা পর্যন্ত করি আমি। তুমি এক্কেবারে চিন্তা কোরো না। শুধু খোঁজ নাও কবে ফিরবেন বরফদাদু।”

অমরেশ চোখে চোখ রাখেন মেয়ের। বোঝার চেষ্টা করেন, মানতে চান ঠিক কতখানি জোর শৈশবের এই অদম্য বিশ্বাসের। তাঁর ভিতরটা কেমন যেন একসঙ্গে উঠে আসতে চায় সব কোষ আর চামড়ার জৈবিক বাধা পেরিয়ে। তিতিরের চোখের ঔজ্জ্বল্য দিশেহারা করে দেয় তাঁর অবচেতনকে। আর ঠিক তখনই তাতে ফুটে ওঠে অন্য কোনও জন্মের অজানা কোনও স্মৃতি তাঁর মনের পর্দায় যা বয়সের ভারে সেই কবেই ঠেকেছিল গোপন কোটরের তলানিতে।

***

“অমু এসছিস? বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ঘরে আয়!”

চার বছরের ছোট্ট অমু কিন্তু ঘরে ঢোকে না। দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে ছাদে। “না, মা বলেতে তোমায় বিলক্ত না কত্তে। আর উপলে না আত্তে একদম।”

টকটকে ফর্সা ছ’ফুট লম্বা সমরেন্দ্র নিজের পড়ার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে দরজার পাল্লাটা হাট করে খুলে দেন। হাঁটু গেড়ে বসে ছোট্ট অমুর মাথায় হাত রাখেন পরম স্নেহে। “তা মা যখন বলেছেন, মানতে তো হবেই, তাই না? তবে তুমি না ঢুকলেও আমি যদি তোমায় কোলে করে তুলে ঘরে নিয়ে আসি, তাহলে নিশ্চয়ই তোমার মা রাগ করবেন না, কী বলো?”

খানিকক্ষণ কী যেন ভাবে অমু। তারপর বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলে, “হ্যাঁ, তাহলে লাগ করা এদ্দম উচিত না।”

হো হো করে হেসে ওঠেন সমরেন্দ্র। “ছোটলাটের তাহলে এই গরিবখানায় আসতে আজ্ঞা হোক!” বলেই ছোট্ট অমুকে কোলে তুলে একপাক ঘুরিয়ে দেন তিনি। আর বাড়ি মাথায় করে, “ছালো ছালো, পলে যাব তো!” বলে পরিত্রাহি চিৎকার জুড়ে ছোট্ট সেদিনের অমু।

***

“আচ্ছা বাবা, বরফদাদু কি সত্যিই মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন? নাকি…” তিতির থেমে যায়। বাবার হুইল চেয়ারটা পার্কের বেঞ্চের পাশে লাগিয়ে লক করে নিজে বেঞ্চে বসে। আজ বেশ গরম পড়েছে কলকাতায়। তাপমাত্রা প্রায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। উজ্জ্বল গোলাপি রঙের ট্যাঙ্ক টপটা ঘামে ভিজে সেঁটে বসেছে তিতিরের গায়ে। তবুও ঘরে এসির আরামে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করা আর বাইরে প্রকৃতির মাঝে বাবাকে নিয়ে এসে ঘণ্টা খানেক থাকার মধ্যে বাছতে বললে তিতির বরাবরই পরেরটাই বেছে নেবে। বরফদাদু তাকে প্রায়ই বলতেন ছোটবেলায়, “মা রাগ করলে আমরা কি তাঁর কাছে যাওয়া বন্ধ করে দিই? আমরা কি চেষ্টা করি না তাঁর মান ভাঙাতে, তাঁর গলা জড়িয়ে আদর খেতে? আবহাওয়া যে পালটেছে, আমরা যে আমাদের প্রকৃতি মায়ের উপর এত অত্যাচার করেছি, তার ফলেই তো এই ক্লাইমেট চেঞ্জ, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের গল্প শুনছিস এখন তোরা। তা বলে কি মায়ের কাছে যাবি না? নিজে দোষ করব আবার নিজেই রাগও দেখাব? তা কি হয় নাকি রে! প্রকৃতি মা এই যে নিজে পুড়ছেন, তাতে যে তাঁর সন্তানদের এত কষ্ট হচ্ছে, তা কি তিনি বোঝেন না? সেই বুঝতে পারার যন্ত্রণাও তো মায়েদের কম হয় না রে। দিনে একবার হলেও তাই তাঁর গায়ে হাত বুলিয়ে আসবি না তিতির?”

অমরেশ বেঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বুড়ো অশ্বত্থের গায়ে হাত বোলান। চোখ বন্ধ করে খানিকটা ভাব আদানপ্রদান করে নেন তাঁর পুরনো এই সঙ্গীর সঙ্গে। সেই ছোটবেলায় ন’কাকার হাত ধরে আসতেন এই গাছতলায়। কতরকমের পাখি আসত তখন এদিকে। সাত ভাই চম্পা, বৌ কথা কও, দোয়েল, ময়না, কাঠঠোকরা—আরও কত কী! একটা ছোটো পেঁচার বাসাও আবিষ্কার করেছিলেন কাকা এই গাছের নিচেই। কোনোভাবে হয়তো হাওয়া লেগে মাটিতে পড়ে গেছিল বাসাটি। বাসার মধ্যে ছিল ছোট্ট আঙুলের সাইজের গুটিকয়েক পেঁচা, যাদের ভালো করে চোখও ফোটেনি তখনও। মাটিতে থাকলে যে কেউ এসে খেয়ে যাবে বলে কাকা নিজে গাছে উঠে আবার যত্ন করে রেখে এসেছিলেন বাসাটি। কে জানে, বাচ্চাগুলো বেঁচে ছিল কি না। তবুও এতটাই বা ক’জন করে, পারে করতে, তাই না? মনে আছে অমরেশের, ছোট্ট অমুর সেদিন কীভাবে গর্বে বুক ফুলে উঠেছিল তার আদরের ন’কাকার বিচক্ষণতায়। আধো আধো স্বরে সে জানতে চেয়েছিল ওইদিন, “ওলা উলতে পাব্বে তো, ন’কাকা?”

সমরেন্দ্র মাথা নেড়েছিলেন। “ওদের মা ওদের যেদিন উড়তে শিখিয়ে দেবে, সেদিন দেখবি, এই গোটা আকাশ ওদের নিজের বুকে দেবে আশ্রয়, অন্য কারও দয়ায় ওদের বাঁচতে হবে না।”

“তোর বরফদাদুর মতো এত শিক্ষিত মানুষ খুব কম দেখেছি রে তিতির-মা। চাকরি-বাকরির চেষ্টায় যাননি। পড়াশোনা শেষ হতেই আমাদের উল্টোডাঙার বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন শুধুমাত্র সারাজীবন নিরিবিলিতে আরও পড়াশোনা করবেন বলেই। ওরকম মানুষদের আমরা আসলে বোধহয় ঠিক ধরতে পারি না। ওঁরা থাকেন বাঁচেন আমাদের মধ্যেই, তবুও যেন আমাদের অনেকটা পেছনে ফেলে রেখে তরতর করে জঙ্গলের ঢ্যাঙা গাছগুলোর মতোন উঠে যান সমস্ত সীমানার বাঁধন পেরিয়ে।”

তিতির নিজের চোখের নীল ফ্রেমের রোদ চশমাটা খুলে কোলের উপর রাখে। বাবার দিকে সামান্য ঘুরে বসে সে। “তাহলে শেষ বয়সে কেন ওঁকে আমাদের সবাইকে ছেড়ে এভাবে অ্যাসাইলামে কাটাতে হল? তুমি তো সব জানতে বাবা! তুমি কেন কিছু করলে না?”

***

ডাক্তার সান্যালের চেম্বারে জড়সড় হয়ে পর পর ঢুকলেন অমরেশরা চার ভাই, এক দিদি। সকলের মুখ থমথমে, বিষণ্ণ। গীতিকাদি সবার বড়ো। তিনিই সবার হয়ে ডাক্তার সান্যালের সঙ্গে শুরু করলেন কথা। “ন’কাকার কী অবস্থা, ডাক্তারকাকু?”

মাথা নাড়লেন ডাক্তার সান্যাল। “সমরেন্দ্রর অবস্থা খুব একটা ভালো নয় রে মা। ডিমেনশিয়া এমনভাবে গুলিয়ে দিচ্ছে ওর সব কিছু, কোনটা ঠিক কোনটা ভুল, ও আর ঠিক ঠাহর করতে পারছে না। ওকে বাড়িতে ওই ছাদের ঘরে রাখাটা আরও বিপজ্জনক হয়ে পড়তে পারে এরপর।”

অমরেশের মেজদা মাথা নাড়েন। “কিন্তু কাকাকে তো কিছুতেই নিচে নামানো যাচ্ছে না একদম। তার উপর নিজের ঘরের ডিপ ফ্রিজের মধ্যে স্নো-ম্যান বানিয়ে তালাচাবি দিয়ে রেখেছেন। বাড়ির বাচ্চাদের বলছেন, ওর মধ্যেই নাকি লুকোনো আছে ওঁর প্রাণ! কিচ্ছু খাওয়াদাওয়া পর্যন্ত করছেন না প্রায়। কী করব, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। অমু কাল চাবিটা জোর করে আনতে যেতেই তো এত বিপত্তি! উন্মাদের মতো হাসতে থাকলেন আর বলে চললেন, ‘চাবি দেব না! বরফের দেশ থেকে পালিয়ে আসা ওই শেষ উদ্বাস্তুকেও তোরা ছেড়ে দিবি না! তোদের সব চাই না, সব? দেখছিস না কেমন করে সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে চারদিক! ডিপ ফ্রিজে হাত দেওয়া চলবে না। ওই বরফ-মানুষেই লুকিয়ে থাকবে সারাজীবন আমার প্রাণ। বুঝতে পারছিস না কেন, এই বরফ-মানুষ না বাঁচলে শেষ হয়ে যাবে আমাদের পুরো আস্ত এই সভ্যতা! তুইও থাকবি না, কেউ থাকবি না তোরা!’ ”

“সেটাই বলছি কমলেশ! ওর সারাজীবনটাই তো কাটল প্রকৃতি-চর্চা করে। সব জায়গায় সেই প্রকৃতিই যখন আজ লাঞ্ছিত, অপমানিত, সমরেন্দ্র তা আর মেনে নিতে পারছে না রে। অ্যাণ্টার্কটিকার বরফ গলে যাওয়া নিয়েই তো সবথেকে বড়ো থিসিসটা করছিল ও। বেশ কয়েক মাস আগে ওর সঙ্গে আমার এই নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনাও হল। তখনই মনে হচ্ছিল জানিস, ওর সব গুলিয়ে যাচ্ছে। সত্যি আর কল্পনা সব এক হয়ে জন্ম নিচ্ছে বরফ-মানুষের মতো নতুন গল্পেরা। যা ভেবেছিলাম, দেখ তাই কিন্তু হল শেষ অবধি।” চশমাটা টেবিলে খুলে রাখলেন ডাক্তার সান্যাল।

দম বন্ধ হয়ে আসা ডাক্তারখানায় এতক্ষণে এবার মুখ খুললেন অমরেশ। শেষ যেই প্রশ্ন বাকি থাকে অগত্যা সেইটেই করার ভাবনা তখন ঘুরছে তাঁর মাথায়। তবে যেই উত্তরটা তিনি পেলেন, তা যে স্বপ্নেও আন্দাজ করেননি তিনি—তাঁর মুখের সমস্ত রেখা এবং ভাঁজ সেই হেরে যাওয়ার গল্প লিখে দিল তাঁর কপালে অবলীলায়। যদি আগেভাগে কিছুটা আঁচও করতে পারতেন ঠিক কোন দিকে ঘুরতে চলেছে পরিস্থিতি, তবে কখনোই হয়তো এই প্রশ্ন তিনি করতেন না। যতক্ষণ ওই নিয়তিকে ঠেকিয়ে রাখা যায় আর কী!

“তাহলে উপায়?”

“আমি লিখে দিচ্ছি, অমরেশ। ইমিডিয়েটলি প্যাভলভ মানসিক হাসপাতালে অ্যাডমিট করো ওকে। বাড়িতে রেখে এই চিকিৎসা আর সম্ভব নয়।”

***

ছোট্ট তিতির তার বরফদাদুর কোলে উঠে চাবির ঘরে চাবি ঢুকিয়ে তা সামান্য ঘুরিয়ে খুলে দেয় দরজা। ধ্যানমগ্ন বরফ-মানুষের তপস্যা ভাঙে। হাসি মুখে তিনি মাথায় হাত রাখেন তিতিরের। সেই শীতল-ঠাণ্ডা পরশ অদ্ভুতভাবে কীরকম বিহ্বল করে দেয় তিতিরের ছোট্ট শরীরটা। স্পষ্ট বাংলায় বলে ওঠে বরফ-মানুষ সাদা বরফের দুটি পাটি সামান্য ফাঁক করে, “চিন্তা করিস না মা, যতদিন তোর বরফদাদুর এই তোরা ক্ষুদে সৈনিকরা আছিস, বরফের দেশের আমার ওই জমাট বুনন আমি ছাড়ব না। আর তোর বরফদাদুও থাকবে আমারই কাছে নির্ভাবনায়, এই দেখ না দেখ, আমার ঠাণ্ডা নিঃশ্বাসে কেমন জমাট বাঁধছে এই প্রকৃতির, এই পৃথিবীর সব আদিরস ও জলকণা।”

***

অন্ধকার ঘরে হিসেব কষে চলেন সমরেন্দ্র। তাঁর বহুদিনের না কাটা চুলদাড়ির মধ্যে সামান্য হাসি খেলে যায়। তিনি জানেন, বড়োরা না মানলেও বা বুঝলেও ওই ছোট্ট অমু বা তিতির বরফের দেশে ঠিক বাঁচিয়ে রাখবে তাঁর প্রাণভ্রমরা।

ছবি  মৌসুমী

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s