দেশ ও মানুষ সব পর্ব একত্রে
উচ্ছের ভূ-গোলমাল
শুভময় মিশ্র
(জয়ঢাক প্রকাশন থেকে প্রকাশিত লেখকের “ষোলোকলা” গ্রন্থ থেকে। অসামান্য কিছু রম্যরচনাসমৃদ্ধ বইটি এইখানে ক্লিক করে অর্ডার দিতে পারবেন।)
ভূগোল পড়তে বসলেই উচ্ছের হাই ওঠে ঘন ঘন; চোখ বুজে আসে। জোর করে বেশি পড়তে গেলে মাথা ঝিমঝিম করে, গলা শুকিয়ে যায়, চোখে অন্ধকার দেখে সে। আসলে বিষয়টা বড্ড গোলমেলে, একটুও মাথায় ঢোকে না ওর। বিষয়টার নাম হওয়া উচিত ছিল ‘ভূ-গোলমাল’, শেষের দুটো অক্ষর কোথায় গেছে কে জানে!
অন্য সব বিষয়ে উচ্ছে বেশ ভালো নম্বর পেলেও ভূগোল নিয়ে অনেক গোলমাল আছে। বারবার ভালো করে পড়ার কঠিন প্রতিজ্ঞা করেও লাভ হয়নি, বই খুললেই মাথা ভোঁ ভোঁ করে। মকর-কর্কট তাকে এক ‘ক্রান্তিকাল’-এর সামনে দাঁড় করিয়েছে, ভারতের নদনদী তাকে ডুবিয়েছে। কয়লা নিয়ে কেলেঙ্কারি তো আছেই, ভূগোলের চাপে আর মাস্টারমশাইদের বকুনির তাপে উচ্ছের জান কয়লা হয়ে গেছে। বক্সাইট জব্বর টাইট দিয়েছে, ইস্পাতের বর্ম ভেদ করার সাধ্য তার হয়নি। বনজ সম্পদের জঙ্গলে পথ হারিয়েছে, ভারী শিল্প তার ঘাড়ে বোঝার মতো চেপে বসেছে। প্রতিবারই চল্লিশের কোঠায় নম্বর পাওয়ায় বাবার তর্জন গর্জনের মধ্যে গর্জনশীল চল্লিশার কথা মনে পড়েছে, কিন্তু পড়তে বসলেই বায়ুস্রোত আর সমুদ্রস্রোতের সামনে খড়কুটোর মত ভেসে গেছে তার প্রতিজ্ঞা। খারাপ রেজাল্টের জন্য বাবার হাতের থাপ্পড় খেয়ে, গন্ডদেশে হাত বোলাতে বোলাতে উচ্ছে ভেবেছে বিষয়টার নাম ‘ভূ-গন্ডগোল’ হলেও চলত। অশ্ব অক্ষাংশতে পালে হাওয়া লাগার অপেক্ষায় অধীর নাবিকের মত উচ্ছেও অপেক্ষায় আছে মাধ্যমিক পরীক্ষার, তারপরেই ভূগোলকে চিরকালের মতো টা টা বাই বাই।
এভাবেই ক্লাস নাইনে উঠেছে উচ্ছে। গরমের ছুটিতে, বাবা কোথা থেকে এক বয়স্ক মাস্টারমশাইয়ের খোঁজ নিয়ে এলেন; কোন এক গ্রামের স্কুলে পড়াতেন, এখন রিটায়ার্ড। কাছাকাছি কোথাও ভাড়া থাকেন, বাড়িতে এসে আলাদা করে পড়াতে রাজি হয়েছেন। বাবা শুনে এসেছেন ওনার হাতে নাকি জিওগ্রাফির জিওনকাঠি আছে।
পরের দিনই মাস্টারমশাই বাড়িতে এলেন, নাম গোপালবাবু। চেহারা দেখেই ভক্তি চটে গেল উচ্ছের। বয়স্ক নয়, বুড়ো বলাই ভালো; বেশিরভাগ দাঁত নেই, তোবড়ানো গাল, হাতে লাঠি, চোখে মোটা কাঁচের চশমা, চশমার দুটো ডাঁটিই খুব নড়বড়ে, কথা বলতে বলতে সেটা একবার খুলে পড়ে গেল। চা খাওয়ার সময় হাত দুটো থরথর করে কাঁপছিল। চেয়ার টেবিলে বেশিক্ষণ বসলে একটু অসুবিধে হয় বলে উনি বারান্দায় মাদুর পেতে বসার কথা বললেন।
অনিচ্ছার সঙ্গে পড়তে বসার আয়োজন করতে করতে উচ্ছের মনে নানারকম সন্দেহ উঁকি দিচ্ছিল| এ হেন লোককে দিয়ে ভূগোলের গোলমেলে জট খুলবে তো! সিলেবাস জানেন তো! এখনকার প্রশ্নের প্যাটার্ন! ওই চশমা দিয়ে ম্যাপের ওপর ছোট ছোট লেখা দেখতে পেলে হয়! কাঁপতে থাকা লিকলিকে হাত দিয়ে ম্যাপ পয়েন্টিং হবে তো! ঘরের ভেতর থেকে বাবা আর গোপালবাবুর কথাবার্তা ভেসে আসছিল; তাতে দেশভাগ, চীনের যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, আঠাত্তরের বন্যা, মূল্যবৃদ্ধি, ভেজাল সব থাকলেও ভূগোলের লেশমাত্র ছিল না। যত ভাবছিল উচ্ছে, তত রাগ হচ্ছিল বাবার ওপর।
চা শেষ করে বারান্দায় এলেন গোপালবাবু, মাদুরের ওপর অদ্ভুত কায়দায় উবু হয়ে বসলেন। ধুতির খুঁট দিয়ে চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোন ক্লাস যেন খোকা?”
খোকা? ক্লাস নাইনের আদ্ধেক হয়ে গেল, এখনও খোকা! গম্ভীর হয়ে উত্তর দিল উচ্ছে, “নাইন।”
“নাইন! ওহো তাই শুনেছিলাম বটে; ঠিক আছে, সময়টা একটু কম আর কি! তবে কমে আর যাবে কোথায়? পৃথিবীকে তেইশ ঘন্টা ছাপান্ন মিনিটের বাঁধা সময়ে নিজের চারদিকে ঘুরতে হবে, সময় চুরির জায়গাই নেই। ওদিকে আবার তিনশো পঁয়ষট্টি দিন ছ’ঘন্টায় চুরানব্বই কোটি কিলোমিটার ঘুরতে হবে সূর্য্যের চারদিকে, ওখান থেকেও পালানোর উপায় নেই। ছ’ঘন্টা ফাঁকির শাস্তি – পরের বছরের লিপইয়ার, তোমার হাতে পড়ার জন্য একদিন বেশি মাধ্যমিকের ভূগোল পড়ার পক্ষে অনেক সময় হাতে আছে। নাইন টেনের ভূগোলে কি আছে এখন দেখি!”
রাগটা আরও বেড়ে গেল উচ্ছের, মুখে কিছু না বলে বইয়ের শুরুতে সিলেবাসের পাতাটা খুলে সামনে ধরল। গোপালবাবু কিন্তু তাকিয়েও দেখলেন না, বললেন, “কি আর থাকবে! ওই তো ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, নদনদী, প্রতিবেশী দেশ, খনিজ সম্পদ; এর বেশি আর কি আছে ভূগোলে! তার চেয়ে তোমার কোথায় আটকাচ্ছে দেখা যাক|”
উচ্ছের কাছে পুরো ভূগোলটাই তো আটকে আছে! কিছু না ভেবে বইটা খুলতেই ভারতের নদনদী চ্যাপ্টারটা বেরিয়ে পড়ল| গোপালবাবুকে সেটা বলতে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ উচ্ছের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর বললেন, “ভারতের বড় বড় নদীগুলোর নাম বল তো দেখি!”
না পড়িয়েই প্রশ্ন! বিরক্তি গোপন করে উচ্ছে উত্তর দিতে শুরু করল, “গঙ্গা, যমুনা …. দামোদর …… তারপরে হল গিয়ে তিস্তা, তারপর…..”, আমতা আমতা করতে থাকে উচ্ছে, আর কিছুই মনে পড়ে না।
স্থির কিন্তু ঘোলাটে দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন গোপালবাবু। কয়েক সেকেন্ড, তারপর তাঁর ডান হাতটা ধীরে ধীরে ওপরে উঠল, মুঠো করা হাতের তর্জনীটা কেবল সোজা হয়ে বেরিয়ে আছে। ভদ্রলোক কি করতে চাইছেন বুঝতে না পারলেও অবাক হয়ে উচ্ছে দেখল গোপালবাবুর হাত আর কাঁপছে না।
গঙ্গা – শব্দটা হঠাৎ এসে ধাক্কা মারল উচ্ছের কানে, গা টা শিরশির করে উঠল। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে গোপালবাবুর তর্জনীটা একটা কাল্পনিক ক্যানভাসের ওপরের ডান দিক ঘেঁষে একটা বিন্দু থেকে শুরু হয়ে নিচের দিকে নেমে, ডানদিকে গিয়ে, আবার নিচের দিকে নেমে এল।
যমুনা – বলার পরেই তর্জনীটা আগের বিন্দুটার একটু ওপর থেকে শুরু করে নিচে নেমে আগের রেখাটায় সঙ্গে জুড়ে গেল।
ব্রহ্মপুত্র – ডানদিক বামদিক ঘুরে নিচের দিকে নেমে এল রেখাটা।
মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী – ক্যানভাসের নিচের দিকে তর্জনীর ছোঁয়ায় আঁকা হল বাম থেকে ডানদিকে আসা রেখাগুলো।
নর্মদা, তাপ্তী – একই ভাবে ক্যানভাসের মাঝ বরাবর ডান থেকে বামে দুটো রেখা আঁকা হল।
শতদ্রু, বিপাশা, রাভি, চেনাব, ঝিলম – ক্যানভাসের ওপরের দিকে ডান থেকে কোনাকুনি বামে পাঁচটা রেখা টানা হল।
একসময় অদৃশ্য ক্যানভাসটা ভর্তি হয়ে উঠল রেখায় রেখায়। শিরশিরানি ভাবটা ততক্ষণে কেটে গেছে উচ্ছের, শুধু ভাবছিল বইখাতা পেনপেন্সিল ছাড়া এ কেমন পড়া! অবাক ভাবটা কাটিয়ে ওঠার আগেই গোপালবাবু উচ্ছেকে একইভাবে সামনের কাল্পনিক ক্যানভাসে ছবি আঁকতে বললেন। প্রথমে একটু বাধো বাধো ঠেকলেও উচ্ছে একটু একটু করে এগোতে লাগল, উল্টো দিকে বসে গোপালবাবুও খেই ধরাতে লাগলেন। তারপরে নতুন ক্যানভাসে এক এক করে আঁকা হল হিমালয়, পীরপঞ্জাল, পূর্বঘাট, পশ্চিমঘাট, বিন্ধ্য, সাতপুরা ইত্যাদি পাহাড়পর্বত; তারপরে বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর ইত্যাদি। এই নতুন ক্যানভাসটা আগেরটার ওপরে চাপিয়ে দিতেই নদীর উৎস আর সঙ্গম, কোন নদী পূর্ববাহিনী, কে পশ্চিমবাহিনী সব পরিষ্কার হয়ে গেল উচ্ছের কাছে।
প্রতি সপ্তাহে ভূগোলের বন্ধ সিংহদরজা একটু একটু করে ফাঁক হতে লাগল উচ্ছের সামনে। মাস দুয়েকের মধ্যেই ভূগোল নিয়ে উচ্ছের সেই আতঙ্ক আর রইল না। উচ্ছে বুঝে গেল বইতে সব আলাদা আলাদা চ্যাপ্টারে থাকলেও ভূপ্রকৃতি, নদনদী, অর্থকারী ফসল, ভারী শিল্প, সমুদ্র বন্দর, কয়লা খনি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদির ভেতর সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ।
এরকম ভূগোল পড়ার কথা শুনে বন্ধুরা হাসাহাসি করল, তাদের হাজারো টিপ্পনি শুনেও উচ্ছে দমে গেল না। আসলে এই ক’দিনেই উচ্ছে বিষয়টাকে ভালোবেসে ফেলেছে, গোপালবাবু স্যার থেকে দাদু হয়ে গেছেন| প্রশ্ন উত্তর লেখা, খাতায় ম্যাপ আঁকা ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার ক্যানভাসে ছবি আঁকা চলছে জোরকদমে। নদীগুলো ততদিনে ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে, সিলেবাসের বাঁধন কেটে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। হাতের মুদ্রায় কখনও নীল, নাইজার, জাম্বেসী, কঙ্গোর আফ্রিকা ভেসে উঠছে ক্যানভাসে, ড্যানিয়ুব, রাইন, ভলগার ইউরোপ, কখনও বা ওব, ইনিসি, লেনা, আমুর, হোয়াংহোর এশিয়া| এশিয়ার নদীর তালিকা আবার শেষ হয় আঙুলে একটা গোল মুদ্রা দেখিয়ে আমুদরিয়া, শিরদরিয়া বলে; ওদের সমুদ্রে মিশতে না পারার দুঃখটা গন্ডি বেঁধে রাখা থাকে হাতের ওই গোল মুদ্রায়। এখন আর ম্যাপ পয়েন্টিং করতে, ব্যাখ্যা করতে, টীকা লিখতে একটুও আটকায় না| উচ্ছে ক্লাস টেন-এ উঠল ভূগোলে বাষট্টি পেয়ে। আর ভূ-গোলমালও নিজের লেজ খসিয়ে কখন যেন ভূগোল হয়ে উঠল।
কিন্তু শারীরিক কারণে মাঝে মাঝেই ফাঁক পড়তে লাগল গোপালবাবুর পড়ানোতে। ক্লাস টেন-এ প্রি-টেস্ট এর পর তো গোপালদাদুর আসা বন্ধই হয়ে গেল, খুব নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। উচ্ছে কিন্তু একটুও ফাঁক পড়তে দেয়নি নিজের পড়ায়। টেস্টের পরে একবার খুঁজে খুঁজে তাঁর বাড়িতে হাজির হয়েছিল উচ্ছে, কিছু না পারা প্রশ্ন নিয়ে। তারপর মাধ্যমিকের ব্যস্ততায় আর খোঁজ নেওয়া হয়নি।
যথাসময়ে জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় পাস করেছিল উচ্ছে, চারটে লেটার সহ খুব ভালো রেজাল্ট হয়েছিল। ভূগোলে ছিল ঊনআশি; স্কুলের মাস্টারমশাইরা সবাই অবাক হয়ে গেছিলেন। বাড়িতেও খুশির বন্যা বয়ে গেছিল। আনন্দের মধ্যেই ইলেভেন-এ ভর্তির তোড়জোড় শুরু হল। পরের দু’বছরে উচ্চমাধ্যমিকের চাপের কথা না বলাই ভাল। তারপর কলেজ, চাকরি, ওপরে ওঠা, ঘর সংসার ইত্যাদি ব্যস্ততার মধ্যে গোপালবাবুর আর খোঁজ নেওয়া হয় নি। উচ্ছে শুধু খবর পেয়েছিল, ওই বাড়ি ছেড়ে গোপালবাবুরা অন্য কোথায় যেন উঠে গেছেন।
জীবনে সবদিক থেকে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে উচ্ছে, ভালো চাকরি, টাকাপয়সা, গাড়িবাড়ি, সফলতা, সম্মান, সবকিছু আশা চেয়ে হয়তো একটু বেশিই এসেছে ওর জীবনে; অন্ততঃ ও নিজে সেটা মনে করে। তবু, একটা দুঃখ তাকে মাঝে মাঝে খোঁচা দিয়ে যায়, এক নম্বরের জন্য ভূগোলে লেটারটা হয়নি। আরেকটা কারণে নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারে না উচ্ছে, মাধ্যমিকের রেজাল্টটা নিজের মুখে গোপালদাদুকে জানানো হয়নি, যেভাবেই হোক দেখা করে বলা উচিত ছিল।
ইদানীং অফিসে বসে গ্রোথ, টার্গেট, শর্টফল, রিকভারি ইত্যাদির হিসেব দেখতে দেখতে ক্লান্ত উচ্ছের মনে হয়, দেড় বছরে চল্লিশ থেকে উনআশির জন্য এত হিসেব তো করতে হয়নি, শুধু চিন্তাভাবনার রাস্তাটা পাল্টে দিতে হয়েছিল। আজও অফিসে কোনও পেশাদার পরামর্শদাতা এলে অজান্তে তুলনা করতে থাকে উচ্ছে, এদের চশমার ডাঁটিগুলো বড্ড শক্তপোক্ত, চশমার পেছনে চোখগুলো খুব বেশি তীক্ষ্ণ; অধীত জ্ঞানের বাইরে হাত বাড়ানোর সময় হাত এদের একটুও কাঁপে না। উচ্ছের মনে সন্দেহ উঁকি দিয়ে যায় পারবে তো পরিবর্তন আনতে!
(লেখাটি পূর্ব মেদিনীপুরের কাজলাগড় হাইস্কুলের শিক্ষক শ্রী রাখাল চন্দ্র মাইতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধার্ঘ্য)
অলঙ্করণঃ জয়ন্ত বিশ্বাস