কন-টিকি অভিযান-আগের পর্বগুলো
থর হেয়ারডাল। (অনুবাদঃ ইন্দ্রনাথ)
আগের কথা
আন্দিজের পায়ের কাছে গভীর জঙ্গলে এসে ঢুকলেন অভিযাত্রীরা। প্রচন্ড বৃষ্টি, জলকাদা, খারাপ রাস্তা, জঙ্গলের ভারী আবহাওয়া, ভ্যাপসা গরম কোনোটাই বাধা হয়ে উঠল না। ওরা এসে পড়লেন, রিভার পালেনক্যু তে। নদীপারেই রেড ইন্ডিয়ানদের গ্রাম আর সেখানেই ওরা দেখলেন, জিপসুদ্ধ নদী পার করার জন্য যে ভেলাটা আনা হল, সেটা, বা – ল – সা কাঠের। শেষমেষ ফেদরিকোর আস্তানায়। জায়গাটা চমৎকার গাছপালাঘেরা বাংলো। লোকটাও জমাটি ও হুল্লোড়ে। আলাপ হল বাচ্চা অ্যাঞ্জেলোর সঙ্গে, ফেদরিকোর ভাইপো, কাকার খুব ন্যাওটা। পরদিন থেকে জঙ্গলে উপযুক্ত বালসা খোঁজা শুরু। বালসা কাটা খুব কঠিন, অনেকটা ভোঁতা ছুঁরি দিয়ে কর্ক কাটার মতো। একটা গাছ কাটতেই সারাদিন লেগে যায়। পলিনেশীয় রীতি মেনে, ওরা গাছ কাটার আগে তার সামনে প্রার্থনা করে তারপর কুড়ুলে হাত দিতেন। প্রত্যেক গাছের এক একটা নামও রাখা হল। শেষ অবধি, নদীতে সবকটা বালসা ভাসিয়ে সেই ভেলায় চেপে গুয়ায়াকুইলে চলল হারম্যান আর থর। সঙ্গে দক্ষ স্থানীয় বন্ধুরা। হারম্যানকে বালসা কাঠগুলো জাহাজে চাপিয়ে আনার ভার দিয়ে রেখে থর চলে এলেন লিমায়। ভেলা বানানোর উপযুক্ত জায়গা জোগাড়ে হন্যে হয়ে সরকারি আমলা মন্ত্রীদের কাছে ঘুরতে লাগলেন, ফল হল না। অবশেষে বহু কষ্টে পেরুর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে একটা সাক্ষাৎকারের ব্যাবস্থা করতে পারলেন। অনেক প্রতীক্ষার পর দেখা হল রাষ্ট্রপতি বাস্তামান্তে ইয়ো রিভেরো-এর সঙ্গে।
দক্ষিণ আমেরিকায়
আমার স্প্যানিশের দৌড় আর রাষ্ট্রপতির ইংরিজি জানাটা প্রায় উনিশ বিশ। ফলে আলাপ পর্ব চুকে আমাকে চেয়ারে বসতে বলার সৌজন্য সারার মধ্যেই আমাদের শব্দভান্ডার গেল ফুরিয়ে। হাত পা নাড়িয়ে, মুখভঙ্গী করে অনেককিছু বোঝানো যায় বটে, কিন্তু এইভাবে ভেলা বানানোর অনুমতি জোগাড়! তাও আবার পেরুর নৌবাহিনীর এলাকাতে! আমি একটা কথা পরিষ্কার বুঝলাম, আমার কথা রাষ্ট্রপতি একবর্ণও বুঝতে পারছিলেন না; অবশ্য আমার চেয়ে আরো ভালো করে তিনি নিজেই সেটা বুঝেছিলেন। কথার মাঝখানে হঠাৎ করে বেরিয়ে ফিরে এলেন বিমানমন্ত্রীকে সঙ্গে করে। ইনি জেনারেল রিভার্দো, চমৎকার পেটানো স্বাস্থ্য, পরনে বিমানবাহিনীর উর্দি। ভদ্রলোক চমৎকার ইংরিজি বলেন, উচ্চারণটা মার্কিনি। আমি ভুল বোঝার জন্য ক্ষমা চেয়ে বললাম, আসলে আমি বিমানবাহিনীর এলাকায় কাজের জন্য অনুমতি চাইছি না, চাইছি নৌবাহিনীর এলাকাতে ঢোকার জন্য। জেনারেল হেসে ফেললেন, বললেন তিনি স্রেফ দোভাষীর কাজ করতে এসেছেন।
একটু একটু করে রাষ্ট্রপতির কাছে গোটা তত্ত্বটা অনুবাদ করে বলা হল, উনি মন দিয়ে শুনলেন, জেনারেল রিভাল্ডোর মাধ্যমে চোখা চোখা প্রশ্ন করলেন। শেষকালে বললেন, “এ’রকমটাই যদি হয়, যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলো পেরু থেকে গিয়েই প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল, তাহলে পেরু অবশ্যই আগ্রহী এই অভিযানে। যদি আপনাদের কোনো সাহায্য করতে পারি, বলুন।”
আমি নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা একটা জায়গা চাইলাম যেখানে চার দেয়ালের মধ্যে আমাদের ভেলাটা বানাতে পারি; নৌবাহিনীর কর্মশালা ব্যবহার করতে পারি; যন্ত্রপাতি, মালপত্র রাখার একটা জায়গাও চাইলাম আর সেগুলো এদেশে আনার বন্দোবস্ত করার ব্যাবস্থা; ড্রাইডক ব্যবহার এবং আমাদের কাজে নৌবাহিনীর লোকেদের সাহায্য পাওয়ার অনুমতি; আর একটা লঞ্চগোছের জলযান, ভেলাটা তীর থেকে টেনে নিয়ে সমুদ্রে ছেড়ে দেবার জন্য।
“ উনি কী কী চাইছেন?” রাষ্ট্রপতি খুবই আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, যাতে আমিও বুঝতে পারি।
“বেশি কিছু না”, রিভার্দো বলতে বলতে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন। আর ওদিকে রাষ্ট্রপতি সন্তুষ্ট হয়ে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন।
সাক্ষাৎকার শেষ হবার আগে রিভার্দো কথা দিলেন যে বিদেশমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি নিজে বলে দেবেন, আর সমুদ্রবিষয়ক মন্ত্রী নিয়েটোকে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া থাকবে, আমাদের যা যা দরকার সেগুলো দেবার জন্য।
“ঈশ্বর তোমাদের রক্ষা করুন।” জেনারেল হাত মেলাতে মেলাতে হাসলেন। অ্যাডজুট্যান্ট এসে আমাকে সঙ্গে করে বাইরে আরেকজনের কাছে নিয়ে গেল।
সেদিন লিমার খবরের কাগজগুলোতে নরওয়ের ভেলা অভিযানের খবরটা ছাপা হল, যা কিনা পেরু থেকেই শুরু হবে। একইসঙ্গে জানানো হল যে আমাজনের জঙ্গলের ইন্ডিয়ানদের নিয়ে গবেষণার জন্য একটা সুইডিশ-ফিনিশ বৈজ্ঞানিক অভিযান শেষ হয়েছে। আমাজন অভিযানের দুজন সুইডিশ সদস্য ক্যানো চালিয়ে নদী বেয়ে পেরু অবধি এসেছে আর এই মুহূর্তে তারা লিমায় এসে পৌঁছেছে। এদের একজন উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেঙ্গট ড্যানিয়েলসন, এবারে পেরুর পাহাড়ি ইন্ডিয়ানদের নিয়ে কাজ করবেন।
আমি খবরটা কেটে রাখলাম; হোটেলে বসে বসে হারম্যানকে ভেলা বানানোর জায়গাটা নিয়ে চিঠি লিখছিলাম, দরজায় টোকা পড়তে থামতে হল। ঘরে যিনি ঢুকলেন তিনি লম্বা, তামাটে রোদে পোড়া দেহ, হাল্কা পোশাকআশাক। আর যখন মাথা থেকে সাদা হেলমেটটা খুলে ফেললেন, মনে হল, ওর লালচে আগুনের মতো দাড়িটা যেন মুখখানা পুড়িয়ে দিয়েছে এবং চুলও পাতলা করে দিয়েছে। লোকটা জঙ্গল থেকে এসেছে বটে তবে লোকটার জায়গা লেকচার রুম।
“বেঙ্গট ড্যানিয়েলসন”, আমি মনে মনে ভাবি।
“বেঙ্গট ড্যানিয়েলসন”, লোকটা নিজের পরিচয় দেয়।
“আমাদের ভেলার ব্যাপারটা শুনেছে”, ভেবে নিয়ে আমি লোকটাকে বসতে বলি।
“আমি ভেলার পরিকল্পনাটা শুনেই আসছি”, সুইডিশ মানুষটা বলল।
“এখন নিশ্চই তত্ত্বটা খারিজ করতে এসেছে, কেন না ব্যাটা তো আবার জাতিতত্ত্ববিদ, এথনোলজিস্ট!” আমি মনে মনে ভাবি।
“এখন, ওই ভেলাটায় তোমাদের সঙ্গে যেতে পারব কিনা, জানতে এসেছি আমি,” শান্তভাবে বলল ও, “আমি মাইগ্রেশন তত্ত্বটা নিয়ে আগ্রহী।”
লোকটা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না, কেবল এই যে ও একজন বৈজ্ঞানিক আর সদ্য জঙ্গলের গভীর থেকে ফিরে সোজা চলে এসেছে, ব্যস। কিন্তু যে সুইডিশ একা পাঁচ পাঁচটা নরওয়েজিয়ানের সঙ্গে ভেলায় ভেসে পড়ার সাহস আর দৃঢ়তা দেখাতে পারছে, তাকে নিরাশ করা সহজ না। যেমন মুখভর্তি দাড়িও ওর ধীরস্থির, রসিক স্বভাবটাকে ঢেকে দিতে পারেনি।
বেঙ্গট আমাদের ছ’নম্বর সদস্য হল। ওই জায়গাটা খালিই ছিল। দলে কেবল ওইই স্প্যানিশ বলতে পারত। এর দিনকয়েক বাদে যখন এরোপ্লেনের সিটে বসে সমুদ্রের ধার ধরে উত্তরের দিকে উড়ে চলেছি, আবার তাকিয়ে দেখলাম; সীমাহীন নীল সমুদ্রের জল পায়ের নীচে। আকাশের তলায় আলগা ভেসে আছে যেন। শীগগিরই আমরা ছ’টা প্রাণী ঠাসাঠাসি একটা ছোট্টো বিন্দুর ওপর আনুবীক্ষণিক প্রাণির মতো ভাসতে থাকব। ওই…ই নীচে, অগাধ জলরাশি যেখানে, মনে হচ্ছে পশ্চিম দিগন্তে গিয়ে জল উপছে পড়ছে। আমরা এমন একটা জায়গায় নিজেদের আবদ্ধ করতে যাচ্ছি যে একে অন্যের চেয়ে দু-চার পায়ের বেশি দূরে যাবার সুযোগও থাকবে না।
যা হোক, আপাতত আমাদের মধ্যে যথেষ্ট জায়গাই রয়েছে। হারম্যান ইকুয়েডরে কাঠের জন্য অপেক্ষায়। নুট হল্যান্ড আর টরস্টাইন র্যাবি সবে বিমানে নিউ ইয়র্কে নেমেছে। এরিক হেসেলবার্গ অসলো থেকে পানামা আসার জাহাজে চড়ে বসেছে। আমি বিমানে চড়ে ওয়াশিংটন যাচ্ছি আর বেঙ্গট, যাবার জন্য তৈরি হয়ে বাকিদের সঙ্গে আলাপ করার জন্য লিমার হোটেলে বসে।
এই লোকগুলোর কোনো দুজন একে অন্যেকে চেনে না, প্রত্যেকেই একে অন্যের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই অবস্থায় একে অন্যের গপ্পগুলো শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়বার আগেই কয়েক সপ্তাহ আমাদের ভেলায় চড়ে পড়া দরকার ছিল। ছটা লোক মাসখানেক চুপচাপ কেউ কারো সঙ্গে কথা না বলে ভেলায় ভাসতে ভাসতে হঠাৎ একদিন মানসিক বিপর্যয় ঘটলে সেটা যেকোনো ঝড় ঝঞ্ঝা বৃষ্টিপাত দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার থেকে অনেক বড়ো বিপদ ডেকে আনবে। এ’রকম সময়ে একটা ভালো মজার কথা বা জোক প্রায় লাইফ বেল্টের মতোই দামি।
আমি যখন ফিরে এলাম ওয়াশিংটনে তখনও বিশ্রী ঠান্ডা আবহাওয়া, ফেব্রুয়ারির ঠান্ডা আর তুষারপাত। বিয়র্ন রেডিওর সমস্যাটা মিটিয়ে রেখেছিল; রেডিও অ্যামেচার লিগের লোকেরা ভেলা থেকে পাঠানো আবহাওয়ার রিপোর্টটা শুনতে আগ্রহী। নুট আর টরস্টাইন বেতারবার্তা পাঠানোর ব্যবস্থাপনায় ব্যস্ত ছিল। এর খানিকটা হবে শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটারে, যেটা কেবল আমাদের জন্যই বিশেষভাবে বানানো হয়েছিল, আর খানিকটা হবে যুদ্ধে গোপন অন্তর্ঘাতে ব্যবহৃত সেট দিয়ে। যা যা পরিকল্পনা করেছিলাম, তা ঠিকঠিক সব নিয়ে জলযাত্রা করতে হলে, তখনও ছোটো বড়ো হাজারটা জিনিস তৈরি বাকি।
ফাইলে কাগজের পাহাড় জমে উঠল। সামরিক অসামরিক নানা দলিল – সাদা, হলদে, এবং নীল – ইংরিজি, স্পেনীয়, ফরাসি, এবং নরওয়েজিয় ভাষায়। একটা নেহাৎ ভেলা-যাত্রার জন্যও কাগজ কারখানাগুলোকে এই আধুনিককালেও আধখানা ফার গাছ কাজে লাগাতে হল। আইন কানুন সর্বত্র আমাদের হাত-পা বেঁধে রেখেছিল, একে একে তার গিঁট খুলতে হচ্ছিল।
“ভগবানের দিব্যি, এই চিঠিচাপাটি সব মিলিয়ে কুড়ি পাউন্ডের মতো ভারী হবে।” নুট একদিন টাইপরাইটারে ঝুঁকে, হতাশ হয়ে বলেই ফেলে।
“ছাব্বিশ” খুব শুকনো গলায় বলে টরস্টাইন, “আমি মেপেছি।”
আমার মা নির্ঘাৎ এই সময়ে আমাদের এই চমকপ্রদ আয়োজনপর্বটা পরিষ্কার ধরতে পারছিলেন; মা লিখলেন, “আমি কেবল চাই যাতে তোমরা ছ’জনে নিরাপদে ভেলায় চাপতে পারো।”
তারপর একদিন লিমা থেকে একটা এক্সপ্রেস টেলিগ্রাম এসে হাজির। ঢেউয়ের ধাক্কায় পাড়ে ছিটকে পড়ে হারম্যানের গুরুতর চোট লেগেছে, ঘাড়ের হাড় সরেছে, লিমার হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। টরস্টাইন র্যাবিকে তক্ষুনি পাঠানো হল গেয়ার্ড ভল-এর সঙ্গে; যুদ্ধের সময় গোপন প্যারাশ্যুট বাহিনীর লন্ডনের জনপ্রিয় সম্পাদক ছিল ও, সেসময় ওইই আমাদের ওয়াশিংটনে সাহায্য করছিল। ওরা হারম্যানকে ভালই দেখল গিয়ে, মাথার চারপাশে একটা স্ট্র্যাপ বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল ওকে, আর ডাক্তার ওর শিরদাঁড়ার একেবারে ওপরে ঘাড়ের কশেরুকার সরে যাওয়া অংশটা ঠিক জায়গামতো বসিয়ে দিয়েছিল। এক্সরেতে দেখা গেছিল, সবচেয়ে ওপরের হাড়টা ভেঙে পুরো ঘুরে গেছিল। হারম্যানের দারুন স্বাস্থ্যই ওকে বাঁচিয়ে দিল আর তাড়াতাড়ি ফিরেও এল, ফ্যাকাসে, ঘাড়শক্ত, বাতের ব্যথা নিয়ে; নৌবাহিনীর ডক এলাকাতে এসে ও বালসা কাঠ জড়ো করার কাজ শুরু করে দিল। বেশ কয়েক সপ্তাহ ওর ডাক্তারের তত্ত্বাবধানেই থাকতে হত, আর খুবই আশঙ্কা ছিল যে আদৌ ও আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে কীনা! প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে পয়লা মোলাকাতেই এমন বিশ্রী ঘটনার পরও ওর অবশ্য এই অভিযানে যাওয়া নিয়ে কখোনো কোনো সন্দেহ ছিল না।
তারপর এরিক পানামা থেকে উড়োজাহাজে করে এসে গেল, আমি আর নুটও ওয়াশিংটন থেকে; একে একে সক্কলে জড়ো হলাম লিমায়, যেখান থেকে রওনা হব আমরা। নৌবাহিনীর ডক এলাকায় কুইভেদোর জঙ্গলের বড়ো বড়ো বালসা কাঠের গুঁড়িগুলো রাখা ছিল। মর্মান্তিক দৃশ্য। সদ্য কাটা গোল কান্ডগুলি, হলদে বাঁশ, নলখাগড়ার ঝাড় আর সবুজ কলাপাতার স্তূপ ডাঁই করে রাখা আমাদের ভেলা বানানোর জন্য। দুপাশে ভয়জাগানো সার সার ধূসর সাবমেরিন আর জাহাজ ধ্বংসকারী ডেস্ট্রয়ার।
ছ’টা সাদা চামড়ার লোক আর বিশটা বাদামি চামড়ার পেরুর নাবিক যাদের শিরায় ইনকাদের রক্ত বইছে, কুড়ুল চালাচ্ছে কিংবা লম্বা ফলাওয়ালা ম্যাশেট ছুরি, এবং দড়ি আর বাঁধন নিয়ে ব্যস্ত। সুবেশ নীল আর সোনালি পোষাকের নৌবাহিনীর অফিসারেরা হঠাৎ তাদের গর্বের নৌবন্দর এলাকায় কতগুলো ঘোলাটে পোশাকের অজানা অচেনা লোক আর তাদের স্থুল কাঠকুটোলতাপাতা দেখে আশ্চর্য তো বটেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল।
গত একশ বছরে এই প্রথম কাল্লাও বন্দরে একটা বালসা কাঠের ভেলা বানানো হচ্ছে। এসব উপকূল অঞ্চলে ইনকাদের গল্পে রয়েছে যে কনটিকির অদৃশ্য হয়ে যাওয়া জাতের লোকেদের থেকে তাদের পূর্বপুরুষেরা এরকম ভেলা চালাতে শিখেছিল, আর আমাদের লোকেরা এখনকার ইন্ডিয়ানদের সেই ভেলা তৈরি করা নিষিদ্ধ করে। খোলা ভেলা চালিয়ে সমুদ্রে গেলে তা মানুষের মৃত্যুই ডেকে আনবে। ইনকাদের পরবর্তী প্রজন্ম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এভাবে সরে এসেছে; আমাদের মতোই, নিখুঁত ইস্ত্রি করা প্যান্ট পড়ছে, আর জাহাজি নৈপুণ্যে তৈরি বন্দুক দিয়ে নিজেদের সুরক্ষিত করে ফেলেছে। বাঁশ, বালসা এসব মান্ধাতার আমলের ব্যাপার। এখানেও জীবন এগিয়ে গেছে ইস্পাতের বর্মের দিকে।
অত্যাধুনিক বন্দর এলাকা আমাদের দারুণ সাহায্য করল। বেঙ্গটকে দোভাষী আর হারম্যানকে প্রধান নির্মাণকারী করে আমাদের সারিসারি ছুতোর আর নৌকোসারানোর দোকান লেগে গেল, আর মাল রাখার অর্ধেকটা জায়গাতে আমাদের যন্ত্রপাতি আর সমুদ্রে নামার জন্য একটা ছোটো পাটাতন, যাতে করে ভেলা তৈরি শুরু সময় কাঠগুলো জলে ভাসানো হয়েছিল।
সবচেয়ে মোটা নটা গুঁড়ি নেওয়া হল মূল ভেলাটা বানানোর জন্য। কাঠের ওপর বেশ গভীর করে খাঁজ কেটে দেওয়া হল, যাতে দড়ি দিয়ে গুঁড়িগুলো বাঁধলে, বা পুরো ভেলটা বাঁধার পর দড়ি পিছলে সরে না যায়। একটাও গজাল, পেরেক বা তারের বাঁধন কিচ্ছুটি ব্যবহার হয়নি ভেলা তৈরিতে। নটা বিশাল গুঁড়ি প্রথমে পাশাপাশি জলে ফেলা হল। পরস্পর বেঁধে ফেলার আগেই, তারা স্বাভাবিকভাবে নিজস্বতা অনুযায়ী যাতে জলে ভাসতে পারে। সবচেয়ে লম্বা ৪৫ ফুটের গুঁড়িটা, মাঝখানে রাখা হল আর তার এপাশ ওপাশ দুদিকেই বেশ খানিকটা বেরিয়ে রইল। এটার পাশাপাশি দুদিকে এবারে ক্রমশ ছোটো গুঁড়িগুলো পরপর সাজানো হল। এতে ভেলার বাহুর দৈর্ঘ্য দাঁড়ালো ৩০ ফুট আর ভেলার সামনেটা দেখতে হল ভোঁতা লাঙলের মতো। পেছনটা সিধে করে কাটা হল, কেবল মাঝের তিনটে কাঠের গুঁড়ি একটু বেরিয়ে রইল, যার ঊপরে একটা মোটা বালসা কাঠ ভেলার আড়াআড়ি রেখে, লম্বা দাঁড় আটকানোর আংটা আটকানো হল। ন’টা বালসা কাঠ নানা দৈর্ঘ্যের সওয়া ইঞ্চি চওড়া শনের দড়ি দিয়ে ভালো করে বাঁধা হয়ে গেলে, হালকা বালসা কাঠ আড়াআড়িভাবে এর ওপরে তিনফুট ছেড়ে ছেড়ে বাঁধা হল।
ভেলা মোটের উপর এখন তৈরি। তিনশ আলাদা আলাদা দৈর্ঘ্যের দড়ি দিয়ে খুব পরিশ্রম করে শক্ত করেই বাঁধা। বাঁশ চিরে এর ওপরে পরপর সারি সারি বাঁধা হল আর তার ওপরে দরমার বেড়া আলগা বিছিয়ে দেওয়া হল। ভেলার মাঝামাঝি একটু পেছনের দিকে একটা ছোটো খোলা ঘর বানালাম আমরা, বাঁশ দিয়ে, দেওয়াল হল দরমা বেড়ার, আর ছাতে সরু সরু করে বাঁশ কেটে লাগিয়ে তার ওপরে কলাপাতা একটার ওপরে আরেকটা টালির মতো করে ছেয়ে দেওয়া হল। ঘরটার সামনে পাশাপাশি দুটো মাস্তুল লাগালাম। ওগুলো ম্যানগ্রোভ গাছ থেকে কেটে আনা, লোহার মতো শক্ত, দুটো একে অন্যের দিকে হেলানো ফলে ডগার দিকে দুটোকেই একত্রে শক্ত করে বেঁধে ফেলা গেল।
বড় চৌকো পালটাকে দু-দুটো বাঁশের খুঁটিতে আরো দ্বিগুণ শক্তপোক্ত করে বেঁধে খাটিয়ে ফেলা হল। যে ন’টা বড়ো কাঠের গুঁড়ি আমাদের বয়ে বয়ে সমুদ্রে নিয়ে যাবে, তাদের সামনেটা স্থানীয়দের মতো করে ছুঁচলো করে দেওয়া হল, যাতে সহজে জলের ওপর ভেসে এগোতে পারে আর সামনের দিকেই নিচু করে পাঠাতন আটকে দেওয়া হল জলতলের খানিকটা ওপরের দিকে যাতে জল ছিটকে না আসে। গুঁড়িগুলোর মধ্যে যেখানে ফাঁকটা একটু বেশি, সেখানে পাঁচখানা করে ফার কাঠের পাটাতন গুঁজে দেওয়া হল। ওগুলো এক ইঞ্চি মতো পুরু আর একফুট মতো চওড়া। জলের মধ্যে ডুবে রইল অন্তত পাঁচফুট। দড়ি আর কাঠের গোঁজের সাহায্যে ওগুলোকে জায়গা মতো রাখা হল। গোটা ভেলাটা জুড়েই ছড়িয়ে এরকম পাটাতন লাগানো হল। এগুলো পাশাপাশি সমান্তরালে থাকা নৌকার পাটাতন বা সেন্টারবোর্ডের কাজ করবে। আবিষ্কার করার ঢের আগে প্রাচীন ইনকাদের সময় থেকেই এরকম পাটাতন ওরা বালসা-ভেলাতে ব্যবহার করত; আর ওরা এধরনের সেন্টারবোর্ড ব্যবহার করত যাতে হাওয়া বা ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেলা পাশাপাশি ভেসে চলে না যায়। আমরা ভেলার চারপাশ দিয়ে রেলিং বা ওরকম কোনো সুরক্ষা হাতল বানাইনি কিন্তু আমরা সরু লম্বা বালসা কাঠ প্রত্যেক পাশে লাগিয়েছিলাম যাতে পা রাখা যায়।
পুরো ভেলাটার নির্মাণ একেবারে হুবহু পেরু আর ইকুয়েডরের প্রাচীন ভেলাগুলোর মতো, কেবলমাত্র সামনের দিকে জল আটকানোর নিচু পাটাতনগুলো ছাড়া, পরে অবশ্য প্রমান হয় ওগুলো একেবারেই অনাবশ্যক ছিল। ভেলাটা বানানোর পর ওর ওপরে খুশিমতো এটা ওটা আমরা সাজাতে থাকলাম, খালি খেয়াল রাখা হল তাতে ভেলার চলাচল আর ভেলার গুণমানে যাতে কোনো আঁচ না পড়ে। আমরা জানতাম আগামী কয়েকদিন আমাদের কাছে ভেলাটাই গোটা পৃথিবী হবে, ফলে যত দিন যেতে থাকল ছোটো ছোটো জিনিস ক্রমশ খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং অনন্যমাত্রার হয়ে উঠতে থাকল।
সুতরাং আমরা ছোটো ডেকটাতে যথাসম্ভব বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করলাম। সরু সরু বাঁশের ফালি গোটা ভেলাতে পাতা ছিল না, বাঁশের ঘরটার সামনের মেঝের দিকে আর ডানপাশে যেদিকটা দেওয়ালবিহীন সেদিকে পাতা ছিল শুধু। ঘরের বাঁদিকটায় বাক্সপ্যাঁটরা, দরকারি সকল জিনিস, যন্ত্রপাতি, সব ডাঁই করা ছিল আর একফালি হেঁটে যাবার মতো জায়গা। ঘরের দেওয়ালের পর ভেলার সামনে আর পেছনের দিকে ন’টা কাঠের গুঁড়ির ওপরে কোনো ডেক বানানো ছিল না। ফলে ঘরের চারপাশে ঘোরার সময়ে আমাদের হলদে বাঁশের বা বেড়ার ওপর থেকে ধূসর আড়াআড়ি ফেলা গোলাকার গুঁড়িতে পা ফেলে অন্যপাশে মালপত্রের ওপরে গিয়ে উঠতে হত। অনেকখানি পা ফেলতে হত এমন না, কিন্তু মানসিকভাবে এই উঁচুনিচু আলাদা আলাদা পা ফেলার জায়গা, চলাচলের সামান্য স্বাধীনতাটুকুর বদলে আমাদের হাঁটায় একটা বৈচিত্র্য আনত। মাস্তুলের ওপরে আমরা একটা কাঠের পাটাতন আটকেছিলাম, নজরদারির জন্য ততটা নয়, এমন নয় যে আমরা যখন ডাঙার কাছাকাছি আসব তখন নজর রাখতে হবে, বরং ভেলা চলার সময়ে ওটায় বেয়ে উঠে সমুদ্রটাকে একটু অন্য অ্যাঙ্গেলে দেখাটাই উদ্দেশ্য ছিল।
ভেলাটা যখন একটু একটু করে দাঁড়াচ্ছে, চারপাশে যুদ্ধজাহাজের মাঝে, সোনালি রঙের আর ঝকঝকে একদম, পাকা বাঁশ আর সবুজ পাতায় তৈরি; একদিন সমুদ্রবিষয়ক মন্ত্রী নিজে এলেন ভেলা পরিদর্শনে। আমরা আমাদের ভেলা নিয়ে বেশ গর্বিত ছিলাম, চারপাশে পিলে চমকানো যুদ্ধজাহাজের মধ্যে প্রাচীন ইনকাদের সময়কে মনে পড়িয়ে দেওয়া একরত্তি সাহসী ভেলা। কিন্তু মন্ত্রী যা দেখলেন তাতে বেজায় আতঙ্কিত হলেন। আমাকে নৌবাহিনীর অফিসে ডেকে পাঠিয়ে নৌবন্দরে যা তৈরি হয়েছে তা থেকে নৌবাহিনীকে সম্পূর্ণ দায়িত্বমুক্ত করার অঙ্গীকারপত্রে আমাকে সই করানো হল। আর বন্দরের প্রধানকে লিখে দিতে হল, যদি আমি ভেলায় লোকজন আর মালপত্র নিয়ে বন্দর ছেড়ে যাই, সেটা সম্পূর্ণ আমার দায়িত্বে আর তাতে কারো কোনো দায় থাকবে না।
পরে আরো কয়েকজন বিদেশী জাহাজি বিশেষজ্ঞ আর কূটনীতিবিদকে নৌবন্দরে নিয়ে এসে ভেলাটা দেখানো হয়েছিল। তাঁরাও খুব একটা আশাব্যঞ্জক কথা বলেননি। কয়েকদিনের মধ্যে আমায় একটি অন্যতম ক্ষমতাশালী দেশের রাষ্ট্রদূত ডেকে পাঠালেন।
“তোমার বাপ মা বেঁচে?” প্রশ্ন করলেন তিনি। হ্যাঁ বলাতে, সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত গলায় যেন ভয়ানক শোকের ব্যাপারে বলছেন, এমন করে বললেন, “তোমার মা বাবা খুবই কষ্ট পাবেন তোমার মৃত্যুসংবাদ শুনে।”
ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমায় এই জলযাত্রায়, সময় থাকতেই, যেতে মানা করলেন অনেক করে। একজন অ্যাডমিরাল ভেলাটা দেখেশুনে তাঁকে বলেছিলেন আমরা কোনোদিন এই ভেলায় জীবিত পৌঁছবো না। প্রথমত ভেলার মাপজোখ ঠিক নেই। এত ছোট যে সমুদ্রে খুঁজে পাওয়া যাবে না, আবার পাশাপাশি এতটাই বড়ো যে দুটো ঢেউয়ের মধ্যে পড়ে মানুষ আর মালপত্রের চাপ সইতে না পেরে বালসা কাঠ ভেঙে যাবে। আর সবচেয়ে বড়ো ব্যাপারটা হল বালসার সবচেয়ে বড়ো রপ্তানিকারক ওকে বলেছেন, পুরো দূরত্বের একের চারভাগ যেতে না যেতেই জল শুষে বালসা এত ভারী হয়ে যাবে যে ভেলাটা ডুবে যাবে।
এইটা একটু খারাপ খবর বটে কিন্তু আমরা আমাদের গোঁ থেকে নড়লাম না বলে আমাদের একটা করে বাইবেল উপহার দেওয়া হল সঙ্গে করে নিয়ে যাবার জন্য। মোটের ওপর বিশেষজ্ঞ যারা যারা ভেলাটা দেখল কেউই উৎসাহব্যঞ্জক কিছুই বলল না। গেইল বা অন্য ঝঞ্ঝা হয়তো আমাদের ভাসিয়ে দিয়ে, আমাদের ছোট্টো ভেলাটাকে গুঁড়িয়ে দেবে, বাতাস আর সমুদ্রের ঢেউয়ে অসহায়ভাবে এদিক ওদিকে ঘুরে ঘুরে ভাসবে, ভেসে চলে যাবে। এমনকি একটা অস্থির সমুদ্রে সারাক্ষণ নোনা জলে ভিজে ভিজে আমাদের পায়ের চামড়া উঠে যাবে, মালপত্র নষ্ট হয়ে যাবে। সমস্ত বিশেষজ্ঞের মতামত একত্র করলে, প্রত্যেকে আলাদা আলাদাভাবে আমাদের ভেলার নির্মাণের ত্রুটি দেখিয়েছেন; একখানা দড়ি, তার বাঁধন, কোনো মাপজোখ, এক টুকরো কাঠ, সারা ভেলাতে এমন কিচ্ছু বাকি নেই যা আমাদের সমুদ্রে ভেঙে পড়ার কারণ হতে পারে। বড় জুয়ারিরা আমাদের ভেলাটা কদ্দিন টিঁকবে এই নিয়েই বাজি ধরে বসল। একজন ফক্কুড়ে নৌবাহিনীর দূত বাজি রাখল, যদি সক্কলে জীবিত দক্ষিণ সমুদ্রের দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছয় তবে অভিযাত্রীরা বাকি জীবন যত হুইস্কি খেতে পারে তিনি দেবেন।
সবচেয়ে বাজে ব্যাপারটা হল যখন বন্দরে একটা নরওয়ের জাহাজ এসে ভিড়ল আর আমরা সেটার কাপ্তান আর তার সবচেয়ে অভিজ্ঞ ঝানু কয়েকজন নাবিককে বন্দরের জাহাজ মেরামতির জায়গায়, ডকইয়ার্ডে, ডেকে আনলাম। আমরা ওদের অভিজ্ঞ পরামর্শের জন্য উদগ্রীব হয়েছিলাম। যখন শুনলাম তাদের সবারই মত হল অমন ভোঁতামুখের যেমন-তেমন ভেলাটা পালের বাতাসে কোনো সাহায্যই পাবে না, আমাদের হতাশা রাখার আর জায়গা ছিল না। কাপ্তান এক পা এগিয়ে বলল, যদিও বা ভেসে থাকতে পারি, হামবোল্ট স্রোতের টানে পাড়ি দিতে ভেলাটার এক কি দু’বছর লেগে যাবে। জাহাজের যন্ত্রপাতির দায়িত্বে থাকা লোকটা আমাদের দড়াদড়ির বাঁধন দেখে মাথা নাড়ল। চিন্তার কিছু নেই। ভেলাটা একপক্ষকালও টিঁকবে না, তার আগেই দড়িগুলো ছিঁড়ে যাবে। সমুদ্রে গুঁড়িগুলো ক্রমাগত ওপরে-নীচে দুলবে, ঘষা খাবে, ওতেই দড়িগুলো যাবে। ধাতব তার বা শেকল ব্যবহার করলে বরং টিঁকে যেতে পারে। এই কঠিন যুক্তিগুলো দমবন্ধ করে দেবার মতো ছিল। ওদের মধ্যে একজনও সত্যি প্রমাণিত হলে আমাদের কোনোই সুযোগ নেই।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম, নিজেকে বার বার জিজ্ঞাসা করলাম, আমরা যা করছি ঠিক করছি তো? ওদের কথার প্রতিযুক্তি দেখাতে পারিনি কারণ আমি তো নাবিক ছিলাম না। কিন্তু আমার কাছে ছিল একটাই মোক্ষম ট্রাম্পকার্ড, যার ওপরে গোটা অভিযানটাই দাঁড়িয়ে। আমি মনে মনে জানতাম, প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা পেরু থেকেই দ্বীপপুঞ্জে পাড়ি দিয়েছিল, আর তখন উপকূল অঞ্চলে এই ভেলাই ছিল পারাপারের জন্য একমাত্র জলযান। আমি একটা সাধারণ ধারনা করেছিলাম যে আমরা যদি একেবারে অন্ধের মতো প্রাচীন ভেলার মতো হুবহু একই ভেলা বানিয়ে থাকি এবং কন টিকি-র জন্য বালসা কাঠ যদি জলে ভেসে থাকে আর দড়ির বাঁধন ৫০০ খ্রীষ্টাব্দে টিঁকে থাকে, তবে তা আমাদের জন্যও থাকবে।
বেঙ্গট আর হারম্যান তত্ত্বটা আগাপাশতলা পড়ল, আর বিশেষজ্ঞরা যখন হাহুতাশ করছে, ছেলেরা খুব শান্তভাবেই নিল সেটা আর দিব্যি লিমাতে ব্যাপক সময় কাটাতে লাগল। খালি একটা সন্ধেয় টরস্টাইন খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে সামুদ্রিক স্রোতটা ঠিকঠাক দিকেই বইছে তো? আমরা সবাই মিলে ফিল্ম দেখতে গেলাম, ডরোথি ল্যামোরকে দেখলাম শনের স্কার্ট পরা, দক্ষিণ দ্বীপপুঞ্জের কোনো দ্বীপে পামগাছের ভিড়ে হুলা মেয়েদের সঙ্গে নাচছে।
“ওখানে যাবই” টরস্টাইন বলল,”আর যেরকম বলেছ সেরকম যদি স্রোত না বয় তাহলে সত্যিই খুব খারাপ হয়ে যাবে।”
আমাদের যাবার দিন এগিয়ে এলে, আমরা পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রক অফিসে গিয়ে দেশ ছেড়ে যাবার অনুমতি চাইলাম। দোভাষী হিসেবে বেঙ্গট লাইনের সামনে দাঁড়াল।
“নাম?” ছোটোখাটো কেরানিটি চশমার ওপর দিয়ে বেঙ্গটের বিশাল দাড়ির দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি ফেলে জানতে চাইলেন।
“বেঙ্গট এম্মারিক ড্যানিয়েলসন।” বেঙ্গট সসম্ভ্রমে বলল।
লোকটা একটা লম্বা ফর্ম টাইপরাইটারে চড়াল।
“কোন জাহাজে চড়ে পেরুতে এসেছিলেন?”
“ইয়ে, দেখুন”, বেঙ্গট বোঝাবার জন্য নিরীহ ছোটোখাটো লোকটার ওপরে ঝুঁকে পড়ে,” আমি জাহাজে চড়ে আসিনি, ক্যানোয় চড়ে পেরু এসেছি।”
লোকটা আশ্চর্য হয়ে ভ্যাবলার মতো দেখল বেঙ্গটকে তারপর ফর্মে একটা ফাঁকা জায়গায় টাইপ করল ‘ক্যানো’।
“আর কোন জাহাজে চড়ে পেরু থেকে বেরোবেন?”
“ইয়ে, মানে, বলছি যে,” বেঙ্গট খুব বিনীতভাবে বলল, “আমি জাহাজে চড়ে যাচ্ছি না, যাচ্ছি ভেলায় চড়ে।”
“বুঝেছি, একই গপ্প,” লোকটা টান মেরে মেশিন থেকে কাগজটা খুলে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলল, “আমার প্রশ্নের জবাবটা ঠিকঠাক দেবেন কি?”
ভেসে পড়ার কয়েকদিন আগেই ভেলায় সমস্ত মালপত্র খাবার জল সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হল। আমরা ছ’জন লোকের চার মাসের মতো রসদ নিয়ে নিয়েছিলাম; ছোটো ছোটো কার্ডবোর্ডের বাক্স ভর্তি সামরিক র্যাশন। হারম্যানের পরিকল্পনা অনুযায়ী গলানো পিচ দিয়ে প্রতিটা বাক্সের চারপাশে একটা অতিরিক্ত প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল। তার ওপরে আমরা বালি ছড়িয়ে দিয়েছিলাম যাতে একটা আরেকটার সঙ্গে লেগে না যায়; তারপর সেগুলো একসঙ্গে ঠাসাঠাসি করে বাঁশের ডেকের ঠিক নীচে নটা আড়কাঠের ওপরে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল, যেগুলো বাঁশের ডেকটাকে ধরে রেখেছিল।
পাহাড়ি ঝরনার স্ফটিক-স্বচ্ছ জলে ছাপ্পান্নটা ছোটো জলের পাত্র ভরা হল, মোট ২৭৫ গ্যালন পানীয় জল। এগুলোও আমরা ঘনঘন করে আড়কাঠের মধ্যে রাখলাম, কেননা সমুদ্রের জলের ঝাপটা তো লাগতেই থাকবে। বাঁশের ডেকের ওপর বাকি জিনিসপত্র বেঁধে রাখা হল, যেমন ফলমূলের বড়ো বড়ো চাটাইয়ের ঝুড়ি, নারকোল ইত্যাদি।
বাঁশের ঘর বা কেবিনটার একটা কোনা টরস্টাইন আর নুট নিয়ে নিল রেডিওর জন্য। ঘরটার মধ্যে নীচের আড়াআড়ি কাঠগুলোর মধ্যে আমরা আটখানা বাক্স বেঁধে রাখলাম। দুটো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আর ফিল্মের জন্য; অন্য ছটা আমাদের প্রত্যেকের জন্য একটা করে, বলা রইল, ওই একএকখানা বাক্সে এঁটে যাবে এমন যত খুশি নিজস্ব জিনিস আমরা সঙ্গে নিতে পারি। এরিক ছবি আঁকার অনেক কাগজের তাড়া আর ওর গিটারটা এনেছিল, ফলে বাক্স ভরে যাওয়াতে ওর মোজাগুলো টরস্টাইনের বাক্সে ঢোকাতে হল। বেঙ্গটের বাক্সটা ভেলায় তুলতে চারটে জাহাজিকে বইতে হল। ও বই ছাড়া কিছুই নেয়নি সঙ্গে, তবে ওরই মধ্যে ও তিয়াত্তরটা সমাজবিজ্ঞান ও জাতিতত্ব্বের কাজকর্ম ঠেসে দিতে পেরেছিল। বাক্সগুলোর ওপরে আমরা বেড়া আর শনের মাদুর বিছিয়ে দিয়েছিলাম। এবারে আমরা প্রস্তুত যাত্রার জন্য।
প্রথমে নৌবাহিনীর এলাকা থেকে বের করে ভেলাটাকে নৌকোয় বেঁধে বন্দর এলাকায় ঘুরিয়ে দেখা হল মালপত্রগুলো সুষমভাবে সাজানো হয়েছে কিনা। তারপর ওটা বেঁধে নিয়ে কাল্লাও বাইচ ক্লাবের দিকে পাড়ি দেওয়া হল, আমাদের যাত্রা শুরুর ঠিক আগের দিন, যেখানে গণ্যমান্য আমন্ত্রিত অভ্যাগতের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে ভেলাটার নামকরণ হবে।
এপ্রিল ২৭, ১৯৪৭, নরওয়ের ফ্ল্যাগ উত্তোলন করা হল। যেসব দেশ আমাদের অভিযানে সহায়তা করেছিল, মাস্তুলে পালের পাশে তাদের ফ্ল্যাগ ঝোলান হল। জেটিতে লোকে লোকারণ্য, সক্কলে ভেলাটার প্রথম জলে ভাসার দৃশ্য চাক্ষুষ করবে বলে এসেছিল। গায়ের রঙ, চোখমুখ দেখে অবশ্য বোঝার উপায় নেই তাদের সুদূর পূর্বপুরুষেরা এই উপকূলেই এরকম বালসা ভেলা ভাসাতেন। আবার পুরোনো স্পেনের লোকেদের বংশধরেরাও ছিল, ছিল পেরুর নৌবাহিনি তথা সরকারের প্রতিনিধি। এছাড়াও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন, আর্জেন্টিনা এবং কিউবার রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ইংরেজ উপনিবেশের প্রাক্তন রাজ্যপাল; সুইডেন ও বেলজিয়ামের মন্ত্রীরা এবং কনসাল জেনারেল বার এর নেতৃত্বে ছোটো নরওয়েজিয় কলোনি থেকে আমাদের বন্ধুরা। সাংবাদিকরা থিক থিক করছিল, মুভি ক্যামেরার শাটারের আওয়াজ;
সত্যি বলছি, একটা জিনিসেরই অভাব ছিল – ব্যান্ডপার্টি আর একটা জয়ঢাক। একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছিল আমাদের কাছে, সমুদ্রখাঁড়ি থেকে বেরিয়ে যদি আমাদের ভেলাটা টুকরো টুকরোও হয়ে যায়, আমরা এক একটা গুঁড়িতে ভেসে বেয়ে বেয়ে পলিনেশীয়া চলে যাব তবু এখানে ফিরে আসার সাহস করব না।
আমাদের অভিযানের সম্পাদক আর মূল ভূখন্ডে আমাদের যোগাযোগ রক্ষাকারী, গেয়ার্ড ভল, নারকেল ফাটিয়ে যাত্রা সূচনা করলেন; এটাতে খানিক প্রস্তরযুগের রীতিও মানা হল, অবশ্য খানিকটা ভুল বোঝাবুঝির কারণেও, কেন না শ্যাম্পেনের বোতলগুলো টরস্টাইনের বাক্সের তলায় ঢোকানো হয়ে গিয়েছিল। আমাদের বন্ধুদের ইংরিজি আর স্প্যানিশে জানানো হল যে ইনকাদের মহান পূর্বপুরুষ, সূর্যদেবতা, পেরু থেকেই পশ্চিমদিকে সমুদ্রে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন আর ১৫০০ বছর আগে পলিনেশীয় অঞ্চলে ফের উদয় হয়েছিলেন; তার নামেই আমাদের ভেলাটার নাম, গেয়ার্ড ভল আনুষ্ঠানিকভাবে ভেলাটার নামকরণ করলেন কন-টিকি। তিনি ভেলার সামনের গলুইয়ে এত জোরে নারকেলটা আছাড় দিলেন (আগে থেকে ফাটানোই ছিল) যে নারকেলের জল আর শাঁসের টুকরো আশপাশে গোল হয়ে ঘিরে থাকা সক্কলের মাথার চুলে গিয়ে পড়ল।
তারপরে বাঁশে লাগানো পালটা খাটানো হল, যার ওপরে ঠিক মাঝামাঝি, আমাদের শিল্পি এরিকের আঁকা, লাল রঙে দাড়িওলা কনটিকির মুখ। তিয়াহুয়ানাকোর শহরের ভগ্নস্তূপের মধ্যে লাল পাথরে তৈরি সূর্য-রাজার মাথার ভাষ্কর্যের অবিকল প্রতিরূপ।
“আহ, সেনর ড্যানিয়েলসন,” ডকইয়ার্ডের কর্মী-সর্দার দাড়িয়ালা মুখটা পালের ওপর দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।
ও বেঙ্গটকে শেষ দু’মাস সেনর কনটিকি বলে ডাকছিল, যবে থেকে ওকে কনটিকির দাড়িওলা মুখের ছবি দেখিয়েছিলাম। কিন্তু এখন, যা হোক, ও বুঝতে পেরেছে যে বেঙ্গটের আসল নাম ড্যানিয়েলসন।
ভেসে পড়বার আগে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নিলাম, তারপর কিছুটা দূর ব্ল্যাক মাউন্টেনের দিকে চললাম, অন্তহীন সমুদ্রে ভেসে পড়ার আগে শক্ত পাথর আর নুড়ির ওপরে একটু হেঁটে চলে আসতে।
আমরা যখন সমুদ্রের পাড়ে ভেলা বানাচ্ছিলাম তখন লিমার বাইরের পাম-বাগানে একটা বোর্ডিং হাউসে থাকতাম। ওখান থেকে কাল্লাও যাতায়াত করতাম বিমান-মন্ত্রকের একটা গাড়িতে, তার ড্রাইভারকে আবার গেয়ার্ড অভিযানের জন্যই মতলব খাটিয়ে জোগাড় করেছিল। এই ড্রাইভারকে এবারে আমরা বললাম, একদিনে যতখানি যাওয়া সম্ভব ততটা পাহাড়ের দিকে গাড়িটা নিয়ে চলো। ধূ ধূ রাস্তা ধরে, ইনকাদের সময় থেকে তৈরি হওয়া সেচের খাল-এর পাশ দিয়ে আমরা আমাদের ভেলার মাস্তুল ছাড়িয়ে প্রায় মাথা ঝিমঝিম ১২০০০ ফুট ওপরে এসে গেলাম। এখানে স্রেফ দুচোখ ভরে পাথর, পাহাড়চূড়া, সবুজ ঘাস দেখতে থাকলাম আর আমাদের সামনে ছড়িয়ে থাকা আন্দিজের নিস্তব্ধ পাহাড়ি নির্জনতা বুভুক্ষুর মতো গিলে নিচ্ছিলাম। আমরা নিজেদের বোঝাচ্ছিলাম যে পাথর, স্থলভাগ, পৃথিবীর মাটি দেখে দেখে দেহে মনে ক্লান্ত, এবারে আমরা ভেসে পড়তে চাই, সমুদ্রকে জানতে চাই।
ক্রমশ