কন-টিকি অভিযান-আগের পর্বগুলো
থর হেয়ারডাল। (অনুবাদঃ ইন্দ্রনাথ)
আগের কথা
সমুদ্র আর তার আবহাওয়ার সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছে কনটিকি আর তার অভিযাত্রীরা। ভেলায় যে যার নির্দিষ্ট দায়িত্বপালনে ব্যস্ত। বাণিজ্যবায়ু কনটিকিকে নিয়ে চলেছে পলিনেশীয়ার দিকে। কেউ না কেউ দাঁড়ে রয়েছে সর্বক্ষণ। কারো দায়িত্বে আবহাওয়ার খুঁটিনাটি মাপার যন্ত্র। রেডিও সচল রাখতে তৎপর দুজন। প্রতি রাত্রে পালা খবরাখবর আর আবহাওয়ার বিবরণ বেতার সংকেতে পাঠানো হত যাতে হ্যাম রেডিওতে কেউ সেটা ধরতে পেয়ে চালান করতে পারে বাইরের পৃথিবীতে। এছাড়া রান্নাবান্না, ভেলার দেখভাল এসব কাজ তো আছেই। পালা করেই সারা হত সেগুলো। উড়ুক্কু মাছের সরবরাহ বেশি হওয়ায় খাবারের মধ্যে সেটা তো ছিলই এছাড়া পঞ্চম শতাব্দীর পলিনেশীয়দের মতো খাবার দাবারের সম্ভারও ছিল ভেলাতে। আধুনিক আর প্রাচীন দুইয়ের মিশেলে খাবারের তালিকা ভাগ করা ছিল। মুশকিল হয়েছিল খাবার দাবারের কার্ডবোর্ডের বাইরে পিচের আস্তরণ দিয়ে যেগুলো সিল করা ছিল সেগুলো বাদে বাকি বাক্সে জল ঢুকে অনেক খাবার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাতে অবশ্য কনটিকির অভিযাত্রীদের খাবারের অভাব হয়নি। খাবার জলের ব্যাপারেও তাই। সমুদ্রের নোনা জল একটু মিশিয়ে নিলে যে তেষ্টা তাড়াতাড়ি মেটে সেটা অভিযাত্রীরা কনটিকিতেই টের পেল। সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল নারকেল, লাউ, কুমড়ো জাতীয় অনেক ফল। এছাড়া কাঁকড়া, প্ল্যাঙ্কটন,ডলফিন, গেঁড়ি গুগলি এসব তো ছিলই। ভেলায় বাসা বেঁধেছিল একটি ছোট্ট কাঁকড়া। ওরা তার নাম দিয়েছিলেন জোহান্স। অভিযাত্রীরা এবার তিমির ঝাঁকের পাল্লায় পড়লেন। কিন্তু আশ্চর্য এই যে তিমিশিকারীদের ওপর আক্রমনের যত গল্প ওরা শুনেছিলেন বাস্তবে ওদের সাথে সেসব কিছুই ঘটেনি। বরং চারপাশে তিমির ঝাঁক আপন মনে ঘোরাঘুরি করে নিজে থেকেই চলে গিয়েছিল। ডলফিনদের ব্যাপারে আশ্চর্য সব অভিজ্ঞতা হল অভিযাত্রীদের। উড়ুক্কু মাছ খুব প্রিয় ডলফিনদের। উড়ুক্কু মাছের টোপ দিয়েই ওরা ডলফিন শিকারও করতেন। আর শিকার করতে হত হাঙর। সেটা খুবই কঠিন ব্যাপার ছিল। হারপুন দিয়েও বাগে আনা যেত না। শেষ অবধি একাধিক মাছ ধরার বঁড়শিতে ডলফিনের টোপ দিয়ে হাঙর শিকার শুরু করলেন ওরা।
(১৩)
মাঝপথে
ভেলার পাশ থেকে নীচু হয়ে ঝকঝকে পরিষ্কার সমুদ্রের জলে মুখ ডুবিয়ে ভেলার তলার দিকটা নজর করলে দেখতাম তলাটা যেন সমুদ্র-দানোর পেট। লম্বা দাঁড়টা যেন ওর লেজ আর ভেলার দুদিকের পাটাতন ওর দুটো পাখনার মত ঝুলছে। মাঝখানে যত পাইলট মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে, সাঁতার দিচ্ছে, পাশে যে একটা বুড়বুড়ি কাটা মানুষের মুন্ডু রয়েছে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। এক দুটো মাছ অবশ্য সাঁ করে এসে নাকের কাছে ঘুরঘুর করে আবার নিশ্চিন্তে ফিরে গিয়ে ঝাঁকে গিয়ে সাঁতরাতে লাগল।
আমাদের পাইলট মাছগুলো দুটো দলে সাঁতার দিত। একদল সেন্টারবোর্ডের মাঝ বরাবর। আরেকদল ভেলার সামনে অর্ধচন্দ্রাকারে। খাবারের টুকরো টাকরা জলে ছুঁড়ে ফেললে মাঝে মধ্যে ঝাঁক থেকে বেরিয়ে ছুটে গিয়ে সেসব খেত। এছাড়া যখন খাবারের পর ভেলার পাশে বাসন ধুতাম এত মাছ জড়ো হত যেন মনে হত একবাক্স ডোরাকাটা পাইলট মাছ জলের ওপর উপুড় করে দিয়েছি। একটুকরো খাবারও ছাড়ত না ওরা, শাকসব্জির টুকরোটাকরা না হলে ডুবে যাবার প্রশ্নই নেই। ভেলার পাটাতনের নীচে এই অদ্ভূত মাছগুলো জড়াজড়ি করে বাচ্চাদের মতো থাকত, যেমন হাঙরের সাথে লেপ্টে থাকে; আমাদেরও ওদের ওপর একটা অভিভাবকের মতো বোধ জন্মেছিল। ওরা কনটিকির সামুদ্রিক পোষ্য হয়ে উঠেছিল; আর ভেলাতে এদের ধরা নিষিদ্ধই হয়ে গেছিল।
আমদের সঙ্গের পাইলট মাছের ঝাঁকের সবকটাই ছিল বাচ্চা, চারামাছ, বড়জোর ইঞ্চিখানেক লম্বা, কোনো কোনোটা ছ’ইঞ্চি। এরিকের হারপুন তিমি-হাঙরটার খুলিতে গেঁথে যাবার পর ওটা বিদ্যুৎবেগে পালিয়ে যেতে ওর সাথে থাকা যে পাইলট মাছগুলো অনাথ হয়ে আমাদের সঙ্গে রয়ে গেল সেগুলো ফুট দুয়েক লম্বা ছিল। ক্রমশ এরকম একাধিক জয়লাভের পর কনটিকির সঙ্গে প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশটা মাছের ঝাঁক জুটে গেল; ওদের প্রায় সবাই কনটিকির শান্ত ধীর স্থির গতিটা আর আমাদের প্রতিদিনের ফেলে দেয়া খাবারের টুকরো টাকরা খুব পছন্দ করে ফেলেছিল, ফলে আমাদের সঙ্গে তারাও প্রায় হাজার কিলোমিটার সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চলল।
কিন্তু মাঝে মাঝে ওদের মধ্যে কয়েকটা বিশ্বাসঘাতকতাও করত। একদিন দাঁড়ে বসে আছি, দেখি দূরে দক্ষিণ দিকে সমুদ্রে জল ফুলে উঠেছে আর একঝাঁক ডলফিন তীব্রবেগে রুপোলি টর্পেডোর মতো কনটিকির দিকে ধেয়ে আসছে। সচরাচর যেমন আসে, জল ছিটিয়ে আরাম করে সাঁতরাতে সাঁতরাতে, তেমনটা নয়, পড়িমড়ি করে সাঁতরে আসছে, যতটা না জল দিয়ে তার চেয়ে বেশি বাতাস কেটে। নীল জল ফুলে উঠেছে, সামনে সাদা ফেনা ছিটকে উঠছে, আর তার পেছনে কালো একটা পিঠ জল কেটে এঁকেবেঁকে স্পিডবোটের মতো তাড়া করে আসছে। মরিয়া ডলফিনগুলো দ্রুত জল কেটে ভেলার কাছে এসে ডুব দিল, বাকিরা শয়ে শয়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে একসাথে পুবদিকে সাঁতরে গেল; ভেলার পেছনটা নানান রঙে ঝকমক করতে লাগল। ওদের পেছনে চকচকে পিঠটা জল থেকে একটু উঠেই মসৃণভাবে ডুব দিল ভেলার নীচে আর ডলফিনের ঝাঁকে গিয়ে সবেগে আঘাত করল। একটা নীল হাঙর, প্রায় কুড়ি ফুট লম্বা আর নারকীয় চেহারা। ওটা চলে যাবার পর দেখা গেল আমাদের পাইলট মাছেরাও হাওয়া। বোধকরি সমুদ্রে ওরা কনটিকির চেয়ে বেশি উত্তেজক আরো একজন বীরের সন্ধান পেয়ে গিয়েছিল।
অভিজ্ঞ লোকেরা আমাদের পইপই করে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে সামুদ্রিক জীবটা সম্পর্কে সেটা হল অক্টোপাস। কেননা তারা ভেলার ওপরে উঠেও আসতে পারে। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি হামবোল্ট স্রোতের এলাকার অনেক বিবরণী আর ম্যাগনেসিয়াম ফটোগ্রাফ আমাদের দেখিয়েছিল। এ জায়গাটা অতিকায় অক্টোপাসেদের প্রিয় বাসভূমি আর রাতের অন্ধকারে তারা জলের ওপরের দিকে উঠে আসে। ওগুলোর এমন রাক্ষুসে খিদে যে ওদেরই একটাকে যদি মাংসের টুকরোর সাথে বেঁধে টোপ দেয়া যায় আরেকজন এসে তাকে শুদ্ধুই খেয়ে ফেলবে। ওদের শুঁড়গুলো একটা হাঙরকে পেড়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট, বড়ো তিমির গায়েও বিশ্রি দাগ করে দিতে পারে তারা। শুঁড়গুলোর মধ্যে বাজপাখির মতো ঠোঁট, বাইরে থেকে দেখা যায় না। আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিল, অক্টোপাসেরা অন্ধকারে ভাসতে থাকে, তাদের চোখ ফসফরাসের মত জ্বলে, আর শুঁড়গুলো এত বড়ো যে চাইলে ভেলার প্রতিটা কোনায় পৌঁছে যাবে, ভেলায় ওঠারও প্রয়োজন হবে না। রাত্তিরে ঠান্ডা ঠান্ডা শুঁড়ে গলা পেঁচিয়ে স্লিপিং ব্যাগ থেকে বার করে টেনে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটা আমাদের মোটেও ভালো লাগেনি, তাই সব্বার কাছে একটা করে বড়ো ব্লেডের বাঁকা ধারালো ছুরি রাখা থাকত, যদি শুঁড়ের হাতড়ানিতে ঘুম ভেঙে টেঙে যায় আরকি! রওনা হবার সময় পেরুর সমুদ্র-অভিজ্ঞরা আমাদের একই কথা শুনিয়ে, চার্টে, বিশেষ করে সমুদ্রের সবচেয়ে খারাপ জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছিল, সেটা এই হামবোল্ট স্রোতের এলাকাটাই। আমাদের সবচেয়ে অস্বস্তির বিষয়ও ছিল সেটা।
বহুদিন যাবৎ আমরা স্কুইডের কোনো চিহ্নই দেখিনি, না ভেলায় না সমুদ্রে। কিন্তু একদিন সকালে টের পেলাম, হ্যাঁ এখানকার সমুদ্রের জলে নিশ্চই তেনারা আছেন। সূর্য ওঠার পর ভেলার ওপরে একটা ছোট্ট অক্টোপাস নজরে পড়ল। বাচ্চা, একটা বেড়ালের মতো বড়ো। রাতের বেলা ভেলায় উঠে পড়েছে আর এখন ডেকের ওপরে মরে পড়ে আছে, কেবিনের বাইরে, বাঁশের মধ্যে শুঁড় পেঁচিয়ে। স্কুইডটার চারপাশে ঘন কালো কালির মতো একটা তরল বাঁশের ডেকের ওপরে ছড়ানো। আমরা লগবুকে এক-দুপাতা লিখে রাখলাম কাটলফিশ থেকে তৈরি কালি দিয়ে। কালিটা ইন্ডিয়া ইঙ্কের মতো। মরা স্কুইডটাকে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা হল, ডলফিনগুলো খুশি হবে।
এই সামান্য ঘটনাতেই টের পেলাম ইনি রাতের বড়ো অতিথিদের অগ্রদূত। এই বাচ্চাটাই যদি ভেলায় উঠে আসতে পারে ওর লোলুপ বাপকাকারা তো পারবেই। প্রাচীন অভিযাত্রীরাও নিশ্চই তাদের ভাইকিং জাহাজে চেপে ভাসতে ভাসতে আর সমুদ্রের দেবতার কথা চিন্তা করতে করতে ঠিক এমনটাই ভেবেছিল আমাদের মতো। কিন্তু পরের ঘটনাটা আমাদের বিমূঢ় করে তুলল। একদিন সকালে দেখি একটা ছোটো স্কুইড কেবিনের ছাদের পামগাছের পাতার ওপরে। এটা আমাদের বেশ হতবাক করে দিল। ওটা নিশ্চই বেয়ে বেয়ে ওঠেনি কারণ ছাতের ঠিক মাঝে ঘন কালির দাগ শুধু গোল হয়ে ওটার চারপাশেই। কোনো সামুদ্রিক পাখিও ফেলেনি কেননা ওটা একদম অক্ষত, ঠুকরানোর কোনো চিহ্নই নেই। একটাই সম্ভাবনা, সমুদ্রের ঢেউ ওটাকে ওখানে তুলে নিয়ে ফেলেছে; অথচ রাতপাহারায় যারা ছিল, তারা কেউই অত বড়ো সমুদ্রের ঢেউ ভেলায় আছড়েছে বলে মনে করতে পারল না। বেশ কিছু রাত পরপর কেটে গেল আর আমরা প্রায়শই ভেলার ওপরে ছোটো ছোটো স্কুইড দেখতে পাচ্ছিলাম। সবচেয়ে ছোটোটা হাতের মধ্যমার সমান।
ক্রমশ ভেলার ওপরে সকালবেলা উড়ুক্কু মাছেদের সঙ্গে এক দুটো করে স্কুইড পাওয়া যাচ্ছিল, রাতে সমুদ্র বেশ শান্ত থাকলেও। আর এগুলো ছোট্ট কিন্তু একেবারে কদাকার, আটখানা শুঁড় আর তার সারা গায়ে চোষক-যন্ত্র লাগানো, দুখানা শুঁড় একটু বেশি লম্বা, মাথায় কাঁটার মতো আঁকশি। যদিও বড়ো স্কুইডের ভেলায় ওঠার কোনো লক্ষণ ছিল না। অন্ধকার রাতে জলের ওপর দিয়ে ফসফরাসের মতো জ্বলন্ত চোখ ভেসে যেতে দেখেছি আর একবার কেবল সমুদ্রে বুড়বুড়ি কেটে একটা বড়ো চাকার মতো কিছু বনবন করে বাতাসে পাক দিতে দেখেছি, তখন আমাদের ডলফিনগুলো হুড়োহুড়ি করে পাগলের মতো পালাচ্ছিল। কিন্তু ছোটোরা প্রায়শই রাত-অতিথি হলেও, কেন যে বড়োগুলো ভেলায় ওঠেনি, সেটা আমাদের কাছে ধাঁধাই রয়ে গেল। দুমাস অবধি,– দুমাসে যথেষ্ট অভিজ্ঞতার সঞ্চয়ের আগে অবধি – এর কোনো উত্তর পাইনি, তদ্দিনে এই কুখ্যাত অক্টোপাস এলাকার বাইরে চলে এসেছিলাম।
ছোট স্কুইডগুলো অনবরত ভেলাতে আসত। একদিন রোদঝলমলে সকালের দিকে সবাই দেখলাম একঝাঁক চকচকে কিছু জল থেকে ছিটকে উঠে চারদিকে বৃষ্টির ফোঁটার মতো ছড়িয়ে পড়ছে আর ডলফিনগুলো সেদিকে ধেয়ে যাচ্ছে। প্রথমে আমরা ভেবেছি উড়ুক্কুমাছ, আমাদের ভেলাতে অমন তিন ধরণের মাছ দেখেছি আমরা। কিন্তু কাছাকাছি আসার পর, কোনো কোনোটা ভেলার চার পাঁচ ফুট ওপর দিয়ে যাচ্ছিল, একটা বেঙ্গটের বুকে লেগে থপ করে ডেকের ওপর পড়ল। একটা ছোট্ট স্কুইড। আমরা খুবই অবাক হয়ে গেলাম। একটা ক্যানভাসের ব্যাগে ওটাকে রাখতেই ওটা জল থেকে ছিটকে ওঠার চেষ্টা করল কিন্তু যথেষ্ট গতি না পাওয়ায় জল থেকে কেবল অর্ধেকটা উঠতে পারল।
একথা জানা আছে যে স্কুইড সাধারণত রকেট বাহিত উড়োজাহাজের নীতিতে জলে সাঁতার দেয়। দেহের পাশে একটা বন্ধ নলের মতো অংশে চাপ দিয়ে সমুদ্রের জল পাম্প করে ঢুকিয়ে উলটো দিক দিয়ে প্রচন্ড জোরে বার করে দেয়। শুঁড়গুলো তার পেছনে মাথার ওপরে একসাথে জড়ো হয়ে মাছের মতো সরু লম্বাটে চেহারা নেয়। ওদের দেহের দুপাশে দুটো মাংসল চামড়ার ভাঁজ থাকে জলে এপাশ ওপাশ করবার জন্য অথবা আস্তে আস্তে সাঁতার দেওয়ার জন্য। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, বড়ো মাছেদের খুব প্রিয় খাবার এই অসহায় ছোটো ছোটো স্কুইডরা খাদকের হাত থেকে বাঁচতে উড়ুক্কু মাছেদের মতো বাতাসে লাফ দিয়ে উঠতে পারে। মানুষ তার উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে রকেটের নীতি আবিষ্কার করার বহু আগেই এরা তাকে কাজে লাগিয়ে ফেলেছিল। সমুদ্রের জল পাম্প করে শরীরের ভেতর দিয়ে পাঠিয়ে প্রচন্ড গতিবেগ অর্জন করে জল থেকে ছিটকে উঠে বাতাসে ভাঁজ করা চামড়াটা ডানার মতো মেলে দেয়। শুরুর গতি নিয়ে উড়ুক্কু মাছের মতোই ঢেউয়ের ওপর দিয়ে যতদূর পারে তদ্দূর উড়ে যায়। এরপর থেকে আমরা মনোযোগ দিয়ে দেখেছি ওরা পঞ্চাশ ষাট গজ অবধি বাতাসে ভেসে যেতে পারে, এককভাবে বা দুটো তিনটে একসাথে। আমরা যত প্রাণীবিজ্ঞানীর সাথে কথা বলেছি, প্রত্যেকের কাছেই স্কুইডের ওড়ার ব্যাপারটা একেবারেই নতুন।
এর আগে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের লোকেদের অতিথি হিসেবে আমি প্রায়শই স্কুইড খেয়েছি। গলদা চিংড়ি আর ইন্ডিয়া রবারের মেশানো স্বাদ। কনটিকিতে অবশ্য স্কুইড, খাবার হিসেবে একেবারে শেষ সারিতে পড়ত। ডেকে এসে পড়লে আমরা ওটার বদলে অন্য কিছুর ব্যবস্থা করতাম। স্কুইডটা হুকে বেঁধে জলে ফেলে বড়ো মাছ ধরতাম। এটা টুনি বা বনিটোর মতো বড়ো মাছেদের খুবই প্রিয় খাবার। আর এই বড়ো মাছগুলো আবার আমাদের খাবারের তালিকায় সবার ওপরে। সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে কেবল যে পরিচিত গন্ডির মধ্যেই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হল তা নয়। ডায়েরিতে এমন অনেক নথি লেখা রয়েছে।
১১/৫ – ভেলার পাশে বসে রাতের খাবার খাচ্ছি একটা বিরাট সামুদ্রিক প্রাণী দুবার ভেসে উঠল আমাদের পাশে পাশে। রীতিমতো ভয় পাওয়ানোর মতো জল ছিটিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল সেটা। ওটা যে কী ছিল কোনো ধারণাই নেই আমাদের।
৬/৬ – হারম্যান একটা মোটকা সোটকা গাঢ় রঙের মাছ দেখেছে। চওড়া সাদা রঙের গা, পাতলা লেজ, কাঁটাওয়ালা। ভেলার ডান দিকে একাধিকবার জল থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠেছে।
১৬/৬ –ভেলার বাঁদিকে মাঝামাঝি একটা অদ্ভুত মাছ দেখা গেছে। ছ’ফুট লম্বা, সবচেয়ে চওড়া অংশটা এক ফুট; লম্বা, বাদামি রঙ, সরু মুখ, মাথার কাছে বড়ো পিঠ-পাখনা, পিঠের মাঝামাঝি আরেকটা ছোটো পাখনা, লেজখানা ভারি এবং কাঁচির মতো। জলের ওপরের তলের কাছেই মাঝে মাঝে ইলমাছের মতো পাক খেয়ে খেয়ে সাঁতার দিচ্ছিল। আমি আর হারম্যান একটা হাত-হারপুন নিয়ে রাবারের ডিঙিতে করে এগোতেই ওটা ডুব দিল। আবার উঠেছিল কিন্তু ফের ডুব দিয়ে মিলিয়ে গেল।
পরদিন – এরিক মাস্তুলে বসেছিল। বারোটা নাগাদ। ও দেখল তিরিশ চল্লিশটা লম্বা, রোগা, একেবারে আগের দিনের মতো দেখতে বাদামি রঙের মাছের ঝাঁক। এবারে তারা বাঁদিক থেকে তীব্র বেগে এসে পেছনের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। যেন একটা বড়ো বাদামি রঙের ছায়া সমুদ্রে মিলিয়ে গেল।
১৮/৬ – ন্যুট খেয়াল করেছে একটা সাপের মতো জীব, দুই থেকে তিন ফুট লম্বা আর পাতলা, জলের মধ্যে সোজা ওপর নীচ করতে করতে নীচের দিকে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেল।
বহুবার এরকম হয়েছে একটা ঘরের মেঝের মতো বড়ো গাঢ় অন্ধকার বস্তুর ওপর দিয়ে ভেসে ভেসে চলেছি, জিনিসটা জলের নীচে পাহাড়ের মতো স্থির হয়ে থেকেছে। মনে হয় ওটা কুখ্যাত দৈত্যাকার স্টিং-রে ছিল, কিন্তু ওটাকে নড়াচড়া করতে দেখিনি আর আমরাও খুব কাছ থেকে না দেখায় ওটার আকার সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারিনি।
এতসব ঘটনা ঘটার কারণে সাগরে থাকার দিনগুলো কখনোই খুব একটা মন্থর ছিল না। জলে ডুব দিয়ে ভেলার দড়িগুলো পরীক্ষা করার কাজটা তো আরো মজাদার ছিল। একদিন হল কী, মাঝের একটা পাটাতন ভেঙে ভেলার তলায়, দড়িতে আটকে, ঝুলতে লাগল; আমরা ওপর থেকে নাগাল পেলাম না। হারম্যান আর ন্যুট ছিল সবচেয়ে দক্ষ ডুবুরি। হারম্যান দু’দুবার ডুব দিয়ে ভেলার তলায় ডলফিন আর পাইলট মাছেদের মাঝে চিত হয়ে বোর্ডটা টানা হ্যাঁচড়া করল। দ্বিতীয়বার জল থেকে উঠে ও ভেলার কিনারে বসে সবে দম নিচ্ছে, এমন সময় একটা আট ফুট লম্বা হাঙর দেখা গেল, ওর পা থেকে দশ ফুট দূরেও হবে না, সোজা জলের তলা থেকে ওর পা লক্ষ করেই আসছে। হাঙরটার প্রতি আমরা হয়তো অবিচারই করেছিলাম, ওর মতলবটা বুঝতে পেরে আমরা ওর মাথায় একটা হারপুন গেঁথে দিয়েছিলাম। হাঙরটা ভয়ানক রেগে গেল, শেষমেশ খুব একচোট ঝটাপটির পর জলের ওপরে তেলতেলে একটা আস্তরণ ছেড়ে সেটা হাওয়া হয়ে গেল। পাটাতনটার কিছুই সমাধান হল না, দড়িতে আটকে অমনিই ঝুলতে লাগল ভেলার তলায়।
তখন এরিক একটা ডাইভিং বাস্কেট বানানোর পরামর্শ দিল। বিশেষ কিছু উপাদান অবশ্য আমাদের কাছে ছিল না, কিন্তু বাঁশ, দড়ি আর একটা পুরোনো সস্তা নারকেল রাখার ঝুড়ি ছিল সঙ্গে। ঝুড়ির ওপরের দিকটা লম্বা করে বাঁশ আটকে দড়ির বুনট দিয়ে বেঁধে দেয়া হল। এবারে ঝুড়িতে করে ভেলার পাশ দিয়ে একে একে নামলেই হল। পাটা ঝুড়ির মধ্যে সুরক্ষিত থাকবে, কিন্তু তার ওপরের অংশে দড়ির জালটা আমাদের আর মাছেদের মধ্যে একটা মানসিক বাধামাত্র হলেও, তেমন তেমন অবস্থায় হঠাৎ কোনোকিছু তেড়ে এলে নীচু হয়ে বসে পড়লেই হল, বাকিরা ভেলা থেকে টেনে জলের ওপরে তুলে নেবে ঝুড়িটা।
ডাইভিং বাস্কেটটা শুধু যে কাজেরই হল তাই নয় ক্রমশ ভেলায় আমোদের জন্য একটা জুৎসই জিনিসও হল। ভেলার নীচে ভাসমান অ্যাকোরিয়াম পর্যবেক্ষণের জন্য খুব সুবিধে হল।
সমুদ্র শান্ত আর হালকা ঢেউ থাকলে আমরা ঝুড়িতে চেপে একে একে জলে নামতাম যতক্ষণ দম থাকত। জলের নীচে অদ্ভূত আবছা ছায়াহীন একটা আলোর স্রোত। জলের নীচে আলো কোনো একটা নির্দিষ্ট দিক থেকে আসে না, যেমনটা আমাদের জলের ওপরের পৃথিবীতে ঘটে। প্রতিসরিত আলো যেমন জলের ওপর থেকে তেমনি জলের নীচ থেকেও আসে। সূর্যের উজ্জ্বলতা নেই, সবদিকেই তার আলো রয়েছে একইরকম। ভেলার তলা থেকে ওপরের দিকে তাকালে, পুরোটা খুব উজ্জ্বল লাগত, ন’টা বড়ো বড়ো লগ, দড়ির বাঁধন, এক আশ্চর্য জাদু আলোয় স্নান করেছে যেন, ফাঁকে ফাঁকে কচি কলাপাতা রঙের সামুদ্রিক শ্যাওলা ভেলার চারপাশে, গোটা দাঁড়টাও ঢেকে আছে তাতে। পাইলট মাছেরা সার বেঁধে সাঁতরাচ্ছে, মাছেদের দলে জেব্রার মতো। বড়ো ডলফিনরা সাঁতার দিচ্ছে গোল হয়ে, সতর্ক, ছটফটে, ঝাঁকি দিয়ে ঘুরছে ফিরছে শিকারের আশায়। পাটাতনের ফাঁক দিয়ে, যেখানে রসাল রেড উড একটু ঝুলে পড়েছে নীচের দিকে সেখানে আলো এসে পড়েছে; তার ওপর সাদা সাদা গেঁড়ি গুগলি বাসা বেঁধে আছে, হলদে নরম অংশটা খোলার বাইরে উঠছে নামছে অক্সিজেন আর খাবারের সন্ধানে। কেউ কাছাকাছি চলে এলেই তড়িঘড়ি লাল আর হলদে খোলার মধ্যে গুটিয়ে বন্ধ করে নিচ্ছে নিজেদের যতক্ষণ না বিপদ কেটেছে বলে মনে করে।
ভেলার নীচে আলোটা চমৎকার আর আরামদায়ক, বিশেষত ভেলার ওপরের নিরক্ষীয় সূর্যের তাপের তুলনায়। এমনকী যখন অতল সমুদ্রের গভীরতার দিকেও তাকাচ্ছি, যেখানে চিরকালীন অন্ধকার রাত্রি, সেই আঁধারও সূর্যের প্রতিসরিত আলোয় আমাদের কাছে উজ্জ্বল নীলাভ রঙের লাগত। আমাদের আশ্চর্য লাগত, একটুখানি জলের তলাতে গেলেই স্বচ্ছ পরিষ্কার নীলের মধ্যে অনেক গভীরে থাকা মাছও আমরা দেখতে পেতাম। অত গভীরে ওগুলো বনিটো হবে হয়তো কিংবা অন্য কোনো ধরণের মাছ, আমরা ঠাহর করতে পারিনি। কখনো কখনো ওরা বিরাট ঝাঁকে থাকত মনে হত গোটা সমুদ্রের স্রোতটাই বুঝি মাছে ভর্তি অথবা ওরা কনটিকির নীচে একজোট হয়েছে আমাদের খানিকটা সঙ্গ দেবে বলে।
জলের নীচে আমাদের সবচেয়ে আহ্লাদ হত সোনালি পাখনার টুনি মাছগুলো এলে। মাঝে মাঝে ভেলার কাছে ওরা ঝাঁক বেঁধে আসত, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই দুটো তিনটে একসঙ্গে এসে আমাদের চারপাশ ঘিরে সাঁতরাতো আর অনেকদিন অবধি থেকে যেত যদি না বঁড়শিতে গাঁথা পড়ত। ভেলার ওপর থেকে ওগুলোকে স্রেফ বড়ো বাদামি রঙের মোটাসোটা মাছ ছাড়া তেমন কিছু আহামরি লাগত না, কিন্তু নিঃশব্দে জলের নীচে ওদের কাছাকাছি হলে ওদের রঙ আর আকার দুইই বদলে যেত। বদলটা এমন হতভম্ব করা যে মাঝে মাঝে আমরা জল থেকে উঠে এসে ভালো করে আরেকবার খেয়াল করে দেখতাম যে জলের নীচে ওই মাছটাকেই দেখেছি কি না। ওরা অবশ্য আমাদের তেমন একটা পাত্তাটাত্তা দিত না, নিজেদের খেয়ালে সাঁতরে বেড়াত, কিন্তু ক্রমে তাদের মধ্যে এমন আশ্চর্য লালিত্য দেখা দিল, যে, কোনো মাছের মধ্যে আমরা তা দেখতে পাইনি। রঙটাও বদলে হালকা বেগনি রঙে ছাওয়া ধাতব রঙের হল। চকচকে ইস্পাত ও রুপো রঙের টর্পেডোর মতো, নিখুঁত অঙ্গসৌষ্ঠব, একটা বা দুটো পাখনা সামান্য নাড়িয়েই, ১৫০ – ২০০ পাউন্ডের ভারী শরীরটা অনায়াসে জলের মধ্যে অনবদ্য ভঙ্গীতে সাঁতরাত।
সমুদ্রের আর তার অধিবাসীদের যত কাছাকাছি আসছিলাম অচেনার ভাব ততই কেটে যাচ্ছিল আর আমরাও বেশ স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠছিলাম। প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকা প্রাচীন মানুষদের শ্রদ্ধা করতে শিখছিলাম এবং সম্পুর্ণ আলাদা দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিষয়টা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সঞ্চয়ও হচ্ছিল। এটা সত্যি যে আমরা টুনি মাছ আর ডলফিনের মধ্যে লবনের পরিমান হিসাব করে ওদের ল্যাটিন নাম দিয়েছি। প্রাচীনেরা এতশত করেনি। কিন্তু তা সত্বেও বলতে বাধ্য হচ্ছি সমুদ্রের যে ছবি প্রাচীন মানুষদের কাছে ধরা ছিল তা আমাদের থেকে ঢের সত্যি।
সমুদ্রের এতটা দূরে স্থির চিহ্ন তো তেমন কিছু নেই। ঢেউ আর মাছের দল, সূর্য আর তারা, আসে আর চলে যায়। দক্ষিণ সমুদ্রের দ্বীপপুঞ্জ আর পেরুর মধ্যে ৪৩০০ মাইলের সমুদ্রে কোনো ডাঙা থাকার কথাও নয়। ১০০ ডিগ্রি পশ্চিমে ভেসে চলার সময় প্যাসিফিক চার্টে দেখা গেল আমাদের পথের ওপর সামনেই একটা প্রবাল প্রাচীরের অবস্থান; দেখে আমরা যারপরনাই বিষ্মিত হলাম। ছোট্ট একটা গোল দাগ দেওয়া ছিল চার্টে, আর সেবছরই ওটা ছাপা হয়েছে, ফলে আমরা ‘দক্ষিণ আমেরিকার জলপথ নির্দেশিকা’ খুললাম। তাতে লেখা আছে, “গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের ৬০০ মাইল দক্ষিণপশ্চিমে ৬ ডিগ্রি ৪২ মিনিট দক্ষিণ অক্ষাংশ ও ৯৯ ডিগ্রি ৪৩ মিনিট পশ্চিম দ্রাঘিমাংশ অবস্থানে প্রবাল প্রাচীর আছে বলে জানানো হয়, প্রথম একবার ১৯০৬ সালে, আরেকবার ফের ১৯২৬ সালে। ১৯২৭ সালে একটা স্টিমার এর এক মাইল পশ্চিম দিয়ে যায় কিন্তু এমন প্রাচীরের সন্ধান তারা পায়নি এবং ১৯৩৪ সালে আরো একটা জাহাজ এর এক মাইল দক্ষিণ দিয়ে যায় তারাও এ প্রাচীরের কোনো চিহ্ন দেখতে পায়নি। ১৯৩৪ সালে ‘কোরি’ নামের একটা জলযান এই অংশে ১৬০ ফ্যাদম গভীর অবধি কোনো তল খুঁজে পায়নি।”
চার্ট অনুযায়ী জায়গাটা জাহাজ চলাচলের জন্য সুবিধের নয় কিন্তু একটা বড়ো জাহাজের ডুবো পাহাড়ের কাছে যেতে যতটা ভয়ের আমাদের ভেলার তো তা নয়, তাই আমরা সোজা চার্টে দেখান ওই বিন্দু লক্ষ্য করেই ভেলার মুখ ঘুরিয়ে দিলাম, দেখাই যাক না কী আছে, এই ভেবে। আমরা যে বিন্দুর দিকে ভেলা তাক করেছিলাম প্রবাল প্রাচীরটা তার খানিকটা উত্তরে চিহ্ন করা ছিল। আমরা দাঁড়টা তুলে নিয়ে চওড়া পালটা খানিক গুটিয়ে রাখলাম। ভেলার মুখটা মোটামুটি উত্তরদিক হয়ে রইল। ঢেউ আর সমুদ্রের বাতাস এবার ভেলার ডানপাশ থেকে এসে লাগল। এইবারে এদ্দিন যতটা অভ্যস্ত ছিলাম তার চেয়ে একটু বেশিই প্রশান্ত মহাসাগরীয় ঢেউ এসে আমাদের স্লিপিং ব্যাগ ভেজাতে লাগল আর আবহাওয়াটাও ক্রমে অনেকটা সতেজ হয়ে উঠল। কনটিকিকে সহজেই এবং অনায়াসেই নিশ্চিতভাবে হাওয়ার দিকে তেরছা করে নিয়ে চালানো যাচ্ছে দেখে অবশ্য আশ্বস্তই হলাম, অন্তত যতক্ষণ পালে বাতাস আছে। নইলে বাতাসের পাল্লায় পাল এমন ফুলে ফেঁপে যেত যে আবার ভেলা সামলাতে পাগল হবার যোগাড় হত।
দু’দিন দু’রাত ভেলাটাকে উত্তর-উত্তরপশ্চিমদিকে বেয়ে চললাম। বাণিজ্যবায়ু দক্ষিণপূর্ব আর পূর্ব দিকের মধ্যে ক্রমাগত এপাশ ওপাশ করছিল বলে সমুদ্র বেশ উত্তাল, হিসেব মেলাতে পারছিলাম না। অথচ ধেয়ে আসা সমস্ত ঢেউগুলোর ওপর দিয়েই ওপর-নীচ করে ঠিক ভেসে চলছিলাম আমরা। মাস্তুলের ওপর থেকে ক্রমাগত নজরদারী চলছিল, ওপর থেকে দিগন্তরেখাও আরো প্রসারিত লাগছিল। ঢেউগুলোর উচ্চতা বাঁশের কেবিনঘরের মাথা ছাড়িয়ে আরো ছ’ফুট উচ্চতায় উঠছিল, আর দুটো ঢেউ পরপর এসে গেলে আরো উঁচু হয়ে শোঁ শোঁ করে এসে যেদিক সেদিক ভেঙে পড়ছিল। রাত্রি হলে আমরা কেবিনের দরজার সামনে প্যাকিং বাক্স দিয়ে আড়াল দিলাম কিন্তু সারা রাত্রি ভিজে ভিজেই বিশ্রাম নিতে হল। চোখ লেগে এসেছে কি আসেনি বাঁশের দেয়ালে এসে প্রথম ঢেউটা আছড়ে পড়ল, আর ফাঁকফোকর দিয়ে হাজার হাজার জলকণা ফোয়ারার মতো ছিটকে এল, রাশি রাশি জলস্রোত আমাদের আর রসদের ওপর দিয়ে হুড়মুড় করে বয়ে গেল।
মেঝে থেকে একটু উঁচু হয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে আসা জলটা মেঝের ফাঁক দিয়ে চলে যেতে দিতে দিতে শুনলাম ঘুমজড়ানো একটা গলা,‘প্লাম্বারকে ফোন করো।’ বলা বাহুল্য প্লাম্বার আসেনি আর সে রাতে আমরা চুপচুপে ভিজে বিছানাতেই কাটালাম। হারম্যানের পাহারার সময়ে একটা বড়ো ডলফিন অনিচ্ছাকৃতভাবেই ভেলায় উঠেও এসেছিল।
পরেরদিন সমুদ্র অনেকটা কম বিশৃঙ্খল। বাণিজ্যবায়ু তখন মোটামুটিভাবে ঠিক করেছে কিছু সময় ধরে পুব দিক থেকেই বইবে। আমরা পালা করে মাস্তুলে বসছিলাম, আন্দাজ করছিলাম, যে বিন্দুতে পৌঁছনোর কথা সেখানে বিকেল বিকেল নাগাদ আমরা পৌঁছে যাব। সেদিন সমুদ্রে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি প্রাণী দেখতে পাচ্ছিলাম। হতে পারে আমরা অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি নজর করছিলাম তখন।
সকালের দিকে দেখি একটা বড়ো তলোয়ারমাছ ভেলার দিকে আসছে, প্রায় জলের ওপরে। ছ দুটো চোখা পাখনা, ছফুট তফাতে জলের ওপরে জেগে আর মাছটার মাথার চোখা তলোয়ারটা প্রায় দেহের সমান লম্বা। হালে বসা লোকটার খুব কাছে এসে বাঁক খেয়ে মাছটা ঢেউয়ের পেছনে ডুব দিল। দুপুরে যখন লোনা জলে ভিজে ভিজেই খাবার খাচ্ছি, বড়ো একটা ঢেউ আমাদের নাকের ডগায় খোলা, মাথা আর ছড়ানো পাখনা সহ একটা বড় কচ্ছপ ঠেলে তুলল। ওই ঢেউটা সরে গিয়ে আরো দুটো ঢেউ পত পর ওঠার মধ্যেই কচ্ছপটা আর নেই, যেমন হঠাৎ এসেছিল অমনিই হাওয়া। এবারও শক্ত খোলার কচ্ছপটার নীচে জলের তলায় চকচকে সবজেটে সাদা পেটের ডলফিনদের খলবল করতে দেখলাম। জায়গাটা অস্বাভাবিকরকম বেশি ইঞ্চিখানেক লম্বা ছোটো ছোটো উড়ুক্কু মাছে ভর্তি, ঝাঁকে ঝাঁকে সাঁতার দিতে দিতে কখনো ভেলাতেও উঠে আসছে। একটা শঙ্খচিল দেখলাম, আর মাঝেমাঝেই ফ্রিগেট (একধরণের নিরক্ষীয় অঞ্চলের সামুদ্রিক পাখি), বড়ো সোয়ালো পাখির মতো চেরা লেজ নিয়ে ভেলার ওপরে চক্কর কাটছে। ফ্রিগেট মানেই কাছাকাছি ডাঙা থাকার চিহ্ন, ভেলার লোকজন খুব আশান্বিত হল।
“সম্ভবত ওখানে প্রবালপ্রাচীর অথবা বেলাভূমি আছে, একই ব্যাপার অবশ্য।” আমাদের মধ্যেই কেউ ভাবল। সবচেয়ে আশাবাদিটি বললেন “মনে করো ছোট্টো সবুজ ঘাসে ছাওয়া একটা দ্বীপ পেলাম, আগে এত কম লোক এসেছে এদিকে কেউ হয়তো ঠিকঠাক জানেই না। তাহলে আমরা একটা নতুন দ্বীপ আবিষ্কার করব – কনটিকি দ্বীপ।”
রান্না করার বাক্সটার ওপর দাঁড়িয়ে সেক্সট্যান্টে চোখ লাগিয়ে দুপুর থেকেই এরিক আরো সতর্ক হয়ে উঠল। সন্ধে ছটা কুড়ি নাগাদ ও আমাদের অবস্থান ঘোষণা করল, ৬ ডিগ্রি ৪২ মিনিট দক্ষিণ অক্ষাংশ ও ৯৯ ডিগ্রি ৪২ মিনিট পশ্চিম দ্রাঘিমাংশ। চার্টে দেখানো প্রবাল প্রাচীরের এক সামুদ্রিক মাইল পূর্বে রয়েছি আমরা। বাঁশের গজ নামিয়ে দেওয়া হল, পাল গুটিয়ে ডেকে। বাতাস এখন পুব দিক থেকে বইছে, ধীরে ধীরে আমাদের সঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে। সূর্য সমুদ্রে টুপ করে ডুবে যেতেই মস্তো চাঁদ উঠল, সমুদ্রের ওপরটা জ্যোৎস্নায় ভেসে গেল, দিগন্ত থেকে দিগন্তে কালো আর রুপোলি রঙে ক্রমাগত ঢেউ খেলতে লাগল। মাস্তুলের ওপর থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চারদিকে ঢেউ ভাঙছে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সমুদ্রতীরে যেমন পর্যায়ক্রমে ঢেউ এসে পড়ে তেমনটা নেই কোত্থাও যাতে বোঝা যেতে পারে প্রবাল প্রাচীর বা ডুবোপাহাড়ের অস্তিত্ব। কেউ ভেতরে নেই, সক্কলে ব্যগ্র হয়ে তাকিয়ে, দু-তিনজন তো উপরে উঠে গেল তক্ষুনি।
নির্দিষ্ট জায়গাটার কেন্দ্র বরাবর পার হতে হতে আমরা নানারকম শব্দ প্রক্ষেপ করছিলাম। যত সীসার তৈরি ভার ছিল মোটা সিল্কের দড়িতে বেঁধে নীচে ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম। দড়িটা পাঁচশো ফ্যাদম লম্বা, আর ভেলা কাত হয়ে থাক বা যেভাবেই ভেসে যাক ভারগুলো সবসময়েই মোটামুটি ৪০০ ফ্যাদম নীচে ঝুলে থাকবে। ওই জায়গাটার পুবে কোনো তল পাইনি, না মাঝ বরাবর, না তার পশ্চিমে। আমরা শেষবারের মতো সমুদ্রের চারপাশটা দেখে নিলাম, আর যখন নিজেরা আশ্বস্ত হলাম যে হ্যাঁ এইবারে ভালোমতো দেখা হয়েছে, আমরা পাল তুলে দিলাম, দাঁড়টা সঠিক জায়গায় জুতে দিলাম আবার। বাতাস আর সমুদ্রের ঢেউ আবার আমাদের ভেলার বাঁদিকে এসে পড়ল।
আমরা আবার আমাদের স্বাভাবিক গতিপথ বরাবর ভেসে চললাম। আগের মতোই ঢেউ বইতে লাগল পেছনের কাঠের গুঁড়িগুলোর ওপর। এবারে আমরা শুকনো অবস্থায় খেতে আর শুতে পারছি, যদিও চারপাশে সমুদ্রের ফোঁসফোসানি আরো কিছুদিন চলল আর বাণিজ্যবায়ুও পুব আর দক্ষিণ-পূর্ব দিকের মধ্যে দোলাচলে থাকল। এই অলীক প্রবাল প্রাচীরের উদ্দেশ্যে ভেলা ভাসানোর সামান্য সময়টাতে আমরা, জাহাজের তলির মতো, ভেলার পাটাতনের কার্যকারিতা উপলব্ধি করেছিলাম। যাত্রাপথে আরো পরে হারম্যান আর ন্যুট যখন ডুব দিয়ে পঞ্চম পাটাতনটা ঠিকঠাক করছিল আমরা ওটার কার্যকারিতা বিষয়ে আরো কিছু জানতে পেরেছিলাম। ইন্ডিয়ানরা এই বিস্মৃত খেলাটাকে ছেড়ে দেবার পর থেকে আর কারো কাছেই বিষয়টা বোধগম্য ছিল না। খাড়া পাটাতনগুলো জাহাজের তলির মতো কাজ করে আর ভেলাকে হাওয়ার সাপেক্ষে একদিকে চলতে সাহায্য করে – সে তো গেল স্বাভাবিক ভেলা বাওয়া। কিন্তু প্রাচীন স্প্যানিয়ার্ডরা যখন বলেছিল, যে ইন্ডিয়ানরা “কোনো কোনো পাটাতন কাঠের ফাঁক দিয়ে উঠিয়ে নামিয়ে” বালসা ভেলাগুলোকে সমুদ্রে, এদিক সেদিক “বাঁক” খাওয়াতে পারে – ব্যাপারটা আমাদের কাছে কেন, যারা যারা ছিল সকলের কাছেই ঠিক ঠিক বোধগম্য হয়নি। পাটাতনগুলো তো সরু কাঠের ফাঁক বরাবর শক্ত করে বাঁধা থাকে, ওটা হালের মতো কী করে ব্যবহার হবে!
আমরা রহস্যটা ভেদ করলাম এই মতো – বাতাস মোটামুটি সুস্থির হয়েছে, সমুদ্দুরও শান্ত, কয়েকদিন কনটিকি অবিচলভাবে এগোচ্ছে, আমাদের দাঁড় টানতে হয়নি তেমন। আমরা পেছনের দিকের আলগা পাটাতনটা কাঠের ফাঁক দিয়ে একটু নীচে ঠেলে দিলাম, আর এক ঝটকায় কনটিকি পশ্চিম থেকে উত্তরপশ্চিমদিকে কয়েক ডিগ্রি ঘুরে গেল। আর সেদিক বরারবর আবার অবিচল চলতে লাগল। পাটাতনটা আবার তুলে নিতেই ভেলা আবার আগের অভিমুখ বরাবর হয়ে গেল। কিন্তু পাটাতনটা অর্ধেক তুললে ভেলা পুরোনো অভিমুখের দিকে অর্ধেকটা ঘুরছে। স্রেফ পাটাতনটা ঠেলে নামিয়ে এবং তুলে অভিমুখ বদল সম্ভব হচ্ছে আর দাঁড় না টেনেও সেদিক বরাবরই রাখা যাচ্ছে।
এটাই ছিল ইনকাদের সুদক্ষ পদ্ধতি। ওরা চমৎকার ভারসাম্যের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল যাতে পালে বাতাসের চাপ মাস্তুলটাকে কেন্দ্র করে কার্যকরী হত। ভেলার সামনেটা আর পেছনটা যথাক্রমে মাস্তুলের দুপাশে দুটি হাতের মতো। পেছনের দিকে পাটাতনের ভার বেশি হলে সামনেটা বাতাসের সাথে অবাধে ঘুরবে, আর সামনের দিকে পাটাতনের ভার বেশি হলে পেছনটা বাতাসের সাথে ঘুরবে। মাস্তুলের কাছাকাছি থাকা পাটাতনগুলোর ওপরে অবশ্য এই দুহাতের ঘাত প্রতিঘাতের কোনো প্রভাব থাকত না। বাতাস পেছনদিক থেকে বইলে পাটাতন কোনো কাজে আসত না, তখন দাঁড় বওয়া ছাড়া ভেলার মুখ ঠিক রাখা কার্যত অসম্ভব হত। আড়াআড়িভাবে থাকলে ভেলা খুবই আস্তে আস্তে ভেসে চলত। আমাদের কেবিনের দরজার মুখ আর যেখানে বসে আমরা খাবার খেতাম, দুটোই ছিল ভেলার স্টারবোর্ড অর্থাৎ ডানপাশে সামনের দিকে আর ঢেউ এসে পড়ত পোর্ট সাইডে মানে বাঁদিকটাতে।
দাঁড়ের লোকটা সেদিকের কাঠের ফাঁক দিয়ে পাটাতন উঠিয়ে নামিয়ে নিলে অনায়াসেই ভেলাটা ডাঁয়ে বাঁয়ে চালনা করা যেত, অত কসরৎ করে দাঁড় টানাটানি করার দরকার হত না। কিন্তু তদ্দিনে আমরা দাঁড়েই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই খাড়া পাটাতনগুলো তার প্রয়োজনীয় অবস্থানে রেখে একটা মোটামুটি অভিমুখ নির্দিষ্ট করার পর দাঁড়ের সাহায্যে বাকি কাজটা করাই সাব্যস্ত করলাম।
আমাদের সমুদ্রযাত্রার পরের ধাপটা ছিল অজানা, অদৃশ্য, ওই ডুবোপাহাড়ের মতোই, যেটাকে শুধু ম্যাপেই দেখানো ছিল। সমুদ্রে তখন আমাদের পঁয়তাল্লিশ নম্বর দিন। ৭৮ ডিগ্রি থেকে ১০৮ ডিগ্রি দ্রাঘিমায় ভেসে এসেছি, তার মানে সামনে প্রথম দ্বীপটিতে পৌঁছনোর জন্য ঠিক অর্ধেক রাস্তা। পুবে দক্ষিণ আমেরিকা ২০০০ মাইল দূরে আর পশ্চিমে পলিনেশীয়াও ঠিক একই দূরত্বে। যেকোনো দিক ধরে, এখান থেকে সবচেয়ে কাছের স্থলভূমি উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জ, আর দক্ষিণে ইস্টার দ্বীপ, অসীম সমুদ্রের মাঝে দুটোই ৫০০ সামুদ্রিক মাইলের বেশি দূরত্বে। আমরা এযাবৎ একটাও জাহাজ দেখতে পাইনি, আর পরেও কখনো দেখিওনি, কারণ প্রশান্ত মহাসাগরে স্বাভাবিক জাহাজ চলাচলের রাস্তা থেকে সরে আমরা অন্য পথে এসেছি।
কিন্তু আমরা সত্যিই এটাকে একটা বিশাল দূরত্ব বলে বুঝতেই পারিনি, কেননা দিগন্তও আমাদের সাথে আপনা থেকেই সরে সরে গেছে, আর আমদের ভাসমান জগৎটা সবসময় একইরকম, উপুড় হয়ে থাকা আকাশের ছাতের নীচে ভেলাটাকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকার থেকেছে। একই তারামন্ডলী রাতের পর রাত এপাশ থেকে ওপাশে ঘুরে ঘুরে গেছে।
ক্রমশ
(রঙিন ছবিগুলো অসলো-র কন টিকি মিউজিয়ামের এগজিবিটের ফটোগ্রাফ-সম্পাঃ