অন্তিম অভিযান আগের পর্বগুলো
১৪ আগস্ট। মাইনাস একুশ মিনিট। মঙ্গল উপনিবেশের পার্থিব হেডকোয়ার্টার।
“ওরা আসছে অ্যাডমিরাল গুপ্ত।”
তাঁর সামনের পর্দার ঠিক কেন্দ্রে একরাশ উজ্জ্বল বিন্দু দেখা দিয়েছে হঠাৎ। বিন্দুগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একটা বিষণ্ণ হাসি খেলে গেল অ্যাডমিরাল বৈশ্বানর গুপ্তের ঠোঁটে। ঠিক দু’ঘন্টা আগে, গ্রহাণু বলয় থেকে হঠাৎ দুটো অতিকায় বিমানবাহী যান প্রকাশ্য মহাকাশে ভেসে আসবার পর থেকেই পাশার দান উলটে গিয়েছিল।
যানগুলোর শক্তি বিচ্ছুরণে বৈদ্যুতিন স্বাক্ষর ছিল না কোনো। সেটা মহাকাশচারণের নিয়মবিরোধী।
গ্রহাণু বলয়ে সদ্য গড়ে তোলা আর্থ শেল্টারগুলোকে এদের পরিচয় জানবার জন্য নির্দেশ পাঠানো শুরু করবার আগেই অবশ্য তাদের রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর নিকট কক্ষপথ থেকে ভেসে আসা একটা ভিডিও ট্রান্সমিশানে।
দীর্ঘ আত্মগোপনের পর হঠাৎ করে পৃথিবীর কক্ষপথে ফের আবির্ভূত হওয়া বিদ্রোহী মঙ্গল উপনিবেশের নেতা অ্যাডমিরাল লালপিওতের সেই ট্রান্সমিশন শুধু তাঁকে উদ্দেশ্য করে ছিল না। সমস্ত প্রচার তরঙ্গে একই সঙ্গে তা ছড়িয়ে দিচ্ছিল একটাই কথা,
“স্বৈরাচারী পার্থিব সরকার মঙ্গল উপনিবেশকে বে-আইনিভাবে দখল করেও মঙ্গল উপনবেশকে ধ্বংস করতে পারেনি। বহু শতাব্দির অবিচারের প্রতিফল হিসেবে ঈশ্বরের রোষ এবার পৃথিবীর ওপর নেমে আসছে। জাতি হিসেবে মানুষের সামান্য অংশই রক্ষা পেয়েছে মঙ্গল উপনিবেশ, গ্রহাণুপুঞ্জ বলয় ও চাঁদের অস্থায়ী শেলটারগুলোতে। আমাদের দুটি বাহক যানে মোট দুশোটি আণবিক ক্ষেপণাস্ত্রে সজ্জিত ফ্রিগেট ক্লাস রণতরী এইবার প্রতিটি উপনিবেশের দিকে তার দখল নেবার জন্য এগিয়ে যাবে। আমরা জানি, পৃথিবীর বিভিন্ন অস্ত্রাগারে আমাদের ধুলো করে দেবার মত অস্ত্রসম্ভার রয়েছে। আমরা জানি, মঙ্গলের পার্থিব উপনিবেশ দূরনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই অস্ত্রদের পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম। কিন্তু মাত্র দু’ঘন্টা সময়ের মধ্যে তারা চাঁদের দিকে এগিয়ে যাওয়া ফ্রিগেটদের ধ্বংস করতে পারলেও মঙ্গল ও গ্রহাণু বলয়ের পার্থিব শেল্টারগুলোর কাছে এসে পৌঁছোতে পারবে না। আমরা এই জায়গাগুলোয় অবশিষ্ট মানুষের একজনকেও ধ্বংস করতে চাই না। কিন্তু পার্থিব সরকার কোনো ধরণের প্রতি আক্রমণ না করলে আমাদের আণবিক মিসাইলগুলো বাধ্য হয়েই…”
নাঃ। এর পরে আর কোনো প্রতিরোধের চেষ্টা করেননি অ্যাডমিরাল বৈশ্বানর গুপ্ত। পৃথিবীকে ঘিরে ক্ষয়শীল কক্ষপথে অন্তিম পাক দিতে থাকা অতিকায় আগুণের গোলাটাই তাঁর সব প্রতিরোধকে শেষ করে দিয়েছিল। আর দু’ঘন্টার মধ্যে ওর ধাক্কায় পৃথিবী থেকে সভ্যতার সব চিহ্ন মুছে যাবে। কয়েক হাজার বছরের জন্য বাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে পৃথিবী। এই উন্মাদ উগ্রপন্থী নিজের জিঘাংসা পরিতৃপ্ত করতে, পৃথিবী থেকে সরিয়ে আনা মানসভ্যতার শেষ আলোর বিন্দুগুলোকে অবহেলায় ধ্বংস করে দিতে পারে। সেটা কোন মূল্যেই হতে দেয়া যায় না। মঙ্গল বা গ্রহাণু বলয়ের প্রতিটি শেল্টারকে ঘিরে যে শক্তিবলয় রয়েছে তা হয়ত এদের আক্রমণকে কয়েক ঘন্টার জন্য রুখে দিতে পারবে। কিন্তু সে-সময়টুকু এই মুহূর্তে যথেষ্ট নয়। সৌরমণ্ডলে সামান্য কিছু মানুষই তো অবশিষ্ট থাকবে আর ঘন্টাদুয়েকের মধ্যে। কী হবে শুধু শুধু তাদের অধিকাংশকে এক জিঘাংসু উন্মাদের শিকার বানিয়ে সভ্যতার কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে!
মাত্রই পাঁচ মিনিট সময় নিয়েছিলে বৈশ্বানর তাঁর সিদ্ধান্ত জানাবার জন্য। নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ।
“আপনার জন্য ট্রান্সমিশন।”
“পর্দায় আনুন।”
পর্দায় দ্রুতবেগে ছুটে আসতে থাকা কুড়িটা ফ্রিগেটের দলটার ছবি মুছে গিয়ে সেখানে জেমস আরিয়ানার মুখটা ভেসে উঠেছে।
“হ্যালো অ্যাডমিরাল।” পরিতৃপ্তির একটা হাসি চিকমিক করছিল আরিয়ানার মুখে, “অ্যাডমিরাল লালপিওতে অন্য কাজে ব্যস্ত আছেন উপস্থিত। যথাসময়ে আপনাকে তিনি ডেকে পাঠাবেন। উপস্থিত তাঁর আদেশ, বিজয়ী যানদের অবতরণের জন্য প্রতিটি শেলটারের প্রতিরক্ষা আবরণ সরিয়ে নেবার আদেশ দিন। এখন থেকে ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় প্রতিটি কেন্দ্রে আমাদের রণতরীরা…”
অপমানটাকে নীরবে হজম করলেন বৈশ্বানর। পাশে বসা কর্নেল ফ্লিন্টের মুখটা রাগে লাল হয়ে উঠছিল। সাধারণত আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে সম-পদমর্যাদার সেনানায়কদের মুখোমুখি হবার কথা। এক্ষেত্রে সম্ভবত ইচ্ছা করেই বৈশ্বানরকে অপমান করবার জন্য অ্যাডমিরাল লালপিওতে তাঁর অধীনস্থ একজন সেনানায়ককে পাঠাচ্ছেন।
কিন্তু তিনি কিছু বলবার আগেই পর্দার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বৈশ্বানর বলে উঠলেন, “আমরা প্রস্তুত আছি ব্যারণ আরিয়ানা।” তারপর ট্রান্সমিশন বন্ধ করে ফ্লিন্টের দিকে ঘুরে তাঁর কাঁধ ধরে মৃদু চাপ দিলেন একবার।
“আপনি…”
“উপায় ছিল না ফ্লিন্ট। এই মুহূর্তে এদের একটা বিমানও যাতে কোনো শেলটারের উদ্দেশে আক্রমণ না শানায় তা নিশ্চিত করবার জন্য যেকোনো অপমান আমি সহ্য করতে রাজি। এই মুহূর্তে ক্ষতির পরিমাণ সর্বনিম্ন রাখাই আমাদের একমাত্র স্ট্র্যাটেজি।”
হতাশ হয়ে মাথা নাড়লেন ফ্লিন্ট, “তাহলে সমস্ত শেলটারের প্রতিরক্ষা বলয়…”
একটা মরীয়া আবেগে ঘন ঘন দুদিকে মাথা নেড়েছিলেন বৈশ্বানর, “না ফ্লিন্ট। এখনই নয়। আরো একুশ মিনিট বাদে। আগে আমি নিজের চোখে আমাদের আশার শেষ বিন্দুটাকেও ধ্বংস হয়ে যেতে দেখতে চাই। তারপর… নাঃ। তারপর আর কোনো প্রতিরোধের কোন অর্থ থাকবে না। পৃথিবীটাই যদি না রইল…”
কঠোর মানুষটার দু’চোখে দু’ফোঁটা জল চিকমিক করছিল। এক ঝলক সেদিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন ফ্লিন্ট। সামনের পর্দায় পৃথিবীর একটা বিবর্ধিত ছবি ভাসছে। তার একেবারে গা ঘেঁষে নড়তে থাকা আগুনের গোলাটা আর একুশ মিনিটের মাথায়…
বুকের ভেতর তাঁরও মোচড় লাগছিল একটা। যুদ্ধ তাঁরও পেশা। মৃত্যু তিনি কম দেখেননি। কিন্তু… শুধু ক্ষমতার লোভে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু ডেকে আনবার মত নারকীয় একটা ষড়যন্ত্র এতদিন ধরে চালিয়ে যেতে পারে যে, তার হাতে মানুষের ভবিষ্যৎ তুলে দিতে…
সামনের নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের দিকে ঝাপসা চোখদুটো মেলে ধরে রেখে মনেমনে তিনি কোনো অলৌকিক শক্তির কাছেই তিনি প্রার্থনা জানাচ্ছিলেন… ঈশ্বর… শুধু একবার… একটা সুযোগ…
***
ঠিক সেই একই প্রার্থনা তখন করে চলেছিল পৃথিবীর অজস্র ভুগর্ভ শেলটারে ইঁদুরের মত লুকিয়ে থাকা কোটি কোটি মানুষ। না। আর কোনো আশা তখন তাদের সামনে নেই। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সর্বশক্তিমান পার্থিব সরকার সকলেই ব্যর্থ হয়েছে। শেলটারগুলোর বড়ো বড়ো পর্দায় তখন পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে চলা উপগ্রহের দল ফুটীয়ে তুলছে কালান্তক ঝড়ে মত ধেয়ে আসা মৃত্যুদূতের ছবিকে। আবহমণ্ডলের প্রথম স্পর্শে তার শরীরে তখন জেগে উঠছিল মৃত্যু-অগ্নির শিখা… সেইদিকে নজর রেখে কোটি কোটি মানুষ তখন তাদের অদেখা, বহুকাল আগে পরিত্যক্ত কোনো অজানা ঈশ্বরের কাছে শেষ প্রার্থনা জানিয়ে চলেছে। একবার… শুধু একবার কোন অলৌকিক পথে যদি…
***
“ঘড়ি দেখ এলেনা।”
“আমি জানি। আয়নমণ্ডল ছুঁতে আর ঠিক আঠারো মিনিট বাকি জিষ্ণু। দশ মিনিটের মধ্যে…”
ফ্রগ লিপারগুলো জলের স্পর্শ পেয়ে নিজে থেকেই চেহারা বদলে নিয়েছে। তাদের প্রসারিত নীচের অংশ থেকে বের হয়ে আসা বাতাসের জেট বিচিত্র কায়দায় ভারসাম্য বজায় রেখে তাদের তিরবেগে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছিল নদীর স্রোতকে উপেক্ষা করে।
সামনে বড়ো হয়ে উঠতে থাকা পাহাড়টার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে দাঁড়িয়েছিল জিষ্ণু।
ঠিক কোথায় ছিল গুহায় ঢোকবার দরজা তা এখন আর তার পক্ষে আর বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু তাদের পরিকল্পনাটা ঠিক মত কার্যকরী হলে…
লাফিয়ে পাড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতে বাঁধা কমিউনিকেটরটাকে চালু করল জিষ্ণু। সেদিকে তাকিয়ে চমকে উঠে এলেনা বাধা দিতে এসেছিল একবার। শঙ্কিত মুখে বলে উঠেছিল, “রেডিও সাইলেন্স বজায় না রাখলে ওরা…”
তার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদু হাসল জিষ্ণু, “আর তার প্রয়োজন হবে না এলেনা। এবার শেষ লড়াই। আর কোনো গোপনীয়তা নয়।” বলতে বলতেই জেগে ওঠা কমিউনিকেটরে কথা বলে উঠল সে, “কো-অর্ডিনেট কা পোন…”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মৃদু একটা কাঁপুনি ছড়িয়ে গেল দুজোড়া ফ্রগ লিপারেই। দূর পাহাড়ের কোনো গোপন জায়গা থেকে ভেসে আসা একটা বেতার সঙ্কেত ফ্রগ লিপারদের যন্ত্রমস্তিষ্কে পাঠিয়ে দিয়েছে গুহামুখের নিখুঁত স্থানাঙ্কের নির্দেশ।
নির্দেশটা পাঠিয়ে দিয়েই তৈরি হলেন কা পোন। বাকি কাজটা ফ্রগ লিপাররা নিজেরাই করে নিতে পারবে। তাঁকে এখন তৈরি হতে হবে অন্য একটা যুদ্ধের জন্য। একটা হিসেব চুকোবার আছে তার। হয়ত নিজে ওদের সঙ্গে গিয়ে নিঃশব্দেই কাজটা সারতে পারতেন তিনি। কিন্তু এই লড়াইটা লড়বার জন্যই তা তিনি করেননি। এত সহজে লালপিওতেকে ছেড়ে দেবেন না তিনি। আর তাই স্থানাঙ্কগুলো ফ্রগ লিপারদের রিসিভারের নীচুশক্তির কম্পাঙ্কে পাঠাবার বদলে সমস্ত কম্পাঙ্কের চ্যানেলেই একসঙ্গে সম্প্রচার করেছেন তিনি।
আকাশের দিকে ক্ষুধিত চোখদুটো তুলে ধরলেন কা পোন। তাঁর কাঁধে উঠে আসা অ্যান্টিক্র্যাফট ক্ষেপনাস্ত্র উৎক্ষেপকের যান্ত্রিক চোখ তখন খুঁজে চলেছে তার শিকারের পারমাণবিক ইঞ্জিনের বিকীরণের স্বাক্ষর।
থরথর করে একবার কেঁপে উঠেই একটা গুঞ্জন উঠল ফ্রগ লিপারদের আণবিক মোটরে। তারপর পাথুরে ঢাল বেয়ে বিদ্যুতবেগে পাহাড়টা বেয়ে উঠে গিয়ে একটা প্রাচীন ধ্বসের সামনে গিয়ে স্থির হল তা।
ধ্বসে পড়ে থাকা পাথরগুলোর দিকে মণিবন্ধে বাঁধা ঘড়িটা এক মুহূর্তের জন্য ঘুরিয়ে ধরে তার গায়ে ভেসে ওঠা রিডিংটা দেখে নিয়ে মুখে একটুকরো হাসি ফুটল জিষ্ণুর। এলেনার দিকে মুখ ঘুরিয়ে সে বলল, “অ্যান্টিম্যাটার সিগনেচার। কা পোন ভুল করে না।”
হাতে উঠে আসা খুদে ব্লাস্টারটা নিয়ে এলেনা শান্ত মুখে বলল, “সরে দাঁড়াও…”
***
নিস্তব্ধ হয়ে গেছে পৃথিবী। একসময় অগণিত বেতার যন্ত্রের তীব্র, কর্কশ শব্দের বন্যা ভেসে আসত তার কক্ষপথে কোনো অল চ্যানেল রিসিভার খোলা রাখলে। অথচ এই মুহূর্তে তা একেবারে শান্ত। নিস্তব্ধ হয়ে গেছে পৃথিবী। মৃত্যুর মুখে এসে দাঁড়িয়ে আর কোনো কিছুই বলবার নেই তাদের।
আর তারপর, হঠাৎ সেখানে একটা ছোট্ট সঙ্কেত ভেসে উঠল। চমকে উঠে একবার পর্দায় ভেসে ওঠা সঙ্কেতগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলেন তিনি। একটা স্থানাঙ্ক। তাঁর পরিচিত। বহুকাল আগে, ওই অরণ্যের বুকে একবার… আজ, সাফল্যের একেবারে তুঙ্গমুহূর্তে পৌঁছোবার মাত্রই কয়েকটা মিনিট আগে ভেত প্রেতাত্মার মত তা জেগে উঠেছে তাঁর মণিটরে।
হঠাৎ সামনের নিয়ন্ত্রক কমপিউটারের রিসিভারের দিকে হাতের একটা ইশারা করলেন লালপিওতে। ছোট্ট যানটা হঠাৎ তার মুখ ঘুরিয়ে ধরেছে পৃথিবীর দিকে। আণবিক ইঞ্জিন পূর্ণশক্তিতে জেগে উঠেছে তার।
“অ্যাডমিরাল… আপনি…”
পাশে বসে থাকা মানুষটার ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে মৃদু হাসলেন লালপিওতে, “প্রাণের চাইতে মিশন অনেক বড়ো হে জওয়ান। আজ মঙ্গল উপনিবেশের জন্য প্রয়োজনে প্রাণ দেব, কিন্তু মিশনকে ব্যর্থ করবার সামান্যত্যম সম্ভাবনাকেও জীবিত রাখতে আমি রাজি নই… কমপিউটার… ভার্টিক্যাল এনট্রি… সম্প্রচারে পাওয়া স্থানাঙ্ক…”
“ভার্টিক্যাল থ্রাস্টার চালু হচ্ছে। নির্দিষ্ট স্থানাঙ্কে ফোর্স ল্যান্ডিং এক মিনিট… উনষাট সেকেন্ড… আটান্ন… সাতান্ন…”
তীব্র বেগে আবহমণ্ডলকে ছিন্নভিন্ন করে ধেয়ে যেতে থাকা যানটাকে ঘিরে আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলে উঠল…
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ভুপৃষ্ঠে, সেই স্থানাঙ্কের কয়েকশ মিটার দূরে অপেক্ষায় থাকা এক শিকারির কাঁধের লঞ্চারের ভেতরে জেগে উঠল একটা ছোটো আণবিক মিসাইল। তার সেনসর উর্ধ্বাকাশের বায়ুমণ্ডলে ঢুকে আসতে থাকা শিকারের গন্ধ পেয়েছে।
***
ব্লাস্টার থেকে বের হয়ে আসা চুলের মত সরু আগুনের শিখাটা সামনের পাথরের স্তূপের গায়ে একটা গর্ত কেটে ফেলছিল। কয়েক মুহূর্ত বাদে সেখান থেকে একরাশ উত্তপ্ত পাথর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে তার পেছনে খুলে যাওয়া গোল গর্তটার দিকে ইশারা করে একগাল হাসল সে, “লঞ্চ উইন্ডো এখনো সাত মিনিট দূরে। আশা করি…”
কিন্তু কথাটা শেষ হল না তার। হঠাৎ আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়েছে জিষ্ণু। আর তারপর দ্রুত হাতে ফ্রগ লিপারের গণককে কিছু নির্দেশ দিতে দিতে সে বলে, “অ্যান্টিম্যাটার সিগনেচারের সঙ্গে ফ্রগ লিপারের ডেস্টিনেশন সিকারকে সিনক্রোনাইজ করো এলেনা। সময় নেই আর…”
বলতে বলতেই সচল হয়ে উঠেছে তার ফ্রগ লিপারজোড়া। প্রকাণ্ড একটা লাফে তাকে নিয়ে সামনের পাথরের স্তূপ পেরিয়ে গুহার ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল তারা। তার পেছন পেছন লাফিয়ে ঢুকে যেতে যেতেই এক মুহূর্তের জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে এলেনা দেখেছিল সেখানে স্থির হয়ে জ্বলতে থাকা মৃত্যুদূতের মত ধুমকেতুটার অগ্নিগোলকের পাশ দিয়ে তিরবেগে নেমে আসা আলোর বিন্দুটার দিকে। কাছাকাছি অরণ্য থেকে উঠে আসা একটা আলোর রেখা তখন ছুটে চলেছে বিন্দুটাকে লক্ষ্য করে।
তবে সে নিয়ে তখন আর মাথা ঘামাবার সময় ছিল না তার। ছুটতে ছুটতেই তার হাতের অস্ত্রের একটা তীব্র শক্তির ঝলক গুহার মুখটাকে আঘাত করে খসে পড়া পাথরের স্তূপে ঢেকে দিয়েছে।
তারপর গুহার ভেতরে হারিয়ে যেতে যেতেই তার কানে এসেছিল একটা মৃদু গুমগুম আওয়াজ। থরথর করে কেঁপে উঠেছিল পাহাড়টা সেই শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই। গুহার ফের খুলে যাওয়া মুখটা থেকে ছুটে এসেছিল মৃদু আলোর একটা ঝলক। আর তার পরমুহূর্তেই দূরাগত একটা বিস্ফোরণের শব্দতার কানে এসেছিল। ফ্রগ লিপার ততক্ষণে তাকে পৌঁছে দিয়েছে মাটির অনেক নীচের একটা সুবিশাল ঘরের একেবারে মাঝখানে, একটা পাটাতনের ওপর বসানো একটা নিয়ন্ত্রক প্যানেলের সামনে দাঁড়ানো জিষ্ণুর পাশে। সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের নির্দিষ্ট একটা জায়গায় তখন হাত রেখেছে জিষ্ণু।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গুহার অন্ধকার কেটে গিয়ে ম্লান একটা আলো জ্বলে উঠল। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও তার ফিরে আসা মালিককে চিনতে ভুল করেনি সেখানে অপেক্ষায় থাকা যন্ত্রগণক।
“স্বাগত জিষ্ণু।” প্যানেলের মাথায় ভেসে ওঠা এক হাত লম্বা ত্রিমাত্রিক ছবিটার দিকে তাকিয়ে চোখ জলে ভরে এল জিষ্ণুর।
প্রফেসর বোসের প্রতিবিম্বের মুখে কোনো আবেগের চিহ্ন ছিল না। তিনি তখন বলে চলেছেন, “গণকের যন্ত্রের হিসেব অনুযায়ী আর ঠিক ছ’মিনিট সময় আছে একাঘ্নির লঞ্চ উইন্ডোর। স্থির হয়ে বোসো…”
কথাটা শেষ হবার আগেই মৃদু একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল গোটা পাটাতনটা। তারপর তাদের নিয়ে তা তিরবেগে উঠে চলল গুহার ছাদের দিকে ছোটো একটা ঘরের দিকে।
“কাজটা সরল,” প্রফেসর বোসের প্রতিবিম্ব কথা বলে চলেছিল, “এই ঘরটা তিন ফুট পুরু টাইটানিয়াম অ্যালয় দিয়ে ঢাকা। উৎক্ষেপণের তীব্র আগুণের ঝাপটায় এইখানে তোমরা নিরাপদে থাকবে… তোমার সামনে প্যানেলের কি বোর্ডে এই কোডটা টাইপ করো…
. -.- .- –. …. -. .. –. —
“কী এটা?”
এলেনার প্রশ্নের জবাবে কি বোর্ডে আঙুল ঠেকিয়ে মৃদু হাসল জিষ্ণু, “প্রাচীনতম যান্ত্রিক কোডিং। উনিশ শতকের আবিষ্কার। মর্স কোড। ওর অর্থ “ekaghni go”
***
নেমে আসতে আসতেই কমপিউটার নিয়ন্ত্রিত কামান একটা ঝলক ছুঁড়ে দিয়েছিল নির্দিষ্ট স্থানাঙ্কটাকে লক্ষ করে। পর্দায় ফুটে উঠেছে সদ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া গুহার মুখ থেকে ফের খসে পড়া পাথরের স্তূপ। তার কালো গর্তটার দিকে তিরবেগে ধেয়ে যেতে যেতেই চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠছিল লালপিওতের। এইবার… এত সহজে তিনি…
কিন্তু চিন্তাটা পুরোপুরি শেষ হবার আগেই হঠাৎ একটা তীব্র ধাক্কায় দুলে উঠল তাঁর যানটা। ভারসাম্য হারানো যন্ত্র তার ইঞ্জিনের শক্তি হারিয়েছে জঙ্গল থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে উঠে আসা কোনো অস্ত্রের আঘাতে।
কিছু করবার ছিল না তাঁর। যানের চূড়ান্ত বিপদের মুখে তার যন্ত্রমস্তিষ্ক নিজেই প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়। প্রাচীন অথচ কার্যকরী এই প্রোগ্রামিং যেকোনো আধুনিক যানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আগুন ধরে যাওয়া আহত যানটা থেকে ছিটকে বের হয়ে আসা তাঁদের আসনগুলো আকাশের বুকেই একে একে খুলে ধরছিল ছাতার মত কিছু প্যারাস্যুট। ছোটো ছোটো থ্রাস্টারের নিখুঁত আঘাত আসনগুলোকে নামিয়ে আনছিল পূর্বনির্ধারিত সেই স্থানাঙ্কে হাঁ করে থাকা গুহাটার মুখে।
সেদিকে একনজর তাকিয়ে দেখে একটা তৃপ্তির হাসি হাসলেন কা পোন। তারপর কোমরে আটকানো জেট বেল্টের সুইচে আঙুল ঠেকালেন। তাঁর কানে ভেসে আসছিল বহু নীচে সেই গুহার গভীর থেকে কি বোর্ডে জিষ্ণুর আঙুলের স্ট্রোকগুলোর শব্দ। তার হাতের ট্রানসিভার চালু করে রেখেছে জিষ্ণু। তিরবেগে নিরাপদ দূরত্বে ভেসে যেতে যেতেই মণিবন্ধে বাঁধা যন্ত্রটা মুখের কাছে তুলে ধরলেন তিনি, “বেস্ট অব লাক জিষ্ণু…”
পায়ের নীচে ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠতে থাকা গুহামুখটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিলেন লালপিওতে। আর কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর… ওখানে নেমে এসে… আজ ওর ভেতরে স্বয়ং শয়তান থাকলেও তাকে লালপিওতের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাঁকে…
চিন্তাটা সম্পূর্ণ শেষ করতে পারলেন না তিনি। হঠাৎ পায়ের নীচের গোটা পাহাড়টা কেঁপে উঠল থরথর করে। তারপর তার অতিকায় পাথরের চাঙড়গুলোকে পালকের মত আকাশের দিকে ছিটকে দিয়ে সেখান থেকে মুখ বাড়াল অর্ধচন্দ্র আকারের একটা কুচকুচে কালো দানবিক জিনিস।
মাত্রই ক’টা মুহূর্তের জন্য তাকে দেখেছিলেন লালপিওতে। আর তারপর আগুনের তীব্র একটা ঝলকে তাঁকে ও সেই পাহাড় ও জঙ্গলকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে তাঁর পাশ দিয়ে দূরত্বকে গিলে খেতে খেতে আকাশের দিকে ধেয়ে গেল অতিকায় একাঘ্নি…
***
পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরতে থাকা সমস্ত উপগ্রহগুলো সেই মুহূর্তে সচেতন হয়ে উঠেছিল। উত্তর পূর্ব ভারতের অজ্ঞাত জঙ্গল থেকে হঠাৎ মুখ বের করে ধেয়ে আসা একটা আগুনের রেখা ছুটে চলেছে আয়নমণ্ডল ছুঁতে চলা অতিকায় মৃত্যুদূতেকে লক্ষ্য করে।
ষোলো মাইল ব্যাসার্ধের দানবের তুলনায় তাকে একটা তুচ্ছ পাথরের টুকরোর মতই দেখায়।
তবু, নিছক কৌতুহলবশেই রিমোট সেন্সিং স্যাটেলাইটদের রিসিভারকে তার দিকে ঘুরিয়ে ধরবার নির্দেশ দিয়েছিলেন বৈশ্বানর। আর তারপরেই হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠে দ্রুত নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন তখনও চালু থাকা পার্থিব যুদ্ধকেন্দ্রগুলোতে। প্রতিটি পার্থিব শেল্টারকে লক্ষ্য করে উড়তে থাকা বিদ্রোহী ফ্রিগেটগুলোকে লক্ষ্য করে উৎক্ষেপনের আদেশ। কারণ ততক্ষণে তাঁর যন্ত্রে একটা অবিশ্বাস্য খবর ধরা পড়েছে। যে স্বপ্নের প্রযুক্তি নিয়ে এতকাল কাজ করেও তাকে ছুঁতে পারেননি পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা, সেই অ্যান্টিম্যাটারের একটা এক কিলোগ্রাম পিণ্ড বুকে নিয়ে ছুটে চলেছে ওই তুচ্ছ পাথরের টুকরো…
উপসংহার
“ফ্যান্টাস্টিক!” এলেনা হাসছিল। মনিটরে চলতে থাকা সংঘর্ষের আলোর রোশনাইয়ের ছবিটা তারা একসঙ্গে বসে অন্তত একশোবার দেখেছে এই তিন দিনে। এখনো আকাশের গায়ে রাতের অন্ধকারে ঐ মৃত্যুদূতের টুকরো টাকরা নজরে পড়ে। শ’খানেক স্ক্যাভেঞ্জার স্যাটেলাইট মিলেও এই তিন দিনে তার সমস্ত টুকরোকে ঊর্ধ্ব আবহমণ্ডল থেকে সাফ করে দিতে পারেনি। কিন্তু সে-সব দৃশ্য, সংঘাত মুহূর্তের এই দশ মিনিটব্যপী ছবিটার কাছে একেবারেই তুচ্ছ। অন্তত সাতটা স্যাটেলাইটের রেকর্ড করা ছবি একত্র করে এই মুভিটা এলেনা নিজেই বানিয়েছে।
একপাশে একটা সোফা জুড়ে বসে কা পোন হাসছিলেন তাদের দুজনের দিকে চোখ রেখে। খানিক বাদে হঠাৎ হাতের রিস্টব্যান্ডটায় মৃদু কাঁপুনি উঠতে তাদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে তাতে একটু চাপ দিলেন তিনি। তারপর সামনে বাতাসে ভেসে ওঠা কুকুরটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বল টাইকো।”
“কার্তাং টু রেডি মালিক। মেইল এসেছে।”
“ডেলিভারি?”
“ছাদের ওপর অপেক্ষা করছে।”
“এত তাড়াতাড়ি?” জিষ্ণু হঠাৎ ঘুরে তাকাল তাঁর দিকে।
কা পোন মৃদু হাসলেন, “যথেষ্ট টাকা থাকলে পৃথিবীর এঞ্জিনিয়াররা অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে রে। আর এ তো একটা টাইটান ক্লাস মালবাহি জাঙ্ক। শুধু ফিটিংগুলো যা করবার দরকার ছিল। এবার শুধু টাইকোর প্রোগ্রামটা ওতে ট্রান্সফার করলেই…”
“না কা পোন। আরো ক’টা দিন আমাদের সঙ্গে থেকে একটু বিশ্রাম নিয়ে…”
একটা অট্টহাসির শব্দ উঠে এলেনার বাকি কথাগুলোকে ঢেকে দিল এসে। হাসতে হাসতে উঠে এসে তাদের দুজনকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে কা পোন ছদ্ম রাগে বলছিলেন, “কেন রে? আমি কি বুড়ো হয়েছি ভেবেছিস? এখনো তোদের দুটোকে দুহাতে চেপে ধরে পোকার মত…”
“উফ্। ছাড়ো ছাড়ো শিগগির,” তাঁর বজ্র আলিঙ্গনের মধ্যে ছটফট করছিল জিষ্ণু, “কদিন একটু আমাদের সঙ্গে…”
“তোদের সঙ্গে? অসম্ভব। সারাটাদিন দুটোয় মিলে আলফা বিটা ডেল্টা পাই করছিস, আর লম্বা লম্বা অঙ্ক কষে যাচ্ছিস। তোদের সঙ্গে থাকা আমার পোষাবে না ব্যস।”
“তাহলে যাবে কোথায়? আবার সেই…”
মৃদু হেসে মাথা নাড়োলেন কা পোন, “নাঃ। আর ব্যাবসাপাতি নয়। অনেক তো হল। এবার আমি রিটায়ার করেছি বুঝলি? এখান থেকে বেরিয়ে সোজা ইউরোপা। অনেকদিন ওর সমুদ্রে টারমকের মুখোমুখি হইনি। তারপর সেখান থেকে…”
বলতে বলতেই হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, “তোদের তো অনেক নামডাক হয়েছে। কিন্তু এই বুড়োর একটা কথা মিলিয়ে নিস। আজ থেকে একশো বছর পরে তোদের ওসব সায়েন্স টায়েন্সের কথাবার্তা শুধু বইয়ের পাতাতেই থেকে যাবে। লোকের মনে কী থেকে যাবে জানিস?”
“কী?”
“দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো আতসবাজির খেলাটা দেখিয়েছিল প্রফেসর সত্যব্রত বসুর ছেলে জিষ্ণু আর তার বন্ধু এলেনা মিলে। এই যে ছবিগুলো দেখছিস এখন, এগুলো পৃথিবীর মানুষ কোনোদিন ভুলবে না দেখিস। চলি রে! ভালো থাকিস তোরা। আর মাঝেমাঝে এই বুড়োটার ছেলেমেয়ের আদর খাবার ইচ্ছে হলে…”
তাঁর দু’গালে তখন দু’জোড়া ঠোঁট এসে জুড়ে বসেছে।
শেষ
গ্রাফিক্স্- ইন্দ্রশেখর